জিওনকাঠের পাখি
শিশির বিশ্বাস
তখন কতই বা বয়স ছেলেটার? বড়জোর বছরতিনেক। লেখাপড়ার পাট শুরু হয়নি। মায়ের কাছে মুখে মুখে শেখে অ আ ক
খ, এক দুই। মাসখানেক হল ঠাকুরদা, ঠাকুরমার
কাছে গ্রামের বাড়িতে এসে সে সবও বন্ধ। তবে কেউ জানে না, ছেলেটার
ভিতরে তখন শুরু হয়ে গেছে অন্য আর এক ব্যাপার। প্রকৃতি চেনার পাঠ। কতদিন আগের কথা
এসব। বড়ো-বড়ো চোখদুটো দিয়ে মুখচোরা ছেলেটা চারপাশে তাকাত। নতুন চোখ দিয়ে অবাক হয়ে
দেখত শুধু। কী দারুণ ছিল সেই নতুন দেখা পৃথিবীটা! মস্ত নীল আকাশ। ফসলভরা সবুজ খেত।
কাঁচা ঘাস আর মমতাভরা মাটির গন্ধ। কী খুশির ছিল সেই দিনগুলো! নতুন কিছু দেখলেই
ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত ঠাকুরমার বুকে, ”বড়দি, কী সুন্দর একটা পাখি! ছড়ানো সুন্দর লেজটা কেমন নাচছে দ্যাখো!”
ঠাকুরমাকে বড়দি বলেই ডাকত ছেলেটা। সবাই যে বড়দি বলত তাঁকে। ঠাকুরমা দেখে
বলেছিলেন, “ওটা ডালা-ঘুরুনি
পাখি দাদা। ডালার মতো লেজ মেলে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়।”
অনেক পরে ছেলেটা বই পড়ে জেনেছিল, পাখিটার নাম চাকদোয়েল। কিন্তু সেদিন ঠাকুরমার কাছে শোনা সেই নামটা মিষ্টি
ছিল আরও বেশি। আনন্দে হাততালি দিয়ে বলেছিল, ”বাঃ, কী সুন্দর নাম! আমাকে পাখিটা ধরে দাওনা বড়দি। খাঁচায় পুষব।”
“ওই যে বায়না শুরু হল দাদার। কিন্তু বনের পাখিকে যে খাঁচায় বন্দী করতে নেই
দাদা। কষ্ট হয় ওদের। সামনে বটতলার মেলা থেকে বরং একটা কাঠের পাখি আনিয়ে দেব।”
মেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। তার আগেই এসে গিয়েছিল রঙিন একটা কাঠের পাখি।
সে এক অদ্ভুত ব্যাপার! সকালে উঠে ঠাকুরমার সঙ্গে বাইরে এসেছে, তাকিয়ে দেখে বারান্দার কোণে খুঁটির পাশে
লেজ ছাঁটা মেটে রঙের চমৎকার একটা কাঠের হাঁস। ছুটে গিয়ে সেটা বুকে তুলে নিয়েছিল
ছেলেটা।
“বড়দি, কী সুন্দর একটা খেলনা হাঁস দ্যাখো! কে রাখল
এখানে?”
“ওমা, তাইতো!” গালে হাত
দিয়েছিলেন ঠাকুরমা, “কে আনল ওটা? হারান
নয়তো?”
হারান বাড়ির কাজের মানুষ। গত রাত্তিরে ভিনগাঁয়ে গিয়েছিল পালাগান শুনতে। ফিরেছে
অনেক রাতে। ছেলেটা কাঠের হাঁস নিয়ে এরপর ছুটেছিল তার খোঁজে। কাছারি ঘরের বারান্দায়
সাতসকালে কী কাজ করছিল সে। ছেলেটা হামলে পড়েছিল সেখানে, “ও হারানকাকু, পাখিটা
তুমি এনেছ বুঝি?”
বড় মজার মানুষ ছিল এই হারান। দারুণ ঘুড়ি তৈরি করতে পারত। ঢাউস মাপের ঘুড়িগুলো গাঁ-গাঁ শব্দে পাড়া কাঁপিয়ে উড়ত। জমিয়ে গল্প বলতেও পটু ছিল। ছেলেটার কথায় মাথা না
তুলেই বলেছিল, ”কী পাখি
মণি?”
