Pages

Friday 1 January 2021

হরর বড়গল্প (মোবাইল ভাঃ): বাঘ নয়, আরো ভয়ানক (শিশির বিশ্বাস)

 


বাঘ নয়, আরো ভয়ানক

শিশির বিশ্বাস

‘এ সেই সত্তরের দশকের কথা।’ বিনুমামা হঠাৎই শুরু করলেন তাঁর গল্প ‘জীবনে অমন ভয়ানক অবস্থায় পড়িনি কখনো। ভাবতে গেলে এই এতদিন পরেও কেঁপে ওঠে বুক।’

কথা শেষ করে উনি থামলেন অল্প। বিনুমামার হঠাৎ এই থামার কারণ জানা আছে আমাদের। হঠাৎ শুরু করা গল্পটা গুছিয়ে নিচ্ছেন। এদিকে দারুণ এক গল্পের গন্ধ পেয়ে মুহূর্তে সবাই তাঁর কাছে ঘেঁসে এসেছি। রাত প্রায় দশটা হলেও আমাদের শহরতলীর বাড়ির বাইরে তখন নিশুতি রাত। ড্রইংরুমের জানলা দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভিতর অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির কোরাস। এই রাতে বিনুমামাকে পেলেই আমাদের ভূতের গল্পের বায়না করা অভ্যাস। কিন্তু আজ সেই বায়নার আগেই বিনুমামা বোমা ফাটিয়েছেন। গল্পের বিষয়বস্তু আঁচ করার উপায় নেই যদিও তবু কান খাড়া হয়ে উঠেছে সবার।

মা নিজেও মোড়া নিয়ে বসে পড়েছেন অদূরে। ততক্ষণে বিনুমামা শুরু করে দিয়েছেন তাঁর গল্প ‘আগেই বলেছি এ সেই সত্তরের দশকের কথা। সবে নতুন এক অফিসে ঢুকেছি। তারপর অল্প দিনেই খুব কাছের বন্ধু হয়ে গেল সহকর্মী বারীন ব্যানার্জী। একসাথে টিফিন অফিসের পরে সিনেমায় ইভিনিং শো। তখন চৌরঙ্গী পাড়ায় ওয়েস্টার্ন ছবির রমরমা। আমাদের অবশ্য বেশি পছন্দ ছিল ইটালির স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন। খবর পেলেই ছুটতাম। সিনেমা দেখা ছাড়াও দু’জনের মধ্যে বড় মিল ছিল বেপরোয়া স্বভাব। এ ব্যাপারে বারীন কিছু উপরেই ছিল বলা যায়। বিলিতি কোম্পানি। শনিবার ছুটি থাকত ওদের। ছুটিটা হেলায় হারাতে রাজি ছিলাম না কেউ। শুক্রবার অফিসের পরেই ছুটতাম হাওড়া নয়তো শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে। আগে থেকে কিছু ঠিক না থাকলেও বাড়ি থেকে বের হবার সময় কিছু প্রস্তুতি তো থাকতই। কাঁধের ব্যাগে দু’চারটে বাড়তি জামাকাপড়। স্টেশনে পৌঁছে মাঝারি পাল্লার কোনো ট্রেনে টিকিট কেটে উঠে বসতাম। পরের দুটো দিন প্রায় ঘোরের ভিতর কাটিয়ে দেওয়া যেত। সোমবার সেখান থেকে সোজা অফিসে।’

বিনুমামা ফের থামলেন। এখানে নতুন পাঠকদের বলে রাখি ব্যাপারটা শুনতে কিছু অবাক লাগলেও মানুষটার স্বভাবটাই ওই রকম। মনে রাখা দরকার এ যে সময়ের কথা তখন মোবাইল তো দূরস্থ সামান্য একটা টেলিফোন করতে হলেও ছুটতে হত কাছের কোনো পোস্ট অফিসে। নইলে খোশামোদ করতে হত অফিসের টেলিফোন বোর্ডের অপারেটর দিদিদের। তা এই ডানপিটে স্বভাবের জন্য বিনুমামা কোনো অফিসেই বেশিদিন চাকরি করতে পারেননি। সেজন্য পরোয়াও করেননি। ফের নতুন একটা জুটিয়ে নিয়েছেন। নয়তো অন্য কিছু। মানুষটি একেবারেই ব্যতিক্রমী চরিত্রের। অভিজ্ঞতায় ভরপুর। গল্পের ঝুলিও বটে। তাই কাছে পেলেই ছেঁকে ধরি সবাই। নিরাশ করেন না উনিও।

ইতিমধ্যে বিনুমামা ফের তাঁর গল্প শুরু করে দিয়েছেন ‘তবে প্রতি শুক্রবারেই যে এমন হত তা নয়। শনিবারেও বের হয়েছি অনেক দিন। তবে শুক্রবারেই রোমাঞ্চটা ছিল বেশি। যেখানে নামলাম হয়তো গভীর রাত তখন। মজাটাই ছিল আলাদা। তবে যে ঘটনার কথা বলতে বসেছি সেই টুর ছিল কিছু অন্য রকমের। সেবার কী এক ব্যাপারে শুক্রবার অফিস ছুটি। বারীন বলল চল বিনু এই সুযোগে সিমলিপাল থেকে ঘুরে আসি।

‘এখানে বলে রাখি সিমলিপাল জঙ্গল তখন আজকের মতো নয়। পাহাড়–জঙ্গলে ভরা ঘন অরণ্য। সখের টুরিস্টের সংখ্যাও কম। বন্যপ্রাণী শিকার তখনো নিষিদ্ধ হয়নি। যারা যায় তাদের বেশিরভাগই পারমিট নিয়ে শিকারের খোঁজে। শিকার সেই সঙ্গে দিন কয়েক জঙ্গলের ভিতর ফরেস্ট বাংলোয় ইয়ার–বন্ধু নিয়ে হইহই।

‘শুক্রবার ছুটি হলেও যেটুকু জানি তাতে সোমবারের মধ্যে ফিরে আসা সম্ভব নয়। আরো দিন দুয়েক লাগতেই পারে। একে বিলিতি কোম্পানি। তায় নতুন চাকরি। ছুটিও পাওনা নেই। এভাবে বিনা নোটিশে কামাই চাকরি নট হয়েও যেতে পারে। বারীন ব্যানার্জী নিজেও জানে সেটা। তাই আর দ্বিরুক্তি করলাম না। 

‘এমন বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে সেই অর্থে প্রস্তুতি কখনই থাকে না আমাদের। এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে বৃহস্পতিবার রাতে অফিস থেকেই বের হয়ে পড়া সম্ভব হয়নি। সামান্য খোঁজ–খবর নিতে জানা গিয়েছিল এক্ষেত্রে ট্রেন নয় বাসেই সুবিধে। অগত্যা পরের দিন ভোর সকালে এসপ্ল্যানেড পৌঁছে কেওনঝাড়ের বাস। কয়েকজন শুভার্থী অবশ্য পরামর্শ দিয়েছিলেন হাজার হোক বাঘ–ভালুকের জায়গা। কলকাতা থেকে কিছু ব্যবস্থা করে যাওয়া নিদেন পক্ষে কিছু খোঁজ খবর নিয়ে বের হওয়া ভাল।

‘পরামর্শটা অবশ্যই মন্দ নয়। কিন্তু এ যে সময়ের কথা তখন বাইরে বেড়াতে যাওয়া আমাদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই ছিল অ্যাডভেঞ্চার। অনিশ্চয়তায় ভরা রোমাঞ্চ। তখন যা বয়স বুকের পাটা তাতে এমন রোমাঞ্চের মজাই আলাদা। পুরনো অভিজ্ঞতায় বেশ জানতাম কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। অযথা চিন্তার কারণ নেই।

‘সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে নির্দিষ্ট দিন ভোর সকালে চেপে বসেছিলাম কেওনঝাড়গামী বাসে। এসপ্ল্যানেড থেকে তখন ভোরের দিকে বাসটা ছাড়ত। অত সকালে এসপ্ল্যানেড পৌঁছোতে সমস্যা হতে পারে বুঝে আগের দিন ট্যাক্সি ঠিক করে রাখা হয়েছিল। তাই সমস্যায় পড়তে হয়নি।

‘কিছু বেলার দিকে বাস বাংরিপাসি পার হতেই শুরু হল পাহাড়–জঙ্গলে ঘেরা ময়ূরভঞ্জ জেলা। তারই ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। বিশোই যখন পৌঁছুলাম বেলা দুপুর। বাস এখানে আধ ঘণ্টার মতো দাঁড়াবে। দুপুরে খাওয়ার বিরতি। দেরি করলাম না আমরাও। সেই ভোরে এসপ্ল্যানেডে বাস ছাড়ার আগে পেটে সামান্য কিছু দেওয়া হয়েছিল। তারপর পথে ছোট এক ভাঁড় চা ছাড়া কিছুই পড়েনি। অগত্যা পেটে ছুঁচোয় ডন মারতে শুরু করেছে।

‘কাছেই মানানসই এক ধাবা গোছের হোটেল। খাওয়া সেরে দাম মেটাবার সময় কথা হচ্ছিল ম্যানেজার মহান্তিবাবুর সঙ্গে। বাস কেওনঝাড় পর্যন্ত গেলেও আমাদের নামতে হবে যশিপুর। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কিছু খোঁজ খবর নেওয়ার জন্যই ধরেছিলাম ওনাকে। তাতেই নিমেষে হিল্লে হয়ে গেল।

‘মাঝবয়সী মহান্তিবাবু চমৎকার মানুষ। দু’জনের মুখের দিকে খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললেন ‘আগে এসেছেন এদিকে?’

‘উত্তরে মাথা নাড়লাম দু’জন না আসিনি।

‘উনি বললেন কতদূর যাবেন?

