নতুন জুতো
শিশির বিশ্বাস
যষ্টিচরণের দশ বছরের ভাগনে ভেবলু একটু ক্যাবলা গোছের। বেচারা এবার বায়না ধরেছে, মামার সঙ্গে কলকাতায় দুর্গাপুজো দেখতে যাবে। যষ্টিচরণের তাই চিন্তার শেষ নেই। এ-তো আর গোবিন্দপুর গাঁ নয়। সাহেবদের হাতে তৈরি শহর। সেই কলকাতায়, খোদ মহাষ্টমীর দিনে ভাগনেকে পুজো দেখাতে নিয়ে যাওয়া কী চাট্টিখানি কথা!
যা গাড়োল, নির্ঘাত একটা গোলমাল পাকিয়ে বসবে। দুপুরে ট্রেনে চাপার পর থেকে যষ্টিচরণ তাই সমানে তালিম
দিচ্ছে ভাগনেকে। গাড়ি হাওড়া স্টেশনে
এসে পৌঁছোতে তাকে শেষ বারের মতো হুঁশিয়ার করে দিলে যষ্টিচরণ, ‘এটা কোলকেতা শহর ভেবলু। গোবিন্দপুর গাঁ পাসনি। হরেক রকম আইনকানুন। একটু বেআইনি করেছ কী, সোজা চালান করে দেবে ফাটকে। সাবধান!’
গোলমাল হয়ে গেল তবুও। একেবারে শুরুতেই। ভেবলু একটু ক্যাবলা গোছের হলেও মামার বেজায় বাধ্য। স্টেশনের চত্বর পার হয়ে দু’জন তখন সবে রাস্তায় পড়েছে‚ হঠাৎ দারুণ ঘাবড়ে গিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে মামাকে
প্রায় দাঁড় করিয়ে দিল‚ ‘ওই দ্যাখো
মামা‚ কী লিখে দিয়েছে দ্যাখো!’
বিরক্ত হয়ে যষ্টিচরণ দেখল, প্রায় রসগোল্লার মতো চোখ করে সামনে একটা বিজ্ঞাপন
বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে ভেবলু। বোর্ডে বড়-বড় হরফে লেখা, পুজোয় চাই নতুন জুতো। শুধু সেটাই নয়, আশপাশে যত বোর্ড নজরে পড়ছে, সেই হাওড়া পুল পর্যন্ত,
সব গুলোয় ওই একই কথা। কিন্তু এগুলো দেখে ভাগনের ঘাবড়ে যাওয়ার কারণ ঠিক বুঝে উঠতে
পারল না। এর মধ্যেই ভেবলুর
ধরা গলা শোনা গেল, ‘আমায় কিন্তু
দুষতে পারবে না মামা। নতুনগাঁয়ের
হাটে পুজোর জামাপ্যান্ট কিনতে গিয়ে এক জোড়া জুতো কিনে দিতে বলেছিলাম। শুনলেই না। এদিকে দ্যাখো, সারা কলকাতা জুড়ে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিয়েছে, পুজোয়
নতুন জুতো চাই। অন্য
কিছু নয়।’
‘আঁ!’ ব্যাপারটা এতক্ষণে
মালুম হল যষ্টিচরণের। ব্যাজার
হয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, ‘তাইতো রে! সেবার এসব দেখিনি কিনা। কোলকেতার আইন-কানুন কখন যে কী হয়!’
