Wednesday 6 January 2021

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোঃ ভাঃ): সেই আশ্চর্য লোকটি (বিমল কর)

 

সেই আশ্চর্য লোকটি

বিমল কর

নেকদিন আগেকার কথা, অন্তত বছর পঁয়ত্রিশ। আমার তখন পনেরো–ষোল বছর বয়স। ঠাকুমা আর ছোটকাকার সঙ্গে কাশী গিয়েছিলাম বেড়াতে, ফেরার সময়ে এমন একটা কাণ্ড ঘটেছিল যার কোন অর্থ আমরা কেউই খুঁজে পাইনি। আজও পাই না।

কোন গাড়ি কী তার নাম ছিল, আজ আমার কিছু মনে নেই। দুপুর নাগাদ আমরা কাশী থেকে মোগলসরাই স্টেশন এসে রেলে চড়েছিলাম। তখন ওইদিককার রেলের নাম ছিল ই আই আর, মানে ইস্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে। এখনকার মতন মাত্র দুটো ক্লাসও তখন ছিল না, ছিল চারটে। ফাস্ট, সেকেন্ড, ইন্টার আর থার্ড। আজকাল রেলের কামরা মানেই যেন একটা ছোটখাটো মেলা, গিসগিস করে লোক। তখনকার দিনে এত ভিড়টিড় কোন গাড়িতেই থাকত না, মেল এক্সপ্রেস গাড়িতেতো নয়ই।

আমাদের গাড়িটা বোধ হয় এক্সপ্রেস গাড়ি ছিল, কেননা সব স্টেশনে থামছিল না। দুপুরের শেষদিকে গাড়িতে উঠেছি। ইন্টার ক্লাস কামরা। জনা ছয় মাত্র যাত্রী আমাদের কামরায়। দিন দুই পরে কালীপূজা। দুর্গাপূজোর পর গিয়েছিলাম কাশীতে, ফিরছি কালীপূজোর আগে! আসব, ধানবাদ। বাবার কাছে নিজেদের বাড়িতে।

সাসারাম এসে পৌঁছতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল। তখন ওদিকে শীত পড়তে শুরু করেছে সবে। ওসব দিকে পুজোর পরই শীত এসে পড়ে, হেমন্তকাল বুঝতে বুঝতেই কখন যেন জব্বর শীত এসে যায়। সাসারামে শের শাহের সমাধি শুনেছি। গাড়ি যখন সাসারামে এসে পৌঁছল তখন এত অন্ধকার যে আমার চোখে বাইরের কিছুই ধরা পড়ল না। এমন কী স্টেশনটাও যেন টিমটিম করছে।

সাসারাম থেকে গাড়ি ছাড়ার সময় একজন ভদ্রলোক এসে গাড়িতে উঠলেন। গায়ে লম্বা রেলের কোট, ওভারকোট ধরনের, পরেনে রেলের প্যান্ট। গলায় একটা রুমাল জড়ানো। মাথায় বারান্দা মার্কা রেলের টুপি। মাথায় বেশ লম্বা।

ভদ্রলোক যখন উঠলেন, গাড়িটা তখন ছাড়ছিল। উনি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কামরার বাতিগুলো দপ করে নিবে গেল। অবশ্য কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার জ্বলে উঠল। উনি কামরায় উঠেই এদিক-সেদিক তাকিয়ে সোজা বাংকে উঠে শুয়ে পড়লেন। জুতো সমেত। শুয়ে পড়ে মাথার টুপিটা এমন করে মুখের ওপর চাপা দিলেন, মনে হল কামরার আলো যেন চোখে না লাগে সেই ব্যবস্থা করে নিলেন। যেটুকু দেখলাম ভদ্রলোককে, বুঝতে পারলাম রেলের লোক, অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান। আমার বাবা রেলের চাকুরে। ছেলেবেলা থেকে রেলের লোক দেখতে দেখতে মনে একটা আন্দাজ হয়ে গিয়েছে, গোমো আর ধানবাদে অজস্র অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান দেখেছি যারা রেলেই কাজ করে। ভদ্রলোকের কত বয়েস তা ঠিক বুঝতে পারিনি, তবে আমার ছোট কাকার চেয়ে নিশ্চয় বড়।

গাড়ি চলতে শুরু করল। একটা বেঞ্চিতে আমরা। ঠাকুমা, ছোটকাকা আর আমি। আর এক বেঞ্চিতে এক বেহারী ভদ্রলোক শুয়ে ছিলেন, তিনিও কাশী ফেরত, সঙ্গে বিস্তর মালপত্র। অন্য বেঞ্চিতে এক সাধুবাবা, সঙ্গে তার কোন মারোয়াড়ী শিষ্য। সাধুবাবার গায়ে গেরুয়া বস্ত্র, এইমাত্র, নয়ত তিনি একেবারে সাধারণ মানুষের মতন, হিন্দিতেই কথাবার্তা বলছিলেন। বিড়ি টানছিলেন।

আমার কাকা ট্রেনে উঠলেই ঢুলতে শুরু করেন। সন্ধে হয়েছে দেখে কাকাও মাথার ওপর বাংকে চড়ে বসলেন। ঠাকুমা বোধ হয় জপতপ শুরু করল মনে মনে। আমি চুপচাপ একা। বাইরে তাকালেই অন্ধকার আর অন্ধকার। মাঝেমাঝে এঞ্জিনের ধোঁয়া এসে যেন নাকে লাগছে, কয়লার গুঁড়ো উড়ছে; আর থেকে থেকে ধোঁয়ার সঙ্গে আগুনের ফুলকি জোনাকির মতন অন্ধকারে ছিটকে পড়ছে।

এইভাবে শোন্ নদী পেরিয়ে গেলাম। কী বড় ব্রিজ। ট্রেন ছুটছে, ছুটতে ছুটতে গয়াও এসে গেল, তখন রাত হয়ে গিয়েছে। গয়া থেকে গাড়ি ছাড়ল। খাওয়া-দাওয়া শেষ আমাদের। কাকা আবার বাংকে উঠে ঘুম লাগালেন। বেহারী ভদ্রলোক খাওয়া শেষ করে ঢেঁকুর তুলতে লাগলেন বড়–বড়। সাধুবাবা শিষ্যসমেত গয়ায় নেমে গেছেন। নতুন কেউ চড়েনি।

সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক কিন্তু একইভাবে শুয়ে আছেন। ঘুমাচ্ছেন নিশ্চয়। ট্রেনে রেলের বহুলোকই যাতায়াত করে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে। কাজকর্মে যায়, কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরে। কাজেই ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার কোন কৌতূহল হয়নি।

গয়া আর কোডারমার মধ্যে কোডারমার আগে মস্ত জঙ্গল। নামকরা জঙ্গল। বিহারে এত বড় জঙ্গল খুবই কম। লোকে বলে গুরপা-গুঝাণ্ডির জঙ্গল। দিনের বেলাতেও এই জঙ্গলের অর্ধেক জায়গায় আলো রোদ ঢোকে না। রেল লাইন পাতার সময় এই জঙ্গলের আরও ভয়ঙ্কর চেহারা ছিল। রেলের কুলি লাইনের অনেকেই নাকি বাঘটাঘের পেটে গিয়েছে এখানে।

রেলের দুটো স্টেশনই আছে, গুরপা আর গুঝাণ্ডি। এই পাহাড়ি জায়গাটুকুর চড়াই ভাঙতে বাড়তি একটা এঞ্জিন জুড়তে হয়, একটা এঞ্জিন টানতে পারে না।

আমার ঠিক মনে পড়ছে না কোডারমা থেকে গয়ার দিকে আসার সময়, না গয়া থেকে কোডরমার দিকে যাবার সময় দুটো এঞ্জিন লাগে। যখনই লাগুক তাতে এ গল্পে কোন ক্ষতি নেই। কেননা তখনকার দিনে বাড়তি এঞ্জিনটা একবার যেমন যেত অন্যবার ফিরে আসত। আবার যেত।

ডবল এঞ্জিন জুড়ে গাড়িটা ছাড়ল। রাতও হয়ে গিয়েছে। জঙ্গলের মুখে ঢুকে বেশ শীত-শীত লাগছিল। কাচের জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। চারদিকে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার; গাছপালা আর অন্ধকার মিশে সে এক এমন জগৎ যা চোখে সওয়া যায়না বেশীক্ষণ। তবু গুরপা গুঝাণ্ডির আসল জঙ্গল তখন শুরু হয়নি, তেমনি নিবিড় নয় গাছপালা।

যেতে যেতে গাড়িটা হঠাৎ থেমে গেল।

সব রেলগাড়িই মাঝে-মাঝে বেজায়গায় থেমে যায়। হয় সিগন্যাল না, না হয় অন্য কোনো গোলমাল হয়; কেন যে থামে যাত্রীরা বুঝতেও পারে না।

গাড়িটা থামার পর সামান্য সময় চুপচাপ কেটে গেল। ভাবছি, এই ছাড়বে। গাড়ি আর ছাড়ে না। হঠাৎ শুনি এঞ্জিনের হুইসেল বাজছে তারস্বরে। বাজছে তো বাজছেই।

বেহারী ভদ্রলোক জেগে ছিলেন, বললেন, ‘লাইনের ওপর নিশ্চয় বাঘ বসে আছে। সরছে না।’

রেল লাইনের ওপর বাঘ বসে থাকে, এঞ্জিনের অত জোরালো আলোয় নড়ে না, শব্দতেও, আমার জানা ছিল না।