‘সিমলিপাল বড় জঙ্গল। ভিতরে রাত কাটাবার জন্য ফরেস্ট লজ বা বাংলো রয়েছে অনেক। যশিপুর থেকে তার অনেকগুলোই বুক করা যায়। বারীন ফস করে বলল চহলা বাংলোটাই কাছে শুনেছি। যদি পাওয়া যায় ওখানেই উঠব আগে।

‘যতদূর জানি চহলা বাংলো খালিই আছে এখন। পেয়ে যাবেন। কিন্তু যাবার ব্যবস্থা কিছু হয়েছে?

‘তেমন কিছু হয়নি এখনো। যশিপুর গিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে।

‘বারীনের উত্তর শুনে মহান্তিবাবু বললেন পেয়ে যাবেন। তবে এক্সট্রা সঙ্গী জোটাতে না পারলে ভাড়া কিছু বেশিই পড়বে হয়তো।

‘মাঝেমধ্যেই বাইরে বেরোনো অভ্যাস। ততক্ষণে মহান্তিবাবুর কথায় কিছু অন্য গন্ধ পেয়ে গেছি। ফস করে বললাম আপনার এখান থেকে কিছু ব্যবস্থা হয়?

‘হবে প্রায় লুফে নিয়ে মহান্তিবাবু বললেন। আমার এখান থেকেও গাড়ি যায় ওদিকে। এক পার্টি জেরান্ডা বাংলো যাবার জন্য আমার এখানে গাড়ি বুক করেছে। কিন্তু পার্টি এখনো এসে পৌঁছায়নি। নইলে আপনাদের এখান থেকেই চহলা যাবার গাড়ি ধরিয়ে দিতে পারতাম। আরামে চলে যেতে পারতেন। ভাড়াও অনেক কম হত।

‘এমন সুযোগ ছাড়া যায় না। আগ্রহে বারীন বলল পার্টি কী আসবেন। তেমন হলে আমরা এখানে অপেক্ষা করতেও পারি।

‘তার দরকার নেই মহান্তিবাবু মাথা ঝাঁকালেন পার্টি আসবেন নিশ্চয়। তবু আপনাদের আটকে রাখা ঠিক হবে না। আপনারা যশিপুর চলে যান। পারমিটের ব্যবস্থা করতেও তো সময় লাগবে। তা ছাড়া টাইগার প্রজেক্টের অফিসে খৈরি রয়েছে। সময় নিয়ে দেখতে পারবেন। আজকাল কলকাতা থেকেও অনেকে যশিপুর আসেন স্রেফ ওই খৈরিকে দেখতেই।’

‘খৈরি! খৈরি কে?’ বিনুমামার কথার মাঝেই আমাদের তরফে প্রায় প্রশ্নের ঝড়।

‘খৈরি যশিপুর টাইগার প্রজেক্টের অফিসে এক পোষা বাঘের নাম।’

‘টাইগার প্রজেক্টের অফিসে বাঘ! খাঁচায় বুঝি?’ বিনুমামার উত্তরে পালটা প্রশ্ন আমাদের।

‘না রে বাপু যশিপুর টাইগার প্রজেক্টের অফিসে খৈরি খাঁচায় বন্দি বাঘ নয়। দিনভর ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ায় অফিস চত্বরে। আসলে প্রজেক্টের ফিল্ড ডাইরেক্টর চৌধুরী সাহেব জঙ্গলের ভিতর বাচ্চাটাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তারপর নিজের বাংলোয় এনে যত্নে বড় করে তুলেছেন। অরণ্যের পরিবেশ না পাওয়ার কারণে খৈরি এখন টাইগার প্রজেক্টের অফিসে মানুষের সঙ্গেই ঘুরে বেড়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। দেশ–বিদেশ থেকে দর্শক আসে। তো খৈরির প্রসঙ্গ থাক। বরং আসল গল্পে ফিরে আসি আবার। মহান্তিবাবুর কথায় এরপর বাসেই আমরা যশিপুর চলে গিয়েছিলাম। উনি গাড়ির নম্বর দিয়ে দিয়েছিলেন। জেরান্ডার পার্টি এসে গেলেই ছেড়ে দেবে গাড়ি। যশিপুর থেকে ধরে নেব আমরা।

‘যশিপুর ফরেস্ট অফিস থেকে চহলা ফরেস্ট বাংলো বুকিং হয়ে গেল সহজেই। মহান্তিবাবু ভুল বলেননি। ফাঁকাই ছিল। যশিপুর ছোট টাউন। ফরেস্ট অফিস টাউনের কিছু বাইরেই হলেও জনবসতি ভালই। দোকানপাট খাবারের ঠেকও কম নয়। হাতে সময় রয়েছে। বুকিংয়ের কাজ শেষ করে গিয়েছিলাম খৈরিকে দেখতে। কিছু নিরাশই হয়েছিলাম বরং। খৈরি পূর্ণ বয়স্ক এক বাঘিনী ঠিকই। কিন্তু অতিরিক্ত যত্ন আর বন্য পরিবেশ না পাওয়ার কারণে সত্যিকারের বাঘিনী আর বলা যায় না। অতিরিক্ত মুটিয়ে প্রায় এক রোলার যেন। চলতে গেলে পেট প্রায় মাটিতে। কয়েক পা গিয়েই বসে পড়ছে থপ করে।

‘বেশি সময় তাই আর নষ্ট করিনি ওখানে। ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম এদিক ওদিকে। গাছপালার ফাঁকে হঠাৎ এক সাধুবাবার থান নজরে পড়তে বারীন পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল সেই দিকে। ডানপিটে বেপরোয়া স্বভাবের হলেও সাধুসন্তদের প্রতি কিছু দুর্বলতা রয়েছে ওর। লক্ষ্য করেছি সামনে তেমন কাউকে দেখলে একবার হলেও ঢুঁ মারা চাই। অগত্যা পিছনে ধাওয়া করেছিলাম আমিও। তেমন বড় গোছের সাধু নয়। একাই এক গাছতলায় বসে কড়ে আঙুলের সমান ছোট এক কাঠের টুকরোয় ছুরি দিয়ে কাটাকুটি করছেন। আমরা সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে হাতের কাজে ব্যস্ত হয়ে রইলেন। সাধারণত এমন খুব একটা হয় না। ভক্ত বা দর্শনার্থী পেলে পথেঘাটে অধিকাংশ সাধুবাবাজি ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাদের নিয়ে। নিঃশব্দে খানিক দাঁড়িয়ে থেকে কিছু নিরাশই হল বারীন। পকেট থেকে একটা টাকা বের করে সামনে রেখে প্রণাম করে ফেরার পথ ধরেছে সাধুবাবা হঠাৎ বললেন থোড়া রুখ যা বেটা।

‘ততক্ষণে খানিক এগিয়ে এসেছি দু’জন। ফিরে গিয়ে দাঁড়ালাম আবার। সাধুবাবা অবশ্য আমাদের দিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য করলেন না। হাতে সেই ছোট কাঠের টুকরো নিয়ে ব্যস্ত। আরো প্রায় মিনিট পাঁচেক পড়ে রইলেন সেটা নিয়ে। তারপর কড়ে আঙুলের মতো সেই ছোট কাঠের টুকরোটা বারীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন এটা সঙ্গে রেখে দে। হাতছাড়া করিসনি।

‘আগেই বলেছি সাধুসন্তর ব্যাপারে বারীনের দুর্বলতা বরাবর। জিনিসটা হাতে নিয়ে ভক্তিভরে কপালে ঠেকিয়ে পকেটে রেখে সামনে বসেই পড়ল এবার। এত যে ব্যাপার সাধুবাবা আমার দিকে একবারও ফিরে তাকাননি। বলেননিও কিছু। তবু বারীনকে বসে পড়তে দেখে বসতে হল আমাকেও। ততক্ষণে বারীন পার্স খুলে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে সামনে রেখেছে। সাধুবাবা অবশ্য সেদিকে তাকালেন না। অস্ফুট গলায় বললেন খানিক দেরি করতে পারবি? ধুনি জ্বালার সময় হয়েছে থেকে দেখেই যা বরং।

‘সাধুবাবার ধুনি জ্বালতে সময় লাগল কম নয়। পাশে বসে উসখুস করছি। আসলে সময় বয়ে যাচ্ছে। বেলাও পড়ে আসছে। ধুনির আগুন তখন জ্বলতে শুরু করেছে বারীন বলল এবার তাহলে যাই বাবা। আমাদের গাড়ি আসার সময় হয়ে আসছে।

‘উত্তরে সাধুবাবা অল্প মাথা নাড়লেন। উঠে এলাম আমরা। দ্রুত পা চালিয়ে ফরেস্ট অফিসের কাছে পৌঁছে যে খবর পেলাম তাতে ভিতরের আশঙ্কাই সত্যি হল। বিশোই থেকে মহান্তিবাবুর গাড়ি খানিক আগে এসেছিল। সামান্য অপেক্ষা করে চলে গেছে তারপর।

‘পথের মাঝে পড়ে পাওয়া সুবিধা সাধুবাবার জন্য নষ্ট হল বলা যায়। তবে তা নিয়ে কেউই উচ্চবাচ্য করিনি। আপসোসও নয়। বেলা পড়ে আসছে। সময় নষ্ট না করে গাড়ির খোঁজ করছি দারুণ এক খবর পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে বনদপ্তরের কয়েকজনের সঙ্গে ভালই পরিচয় হয়ে গেছে। তাদেরই একজন ফরেস্ট গার্ড সেবক দাস। বছর তিরিশ বয়স। চটপটে তরুণ। দেখা হতে অবাক হয়ে বলল ‘আপনাদের গাড়ি তো এসেছিল সার! যাননি?’

