শিয়ালপাড়ায়
ফুটবল ম্যাচ
শিশির
বিশ্বাস
এয়ারপোর্টের
শিয়ালপাড়ায় সেদিন হঠাৎ হুলুস্থুল কাণ্ড। শুরুটা অবশ্য আর পাঁচটা দিনের মতোই ছিল।
দিনভর বিশ্রামের পর বিকেলে মোড়লের ঠেকে আসর বসেছে। শুধু খোশআড্ডা নয়। নানা শলাপরামর্শও হয়।
হাজার হোক‚ বর্তমান শিয়ালপাড়া তো আর এঁদো গ্রামে
নয়। খোদ এয়ারপোর্টের রানওয়ের ধারে। চারপাশ ঘিরে উঁচু পাঁচিল। সর্বক্ষণ সেপাই–সান্ত্রী‚
হরেক হ্যাপা। প্রতি বিকেলে শলাপরামর্শর জন্য খানিক
সময় দিতেই হয়।
এয়ারপোর্ট
ঘিরে উঁচু পাঁচিল অবশ্য নামেই। নানা স্থানে বড়সড় ফোকর। অন্ধকার ঘন হলেই সেই ফোকর
দিয়ে সুট সুট করে সবাই বের হয়ে পড়ে। চারদিকে হরেক পাড়া‚ বস্তি
আর বাজার। খাওয়ার অভাব নেই। আগে পাড়ার কুকুরগুলো ঝামেলা করত। তা এয়ারপোর্টের শিয়ালপাড়া
বলে কথা! একদিন দল বেঁধে এমন কড়কানি দিয়েছিল‚ কুকুরের
দল আর কাছে ঘেঁসে না। দেখলেই উলটো দিকে দৌড়। অগত্যা
রাতভর মহানন্দে পাড়ায় পাড়ায় টহল। কপাল ভাল
থাকলে কারও এক–আধটা হাঁস–মুরগিও জুটে যায়। স্পেশাল ভোজ সেদিন।
ফিরে এসে জনে জনে গল্প শোনায়। গত কালও দু’জনের
স্পেশাল ভোজ হয়েছে।
আসরে
তখনও সবাই এসে পৌঁছোয়নি। স্পেশাল ভোজের গল্পে কয়েকজন কচিকাঁচার জিবে জল গড়াতে শুরু
করেছে দেখে মোড়ল ভরসা দিয়ে বলল‚ ‘মন
খারাপ করিসনি বাপু। ওই ‘বয়লার’ (ব্রয়লার) মুরগির কী
স্বাদ আছে র্যাঁ? দিন কয়েক সবুর কর। এই শিয়ালপাড়ায় বসেই আসল মাংসর স্বাদ
পাবি। শালিক‚ ফিঙের দল যেভাবে ভিড় বাড়াতে শুরু
করেছে‚ তোদের কপাল ফিরতে দেরি নেই।’
শিয়ালপাড়ার
মোড়ল পুরনো দিনের ঘাগি। তার কথায় কচিকাঁচার দল তো থ। ‘কী যে বলো
মোড়লদাদু‚ ঠিক নেই। গাছে ফিঙে–শালিকের
ভিড় বাড়লে আমাদের ফয়দা কী?’
‘আছে
রে বাপু আছে।’
মোড়ল ঝিলিক দিয়ে চোখ নাচাল‚ ‘সেদিন
দেখলি না‚ একটা পেলেন (প্লেন) নামার সময় কেমন
টালমাটাল হয়ে গোঁত্তা খেতে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস সামলে নিতে পেরেছিল! নইলে আর দেখতে হত
না!’
‘সে
তো এক বুদ্ধু শালিক ফুড়ুৎ করে সামনে এসে পড়েছিল। তারপর কোথায় যে ভ্যানিস হয়ে গেল
টের পেলুম না।’
এক সেয়ানা কচি বলতে বলতে জিবের জল টানল।
‘কী
করে আর টের পাবি বাছা! সে ততক্ষণে পেলেনের ইনজিরির (ইঞ্জিন) ভিতর তালগোল পাকিয়ে
উপে গেছে! তবে তোদের কপাল ওই শালিক বেচারাই খুলে দিয়ে গেছে রে। সগ্গে গিয়ে সুখে
থাকিস বাপু।’
কচিদের
মাথায় তখনও ঢোকেনি ব্যাপারটা। দেখে মোড়লই তারপর খোলসা করে দিয়েছে‚
কোম্পানির বাবুরা কী এরপর হাত তুলে বসে থাকবে? দিন কয়েকের
মধ্যেই ঠিকেদারের লোক এয়ারগান হাতে এসে পড়ল বলে। প্রতি বছর দেখছি তো‚ কী
টিপ রে বাবা হাতে! রানওয়ের পাশে ঘাস আর নলখাগড়ার ডগায় পাখি বসলেই বন্দুক তুলে
ফটাস। ব্যস‚ ল্যাজ উলটে নিমেষে অক্কা। ছুটে গিয়ে
তুলে আনলেই হল। কত মাংস খাবি তখন।
ফটকা
মোড়লের এক ন্যাওটা সাগরেদ। পাশে বসে শুনছিল। সুড়ুত করে জিবের জল টেনে বলল‚
‘আর বলো না ওস্তাদ। শুধু শালিক–ফিঙে কেন? কাগের কথাও
বলো। আহা কী আস্বাদ! আবার পেটটাও বেশ ভরতি হয়ে যায়!’