আমার কাকাও দেখি বাংক থেকে নেমে এলেন। ব্যাপারটা কী হচ্ছে বোঝার জন্যে জানালা খুলে দিলাম। দেখি গার্ডসাহেবের হাতের সেই লাল সবুজ লণ্ঠন ঝুলিয়ে সামনের এঞ্জিনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর সঙ্গে দু’একজন খালাসী ধরনের লোক বোধহয় পেছনের এঞ্জিনের। লাইনের পাশ দিয়েই যাচ্ছে সবাই।

আমাদের মতন আরও অনেকে গলা বাড়াচ্ছে কামরার মধ্যে থেকে। গাড়ির বাইরের দিকের আলো পড়েছে সামান্য, ভেতরের আলোও জানালা দিয়ে বাইরে পড়ছিল আবছাভাবে।

আমার কাকা আর বেহারী ভদ্রলোক নানা রকম কথা বলতে লাগলেন। ঠাকুমা একটু শুয়েছে। সেই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোক কিন্তু বাংকের ওপর পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছন। টুপিতে মুখ ঢাকা।

গাড়ি আর ছাড়ে না।

ঠিক যে কতক্ষণ কাটল তাও বুঝতে পারলাম না। শেষে দেখি গাড়ির দরজা খুলে অনেকেই নামতে শুরু করেছে। নেমে যে যার কামরার পা-দানির কাছে দাঁড়িয়ে। নানা রকম গলা শোনা যাচ্ছে। জঙ্গলের মধ্যে কারও সাহস নেই দু’পা এগিয়ে কিছু জেনে আসবে।

আমার কাকাও দরজা খুলে নীচে নামলেন। আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। কী যে হচ্ছিল তাও বুঝতে পারছিলাম না।

শেষ পর্যন্ত বেশ শোরগোল পড়ে গেল। কেমন করে যেন দু-চারটে টর্চও বেরিয়ে গেল। লাইনের পাশ দিয়ে যাতায়াত করতে লাগল কেউ কেউ। গার্ড সাহেব শেষ পর্যন্ত ফিরতে লাগলেন। লোকে খোঁজ খবর নিচ্ছে, হল কী?

কাকা একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন। খবর নিয়ে ফিরে এসে শুকনো মুখে বললেন, সামনের এঞ্জিনের ড্রাইভার মারা গিয়েছে হঠাৎ। নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। ফায়ারম্যানদের একজন গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। শুনে আমি চমকে উঠলাম। বেহারী ভদ্রলোক বললেন, ‘হায় ভগবান!’

মানুষ হঠাৎ কেমন করে মারা যায়, সে বয়সে বুঝতাম না। এখন বুঝি। তখন বুঝতে পারিনি ড্রাইভারের সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছিল। তখন এ-সব রোগ নিরোগের কথা শোনাও যেত না।

আগে রেল এঞ্জিনের মধ্যে ড্রাইভারের সঙ্গে কয়লা-দেওয়া জনা দুয়েক লোক ছাড়াও বোধ হয় একজন সাগরেদ থাকত ড্রাইভারের। এদেরই কেউ গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। দিয়ে ঘন ঘন হুইসেল্ মেরে বিপদটা জানাচ্ছিল গার্ডকে।

এখন কী হবে? ড্রাইভার তো মারা গেল। গাড়ী চালাবে কে? আমরা কি সারা রাত এই জঙ্গলে পড়ে থাকব?

ড্রাইভার মারা গেছে এটা কোনো রকমে সব কামরায় প্রচার হয়ে পড়ল। তারপর একটা হই-হই। বাইরে বড় কেউ নামছে না, পাদানির তলায় দাঁড়িয়ে আছে। গলা বাড়াচ্ছে সবাই।

এমন সময় শোনা গেল, মৃত ড্রাইভারকে নামিয়ে ব্রেকভ্যানে তোলা হচ্ছে। দেখতে দেখতে রাত বেড়েই চলল। আমরা অসহায়ের মতন গাড়িতে বসে আছি। ভাবছি, এই জঙ্গলে সারাটা রাত কাটাতে হবে। না জানি কী হবে!

গার্ড সাহেব বেশ চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। কতবার যে সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করলেন! তারই তো যত ঝঞ্ঝাট ঝামেলা। এতগুলো যাত্রীর জীবন-মরণ যেন তারই হাতে।

আরও খানিকটা পরে দেখি গার্ড সাহেব প্রত্যেকটি কামরার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন বলে দিচ্ছেন। বোধ হয় সাবধান করে দিচ্ছেন; বলছেন, যে যার কামরায় দরজা বন্ধ করে বসে থাকো, সকাল না হলে কিছু করার উপায় নেই।

আমাদের কামরার কাছে এলেন গার্ড সাহেব। আধ খোলা দরজা দিয়ে উঠলেন ভেতরে। লম্বা-চওড়া চেহারা, অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান গার্ড। বললেন, ‘আপনাদের সারারাত গাড়িতেই থাকতে হবে। সাবধানে থাকবেন। খুবই দুঃখের কথা, সামনের এঞ্জিনের ড্রাইভার হঠাৎ মারা গেছেন।’

গার্ড সাহেব নেমে যাবার একটু পরেই দেখি বাংক থেকে সেই অ্যাংলো ভদ্রলোক নেমে এলেন। টুপি পড়লেন এমন করে যে, মুখটা আড়াল হয়ে গেল। ভাল করে দেখতেও পেলাম না মুখটা।

ভদ্রলোক কামরা থেকে নেমে গেলেন। তারপর দেখি পাশের কামরা থেকে গার্ড সাহেব নামামাত্র কী সব কথাবার্তা বলছেন।

সামান্য পরে দেখলাম গার্ড সাহেব আর সেই লোকটি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

কাকা বললেন, ‘যে মারা গেছে তার কেউ হবে।’

বেহারী ভদ্রলোক বললেন, ‘মালুম, দোস্ত....।’

ঠাকুমা বললেন, ‘দরজাটা বন্ধ করে দে।’

আমরা যখন দরজা বন্ধ করে, জানালার শার্সি ফেলে যে যার শোবার ব্যবস্থা করছি, তখন একেবারে আচমকা হুইসেল বেজে উঠল। বার তিন। টানা টানা। তারপরই গাড়ি আবার নড়ে উঠল।

সবাই অবাক।

কাকা বললেন, ‘লোকটা নিশ্চয় ড্রাইভার। এ-লাইনে হরদম রেলের কত লোক আসা যাওয়া করে। যাক্ বাবা, বেঁচে গেলাম। কোডরমা তো পৌঁছই। এই জঙ্গলে সারা রাত পড়ে থাকতে হলে মরে যেতুম।’

গুরপা-গুঝাণ্ডির জঙ্গল পেরিয়ে আমরা কোডরমা পৌঁছালাম যখন তখন প্রায় মাঝ রাত।

স্টেশনে গাড়ি থামল। হঠাৎ শুনি প্লাটফর্মে হই-হই। জানলা দরজা খুলে নেমে গেল অনেকে। কাকাও নেমে গেলেন। খানিকটা পরে ছুটতে ছুটতে এসে বললেন, ‘সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! ওই যে লোকটা আমাদের কামরা থেকে নেমে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এল, সেই লোকটা যখন গাড়ি চালিয়ে আনছিল, তখন এঞ্জিনের ফায়ারম্যানরা বয়লারের আলোয় লোকটাকে পুরো দেখতে পেয়েছিল। এক্কেবারে মরা ড্রাইভারের মুখের মতন দেখতে। সেই মরা ড্রাইভারই। গাড়ি থামতেই দুটো ফায়ারম্যান এঞ্জিন থেকে নেমে পালিয়েছে। লোকটাকেও আর দেখা যাচ্ছে না।’

বেহারী ভদ্রলোক বললেন, ‘হায় রাম!’ বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

আমি বললুম, ‘আর গার্ড সাহেব?’

কাকা বললেন, ‘গার্ড সাহেব ব্রেক ভ্যান খুলে ডেডবডি নামাবার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। বলছেন, মরা ড্রাইভারর আর জ্যান্ত ড্রাইভারে কে যে সত্যি আর কে মিথ্যে—তিনি বুঝতে পারছেন না।

আমার হাত-পা কাঁপছিল, গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। আমি বললাম, ‘তাহলে কে গাড়ি চালিয়ে আনল?’

কাকা বললেন, ‘আমিও তো ভাবছি ভূতে তো আর গাড়ি চালাতে পারে না! কিন্তু ফায়ারম্যানেরা বা কেন পালাবে? লোকটাই বা কেন উধাও হবে? আশ্চর্য!’

আমার মনে পড়ল, সাসারাম স্টেশনে লোকটা ওঠা মাত্র আমাদের কামরার আলো দপ করে নিবে গিয়েছিল।

কেন?