‘সে ভাই আমাদেরই দোষে।

‘মাথা নেড়ে সংক্ষেপে ব্যাপারটি ব্যক্ত করল বারীন কী যে করি এখন তাই ভাবছি।

‘বারীনের কথায় সেবক এক মুহূর্ত কী চিন্তা করে যে প্রস্তাব করল তার থেকে ভাল কিছু হয় না।  চহলার কাছে একদল চোরাই কাঠ পার্টির দেখা পাওয়া গেছে। খানিক আগে সেই খবর আসতে বনদপ্তরের একটা জিপ তাদের খোঁজে চহলার দিকে যাচ্ছে। থানায় খবর গেছে। পুলিশ এসে পড়লেই রওনা হয়ে যাবে। দলে তারও যাবার কথা। বড় জিপ। ইচ্ছে করলে আমরাও সঙ্গে যেতে পারি। গাড়ি অবশ্য চহলা ফরেস্ট বাংলো যাবে না। তবে যেখান নামতে হবে সেখান থেকে মাইল খানেক হাঁটা পথ। ওরা অপেক্ষা করছে পুলিশের জন্য। এসে পড়লেই রওনা হয়ে পড়বে।

‘বলা বাহুল্য এ যেন প্রায় মেঘ না চাইতেই জল। মুহূর্তে রাজি হয়ে গেলাম তাহলে তো খুবই ভাল হয় ভাই। নইলে যা অবস্থা দেখছি রাতটা হয়তো এখানেই পড়ে থাকতে হবে।

‘তাহলে আমাদের সঙ্গেই চলে আসুন সার। তা হাটবাজার করেছেন কিছু?

‘হাটবাজার!

‘কিছু অবাক হয়ে তাকালাম দু’জন।

‘হ্যাঁ সার হাটবাজার। যেখানে যাচ্ছেন বলতে গেলে কিছুই কিন্তু মিলবে না সেখানে। চহলা বাংলো দেখাশোনার জন্য মালি আছে অবশ্য। বললে দু’বেলার খাবারও হয়তো জোগান দিতে পারবে। কিন্তু সে মোটা চালের ভাত। সঙ্গে জঙ্গলের বুনো আলুর ঝোল। যে ক’দিন থাকবেন তাই খেতে হবে। কপাল ভাল থাকলে এক–আধ দিন বুনো মুরগি বা কোয়েলের ডিম মিলতেও পারে।

‘সত্যি কথা বলতে কী দু’জন যে ধরণের মানুষ ওসব খাবারে ভালই অভ্যস্থ। তবু প্রস্তাবটা কেন জানি না মনে ধরে গেল। যাব তো বনদপ্তরের গাড়িতে। সুযোগ যখন পাওয়া গেছে দুটো দিন ভালমন্দ দিয়ে পেট ভরাতে আপত্তি কোথায়? অগত্যা ছুটলাম হাটবাজারের খোঁজে।

‘বাইরে বের হলে এসব বারীনই সামলায়। আমি একেবারেই মাথা গলাই না। তা দিলদরিয়া মানুষ বারীন অল্প সময়ের মধ্যে চাল–ডাল–আলু সমেত মালপত্র যা কিনে ফেলল প্রায় গন্ধমাদনের সামিল। কেনাকাটা শেষ করে ফেরার পথ ধরেছি দেখি পথের পাশে এক দেহাতি মানুষ একজোড়া তাগড়াই মোরগ নিয়ে বসে আছে। গ্রামের চরে খাওয়া মোরগ। এক একটার ওজন কেজি চারেকের কম নয়। কলকাতার বাজারে দেখা যায় না তেমন। অগত্যা বারীন যে ঝাঁপিয়ে পড়বে জানাই ছিল। কিন্তু হোঁচট খেতে হল গোড়াতেই। দেহাতি মোরগওয়াল জানিয়ে দিল নিতে হলে দুটোই কিনতে হবে। হঠাৎ খুব বিপদে পড়ে টাকার দরকার হওয়ায় অনেক দূরের গ্রাম থেকে আসছে। সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। অথচ একটা মোরগ বেচে তার প্রয়োজন মিটবে না। দুটো এক সঙ্গে নিলে কিছু সস্তাতেও দেবে।

‘অত বড় দুটো মোরগ। দামও কম নয়। ইচ্ছে থাকলেও বারীন মনস্থির করতে পারছিল না। এদিকে দেহাতি লোকটার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম একটা কথাও মিথ্যে বলেনি বেচারা। টাকাটা খুবই দরকার। কী খেয়ালে ফস করে বলে ফেললাম নিয়ে নে বারীন। একটার দাম দিয়ে দেব আমি।

‘আমার প্রস্তাবে বারীন রাজি হবে না জানতাম। আসলে ওকে উসকে দেবার জন্যই বলা। হলও তাই। মুহূর্তে বলল তা হবে কেন? দুজনেই দেব।

‘মুহূর্তে মনস্থির করে দুটো মোরগই এরপর কিনে ফেলল বারীন।

‘যাই হোক শেষ পর্যন্ত থানা থেকে জনা দুই পুলিশ যখন এসে পৌঁছল অনেকটা সময় চলে গেছে। ঠিক ছিল একজন রেঞ্জার যাবেন। কিন্তু দেরি হবার কারণে তিনি আর গেলেন না। পরিবর্তে এলেন বিট অফিসার ধবল মিশ্র। ভুঁড়ি সর্বস্ব থলথলে শরীর। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। গাল ভরতি পান চিবোতে চিবোতে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বার কয়েক হাত কপালে ঠেকালেন আগে। তারপর উঠে বসলেন সামনের সিটে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এই অবেলায় বের হতে যথেষ্টই আপত্তি ছিল তাঁর। কিন্তু রেঞ্জার সাহেবের কথায় না করতে পারেননি।

‘আমরা অবশ্য মালপত্র নিয়ে আগেই গাড়িতে। অগত্যা মিশ্র সাহেব উঠে বসতেই ছেড়ে দিল।’

এই পর্যন্ত বলে বিনুমামা থামলেন আবার। আমাদের উৎসুক মুখগুলোর দিকে অল্প চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন ‘এ যে সময়ের কথা সিমলিপাল অরণ্য তখন ভয়ানক বললেও কম বলা হয়। ভিতরে এমন ঘন জঙ্গল অনেক জায়গায় দিনের বেলাতেও গাড়ির হেড লাইট জ্বালতে হয়। এদিকে পথও কম নয়। অথচ গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে বিকেল প্রায় চারটে। তবু শহর ছাড়িয়ে গ্রামের পথে চলতে মন্দ লাগছিল না। কিন্তু গ্রাম ছাড়িয়ে জঙ্গলের পথ ধরতেই মালুম পাওয়া গেল পথ একেবারেই ভাল নয়। জঙ্গলে ঢোকার মুখেই এক চেকপোস্ট। এখানে জঙ্গলে ঢোকার অনুমতিপত্র চেক করা হয়। কিন্তু আমাদের গাড়ি বনদপ্তরের। তার উপর সামনে সিটে বিট অফিসার হাত নাড়ছেন দেখে গাড়ি কাছে পৌঁছোবার আগেই খুলে গেছে গেট। থামতে হয়নি। মিনিট পনেরো পরে ফের এক চেকপোস্ট। থামতে হল না সেখানেও। কিন্তু পথের অবস্থা একেবারেই ভাল নয়। উঁচু–নিচু অসমতল পথ। তার উপর পথের অনেক স্থান দিয়েই বয়ে চলেছে জলধারা। কাছেই পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসা ঝরনার জল। অনেক দিন মেরামত না হওয়ার কারণে যথেষ্টই খারাপ অবস্থা। এ ছাড়া অনেক স্থানেই পাহাড়ি পথ। ঘন ঘন বাঁক আর চড়াই উতরাই। ঝাঁকুনিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার জোগাড়। তারই মাঝে একসময় নেমে এল অন্ধকার। দু’জনের অবস্থা অনুমান করে সেবক দাস বলল সবে অর্ধেক পথ এসেছি সার। গাড়ি আটটার আগে পৌঁছবে না।

‘সন্ধে নামার পর জঙ্গলের অবস্থা দেখে ততক্ষণে প্রমাদ গণে ফেলেছি। সরু পথের দুই পাশে শুধু ঘন জঙ্গল আর জঙ্গল। অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির কোরাস। তারই ভিতর আচমকা এক–আধটা রাতজাগা পাখির চিৎকার। রাতের পাখির ডাক যে এমন ভয়ানক হয় জানা ছিল না। অন্ধকারে বসে মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিল চহলা বনবাংলোর আগে যেখানে আমাদের নামিয়ে দেবার কথা সেখান থেকে এত মালপত্র নিয়ে এই অন্ধকার জঙ্গলের পথ ধরে যাব কী করে।

‘পাশে বারীনকে সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সে তখন সেবক দাসের সঙ্গে দিব্যি গল্প জুড়ে দিয়েছে। সেবকের কথাতেই বুঝলাম আমাদের নামিয়ে দিয়ে ওরা এগিয়ে যাবে আরো ভিতরে এক দেহাতি গ্রামের দিকে। খবর সেই গ্রামের কাছেই ডাঁই হয়েছে অনেক কাটা গাছের গুঁড়ি। রাত হলেও সমস্যা হবে না। কাজ মিটিয়ে রাতেই যশিপুর ফিরে যাবে ওরা। একান্তই সম্ভব না হলে থেকে যাবে কোনো ফরেস্ট বাংলোয়। তাই শুনে বারীন হঠাৎ বলে ফেলল তা সেবকদা এই রাতে কোনো কারণে যদি যশিপুর ফেরা সম্ভব না হয় সবাই চলে আসবেন চহলা বাংলোয়। মালির আপত্তি না হলে মুরগির ঝোল–ভাতের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

‘এদিকে বাংলা কথা বোঝে সবাই। ভাল বলতেও পারে অনেকে। সামনে বসে বিট অফিসার ধবল মিশ্র নিশ্চয় শুনছিলেন সব। হঠাৎ বললেন গাড়িতে মুরগি আছে নাকি?

‘বিট অফিসারের কথায় থতমত খেয়ে ঢোঁক গিলল সেবক দাস। বিট অফিসার ধবল মিশ্রর কথা আগেই শুনেছি ওর কাছে। নিষ্ঠাবান মানুষ। মাছ–মাংস খান না। মুখ ফসকে বলে ফেলে বারীন যে একেবারেই ঠিক করেনি নিজেও বুঝতে পারছিল। উত্তর দিল সেবক দাসই। আমতা আমতা করে বলল আছে সার। ফরেস্ট বাংলোয় দিন দুয়েক থাকবেন ওনারা। তাই সঙ্গে নিয়েছেন।

‘এই রাতের গাড়িতে মুরগি! মানা করা উচিত ছিল তোমার।

‘ধবল মিশ্রর কণ্ঠে রীতিমতো ক্ষোভ ঝরে পড়ল। উত্তরে সেবক দাস নীরব থাকলেও বারীন তাড়াতাড়ি বলল ওনার দোষ নেই সার। কেনার সময় উনি ছিলেন না। মানা করবেন কী করে?