‘সে
তো ঠিক বাপু।’
খরখরে গলা মোড়লের‚ ‘কিন্তু যে
খপর (খবর) আনতে পাঠিয়েছিলাম‚ তার
কী হল রে?’
‘সে ভেব
না ওস্তাদ। শিয়ালপাড়ার সেরা তিন টিকটিকি (গুপ্তচর) পাঠানো হয়েছে। খপর
নিয়ে এখনই এসে পড়বে।’
এয়ারপোর্টের
শিয়ালপাড়ায় মোড়লের শাসন বেজায় কড়া। পান থেকে চুন খসার জো নেই। একটু বাদেই তিন
টিকটিকি এসে হাজির। বেজায় থমথমে মুখ। কোনও মতে সামান্য দম নিয়ে বলল‚
‘ওস্তাদ‚ খপর বেজায় খারাপ। কাগজের প্রথম পাতায়
হেড লাইন‚ শুধু কাক–চিল নয়‚ এয়ারপোটের
শিয়ালদেরও এবার ছাড়া হবেনে। গুনে গুনে
অ্যারেস্ট করে বিদেয় করা হবে।’
এই
পর্যন্ত শুনেই নড়ে উঠল মোড়ল। ‘তা আসল খপরটা এনেছিস?’
‘এনেছি
ওস্তাদ।’
তিন টিকটিকির মুখগুলো হঠাৎ যেন ঝকঝকে হয়ে উঠল। ‘গরমেন্টের
হিসেব তো‚ আর বোলোনি গুরু! এয়ারপোটের শিয়ালপাড়ায়
শিয়াল নাকি মোট দেড়শ। এদিকে আমরা যে তিনশো ছুঁয়ে ফেলেছি‚ সে
খোঁজই রাখে না। খিঁক–খিঁক।’ তিন টিকটিকি একসাথে হেসে উঠল।
কিন্তু
কচিকাঁচাদের মুখ ততক্ষণে শুকিয়ে আমসি হবার জোগাড়। ‘ও মোড়লদাদু‚
তাহলে মোদের কী হবে?’
‘হবে
ঘোড়ার ডিম।’
ভরসা দিয়ে মোড়ল বলল‚ ‘শুনলি
তো‚ ওদের হিসেবে শিয়াল-পাড়ার জনসংখ্যা
দেড়শ। মানে গোড়াতেই বাকি দেড়শর ছাড় হয়ে যাচ্ছে। ঠিকেদারবাবু ওই দেড়শ শিয়াল ধরার
অর্ডার নিয়ে কাজে লাগবেন। তারপর বড়োজোর শখানেক ধরে বাবুদের সঙ্গে টেবিলের তলায়
ব্যবস্থা করে ফেলবেন। ব্যস‚ হয়ে
গেল। শিয়ালপাড়া যেমন আছে তেমই থাকবে। একদম
ভাবিসনি।’
কিন্তু
কচিকাঁচাদের ভয় তবু যায় না। কাছে ঘেঁসে এসে বলে‚ ‘ও
মোড়লদাদু‚ তুমি তো বলেই খালাস। যদি ওই একশোর
মধ্যে পড়ে যাই?
কী হবে তখন?’
‘সে
তো সেবার আমাকেও ধরেছিল রে। তা পারল কিছু করতে?’ ফোঃ করে
উড়িয়ে দিল মোড়ল।
‘অ্যাঁ‚
তুমিও ধরা পড়েছিলে!’ কচিকাঁচার দল একসাথে হইহই করে উঠল।
‘তবে
আর বলছি কী রে!’
গোঁফ চুমরে মোড়ল ব্যক্ত করল‚ ‘তখন
তোদের মতোই বয়স। হাঁদারাম। খাঁচায় কচি মুরগির টোপ দেখে মাতা কী আর ঠিক ছিল রে!