আপলোড: ১৮/১২/২১

Tuesday 5 January 2021

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোঃভাঃ): চেতলার কাছে (লীলা মজুমদার)

 


চেতলার কাছে

লীলা মজুমদার

চেতলা, কালীঘাট, আদিগঙ্গা ইত্যাদি যতই পবিত্র স্থান হোক না কেন, ও সব জায়গা মোটে ভাল না। আর লোকের মুখে মুখে কী সব অদ্ভুত গল্পই যে শোনা যায়, তার লেখা-জোখা নেই। তাছাড়া মশা-মাছি তো আছেই। চিলতে চিলতে সব গলি, তাতে মান্ধাতার আমলে তৈরি ঝুরঝুরে সব বাড়ি। তায় আবার সব বাড়ি থেকে সব বাড়ির উঠোন দেখা যায়। এক ফালি উঠোনের মধ্যে এই বড় বড় সব গাছ। তালগাছ, আমগাছ, বটগাছ, তাদের ডালপালা বেয়ে, ঝুরি ধরে ঝুলে যে কোন বাড়ি থেকে যে কোন বাড়িতে চলে যাওয়া যায়। বিপদ বুঝলে একটা হাঁক দিলেই হল। সবাই সাত পুরুষ ধরে সবার চেনা। পুরনো সব ঝগড়াও আছে, তার কারণ নিজেরাই ভুলে গেছে, তবু এখনো কথাবার্তা বন্ধ। মুখ দেখা আর কী করে বন্ধ করে, নড়বড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই, সব বাড়ি থেকে সব বাড়ির রান্নাঘরের ভিতর পর্যন্ত দেখা যায়। কার বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সবাই চোর ছ্যাঁচোর খুনে পর্যন্ত জানতে পারবে। একটা টিকটিকি লুকোবার কোথাও জায়গা নেই, দুষ্কৃতকারীদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। কার ঘরে চুরি করার মতো কী আছে এবং কোথায় আছে তাও সবাই জানে। নেইও অবিশ্যি কারো কিছু। সেদিক দিয়ে জায়গাটাকে চোরেদের গোবি মরুভূমিও বলা যায়।

আমার বন্ধু বটুর বড়কাকা ওখানকার থানার মেজো দারোগা। তাছাড়া ওদের সাত পুরুষের বাড়িও ওখানে। নাকি বাড়ি হবার সময় ক্লাইব জন্মায়নি। বটু জায়গাটার নাম দিয়েছে মিসার হতাশা। শুনে বড়কাকা খুবই মুষড়ে পড়েছেন, দুষ্কৃতকারীরাই যদি একটু সুযোগ না পেল, তাহলে ওর হেড অপিসে উন্নতি হয় কী করে? অবশ্যি ও সব সাধারণ জিনিসের চাইতেও অন্য এক আরও ভয়ের জিনিস আছে, সবাই সন্ধে হতে যার ভয়ে জুজু। অধিকাংশই ওপর হাতে একগোছা শঙ্কট তারিণী মাদুলি বেঁধে নিরাপত্তা রক্ষা করেন। কারণ পুলিসে আর কী-ই বা করতে পারে?

বটুদের উঠোনের আম পাকলে বটু আমাকে তিন দিনের জন্য ধরে নিয়ে গেছিল। ঐ তিনদিনে আমি যতগুলো সত্যিকার ভূতের গল্প শুনলাম, সারা জীবন ধরে অত শুনিনি। সবাই সবার পাশের বাড়ির অশরীরীদের নিয়ে।

কী বড় বড় সবুজ রঙের চিংড়ি মাছ নিয়ে একটা লোক বিক্রি করতে এল। চিল-কোঠায় পুজো করতে বসে তাকে দেখেই বটুর ছোট ঠাকুমা চ্যাঁচাতে লাগলেন, ‘না বাছা, এস্থানে ও মাছ কেউ খাবে না। তুমি অন্য জায়গায় দেখ।’

বটুতো চটে কাঁই, কী ভালো ভালো চিংড়ি মাছ! ছোট ঠাকুমা নেমে এসে বললেন, ‘বাস, মাছ দেখেছিস তো অমনি হয়ে গেল। আরে ওকি সত্যিকার মাছ? অত বড় চিংড়ি কখনো চার টাকায় দেয় কেউ? আবার বলছে পরে দাম নেবে।’

বটু বলল, ‘আহা, বলল যে বিক্রি না হলে পচে যাবে।’

কাষ্ঠ হেসে ছোট ঠাকুমা বললেন, ‘তুইও যেমন। তাছাড়া ওগুলো মাছও নয়। ঐ জেলের পো-ও মানুষ নয়, সব ইয়ে।’এই বলে ছোট ঠাকুমা হাতে শান্তি জল ছেটাতে শুরু করলেন।

বটুও বলল, ‘সত্যিও হতে পারে, মুখটা কেমন মিচকে মতো দেখলি না?’

আমি বললাম, ‘যাঃ। ভূতের হাঁটু উল্টোদিকে থাকে আর ওদের ছায়া পড়ে না।’

ছোট ঠাকুমা শুনতে পেয়ে ডেকে বললেন, ‘ইদিকে এখনো রোদ আসেনি বাবা, ছায়া দেখবে কী করে? সে যাই হোক, আদি গঙ্গার বটগাছের তলায় যেন কখনো যাসনি। জায়গাটা ভালো নয়।’

গিজগিজে সব বাড়ি, বটগাছ তলায় যেতে হলে সার্কাস করতে হয়। অথচ সেখানে নাকি কারা কাপড় কাচে, ঝগড়া করে, মাছ ধরে। তাল মিলিয়ে এই আদি গঙ্গাও এক রহস্য! মাল বোঝাই বড় বড় নৌকো কখনো চিৎপাত হয়ে কাদার উপর পড়ে ঝিমোয়! অথচ মাঝিগুলোর কিছুমাত্র ভাবনা নেই। নৌকোর দিব্যি রান্না–খাওয়ায় ব্যস্ত! তবে খানিক বাদেই জল বাড়তে শুরু করে আবার। ভেসে ওঠে মাল বোঝাই নৌকোগুলো। কী কাণ্ড, ততক্ষণে মাঝিদের রান্না–খাওয়াও সারা। দড়ির গুণ কাঁধে ফেলে দিব্যি পাড় বরাবর টানতে থাকে নৌকো। বাঁকের ওধারে হারিয়েও যায়। 

এদিকে কখন সূর্য ডুবে গেছে, সামনের দোতলায় লটঘটে বারান্দায় দুজনে গল্প করছি। ছপ করে কী একটা পায়ের কাছে পড়ল। আর সে কী সুগন্ধ ভুরভুর করতে লাগল। তুলে দেখি কলাপাতায় মোড়া বড় বড় চিংড়ি মাছ ভাজা। নীচের দিকে চেয়ে দেখি, সেই মিচকে লোকটা মিট মিট করে হাসছে। মোটা মোটা কান, নাকে মস্ত আঁচিল। একতলার বৈঠকখানা থেকে বটুর পিসেমশাই ডেকে বললেন, ‘কে? কে ওখানে ?’

মুহূর্তে কেউ কোথাও নেই! আমরা দুজন অবশ্য খেয়ে ফেললাম সব কটা চিংড়ি মাছ। যদি এগুলো চিংড়ি মাছ নাও হয়, তবু খেতে বেজায় ভালো।

ভিতর দিকের উঠানে আম গাছের গায়ে লাগা বুড়ো তালগাছ। ছোট-ঠাকুমা সাদা রেকাবি করে খোয়া ক্ষীর, চিঁড়ের মোয়া আর বড় বড় মনাক্কা নিয়ে তালগাছের কোটরে রেখে ভক্তি ভরে গলায় কাপড় জড়িয়ে প্রণাম করলেন। ছোট ঠাকুমা চলে যেতেই বটু বলল, ‘ব্ৰহ্মদত্যিকে তোয়াজ করা হচ্ছে। তালগাছে বাস করেন তিনি।’

আরও কী বলতে যাচ্ছিল বটু, ছোট ঠাকুমা পিছন থেকে বললেন, ‘অমন অছেদ্দা করিসনে বাছা। উনি আমার অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহের ছোট ভাই। চটিয়ে দিলে সব্বোনাশ করবেন, খুশি রাখলে আমাদের জন্য না পারেন এমন জিনিস নেই। ঐ বিদ্যে বুদ্ধি নিয়ে বছরে বছরে পাস করে যাচ্ছিস, সেটা কী করে সম্ভব সে কথা কখন ভেবেছিস? হুঃ।’

বলে ছোট-ঠাকুমা গীতা পড়তে ঘরে গেলেন। যাবার সময় আরো বলে গেলেন, ‘তোরা বিশ্বাস না করতে পারিস, কিন্তু রোজ উনি এই জিনিস গ্রহণ করেন, আর তার বদলে একটি পয়সা আশীর্বাদী—’

আর বলা হল না কারণ সেই সময় বড়কাকা বাড়ি এলেন।

বড় কাকা খুব চটে ছিলেন। চা আর চিঁড়ের মোয়া খেতে খেতে বললেন, ‘এখুনি আবার বেরোতে হবে। বাজারের লোকদের নালিশের জ্বালায় আর টেকা যাচ্ছে না। গোলাবাড়িতে রাতে তদন্তে যেতে হবে।’

তাই শুনে বড়কাকী এমনি চমকে গেলেন যে, হাতের দুধের হাতা থেকে অনেকখানি দুধ মাটিতে পড়ে গেল। চোখ গোল গোল করে ফ্যাকাসে মুখে বললেন, ‘কিন্তু, কিন্তু…’

বড়কাকা কাষ্ঠ হাসলেন, ‘কিছু কিন্তু–কিন্তু নয়। এর ওপর আমার প্রমোশন নির্ভর করছে। কোনো ভয় নেই, ছটা ষণ্ডা লোক সঙ্গে থাকবে। হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে।’

