মাকুমামার ব্যাঘ্র কাণ্ড
শিশির বিশ্বাস
সবারই
কিছু না কিছু সাধ-আহ্লাদ থাকে। আমাদের
মাকুমামারও সাধ ছিল বড় মাপের শিকারি হবার। নামডাকে
ছাড়িয়ে যাবেন জিম করবেটকেও। আজকাল
অবশ্য শিকার নিষিদ্ধ। বন্যপ্রাণীর
সংখ্যাও কমতে-কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কিন্তু
সে সময় তেমন ছিল না। তো যাই হোক, সাধ থাকলেও তেমন একটা সুযোগ কিছুতেই আর তিনি করে উঠতে পারছিলেন না।
পৈতৃক
একটা গাদা বন্দুক ছিল। সেটা নিয়ে এক
সময় প্রায়ই নাকি বাগেরহাটে নিজেদের গ্রামের কাছে ছোটখাটো জঙ্গলে পাখি মারতে যেতেন। কিন্তু
তারপর হঠাৎ দেশ ভাগ হয়ে গেল। সবাই
চলে এলেন এপারে। অবস্থাও গেল পালটে। অগত্যা
মনের ইচ্ছেটা আর পূর্ণ হতে পারেনি। তাই
বলে, তিনি অবশ্য নিরাশ হননি একেবারেই। যত রাজ্যের
শিকার কাহিনি পড়ে নীরবে শিকারি হবার তালিম নিয়ে যাচ্ছিলেন। থাকতেন
বউবাজারের ওদিকে এক মেসে। তার বিছানার
পাশের সেলফটা বোঝাই থাকত নানা রকম শিকারের বইয়ে। এ ছাড়া
মলাটে বাঘের মুখ আঁকা পেল্লায় সাইজের এক বাঁধানো খাতাও শোভা পেত সেখানে। কোন
এক আর্টিস্টকে দিয়ে আঁকিয়ে নিয়েছিলেন। বাজারে
নতুন কোনও শিকারের বই বের হলেই খুঁজেপেতে কিনে ফেলতেন। তারপর
সময় করে সেই সব বই থেকে নোট নিয়ে মন্তব্য সহ টুকে রাখতেন খাতায়। এইভাবে
রাজ্যের বাঘ–ভালুকের হালচাল আর প্রকৃত শিকারির কর্তব্য প্রায়
কণ্ঠস্থই করে ফেলেছিলেন।
রুমমেট, দাশরথি ভট্টাচার্য ওরফে দাশুবাবু প্রায়ই তাঁর শিকার পাঠের খবরাখবর নিতেন,
‘আজ কদ্দুর এগোলেন মশায়?’
‘আর ভাই!’ বলতে গিয়ে মুখটা প্রায় আমশির মতো বেঁকে যেত
মাকুমামার, ‘শেখার কী আর কিছু বাকি রেখেছি মশায়! কিন্তু এই পোড়া দেশে কী আর হয় কিছু? এখন হাতে থ্রি
সেভেনটি ফাইভ হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড ডবল ব্যারেল রাইফেল একটা পেতাম, আর সেই সাথে একটু চান্স।’
দাশুবাবু
তাড়াতাড়ি বলতেন, ‘আরে ঘাবড়াচ্ছেন কেন মশায়? লড়ে যান দেখি। আমি
ভটচার্যির পো যখন কথা দিয়েছি, চান্স আপনাকে একটা করে দেবই।’ বলেই তিনি আর দেরি না করে সরে পড়তেন সুড়ুৎ করে। আর নয়তো
মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়তেন চাদর মুড়ি দিয়ে।
এক ইনশিয়োরেন্স
কোম্পানির দালালি করতেন দাশুবাবু। সেই
সুবাদে অনেকের সঙ্গে জানাশোনা ছিল। তিনি
ভরসা দিয়েছিলেন, তেমন কোনও পার্টি পেলে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। মাকুমামা
সেই আশাতেই দিন গুনতেন। যাই হোক, বেড়ালের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত শিকে ছিঁড়ল। সেদিন
বিকেলে, দাশুবাবু হঠাৎ ছুটতে-ছুটতে এসে বললেন,
‘আরে মশায় শুনেছেন? পাশের ‘হোটেল দিনরাত’এ ডালটনগঞ্জের এক ভদ্রলোক এসে উঠেছেন। হঠাৎ