“এই যে কাঠের হাঁসটা।”
হারান মুখ তোলেনি এর পরেও। হাতের কাজ করতে করতেই ঠোঁট উলটে বলেছিল, ”কী যে বলো মণি! কাঠের হাঁস কোত্থেকে পাব?
আমি তো কাল রাতে যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম। যাইনি?”
“তা ঠিক। তবে কী করে বারান্দার ওখানে এল?”
“সে অনেক ভাবেই আসতে পারে মণি। কে জানে, হয়তো
জিওনকাঠের পাখি ওটা।”
“জিওনকাঠ!” বড়-বড় চোখ দুটো মেলে খানিক হাঁ করে তাকিয়ে
রইল ছেলেটা।
তারপর কোনওমতে বলল,”জিওনকাঠ, জিওনকাঠ কী?”
“সে এক আজব কাঠ মণি। জিওনকাঠের তৈরি পাখি, পুতুল এসব
নাকি জ্যান্ত হয়ে যায় রাত্তিরে। দিনের বেলা আবার সেই আগের মতো।”
“জিওনকাঠ কোথায় হয় কাকু?”
“এই সেরেছে!” হারান প্রমাদ গণেছে এরপর, “আমি কি লেখাপড়া শিখেছি যে, অত খবর জানব? তুমি কিন্তু ভাই গোল করো না আর। হাতে কাজ রয়েছে মেলা।”
জিওন কাঠের হদিস ছেলেটা মনে মনেই ভেবে নিয়েছিল এরপর। সাত সমুদ্র তের নদীর পারে
এক দ্বীপ। আকাশের রং সেখানে সবুজ। গাছের পাতার রং নীল। পথের ধারে ছড়িয়ে থাকে হরেক
মণি-মানিক। দ্বীপের মাঝে মস্ত এক তেপান্তরের মাঠ। তার
এক গাছে বাস করে একজোড়া ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি। সেই গাছের শেকড় থেকে মেলে জিওনকাঠ।
এরপর কাঠের ওই পাখিটাই হয়ে উঠল ছেলেটার ধ্যান-জ্ঞান। পাখিটা নিয়ে সারাদিন খেলে
বেড়ায় আপনমনে। একা-একা কথা বলে। কাঠের পাখিটা কখনও হয়ে যায় পক্ষীরাজ। কখনও রামভক্ত
জটায়ু। কদিন আগে ঠাকুরদার সঙ্গে পাশের পাড়ায় সীতাহরণ পালা দেখতে গিয়েছিল ছেলেটা।
সব বোঝেনি তেমন। তবে জটায়ু লোকটাকে মনে ধরেছিল। রংচঙে পোশাক পরে লম্বা-চওড়া
চেহারার লোকটা কাঁধে সদ্যভাঙা গাছের একটা ডাল নিয়ে লম্ফঝম্ফ করছিল। আমোদ পাচ্ছিল
সবাই। তবে রাবণের হাতে তার মৃত্যুটা মোটেই পছন্দ হয়নি। বাড়িতে কাঠের পাখিটা তাই
কখনও হয়ে যেত জটায়ু। ভয়ানক এক যুদ্ধের পর মারা পড়ত রাবণ। খুব আনন্দ হত ছেলেটার।
কিন্তু কপাল মন্দ। পাখিটা হারিয়ে গেল একদিন। কত খুঁজল সবাই, কিন্তু মিলল না কোথাও। মনের দুঃখে ছেলেটা
সারাদিন খায়নি কিছুই। শেষে সন্ধেয় ঠাকুরমা অনেক সাধাসাধি করে কিছু খাইয়ে ঘুম
পাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
পরদিন ভোরে ছেলেটার ঘুম যখন ভাঙল, জানলা দিয়ে চাঁপাফুলের মতো একরাশ হলদে রোদ বিছানা ভাসিয়ে দিয়েছে। জানালার
পাশে শিউলি গাছের মগডালে দোয়েল পাখিটা শিস দিচ্ছে তখনও। কয়েকটা শালিখ কোরাস ধরেছে
চালের উপর। উঠোনে গোয়াল ঘরের পিছনে ন্যাড়া কদম গাছের ডালে বাবুইয়ের বাসা দুটো
ভোরের মিঠে বাতাসে নতুন বউয়ের নোলকের মতো দুলছে। প্রতিদিন এই সময়ে ঘুম ভাঙতেই
ভোরের মিঠে বাতাসের মতোই কেমন ফুরফুরে হয়ে যায় মনটা। রাত্তিরের ঘুমের আলস্য পালিয়ে
যায় কোথায়। উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। আজ গতদিনের কথা মনে পড়তেই কিন্তু অন্ধকারে তলিয়ে
গেল আবার। ঠাকুরমা এসে ডাকলেন, “ওঠো দাদা, সকাল হয়ে গেছে।”