বটুর কাছে শুনলাম যে, বাড়িটাতে একশো বছর কেউ থাকে না। বড়ই দুর্নাম। নাকি ওটা চোরাচালানকারীদের গুহ্য আড়ত। মাটির তলায় সুড়ঙ্গ আছে, আদিগঙ্গায় তার মুখ। অনেকে দেখেছে। সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে সোনাদানা বেআইনী জিনিস বস্তা বস্তা পাচার করা খুব শক্ত নয়। বাজারে নাকি ওদের চর ঘুরে বেড়ায়। কখনো জেলে সেজে, কখনো পুরুত ঠাকুর সেজে। এটা ওটা কিনতে চায়, চা খেতে চায়, অচল পুরনো পয়সা দিয়ে দাম দিতে চায়। তা লোকে শুনবে কেন? দিয়েছে নালিশ করে। বড়কাকা বলেছিলেন, ‘লোকটাকে ধরা যায় না। ফুসফাস করে এখান দিয়ে ওখান দিয়ে গলে পালায়। কোনো দোকানদারের সঙ্গে ষড়ও থাকতে পারে। শুনেছি চেহারা দেখেই সন্দেহ হয়, কীরকম মিচকে মতো, মোট মোটা কান, নাকের ডগায় আঁচিল।’

শুনে আঁতকে উঠেছিলাম, বটা কনুইয়ের গুঁতো মেরে থামিয়ে দিয়েছিল। আটটা বাজতেই মহা ঘটা করে আটজন সশস্ত্র লোকজন নিয়ে বড়কাকা তদন্তে চলে গেলেন। ছোট ঠাকুমা তাঁর গলায় হলদে সুতো দিয়ে একটা বেলপাতা ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ব্যস, আর ভয় নেই। সেখানে গিয়ে কেউ কিছু দিলে খাসনে যেন। দুগগা, দুগগা।’

বড়কাকা চলে গেলে বললেন, ‘কামান দেগে হাওয়া ধরা, হুঁ।’

আমরা ছাদে গিয়ে আদিগঙ্গায় জল বাড়তে থাকা দেখতে লাগলাম। বটু বলল, ‘ঐ গোলাবাড়ীটা আমার ঠাকুরদার অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের ছোট ভাই পেয়েছিল। ব্যাটা মহা লক্ষ্মীছাড়া ছিল, লেখাপড়া শেখেনি, কাজকর্ম করত না, খালি মাছ ধরার বাই ছিল আর চীনে ব্যবসাদারদের কাছ থেকে চায়ের নেশা ধরেছিল। দুদিনে বাড়ীর সব ঝাড়বাতি, আসবাব পত্তর, রূপোর বাসন, বেচেবুচে সাফ করে দিল। ওর বুড়ী মা নাকি খুচরা পয়সা–কড়ি এমনি লুকিয়ে রেখে চোখ বুজেছিলেন যে, ব্যাটা সে সব খুঁজেই পায়নি। এখনো নাকি খুঁজে বেড়ায়। তাই ও বাড়িতে কেউ রাত কাটায় না। সেইখানে গেছে বড়কাকা তদন্ত করতে। খুচরো টাকাকড়ির বাক্সটা পেলে মন্দ হয় না। আমরাই তো ওর ওয়ারিশ। সে ব্যাটাতো বিয়েই করেনি। বিশ্রী দেখতে ছিল নাকি। শুঁটকো, কালো বড় বড় কান, চাকর চাকর চেহারা। গেঞ্জি গায়ে ঘাটে বসে অষ্টপ্রহর আদিগঙ্গায় মাছ ধরত। কে! কে ওখানে?’

খচমচ করে তালগাছ থেকে আমগাছ। আমগাছ থেকে নড়বড়ে বারান্দা কাঁপিয়ে মিচকে লোকটা হাসি হাসি মুখ করে উঠে এসে নাকের ফুটো ফুলিয়ে ফোঁস-ফেঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, চা চা গন্ধ পাচ্চি মনে হচ্ছে।’

মিথ্যে নয়। কেতলিতে একটু চা আর একটা মটির ভাঁড় বটু লুকিয়ে এনেছিল সামনের দোকান থেকে। নীচে নামাতেও হয়নি, ওদিকে মিচকে লোকটা ততক্ষণে তেঁতুলগাছে বসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, রোজকার মতো।

চা পেয়ে লোকটা আহ্লাদে আটখানা, মিচকে মুখ যেন সাত ভাজ হয়ে গেল। বললাম, ‘পেঁয়াজি খাবে নাকি?’

জিব কেটে বলল, ‘অ্যাঁ, ছি ছি ও নাম করবেন না। আমার বরাদ্দ রোজগার মতো খেয়েই এসেছি, চিড়ের মোয়া, খোয়া ক্ষীর, মেওয়া—’

বটু আর আমি এ ওর দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না। খাক না বেচারি।

মিচকে লোকটি বলল, ‘বড়কর্তা আমাদের ওখানে এমন হাঁকডাক লাগিয়েছেন যে, টিকতে না পেরে ওনার এখানে গা ঢাকা দিতে এসেছি। দেখ দাদা, তালগাছের মুড়োয় তোমাদের জন্য একটা দ্রব্যি রেখে গেলাম। আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। সেখানে মা অমৃতি বানায়।’

বটু ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কেন চলে যাবে। এখানে বুঝি খেতে পাও না।’

ফিক করে হেসে মিচকে লোকটা বলল, ‘দুবেলা নৈবিদ্যি পাই। কষ্ট কিসের? ঐ এল বলে আমি উঠি।’ বলেই হাওয়া।

নীচে বড়কাকাদের রাগ রাগ গলার হাঁক-ডাক শোনা গেল। নিশ্চয় কিছু দুষ্কৃতকারীটারি ধরতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে আদ্যিকালের তালগাছটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। পোকা ধরা, পুরানো গুঁড়ি ভেঙ্গেচুরে একাকার। তার মধ্যে দেখা গেল বেশ বড় একটা কাঠের হাতবাক্স, পুরানো টাকা কড়িতে তার অর্ধেক ভর্তি। আর চাঁচা–পোঁছা নৈবেদ্যের রেকাবিটা তিন টুকরো হয়ে পড়ে আছে। বড় কাকার রাগ ঠাণ্ডা।

পরদিন বড়কাকা বললেন, ‘আশ্চর্যের বিষয়, সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা খোপে ঐ বাক্স রাখার স্পষ্ট দাগ দেখলাম। সেই বুড়ী ঠাকরুণ তাহলে বাউণ্ডুলে ছেলের হাত থেকে ওটাকে বাঁচাবার জন্য এখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন! এটাও তো তাঁদেরই বাড়ি।’

ছোট ঠাকুমা শূন্যে নমস্কার করে বললেন, ‘কত বাঁচিয়ে ছিলেন সে তো বোঝাই যাচ্ছে! ও বটা, এবার থেকে নিজে পড়িস দাদু, সে তো গেল।’ ফোঁত ফোঁত করে একটু কেঁদেও নিলেন। বড়কাকা তো অবাক!

আপলোড: ৯/১১/২০২১

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): বিনোদ ডাক্তার (হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়)


বিনোদ ডাক্তার

হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

মার চাকরিই এইরকমের। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা ঘুরে বেড়ানো। ব্যাঙ্কের হিসেব দেখে দেখে। কোথাও তিন-চার দিনেই কাজ হয়ে যায়, আবার কোথাও দিন কুড়িও লেগে যায়। এটা নির্ভর করে ব্যাঙ্কের হিসাবের জট কেমন পাকিয়েছে তার ওপর।

আগে ব্যাঙ্কের শাখা কেবল বড় বড় শহরেই থাকত। কিন্তু এখন চাষীদের সুবিধার জন্য আধা শহরে, গ্রামেও শাখা হচ্ছে। আমাকে বেশীর ভাগ সময় এই আধা শহরেই যেতে হত।

এই ধরনের কাজে একবার বিরামপুরে যেতে হয়েছিল। সকালে অফিসে গিয়ে শুনলাম বেলা তিনটার গাড়িতে রওনা হতে হবে। আমার এক প্রস্থ বিছানা বাঁধাই থাকত। সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে ট্রেনে চড়ে বসলাম।

বিরামপুর স্টেশনে যখন নামলাম, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারদিকে কেরোসিনের আলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তায় লোকচলাচল বিশেষ নেই।

ব্যাঙ্ক থেকে একটি লোক আমায় নিতে এসেছিল। আমরা দু'জন সাইকেল রিকশায় চড়ে বেশ কিছুটা গিয়ে একতলা লাল রংয়ের বাড়ির সামনে পৌঁছলাম।

সঙ্গের লোকটি বলল, নামুন সার, এখানেই আপনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দু'খানা ঘর, মাঝখানে ছোট উঠান, ওপাশে রান্নাঘর। একজনের পক্ষে যথেষ্ট। দরজার কাছে একটি লোক বসেছিল। সে আমাদের দেখে উঠে দাঁড়াল। ব্যাঙ্কের লোকটি বলল, স্যার, আপনার রান্নাবান্না, বাসন মাজা, ঘরদোর ঝাড়ামোছার কাজ এ-ই করবে।

রাত নটার মধ্যেই খাওয়া শেষ করে শোবার আয়োজন করলাম। কাজের লোকটা চলে গেছে। এখান থেকে তার বাড়ি চার মাইল দূরে। আবার কাল ভোর ছটায় আসবে।

শোবার মিনিট দশেকের মধ্যে পেটের যন্ত্রণা শুরু হলো। অসহ্য যন্ত্রণা! শরীর একেবারে কুঁকড়ে যায়। মনে হয় দমবন্ধ হয়ে যাবে।

এরকম আমার মাঝে মাঝে হয়। সেইজন্য সব সময় ওষুধ কাছে রাখি।

হ্যারিকেনের শিখাটা বাড়িয়ে দিয়ে সুটকেসটা খুললাম। তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। সর্বনাশ! ওষুধের শিশিটা ফেলে এসেছি। বেশ মনে আছে শিশিতে গোটা আটেক বড়ি ছিল।

