সান্তা ক্লজ
শিশির বিশ্বাস
শ্রীচরণেষু বাবা,
তোমার পাঠানো বইটা
পেয়েছি বাবা। প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেছি। খুব ভাল বই। তবে সবচেয়ে ভাল ‘দি হোলি ম্যান’
গল্পটা। তুমি পড়নি? সেদিন ওই গল্পটা নিয়ে
বন্ধুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। খুব তর্ক হয়ে গেল। ওরা বলে, সান্তা
ক্লজ নাকি নিছকই এক কাল্পনিক চরিত্র। বড়দিনের ছুটিতে ছোটদের খুশিতে ভরিয়ে দেবার
জন্য সৃষ্টি। কিন্তু সান্তা ক্লজ তো এই পৃথিবীরই মানুষ, তাই
না বাবা? জন্মেছিলেন আনুমানিক খ্রিষ্টীয় তিনশো পঞ্চাশ সালে।
লিসিয়ার মাইরা শহরে। মানুষটির আসল নাম সেন্ট নিকোলাস। ওলন্দাজদের ভাষায় সেন্ট
নিকোলাস ‘সিন্টা ক্লায়েস’ হয়ে কবে যে
সান্টা ক্লজ বনে গেছে, কেউ জানে না। কিন্তু ওরা কেউ মানতেই
চাইল না। তাও তো ওদের আমি আসল কথাই বলিনি।
তোমায় চুপি চুপি বলি
বাবা, আমি সান্তা ক্লজকে দেখেছি। এই কোলকাতার পথে। এবার বড়দিনের ঠিক আগের
বিকেলে। পার্ক স্ট্রিটে।
বাবা, সেই যেবার তুমি
আমায় বড়দিনে নিউ মার্কেটে নিয়ে গিয়েছিলে, এবার বড়দিনের
জৌলুসও তার চাইতে কম নয়। গোটা চৌরঙ্গী আর পার্ক স্ট্রিট পাড়ায় খুশির আমেজ।
বিকেল হতেই জ্বলে উঠেছে নানা রঙের আলো। চারদিকে রঙিন কাগজের ফুল আর পতাকার মেলা।
বড় বড় দোকানে কাচের শোকেস আলো করে রয়েছে ঝলমলে এক্স-মাস ট্রি। রঙিন কাগজ আর তুলোয়
মোড়া হাসিখুশি সান্তা ক্লজ বুড়ো। সাথে উপহারের ডালি। পিলপিল করে মানুষ ছুটছে
দোকান থেকে দোকানে। হাত ভরতি সওদা। কেনাকাটার বিরাম নেই।
পার্ক স্ট্রিটের এক
বড়সড় দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বছর পঞ্চাশ বয়সের একটা মানুষ। রোগা বেঁটেখাটো
চেহারা। মুখ ভরতি বসন্তের দাগ। কদিনের না-কামানো কাঁচাপাকা খোঁচা দাড়ি। পোশাকটাও
বেঢপ। মাথায় সান্তা ক্লজ টুপি। কোঁচকানো ছেঁড়া সার্টের উপর তাপ্পি দেওয়া কোট।
গলায় আধছেঁড়া পুরোনো টাই। পরনে ঢোলা প্যান্ট। পায়ে দোমড়ানো বিবর্ণ একজোড়া বুট
জুতো। বড়দিনের পার্ক স্ট্রিটে বেজায় বেমানান।
মানুষটার বাঁ বগলে খালি
একটা ছোট টিনের কৌটো। হাতে ঝুলছে আধছেঁড়া ঢাউস এক পলিথিনের থলে। কাগজের বাঁশিতে
ভরতি। রঙিন কাগজে তৈরি নলের মতো বাঁশিগুলোর একদিকে ফুটো। ফুটোয় মুখ দিয়ে সুর করে
গাইলে, ফুটোর পাশে নলের মুখে আটকানো টিসু পেপারের কম্পনে মিষ্টি বশির আওয়াজে