গেলুম ধরা পড়ে। তারপর চালান করে দিল নতুন টাউনের ওদিকে জঙ্গল দপ্তরের খাঁচায়।
‘তারপর
দিন কয়েকের মধ্যে প্রাণপাখি প্রায় খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। দিন গেলে খাবলা কয়েক পচা
পান্তায় অতগুলো শেয়ালের কিছু হয়? রাত নামলেই কান্নাকাটি। দুদিন পরেই
দেখি ডেকচি ভরতি ভাত আর শুঁটকিমাছের রসা আসতে শুরু করেছে। প্রায় জামাই আদর।
‘রহস্য
ফাঁস হতে সময় লাগেনি এরপর। প্রতি রাতে
একপাল শেয়ালের কান্নাকাটির আওয়াজে সল্ট লেকের বাবু–বিবিদের
ঘুমের দফা রফা। তাদের একজন আবার ডাকসাইটে মন্ত্রী। অগত্যা জঙ্গল দপ্তরে কড়া
কমপেলেন (কমপ্লেন)। নড়ে বসতেই হয়েছে।
‘কিন্তু
হুঁ–হুঁ
বাবা‚ আমরাও হলুম শেয়ালের পো। পেটে খাবার
পড়তে তখন গতরেও তাকত। এরপর প্রতিদিন রাত নামতেই বসিয়ে দিলাম সঙ্গীতের আসর।
তারস্বরে চেল্লানি:
হুক্কা
হুয়া‚ ক্যায়সা হুয়া?
আচ্ছা
হুয়া‚ আচ্ছা হুয়া।
‘ব্যাপার
দেখে বন দপ্তরের তো মাতায় হাত। শেষে এক রাতে মন্ত্রীর ধমকানি খেয়ে জনা কয়েক পুলিশ
লাঠি বন্দুক হাতে দরজা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল খাঁচার ভিতর। আমরাও
তো তাই চাইছিলুম। দরজা খোলা পেয়ে অন্ধকারে কে
কোনদিকে ছিটকে পড়ল পুলিশের দল ঠাওর করতেই পারেনি। তারপর এক ছুটে ফের এই শিয়ালপাড়ায়।’
‘তোমার
মনে নেই মোড়ল। পুলিশের লাঠির ঘায়ে মারাও পড়েছিল কয়েকজন। আমার বউটাও ছিল তার মধ্যে।’ থাবার
চেটোয় চোখ মুছল একজন।
‘মনে
আছে রে বাপু‚ মনে আছে।’ মোড়ল
সান্ত্বনা দিল তাকে। ‘তারপর সেই শিয়াল হত্যা নিয়ে কাগজে কী হইচইটা হয়েছেল বল
দিনি! বিধান সভা তোলপাড়। পুলিশ পালাবার পথ পায়নে। ওদিকে মন্ত্রী মশায় তো বেগতিক
দেখে হাত ধুয়ে ফেলেছেন। সাফ বলে দিলেন‚ শেয়ালের
চেল্লানি সামলাতে বলেছিলুম ঠিকই। খুনোখুনি কত্তে বলিনি! ওসব বেয়াদপ পুলিশের
বাড়াবাড়ি।
‘ব্যস‚
যত দোষ নন্দ ঘোষ। সব কয়টা পুলিশ সাসপেন (সাসপেন্ড)। হুঁ–হুঁ
বাবা শেয়ালের গায়ে হাত। সহজ কতা নাকি!’
‘শুধু
সেবার? আমাদের
নুলোর কথা মনে নেই?’ পাশ থেকে একজন বলল।
‘তাই
তো রে! হতভাগা নুলোটাকে তো দেখছি না!’ এতক্ষণে খেয়াল হল মোড়লের। ‘হতচ্ছাড়াটা
গেল কোথায়?’
‘ও
নিয়ে ভেবো না ওস্তাদ। নুলো জরুরী এক কাজে বাজারের দিকে গেছে। চলে আসবে।’
‘কী
কাজ রে?’