‘কিন্তু আমার পায়ে যে জুতোই নেই মামা। আর তোমার পায়ে…।’
ভেবলুর পা দিগম্বর, বরং মন্দের ভাল। কিন্তু যষ্টিচরণের পায়ে গণ্ডা কয়েক তাপ্পি মারা, গাঁয়ের মেঠোপথ ঠ্যাঙানো ধুলোমাটি মাখা যে বস্তুটি
রয়েছে সেটি তো প্রাগৈতিহাসিক বলা চলে। ভাগনের বক্তব্য শেষ হবার আগেই তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলে
যষ্টিচরণ, ‘স্-স্-স, একদম চেপে যা ভেবলু। মেলা চ্যাঁচামেচি করিসনি। চুপচাপ চলে আয় আমার সাথে। দু’জোড়া জুতো কিনে ল্যাঠা চুকিয়ে ফেলি।’
ভাগনের হাত ধরে ষষ্টিচরণ অতঃপর সেঁধিয়ে গেল ভিড়ের ভিতর। চলতে চলতেই এক ফাঁকে পায়ের পৈতৃক জুতোজোড়া খুলে এক লাথিতে
বিদেয় করে দিল। তারপর হাওড়ার ফুটপাতে
বিস্তর দরাদরি করে দু’জোড়া নতুন
জুতো কিনে চটপট পায়ে গলিয়ে নিলে দু’জন।
‘খুব যে ঘাবড়ে গিয়েছিলি ভেবলু! কেমন ম্যানেজ করলুম বল দেখি? হুঁ-হুঁ বাবা, এ শর্মা হল যষ্টিচরণ চক্কোত্তি!’
মামার কেরামতি মানতেই হল ভেবলুকে। ইতিমধ্যে সামনে একটা ট্রাম এসে দাঁড়িয়েছে। কনডাক্টর ‘কলেজ স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট’ বলে
চ্যাঁচাচ্ছে। ভাগনেকে
নিয়ে ছুটে গিয়ে তাতে চেপে বসল ষষ্টিচরণ।
কলেজ স্কোয়ার থেকে শুরু হয়েছিল। তারপর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সেই নতুন জুতোর গুণে মস্–মস্ করে ঘোড়ার গতিতে
গোটা বিশেক পুজো দেখে ফেলল দু’জন। চলতে-চলতে যষ্টিচরণ বলল, ‘বুঝলি ভেবলু, এই কোলকাতার জবাব নেই। নতুন
জুতো পায়ে দিয়েই না কেমন গটমট করে পুজো দেখতে পাচ্ছি বল?’
প্রত্যুত্তরে ভেবলুর গলা দিয়ে কিন্তু গোঁ-গোঁ করে একটু শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হল না। বেচারা কিছুক্ষণ ধরেই কেমন গুম মেরে গেছে। ওর ডান হাতটা ষষ্টিচরণের শক্ত মুঠোয়। কিছুতেই আর সে মামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না।
ব্যাপার দেখে যষ্টিচরণ বলল, ‘কী হল রে তোর?’
‘আমার হাত ছেড়ে দাও মামা। আমি একা হাঁটব।’ রীতিমতো ধরা গলা ভেবলুর।
শুনে ষষ্টিচরণ তো অবাক, ‘বলিস কী রে! হারিয়ে যাবি যে। কলকেতার হালচাল কিছু জানিসনি তুই।’
কিন্তু ভেবলু শুনতে রাজি নয়। শেষটা ফোঁস-ফোঁস করে ফোঁপাতে শুরু করল। দেখে ভাগনের হাতটা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিল যষ্টিচরণ। শর্ত রইল, ভেবলু মামার সামনে থাকবে।
একে একে আরও গোটা কয়েক মণ্ডপ ঘোরা হয়ে গেল। ভিড়টা এদিকে বেশ পাতলা। বেশ দ্রুতই চলা যায়। অথচ যষ্টিচরণের পায়ে সে জোর আর নেই যেন। গতি বেশ মন্থর। আর ভেবলুর তো কথাই নেই। ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। একসময় ষষ্টিচরণ হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখল, ভেবলু রীতিমতো খোঁড়াচ্ছে।
‘কী রে ভেবলু, এর মধ্যেই
পা ধরে গেল! খোঁড়াচ্ছিস যে বড়ো!’