আলাপ হল আজ। অভিজ্ঞ শিকারি।’
‘আঁ! বলেন কী?’ মুহূর্তে মাকুমামার
চোখ দুটো স্পেশাল সাইজের রসগোল্লা।
‘তবে আর বলছি কী মশায়? ডালটনগঞ্জে বিরাট বনেদি বংশ ওনারা। আপনার
ওই ‘থ্রি সেভেনটি ফাইভ-টাইভ’ কী সব বলেন, অমন গণ্ডা কয়েক রাইফেল ওঁদের বাড়ির বৈঠকখানায়
ঝোলে। বুঝলেন মশায়, হিন্টস আমি একটু দিয়েই রেখেছি। দিন
কয়েক থাকবেন। এর মধ্যে ধরে ঝুলে পড়ুন দেখি।’
বেশি
বলতে হল না। হোটেল দিনরাত’এ অনেকের সঙ্গেই খাতির রয়েছে মাকুমামার। পড়ি
কী মরি করে তক্ষুনি ছুটলেন।
ভদ্রলোকের
নাম শিবশঙ্কর রায়। অতি অমায়িক এবং দরাজ মনের মানুষ। দিন
কয়েকের মধ্যেই মাকুমামা তাঁকে পেড়ে ফেললেন। তারপর
একদিন সবিনয়ে নিবেদন করলেন তাঁর মনের বহুদিনের বাসনা। শুনে
শিবশঙ্করবাবু বললেন, ‘আরে এ আর এমন কী! রুমাণ্ডিতে
আমাদের নিজেদেরই বাংলো আছে। কাজের
চাপে অনেক দিন আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। চলুন
না, দিন কয়েক কাটিয়ে আসি। শিকারও
হবে, রেস্টও হবে একটু।’
এরপর
আনন্দে মাকুমামার তো কদিন আর মাটিতে পা-ই পড়তে চায় না। শেষে
একদিন দুর্গা-দুর্গা বলে রওনা হয়ে পড়লেন শিবশঙ্করবাবুর সঙ্গে। দাশুবাবু
এক ফাঁকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘যাচ্ছেন তো, পারলে একটা
হরিণের ছাল-টাল নিয়ে আসবেন। বামুনের
ছেলে। পেতে সন্ধ্যা আহ্নিকটা করা যাবে।’
শুনে, মাকুমামা নাক-টাক কুঁচকে বললেন‚ ‘কী যে বলেন মশায়! সুযোগ
যখন মিলেছে, নিশ্চিন্ত থাকুন, একটা বাঘের
ছালই এনে দেব আপনাকে।’
ডালটনগঞ্জে
শিবশঙ্করবাবুরা সত্যিই বনেদি পরিবার। মস্ত
কাঠের ব্যবসা। বাড়িতে গোটা কয়েক বিভিন্ন মডেলের আগ্নেয়াস্ত্র
দেখে তাক লেগে গেল মাকুমামার। কিন্তু
সমস্যা হল‚ বাড়িতে এসেই ভদ্রলোক কিছু ব্যবসায়িক কাজে জড়িয়ে পড়লেন। দিন
সাতেকের আগে ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই। সেজন্য
অবশ্য অসুবিধা ছিল না। কয়েকটা দিন
মাকুমামা দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারতেন ওঁদের বাড়িতে। ভদ্রলোকেরও
ইচ্ছে ছিল তাই। কিন্তু মাকুমামার মন তখন পড়ে রয়েছে
জঙ্গলে বাঘের পিছনে। বায়না ধরলেন, অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। তিনি
একাই যাবেন জঙ্গলে। শিকারের কায়দা-কানুন গুলে খেয়েছেন। অসুবিধা
হবে না। মাকুমামার একান্ত ইচ্ছে দেখে শিবশঙ্করবাবু
আর আপত্তি করলেন না। সেই দিনই তাঁকে
জিপে পৌঁছে দিলেন রুমাণ্ডির বাংলোয়।
পাহাড়ের
এক টিলার উপর কাঁটাতার ঘেরা ছোট্ট ছিমছাম ছবির মতো বাংলো। হাতায়
দাঁড়িয়ে চারপাশের বনাঞ্চল ভারী চমৎকার! পালামৌ জঙ্গলের কথা মাকুমামা
বইতে পড়েছেন। এখন আসল জঙ্গল