সন্দেহে দুলে উঠল মোড়লের চোখ। কিন্তু ভাবনাটা মাথায় বেশিক্ষণ ঠাঁই পেল না।
কচিকাঁচার দল ততক্ষণে নড়ে উঠেছে। নুলোদা শিয়ালপাড়ার চাঁই। অথচ সামনের এক পায়ে
থাবার অর্ধেক নেই। উড়ে গেছে। সামান্য খুঁড়িয়ে চলে। নুলো নাম সেই কারণে।
কচিকাঁচাদের কৌতূহল তো ছিলই। আজ সুযোগ হতে হামলে পড়ল। ‘নুলো‚
নুলোদার কী হয়েছিল মোড়লদাদু।’
‘সে
এক কাণ্ড রে।’
মোড়ল আড় চোখে চারপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে ফের মুখ খুলল‚
‘হতচ্ছাড়াটা বরাবরই বেশি চালাক তো। ফাঁকায় ধেড়ে এক তিতির দেখে আমার মতোই মাতা
ঠিক রাখতে পারেনি। যেই লাফিয়ে পড়েছে‚ একদম
ঘ্যাঁচ। জাঁতিকলের দাঁড়া চেপে বসল পায়ের উপর। হতভাগা পালাবার পথ পায়নে। কাঁউমাউ
চেল্লানি। ভাগ্যিস‚ জাঁতিকলের
দাঁড়া পড়েছিল থাবার ডগায়। লাফালাফিতে থাবার ডগা ছিঁড়ে যেতে পালিয়ে বাঁচে। হতভাগা
সেই থেকে নুলো। আরে বাপু‚ পেটে এত বুদ্ধি তোর‚ আর
তলিয়ে দেখবিনি! খাঁচা নেই তো কী? আসলে যে জাঁতি…।’
‘আমার
‘অ্যাবসেনে’ (অ্যাবসেন্ট)
কী বদনাম হচ্ছিল ওস্তাদ।’ মোড়লের কথা শেষ হতে পেল না। পাশ থেকে
খোদ নুলো গরগর করে উঠল। কখন যে হাজির হয়েছে‚ খেয়াল
করেনি কেউ।
‘ও
তুই এসে পড়েছিস!’ থতমত খেয়ে ঢোঁক গিলল মোড়ল। শিয়ালপাড়ায়
নুলোকে তেমন ঘাঁটায় না কেউ। সামান্য মাথা চুলকে বলল‚ ‘ওই
কচিকাঁচারা শুনতে চাইল।’
‘তাই
শুধু বদনামটাই করে যাচ্ছ!’ নুলো গরগর করে উঠল। রাগ এক রত্তি
কমেনি তার।
‘আরে
সে তো বলতামই রে।’ মোড়ল একগাল হাসল এবার। ‘তার আগেই তো
তুই বাগড়া দিয়ে বসলি। হ্যাঁ‚ তারপর
সে এক কাণ্ড হয়েছিল বটে। নুলোর বুদ্ধি তো জানিস।
সেই থেকে এয়ারপোর্টে ক্যামেরা হাতে রিপোর্টার দেখলেই কাছ দিয়ে ন্যাংচাতে
ন্যাংচাতে দৌড়। দিন কয়েক পরেই কাগজে সেই ছবি। সঙ্গে
রিপোর্ট‚ জাঁতিকলে এয়ারপোর্টে বিস্তর শেয়ালের
থাবা নাকি কাটা পড়েছে। ব্যস‚ আর
যায় কোথা! হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেল। মনের মতো কাজ পেয়ে ‘পশু ক্লেশ
নিবারণ সমিতি’
প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল। এভাবে শিয়ালদের উপর অত্যচার করা যায় না। অন্যায়‚অন্যায়!
‘এয়ারপোটের
বাবুরা শেষে নাকে খত দিয়ে বাঁচে। সেই থেকে শিয়াল ধরার জন্য জাঁতিকল বন্ধ।’ কথা
শেষ করে মোড়ল থামল অল্প। তারপর তোয়াজ করে বলল‚ ‘তা
হ্যাঁরে নুলো। আসতে এত দেরি করলি যে! গেছিলি কোতা?’
‘গেচিলাম
মাতায়। আজ রাতে শিয়ালপাড়ায় যে ফুটবল ম্যাচ‚ সে
খপর রাখো?
নাকি নামেই মোড়ল?’
শুনে
মোড়ল প্রায় আকাশ থেকে পড়ল। পাঁচিলের ওধারে পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল ম্যাচ হয়। দূর থেকে
তাই দেখে শিয়ালপাড়ার অনেকেরই শখ হয়েছে তারাও একদিন ফুটবলের আসর বসাবে। পাড়ায় যেসব
মাঠে খেলা হয়‚ এই বর্ষায় সেসব প্রায় নরক হয়ে থাকে।
অথচ ওদের শিয়ালপাড়ার পাশে অত বড় ঝকঝকে রানওয়ে। দিব্যি ফুটবলের আসর বসানো যায়।
প্রথম দিন ওদের সেই বায়না শুনে মোড়লের তো প্রায় খাবি খাওয়ার জোগাড়। যেখানে একটা
শালিক ঢোকার হুকুম নেই‚ সেখানে
ফুটবল ম্যাচ! কিন্তু কে শোনে সে কথা। সবার এক গোঁ। শেষে উপায় নেই দেখে বলেছিল‚
সখ তো হয়েছে। তা খেলবি যে‚ ফুটবল
কোথায়? আছে
তোদের?