‘বারীনের সাফ উত্তরে ভদ্রলোক কিছু নরম হয়ে বললেন আপনারা ঠিক করেননি ভাই। আজকের রাতটা ভাল নয়। তার উপর যাচ্ছি এক ঝামেলার কাজে।

‘বাইরে দুই দিকে জমাট অন্ধকার হলেও হেডলাইটের আলো গাছপালায় প্রতিফলিত হবার কারণে গাড়ির ভিতর অন্ধকার তেমন জমাট নয়। বারীন বা আমি ফের কী উত্তর দেই সেই আশঙ্কায় সেবক দাস চোখের ইশারায় মানা করল আমাদের। কেউ তাই আর কথা বাড়ালাম না। কিন্তু ঝামেলা তবু হয়েই গেল। সমতল জমি পেয়ে গাড়ি তখন বেশ জোরেই ছুটেছে হঠাৎই কী কারণে সিটের তলায় রাখা একটা মোরগ হঠাৎ তারস্বরে ডেকে উঠল কোঁক–ক–র্–র্–র্–কোঁ–ও–ও–ও…

‘দেখাদেখি তান ধরল অন্যটাও।

‘দুই মোরগের হঠাৎ সেই চিৎকারে সিঁটিয়ে আছি তখন। মিশ্র সাহেব ফের কী বলে ওঠেন ভাবছি। তার মধ্যেই কাঁ–আঁ–আঁ–ক্ করে বড় একটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি। ড্রাইভারের হঠাৎ এমন ব্রেক কষার কারণ বুঝতে কোনোমতে ঝাঁকুনি সামলে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে বাইরে চোখ ফেলেছিলাম। মুহূর্তে সারা শরীর কেঁপে উঠল। হাত কয়েক দূরে পথের উপর এক জলধারা। খানিক দুরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে আসা ঝরনার জল বয়ে চলেছে পথের উপর দিয়ে। সেই তিরতির জলধারার উপর খেলা করছে দুটো বিশাল বড় সাপ। হাত পনেরোর কম কোনোটাই নয়। ওধারে বসে ফরেস্ট গার্ড সেবক দাস সেদিকে তাকিয়ে বার কয়েক কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল সার জোড়া কিং কোবরা!

‘কিং কোবরা মানে শঙ্খচূড় চিড়িয়াখানা ছাড়া আগে দেখিনি কখনো। ইতিমধ্যে তীব্র আলোর কারণে দুটো সাপই ফণা তুলে খাড়া হয়ে উঠেছে। ভূমি থেকে অন্তত হাত তিনেক উঁচুতে ফণা তোলা দু’দুটো মাথা মৃদু দুলছে। ঘন ঘন চেরা জিভ যেভাবে বাইরে বের হয়ে আসছে বুঝতে বিলম্ব হয় না যথেষ্টই বিরক্ত। 

‘ইতিমধ্যে বার কয়েক জঙ্গলে ঘোরা হয়ে গেছে। দেখা হয়ে গেছে নেকড়ে চিতাবাঘ এমনকী ডোরাকাটা কেঁদোবাঘও। কিন্তু এমন কিং কোবরা দেখিনি আগে। কিন্তু দারুণ সেই দৃশ্য চোখ ভরে দেখব কী এই অন্ধকার রাতে গাড়ি কীভাবে ওদের পাশ কাটাবে তাই ভেবেই কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। যেভাবে সাপ দুটো হাত তিনেক উঁচুতে ফণা তুলে রয়েছে খোলা জিপ নিয়ে পাশ কাটানো অসম্ভব।

‘প্রায় দম বন্ধ করে তাকিয়ে আছি। ব্যতিক্রম নয় অন্যরাও। ড্রাইভার ইতিমধ্যে হেডলাইট অফ–অন করতে লেগেছে যদি ভয় পেয়ে স্থানত্যাগ করে সেই আশায়। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীতই হয়েছে বরং। দুই সর্পরাজের চেরা জিব বাতাস চাটছে আরো ঘন–ঘন। অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির কোরাসের ভিতরে চাপা ফোঁস–ফোঁস শব্দ।

‘মিনিট কয়েক কেটে গেছে তারপর। একসময় তো ভাবতে শুরু করেছি গাড়ি আর না এগিয়ে ফেরার পথই ধরবে হয়তো। কিন্তু এই সরু রাস্তায় সেটাও খুব সহজ নয় বলেই ড্রাইভার সেই চেষ্টা করেনি। এই যখন অবস্থা হঠাৎই সিটের তলায় মোরগ দুটো ফের তারস্বরে ডাকতে শুরু করল। এবারের গলার স্বর আগের মতো নয়। মনে হল ভীষণ ভয় পেয়েছে যেন। রীতিমতো কাঁপছে গলা। অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল সেই সময়। অদূরে ফণা উঁচু করে থাকা প্রায় স্থির সাপ দুটো হঠাৎই নড়ে উঠল কেমন। মুহূর্তে মাথা নামিয়ে ঢুকে পড়ল পথের পাশে জঙ্গলের ভিতর। দীর্ঘ দেহটা অদৃশ্য হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল অবশ্য।

‘দেখে প্রায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। সামনে মিশ্র সাহেব তো কপালে হাত ছুঁয়ে বলেই ফেললেন না সার আপনাদের মোরগ দুটোই আজ বাঁচিয়ে দিল দেখছি। এত দিন চাকরি এত বড় কিং কোবরা আগে দেখিনি। বাপরে!

‘আমরা কেউ অবশ্য জবাব দিলাম না। আসলে বিপদ দূর হলেও তার ধকল তখনো সামলাতে পারিনি কেউ। ইঞ্জিন চালুই ছিল। মিনিট দুই অপেক্ষার পর গাড়ি চলতে শুরু করল আবার। তারপর পথের উপর সেই জলধারা পার হতে গিয়ে যা ঘটল স্বপ্নেও ভাবা যায়নি। হঠাৎ গাড়ির পিছনের দুই চাকা ভীষণভাবে স্কিড করতে শুরু করল। ছরছর শব্দে সমানে কাদাজল ছিটকে উঠতে লাগল। সন্দেহ নেই জলধারার কারণে নরম মাটি কাদা হয়ে ছিল। তার উপর গাড়ি এসে পড়তেই চাকা স্কিড করতে শুরু করেছে। মিনিট খানেক চেষ্টার পর ড্রাইভার শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে জানিয়ে দিল নেমে ঠেলতে হবে গাড়ি।

‘জলধারার কাদা অংশ বেশি নয়। ঠেলে দেওয়াই যায়। কিন্তু খানিক আগের সেই ভয়ানক ব্যাপারের পর কেউ নামতে ভরসা পাচ্ছিল না। এমন কী ফরেস্ট গার্ড সেবক দাসরাও। কারো মুখেই কথা নেই। বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারছে না কেউ। ওই সময় খুব কাছে আচমকা জোরাল ঝিঁঝির আওয়াজ শুরু হল। জঙ্গলে ঝিঁঝির আওয়াজ নতুন কিছু নয়। বিকেলের আলো পড়ে আসতে পথের দুই পাশে ঝিঁঝির আওয়াজ চলছেই। কিন্তু এত জোরাল কখনো নয়। অন্ধকার রাতে নির্জন বনের ভিতর আচমকা সেই আওয়াজে বুকের ভিতর হঠাৎ কেঁপে উঠল।

বিট অফিসার ধবল মিশ্র কান পেতে সেই আওয়াজ সামান্য শুনে হঠাৎই নড়ে উঠলেন। সামান্য গলা ঝেড়ে নিয়ে পিছনে সেবকের নাম ধরে ডাকলেন।

‘মুহূর্তে সন্ত্রস্ত সেবক দাসের উত্তর বলেন সার।

‘আগেই বলেছিলাম রাতটা ভাল নয়।

‘সার।

‘সেবক উত্তর করতেই উনি বললেন গাড়িতে ওই মোরগ আর এক মুহূর্ত রাখা যাবে না। নজর লেগেছে কারো। দেরি না করে বাইরে ফেলে দে এখুনি।

‘বলে কী ভদ্রলোক! অল্প আগে কেনা জোড়া মোরগ। দুটো মিলিয়ে ওজন কেজি সাতেকের কম নয়। সেই জোড়া মোরগ বাইরে ফেলে দিতে বলছেন ভদ্রলোক!

