মৃতের সহিত সাক্ষাৎ
তুষারকান্তি ঘোষ
সে আজ প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ
বছর আগের কথা। আমার জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়াছিল, সেটার সত্যকার তাৎপর্য কি, তাহা
আমি আজও বুঝিতে পারি নাই। আমি যাহা লিখিতেছি তাহা যে শুধু সত্য তাহাই নয়, আমি যাহা
বর্ণনা করিতেছি, তাহাও অক্ষরে অক্ষরে সত্য। এই ঘটনাটি ঘটেছিল দিল্লীতে, কুইন রোডস্থিত
করোনেশন হোটেলে। ইহা সম্যক বুঝিতে হইলে ইহার কিছুদিন আগের কথা জানা আবশ্যক।
সেদিন সরস্বতী পূজার ভাসান।
তখনও আমাদের অমৃতবাজার পত্রিকার নূতন বাড়ি নির্মিত হয় নাই। আমরা তখন ২নং আনন্দ চ্যাটার্জি
লেনে থাকি। আমাদের বাড়ির বাগানে সেইদিন বিকালে, আমরা কয়জনে ব্যাডমিন্টন খেলিতেছিলাম।
আমার ছোড়দাদা (আমার ঠিক উপরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) সেইখানে বেড়াইতেছিলেন এবং মধ্যে মধ্যে
দাঁড়াইয়া আমাদের খেলা দেখিতেছিলেন। আমি দেখিতেছিলাম যে, ছোড়দাদার মুখ বড়োই বিষণ্ণ,
যেন কি চিন্তা করিতেছেন। দু’একবার আমাকে যেন কি বলিতে চাহিলেন, কিন্তু বলিলেন না। খেলা
শেষ হইলে ছোড়দাদা আমাকে একপাশে ডাকিয়া অতি বিষয় স্বরে বলিলেন, ‘দেখ, যদি আমি হঠাৎ
মরে যাই, তুই তোর ছোটো বউদিকে আর ছেলে-মেয়েদের দেখা শোনা করবি তো?’
আমি এই কথা শুনিয়া চমকিয়া
উঠিলাম ও ছোড়দাদার মন হইতে ঐরূপ ভাব দূর করিবার জন্য বলিলাম, ‘কি পাগলের মতো যা-তা
বকছে-তুমি হঠাৎ মরতে যাবে কেন, আর আমারই বা তোমার ফ্যামিলিকে দেখবার কি দরকার হল?’
বকুনি খাইয়া ছোড়দাদা
তখন চুপ করিয়া গেলেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আবার আমাকে বলিলেন, ‘তুই রাগ করিস কেন?
মরা-বাঁচার কথা কে বলতে পারে? আমার যদি হঠাৎ কিছু হয়, তুই ওদের দেখবি তো?’
আমি রাগ করিয়া বলিলাম,
‘না দেখবো না। তোমার মতো পাগলের সঙ্গে আমি বকতে পারি না।’
—এই বলিয়া আমি সেখান হইতে
চলিয়া গেলাম। কিন্তু হায়, তখন বুঝিতে পারি নাই যে, নিজের জন্য কি শেল প্রস্তুত করিতেছি।
সরস্বতীর বিসর্জন দিয়া
রাত্রে আহারের পর অতি ক্লান্ত হইয়া সবেমাত্র ঘুমাইয়াছি, এমন সময় আমার দুয়ারে ধাক্কা
পড়িল। দরজা খুলিয়া শুনিলাম যে, ছোড়দাদার হঠাৎ অত্যন্ত হাঁপানি হইয়াছে। আমি তৎক্ষণাৎ
নিচে তাহার ঘরে গিয়া দেখিলাম যে, তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছেন। আমাকে দেখিয়াই বলিলেন,
‘ডাক্তার। আর সহ্য করতে পাচ্ছি না!’
তৎক্ষণাৎ ডাক্তার আনা হইল
এবং তিনি আসিয়াই ইনজেকশন দিলেন। হায়, তখনও যদি ছোড়দাদাকে আমার মনের কথা বলিতাম!
