রাত্রে
লীলা মজুমদার
গজুখুড়ো শিউরে উঠে বললেন, ‘উঃ! আর সত্যিমিথ্যে
শুধোসনি রে বাপ! সে রাতের কথা ভুলে যাবার মতো নয় রে। আজ পর্যন্ত বেশি খেলেটেলে,
সে রাতের স্বপ্ন দেখি ! তখন এ রকম ছিলাম না রে ব্যাটারা; প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর আগের কথা। ইয়া তাগড়াই চেহারা ছিল, প্রায় ৬ ফুট ৪৪ ইঞ্চি ছাতি, তা তোরা বিশ্বাস করিস
আর নাই করিস। তোদের আর কি দোষ? নানারকম দুঃখ হতাশায় আর
বয়সের প্রকোপে, কুঁকড়ে এখন না হয় কিঞ্চিৎ নাটা-পানাই
হইছি। তাতে আর আমার বাঘা গজেন নামটা নেই হয়ে যাচ্ছে না। সেকালে হাঁক দিলে পাহাড়
কাঁপত, তা জানিস।
পাহাড় দেশের বন বিভাগে চাকরি করি। যখন-তখন যেখানে সেখানে তদন্তে আর
পরিদর্শনে যেতে হয়। সঙ্গে চলে এক ঢেঁকির অবতার, নাম
তার বটকেষ্ট। সন্ধ্যের আগেই পাহাড় চুড়োয় একটা বাংলোয় পৌঁছানো চাই। সেখানে পৌঁছেই
আরামে হাত পা মেলে বসা যাবে। চিমনিতে গণগণে সরল কাঠের আগুন জলবে; তাতে একটা তিন ঠেঙো আংটায় টগবগ করে ডিমের খিচুড়ি ফুটবে; সারা জীবনের সমস্ত হতাশা ব্যর্থতা ভুলে যাব। ভালো রাঁধে বলে শুনেছি বাংলোর
ঐ ঘেঁটুরাম। আহা জন্মে জন্মে যেন ওকে পাই! আর পেছতে না পারলে বাঘ-বাঘেলাতে ছিঁড়ে
খাবে।
এই সব ভাবতে ভাবতে তো ঝড়বৃষ্টি ঠেঙিয়ে, খাড়া
পাহাড়ের পথ বেয়ে রাত নামলে বাংলোর সামনে পৌঁছলাম। চারদিক মেঘে মেঘে কালো হয়ে
আছে‚ দিন না রাত বোঝা দায়। বাংলোর
করগেটের ছাদে ঝমঝম করে বৃষ্টির ধারা নামছে। বাড়িটিও ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনুষ্য
বাসের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। দরজা জানলা এঁটে বন্ধ। ভিতরে এতটুকু আলো মালুম দিচ্ছে
না। হাড় কাঁপানো শীত।
বটকেষ্টর বয়স কম‚ যদিও মাইনে বেশি, সে
কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে থাকবে। দমান্দম দরজা পিটে চ্যাঁচাতে লাগল‚ কে আছে? দরজা খোল!
আমাদের ইনফর্মেশন হল এ বাংলো ঘেঁটু সরদারের জিম্মায় আছে। তার দিনে ২৪
ঘণ্টা ডিউটি। দশ দিকে চার জোড়া করে চক্ষুকর্ণ খোলা রাখতে না পারলে,
এ জায়গায় পাঁচ মিনিটে লোকে নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু হয়ে যায়,
তা কে না জানে! তবে কি—তবে কি’ কিন্তু বটকেষ্টর কড়ানাড়ানি আর দরজা পেটনিতে মরা মানুষও উঠে বসবে, তাতে কোনো
সন্দেহ নেই। আমি তার আড়ালে দাঁড়িয়ে দুমদামের ফাঁকে ফাঁকে যেন শুনতে পেলাম কাঁপা
কাঁপা গলার নিশ্চয় ঘেঁটু পালোয়নি-ই বলছে‚ কে ? কে ?
কি রে বাবা! কথা কয় না কেন ? ইয়ে
টিয়ে নয়তো? একে শীতে আর ভয়ভাবনায় হাত পা পেটে সেঁদিয়ে
গেল, তার ওপরে আবার ই কি গেরো!
