Tuesday 5 January 2021

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোঃভাঃ): চেতলার কাছে (লীলা মজুমদার)

 


চেতলার কাছে

লীলা মজুমদার

চেতলা, কালীঘাট, আদিগঙ্গা ইত্যাদি যতই পবিত্র স্থান হোক না কেন, ও সব জায়গা মোটে ভাল না। আর লোকের মুখে মুখে কী সব অদ্ভুত গল্পই যে শোনা যায়, তার লেখা-জোখা নেই। তাছাড়া মশা-মাছি তো আছেই। চিলতে চিলতে সব গলি, তাতে মান্ধাতার আমলে তৈরি ঝুরঝুরে সব বাড়ি। তায় আবার সব বাড়ি থেকে সব বাড়ির উঠোন দেখা যায়। এক ফালি উঠোনের মধ্যে এই বড় বড় সব গাছ। তালগাছ, আমগাছ, বটগাছ, তাদের ডালপালা বেয়ে, ঝুরি ধরে ঝুলে যে কোন বাড়ি থেকে যে কোন বাড়িতে চলে যাওয়া যায়। বিপদ বুঝলে একটা হাঁক দিলেই হল। সবাই সাত পুরুষ ধরে সবার চেনা। পুরনো সব ঝগড়াও আছে, তার কারণ নিজেরাই ভুলে গেছে, তবু এখনো কথাবার্তা বন্ধ। মুখ দেখা আর কী করে বন্ধ করে, নড়বড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই, সব বাড়ি থেকে সব বাড়ির রান্নাঘরের ভিতর পর্যন্ত দেখা যায়। কার বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সবাই চোর ছ্যাঁচোর খুনে পর্যন্ত জানতে পারবে। একটা টিকটিকি লুকোবার কোথাও জায়গা নেই, দুষ্কৃতকারীদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। কার ঘরে চুরি করার মতো কী আছে এবং কোথায় আছে তাও সবাই জানে। নেইও অবিশ্যি কারো কিছু। সেদিক দিয়ে জায়গাটাকে চোরেদের গোবি মরুভূমিও বলা যায়।

আমার বন্ধু বটুর বড়কাকা ওখানকার থানার মেজো দারোগা। তাছাড়া ওদের সাত পুরুষের বাড়িও ওখানে। নাকি বাড়ি হবার সময় ক্লাইব জন্মায়নি। বটু জায়গাটার নাম দিয়েছে মিসার হতাশা। শুনে বড়কাকা খুবই মুষড়ে পড়েছেন, দুষ্কৃতকারীরাই যদি একটু সুযোগ না পেল, তাহলে ওর হেড অপিসে উন্নতি হয় কী করে? অবশ্যি ও সব সাধারণ জিনিসের চাইতেও অন্য এক আরও ভয়ের জিনিস আছে, সবাই সন্ধে হতে যার ভয়ে জুজু। অধিকাংশই ওপর হাতে একগোছা শঙ্কট তারিণী মাদুলি বেঁধে নিরাপত্তা রক্ষা করেন। কারণ পুলিসে আর কী-ই বা করতে পারে?

বটুদের উঠোনের আম পাকলে বটু আমাকে তিন দিনের জন্য ধরে নিয়ে গেছিল। ঐ তিনদিনে আমি যতগুলো সত্যিকার ভূতের গল্প শুনলাম, সারা জীবন ধরে অত শুনিনি। সবাই সবার পাশের বাড়ির অশরীরীদের নিয়ে।

কী বড় বড় সবুজ রঙের চিংড়ি মাছ নিয়ে একটা লোক বিক্রি করতে এল। চিল-কোঠায় পুজো করতে বসে তাকে দেখেই বটুর ছোট ঠাকুমা চ্যাঁচাতে লাগলেন, ‘না বাছা, এস্থানে ও মাছ কেউ খাবে না। তুমি অন্য জায়গায় দেখ।’

বটুতো চটে কাঁই, কী ভালো ভালো চিংড়ি মাছ! ছোট ঠাকুমা নেমে এসে বললেন, ‘বাস, মাছ দেখেছিস তো অমনি হয়ে গেল। আরে ওকি সত্যিকার মাছ? অত বড় চিংড়ি কখনো চার টাকায় দেয় কেউ? আবার বলছে পরে দাম নেবে।’

বটু বলল, ‘আহা, বলল যে বিক্রি না হলে পচে যাবে।’

কাষ্ঠ হেসে ছোট ঠাকুমা বললেন, ‘তুইও যেমন। তাছাড়া ওগুলো মাছও নয়। ঐ জেলের পো-ও মানুষ নয়, সব ইয়ে।’এই বলে ছোট ঠাকুমা হাতে শান্তি জল ছেটাতে শুরু করলেন।

বটুও বলল, ‘সত্যিও হতে পারে, মুখটা কেমন মিচকে মতো দেখলি না?’