দেখে তাজ্জব বনে গেলেন। আরে বাসরে! যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ, পাহাড় আর ফুলের মেলা। কোথাও
লাল রঙের পলাশ যেন আবির ছড়িয়েছে সবুজের বুকে। সেই
সাথে মহুয়াফুলের মাতাল গন্ধ। আর কত
জাতের যে পাখি! সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত বাংলোর হাতা মুখর হয়ে
থাকে। দেখাশোনার জন্য জাঁদরেল চেহারার কেয়ার
টেকারও রয়েছে একজন। ছক্কু সিং। অনেক
দিনের পুরোনো অভিজ্ঞ মানুষ। সুতরাং
চিন্তার কিছু নেই। তবু গোড়ায় দিন দুয়েক একটু ভয়ে ভয়েই
কাটল। বাইরে বড়ো একটা বের হলেন না। কিন্তু
তারপর একদিন বাংলোর হাতায় বন্দুকে ছর্রা ভরে একসাথে গোটা কয়েক
হরিয়াল ফেলে দিতেই ফের পুরোনো ফর্মে এসে গেলেন।
পরের
দিনই দারুণ এক খবর এসে গেল! মাইল কয়েক দূরে এক গ্রামের কাছে দিন কয়েক
নাকি ঘন-ঘন বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। দু-চারটে গরু ছাগলও তার পেটে গেছে। খবর
শুনে মাকুমামা তো তক্ষুনি এক পায়ে খাঁড়া। পরদিনই
বন্দুক কাঁধে রওনা হয়ে পড়লেন ছক্কু সিং-এর সাথে।
গোড়ায়
ঠিক ছিল সেই রাতেই মাচায় শিকারে বসবেন মাকুমামা। ছক্কু
সিং-ও সঙ্গে থাকবে। কিন্তু
যথাস্থানে পৌঁছে তার মত গেল পালটে। কী এক
পরব উপলক্ষে রাত্তিরে গ্রামে উৎসবের আয়োজন হয়েছে। সারা
রাত গান–বাজনা, খাওয়াদাওয়া হবে। ছক্কু
সিং উৎসব ছেড়ে নড়তে রাজি হল না। মাকুমামাকে
বলল, ‘মেহেরবানি করে আজ রাত্তিরটা বাদ দিন সাহেব। কাল
শিকারে বের হওয়া যাবে।’
কিন্তু
মাকুমামার মন তখন পড়ে রয়েছে বাঘের পিছনে। গোঁ
ধরলেন, রত্তিরে তিনি একাই মাচায় থাকবেন। ছক্কু
সিং সঙ্গে না থাকলেও চলবে। অযথা
একটা রাত নষ্ট করতে রাজি নন।
অগত্যা
সেই ব্যবস্থাই হল। বিকেল নাগাদ গোছগাছ করে ছক্কু সিং মাকুমামাকে
নিয়ে বের হয়ে পড়ল। সঙ্গে মাচা বাঁধার
জন্য আরও জনা কয়েক। গ্রাম থেকে মাইল
খানেক দূরে গভীর জঙ্গলের ভিতর মস্ত এক শালগাছের উঁচু ডালে ছক্কু সিং মাচা বাঁধতে চেয়েছিল। কিন্তু
মাকুমামার পছন্দ হল না। অত খাঁড়াই গাছে
তিনি উঠতে পারবেন না। কাছেই এক গামার
গাছ। বড় আকারের হলেও গুঁড়ি তেমন খাঁড়া নয়‚ বেশ ঢালু। সেই
গাছটাই মাচা বাঁধার জন্য পছন্দ করলেন তিনি। সহজে
উঠতে পারবেন।
গোড়ায়
ছক্কু সিং সামান্য আপত্তি জানালেও মাকুমামার ইচ্ছে দেখে রাজি হয়ে গেল। চটপট
বেঁধে ফেলা হল মাচা। মাকুমামাও বন্দুক
নিয়ে উঠে বসলেন সেটায়। জীবনে প্রথম
শিকারের রাত। কালীমায়ের ভক্ত মাকুমামার ইচ্ছায় কালো
কুচকুচে নধরকান্তি এক পাঁঠা গ্রাম থেকে জোগাড় হয়েছিল। ছক্কু
সিং সেটাকে গাছের গোড়ায় বেঁধে দিল শক্ত করে। উৎসাহে
মাকুমামা উপর থেকে বললেন, ‘কাল সকাল-সকাল চলে এসো
বাপু। তাড়াতাড়ি ছালটা না ছাড়ালে বাঘের চামড়াটা
নষ্ট হয়ে যাবে।’
মাকুমামা