উত্তর দিল না ছেলেটা। পড়ে রইল গোঁজ হয়ে। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। দোয়েল পাখিটা
গলা সেধে তখন বিদায় নিয়েছে। চালের উপর শালিখদের মজলিশ শেষ। গোয়ালঘরে কালিগাইয়ের
ছোট্ট নুলিবাছুরটা ডেকে উঠল, হাম্মা-আ-আ।
এবার উঠতেই হল ছেলেটাকে। কালিগাইয়ের নুলিবাছুরটার বয়স মোটে দশ দিন। ওর খেলার
আরেক সাথী। সকাল থেকে দেখতে না পেয়ে এবার ডাকতে শুরু করেছে। আর যে শুয়ে থাকা যায়
না! আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠতেই হল ছেলেটাকে। তারপর সোজা বাড়ির পিছনের
পুকুরঘাটে। চোখ-মুখে জল দিয়েই ছুটবে নুলিবাছুরের সঙ্গে খেলতে। কিন্তু পুকুরঘাটে যে
আর এক ব্যাপার অপেক্ষা করে আছে তা তখন ভাবতেও পারেনি সে।
প্রথমে তো বিশ্বাস হতেই চাইছিল না। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন নয়তো! চোখটা কচলে নিল
বার কয়েক। না, জেগেই তো
আছে। তারপরেই দারুণ উত্তেজনায় চিৎকার করে ডাকল ঠাকুরমাকে, “বড়দি,
শিগ্গির এসো। দেখে যাও।”
ঠাকুরমা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। ছুটে এলেন সব ফেলে। তারপর পুকুরের দিকে তাকিয়ে
গালে হাত দিয়ে বললেন, ‘ওমা!
পানডুবি হাঁসটা পুকুরে কোত্থেকে এলো!”
বিরক্ত হল ছেলেটা, “তুমি
কিচ্ছু জান না বড়দি। ও তো আমার সেই কাঠের পাখিটা। হারানকাকু ঠিকই বলেছিল।
জিওনকাঠের হাঁস তো! জ্যান্ত হয়ে উড়ে গিয়েছিল। রাত্তিরে ফিরে এসেছে পুকুরে। ভাল করে
দ্যাখো, সত্যি কিনা?”
“তাই তো রে দাদা!” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন
ঠাকুরমা, “চোখেও তো ছাই তেমন দেখতে পাইনে। ঠিকই, সেই কাঠের হাঁসটাই তো! তা এবার খুশি তো দাদা?”
ছেলেটার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তবে সেদিকে তখন খেয়াল ছিল না
ছেলেটার। অপলক নয়নে তাকিয়ে দেখছিল হাঁসটাকে। লেজবিহীন মেটে রঙের ছোট আকারের হাঁসটা
দারুণ আনন্দে সাঁতার কাটছে পুকুরের জলে। হঠাৎ হঠাৎ জলে এতটুকু ঢেউ না তুলে
বিদ্যুদ্বেগে ডুব দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ভেসে উঠছে খানিক আগে। সে ভারি মজার
ব্যাপার।
সেই মজার দৃশ্যে মশগুল হয়ে পরের কয়েকটা দিন যেন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল ছেলেটার।
অনেক ডাকাডাকি, সাধাসাধি
করলেও হাঁসটা কাছে আসেনি কখনও। সেজন্য তার দুঃখ ছিল না। দিনের মধ্যে কতবার এসে
দেখে যেত হাঁসটাকে! ডেকে দেখাত সবাইকে। হারান একদিন বলেছিল, ”জিওনকাঠের
হলেও ওটা কিন্তু পানডুবি হাঁসই মণি। ডুবডুবি হাঁসও বলে অনেকে। ডুবে-ডুবে খাবার
খুঁজে খায় তো। ছোট মাছ, গেঁড়ি, গুগলি।
তাই ওই নাম। ডানা তেমন বড় না হলেও উড়তে পারে ভালই। তবে কোথাও আস্তানা গাড়লে সহজে
নড়তে চায় না। ডিম ফুটিয়ে বাচ্চাও তোলে। তবে এখানে গাঁয়ের ভিতর এত মানুষ, মনে হয় না থাকবে বেশিদিন।”
হারানের ওই শেষ কথাগুলো একটুও ভাল লাগেনি ছেলেটার। ছলছল চোখে বলল, “কী যে বল কাকু! ও যে আমার খেলার সঙ্গী!”