কিন্তু তখনও তো বুঝি নাই আমাদের কি সর্বনাশ হইতেছে। ইনজেকশনের পর ছোড়দাদা তৎক্ষণাৎ
ঘুমাইয়া পড়িলেন।
তার পরদিন সকালে কিছু বেলাতে
শুনিলাম যে, ছোড়দাদা তখনও ঘুমাইতেছেন। আমরা ভাবিলাম ইহা মর্ফিয়ার ফল তখনও আমাদের মনে
কোনো শঙ্কা জাগে নাই। তাহার পর যখন অনেক বেলাতেও ছোড়দাদার ঘুম ভাঙিল না তখন আমরা ডাক্তার
আনিলাম, কিন্তু তখন আর কিছু করিবার ছিল না। আমার স্নেহময় ছোড়দাদা তখন মহাপ্রস্থানের
পথে যাত্রা করিয়াছেন। তিনি আর জাগিলেন না, আর কথা কহিলেন না।
বলিতে হইবে কি, আমার হৃদয়
ভাঙিয়া গেল। ভ্রাতৃ-বিয়োগের অপেক্ষা আরো বড়ো আঘাত আমার হৃদয়কে খণ্ডিত করিতে লাগিল।
কাঁদিয়া কাঁদিয়া নিজের হৃদয়কে বারবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, কেন ছোড়দাদাকে সত্য
কথা বলিলাম না। কেন তাহাকে বলিলাম যে, আমি তোমার সংসার দেখিবো দেখিবো দেখিবো। কিন্তু
তখন কে আমার কথা শুনিবে?
ইহার পর আমার হৃদয় সর্বদাই
অনুতাপে দগ্ধ হইত। বারবার ছোড়দাদাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিতাম, সেদিন ব্যাডমিন্টনের
মাঠে আমি তোমায় মিথ্যা কথা বলেছি। কিন্তু কিছুমাত্র শান্তি পাইতাম না, মন সর্বদাই
অবর্ণনীয় ব্যথায় ভরিয়া থাকিত।
ইহার অতি অল্পদিন পরেই
আমাকে কোনো বিশেষ কাজে দিল্লী যাইতে হয়। দিল্লীতে বিকালে পৌঁছিয়া করোনেশন হোটেলে
উঠিলাম। সন্ধ্যার পর স্নান করিয়া আমার রাত্রের খাবার আনিতে আদেশ করিলাম। হোটেলের চাকর
আসিয়া বলিল যে, তখনও খাবার প্রস্তুত হইতে সামান্য বিলম্ব আছে। সময় কাটাইবার জন্য
আমি একখানি বই লইয়া শয্যায় শয়ন করিলাম।
খানিক পরে মনে হইল যেন
আমার শরীরটি অত্যন্ত হালকা বোধ হইতেছে এবং আমি যেন আমার বিছানার উপরে শূন্যে ভাসিতেছি।
একটু একটু করিয়া আমার দেহ শূন্যে ভাসিতে ভাসিতে চলিতে আরম্ভ করি। আমার মাথার নিকট
যে জানলা খোলা ছিল তাহার ভিতর দিয়া বাহির হইয়া ক্ৰমে ঊর্ধ্বে উঠিতে লাগিলাম। আমায়
যে এই অবস্থা হইয়াছে এবং আমি যে কিছু অস্বাভাবিক বোধ করিতেছি তাহা আমার মনে হইল না,
শূন্যে ভাসিয়া চলা যেন আমার কাছে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, আমি অতি আরামে ও সহজভাৰে যাইতে
লাগিলাম।
খানিকটা ঊর্ধ্বে উঠিয়া
একদিকে যাইতে লাগিলাম। ক্রমে ক্রমে আমার চারিপাশের আলোকোজ্জ্বল অবস্থা অস্পষ্ট হইতে
লাগিল। একটু পরে গভীর অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। কোথা দিয়া যাইতেছি, এবং কোথায়
আমার গন্তব্যস্থান কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।
ক্রমে ক্রমে আমার আশেপাশে
আবার অস্পষ্ট আলোক ফুটিতে লাগিল, যেন তৃতীয়া কিংবা চতুর্থীর চাঁদের আলো। ক্রমে আরো
একটু স্পষ্ট হইলে আকাশে বহু তারা ও পারিপার্শ্বিক দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হইতে লাগিল। ক্রমে