বলা
বাহুল্য‚ ওই এক অস্ত্রেই সেদিন কাত করে
দিয়েছিল সবাইকে। সত্যিই তো। খেলার আসল জিনিস ফুটবলটাই যে নেই। ব্যাপারটা তাই
ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। হাঁফ ছেড়েছিল মোড়লও। হঠাৎ ওই কথায় খানিক গুম হয়ে থেকে বলল‚
‘কিন্তু খেলবি যে ফুটবলের ব্যবস্থা করেছিস?’
‘সেই
ব্যবস্থা করতেই তো আজ বাজারের ফলপট্টির দিকে গিয়েছিলুম।’ বুক চিতিয়ে
নুলো ব্যক্ত করল।
‘ফলপট্টি?’ শুনে
মোড়ল তো প্রায় থ হবার জোগাড়। ‘ওখানে ফুটবল কোথায়?’
‘যেমন
বুদ্ধি তোমার ওস্তাদ।’ নুলো নাক উঁচিয়ে হাসল। ‘ভোলা দাসের
ফলের দোকানে দুপুরে লরি ভরতি মাল এসেছে। ইয়া সাইজের বাতাপি লেবু। সন্ধেয় দোকান
খোলার আগেই ঝুড়ি ফাঁসিয়ে নিয়ে এসেছি। পুরো এক ডজন ঢাউস বাতাপি। ওই
বাতাপি লেবু দিয়েই আজ শিয়ালপাড়ায় ফুটবল ম্যাচ হবে।’
‘অ্যাঁ‚
বাতাপি লেবু দিয়ে ফুটবল ম্যাচ!’ মোড়ল শেষ চেষ্টা করল। ‘ও
তো দু’মিনিটেই
টেঁসে যাবে রে। শেষে খেলা ফেলে বাতাপির ভাগ নিয়ে লড়াই শুরু করে দিবি। ছ্যাঁ–ছ্যাঁ।
কী লজ্জার কতা!’
নুলো
যেন তৈরি হয়েই ছিল। ঘাড় ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিল‚ সে
জন্য আগেই নতুন নিয়ম হয়েছে। খেলোয়াড়দের কেউ তেমন করলেই লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের
বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আর একটা বাতাপি লেবু ফাটলে তৎক্ষণাৎ অন্য একটা নামিয়ে
দেওয়া হবে মাঠে। পুরো বারোটা বাতাপি কী আর অমনি আনা হয়েছে। এক ঘণ্টা দিব্যি চলে
যাবে।
মোড়ল
এরপরেও চেষ্টায় খামতি রাখেনি। কিন্তু নুলো আজ আটঘাট বেঁধেই এসেছে। হঠাৎ
বিশ্বকাপের হুজুক তুলে মাত করে ফেলল। আর একদিন
পরেই নাকি রাশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হচ্ছে। সারা পৃথিবীর ফুটবল টিম সেখানে
হাজির হয়ে গেছে। দলে দলে দর্শক আর রিপোর্টারের দল। খবরের কাগজে
শুধু সেই খবর। আজই রাত পৌনে দশটায় এক ঝাঁক দর্শক নিয়ে স্পেশাল প্লেন রওনা হচ্ছে
মস্কোর দিকে। এই সময় শিয়ালপাড়ায় একটা ফুটবল ম্যাচ করতে না পারলে পেসটিজ
(প্রেস্টিজ) থাকে না। তার উপর আজ দারুণ একটা সুযোগও রয়েছে। রাত পৌনে দশটার মস্কো
প্লেনের পর পরের প্লেন সেই দশটা বাহান্নয়। অর্থাৎ মাঝে অনেকটা সময় ফাঁকা। এই সময়ে
রানওয়ের খানিকটা দিব্যি খেলার মাঠ বানিয়ে ফেলা যায়।
অগত্যা
মোড়লের কোনও আপত্তিই আর ধোপে টেকেনি। তারপর নুলো যখন প্রস্তাব দিল‚ ম্যাচে
রেফারির দায়িত্ব থাকবে মোড়লের হাতেই। সময়ে খেলা শেষ না হলে বাঁশি বাজিয়ে থামিয়ে
দিতে পারবে। অগত্যা অনুমতি না দিয়ে মোড়লের আর পথ ছিল না। ঢোঁক গিলে বলল‚
‘তা ফুটবল যে খেলবি‚ দল
ঠিক করেছিস?’