‘জুতোয় বড্ড কামড়াচ্ছে মামা। হাঁটতে পাচ্ছি না।’ ভেবলু এবার
বোধ হয় সত্যিই কেঁদে ফেলবে। কিছুক্ষণ
ধরে পায়ের জ্বলুনি যষ্টিচরণও টের পাচ্ছিল। নতুন জুতোর ঘষায় দু’পায়েই লাগছে বেশ। বলল, ‘ঘাবড়াসনি‚ নতুন জুতো তো‚ প্রথম-প্রথম অমন হয় একটু। খানিক বাদে ঠিক হয়ে যাবে।’
মামার আশ্বাসে একটু যেন সান্ত্বনা পেল ভেবলু। খোঁড়াতে খোঁড়াতেই ঘুরল আরও গোটা কয়েক মণ্ডপ। কিন্তু মামার আশ্বাস পূর্ণ হবার কোনও সম্ভাবনাই দেখতে
পেল না। পায়ের জ্বলুনি
কমা তো দূরের কথা, বরং উত্তরোত্তর
পাল্লা দিয়ে চড়ছে।
নতুন জুতোর মূলে ভেবলু নিজেই। সেই কারণে এতক্ষণ ভয়ে-ভয়ে একটু রেখে ঢেকেই চলছিল। কিন্তু আর পারল না। প্রায় মর্মভেদী আর্তনাদ বের হয়ে এল তার গলা দিয়ে, ‘মামাগো বাড়ি যাব। জুতোয় জ্বলে যাচ্ছে পা। মরে গেলুম।’
শুধু ভেবলু নয়, পায়ের জ্বলুনির চোটে ততক্ষণে ষষ্টিচরণও প্রায় জেরবার হবার জোগাড়। কিন্তু বাড়ি বললেই তো আর হল না। কোথায় গোবিন্দপুর আর কোথায় কলকাতা! যষ্টিচরণ ভাগনেকে বলল, ‘চল ওই পার্কে বসে একটু জিরিয়ে নিইগে। ঠিক হয়ে যাবে।’
সামনেই বেশ বড় একটা পার্ক। পুজো দেখতে বেরিয়ে অনেকেই জিরিয়ে নিচ্ছে। ভেলপুরি, ফুচকাওয়ালা ঘিরে মানুষের জটলা। ভিতরে ঢুকে এক কোণে ঘাসের উপর এসে বসতে ভেবলু দু’পায়ের জুতো খুলে ফেলল মুহূর্তে। বেচারার দু’পায়ে ডজন দুয়েক ফোসকা ফুটে বেরিয়েছে। ফেটেও গেছে কয়েকটা। ভয়ানক অবস্থা।
ততক্ষণে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের পায়ের
জুতোজোড়াও খুলে ফেলেছে যষ্টিচরণ। আঃ! পা-দুটো জুড়িয়ে গেল
যেন। ভেবলুর কচি পা। কিন্তু যষ্টিচরণের কড়া-পড়া শক্ত পা-ও রেহাই পায়নি। অন্ধকারে জল টুসটুসে মস্ত ফোসকাগুলোর উপর আস্তে হাত বোলাতে
লাগল। ঘণ্টা খানেক জিরিয়ে
নিল দু’জন। ফের উঠবার পালা এবার। ভেবলু কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি আর জুতো পরতে পারব না মামা।’
‘বলিস কী রে হতভাগা! জুতোর
কী হবে তাহলে?’
‘কেন? হাতে নিয়ে নেব।’ চটপট জবাব দিল ভেবলু।
শুনে প্রায় আঁতকে উঠল যষ্টিচরণ। ‘খবরদার ভেবলু। এটা তোর গোবিন্দপুর গাঁ পাসনি যে, যা ইচ্ছে করলেই হল। ভালোয়-ভালোয় জুতো পরে নে। মামার
সেই রুদ্রমূর্তির সামনে ভেবলু মিইয়ে গেল একেবারে। ভয়ে-ভয়ে জুতোজোড়া পায়ে গলিয়ে নিয়ে ফোঁস–ফোঁস করতে-করতে উঠে দাঁড়াল।
রাস্তায় নেমে কয়েক পা চলতেই ষষ্টিচরণের মালুম হল ঘন্টা
খানেক জিরিয়ে লাভ হয়নি কিছুই। আগে
তবু খানিকটা হজম করা যাচ্ছিল। কিন্তু
এখন আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। প্রতি
পদক্ষেপেই দু’পায়ে চড়াৎ-চড়াৎ করে ইলেকট্রিক শক মারছে যেন। এর মধ্যেই ভেবলু পেছন থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ‘মামাগো ওই দ্যাকো!’