এখন উপায়! বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আসবার সময় কাছেই এক ডাক্তারখানা চোখে পড়েছিল। ডাক্তারখানার নামটা অদ্ভুত! আরামঘর। নীচে লেখা, চব্বিশ ঘণ্টা খোলা। যদিও ডাক্তারখানা বন্ধ ছিল তখন। হয়তো ডাক্তারবাবু লাগোয়া বাড়িতেই থাকেন। কোনো দরকারে ঘরে গিয়েছিলেন তখন।

হাতঘড়িতে সময় দেখলাম ন'টা চল্লিশ। এত রাতে এই মফঃস্বল শহরে ডাক্তারখানা কি খোলা থাকবে? যাই হোক আমাকে একবার চেষ্টা করে দেখতেই হবে। যন্ত্রণা ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছে।

যদি ডাক্তারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েই থাকে, তাহলে খোঁজ করে দেখতে হবে ডাক্তার হয়তো ওই বাড়িতেই থাকে। দরজা ধাক্কা দিয়ে তাকে উঠিয়ে একটা ব্যবস্থা করতে বলতে হবে।

কোন রকমে উঠে দরজায় তালা লাগিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। চারদিক অন্ধকার। রাস্তায় বাতিগুলো নিভিয়ে দিয়েছে।

দু হাতে পেট চেপে প্রায় কুঁজো হয়ে এগিয়ে গেলাম। বরাত ভাল। আরামঘর খোল। টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছে।

ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল। পরনে কালো রংয়ের সুট। কালো টাই। ময়লায় তেলচিটে অবস্থা। একমাথা পাকা চুল প্রায় কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। তোবড়ানো মুখ। দুটি চোখ রক্তের মতন লাল।

কি চাই? রোগা চেহারা হ'লে হবে কি, বাজখাঁই গলার আওয়াজ। পেটের যন্ত্রণার কথা বললাম।

আমার কথা শেষ হবার আগেই ডাক্তার ধমক দিয়ে উঠল, বুঝেছি, বুঝেছি, অম্লশূল। বসুন, ওই বেঞ্চটায়। বসলাম। ডাক্তার পিছনের কাচভাঙ্গা আলমারি থেকে একটা শিশি বের করে কাগজে ঢেলে আমাকে দিল, খেয়ে নিন।

তামাকের গুঁড়াের মতন কাল রং। বিশ্রী গন্ধ। ভয় হল, কেমন ডাক্তার জানি না, কি ওষুধ ঠিক নেই। খাওয়া কি ঠিক হবে?

সন্দেহ হলে ফেলে দিন। খেতে হবে না। ডাক্তার গর্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আমি ওষুধটা গালে ঢেলে দিলাম। কি আশ্চর্য, মিনিট পাঁচেকও গেল না। ব্যথাটা একেবারে সেরে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাকে কত দিতে

আবার বোমা ফাটল।

কে মশাই আপনি, বিনোদ ডাক্তারকে পয়সা দিতে চাচ্ছেন? কত লাখ টাকার মালিক আপনি? জানেন না, আমি পয়সা নিয়ে চিকিৎসা করি না।

নিজের দোষ কাটাবার জন্য মৃদু কণ্ঠে বললাম, কিছু মনে করবেন না। আমি এখানে নতুন এসেছি। এসব জানা ছিল । আপনার ডাক্তারখানা কতক্ষণ খোলা থাকে ?

সারারাত, বলেই বিনোদ ডাক্তার খিচিয়ে উঠল, আপনার আর কিছু দরকার আছে? না থাকে তো উঠে পড়ন। আমার অন্য রোগীরা আসবে।

বাড়ি চলে এলাম। অনেক রাত অবধি বিনোদ ডাক্তারের কথা চিন্তা করলাম। ভাল ওষুধ হয় তো দেয়, কিন্তু মেজাজটা রুক্ষ। ভাল ভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। দিন দুয়েক পর ব্যাঙ্কের হিসাব দেখতে দেখতে ম্যানেজার অনিলবাবুকে কথাটা বললাম।

ছোট জায়গা হলে কি হবে মশাই, এখানকার ডাক্তার একেবারে ধন্বন্তরি।

কার কথা বলছেন?

ওই যে আরামঘর-এর বিনোদডাক্তার।

আমার উত্তর শুনে অনিলবাবু কিছুক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে দেখল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, বিনোদডাক্তারের সঙ্গে দেখা হল কোথায়?

বললাম, দিন দুয়েক আগে পেটে একটা ব্যথা হয়েছিল। এরকম আমার মাঝে মাঝে হয়। বিনোদ ডাক্তারের একটা বড়িতেই সেরে গেল। আশ্চর্য ওষুধ!

অনিলবাবু আর কিছু বলল না, কিন্তু লক্ষ্য করলাম সারাটা দিন আমাকে যেন এড়িয়ে চলল।

ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। বিনোদডাক্তার তার বদমেজাজের জন্য বোধ হয় এ এলাকায় কারও প্রিয়পাত্র নয়। এ জন্য অনিলবাবুও সম্ভবতঃ তাকে পছন্দ করে না। তাই আমার বিনোদডাক্তারের কাছে যাওয়াটা অনিলবাবু ভাল চোখে দেখেনি।

কিন্তু আমার অবস্থা আমিই জানি। সারাটা রাত সেই নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করে পরের দিন অনিলবাবুর পছন্দসই ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

দিন কয়েক পর হঠাৎই খেয়াল হল বিনোদ-ডাক্তারের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। খাওয়া-দাওয়া শেষ। গরমের জন্য ঘুমও আসছে না। আরামঘর তো অনেক রাত অবধি খোলা থাকে। দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় জনমানব নেই। এ সময় থাকবারও কথাও নয়। আরামঘরের কাছাকাছি যেতেই হাসির শব্দ কানে এল। অনেক লোকের মিলিত কণ্ঠের হাসি। খুব উচ্চরোলে। তাহলে কি এই সময় বিনোদডাক্তারের বন্ধুরা আড্ডা জমায়। আড্ডা দেবার অদ্ভুত সময় তো! সামনের দিকে কেউ নেই। আওয়াজ আসছে ভিতরের ঘর থেকে। ঘরও ঠিক বলা যায় না। আলমারি দিয়ে একটা ঘরই আলাদা করা।

কৌতূহল হল। দুটো আলমারির ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম। পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন বরফের স্রোত নেমে গেল। পা দুটো কেঁপে উঠল থরথর করে।

টেবিলের ওপর একটা কঙ্কাল শুয়ে। বিনোদডাক্তার স্টেথেসকোপ দিয়ে তার বুক পরীক্ষা করতে করতে বলছে, মগ ডালে ডালে বেড়িও না, তোমার বুকের হাড় খুবই দুর্বল। কোনদিন মট করে ভেঙে যাবে। প্লাস্টার করে শুইয়ে রাখব, তখন মজাটা টের পাবে। বিনোদডাক্তারের কথা শুনে কঙ্কালটার সে কি হাসি! ওপরের দিকে চেয়ে দেখি একটা কঙ্কাল শূন্যে দোল খাচ্ছে। বিনোদডাক্তার তার দিকে দেখে গম্ভীর গলায় বলল, রোজ এই রকম ব্যায়াম করবি, তবে দেহ মজবুত হবে।

হঠাৎ হাসির শব্দে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম, কোণের দিকে বেঞ্চের ওপর বসে আর একটা কঙ্কাল শিশি থেকে বড়ি নিয়ে অনবরত মুখে ফেলছে আর হাসছে। অদ্ভুত হাসি। ঠিক দুটো হাড়ে ঠোকাঠুকি করলে যেমন শব্দ হয়, তেমনি।

কঙ্কালটা হাসতে হাসতেই বলল, বিনোদডাক্তার তোমার চোগা চাপকান খুলে আমাদের মতন হালকা হও দেখি। তোমার গরমও লাগে না?

কঙ্কালটা আচমকা থেমে গেল। আর কথা বলতে পারল না। বিনোদডাক্তার বলল, কি হল হে? কঙ্কালটা অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল, গলার বড়িটা আটকে গেছে। বলেই কঙ্কালটা দুটো হাত দিয়ে নিজের গলাটা মোচড়াল। মাথাটা গলাসুদ্ধ তার হাতে খুলে এল। সেটা বার কয়েক বেঞ্চে ঠুকেই বলল, ব্যাস, বড়িটা নেমে গেছে। ব্যাপার দেখে আমার অবস্থা কাহিল। ভয়ে মুখ থেকে একটা আর্তনাদ বের হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো কঙ্কাল সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, কে, কে ওখানে? আমি আর তিলমাত্র দেরি না করে ছুটতে শুরু করলাম প্রাণপণ শক্তিতে, কোন দিকে না চেয়ে।। পিছনে অনেকগুলো হাড়ের খটমট শব্দ। ক্রমেই কাছে আসছে।

তাড়াতাড়ি তালা খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। বুকটা দুপদুপ করছে। এখনই বুঝি দম বন্ধ হয়ে যাবে।

সারাটা রাত বিছানায় বসে কাটালাম। কেবল মনে হল খটখট শব্দ যেন বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনই হয়তো দরজার কড়া নাড়বে। তারই বা দরকার কি? এরা তো দরকার হলে বন্ধ দরজার মধ্যে দিয়েই চলে আসতে পারে।

আমি খুব ভীতু এমন অপবাদ কেউ দেবে না। ভূত, আত্মা এসবে আমার চিরদিনই আস্থা কম। কিন্তু চোখের সামনে | যে দৃশ্য দেখেছি, তাকে অস্বীকার করি কি করে?

ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জোর খটখট শব্দে চমকে জেগে উঠলাম।

না, ভয়ের কিছু নেই। কাজের লোকটা দরজা ঠেলছে। উঠে দরজা খুলে দিতে সে জিজ্ঞাসা করল, বাবুর কি শরীর খারাপ?

কেন, বল তো?

চেহারাটা কেমন দেখাচ্ছে। তাছাড়া আপনি তো খুব ভোরে ওঠেন।

ছোট করে শুধু বললাম, রাত্রে ভাল ঘুম হয় নি।

একটা সুবিধা, আজ রবিবার। ছুটির দিন। খাওয়া-দাওয়ার পর সারাটা দুপুর ঘুমাব। তাহলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আগের রাতের দেখা সেই বীভৎস দৃশ্য চোখের সামনে থেকে তাড়াব কি করে! বিনোদডাক্তারের সম্বন্ধে সব কিছু আমাকে জানতেই হবে। কাজের লোকটির নাম যোগেন। যখন দুপুরে যোগেন ভাতের থালা রাখছিল তখন তাকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা যোগেন, তুমি কতদিন এখানে আছ?

কোথায় বাবু?

এই বিরামপুরে।

মাথা চুলকে যেগেন বলল, তা বিশ-বাইশ বছর হবে বাবু। কেন বলুন তো?

তুমি বিনোদডাক্তারকে চেন?

বিনোদডাক্তারের নামটা কানে যেতেই যোগেনের মুখের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখের দৃষ্টিতে ভয়ের ছাপ। চিনতাম বাবু। উনি এ এলাকার নামকরা ডাক্তার ছিলেন। ওঁর ওষুধ যেন কথা বলত।

ছিলেন বলছ কেন! এখন নেই?

বাবু। বছর পাঁচেক হল মারা গেছেন।

সে কি!

হ্যাঁ বাবু, চার বন্ধু মিলে পাশা খেলছিলেন, হঠাৎ ঝড় উঠেছিল। যেমন হাওয়ার জোর, তেমনই বৃষ্টির দাপট। কত বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছিল, কত গাছ যে উপড়ে পড়েছিল, তার আর ঠিকঠিকানা নেই।

আরামঘরের পাশে বিরাট একটা বটগাছ ছিল, সেই বটগাছ শিকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়েছিল আরামঘরের ছাদের ওপর। ব্যস, বিনোদডাক্তার আর তার তিন বন্ধু খতম। কেউ একটু চেঁচাবারও অবকাশ পাননি। শিকড়ের মধ্যে এমন ভাবে চার বন্ধুর দেহ চাপা পড়ে গিয়েছিল, যে পরের দিন তাদের দেহ কেটে কেটে বের করতে হয়েছিল।

বাধা দিয়ে বললাম, কিন্তু আমি বিনোদডাক্তারকে যে দেখেছি!

অনেকেই দেখে বাবু। রাত বিরেতে আরামঘরের পাশ দিয়ে যাদের যেতে হয়, তারাই দেখেছে, বিনোদডাক্তার বন্ধুদের ওষুধ দিচ্ছে, কিম্বা চারজনে মিলে পাশা খেলছে। তাছাড়া দিনের বেলাতেও দেখা যায়, আরামঘরের সামনের বেলগাছটা, ঝড় নেই, বাতাস নেই, ডালপালাসুদ্ধু দুলছে। ওই গাছেই ওঁদের বাস কিনা।

কথা শেষ করে যোগেন দুটো হাত কপালে ঠেকাল। চুপ করে শুনে গেলাম। অন্য সময় হলে যোগেনের একটা কথাও বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু আমি নিজের চোখেই তো সব দেখেছি।

সেদিন বিকাল হতে, সূর্যের আলো থাকতে থাকতে বের হয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য, দিনের আলোয় ভাল করে আরামঘরটা দেখব। যদি সম্ভব হয়, বিনোদ ডাক্তারকেও একবার দেখব। ওইখানেই তো ডাক্তারের আস্তানা।

আরামঘরের সামনে গিয়েই থমকে দাড়িয়ে পড়লাম। আরামঘরের দরজাই দেখা গেল না। তার সামনে আগাছার জঙ্গল। আকন্দ আর ফণীমনসার ঝোপে বোঝাই। বুঝতেই পারা যায়, বহুদিন এ দরজা খোলা হয়নি। খোলা সম্ভব নয়। একটু এগিয়ে যেতে তক্ষক ডেকে উঠল। অস্বাভাবিক রুক্ষ স্বর। ঠিক যেন বিনোদডাক্তারের গলা।

তাড়াতাড়ি পিছিয়ে আসতেই এক দৃশ্য চোখে পড়ল।

চারদিক থমথমে। কোথাও ছিটেফোঁটা বাতাস নেই। অথচ সামনের বেলগাছের উঁচু দিকের কয়েকটা ডাল সবেগে দুলছে। সেদিকে তাকিয়ে মনে হল, বিনোদডাক্তারের অশরীরী বন্ধুরা ব্যায়াম করছে নিজেদের দেহের খাঁচা ঠিক রাখার জন্য।

বাড়ি ফিরে এলাম। আরামঘরের কাছাকাছি থাকতে আর সাহস হল না। বিরামপুরেও নয়।

শরীর হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে পড়েছে, এখানে থাকা সম্ভব নয়, এই কথা চিঠিতে লিখে যোগেনকে বললাম পরের দিন সকালে চিঠিটা ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের হাতে দিতে।

সন্ধ্যার ঝোঁকেই সাইকেলরিকশা ডেকে বিছানা সুটকেস নিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হয়ে পড়লাম।

আমার পক্ষে বিরামপুরে থাকা আর সম্ভব নয়। আবার যদি কোন রাতে পেটের যন্ত্রণা শুরু হয়, তাহলে যন্ত্রণায় পাগল হয়ে হয়তো সব ভুলে বিনোদ ডাক্তারের কাছে গিয়ে দাঁড়াব। কিন্তু তার দেওয়া ওষুধ কি আর খেতে পারব? খেতে সাহস হবে?

আপলোড: ১২/১০/২১

হাসির গল্প (মোবাইল ভাঃ): কালীগঞ্জের প্যাকাটি (শিশির বিশ্বাস)

 


কালীগঞ্জের প্যাঁকাটি

শিশির বিশ্বাস

ল্যাপটপ খুলে কাজ করছিলেন দিবাকর রায় রাত হয়েছে বেশ ছোট মফস্বল শহর কালীগঞ্জ প্রায় নিঝুম কালীগঞ্জের এই বাড়িটা অবশ্য বন্ধু রাজীবের চাকরি নিয়ে বছর কয়েক হল আছে এখানে দিবাকরের মতোই এখনও বিয়ে-থা করেনি তবে গোছানো মানুষ সস্তায় পেয়ে অল্পদিন হল কিনে ফেলেছে ছোট একতলা বাড়িটা একাই থাকে অফিসের কাজে দিন কয়েকের জন্য টুরে বেরিয়েছে বাড়িটা খালিই পড়ে ছিল খবরটা পেয়ে দিবাকর সময় নষ্ট করেননি কলকাতায় এক স্কুলে পড়ান সম্প্রতি পি.এইচ.ডি করছেন থিসিস লেখার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে দরকার ছিল দিন কয়েকের জন্য একটু নিরিবিলি ব্যবস্থা তাই চলে এসেছেন এখানে যাবতীয় দরকারি নোটস্ ভরে নিয়েছেন ল্যাপটপে এছাড়া প্রয়োজনে ডেটা কার্ড ওয়েবসাইট তো রয়েছেই জায়গাটাও মন্দ নয় ছোট শহর হলেও কলকাতা থেকে তেমন দূরে নয় সব সুবিধেই রয়েছে অথচ বেশ নিরিবিলি সমস্যা একটাই ভয়ানক সমস্যা কালীগঞ্জে পা দিয়েই সেটা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছেন চারপাশে পানা পুকুর খোলা নর্দমা ফল স্বরূপ অসম্ভব মশার উপদ্রব দিনের বেলা তবু এক রকম সন্ধে নামলে আর রেহাই নেই রাজীব অবশ্য আগেই এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল দিনকালও ভাল নয় দিবাকর তাই সন্ধে হলেই মশারি খাটিয়ে ল্যাপটপ আর খাতাপত্র নিয়ে বিছানায় এভাবে কাজ করতে অসুবিধা হয় খুবই কিন্তু উপায় নেই দিন দুয়েকের কাজ আর বাকি তারপরেই পাততাড়ি গোটাবেন শেষ মুহূর্তে তাই বুঁদ হয়ে কাজ করছিলেন হঠাৎ দেওয়াল ঘড়িতে টুং-টাং শব্দে সুরেলা আওয়াজ শুরু হল রাত একটা

ঘড়ির আওয়াজ তখনও শেষ হয়নি হঠাৎ চটাত করে হালকা একটা শব্দ খুব কাছেই মুহূর্তে ভুরু কুঁচকে উঠল দিবাকরের খেয়াল হল, ঠিক এক ঘণ্টা আগে বারোটা বাজার সময়েও আওয়াজটা পেয়েছিলেন তখন তেমন গ্রাহ্য করেননি কিন্তু এবার আর তা সম্ভব নয় কলকাতার নামি স্কুলের শিক্ষক ছাত্র এবং সহকর্মী উভয় মহলেই সুনাম রয়েছে তবে নিজে ছাত্র জীবনে একেবারেই অন্য প্রকৃতির ছিলেন ভয়ানক ডানপিটে স্কুলে ভাল ছেলে বলে সুনাম ছিল কিন্তু দুষ্টুমিতেও ছিলেন সেরা এজন্য শাস্তিও কম পেতে হয়নি

দিবাকর মশারির ভিতর থেকে সন্তর্পণে চারপাশে চোখ ঘোরালেন সন্দেহজনক কিছু কিছু নজরে পড়ল না একা মানুষ রাজীব ঘরে তেমন কিছুই নেই বড়সড় ঘরটা প্রায় ফাঁকাই বলা চলে ঘড়ির আওয়াজ থেমে গেছে ইতিমধ্যে চারপাশ ফের নিস্তব্ধ পিন পড়লেও শোনা যায় একবার ভাবলেন শোনার ভুল বুঝি কিন্তু নড়েচড়ে উঠলেন তারপরেই রীতিমতো ঝাঁজালো গলায় হাঁকলেন, ‘খাটের তলায় কে রে?’