আমি বললাম, ‘যাঃ। ভূতের হাঁটু উল্টোদিকে থাকে আর ওদের ছায়া পড়ে না।’

ছোট ঠাকুমা শুনতে পেয়ে ডেকে বললেন, ‘ইদিকে এখনো রোদ আসেনি বাবা, ছায়া দেখবে কী করে? সে যাই হোক, আদি গঙ্গার বটগাছের তলায় যেন কখনো যাসনি। জায়গাটা ভালো নয়।’

গিজগিজে সব বাড়ি, বটগাছ তলায় যেতে হলে সার্কাস করতে হয়। অথচ সেখানে নাকি কারা কাপড় কাচে, ঝগড়া করে, মাছ ধরে। তাল মিলিয়ে এই আদি গঙ্গাও এক রহস্য! মাল বোঝাই বড় বড় নৌকো কখনো চিৎপাত হয়ে কাদার উপর পড়ে ঝিমোয়! অথচ মাঝিগুলোর কিছুমাত্র ভাবনা নেই। নৌকোর দিব্যি রান্না–খাওয়ায় ব্যস্ত! তবে খানিক বাদেই জল বাড়তে শুরু করে আবার। ভেসে ওঠে মাল বোঝাই নৌকোগুলো। কী কাণ্ড, ততক্ষণে মাঝিদের রান্না–খাওয়াও সারা। দড়ির গুণ কাঁধে ফেলে দিব্যি পাড় বরাবর টানতে থাকে নৌকো। বাঁকের ওধারে হারিয়েও যায়। 

এদিকে কখন সূর্য ডুবে গেছে, সামনের দোতলায় লটঘটে বারান্দায় দুজনে গল্প করছি। ছপ করে কী একটা পায়ের কাছে পড়ল। আর সে কী সুগন্ধ ভুরভুর করতে লাগল। তুলে দেখি কলাপাতায় মোড়া বড় বড় চিংড়ি মাছ ভাজা। নীচের দিকে চেয়ে দেখি, সেই মিচকে লোকটা মিট মিট করে হাসছে। মোটা মোটা কান, নাকে মস্ত আঁচিল। একতলার বৈঠকখানা থেকে বটুর পিসেমশাই ডেকে বললেন, ‘কে? কে ওখানে ?’

মুহূর্তে কেউ কোথাও নেই! আমরা দুজন অবশ্য খেয়ে ফেললাম সব কটা চিংড়ি মাছ। যদি এগুলো চিংড়ি মাছ নাও হয়, তবু খেতে বেজায় ভালো।

ভিতর দিকের উঠানে আম গাছের গায়ে লাগা বুড়ো তালগাছ। ছোট-ঠাকুমা সাদা রেকাবি করে খোয়া ক্ষীর, চিঁড়ের মোয়া আর বড় বড় মনাক্কা নিয়ে তালগাছের কোটরে রেখে ভক্তি ভরে গলায় কাপড় জড়িয়ে প্রণাম করলেন। ছোট ঠাকুমা চলে যেতেই বটু বলল, ‘ব্ৰহ্মদত্যিকে তোয়াজ করা হচ্ছে। তালগাছে বাস করেন তিনি।’

আরও কী বলতে যাচ্ছিল বটু, ছোট ঠাকুমা পিছন থেকে বললেন, ‘অমন অছেদ্দা করিসনে বাছা। উনি আমার অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহের ছোট ভাই। চটিয়ে দিলে সব্বোনাশ করবেন, খুশি রাখলে আমাদের জন্য না পারেন এমন জিনিস নেই। ঐ বিদ্যে বুদ্ধি নিয়ে বছরে বছরে পাস করে যাচ্ছিস, সেটা কী করে সম্ভব সে কথা কখন ভেবেছিস? হুঃ।’