ষষ্টিচরণ তাকিয়ে দেখল, রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাত ধরে এক আধবয়সী ভদ্রলোক গুটিকয়েক বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে চলেছে। ছোট
ছেলেমেয়েদের সবার পা খালি। তবে
প্রত্যেকের হাতে ঝুলছে এক জোড়া করে চকচকে নতুন জুতো। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাড়ি থেকে সেগুলো পায়ে দিয়েই বেরোনো হয়েছিল। কিন্তু শেষে আর পায়ে রাখা যায়নি। হাতে উঠে এসেছে।
এদিকে ভেবলু ততক্ষণে এক কাণ্ড করে ফেলেছে। সুট করে উবু হয়ে পায়ের জুতো খুলে তুলে নিয়েছে হাতে, ‘আমিও জুতো হাতে নিয়ে নিলুম মামা।’
দেখে হাঁ হাঁ করে ভেবলুকে বাধা দিতে যাচ্ছিল যষ্টিচরণ। কিন্তু মাত্র দু’পা গিয়েই ‘বাপরে’ বলে পা তুলে
ল্যাংচাতে শুরু করল। ওফ্! ডান পায়ের এক নম্বর ফোসকাটা ফেটে গেছে। ওদিকে ভেবলু ততক্ষণে খালি পায়ে ছিটকে গেছে দশ হাত দূরে। যষ্টিচরণ হাড়ে-হাড়ে মালুম পেল, পায়ে ওই সর্বনেশে জুতো থাকতে ভেবলুকে
আর পাকড়াও করা সম্ভব নয়।
দান পালটে গেছে এবার। জুতো হাতে ভেবলু এখন আগে-আগে। প্রায় ঘোড়ার বেগে ঘুরছে মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে। আর তাকে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে অনুসরণ করছে ষষ্টিচরণ। প্রাণান্তকর অবস্থা। বাপরে! নতুন জুতোর গুঁতো যে এমন ভয়ানক আগে বোঝেনি কখনও। জুতো তো নয়, যেন আংরা ভরতি দুটো জ্বলন্ত উনুন। আর তার মধ্যে পা-দুটো গলিয়ে রয়েছে। প্রতি
পদক্ষেপে জ্বলন্ত আংরাগুলো ছ্যাঁকা দিচ্ছে সমানে। অথচ পা বের করার জো নেই। গোটা চারেক মণ্ডপ ঘুরতেই যন্ত্রণায় জেরবার। পঞ্চম মণ্ডপের কাছে এসে বুঝতে পারল, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার নিজের বারোটাও
বেজে গেছে এবার। এক
পা চলার ক্ষমতা নেই। ফুটপাতের
কোণে একটু অন্ধকারমতো জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাগনেকে বলল, ‘রাত বারোটা বাজে ভেবলু। খিদে পায়নি তোর?’
সেই দুপুরে বাড়ি থেকে বের হবার পর তেমন কিছুই আর পেটে
পড়েনি। ভয়ানক খিদে পেলেও
জুতো নিয়ে এতসব কাণ্ডের পর এতক্ষণ সেটা আর ব্যক্ত পরতে পারেনি ভেবলু। মামার কথায় নেচে উঠল, ‘হ্যাঁ গো মামা। বড্ড খিদে পেয়েছে।’
‘তাহলে এক কাজ কর। সামনের এই পুজোটা তুই একাই দেখে আয়। আমি দাঁড়িয়ে আছি এখানে। ফিরে এলেই দু’জন খেয়ে নেব কোথাও।’
‘আমি কিন্তু স্পেশাল মোগলাই খাব মামা। সেই সাথে কোবরেজি কাটলেট দুটো।’ ইতিমধ্যে
এক রেস্তরাঁর সামনে মেনুবোর্ডে লেখা নাম দুটো বেশ পছন্দ হয়েছে ভেবলুর। সুযোগ পেতেই জানিয়ে দিল।
‘ঠিক আছে বাবা। তুই ঘুরে আয় দেখি।' তাগাদা লাগাল
যষ্টিচরণ। ভেবলু আর কথা বাড়াল
না। দুই হাতে দুই জুতো
দুলিয়ে, দিব্যি নাচতে-নাচতে চলে গেল ভিতরে। আর
সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ পারা যায়, ভাগনের সেই জুতো দোলানো জুলজুল করে দেখতে লাগল ষষ্টিচরণ।
ঠাকুর দেখে একটু বাদেই ফিরে এল ভেবলু। যষ্টিচরণ যথাস্থানেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ক্যাবলা হলেও ভেবলুর জবাব নেই! কাছে এসেই সে মুহূর্তে আবিষ্কার করে ফেলল,
মামার পায়ের জুতো লোপাট।
‘তোমার জুতো কোথায় গো মামা?’