আওয়াজ উঁচু পর্দায় না হলেও ঝাঁজ ছিল যথেষ্ট কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দিবাকর ফের হাঁক দেবেন কিনা ভাবছেন, হঠাৎ খাটের তলা থেকে চিঁ-চিঁ আওয়াজ, ‘এজ্ঞে আমি প্যাঁকাটি তিন বেজায় মশা

সন্দেহ হলেও দিবাকর এতটা আশা করেননি ততক্ষণে মশারির ভিতর থেকে বাইরে বের হয়ে এসেছেন সামান্য হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘প্যাঁকাটি তিন! তার মানে?’

বললাম তো প্যাঁকাটি তিন অধমের নামরীতিমতো অসহিষ্ণু গলায় জবাব এল খাটের তলা থেকে তারপর মুহূর্তে গুঁড়ি মেরে বের হয়ে এল রোগা লিকলিকে চেহারার একটা মানুষ পরনে মিশকালো ঝুলো হাফপ্যান্ট গায়ে ওই রঙের ঢলঢলে গেঞ্জি

দিবাকর তাকিয়ে ছিলেন হাঁ করে লোকটার খাঁড়ার মতো নাকের দু'পাশে কুতকুতে চোখ দুটো ঝিলিক দিয়ে উঠলএজ্ঞে প্যাঁকাটির মতো চেহারা কিনা, তাই ওই নামেই ডাকে সবাই আর তিন হল নম্বর দলে ওই নামে আরও জনাকয়েক রয়েছে যে কঙ্কাল নামও আছে কয়েকজনের হেঁহেঁএকরাশ দাঁত বের করে হাসল লোকটা

তাহলে চুরির মতলবে ঢুকেছিলি ঘরে!’

হেঁহেঁ সে আর বলতেফের দাঁত বের করে হাসি

তা, খাটের তলায় কতক্ষণ ছিলি বল দেখি? বুঝতেই পারিনি!’

হেঁহেঁ, প্যাঁকাটি তিন খাটের তলায়, আলমারির পিছনে ঘাপটি মেরে থাকবে আর গেরস্ত বুঝে ফেলবে, তাই হয় নাকি! গুরুর টেরেনিং কি মিছে? শুধু ওই বজ্জাত মশা মাটি করল

কথা শেষ না করেই লোকটা প্রায় খেপে গিয়ে নাকের উপর ল্যান্ড করা এক মশার উপর বিরাশি সিক্কার এক থাপ্পড় কশিয়ে দিয়েওফ্‌’ করে ককিয়ে উঠল দেখে ফিক করে হেসে ফেললেন দিবাকর রায় বললেন, ‘তা, এত গুণ তোর, আর সামান্য খোঁজ-খবরটুকু না করেই হানা দিলি এখানে! ঝাড়া হাত-পা মানুষ আমি, বাড়ির মালিক রাজীবও তাই ঘরে আছেটা কী যে চুরি করবি?’

কেন? আপনার ওই লেপ-তোশক! ওটা বাগাবার জন্যই তো এত মেহনতবলতে গিয়ে চোখ দুটো ফের ঝিলিক দিয়ে উঠল প্যাঁকাটির

বলিস কী! স্রেফ লেপ তোশক চুরির জন্য এই মশার ভিতর খাটের তলায় পড়ে রয়েছিস!’ দিবাকর প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন

অ্যাঁ! তাই বলেছি বুঝি!’ জিব কেটে নাক কান মলল লোকটাভুল হয়ে গেছে ছার মুখ্যু মানুষ কিনা এজ্ঞে লেপ তোশক নয় আপনার ওই লেপটেপ

শুনে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে উঠল দিবাকরের এবার আর ভুল হয়নি বুঝতে কী সর্বনাশ! হতভাগার টার্গেট তাহলে ওর ল্যাপটপ! যথেষ্ট দামিই শুধু নয়, এতদিনের যাবতীয় পরিশ্রমের ফসল ভরা আছে ওর ভিতর চুরি গেলে সব কিছু শুরু করতে হত নতুন করে যথাসময়ে থিসিস জমা দেওয়াও সম্ভব হত না মাত্র দিন সাতেক হল এসেছে এর মধ্যে ফিল্ড ওয়ার্কটা ভালই সেরে ফেলেছে! কিন্তু লোকটা কখন যে ঘরে ঢুকল, অনেক ভেবেও সুরাহা করতে পারলেন না বিকেলে রাতের খাবার কিনতে বাজারের দিকে গিয়েছিলেন তারপর সারা সময় ঘরেই রয়েছেন একটু ঢোঁক গিলে বললেন, ‘তা বাপু, কী করে ঘরে ঢুকলি বল দেখি?’

বললাম না, সব গুরুর কৃপা অনেক মেহনত করে শিখতে হয়েছে তারপরেই না দলে জায়গা রাতে খাওয়ার পরে একটু বাইরে বের হয়েছিলেন, মনে নেই? কাজ সেরে ফেলেছি সেই ফাঁকেফের খিঁক করে হাসল লোকটা

রাতের খাওয়াটা দিবাকর আজ একটু তাড়াতাড়িই সেরে ফেলেছিলেন চৌরাস্তার মোড়ে ফার্স্ট ফুডের দোকান আছে সন্ধেয় কিছু একটা নিয়ে আসেন সেখান থেকে আজও গিয়েছিলেন পাশেই রসময়ের মিষ্টির দোকান রাজীবের কাছেই শোনা, এদের ল্যাংচা আর পান্তুয়ার নাকি নামডাক খুব মিষ্টিটা ওর পছন্দের তালিকায় পয়লা নম্বরে হলেও কাজের চাপে আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি বড়জোর দিন দুয়েক আর থাকতে হবে হয়তো তাই রাতের খাবারের সঙ্গে এক হাঁড়ি মিষ্টিও কিনে ফেলেছিলেন একটু বেশি করেই রাতের খাওয়া তাই একটু তাড়াতাড়িই সেরে নিয়েছেন তাও সেই নটা নাগাদ মুখ-হাত ধুয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন মিনিট কয়েক হতভাগা সেই সময়েই ঢুকেছে ভিতরে তার পাশ দিয়েই অথচ টেরটিও পাননি চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘সে তো অনেকক্ষণ রে!’

এ আর এমন কী ছার! গুরুর তালিমে ওসব অভ্যেস আছে প্যাঁকাটির শুধু একটাই সমস্যা, শরীরের বারো আনা রক্ত হতচ্ছাড়া মশার পেটেই চলে যায় ওই জন্যই তো গায়ে গত্তি লাগল না আপনাদের আর কী সন্ধে হতেই দিব্যি মশারির ভিতর ঢুকে পড়েছেন!’

লোকটার কথার ধরণে দিবাকর হেসে ফেলে বললেনতা রাতের খাওয়া হয়েছে তোর?’

শুনে খিঁক করে হাসল প্যাঁকাটিখাওয়াদাওয়া করে কেউ চুরি করতে বের হয় নাকি? আপনি দেখছি কিচ্ছু জানেন না লেখাপড়াই শিখেছেন শুধু

কেন রে?’

গুরুর বারণচোখ নাচাল প্যাঁকাটি আমাদের হেবো গুরুর মানা শোনেনি সেবার ব্যস, গেরস্তের ঘরে ঢোকাই সার হল ভরপেটে খাটের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল বেঘোরে শেষে নাক ডাকা শুরু হতেই হাতেনাতে পাকড়াও খেপে গিয়ে গুরু দল থেকেই দুর করে দিলে তাকেবলতে-বলতে আস্তিনে চোখ মুছল লোকটা বোধহয় হেবোর দুর্গতির কথা ভেবেই

তা, আজ তুইও তো ধরা পড়ে গেলি

সে তো ওই মশার জন্য আর আপনিও যে এত রাত পর্যন্ত মশারির তলায় লেপ-তোশক, থুড়ি লেপটেপ নিয়ে পড়ে থাকেন তা জানব কেমন করে!’

এঃ! শেষে মশার কাছে কাত হয়ে গেলি!’ দিবাকর জিব দিয়ে চুক-চুক শব্দ করলেন

তা, কতক্ষণ আর কামড় সহ্য করা যায় বলুন দেখি!’ প্যাঁকাটি খিঁচিয়ে উঠল এবার, ‘হতচ্ছাড়াগুলো সারা শরীরে প্রায় চাষ করে ফেলেছে আর আপনাকেও বলিহারি, জেগেই যখন রয়েছেন, মশারির তলায় না ঢুকে মশার ধূপও তো জ্বালাতে পারতেন! ওফ্প্রায় এক লিটার রক্ত মেরে দিয়ে গেছে!’