‘সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। দেখি ইতিমধ্যে ফরেস্ট গার্ড সেবক দাস ঝুঁকে পড়েছে পাশে বারীনের উপর। ফিসফিস করে বলছে কিছু। উত্তরে বারীনও ঘাড় নাড়ল সামান্য। সেবক অতঃপর এক মুহূর্ত দেরি না করে সিটের তলা থেকে দড়ি বাঁধা মোরগ দুটো টেনে বের করে আনল।

‘মোরগ দুটো সেই যে কাঁপা গলায় ডাকতে শুরু করেছিল। তারপর থামেনি আর। এবার সেবক তাদের বাইরে টেনে আনতেই শুরু হল পরিত্রাহি চিৎকার। সেবক অবশ্য তাতে কান দিল না। সামনে খোলা দরজা দিয়ে মুহূর্তে ছুঁড়ে দিল বাইরে। 

‘কাঁ–আঁ–আঁ–আঁ শব্দে পরিত্রাহি চিৎকারে দুটো মোরগই পাখা ঝাপটে ছিটকে গেল বাইরের অন্ধকারে। হঠাৎই দেখলাম অন্ধকারের ভিতর থেকে নিকষ কালো দুটো দীর্ঘ লম্বা হাত বেরিয়ে এসে শূন্যেই লুফে নিল তাদের। নিমেষে ফের হারিয়ে গেল অন্ধকারের ভিতর। মোরগ দুটোর আর্তনাদও থেমে গেল মুহূর্তে। আর কী কাণ্ড! ফের স্টার্ট দিতে গাড়িও দিব্যি গড়াতে শুরু করল সেই কাদায় ভরা জলধারার উপর দিয়ে। চাকা স্কিড করল না একবারের জন্যও।’

‘সে কী!’ বিনুমামা হঠাৎ থামতে আমরা তখন তাঁর গায়ে কাছে ঘেঁসে এসেছি প্রায়।

‘হ্যাঁ রে একদম তাই। প্রথমে মনে হয়েছিল অন্ধকার ফুঁড়ে হঠাৎই বের হয়ে আসা সেই কালো লম্বা হাত স্রেফ দেখার ভুল। কিন্তু তাই যদি হবে ছুঁড়ে দেওয়া মোরগ দুটো শূন্যে লুফে নিল কে? গাড়ি থেকে খুব দূরে তো নয়! চোখের পলকে অত বড় দুটো মোরগ অন্ধকারে শুধু হারিয়ে যাওয়া নয় তাদের আর্ত চিৎকার নিমেষে থেমে যাওয়ার কোনো ব্যাখ্যাও তো দিতে পারিনি সেদিন। সবটাই কেমন হেঁয়ালির মতো।’

‘তারপর?’

‘অদ্ভুত ব্যাপারটা নিয়ে গাড়িতে কেউ আর একটি কথাও বলেনি তারপর। বার কয়েক কপালে হাত ছোঁয়ানো ছাড়া কারো মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হয়নি। মুখে কুলুপ আঁটা সবার।

‘পথে অবশ্য কোনো ঝামেলা হয়নি তারপর। আমাদেরও আর পথের মাঝে নামিয়ে দেওয়া হয়নি। বিট অফিসার ধবল মিশ্রই ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়েছিল এই রাতে পথের উপর নামিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। আমাদের যেন চহলা ফরেস্ট বাংলোতেই পৌঁছে দেওয়া হয়। আদেশ পেয়ে ড্রাইভারও আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল চহলা বাংলোর দোর গোড়ায়। সমস্যায় পড়তে হয়নি।

গভীর জঙ্গলের মাঝে চহলা বাংলো এককথায় চমৎকার। চারপাশে ইউক্যালিপটাসের সারি। খানিক আগে সেই ভয়ানক ঘটনার পর প্রায় হাঁফ ছাড়লাম যেন। বাংলোর মালি ভুনি ওঁরাও বেজায় ভাল মানুষ। তৎক্ষণাৎ বাংলোর সবচেয়ে ভাল ঘরটাই খুলে দিল আমাদের জন্য। এক ফাঁকে শুধু বলল এই সময় না এলেই ভাল করতেন বাবু। দিন কয়েক হল এদিকে ঘন ঘন বাঘ বের হচ্ছে। 

‘নিরাপদ আশ্রয় মিলতে আমরা অবশ্য তার কথা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাইনি। বারীন তো বলেই ফেলল ভাগ্যিস সাধুবাবার জন্য গাড়ি ফেল হয়েছিল। নইলে আজকের দারুণ অভিজ্ঞতাটা মাঠে মারা যেত। নগদ টাকায় কেনা দু’দুটো মোরগ খোয়া গেছে অবশ্য। কিন্তু যে অভিজ্ঞতা হল তার দাম আরো বেশি কী বলিস?

‘উত্তরে ঘাড় নেড়েছিলাম শুধু। তখন কী আর জানতাম আরো বড় ভয়ানক অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।’

বিনুমামা ফের থামলেন। টুলটুলি বলল ‘তাহলে বাঘের সামনেই পড়ে গিয়েছিলে নাকি মামা?’

‘বাঘ কী বলছিস! বাঘের চাইতেও ভয়ানক! গোড়াতেই তো বলেছি জীবনে অমন বিপদে আর পড়িনি কখনো।

‘পরের দুটো দিন প্রায় ঘোরের মধ্যে মধ্যে পার হয়ে গেল। ভেবেছিলাম জেনাবিল আর জেরান্ডাও ঘুরে আসব। পরের দিন সুযোগও মিলে গিয়েছিল। চহলা হয়ে এক জিপ যাচ্ছে জেনাবিলের দিকে। চড়ে বসলেই হত। কিন্তু সবে গতকাল এসেছি মন সায় দিল না। তার উপর গত রাতে ভুনি ওঁরাওয়ের হাতের রান্না খেয়ে মজে গেছি বলা যায়। জলজ্যান্ত দুটো মোরগ পথের মাঝে ওইভাবে খুইয়ে বারীনের তখন জেদ চেপে গিয়েছিল বোধ হয়। হঠাৎই বলে ফেলেছিল রাতে মুরগির ব্যবস্থা করা যাবে ভুনি?

‘বারীনকে তো চিনি। নেহাতই কথার কথা। এই রাতে ও নিজেও আসা করেনি। কিন্তু ফরমাস হতেই ভুনি ওঁরাও দিব্যি জুটিয়ে ফেলল কোথা থেকে। রাতে সেই দেহাতি মুরগির ঝোল আর গরম ভাত খেয়ে ফ্লাট হয়ে গেছি প্রায়। ভুনি ওঁরাও কথা দিয়েছে মুরগি জুটিয়ে আনবে আজও। অগত্যা বাতিল করে দিলাম সেই সুযোগ।

‘চহলা বাংলো ঘন জঙ্গলের ভিতর। বাংলোর হাতায় সার দিয়ে শুধু ইউক্যালিপটাস। তারপরেই গভীর ঘন জঙ্গল। সকাল থেকে শুধু পাখির কলরব। তারই ফাঁকে দু’একটা কোটরা হরিণের ডাক। গত রাতে বার কয়েক হাতির ডাক শোনা গেলেও দিনে আর শুনতে পাইনি। সকালে গরম খিচুড়ি দিয়ে ব্রেক ফার্স্ট সারা হবার পর ঠিক হল কাছেই কায়রাকোচার বাংলো ঘুরে আসব। বলা বাহুল্য খবরটা ভুনি ওঁরাওয়ের কাছেই পাওয়া গিয়েছিল। মাত্রই মাইল আড়াই পথ। ছোট এক ছেলে ঝগড়ুকেও দিয়ে দিয়েছিল সঙ্গে।

‘বছর দশেক বয়স হলেও বেশ কাজের ছেলে ঝগড়ু। জঙ্গলের পথঘাট হাতের তালুর মতো চেনা। তার সঙ্গে জঙ্গলের লাল কাঁকড় বিছানো পথে চারপাশের মনোরম দৃশ্য আর পাখির ডাক শুনতে শুনতে পথ চলার কষ্ট টের পাইনি একদম। যদিও পথের দু’ধারে ঘন জঙ্গল। বন্য জন্তুর আনাগোনা বোঝার জন্য পথের পাশে খানিক দূর অন্তর রয়েছে ইমপ্রেশন প্যাড মানে খানিকটা জায়গার মাটি ঝুরো করে কুপিয়ে রাখা। তার উপর হরিণ শুয়োর থেকে শুরু করে বাঘ–হাতি পর্যন্ত একাধিক জন্তুর পায়ের ছাপ। কতক একদম টাটকা। দেখেই বোঝা যায় তাদের নিয়মিত আনাগোনা রয়েছে। তবে দু’চারটে বানর ছাড়া অন্য কিছুই চোখে পড়েনি। তাই সাহস কিছু বেড়েই গিয়েছিল বরং। তার উপর মন ভাল করে দেওয়া অবিশ্রান্ত পাখির ডাক। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কায়রাকোচার বাংলোয়। ফেরার পথে অনেকটাই চলে এসেছি তখন ঝগড়ু হঠাৎ পথের পাশে এক ইমপ্রেশন প্যাডের সামনে থেমে বলল এই দেখুন বাবু টাটকা বাঘের পায়ের ছাপ।

‘তাকিয়ে দেখি ঝুরো মাটির উপর একদম টাটকা বাঘের পায়ের ছাপ। গজেন্দ্র গমনে তিনি চলেছেন আমাদের খানিক আগে। চহলার দিকেই। আকারে যথেষ্ট বড় সেই পায়ের ছাপ দেখে বেজায় ভয় যে পেয়েছিলাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হোক না দিন ঘন জঙ্গলের মধ্যে নিরস্ত্র তিনটি মানুষ। অদূরে গাছের আড়াল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লে… ভাবতে গিয়ে ঘুরে উঠেছিল মাথা। বলা যায় বুকে বল পেলাম ঝগড়ুর কথায়।

‘মাথা ঝাঁকিয়ে যা জানাল তার মোদ্দা অর্থ অযথা ভয় পাবার কিছু নেই। বাঘটা সকালে শিকারের খোঁজেই বের হয়েছে বটে। তবে আমরা তার লক্ষ্য নই তাই আগে চলেছে। সিমলিপাল জঙ্গলের খুব কম বাঘই নরখাদক। বনের স্বাভাবিক খাদ্য হরিণ বা শুয়োর শিকারে অক্ষম হয়ে না পড়লে মানুষের দিকে নজর দেয় না।

‘সেদিন অনেকগুলো ইমপ্রেশন প্যাডে তার পায়ের ছাপ দেখেছিলাম। বরাবর আমাদের আগে আগে চলেছে চহলার দিকে। একসময় তো ভয় হচ্ছিল চোখের সামনে পড়ে না যায়। তাহলে কী যে হত ভগবানই জানেন কিন্তু একবারও তিনি দেখা দেননি। বাঘটা অবশ্য চহলা পর্যন্ত যায়নি। তার আগেই জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গিয়েছিল। আমরাও হাঁফ ছেড়েছিলাম।’

বিনুমামা থামতেই টুলটুলি বলল ‘এ তো দারুণ অভিজ্ঞতা মামা!’