‘বিলকুল।’ নুলো
তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিল। ‘একটা দল আমার নুলো একাদশ। অন্যটা আগে
মোড়ল একাদশ ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু তুমি যখন রেফারি‚ তখন
অন্য কারও নামে হোক।’
‘না–না‚
অন্য দল ওই আমার নামেই হবে।’ মুহূর্তে মোড়ল জানিয়ে দিল। ‘শিয়াল-পাড়ার
মোড়ল একাদশ বনাম নুলো একাদশ। দেখা যাক‚ কার
তাকত বেশি।’
‘তাহলে
তো রেফারি অন্য কাউকে করতে হয়।’
‘সে
তো অবশ্যই।’
নুলোর কথা শেষ হতেই মোড়লের সাফ জবাব‚ ‘আজকের
খেলায় রেফারি হবে ফটকে।’
ঝানু
মোড়ল এক চালে অনেক দিক সমলে ফেলল। একে তো আজকের খেলায় নুলোর দলকে হারাতে পারলে
হতচ্ছাড়ার বাড়বাড়ন্ত কিছু কমানো যায়। শিয়ালপাড়ায় নুলো যে ইদানীং দল পাকাতে শুরু করেছ‚
মোড়লের জানতে বাকি নেই। হতভাগার ইচ্ছে এবার মোড়লের আসনে বসবে। সুযোগ যখন পাওয়া
গেছে‚ একটা হেস্তনেস্ত আজই সেরে ফেলা যায়।
আর রেফারি ফটকে তো তার ন্যাওটা। পেটে ঘোরপ্যাঁচ নেই। এক চালে অনেক কাজ সেরে ফেলা
যাবে।
অগত্যা
শিয়ালপাড়ার ফুটবল ম্যাচ শুরু হয়ে গেলে যথা সময়। সবাই তৈরি হয়েই ছিল। রাত পৌনে
দশটার স্পেশাল প্লেন ফুটবল–বাবুদের নিয়ে মস্কোর দিকে উড়ে যেতেই সবাই হইহই করে নেমে
পড়ল রানওয়ের উপর। ইতিমধ্যে দল ঠিক হয়ে গেছে। মোড়ল একাদশের খেলোয়াড় মোড়ল আগে বেছে
নিয়েছে। নুলো একটু গাঁইগুঁই করেছিল। কিন্তু মোড়ল ভেটো দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়েছে।
যেহেতু সিনিয়র। তায় শিয়ালপাড়ার মোড়ল। তাই আগে তার টিম। নুলো আর ট্যাঁ–ফো
করতে পারেনি। হতচ্ছাড়া নুলোটাকে হারতেই হবে আজ।
নিজের দলের সবাইকে কড়ার করে নিয়েছে। কথাও দিয়েছে সবাই। নুলোর দলকে আজ হারিয়ে মাঠ
ছাড়বে।
বলা
বাহুল্য মোড়লের প্যাঁচে পড়ে নুলোর টিম তৈরি হয়েছে বাকি ঝড়তিপড়তিদের নিয়ে। মোড়লের
তাই খুব আশা ছিল। কিন্তু খেলা শুরু হতেই মাথায় হাত পড়ার জোগা! খোঁড়া পায়ে নুলো
একাই যে একশো হয়ে উঠবে‚ ভাবতেই
পারেনি কেউ। শুরুর মিনিট দেড়েক পরে প্রথম বল অর্থাৎ বাতাপি লেবু পায়ে পেয়েই নুলো
সাইড লাইন ধরে কোমর নাচিয়ে লাফাতে লাফাতে ছুটেছে। আটকাতে ছুটে গিয়েছিল জাঁদরেল
চেহারার একজন। নুলোর কোমরের গুঁতোয় মুহূর্তে ছিটকে পপাত ধরণীতল। যাচ্ছেতাই অবস্থা। উঠে দাঁড়াবার
অবস্থা নেই।
ফাউল
ফাউল বলে মোড়লের দল চেঁচিয়ে উঠেছিল। কিন্তু হতভাগা ফটকে হাত নেড়ে জানিয়ে দিল ফাউল
নয়‚ ফেয়ার প্লে। তিন পায়ে লাফিয়ে চলতে
খোঁড়া নুলো ওইভাবেই ঢিকলি দিয়ে কোমার দোলায়। পা সামান্য বাঁকা হবার কারণে
ব্রাজিলের ডাকসাইটে খেলোয়াড় গ্যারিঞ্চাও নাকি ওইভাবে বল নিয়ে ছুটত। অগত্যা ফাউল
হতেই পারে না। আহত শিয়াল তখন রানওয়েতে পড়ে কাতরাচ্ছে। ফটকে নিজেই তার ঠ্যাং
ধরে টেনে সরিয়ে দিয়ে ফের খেলা শুরু হবার বাঁশি বাজিয়ে দিল।
ফটকে
এমন বেইমানি করবে‚ মোড়ল ভাবতেই
পারেনি। অগত্যা হয়ে গেল। একা নুলোকে সামলাতেই তার টিমের হিমসিম অবস্থা। ভাগ্যিস
বেছে বেছে ষণ্ডা চেহারার শিয়ালদের নিজের টিমে নিয়েছিল। তাই এগারোজন মিলে শেষ রক্ষা