কে তোমরা ?
আমি তখন বটকেষ্টকে সরিয়ে ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে বললাম,
কি জালা! দরজাটা খোলই না! একেবারে বেড়াল-ভেজা হয়ে গেলাম যে?
আমরা জরিপের লোক।’
সাহস পেয়ে ঘেঁটু দরজা খুলে দিল। বটকেষ্ট আগুন হয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল,
আমি তাকে থামিয়ে বললাম, ‘আরে, যেতে দাও। তোমার নাম ঘেঁটু না? কই, ঘরে কি খাবারদাবার আছে, নিয়ে এসো। আমরা ডিমের
খিচুড়ির স্বপ্ন দেখতে দেখতে এয়েছি! চিমনিতে আগুন দাও।’
তাই শুনে আমাদের পদমর্যাদা ভুলে সে ব্যাটা অট্টহাস্য করে উঠল। বেড়ে বললেন
স্যার! নিজে তো আছি বাসি পাঁউরুটি চিবিয়ে। চিমনির চোঙা ঝড়ে উড়ে গেছে। জল ঢুকে
উনুন হয়েছে কাদার ঢিবি। দেশলাই ভিজে সপসপে। একটা বিড়ি পর্যন্ত নেই।'
বললাম, ব্যাস! ব্যাস! আর কথা বাড়িয়ে
লাভ কি? পাঁউরুটি তো আছে? আমাদের
ব্যাগে মাখনও আছে, টিনে মাছ-ও আছে। ওতেই হবে। কি হল ?
বসে পড়লে যে? ভুত দেখেছ নাকি?’
বলা মাত্র তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, খাতির
টাতির ভুলে ঘেঁটু আমার মুখে চেপে ধরল। আমি তো চটে কাঁট! ‘ও কি হচ্ছে! ঠাণ্ডার
সময় ইয়ার্কি ভালো লাগে না বলছি!'
ঘেটু আমার মুখ ছেড়ে দিয়ে হাত কচলে বলল, রাতে
ওনাদের নাম করবেন না স্যার! একা থাকি, বুঝলেন কি না! তা
ছাড়া পাঁউরটিও নেই। অন্নাভাবে খেয়ে ফেলেছি।
‘তাতে কি! আমাদের সঙ্গে বিস্কুট আছে। হাত পা ধোবার জন্য একটু, গরম জল পেতে পারি তো?
‘আজ্ঞে, তা বললে তো চলবে না। ঝাঁঝরি পানা টিনের চাল।
তার মধ্যে দিয়ে জল চুঁইয়ে উনুনের কিছু কি রেখেছে। স্টোভ ঠাণ্ডা, কেরোসিন শেষ‚
তাছাড়া এ জায়গা মোটেই ভালো নয়।
‘তোমার হেপাজতে বাড়ি, তা ছাদ সারাতে পার
না? জল পড়বে কেন ?
‘এ্যাঃ। কোয়ার্টারের মেনটিন্যানস তো ত্রিশ টাকা, তা
ছাদ দিয়ে জল পড়বে না তো কি লেমনেট পড়বে ?
‘আচ্ছা বাবা, আচ্ছা! তা দু’জনের শোবার
জায়গা হবে তো?
কাষ্ঠ হেসে ঘেঁটু আমাদের মিটমিটে টর্চের আলোতে দরজা খুলে দিয়েই পিট্টান।
আমরা বাইরের ঘরে বসে ব্যাগ খুলে বিস্কুট, সন্দেশ,
আপেল আর যে যার ফ্লাস্ক থেকে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চা খেয়ে, ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলাম। চকিতে একবার
চোখে পড়ল পাশাপাশি দুই খাটে বিছানা পাতা, সঙ্গে সঙ্গে
টর্চের ব্যাটারি শেষ, ঘন আঁধার।
যাকগে, এক ঘুমে রাত কাবার করা যাবে।
এই মনে করে অন্ধকারে কাপড় ছেড়ে, বিছানায় শুয়েই একটা মরা
মানুষের কনকনে মুখে হাত পড়ল। আমিও নিঃশব্দে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেলাম। সঙ্গে
সঙ্গে বটকেষ্টর কাঁপা গলা কানে এলো, 'ও গজদা, আমার খাটে যে মরা মানুষের বরফের মতো পা! আমি পড়ে গেছি !