‘দারুণ তো বটেই।’ বিনুমামা অল্প হাসলেন ‘আর সেই দারুণ অভিজ্ঞতাটাই পরের দিন কাল হয়ে গেল।’

‘কেন? কেন মামা?’

‘সেটাই তো বলতে বসেছি রে।’ সামান্য দম নিয়ে বিনুমামা ফের শুরু করলেন ‘চহলা ফরেস্ট বাংলো থেকে মোরামের পথ বেরিয়েছে আরো একটা। চক্রাকারে বনের ভিতর মাইল কয়েকে গিয়ে ফের চহলাতেই ফিরে এসেছে। অর্থাৎ সেই পথ বরাবর চললে গভীর বনের মধ্যে দিয়ে ঘুরে ফের চহলার ফরেস্ট বাংলোতেই ফিরে আসা যায়। পরের দিন খবরটা শুনেই ঠিক করে ফেললাম ঝগড়ু নয় নিজেরাই যাব। অ্যাডভেঞ্চারটা আরো দারুণ হবে। প্রস্তাবটা অবশ্য বারীনই দিয়েছিল। মুহূর্তে লুফে নিয়েছিলাম আমিও। গতকালের অভিজ্ঞতা এই সুযোগে আরো জমাট করে নেওয়াই যায়।

‘ভাবা হয়েছিল একটু সকালের দিকেই বের হব। কিন্তু সেটা আর হল না। অনেকটাই পথ। ঠিক হল দুপুরের খাওয়ার কাজটা সেরেই যাওয়া ভাল। অগত্যা দেহাতি মুরগির ঝোল–ভাত খেয়ে যখন রওনা দিলাম দুপুর পার হয়ে গেছে। বেলা প্রায় তিনটে। তবে তা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাইনি। ঝাড়া হাত–পা মানুষ দু’জন। একটু পা চালিয়ে চললে সন্ধের আগেই বেশ ফিরে আসতে পারব।

‘কিন্তু যা ভাবা যায় তাই কী সব সময় হয়? বনের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথটা প্রায় চক্রব্যূহর মতো। তার উপর অজস্র পাখির ডাক। ভাগ্য ভাল বলতে হবে দুই জায়গায় হরিণের ঝাঁকেরও দেখা পাওয়া গেল। পথের পাশে হঠাৎ ঝনঝন শব্দে চমকে তাকিয়ে দেখি একেবারে জোড়া সজারু। খানিক পরে দূরে ডালপালা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনে যখন ভাবছি গাছ কাটা হচ্ছে বোধ হয়। কিন্তু এগিয়ে যেতে মালুম পেলাম ব্যাপারটা। রাস্তা থেকে খানিক নীচে এক পাল হাতি। ডাল ভেঙে নামিয়ে পাতা দিয়ে ভোজের আসর বসিয়েছে। ভাগ্যিস জায়গাটা অনেক নীচে তাই নিশ্চিন্তেই দাঁড়িয়ে দেখলাম খানিক।

‘এসব কারণে যে দেরি হয়ে যাচ্ছে খেয়ালই হয়নি গোড়ায়। যখন সেটা মালুম হল সূর্য অনেকটাই ঢলে পড়েছে। বনের ভিতরে আলো বেশ কমে এসেছে। দ্রুত পা চালাচ্ছি ডানদিকে জঙ্গল অনেকটা হালকা দেখে বারীন পরামর্শ দিল চল বিনু একটু শর্টকাট করা যাক।

‘বারীন এরপর যে পরামর্শ দিল সেটা মন্দ নয়। আগেই বলেছি জঙ্গলের ভিতর পথ অনেকটা বৃত্তাকার। ক্রমশ ডানদিকে বেঁকে গেছে। অর্থাৎ ডানদিকে হালকা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গেলে ফের চলার পথেই পড়ব আবার। অনেক সংক্ষিপ্ত হবে। 

‘অগত্যা দু’জন নেমে পড়লাম ডানদিকের হালকা জঙ্গলে। কিন্তু প্রায় মিনিট পনেরো পথ চলার পর যখন পথের হদিস পাওয়া গেল না টনক নড়ল। এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়! এদিকে হালকা জঙ্গল ততক্ষণে আর হালকা নেই যথেষ্টই ঘন। পড়ন্ত বিকেলে আলো ভয়ানক কম। সামনে হাত কয়েকের বেশি নজর পড়ে না। যে কোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। দু’জন আর না এগিয়ে ফিরে যাব কিনা ভাবছি। আচমকা বন কাঁপিয়ে বাঘের ডাক। যে দিক থেকে এসেছি সেই দিক থেকে।

‘দু’দিন হল এসেছি বাঘের পায়ের ছাপ দেখলেও বাঘের আওয়াজ কখনো শুনিনি। ঘন জঙ্গলের ভিতর দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হল কেউ বুঝি বেঁচে নেই আর। জারিজুরি নিমেষে খতম। ধাতস্থ হতে প্রায় মিনিট কয়েক লেগে গেল। তারপর জঙ্গল ভেঙে প্রায় হাতড়াতে হাতড়াতে দু’জন সেই সামনের দিকেই এগোতে লাগলাম। ওইভাবে কতক্ষণ চলেছিলাম হুঁশ নেই। হঠাৎ জঙ্গল অনেকটাই ফের হালকা হয়ে গেল। ভেবেছিলাম বোধ হয় পথের কাছে এসে পড়েছি। কিন্তু ভাল করে নজর করতে গিয়ে বুঝলাম পথ নয় খানিক দূরে জঙ্গলের ভিতর অনেকটা পরিষ্কার জায়গা ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া। তারই মাঝে একটা বাংলো গোছের বাড়ি। খুব বড় না হলেও ছিমছাম।

‘রাস্তা থেকে দূরে এই জঙ্গলের ভিতর এমন বাংলো বাড়ি কে করল তখন আর ভাবার সময় নেই। একে পরিশ্রান্ত শরীর মানসিক দুশ্চিন্তায় ভয়ানক কাহিল অবস্থা। সন্ধে হতেও দেরি নেই। কাঁটাতারের বেড়ার মাঝে শিকল টানা কাঠের মজবুত গেট। দ্রুত সেই গেট খুলে দু’জন ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বাংলো বাড়ির সদর দরজায় তালা ঝুলছে। আশপাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। তবে মানুষ যে আছে বোঝা যাচ্ছিল ঝাঁট দেওয়া পরিষ্কার টানা বারান্দা আর বাংলোর হাতা দেখে। খানিক ডাকাডাকি করতে বাংলোর পিছন থেকে এক  দেহাতি মানুষ বেরিয়ে এল। সম্ভবত বাংলোর পিছনে কোনো খুপরি ঘরে আস্তানা। মালি গোছের কেউ। লোকটা অবাক হয়ে খানিক তাকিয়ে থেকে বলল ‘আপ কৌন হো বাবু?

‘সন্ধের অন্ধকার ইতিমধ্যে ঘন হতে শুরু করেছে। বলা বাহুল্য লোকটাকে দেখে প্রায় যেন হাতে চাঁদ পেলাম দু’জন। ভেবেছিলাম এটিও বুঝি বন দপ্তরের কোনো বাংলো। আর চহলা যখন খুব দূরে নয় অনুরোধ করলে আমাদের বাংলোয় পৌঁছেও দিতে পারবে। সংক্ষেপে ব্যাপারটা জানিয়ে সেই কথাই বললাম তাকে।

‘লোকটার নাম লাল সিং। বাংলোর মালি। আমাদের কথায় কিন্তু বিশেষ গরজ দেখাল না। সাফ জানিয়ে দিল বাংলোটা মোটেই বনদপ্তরের নয়। ম্যাকেঞ্জি সাহেবের।

‘ম্যাকেঞ্জি সাহেব কে?

‘অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে সে জানাল সাহেব বন দপ্তরেই কাজ করতেন আগে। এখন অবসরের পর পরিবার নিয়ে এখানে থাকেন। কী এক দরকারে সাহেব কী দিন কয়েক হল পরিবার নিয়ে কলকাতায় গেছেন। সে একাই আছে এখন। এই অবস্থায় বাংলো ফেলে কোথাও যেতে পারবে না। তা ছাড়া জঙ্গরে ভিতর দিক ভুল করে ভিন্ন দিকে চলে এসেছি। ফের রাস্তায় পড়তে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। চহলা বাংলো সেখান থেকে অনেকটাই দূর। তার উপর বাঘ বের হয়েছে। খানিক আগে ডাকও শোনা গেছে। এই রাতে এতটা পথ যাওয়া বিপদ হতেই পারে।

‘লাল সিংয়ের কথায় প্রায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। অমন যে বারীন সেও প্রায় হাউমাউ করে উঠল তাহলে তাহলে কী হবে ভাই? এখানে রাত কাটাবার কিছু ব্যবস্থা করা যাবে?

‘উত্তরে লাল সিং খানিক থম হয়ে থেকে জানাল এ তো আর সরকারি বাংলো নয় বাবু। সাহেবেরও কড়া হুকুম। তবু এই অবস্থায় আপনাদের ফিরিয়ে দেই কী করে!

‘লাল সিং রাজি হতে প্রায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমাদের। সাহেবের খাস ঘর লাল সিং অবশ্য খুলে দেয়নি। খুলে দিয়েছিল পাশের ছোট ঘরটা। বিছানা ছোট হলেও একটা রাত কাটিয়ে দেওয়া যায়। তাই আর দ্বিরুক্তি করিনি। বড় ঘর খুলে না দিলেও লাল সিং অন্য দিক দিয়ে কার্পণ্য করেনি। ভেবেছিলাম রাতটা অনাহারেই কাটাতে হবে হয়তো। কিন্তু তা হয়নি। রাতে খ্যাঁটের ব্যবস্থা ভালই করেছিল। গরম ভাত আর বন–কুড়নো তিতিরের ডিমের ঝোল। এক একজনের প্লেটে চারটে করে। এতটা আশা করিনি কেউ।

‘খাওয়াদাওয়ার পর শুয়ে পড়া যেত। লাল সিংও সেই কথাই বলেছিল। কিন্তু গা করিনি। দিনটা শুরু হয়েছিল ভালই। তারপর যে বিপদে পড়েছিলাম তার থেকে যে এভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে ভাবিনি। বিছানায় বসে সেই গল্পই চলছিল। বারীন হঠাৎ জানলার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল কে? কে ওখানে?