“আমি কি সেই কথা বলেছি মণি?” ছেলেটার ছলছল চোখের দিকে
তাকিয়ে বলল হারান, “আসলে গাঁয়ের ছোঁড়াগুলো যা বদমাশ। তবে ভেব
না তুমি। আমি বলে দেব সবাইকে।”
হারান নিশ্চয় বলে দিয়েছিল। পাড়ার ছেলেরা কেউই আর বিরক্ত করেনি হাঁসটাকে।
ওইটুকু হাঁস, কিন্তু কী
ভীষণ বুকের পাটা! ছেলেরা দল বেঁধে যখন সাঁতার কাটে, বেপরোয়া
হাঁসটা নিজেই চলে আসে কাছে। তারপর একটু বেচাল দেখলেই নিমেষে টুপ করে ডুব। খানিক
পরেই ভেসে উঠবে দূরে। দেখে খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠত ছেলেটা। পুকুরঘাটে বসে হাঁ করে
দেখত। ডাকত হাত নেড়ে। সেই ডাকে হাঁসটা কখনও কাছে না এলেও নিজের মনেই খেলত তার
সঙ্গে। গড়িয়ে যেত সময়।
দিন যায়, মাস যায়।
বর্ষায় ভারি হয়ে ওঠে আকাশ। ঘন মেঘের আনাগোনা। মন ভারী হয়ে ওঠে
ছেলেটারও। গ্রামের বাড়ির দিন যে শেষ হয়ে এল এবার। কলকাতা থেকে বাবা এসেছেন। নিয়ে
যাবেন। ইস্কুলে ভর্তি হতে হবে এবার। ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, হারানকাকুর কথা ভেবে ছেলেটার মন তাই ভারী হয়ে রয়েছে ক’দিন। এতদিনের সঙ্গী হাঁসটার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না।
ক্রমে যাওয়ার দিন এসে গেল। সকাল থেকে সবাই গোছগাছ ব্যস্ত। এমন সময় ছুটতে ছুটতে
এল হারান, “কাণ্ড দ্যাখ মণি!
পুকুরে হাঁসটা নেই! রাত্তিরে উড়ে গেছে!”
ভোরে সবে তখন ঘুম ভেঙেছে ছেলেটার। বারান্দায় এসে শান্ত গলায় বলল, “আমি জানি কাকু।”
“অ্যাঁ! জানো মানে! তুমি তো সবে ঘুম থেকে উঠলে!” অবাক
হল হারান।
“তাতে কী? ও সেই জিওনকাঠের পাখি যে! গত ক’দিন তাই সমানে প্রার্থনা করেছি, ও যেন আবার সেই আগের মতো কাঠের পাখি হয়ে যায়। তাহলে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
খেলব ওর সঙ্গে। পাখিটা আমার প্রার্থনা ফেলতে পারেনি। একটু আগে ঘুম থেকে উঠে দেখি ও
আবার কাঠের পাখি হয়ে পড়ে আছে বিছানার পাশে। এই দ্যাখো।”
কোলের ভিতর থেকে পরম মমতায় ছেলেটা বের করল সেই হারিয়ে যাওয়া কাঠের পাখিটা।
ছবিঃ প্রদীপ গোস্বামী (সৌজন্য: শিশুমেলা)
17/3/2017
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। গল্পটা যেন টেনে রেখে দিয়েছিল আমায়। খুব খুব ভালো লেগেছে ।
ReplyDeleteঅপূর্ব সুন্দর
ReplyDelete