তখন ধরেই নিয়েছেন‚ রাতারাতি বাঘ তিনি একটা মারছেনই। কিন্তু
আসল ঘটনার কিছুমাত্রও যদি তখন তিনি আঁচ করতে পারতেন, তাহলে কিছুতেই
এভাবে একলা জঙ্গলের ভিতর রাত কাটাবার ঝুঁকি নিতেন না। সেটা
বুঝলেন একটু পরেই।
ভোরে
যথা সময়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছক্কু সিং তো দলবল নিয়ে চলে গেল। আর তার
একটু পরেই চারপাশে অন্ধকার ঘনাতে শুরু করল। বাড়তে
শুরু করল ঝিঁঝির কোরাস। সেই সঙ্গে নিস্তব্ধ
বনভূমি কাঁপিয়ে আচমকা ভেসে আসতে লাগল অদ্ভুত সব শব্দ। রাত-জাগা এসব পশু পাখির ডাকের সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই মাকুমামার। চিনতে
পারলেন না প্রায় কোনওটাই। একা
মাচায় বসে একটু ভয়-ভয়ই করতে লাগল। আর সে
কী অন্ধকার! মনে হচ্ছে চারপাশে যেন পোঁচের পর পোঁচ আলকাতরা
চড়িয়ে দিয়েছে। হাতের বন্দুকটা
পর্যন্ত নজর করতে পাচ্ছেন না, তো গাছের নীচে বাঘ শিকার করবেন কেমন
করে ভেবে পেলেন না।
গাঢ়
অন্ধকারে পাশে গাছের ডাল একটু নড়ে উঠলেও ভয়ে সিটিয়ে যেতে লাগলেন। মনে
হতে লাগল, এই বুঝি একটা ভালুক এগিয়ে আসছে। আর সেই
সাথে শুরু হল মশার উপদ্রব। ঘণ্টা
খানেকের মধ্যেই মাকুমামার সারা শরীরে দিব্যি কোদাল চালিয়ে ফেলল যেন। তারই
ভিতর কোনোক্রমে মশাদের ঠেকা দিয়ে বন্দুক আঁকড়ে ঠায় বসে রইলেন তিনি। এক একটা
মুহূর্ত এক একটা যুগ মনে হতে লাগল। মাকুমামা
অচিরেই মালুম পেলেন বইয়ের বিদ্যে আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক বিস্তর। একা
এভাবে শিকারে আসা ঠিক হয়নি একেবারেই।
যাই
হোক, এভাবে সারা রাত্তির চললে কতক্ষণ টিকতে পারতেন তা ঈশ্বরই জানেন। কিন্তু
রাত গোটা দশেক নাগাদ আকাশে চাঁদ দেখা দিল। মনোরম
আলোয় বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল চারপাশ। মাকুমামা
খানিকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। অন্তত
ভালুকের আতঙ্ক থেকে কিছু রেহাই পাওয়া গেল। ওরই
মধ্যে গাছের নীচে পাঁঠা তার চোখের সামনে দিব্যি ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোল। শুধু
তিনি গাছের উপর মাচায় বসে রাতভর মশাদের ঠেকা দিতে-দিতে দূর থেকে
ভেসে আসা কী একটা অচেনা জন্তুর আচমকা বুকের রক্ত হিম করা হ্যাঃ-হ্যাঃ শব্দে থেকে-থেকেই চমকে উঠতে লাগলেন। এছাড়া, বাঘ তো দূরের কথা, একটা শেয়ালেরও দেখা মিলল না।
ভয়ানক
সেই রাত এভাবেই ভোর হল এক সময়। ভোরের
পাখির মিষ্টি রব ভেসে আসতে লাগল। একটু
পরে মিঠে রোদ্দুর উঠতে মশার উৎপাতও কমে গেল অনেক। রাত্তিরের
দুঃস্বপ্ন থেকে রেহাই পেয়ে মাকুমামা যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলেন। রাতে
বাঘের দেখা না মেলায় তখন তিনি বেজায় খুশিই বলা যায়। বাপরে! মাচায় বসে বাঘ শিকারে যে এত ঝক্কি, কে জানত!