বলে ছোট-ঠাকুমা গীতা পড়তে ঘরে গেলেন। যাবার সময় আরো বলে গেলেন, ‘তোরা বিশ্বাস না করতে পারিস, কিন্তু রোজ উনি এই জিনিস গ্রহণ করেন, আর তার বদলে একটি পয়সা আশীর্বাদী—’

আর বলা হল না কারণ সেই সময় বড়কাকা বাড়ি এলেন।

বড় কাকা খুব চটে ছিলেন। চা আর চিঁড়ের মোয়া খেতে খেতে বললেন, ‘এখুনি আবার বেরোতে হবে। বাজারের লোকদের নালিশের জ্বালায় আর টেকা যাচ্ছে না। গোলাবাড়িতে রাতে তদন্তে যেতে হবে।’

তাই শুনে বড়কাকী এমনি চমকে গেলেন যে, হাতের দুধের হাতা থেকে অনেকখানি দুধ মাটিতে পড়ে গেল। চোখ গোল গোল করে ফ্যাকাসে মুখে বললেন, ‘কিন্তু, কিন্তু…’

বড়কাকা কাষ্ঠ হাসলেন, ‘কিছু কিন্তু–কিন্তু নয়। এর ওপর আমার প্রমোশন নির্ভর করছে। কোনো ভয় নেই, ছটা ষণ্ডা লোক সঙ্গে থাকবে। হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে।’

বটুর কাছে শুনলাম যে, বাড়িটাতে একশো বছর কেউ থাকে না। বড়ই দুর্নাম। নাকি ওটা চোরাচালানকারীদের গুহ্য আড়ত। মাটির তলায় সুড়ঙ্গ আছে, আদিগঙ্গায় তার মুখ। অনেকে দেখেছে। সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে সোনাদানা বেআইনী জিনিস বস্তা বস্তা পাচার করা খুব শক্ত নয়। বাজারে নাকি ওদের চর ঘুরে বেড়ায়। কখনো জেলে সেজে, কখনো পুরুত ঠাকুর সেজে। এটা ওটা কিনতে চায়, চা খেতে চায়, অচল পুরনো পয়সা দিয়ে দাম দিতে চায়। তা লোকে শুনবে কেন? দিয়েছে নালিশ করে। বড়কাকা বলেছিলেন, ‘লোকটাকে ধরা যায় না। ফুসফাস করে এখান দিয়ে ওখান দিয়ে গলে পালায়। কোনো দোকানদারের সঙ্গে ষড়ও থাকতে পারে। শুনেছি চেহারা দেখেই সন্দেহ হয়, কীরকম মিচকে মতো, মোট মোটা কান, নাকের ডগায় আঁচিল।’

শুনে আঁতকে উঠেছিলাম, বটা কনুইয়ের গুঁতো মেরে থামিয়ে দিয়েছিল। আটটা বাজতেই মহা ঘটা করে আটজন সশস্ত্র লোকজন নিয়ে বড়কাকা তদন্তে চলে গেলেন। ছোট ঠাকুমা তাঁর গলায় হলদে সুতো দিয়ে একটা বেলপাতা ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ব্যস, আর ভয় নেই। সেখানে গিয়ে কেউ কিছু দিলে খাসনে যেন। দুগগা, দুগগা।’

বড়কাকা চলে গেলে বললেন, ‘কামান দেগে হাওয়া ধরা, হুঁ।’

আমরা ছাদে গিয়ে আদিগঙ্গায় জল বাড়তে থাকা দেখতে লাগলাম। বটু বলল, ‘ঐ গোলাবাড়ীটা আমার ঠাকুরদার অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের ছোট ভাই পেয়েছিল। ব্যাটা মহা লক্ষ্মীছাড়া ছিল, লেখাপড়া শেখেনি, কাজকর্ম করত না, খালি মাছ ধরার বাই ছিল আর চীনে ব্যবসাদারদের কাছ থেকে চায়ের নেশা ধরেছিল। দুদিনে বাড়ীর সব ঝাড়বাতি, আসবাব পত্তর, রূপোর বাসন, বেচেবুচে সাফ করে দিল। ওর বুড়ী মা নাকি খুচরা পয়সা–কড়ি এমনি লুকিয়ে রেখে চোখ বুজেছিলেন যে, ব্যাটা সে সব খুঁজেই পায়নি। এখনো নাকি খুঁজে বেড়ায়। তাই ও বাড়িতে কেউ রাত কাটায় না। সেইখানে গেছে বড়কাকা তদন্ত করতে। খুচরো টাকাকড়ির বাক্সটা পেলে মন্দ হয় না। আমরাই তো ওর ওয়ারিশ। সে ব্যাটাতো বিয়েই করেনি। বিশ্রী দেখতে ছিল নাকি। শুঁটকো, কালো বড় বড় কান, চাকর চাকর চেহারা। গেঞ্জি গায়ে ঘাটে বসে অষ্টপ্রহর আদিগঙ্গায় মাছ ধরত। কে! কে ওখানে?’