‘আঁ!’ প্রায় যেন ভূত দেখার
মতোই চমকে উঠল ষষ্টিচরণ। ‘তাইতো রে! জুতো পায়েই
তো ছিল। গেল কোথায় বল দেখি?’
ভাগনের পানে তাকিয়ে সমানে আপসোস করতে থাকে যষ্টিচরণ, ‘টাকাটাই জলে গেল রে ভেবলু। হায়-হায় অমন চমৎকার জুতো! দামটাও কম নেয়নি রে!’
মামার শোক দেখে মুষড়ে পড়ল ভেবলুও। অমন আনকোরা জুতো এক কথায় হারিয়ে গেলে কার না কষ্ট হয়? খানিক কী চিন্তা করে ভেবলু রাস্তার পাশে পোস্টে
বাঁধা একটা লাউড স্পিকারের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ, ‘ওই শোনো মামা। ছেলেপুলে, জিনিসপত্র যার যা হারাচ্ছে জানিয়ে দিচ্ছে ওতে। চলো আমরাও জানিয়ে আসি।’
কিন্তু জুতোর শোকে শোকাতুর ষষ্টিচরণের খুব একটা উৎসাহ
দেখা যায় না। মাথা চুলকোতে চুলকোতে
বলে, তাতে জুতো কি আর পাওয়া
যাবে রে? আনকোরা নতুন!’
ভেবলুর উৎসাহে কিন্তু ভাটা পড়ে না। ‘খুব পাওয়া যাবে মামা। এত
সব ব্যবস্থা কী আর শুধু-শুধুই করেছে?’
মামার হাত ধরে প্রায় টানতে-টানতে ভেবলু এক ভলান্টিয়ার ছোকরার দিকে এগিয়ে
গেল। ব্যাপারটা জানাতে
সে ওদের খানিক দূরে ফুটপাতের উপর একটা ঘেরা জায়গায় নিয়ে এল। ভিতরে প্রায় গলদঘর্ম অবস্থায় মাইক্রোফোন নিয়ে বসে রয়েছে
ছোকরা বয়েসী একজন। সামনে এক তাড়া
চিরকুট। ওরা ঢুকতেই ভাঙা
গলায় বলল, ‘কে হারিয়েছে?’
ভেবলু সামনেই ছিল। চটপট উত্তর দিল,
‘আজ্ঞে, মামার জুতো।’
‘আনকোরা নতুন জুতো সার। আজই কেনা।’ মাথা চুলকোতে-চুলকোতে
যোগ করল যষ্টিচরণ।
চিরকুটে লিখতে গিয়ে, গোড়ায় হঠাৎ থেমে গিয়েছিল ছোকরাটা। তারপর কী ভেবে বলল, ‘অ ছিনতাই?’
অতঃপর চটপট ওদের নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা
করতে বলে, ফের মাইক্রোফোন নিয়ে
ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
বাইরে অনেকেই অপেক্ষা করছে। সবই ছেলেপুলে হারানো কেস। দু’জন সেখানে এসে দাঁড়াল। যষ্টিচরণ
একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এ আবার কী
ঝামেলা বাধালি বল দেখি? ঠাকুর দেখতে এসে এভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে
থাকার কোনও মানে হয় এখন?’
কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সেই ভেবলু তখন অদূরে ফুটপাতে
এক অস্থায়ী রেস্তোরাঁর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সামনে মস্ত একটা মেনুবোর্ড। ভিতরে চেয়ার টেবিলে বসে গবগব করে খাবার গিলছে কয়েকজন। ষষ্টিচরণ থামতেই সে বলল, ‘মামা, ওই দ্যাখো স্পেশাল
মোগলাই আর কোবরেজি কাটলেটের দোকান। চলো এই ফাঁকে খেয়ে নিই।’
ভেবলুর বায়না ফেলার উপায় নেই আর। দু’জন রেস্তোরাঁয় ঢুকে একটা ফাঁকা টেবিল দেখে বসে পড়ল।
অর্ডার মাফিক খাবার এসে গেল একটু বাদেই। সঙ্গে ঝকঝকে ছুরি আর কাঁটাচামচ। অনভ্যস্ত হাতে ছুরি আর কাঁটা নিয়ে তারপর যা শুরু হল, তাকে খাওয়া না বলে খাটুনিও বলা যায়। ভেবলু অবশ্য একটু বাদে ছুরি, কাঁটা ফেলে হাত লাগিয়ে দিল। কিন্তু যষ্টিচরণ নিরুপায়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মিনিট পনেরোর প্রাণান্তকর পরিশ্রমে খাবারের প্লেটগুলো যখন খালি
করা গেল, যষ্টিচরণ তখন রীতিমতো ঘামতে শুরু করেছে। ওফ্! কী কুক্ষণেই যে ভেবলুকে নিয়ে পুজো দেখতে বেরিয়েছিল! ঢের হয়েছে। এবার
ভালোয়-ভালোয় বাড়ি ফিরতে পারলে
হতভাগাটাকে নিয়ে জীবনে আর এমুখো নয়।
ইতিমধ্যে চকচকে একটা প্লেটে গোটাকয়েক মৌরির সঙ্গে সাজিয়ে-গুছিয়ে বিল এসে গেছে। ব্যাজার মুখে পাঞ্জাবির বুক পকেটে রাখা মানিব্যাগের দিকে
হাত বাড়িয়েছিল যষ্টিচরণ, মুহূর্তে
দারুণ চমকে চেয়ার-টেয়ার উলটে লাফিয়ে উঠল ভয়ানক ভাবে। ‘আমার মানিব্যাগ!’
মানিব্যাগটা পাঞ্জাবির বুক পকেটেই ছিল। কিন্তু এখন সেটা বিলকুল ফাঁকা। রীতিমতো আর্তনাদ করে উঠল ষষ্টিচরণ, ‘আমার মানিব্যাগ, আমার
মানিব্যাগ চুরি গেছে!’
রেস্তোরাঁর জনা কয়েক ছোকরা ততক্ষণে ছুটে এসেছে। ষষ্টিচরণ তার হাতটা খালি বুক পকেটে ঢুকিয়ে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘আমার
মানিব্যাগটা এই পকেটেই ছিল সার। কখন
চুরি গেছে। এই দেখুন।’
‘এই ভিড়ে বুক পকেটে কেউ মানিব্যাগ রাখে?
আচ্ছা লোক তো মশাই!’ মন্তব্য করল কয়েকজন। রেস্তোরাঁর এক ছোকরা বলল, ‘ভাল করে সাইড পকেটগুলো দেখুন তো।’
‘আঁ!' ছোকরার কথায় সান্ত্বনা
পাওয়া দূরে থাক, বরং হঠাৎ যেন খাবি খেল ষষ্টিচরণ। মুখটা আপনা থেকে হাঁ হয়ে গেল। দেখে ছোকরাটি ফের বলল, ‘হাঁ করে দেখছেন কী মশাই? ভাল করে সাইড পকেট
দুটো দেখুন। ভুল করে রাখতেও
পারেন।’
নেহাত সাধারণ কথা। কিন্তু তাতেই যেন যষ্টিচরণের সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। রীতিমতো তোতলাতে শুরু করল সে, ‘স্-সাইড পকেটে কি-কিচ্ছুটি নেই সার। সত্যি
বলছি, বিলকুল খালি।’
কিন্তু খালি বললেই ছাড়ছে কে? মালিকসহ রেস্তোরাঁর তাবৎ ছেলে-ছোকরা ততক্ষণে ঘিরে ধরেছে তাকে। ‘আচ্ছা লোক
তো মশাই! পকেটে হাত না দিয়ে শুধু চেল্লাচ্ছেন! এদিকে পকেট দুটো তো বেশ ভারিই মনে হচ্ছে!’