মনে-মনে ঠিক করে ফেললেন, ঢের হয়েছে, এবারের মতো বাঘ শিকারের এখানেই ইতি টানবেন
তিনি। সাধ করে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা পেতেছিলেন! এক রাতেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে।
সারা
রাত চোখের পাতা এক করা যায়নি। মাকুমামা
এরপর ঠিক করলেন ছক্কু সিং আসবার আগে একটু ঘুমিয়ে নেবেন। সেই
মতো শিয়রের পাশে বন্দুকটা রেখে মাচায় গুটিসুটি হয়ে কোনও মতে শুয়ে পড়লেন। এমন
সময় গাছের নীচে ছাগলটা হঠাৎ তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেই ম্যা—ম্যা শব্দে পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করল। আর সেই
সঙ্গে আচমকা রক্ত জল করা গুরু গম্ভীর আওয়াজ, ঘুঁ-র্-র্-র্।
মাকুমামার
তখন সবে একটু তন্দ্রামতো এসেছে। শব্দটা
কানে যেতেই দারুণ চমকে তড়াক করে মাচার উপর উঠে বসলেন। তাড়াতাড়ি
নীচের দিকে তাকিয়ে যা দেখলেন, তাতে তো আক্কেল প্রায় গুড়ুম হবার
জোগাড়। কী ভয়ানক! জলজ্যান্ত এক বাঘ নীচে ঝোপের ভিতর থেকে উঁকি মারছে।
এর আগে
তিনি সার্কাসের পোষা কিংবা চিড়িয়াখানার আধপেটা শুঁটকো বাঘই দেখেছেন। এখন
নির্জন থমথমে বনের মাঝে ভয়ানক প্রাণীটার মূলের মতো দাঁত আর ভাঁটার মতো এক জোড়া চোখের
দিকে তাকিয়ে তাঁর দাঁত কপাটি প্রায় লেগে যাবার জোগাড়!
এদিকে
ঘুঁ-র্-র্-র্
শব্দে আরও একটা হুঙ্কার দিয়ে বাঘটা ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে ঝোপ ঠেলে। দেখে
মাকুমামার তো নাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। পাশেই
বন্দুক। কিন্তু সেটা ধরবেন কী, তাঁর হাত-পা তখন রীতিমতো ঠক্-ঠক্
করে কাঁপতে শুরু করেছে। ভোঁ-ভোঁ করছে মাথা। ভিরমি
খেয়ে পড়ে না যান সেই ভয়ে কাঁউমাঁউ করে দু’হাতে কাছেই একটা ডাল জাপটে
ধরলেন।
ওদিকে
নীচে বাঘটা চাপা গর্জনে লেজটাকে বিচিত্রভাবে দোলাল কিছুক্ষণ। জুলজুল
করে ছাগলটাকে দেখল খানিক। তারপর দু’জোড়া পা সামনে পিছনে ছড়িয়ে বার কয়েক বুকডন দিয়ে মুখ তুলে মস্ত এক হাই
ছাড়ল। আর তখনই মাচার উপর মাকুমামাকে দেখতে পেল
সে। জুলজুল করে সেই ভাবেই তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। গুর-গুর করে একটা চাপা স্বর বেরিয়ে এল গলা দিয়ে। লেজটা
বার কয়েক আছড়াল মাটিতে। তারপর আর একটা
হাই ছেড়েই এক লাফে একেবারে গাছের গোড়ায়।
মাকুমামা
স্বভাবতই আশা করেছিলেন, বাঘটা এবার পাঁঠার ঘাড় মটকাবে। কিন্তু
সে তার ধার দিয়েই গেল না। পিছনের
দুই পায়ে নুলো গেড়ে বসে খর–খর করে সামনের দুই থাবা গাছের গুঁড়িতে
আঁচড়াল খানিক। নখে শান দিল
বোধ হয়। তারপরেই তড়াক করে এক লাফে একেবারে গাছের
ডালে।
দারুণ
চমকে মাকুমামা চোখ দুটো কচলে নিলেন। কী সর্বনাশ! বাঘ যে গাছে উঠতে লেগেছে গো! শিকারের এত বই ঘেঁটে খেয়েছেন,
কোথাও এমন কথা তো লেখেনি! একবার খবরের কাগজে দেখেছিলেন