‘বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কলকাতার মানুষ তিথির হিসেব রাখে না। তবে গত দু’দিন চহলায় ঘন অন্ধকার রাত দেখে অমাবস্যা কাছে বলেই মনে হয়েছিল। গোড়ায় তাই নজরে না পড়লেও একটু পরেই বোঝা গেল ব্যাপারটা। জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। বারীন ফের চেঁচিয়ে উঠল কে? কে ওখানে? 

‘কয়েক মুহূর্ত কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপরেই গরাদের ওধারে কাঁচুমাচু হয়ে মুখ বাড়াল লাল সিং।

‘বাবু আমি। লাল সিং।

‘তা জানলার কাছে ওইভাবে দাঁড়িয়ে কেন? কী দেখছিলে?

‘আজ্ঞে বাবু থতমত খেয়ে লাল সিং বলল পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ বেজায় পোড়া গন্ধ নাকে আসতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। আপনাদের সঙ্গে কিছু আছে নাকি? এমন পোড়া গন্ধ!

‘বলে কী লোকটা! অবাক হয়ে পরস্পর মুখের দিকে দু’জন হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। বারীনই বলল কই তেমন কিছু তো সঙ্গে নেই। কিসের গন্ধ?

‘কী জানি বাবু লাল সিং ঠোঁট ওলটাল। কেমন একটা পোড়া বাজে গন্ধ। ঘরেই তো ছিলাম। থাকতে না পেরে ছুটে এলাম।

‘লোকটার কথা আচার আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। সন্দেহজনক। বারীন কী বলে ফেলে সেই আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি বললাম আমাদের কাছে তেমন কিছু নেই ভাই। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। আমরাও শুয়ে পড়ব এবার।

‘তাই শুয়ে পড়ুন বাবু।

‘সামান্য ইতস্তত করে লাল সিং চলে গেল। বারীন তখনো থম হয়ে রয়েছে দেখে আমিই বললাম কী ভাবছিস?

‘ব্যাপার তেমন সুবিধার মনে হচ্ছে না যেন। কিছু উদ্দেশ্য নেই তো?

‘ব্যাপারটা বারীনকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে তখন। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম কী আর উদ্দেশ্য থাকবে? আমাদের সঙ্গে কী এমন আছে?

‘তা ঠিক। তবু রাতে একটু সাবধান থাকতে হবে মনে হচ্ছে।

‘উত্তরে মাথা নাড়লাম ঠিকই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কিছুই আর হয়নি। জঙ্গলের ভিতর এক টানা মাইল কয়েক পথ হেঁটে দু’জনেই তখন ক্লান্ত। তার উপর বুনো তিতিরের ডিমের ঝোল–ভাত দিয়ে ভুরিভোজ। তবু হয়তো সামলে নেওয়া যেত। কিন্তু ঘরে লাল সিংয়ের জ্বেলে দিয়ে যাওয়া একমাত্র হ্যারিকেনের তেল যে ফুরিয়ে এসেছে জানব কেমন করে। শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই নিবে গেল সেটা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভিতর কতক্ষণ আর জেগে থাকা যায়! কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই তারপর।

‘অনেক রাতে হঠাৎই ভেঙে গেল ঘুমটা। ঘরে গাঢ় অন্ধকার। পাশে বারীন প্রায় অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। চোখ বুজে ফের পাশ ফিরতে যাব। কান দুটো সজাগ হয়ে উঠল।  বাইরে কারা যেন ফিসফাস করে কথা বলছে। চলাফেরার শব্দ। লাল সিং নয়তো? কিন্তু সঙ্গে আরও কয়েকজন রয়েছে। দু’একজন মহিলাও রয়েছে রয়েছে মনে হল। তাদের হাতের চুড়ি পায়ের ভারি তোড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু কী তাদের উদ্দেশ্য অনেক ভেবেও কিনারা করতে পারলাম না। এত চাপা গলায় কথা চলেছে বোঝা মুশকিল। পাশে বারীন তখনো প্রায় মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে। যথাসম্ভব নিঃশব্দে তাকে ঠেলা দিয়ে জাগাবার চেষ্টা করলাম। হল না। বরং ঘুমের ভিতর আরামে পাশ ফিরল। থম হয়ে পড়ে আছি। হঠাৎ দুড়দাড় শব্দে নতুন কয়েকজন যেন ছুটে এসে যোগ দিল আগের মানুষগুলোর সঙ্গে। যথেষ্ট উঁচু গলায় একজন গর্জে উঠল। পরিষ্কার শুনতে পেলাম এবার।

‘কী রে এখনো দাঁড়িয়ে আছিস এখানে! ভিতরে যাসনি?

‘কী করে ভিতরে ঢুকবো গুরু।

‘কে একজন মিনমিন করে বলল ভিতরে কেমন ঝাঁঝালো পোড়া গন্ধ! দু’একজন চেষ্টা করেছিল। পারেনি।

‘জালে কী আটকেছে রে আজ।

‘বেড়ে জিনিস ছিল গুরু। একেবারে একজোড়া।

‘বলতে বলতে উলস্‌ করে কেউ জিবের জল টানল।

‘লালু হতচ্ছাড়া কোথা?

‘মিনসেটা কোনো কম্মের নয় দাদা। ব্যাপার দেখে সেই যে সটকান দিয়েছে আর ধারেকাছে আসেনি।

‘মেয়েলি কণ্ঠে খেঁকিয়ে উঠল কেউ। ফের সেই চুড়ির আওয়াজ।

‘এতদিন পরে জালে মাছ আটকে তাহলে লাভটা কী হল! ওস্তাদ কোথায়? তেনাকেও তো ডেকে আনতে পারতিস। ঠিক ঢুকে পড়ত। ওসব গন্ধে কিছু হয়নে ওনার।

‘সে কী আর হয়নি গুরু। তা তিনি ভাগিয়ে দেলেন শুনে। কবে নাকি তেনাকে জোড়া মোরগ ভেট দেছেন এনারা। তিনি আসবেননি।

‘ওস্তাদের এই এক দোষ! তুমি তো বাপু ভোগ পেয়েছ তা মোদের পেট ভরে কিসে? তা কিছু একটা করো গুরু। এমন সুযোগ কতদিন আসেনি গো!

‘বলতে বলতে হুস করে ফের জিবের জল টানার আওয়াজ।

‘তোরা কেউ কোনো কাজের নয় দেখছি! দাঁড়া আমি নিজেই যাচ্ছি ভিতরে।

‘এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। সাড়াশব্দ নেই। বলা বাহুল্য, বাইরে সেই কথার মাথামুণ্ডু তেমন বুঝতে না পারলেও মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা একেবারেই সুবিধার নয়। ভয়ানক বিপদ! এই ঘন জঙ্গলের ভিতর অন্ধকার নিশুতি রাতে ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে পেটের ভিতর কেমন হিম হয়ে আসছিল। কিন্তু খানিক সময় কেটে যাবার পরেও যখন আর সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। কিছু নিশ্চিন্ত হয়ে পাশ ফিরতে যাচ্ছি কানের কাছে কাঠের মেঝে কাঁপিয়ে হঠাৎ দুড়দাড় পায়ের শব্দ। কে যেন ঘর থেকে ছুটে পালাল। তারপরেই বাইরে ভারি গলায় হাউমাউ চিৎকার বাপরে জ্বলে গেছে জ্বলে গেছে হাত।

‘কেন গুরু কী হয়েছে। অমন পোড়া গন্ধের মধ্যেও বেশ তো ঢুকলে ঘরে!

‘নাক বন্ধ করে সেতো ঢুকেছিলাম রে। পোড়া গন্ধটা সত্যিই বেজায় ভয়ানক। তবু জালে আটকানো দারুণ দুই শিকার দেখে পরোয়া করিনি। লালু আজ জবর মাল আটকেছে বটে! কাছে গিয়ে দেখি তার একটা প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জেগেই আছে বোধ হয়। তবে অন্যটা মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে দেখে সেটাকেই ধরতে গেছিলাম। কলজে ছিঁড়ে খাব। বাপরে! ছোঁড়াটার গায়ে হাত দিতেই আগুনের ছ্যাঁকা লাগল যেন! পালিয়ে আসতে হল।

‘বলা বাহুল্য এরপর মাথা আর ঠিক রাখতে পারিনি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই জ্ঞান ফিরল বারীনের ডাকে বিনু বিনু…

‘তাকিয়ে দেখি সে দুই হাতে সমানে ঝাঁকাচ্ছে আমাকে। বেচারার দুই চোখে শুধুই আতঙ্ক। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম মুহূর্তে। তারপর চারপাশে তাকিয়ে যা নজরে পড়ল তাতে মাথা বোঁ করে ঘুরে উঠল। বারীনের চোখে আতঙ্ক অকারণে নয়। ঘন জঙ্গলের ভিতর ইতস্তত ছড়িয়ে কিছু ভাঙা কিছু ইট–পাথরের টুকরো। হালকা ঝোপঝাড়। তারই মাঝে পড়ে আছি আমি। ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাংলোর চিহ্নমাত্র নেই। একটাই ভরসার কথা ভোরের আলো ফুটেছে। মাথার উপরে ঝকঝকে আকাশ। চারপাশে ঘন গাছপালার ফাঁকে আলোর রেখা।

‘হাঁ করে তাকিয়ে আছি। বারীন ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল বিনু এখানে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। চল শিগগির।

‘বারীন তাগাদা দিলেও হঠাৎ চোখ পড়তে আমি তখন হাঁ করে তাকিয়ে আছি ওর বুক পকেটের দিকে। পকেটের খানিকটা জায়গা পুড়ে কালো হয়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি বললাম ‘বারীন তোর জামার পকেট অমন পুড়ে গেল কীভাবে!