‘স্-সত্যি বলছি সার। আ-আমার পকেটে একটা নয়া পয়সাও নেই। বলতে-বলতে দু’হাতে জামার সাইড পকেট দুটো চেপে কয়েক পা পিছিয়ে
গেল ষষ্টিচরণ। রীতিমতো
সন্দেহজনক আচরণ। কে যেন বলল, ‘সাইড পকেট দুটো হাতড়ে দেখুন তো। জোচ্চোর, বদমাশ মনে হচ্ছে।’
বাইরে পুজো প্যান্ডেলের লাউড স্পিকারটাও ওই সময় গমগম
করে উঠল, ‘একটি ঘোষণা, এক জোড়া কালো রঙের নতুন জুতো অল্প আগে ছিনতাই হয়েছে। খোঁজ পেলে…’
ঘোষণা তখনও শেষ হয়নি। যষ্টিচরণ আচমকা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল টেবিলের উপর। তারপর হতভম্ব ভেবলুকে বগলদাবা করে মুহূর্তে এক লাফে চেয়ার
টেবিল উলটে বাইরে রাস্তার উপর।
‘ধর-ধর!’ হই-হই রব উঠল চারপাশে। কিন্তু যষ্টিচরণ ততক্ষণে ওয়ান আপ রাজধানী এক্সপ্রেস। তাকে ধরে সাধ্য কার? হই হট্টগোল পিছনে পড়ে রইল। ভাগনেকে বগলে চেপে গলিঘুঁজি দিয়ে খালি পায়ে প্রায় উড়ে
চলল ষষ্টিচরণ। থামল একেবারে সেই
হাওড়া পুলের মাঝে এসে। ধপাস
করে ভেবলুকে নামিয়ে দিয়ে হাঁসফাঁস করে দম নিতে লাগল। প্রায় ঝোড়ো কাকের মতো অবস্থা। আর ভেবলু তো প্রায় বিধ্বস্ত। কিন্তু এত ধকলেও জুতোজোড়া হস্তচ্যুত হয়নি। দিব্যি দু’হাতে ঝুলছে। হঠাৎ
সেদিকে চোখ পড়তে প্রায় যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল ষষ্টিচরণ।
‘হতভাগা, এখনও ওই অলক্ষুণে
জুতো হাতে রেখেছিস!’ বলতে-বলতে ভাগনের গালে
ঠাস করে এক চড় কশিয়ে দিল সে। তারপর
চারপাশে সাবধানে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে, পাঞ্জাবির দু’ধারের দুই পকেট থেকে সন্তর্পণে টেনে বের
করল হারানো জুতোজোড়া।
আকস্মিক ঘটনার ঘনঘটায় ভেবলু এত দূর ঘাবড়ে গিয়েছিল যে, মামার ওই পেল্লায় চড় খেয়েও কাঁদেনি। গলা শুকিয়ে কাঠ। তার উপর সেই হারানো জুতো মামার পকেট থেকে বেরোতে দেখে
বেচারার চোখ তো উলটে আসার জোগাড়।
কিন্তু যষ্টিচরণের রাগ তখনও পড়েনি। ভাগনেকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘হাঁ করে দেখছিস কী হতভাগা? এক চড়ে তোর মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিলে ঠিক হয় এখন। ওফ্! ধরতে পারলে এতক্ষণে পিটিয়ে মুড়িঘণ্ট বানিয়ে ফেলত। ফ্যাল শিগগির।’
প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেবলুর হাত থেকে জুতোজোড়া একরকম
ছিনিয়ে নিয়ে একসাথে সবগুলো ঝপাং করে ফেলে দিল গঙ্গায়। আর এতক্ষণ পরে ভেবলু কেঁদে ফেলল ভ্যা করে।
ছবি: দিলীপ দাস
প্রথম প্রকাশ: ‘শুকতারা’ জ্যৈষ্ঠ ১৩৯০
দারুন গল্প ,এই গল্পটি প্রথম শুকতারায় বের হয় !
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDeleteখুব সুন্দর...
ReplyDeleteদারুন সুন্দর, খুব উপভোগ্য একটি গল্প।
ReplyDeleteশিশিরবাবুকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
খুব সুন্দর উপভোগ্য একটি গল্প , উপহার দেওয়ায় শিশিরবাবুকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
ReplyDelete