করে যেতে পারল‚ মানে গোল বাঁচানো গেল‚ এই
যা।
মারকাটারি
সেই খেলায় এরপর আর হুঁশ ছিল না কারও। নুলোর টিমকে হারাবার জন্য খোদ মোড়লের নিজেরও
তখন মাথার ঠিক নেই। খেলা এরপর সারা রাতই চলত হয়তো। কিন্তু বারোটা বাতাপি লেবুর
শেষেরটা ফেঁসে যেতে থামাতেই হল খেলা। টাওয়ারের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মোড়লের তো মাথায়
হাত। কী কাণ্ড! ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘর পার হয়ে আরও দশ মিনিট। ভাগ্যিস শেষ
বাতাপিটা তবু ফেঁসে গিয়েছিল! দশটা পঞ্চান্নর বোয়িং নির্ঘাত রানওয়ে ক্লিয়ার না পেয়ে
পাক খাচ্ছে আকাশে। পালা‚ পালা।
মুহূর্তে
রানওয়ে সাফ করে যে যার গর্তের দিকে দৌড়।
মোড়লের
হিসেব অবশ্য মেলেনি। দশটা পঞ্চান্নর বোয়িং সেদিন আর এয়ারপোর্টে নামেনি। খবরটা
পাওয়া গেল পরের দিন সকালে। ভোরেই জনা কয়েক টিকটিকি পাঠানো হয়েছিল। খানিক বাদে তারা
যে খবর নিয়ে এলো‚ তাতে মোড়ল
তো বটেই‚ সারা শিয়ালপাড়ার মাথায় হাত। সর্বনাশের কিছু বাকি নেই!
বোয়িং গত রাতে যথা সময়ে চলে এসেছিল। রানওয়ের জুড়ে শেয়ালের মচ্ছব দেখে পাইলট আর
ঝুঁকি নেয়নি। চলে গেছে ভুবনেশ্বরের দিকে।
আরও
ভয়ানক কথা‚ প্লেনে এক ডাকসাইটে মন্ত্রী আসছিলেন।
তিনি নাকি ব্যাপারটায় চক্রান্তের গন্ধ পেয়েছেন। এয়ারপোর্ট বাবুদের কয়েকজনের চাকরি
যাচ্ছেই। শিয়ালপাড়ার সাড়েসর্বনাশ হতেও বাকি নেই। রানওয়ের জঙ্গল সাফ করে শুধু শিয়াল
ধরা নয়‚ পাঁচিলে ফোকর যা আছে‚
এক এক করে সব বন্ধ করা হবে এবার।
খবরে
যে কিছুমাত্র ভুল নেই‚ বোঝা গেল
দুপুরের আগেই। গণ্ডা কয়েক ঘাস কাটার গাড়ির সঙ্গে শখানেক মিস্ত্রি–মজুর
ইট–বালি
আর সিমেন্টের বস্তা নিয়ে হাজির। হইহই করে শুরু হয়ে গেল কাজ। সন্ধের মধ্যে অর্ধেক
জঙ্গল সাফ। বন্ধ অর্ধেকের বেশি ফোকর।
রাতে
অন্ধকার নামতে সবাই যখন বিদেয় নিয়েছে‚ গর্ত
থেকে একে একে বেরিয়ে এলো শিয়ালপাড়ার সবাই। চারপাশে তাকিয়ে সবার তো মাথায় হাত। মুখ
শুকিয়ে আমসি। কয়েকজন হামলে পড়ল মোড়লের উপর। ‘হাজার হোক শিয়ালপাড়ার
মোড়ল তুমি। আগে থাকতে সাবধান করতে পারলে না? কী সর্বনাশ
হয়ে গেল বল দেখি। কিছু একটা বিহিত করো এবার।’
উত্তরে
মোড়লের মুখে কথা নেই। নাটের গুরু শয়তান নুলোটা। কিন্তু সেকথা বলার মুখ নেই। ফুটবলে
মজে গিয়ে গতরাতে মাথাটাই কাল খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নইলে এমন হয়! কে জানে সব নুলোর
চক্রান্ত কিনা! গদি দখলের মতলব। খানিক থম হয়ে থেকে বলল‚ ‘বাপুরে‚
আমার মাতায় কিছুই আর ঢুকতেচে না। যা দেকতেছি‚ ‘এমারজেসি’ (এমার্জেনসি)
লাগু হয়ে গেছে। নইলে এক দিনে জঙ্গলের অর্ধেক সাফ! বাপের জন্মে দেখিনি।’ বলতে
বলতে মোড়ল ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। তারপর চোখ মুছে বলল‚ ‘শিয়ালপাড়ার
মোড়লগিরির ইচ্ছে আর নেই। ওই দায়িত্ব নুলোকে দিয়ে আজই বউ–ছেলেপুলে
নিয়ে সুন্দরবনের দিকে রওনা হচ্ছি আমি।’
শুনে
সবাই তো একসাথে হাউমাউ করে উঠল‚ ‘বলো
কী ওস্তাদ! তাহলে আমরাও কী সুন্দরবনের দিকেই যাব?’