‘উত্তরে বারীন চমকে উঠে জামার পকেটের দিকে তাকাল। তারপর চট করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল কড়ে আঙুলের মতো ছোট এক কাঠকয়লার টুকরো। হাঁ করে খানিক তাকিয়ে রইল সেই দিকে। তারপর কোনোমতে বলল যশিপুরে সেই সাধুর দেওয়া কাঠের টুকরো পকেটেই ছিল। পুড়ে এমন কাঠকয়লা হল কী করে!

‘বারীন বলার আগেই অবশ্য কাঠকয়লার টুকরোটা চিনতে ভুল হয়নি আমার। সন্দেহ নেই রাতের অন্ধকারে যে লোকটার কথা শেষবার শুনেছিলাম তার আঙুল কিসের ছ্যাঁকায় পুড়েছিল। মনে পড়তেই সারা শরীর কেঁপে উঠল। লাফিয়ে উঠে বললাম সে পরে হবে। এখন চল এখান থেকে।

‘বারীন আর দ্বিরুক্তি করল না। দু’জন মুহূর্তে রওনা হয়ে পড়লাম।

‘আগের দিন কিছুতেই খুঁজে পাইনি। আজ কিন্তু জঙ্গলের ভিতর খানিক এগোতেই মোরামের পথটা পাওয়া গেল। পুব আকাশ দেখে দিক মিলিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে চলতে শুরু করলাম চহলা বনবাংলোর দিকে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম যথাস্থানে। আমাদের দেখে ছুটে এল ভুনি ওঁরাও।

‘রাতে কোথায় ছিলেন বাবু? আমরা তো ভেবেই খুন। হাজার হোক বনজঙ্গল বলে কথা। তারপর অমাবস্যার রাত। এই রাতে আমরাই বের হই না!

‘সারা পথ পাশাপাশি হেঁটে এলেও এ পর্যন্ত কেউ একটি কথাও বলিনি। বারীন সামান্য ইতস্তত করে বলেই ফেলল ব্যাপারটা।

‘সব শুনে ভুনি ওঁরাও খানিক হাঁ করে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। শেষে ঢোঁক গিলে বলল বলেন কী বাবু রাতে আপনারা ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাংলোয় ছিলেন! কিছু হয়নি?

‘না হয়নি তো! শুধু সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ফাঁকা জঙ্গলের ভিতর শুয়ে আছি দু’জন। ঘরবাড়ির চিহ্ন মাত্র নেই।

‘ঘরবাড়ি ওখানে কিছু নেই তো। শুধু এই অমাবস্যার রাতে কখনো দেখা যায়। আপনারা যে ফিরে আসতে পেরেছেন অনেক ভাগ্য।

‘কেন?

‘বারীনের কথায় ভুনি ওঁরাও বলল সে অনেক কথা বাবু। আমার জন্মেরও আগের কথা। তবু এদিকে ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাংলোর কথা অনেকেই শুনেছে। বহুদিন আগে ম্যাকেঞ্জি সাহেব বন দপ্তরেই চাকরি করতেন। অবসর নিয়ে এখানেই থাকবেন বলে জঙ্গলের ভিতর এক বাংলোবাড়িও তৈরি করিয়েছিলেন। দেখভালের জন্য জনা তিনেক লোকও ছিল। কিন্তু ভোগ আর করতে পারেননি। মাস কয়েকের মধ্যে এক রাতে শুধু ম্যাকেঞ্জি সাহেব নয় তিন কাজের মানুষও খুন হয় ওই বাড়িতে। প্রত্যেকের দেহের পেট আর বুক খুবলে খাওয়া। ক্ষতবিক্ষত শরীর। এভাবে কে তাদের খুন করল সেই রহস্যের কিনারা হয়নি। অনেকেই মনে করেছিল মৃতদেহগুলো সম্ভবত বাঘে খুবলে খেয়েছে। কিন্তু সুরতহালে তেমন প্রমাণ মেলেনি। মাটিতেও বন্য জন্তুর পায়ের ছাপ ছিল না।

‘রহস্য থিতিয়ে যাবার আগে ফের সেই ব্যাপার। সেবার কলকাতা থেকে একদল শিকারি এদিকে এসেছিলেন। সব মিলিয়ে জনা তিনেক মানুষ। তারা রাতে ওই বাংলোয় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরের দিন তাদেরও দেহ ওই একই রকম ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেও এক অমাবস্যার রাত। সমাধান হয়নি সেই মৃত্যু রহস্যেরও। তবে বনদপ্তর থেকে পোড়ো বাংলোটা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল তারপর। কিন্তু বিপদ কাটেনি তাতেও। এরপরেও বিভিন্ন সময় একাধিক শিকার পার্টিকে ওই জায়গায় একইভাবে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। অনেকেরই তাই ধারণা অমাবস্যার রাতে ওখানে নাকি ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাংলো দেখা যায় কখনো। যারা রাত কাটাবার জন্য সেখানে আশ্রয় নেয় তারা আর বেঁচে ফেরে না। আজ আপনাদের কথায় বোঝা গেল সেই গুজব মিথ্যে নয়।

‘বারীন সত্যিই ডানপিটে মানুষ। ভুনি ওঁরাওয়ের সেই কথার পরেও খুব একটা দমেনি। ঘরে এসে স্নানের পর ব্রেক ফার্স্ট সারা হতে হঠাৎ বলল চল বিনু আর একবার জায়গাটা ঘুরে আসি। অন্ধকারে আমাদের দেখার ভুল নয়তো!

‘দেখার ভুল তো অবশ্যই। তবে আমি কেন তোরও ফের ওখানে যাওয়া চলবে না।

‘কেন?

‘তোর পকেটে সাধুর দেওয়া সেই কাঠের টুকরোটাই গত রাতে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে রে আমাদের! ভয়ানক বিপদ গেছে গত রাতে।

‘কী বলছিস!

‘একদম ঠিক।

‘একে একে গত রাতের অনেক কথাই খুলে বললাম ওকে। আমি থামতেই বারীন উঠে গিয়ে ছেড়ে রাখা শার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল। মুহূর্তে প্রায় লাফিয়ে উঠল

‘কী কাণ্ড পুড়ে কয়লা হয়ে গেলেও সকালে তো পকেটেই রেখেছিলাম। এখন নেই। পড়ে গেল নাকি?

‘আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল ঠিক এটাই হবে। মাথা নেড়ে বললাম পড়ে যায়নি রে। কাজ শেষ করে বিদায় হয়ে গেছে।

‘তারপর সেই দুপুরেই একটা গাড়ি পেয়ে দু’জন যশিপুর ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু অনেক খুঁজেও সেই সাধুবাবার দেখা পাইনি। অনেককে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম তাঁর কথা। আশ্চর্য ব্যাপার হল কেউই চিনতে পারেনি। অমন কোনো সাধুকে কেউ যশিপুরে দেখেনি কোনোদিন।’

‘সে কী? সাধুবাবাকে দেখিনি কেউ!’

গল্প শেষ করে বিনুমামা থামতেই সমস্বরে বলে উঠলাম সবাই। উত্তরে মাথা নাড়লেন বিনুমামা। ‘না দেখেনি কেউ। সবাই তো তাই বলেছিল। তবে সে যাই হোক তারপর অনেক দিন পর্যন্ত রাতে ঠিক মতো ঘুমোতে পারিনি। দুই চোখের পাতা এক করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই অদ্ভুত রাতের কথা। আতঙ্কে উঠে বসতাম। সেই রাতের সব কথা খুলে বলতে পারিনি সেদিন বারীনকেও। স্রেফ আতঙ্কের কারণে। তবে অনেক দিন পরে ব্যাপারটা মনের ভিতর অনেকটাই যখন থিতিয়ে গেছে সেই সময় একদিন কথায় কথায় হঠাৎ বারীন যখন জিপে জঙ্গলে যাওয়ার পথে মোরগ দুটোর জন্য আপসোস করছিল শুধু বলেছিলাম অন্ধকারে সেদিন হাত বাড়িয়ে যিনি মোরগ দুটো লুফে নিয়েছিলেন তিনি ওস্তাদ ছিলেন রে বারীন।

‘ওস্তাদ!

‘অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বারীন।

‘হ্যাঁ রে ওস্তাদ। সেই রাতে যারা আমাদের ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাংলোয় জালে আটকেছিল তাদের ওস্তাদ। ক্ষমতাও অনেক বেশি। যাওয়ার দিন রাতে দারুণ দুটো মোরগ ভেট পেয়ে বেজায় খুশি হয়েছিল ওস্তাদ। তাই ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাংলোয় ছাড় দিয়েছিল আমাদের। নইলে সাধুবাবার মন্ত্রও হয়তো বাঁচাতে পারত না।

‘ওস্তাদ! ওস্তাদ কে?

‘দারুণ অবাক হয়ে ফের প্রশ্ন বারীনের।

‘উত্তরে ঠোঁট উলটেছিলাম মাত্র। বলার মতো ছিল না কিছু।’

আপলোড: ২০/৩/২০২১

11 comments:

  1. অসাধারণ, আমি সমিলিপাল ঘুরে এসেছে, তাই আর ভালো লাগলো, এখন আর চাহলা থাকতে দায়না, কিন্তু আমি রাতের জঙ্গল , আপনার লেখাটা পরে ঘায়ে কাঁটা দিলো।

    ReplyDelete
  2. দুর্দান্ত লেখাটা

    ReplyDelete
  3. দারুণ লাগলো... খুব ভয়ের

    ReplyDelete
  4. অসাধারণ। অনবদ্য।

    ReplyDelete
  5. অসাধারণ লেখা শিশিরবাবু - মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লাম!

    ReplyDelete
  6. খৈরী র জন্ম 1974 এ তাই 60 এর দশকের শেষভাগে যশিপুরের বাঙলোয় খৈরীকে দেখা সম্ভব নয় ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসতর্কতার কারণে গল্পে সত্তরের বদলে ষাটের দশক হয়ে গেছে। ভুল আমারই। ধন্যবাদ।

      Delete