বললাম, চুপ। কাঠ হয়ে পড়ে রইলাম।
ঠিক এই সময়ে আমরা ভির্মি যাবার আগে ক্ষীণ একটা আলো এসে ঘরে পড়ল। দেখি ঘেঁটুরাম
একটা ঘেরাটোপ দেওয়া খুদে লণ্ঠন নিয়ে এসে অবাক! ‘ই
কি স্যার! আপনারা এক খাটের দু’পাশে দুজন মাটিতে এলিয়ে রইছেন যে! তা আমি ভাবলাম
ঘরে যদি অজগর সাপ লুকিয়ে থাকে, জলঝড়ের প্রকোপ থেকে
বাঁচাবার জন্য ঘরে সেধুঁনো অসম্ভব নয়। বলা তো যায় না। তাই আলোটা
দিতে এলাম। একবার কাগজে নাকি লিখেছিল, সকল হোটেলে ডিটেকটিভ
নেই! তার বদলে ইয়া মোটা অজগর। বলা তো যায় না! তা আপনেরা নিচে শুয়ে কেন ?
বটকেষ্ট বলল, যোগাভ্যাস করছি। ভাগো দিকিনি।
আলোটা রেখে যাও।
ঘেটুরাম ঘেরা লণ্ঠন নামিয়ে রেখে বলল, ভালো
কথা। পাশের কাপড় ছাড়ার ঘরে খাটের তলায় আমাদের পোষা ভালকটা ঘুমোচ্ছে। ও জাগলেই
এই বিস্কুট দুটো খাইয়ে দেবেন। ও আবার অচেনা লোক দেখলেই মহা ত্যাঁদড়ামো করে কি না।'
শুনে আমি হাঁ! তুমি তো সাংঘাতিক লোক হে! যদি আমাদের খেয়ে ফেলত?
ঘেঁটুরাম হাসল, ‘আরে না, না। ওরা নিরামিষ খায়। তবে রেগেমেগে যদি কারো হাত পা ছিড়েও নেয়, চমৎকার সব নকল হাত পা পাওয়া যায়!
বটকেষ্ট খাটের তলায় আলো ফেলে বলল, ‘কই ভালুক?
বের কর ভালুক, নইলে তোমার ছাল চামড়া ছাড়িয়ে
নেব। ইয়ার্কি করার জায়গা পাও না। গজুদা, আমার
ওয়াকিংস্টিকটা…
ঘেঁটুর ভোল বদলে গেল! সে বলল, ‘বেঁশ তোঁ,
তাঁই কঁরুন, আঁমাকে লাঁঠিপেটা কঁরে ঠ্যাং ভেঁঙে,
চাঁকরি খেঁয়ে, তাঁড়িয়ে দিঁন! আঁপনারা সুঁখে
থাঁকুন। তঁবে এঁই আঁমি বঁলে দিঁলাম ভাঁলুক অঁজগর নাঁ থাঁকতে পাঁরে, কিঁন্তু এঁই বঁড় বঁড় কাঁকড়াবিছে আঁমি নিঁজে বঁহুবার, দেঁখেছি, এ্যাঁ ও কি! ঠ্যাং তুলে বসলেন যে? তা ভালোই করেছেন। এবার একটু ঘুমের চেষ্টা দিন তো দেখি। শুকতারা উঠেছে,
কুঁকড়ো ডেকেছে, এবার ফরসা হবে!
ইয়ে মানে আমাকে একটু ক্ষ্যামা ঘেন্না করবেন স্যার। কি করি অনিদ্রায় ভুগি
কিনা তাই নানা ভাবে রাত কাটাতে হয়। ভূতের বই পড়ি, ভয়ের
গল্প ভাবি। কি আর বলবো স্যার, ভয়তে বড় আরাম পাই। আচ্ছা,
চলি। সাতটায় হাজিরা দেব।’
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
আপলোড: ২৮/১/২০১৯
Valo, ghetu tahole voot na manush?
ReplyDeleteবাবারে
ReplyDeleteKhub bhalo laglo
ReplyDelete