‘সে
কী করবি নুলোকে জিজ্ঞাসা করে দ্যাখ। তোদের নতুন মোড়ল। আমি চললুম। আর একটা দিনও
এখানে থাকার ইচ্ছে নেই। বললুম না‚ ‘এমারজেসি’ নেগেচে।
কালকের মধ্যেই পাঁচিলের ফোকর বিলকুল বন্ধ হয়ে যাবে। আটকে পড়ে মরবি তখন।’
সত্যি
সত্যিই মোড়ল এরপর আর দেরি করেনি। বউ–ছেলেপুলে নিয়ে পিটটান।
অন্য
কয়েকজন তার সঙ্গী হবে কিনা ভাবছিল। নুলো তাদের ধমক দিয়ে থামাল। ‘হতভাগা‚
বুড়োর ভীমরতি ধরেছে বলে তোরাও গিয়ে সেই বাঘের মুখে পড়তে চাস!’
‘বাঘ!
বাঘ কোথায় ওস্তাদ?’ বেজায় ঘাবড়ে কয়েকজন ব্যক্ত করল।
‘সোঁদরবনে
বাঘের ঠেক‚ তাও জানিস না হাঁদার দল! তাও হেঁজিপেজি
নয়‚ একেবারে কেঁদো বাঘ! সরকার তাদের ভোজের জন্য সেখানে এখন
শুয়োর আর হরিণ পাঠাতে লেগেছে। আর শিয়াল হয়ে তোরাও কিনা সেই দলে নাম লেখাতে যাবি!’
‘তাহলে? তাহলে
উপায় কী ওস্তাদ।’ প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল সবাই।
‘উপায়
আছে।’ নুলো
ঠ্যাং তুলে নাচাতে নাচাতে ব্যক্ত করল শিয়ালপাড়ার নতুন মোড়ল। ‘যা
দেখছি‚ আগামী কালের মধ্যে শুধু জঙ্গল সাফ নয়‚
পাঁচিলের বেবাক ফোকরও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অগত্যা দিন কয়েক অনশন ছাড়া গতি নেই।
তারপর।
‘তারপর
কী?’ প্রায়
হাহাকার করে উঠল শিয়ালপাড়ার সবাই।
‘তারপর
আবার কী?’ প্রায় দাবড়ে উঠল নুলো। ‘শিয়াল হয়েছিস‚ এরমধ্যে পাঁচিলের
তলা দিয়ে গোটা কয়েক গর্ত খুঁড়ে ফেলতে পারবি না!’
‘পারব‚
পারব গুরু।’ উৎসাহে হইহই করে উঠল সবাই।
‘তবে
আর কী।’ নুলো ঠ্যাং নাচিয়ে ব্যক্ত করল। ‘তাহলে আজ থেকেই কাজে লেগে পড়। তা ছাড়া ওধারের পাড়ার মানুষ তো আছেই। নিজেদের
দরকারে দিন কয়েকের মধ্যে ফের পাঁচিল ভেঙে ফোকর বের করে ফেলবে। আর ‘এমারজেসি’ উঠে
গেলে জঙ্গলও গজিয়ে উঠবে ফের। ‘এয়ারপোটের’ শিয়ালপাড়া
যেমন আছে‚ তেমনই থাকবে। শুধু দিন কয়েক তিতির–মুরগি
এসব দেখলে বোকার মতো নোলা বাড়াসনি আবার।’
শিয়ালপাড়ার
খবর আপাতত এই পর্যন্তই। পরের খবর এখনও পাইনি কিছু।
আপলোড: ১২/৮/২০২১
No comments:
Post a Comment