শুধু এক লিটার রক্ত!’ সামান্য নড়ে বসে দিবাকর চোখ নাচালেনআর কিছু নয়?’

কী?’ দিবাকরের কথার ধরনে হঠাৎ যেন থতমত খেল প্যাঁকাটি তারপর একগাল হেসে বলল, ‘ও ম্যালেরিয়া! এজ্ঞে ওসব ছেলেবেলায় হত একসময় এখন আর সুবিধা করতে পারে না

আরে সে ম্যালেরিয়া নয় রে খবরের কাগজ উলটে দেখেছিস কোনও দিন? নাকি ওসবে লবডঙ্কা!’

দিবাকরের কথায় যেন আঁতে ঘা লাগল প্যাঁকাটির মুখ ঝামটে বলল, ‘কেন, রাতে সিঁধ কাটি বলে কি ফেলনা? তবে কাগজ পড়ার সময় কোথায় ছার? রাতভর খাটাখাটির পর ঘুম ভাঙতে সেই বিকেল তখন কে পড়ে ওসব?’

খুব খারাপ খুব খারাপমাস্টারি কায়দায় দিবাকর মাথা নাড়লেনতোদের গুরুর এদিকেও একটু নজর দেওয়া উচিত ছিল রে!’

-কেন বলুন দেখি?’ ফের থতমত খেল প্যাঁকাটি

কেন বলুন দেখি!’ দিবাকর প্রায় ভেংচে উঠলেনরোজকার কাগজে একটু নজর দিলেই বুঝতে পারতি আরে বাপু, এখন সেই মামুলি ম্যালেরিয়ার দিন আর নেই পালটে গেছে বেমালুম কুইনিন তো ছার, আরও ভারি-ভারি ওষুধেও হচ্ছে না কিছু

বলেন কী!’ প্রায় আকাশ থেকে পড়ল প্যাঁকাটি

হ্যাঁ রে আর কী ওজনদার নাম তাদের! ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া, হেমারেজিক ডেঙ্গি, এনকেফেলাইটিস, চিকুন…’

অ্যাঁ! এসব কী?’ দিবাকরের কথার মাঝেই চোখ কপালে তুলে প্যাঁকাটি হাঁ-হাঁ করে উঠল

এসব মশার আমদানি করা রোগ ধরলে আর রেহাই নেই পড়তে যখন পারিস নিজের চেখেই দ্যাখ তাহলেবলতে-বলতে ওয়েবসাইট থেকে দিবাকর সেদিনের এক বাংলা কাগজের প্রথম পাতা ল্যাপটপে খুলে ফেললেন

আগ্রহে ঝুঁকে পড়লেও খানিক চোখ বুলিয়ে প্যাঁকাটি গম্ভীর হয়ে বলল, চশমাটা সঙ্গে নেই পড়েই শোনান বরং

পড়ে আর কী শোনাব সকালেই দেখা হয়ে গেছে আমার দিবাকর রায় হাসলেন, ‘গতকাল কলকাতায় তিন তিনজন মারা গেছে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় জনা কয়েক হাসপাতালে চিকুনগুনিয়ায় মারা গেছে আরও চারজন এনকেফেলাইটিসে…’

বাপরে!’ প্রায় আঁতকে উঠল প্যাঁকাটি শুনিনি তো!'

দিনভর পড়ে ঘুমলে কী আর এসব শোনা যায় রে! এ তো শুধু কলকাতার কথা কলকাতার বাইরে অবস্থা আরও ভয়ানক দাঁড়া, আর একটা কাগজ খুলছি কী লিখেছে দ্যাখ

দিবাকর আর একটা ওয়েবসাইট খুলতে যাচ্ছিলেন প্যাঁকটি ব্যাজার মুখে বলল, ‘রাতটাই মাটি করে দিলেন ছার মনে হচ্ছে জাত ব্যবসাটা ছেড়েই দিতে হবে এবার

ছেড়ে দিবি!’ দিবাকর চোখ নাচালেন, ‘এটা মন্দ বলিসনি

আপনার মতলবটা কী বলুন দেখি?’ প্যাঁকাটির চোখ দুটো হঠাৎ  সন্দেহে দুলে উঠলসেই থেকে খেলিয়ে যাচ্ছেন শুধু!’

মতলব আর কী?' নির্লিপ্তি গলায় দিবাকর বললেন, ‘রাত দুপুরে গেরস্তের ঘরে চুরি করতে ঢুকে ধরা পড়েছিস কিছু তো করতেই হবে

, এই মতলব!’ আরামে একটা নিশ্বাস পড়ল প্যাঁকাটির, ‘তা ডাকুন পুলিশ যা দিনকাল, জেল-হাজতে কদিন থাকতে পেলে বিশ্রাম হয় একটু

উঁহু, সেটি হচ্ছে না বাপু মুচকি হেসে দিবাকর মৃদু মাথা নাড়লেন

তাহলে?' কুতকুতে চোখ দুটো ফের কুঁচকে উঠল প্যাঁকাটির

হাজার হোক রাত দুপুরের কুটুম তুই শুধু হাতে ফিরে যাবি, তাই কি হয়? টেবিলে ঢাকা দেওয়া হাঁড়িতে গোটা কয়েক মিষ্টি আছে একটু মিষ্টিমুখ করে যা বরং রাতও তো কম হয়নি

অ্যাঁ!’ এই এতক্ষণে প্যাঁকাটির ঠোট ঝুলে পড়ল

হ্যাঁ রে স্কুলের মাস্টার আমি ছেলেদের গায়ে হাত তুলিনি কখনও তোর বেলাতেই বা অন্য রকম হবে কেন?’

পাশেই টেবিলের উপর মিষ্টির হাঁড়ি সেদিকে সামান্য ঘাড় ফিরিয়ে চোখ দুটো হঠাৎ জুলজুল করে উঠল প্যাঁকাটির এ যেঅ্যাটম বোম গো কত্তা!’

ব্যাপারটা জানা ছিল দিবাকরের বন্ধু রাজীবের কাছেই শোনা ছোট হলেও কালীগঞ্জ অনেক দিনের পুরনো শহর সেই যুদ্ধের সময় জাপানি বোমার ভয়ে কলকাতার অনেকে এসে ভিড় করেছে কালীগঞ্জে তারপর তো খোদ জাপানেই বোমা পড়ল রসময় ময়রা তখন বেঁচে মাথা খাটিয়ে সরেস ছানা আর ক্ষীর দিয়ে তৈরি খাটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা এক পোয়া ওজনের বিশাল আকারের পান্তুয়া গড়ে নাম দিয়েছিলেনঅ্যাটম বোম সাইজ আর সেই আগের মতো নেই বটে, তবু ওই নামেই এখনও বিখ্যাত হয়ে রয়েছে মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বললেন, তাহলে আর দেরি করিসনে বাপু

প্যাঁকাটিও দেরি করল না এরপর মুহূর্তে প্রায় হামলে পড়ল হাঁড়ির উপর খেতে খেতেই বলল, ‘রাতের কুটুমের খাতিরে ব্যবস্থাটা ভালই করলেন কত্তা কিন্তু মুশকিলেও ফেলে দিলেন একটু

কেন রে?’

গুরুর বারণ গো কিন্তু রসময়ের অ্যাটম বোম বলে কথা! মাথা ঠিক রাখা যায়! আপনিই বলুন?

গুরুর কথা রাখমোলায়েম গলায় দিবাকর বললেন, ‘বরং এই অধমের কথাটা পারলে মনে রাখিস একটু নইলে স্রেফ মশার হাতেই মারা পড়বি একদিন ছারই বল আর কত্তা, কেউ বাঁচাতে পারবে না

আপনি তো বলেই খালাস কত্তা জাত ব্যবসা ছাড়া কী সহজ কাজ!’ মিষ্টির হাঁড়ি শেষ করে হাত চাটতে-চাটতে ব্যাজার হয়ে বলল প্যাঁকটি তারপর হাঁড়ি নামিয়ে ঝুপ করে দিবাকরের পায়ে একটা প্রণাম ঠুকেই দরজা খুলে ঝাঁ করে বের হয়ে গেল নিমেষে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে

দরজা বন্ধ করে দিবাকরও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এরপর পরদিন সকালে উঠে আবিষ্কার করলেন টেবিলের উপর মিষ্টির খালি হাঁড়ির তলায় ভাঁজ করা একটা তেলচিটে দশ টাকার নোট তবে আসল ব্যাপারটা জানতে পেলেন আরও দিন কয়েক পরে থিসিস শেষ করে তখন ফিরে এসেছেন কলকাতায় বন্ধু রাজীবের ফোন এল একদিন প্রায় মিরাকেল ব্যাপার ঘটে গেছে কালীগঞ্জে একদল মানুষ হঠাৎ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে শহরের সব পানাপুকুর একে-একে সাফ করে ফেলেছে ব্যাপার দেখে চক্ষুলজ্জার খাতিরে নড়েচড়ে বসেছে মিউনিসিপ্যালিটিও নোংরা নর্দমা, ডোবা, পানাপুকুর সব এখন ঝকঝকে মশার উৎপাতও উধাও কালীগঞ্জ আর সেই কালীগঞ্জ নেই পালটে গেছে একদম

ছবি: আনন্দমেলা পত্রিকার সৌজন্যে

প্রথম প্রকাশ: আনন্দমেলা: ২০ ডিসেম্বর ২০০৮

আপলোড: ৮/১০/২১