বটে, গাঁয়ের মানুষের তাড়া খেয়ে সোঁদরবনের এক বাঘ নাকি পালাবার
পথ না পেয়ে সটান এক খেজুর গাছের ডগায় চড়ে বসেছিল। সে খবর
কাগজওয়ালাদের বানানো গপ্পো বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তখন। কোথায়
ভেবেছেন, বাঘটা পাঁঠার ঘাড় মটকে বিদেয় হবে, তিনিও
বাঁচবেন। কিন্তু শয়তানটা এদিকে যে খোদ তাকেই ভোজের
মেনু করে বসে আছে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। অভিজ্ঞ
মানুষ ছক্কু সিং তবে কি এই কারণেই উঁচু গাছের ডালে মাচা বাঁধতে চেয়েছিল? তিনি রাজি হননি।
মাকুমামার
বাহারি চুল দেখতে-দেখতে কদমছাঁট হয়ে মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠল। গা বেয়ে
ঘাম ছুটতে শুরু করল। আর তার বিস্ফারিত
চোখের সামনেই বাঘটা দিব্যি এক ডাল থেকে আর এক ডালে লাফিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল মাচার
দিকে। দেখে ডাক ছেড়ে কেঁদে ফেললেন তিনি, ‘বাপ! তোর পেটে শেষে এই ছিল রে! নগদ টাকায় অমন নধর কালো পাঁঠা আনালুম, মনে ধরল না মোটে!
এই বুড়ো হাড়ে কিছু কী আর পাবি? ছেড়ে দে বাপ!
নাক-কান মলছি, বাঘ শিকারের
শখ এক রাত্তিরেই মিটে গেছে আমার।’
কিন্তু
মাকুমামার সেই আকুল আবেদন বাঘের প্রাণে কিছুমাত্র দাগ কাটল না। ততক্ষণে
সে প্রায় মাচার কাছে পৌঁছে গেছে। মাকুমামা
এবার মরিয়া হয়ে পাশে বন্দুকের দিকে হাত বাড়ালেন। যদিও
বেশ জানেন, এই অবস্থায় বন্দুক তাক করে বাঘ মারা তার কর্ম নয়। কিন্তু সেটাও শেষ পর্যন্ত হল না। বন্দুক
কোথায়! নড়বড়ে দড়ির মাচা গলে কখন সেটা নীচে পড়ে গেছে বুঝতেই পারেননি!
হায় হায়!
প্রাণের
তাগিদে মাকুমামা তাড়াতাড়ি মাচা ধরে ঝুলে পড়লেন এবার। উদ্দেশ্য
নীচের ডালে কোনরকমে পা দিয়ে যদি নামতে পারেন তো বন্দুকটা নিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করবেন।
কিন্তু
দুর্ভাগ্য, মাচা ধরে সম্পূর্ণ ঝুলে পড়েও তিনি নীচের ডালের নাগাল পেলেন না। অতঃপর
কী করবেন যখন বুঝে উঠতে পারছেন না, সেই সময় শিকার পালায়
দেখে বাঘটা এক তুড়ুক লাফে এসে পড়ল মাচার উপর। নড়বড়ে
মাচা দুলে উঠল ভীষণভাবে। আর সেই দারুণ
ঝাঁকুনিতে মাকুমামার হাত গেল ফসকে। তাড়াতাড়ি
হাতের কাছে লম্বা দড়ির মতো কী একটা ঝুলতে দেখে দু’হাতে সেটাই প্রাণপণে
আঁকড়ে ধরলেন।
এদিকে
নড়বড়ে মাচার উপর লাফিয়ে পড়ে বাঘটাও সামান্য বেসামাল হয়ে গিয়েছিল। এমন
সময় আচমকা তার লেজের উপর ভয়ানক হ্যাঁচকা টান পড়তেই হড়কে গেল পা। স্বয়ং
মাকুমামা তখন তার লেজ ধরে ঝুলে রয়েছেন। আসলে
দড়ি ভেবে খোদ বাঘের লেজটাকেই তিনি চেপে ধরেছিলেন কিনা! অত উঁচু থেকে পড়লে কাউকেই আর দেখতে হত না! কিন্তু হাজার
হলেও বনের বাঘ! পড়তে পড়তেই শেষ পর্যন্ত নীচের একটা ডাল আঁকড়ে
ধরতে পারল! আর মাকুমামা তার লেজ ধরে ঝুলতে থাকলেন শূন্যে!
