মাকড়শা বাড়ি
পিটার ডি নিভারভিল
বাংলা রূপান্তর: শিশির বিশ্বাস
হাইওয়ের পাশে ছোটমতো এক পোস্টের দিকে চোখ পড়তে জনসন গাড়ির ব্রেক কশে ব্যাক গিয়ার
দিয়ে পিছিয়ে নিল খানিক। প্রায়
অস্পষ্ট হয়ে আসা পুরোনো এক সাইনবোর্ড।
এলসওয়ার্থের বিখ্যাত মাকড়শা বাড়ি।
পাশের রাস্তায় মাত্র পাঁচ মাইল।
মাকড়শার ব্যাপারে জনসনের আগ্রহ অনেক দিনের। মনে আছে‚ বয়স তখন মাত্রই আট বছর‚ চিলেকোঠায় বাতিল মালপত্রের ঘরে সোনালি রঙের বড় একটা মাকড়শার জালের খোঁজ পেয়েছিল। রোজ সকালে একটা জারে গোটা কয়েক পিঁপড়ে আর পোকামাকড় যোগাড়
করে হাজির হত সেখানে। একটা
একটা করে সেগুলো মাকড়শার জালের উপর ফেলে দিত। প্রায় বিদ্যুৎ গতিতে মাকড়শাটা তার গোপন আস্তানা থেকে ছুটে
এসে তীক্ষ্ণ দাঁড়া দিয়ে আতঙ্কিত শিকারের দেহে বিষ ফুঁড়ে দিয়ে অপেক্ষা করত। বিষের ক্রিয়ায় শিকারটি স্থির হয়ে যেত এক সময়। মাকড়শাটা এরপর‚ সন্তর্পণে ফিরে আসত শিকারটির কাছে। হরেক কায়দায় জাল দিয়ে মুড়ে ফেলত। পরে আহারের জন্য।
এভাবে চলত জারের শেষ পোকাটি পর্যন্ত। একদিন মায়ের চোখে পড়ে যেতে শুধু বকাঝকা নয়‚ পিঠেও কয়েক ঘা পড়েছিল। তবে পরোয়া করেনি। জালে আটকানো পোকাগুলোর ছটফটানির সেই
ভয়ানক দৃশ্য বহুবার রসিয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প করেছে। মাকড়শার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে আরও।
মাত্র পাঁচ মাইল! জনসন হাতের
ঘড়ির দিকে তাকাল। বিকেল
চারটে। মাকড়শা বাড়ি দেখে
মোটেলে ফিরে স্নান সারতে সমস্যা হবার কথা নয়। মিটিং সেই সন্ধে ছ’টায়। হাতে
যথেষ্টই সময়।
পাশে হাইওয়ে ক্রস করে সরু এক রাস্তা। জনসন দেরি না করে সেই পথে গাড়ি ঘুরিয়ে দিল। ভিতরে তখন এক অন্য রকম উত্তেজনা টের পাচ্ছিল ও। দিনভর বায়ার্সদের সঙ্গে একঘেয়ে মিটিং। কোম্পানির আজেবাজে
জিনিসের গুণগান। এই ব্যাপারে ওর
কেরামতি অবশ্য কম নয়। গত
তিন বছর ধরে কোম্পানির সেরা সেলস অফিসার। মোটা রোজগার। তবু একেবারেই পছন্দ নয়। আজকের মিটিংও ব্যতিক্রম নয়। তার আগে একটু পছন্দের কিছু মন্দ নয়। ভাবতে গিয়ে খুশিতে গাড়ির স্পীড আরও বাড়িয়ে দিল ও। কিন্তু খানিক এগোতেই দমে গেল বেশ। ধুলোয় ভরা সরু রাস্তাটার প্রায় কঙ্কালসার অবস্থা। সাবধানে ড্রাইভ করেও শেষে পথের মাঝে বিশ্রী এক গর্তের
সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেই হল।