খচমচ করে তালগাছ থেকে আমগাছ। আমগাছ থেকে নড়বড়ে বারান্দা কাঁপিয়ে মিচকে লোকটা হাসি হাসি মুখ করে উঠে এসে নাকের ফুটো ফুলিয়ে ফোঁস-ফেঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, চা চা গন্ধ পাচ্চি মনে হচ্ছে।’

মিথ্যে নয়। কেতলিতে একটু চা আর একটা মটির ভাঁড় বটু লুকিয়ে এনেছিল সামনের দোকান থেকে। নীচে নামাতেও হয়নি, ওদিকে মিচকে লোকটা ততক্ষণে তেঁতুলগাছে বসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, রোজকার মতো।

চা পেয়ে লোকটা আহ্লাদে আটখানা, মিচকে মুখ যেন সাত ভাজ হয়ে গেল। বললাম, ‘পেঁয়াজি খাবে নাকি?’

জিব কেটে বলল, ‘অ্যাঁ, ছি ছি ও নাম করবেন না। আমার বরাদ্দ রোজগার মতো খেয়েই এসেছি, চিড়ের মোয়া, খোয়া ক্ষীর, মেওয়া—’

বটু আর আমি এ ওর দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না। খাক না বেচারি।

মিচকে লোকটি বলল, ‘বড়কর্তা আমাদের ওখানে এমন হাঁকডাক লাগিয়েছেন যে, টিকতে না পেরে ওনার এখানে গা ঢাকা দিতে এসেছি। দেখ দাদা, তালগাছের মুড়োয় তোমাদের জন্য একটা দ্রব্যি রেখে গেলাম। আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। সেখানে মা অমৃতি বানায়।’

বটু ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কেন চলে যাবে। এখানে বুঝি খেতে পাও না।’

ফিক করে হেসে মিচকে লোকটা বলল, ‘দুবেলা নৈবিদ্যি পাই। কষ্ট কিসের? ঐ এল বলে আমি উঠি।’ বলেই হাওয়া।

নীচে বড়কাকাদের রাগ রাগ গলার হাঁক-ডাক শোনা গেল। নিশ্চয় কিছু দুষ্কৃতকারীটারি ধরতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে আদ্যিকালের তালগাছটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। পোকা ধরা, পুরানো গুঁড়ি ভেঙ্গেচুরে একাকার। তার মধ্যে দেখা গেল বেশ বড় একটা কাঠের হাতবাক্স, পুরানো টাকা কড়িতে তার অর্ধেক ভর্তি। আর চাঁচা–পোঁছা নৈবেদ্যের রেকাবিটা তিন টুকরো হয়ে পড়ে আছে। বড় কাকার রাগ ঠাণ্ডা।

পরদিন বড়কাকা বললেন, ‘আশ্চর্যের বিষয়, সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা খোপে ঐ বাক্স রাখার স্পষ্ট দাগ দেখলাম। সেই বুড়ী ঠাকরুণ তাহলে বাউণ্ডুলে ছেলের হাত থেকে ওটাকে বাঁচাবার জন্য এখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন! এটাও তো তাঁদেরই বাড়ি।’

ছোট ঠাকুমা শূন্যে নমস্কার করে বললেন, ‘কত বাঁচিয়ে ছিলেন সে তো বোঝাই যাচ্ছে! ও বটা, এবার থেকে নিজে পড়িস দাদু, সে তো গেল।’ ফোঁত ফোঁত করে একটু কেঁদেও নিলেন। বড়কাকা তো অবাক!

আপলোড: ৯/১১/২০২১

2 comments:

  1. Vuter golper modhyeo j ekta..ghoroa amej thake..seta ei golpota na porle jantamna.. 😊

    ReplyDelete