চাঁদের আলো বাড়িতে লাগিল যেন চাঁদ পূর্ণিমার দিকে অগ্রসর হইতেছে, আমি দেখিলাম এক সুরম্য
বনপথে অগ্রসর হইতেছি! নির্জন প্রান্তর, নদী, পর্বত ও বন অতিক্রম করিয়া যাইতে লাগিলাম।
ক্রমে চাঁদের আলো আরো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক দৃশ্য আরো সৌন্দর্যময় হইতে
লাগিল। চারিদিকে ফুল ফুটিয়া আছে, ফুলের সুগন্ধে আকাশ বাতাস ভরিয়া আছে। সে সৌন্দর্যের
বর্ণনা হয় না। আমার প্রাণ–মন আনন্দে ভরিয়া গেলো, কিন্তু কোনো জনমানব দেখিলাম না।
একটু পরেই এক নির্জন প্রান্তরে
একটি মাত্র সাদা বাড়ি দেখিলাম! সেখানে আর কোনো বাড়িঘর নাই বা সেখানে কোনো গ্রাম আছে
বলিয়াও বোধ হইল না। বাড়িটি উঁচু ও ছাদের উপর একটি চিলে কোঠা দেখিলাম। আমি শূন্যে
ভাসিতে ভাসিতে ছাদের পাঁচিল ডিঙাইয়া ছাদে অবতরণ করিলাম। সমস্ত ছাদ পূর্ণিমার আলোকে
উদ্ভাসিত কেবল একাংশে সেই চিলে কোঠার ছায়া পড়িয়াছে; দেখিলাম, সেই ছায়াতে ছাদের
পাঁচিলে হাত রাখিয়া আমার ছোড়দাদা দাঁড়াইয়া আছেন।
ছোড়দাদাকে দেখিয়া বিদ্যুতের
মতো আমার হৃদয়ে একটিমাত্র কথার উদয় হইল যে, এই তো ছোড়দাদাকে পাইয়াছি। এখনি কেন
তাঁহাকে আমার মনের কথা বলি না? আমি ছুটিয়া তাহার নিকটস্থ হইয়া বলিলাম, ‘ছোড়দাদা,
ছোড়দাদা, আমি আগে তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছি। আমি তোমার ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা করবো।
তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।’
ছোড়দাদা আমার দিকে ফিরিলেন
ও হাসিলেন। সে হাসি যে কত করুণ তাহা আমার বুঝাইবার সাধ্য নাই। তিনি বলিলেন, ‘ওরে তা
কি আমি জানি না ভাই! পরমুহূর্তেই ছোড়দাদা কেমন যেন উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, ‘যা, এখুনি
ফিরে যা, আর এখানে এক মুহূর্তও থাকিস নি।’
ছোড়দাদা একথা বলিবামাত্র
আমার দেহ প্রত্যাবর্তন করিতে শুরু করিল; আমি আর দ্বিতীয় কথা বলিবার সুযোগ পাইলাম না,
আমার দেহ ছাদের পাঁচিল ডিঙাইয়া শূন্যে ভাসিতে ভাসিতে চলিতে লাগিল। ফিরিবার পথ বর্ণনা
করিবার আবশ্যক নাই, কারণ যে পথ দিয়া গিয়াছিলাম সেই পথ দিয়াই প্রত্যাবর্তন করিতে
লাগিলাম, সেই ফুলবন, ফুলের গন্ধ, নির্জন প্রান্তর, নদ-নদী-পর্বত এবং গভীর আশ্চর্যের
বিষয় এই যে, চাঁদের আলো যাইবার সময় যেরূপ কম বেশি হইয়াছিল, ফিরিবার সময় উল্টাভাবে,
সেইরূপই দেখিলাম। সেই গভীর অন্ধকারের ভিতর দিয়া আসিতে হইল এবং অবশেষে হোটেলের জানলা-পথে
আমি কামরায় প্রবেশ করিলাম।
সবেমাত্র বিছানায় শুইয়াছি,
এমন সময় আমি শুনিলাম, ‘এ সাব, আপকা খানা লায়া।’
—হোটেলের চাকর বলিতেছে।
উপরে যাহা লিখিলাম, তাহা
কিছুমাত্র অতিরঞ্জিত নয়। আমার গমন ও প্রত্যাগমনে কতো সময় লাগিয়াছিল বলিতে পারি না।
বোধহয় মিনিট কয়েক হইতে পারে, ইহা যে কিরূপে হইল, কেন হইল, তাহা আমি আজও বুঝিতে পারি
নাই।
No comments:
Post a Comment