গানের সুরটি বেজে ওঠে। লোকটি মুখে একটি বাঁশি নিয়ে হরেক জনপ্রিয় গানের সুর তুলছে,
আর ঘুঙুর বাধা ডান হাতে বাঁ বগলের টিনের কৌটোয় সুরের তালে তবলার বোল
তুলছে।
এক একটা বাশির দাম দশ
পয়সা। ফুটপাতে এক দঙ্গল অর্ধউলঙ্গ শিশুর ভিড় জমেছে মানুষটিকে ঘিরে। কেনার খদ্দের
কম। তবু হাতে হাতে বিক্রিও হয়েছে কয়েকটা। চটপট বাজাবার কায়দা শিখে নিয়ে তারাও
সুর তুলেছে লোকটির সাথে। দু’চোখে খুশি উপচে পড়ছে। যারা কিনতে পারেনি, মজাটা উপভোগ করছে তারাও।
জলসা যখন বেশ জমে উঠেছে, হঠাৎ সামনে
দোকানের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন ধোপদুরস্ত সাহেবি পোশাকের এক বাবু। বোধহয় দোকানের
মালিক পক্ষের কেউ। ওদের দেখেই চোখ কটমট করে দাঁড়িয়ে গেলেন। দোকানের ঝকমকে শোকেস
তখন প্রায় ঢেকে ফেলেছে ক্লাউনমার্কা সেই মানুষটি আর তাকে ঘিরে ভিড় জমানো এক
দঙ্গল অর্ধ উলঙ্গ ছেলেমেয়ে। শোকেসের ঝলমলে সান্তা ক্লজ আর একরাশ দামি উপহারের
ডালির কিছুই রাস্তা থেকে দেখার উপায় নেই। দু’চোখে এক ঝলক
আগুন ছুঁড়ে দিয়ে বাবুটি ধমকে উঠলেন, ‘এ বুড়া আগে বাঢ়ো।
আগে বাঢ়ো, জলদি।’
মুহূর্তে থেমে গেল জলসার আসর।
মুখ থেকে বাশি নামিয়ে চারপাশে ঘিরে ধরা শিশুগুলির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অদ্ভুত হাসল লোকটা।
আড় চোখে একবার দেখে নিল বাবুটিকে। তারপর মাথা নুইয়ে সেলাম জানিয়ে বলল, ‘আগে তো জরুর
বাঢ়েগা বাবু। সারে জিন্দগী। পিছুমে কভি নেহি।’
বাঁশিটি ফের মুখে নিয়ে
ভিড় ঠেলে চলতে শুরু করল সে। বাঁশিতে তখন সুর উঠেছে:
থোড়া দেখকে চলো মেরে লাল, আগে বাঢ়ো।
সুরে সুর মিলিয়ে ছেলের
দলও অনুসরণ করল তাকে। খালি হয়ে গেল শোকেসের সামনে ফুটপাত। ছেলের দল নিয়ে রাস্তার
ভিড়ে হারিয়ে গেল লোকটা। শুধু টিনের কৌটোয় তোলা তবলার বোলটাই দূর থেকে ভেসে আসতে
লাগল, টরে-টক্কা। টরে-টক্কা। টরে-টক্কা। ঠিক টেলিগ্রাফের সংবাদের মতো।
শোকেসের ভিতর তখন ঝলমল
করছে কাগজ আর তুলোর নকল সান্তা ক্লজ। হাতে উপহারের ডালি।
আমরা ভাল আছি বাবা।
প্রণাম নিও। ইতি, সুমন।
ছবি: রাজা (সৌজন্য:
সন্দেশ)
প্রথম প্রকাশ: ‘সন্দেশ’ পৌষ ১৩১৬
খুব ভালো লাগল... বড় দিনের শুভেচ্ছা রইল
ReplyDeleteগতবছর পড়েছিলাম... এবারও পড়লাম। এটাই উৎসব... ফিরে ফিরে আসে। ভালো থাকবেন।
ReplyDeleteখুব সুন্দর।
ReplyDelete