লেজের টানে বাঘ বাবাজির তখন বিষম অবস্থা! দারুণ
ক্রোধ আর যন্ত্রণায় ঘোঁয়াং-ঘোঁয়াং শব্দে বন প্রায় কাপিয়ে
ফেলল।
তারপর শুরু হল এক ভয়ানক ব্যাপার!
দেখা তো দূরের কথা, কেউ শোনেওনি কখনও। উপরে
গাছের ডাল আঁকড়ে বাঘটা সমানে নিষ্ফল আক্রোশে গজরাচ্ছে! আর নীচে মাকুমামা তার লেজ ধরে ঝুলতে ঝুলতে ‘বাবাগো‚ খেয়ে ফেললে’ বলে পরিত্রাহি
চেল্লাচ্ছেন। না পারছেন ছাড়তে, না পারছেন তার বিশাল বপু নিয়ে ঝুলে থাকতে। সে এক
দৃশ্য বটে!
কিন্তু
শেষ আছে সব কিছুর। মাকুমামার ওই পেল্লায় শরীরের ভার সামলানো
সহজ ব্যাপার নয়। খানিক ঝুলোঝুলির পর বাঘের লেজটা পটাং
করে ছিঁড়ে সশব্দে নীচে পড়ে গেলেন। ব্যস! তারপরে কিচ্ছুটি মনে নেই তাঁর। আর বাঘটা
দারুণ যন্ত্রণায় ‘কেঁউমেঁউ’ করে খানিক কান্নাকাটির
পর ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে ভোঁ দৌড়।
এদিকে
সারা রাত নাচ-গান আর খাওয়াদাওয়ার পর শেষ রাত্তিরের দিকে
ছক্কু সিং সেই যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ভাঙতে একটু দেরিই হয়ে গেল। তারপর
মাকুমামার কথা মনে পড়তেই সে লোকজন নিয়ে ছুটল জঙ্গলের দিকে।
নির্দিষ্ট
জায়গায় এসে ব্যাপার দেখে সবার তো আক্কেল গুড়ুম হবার জোগাড়! ছাগলটা দিব্যি গাছের নীচে আরামে পাতা চিবোচ্ছে। আর একটু
দূরে মাকুমামা উপুড় হয়ে মড়ার মতো পড়ে রয়েছেন। হাতে
তখনও পেঁচিয়ে ধরা বাঘের আস্তো এক লেজ! ব্যাপারটা হজম করতেই
মিনিট কয়েক লেগে গেল ছক্কু সিং-এর। তারপর
ছুটে গিয়ে মাকুমামার নাকে হাত দিয়ে দেখল ক্ষীণ নিঃশ্বাস একটু বইছে তখনও। দেরি
না করে তৎক্ষণাৎ তাকে নিয়ে সবাই ছুটল গ্রামের দিকে।
মাকুমামা
তার বৌবাজারের মেসে ফিরলেন পাক্কা চার মাস পরে। মেসের
সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে কোনোক্রমে ঘরে
পৌঁছে প্রথমেই তিনি তাঁর সেই বই খাতা-সহ সাধের সেলফটিকে মুটে
ডেকে বিদেয় করলেন। তবে
কথার খেলাপ করেননি। বাঘের ছাল আনতে না পারলেও বাঘের সেই লেজটা
দিয়ে দিলেন দাশুবাবুকে। ভদ্রলোক তাতেই
মহা খুশি। লেজ হলেও বাঘের তো বটে! যত্ন করে সেটা তিনি টাঙিয়ে রেখেছেন ঘরের দেওয়ালে। দিনের
মধ্যে হাজার বার এখন সেটা চোখে পড়ে মাকুমামার। শুনছি, বর্তমানে তিনি নাকি নতুন মেস খুঁজছেন।
ছবি: দিলীপ দাস
প্রথম প্রকাশ: ‘শুকতারা’ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৫
দারুণ মজার গল্প। ছেলেবেলায় পড়া সেই কুট্টিমামার কথা ফের মনে পড়িয়ে দিল।
ReplyDeleteগল্পটা অনেক সুন্দর।
ReplyDeleteঅনেক..........! অনেক.....! অনেক..! ভাল লাগল । এই রকম অসাধারন একটা পোস্ট দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আসা করি এই রকম পোস্ট আরও পাব। সময় থাকলে আমার list of online shopping sites সাইটে ঘুরে আস্তে পারেন।