জনসন ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে চারটে। গোড়ায় ভেবে রেখেছিল‚ মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবে। প্রায় দ্বিগুণ সময় পার হয়ে গেছে। ফিরে যাবে কিনা ভাবছে‚ হঠাৎ পিছনে ঝোপ–জঙ্গল ভরা ছোট এক টিলার মাথায় পাঁচিল
ঘেরা পুরোনো এক খামার বাড়ি নজরে পড়ল। পাশে আনকোরা নতুন এক সাইনবোর্ড।
এলসওয়ার্থের বিখ্যাত মাকড়শা বাড়ি।
হরেক মাকড়শার রোমহর্ষক কাণ্ড দেখতে আসুন।
ভাগ্যিস পথের উপর গর্তটা ছিল! নইলে নজরেই পড়ত না। ছেড়ে এগিয়ে যেত। তারপর ফেরার পথে নজরে পড়লেও সময় হত না। ফের কবে এদিকে কাজ পড়বে সেই অপেক্ষায় থাকতে হত। আসলে সাইনবোর্ডের ‘রোমহর্ষক কাণ্ড’ শব্দ দুটো তখন প্রায় পেড়ে ফেলেছে ওকে। একেবারে মনের কথা!
গাড়ি নিয়ে জনসন যখন টিলার উপর যথাস্থানে পৌঁছল‚ কিছুটা যেন দমেই গেল। উঁচু
পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। আধভাঙা কার্নিশ‚ প্লাস্টার খসে প্রায় হতশ্রী অবস্থা। আশপাশে জনপ্রাণী নেই। কেমন নিঝুম‚ থমথমে। বাড়িতে
কেউ আছে তো?
সন্দেহটা জনসনের মাথায় সবে পাক খেতে শুরু করেছে‚ কালো স্কার্ট পরা এক বৃদ্ধা পাশের দরজা ফাঁক করে বেরিয়ে এলেন। বয়স সত্তরের কম নয়। আশিও হতে পারে। শীর্ণ লোলচর্ম।
‘কী চাই বাপু?’ খনখনে গলায় বৃদ্ধা বললেন।
বাড়ির অবস্থা দেখে জনসন গাড়ি থেকে বের হয়নি তখনও। ভিতর থেকেই মুখ বাড়িয়ে বলল‚ ‘এটাই কী মাকড়শা বাড়ি?’
‘বোর্ডে তেমনই তো লেখা। নয়
কী?’
বৃদ্ধার বাঁকা উত্তর গায়ে না মেখে জনসন বলল‚ ‘এখন খোলা আছে কি ? দেখা যাবে?’
‘দাঁড়াও তাহলে। জ্যাককে
নিয়ে আসছি। ও আবার কাঠ চ্যালা
করছে।’ কথা শেষ করে বৃদ্ধা পাশে সরু এক অন্ধকার পথে
অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
জনসন দরজা খুলে গাড়ি থেকে বের হল এবার। চারপাশে ফের তাকাল। কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি সমানে তাড়া করেই বেড়াতে লাগল। খামার বাড়ি এমন নিস্তব্ধ হয় নাকি! বাতাসের মৃদু গোঙানি ছাড়া কোনও সাড়াশব্দ
নেই। কেমন নিঝুম। লোক
ঠকানো কারবার নয়তো? জনসনের কপালের
ভাঁজ ক্রমেই বাড়ছিল। ফিরে যাবে কিনা ভাবছে‚ বৃদ্ধাকে ফের
দেখা গেল। পিছনে আরও লোলচর্ম
এক প্রাচীন বৃদ্ধ। পরনে নীল রঙের ঢিলে
ট্রাউজার আর শার্ট। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে
আগন্তুক মানুষটিকে সামান্য জরিপ করে নিলেন তিনি। থুক করে একদলা চিবোনো তামাক ফেলে হাতের পিঠ দিয়ে মুখটা
মুছে নিয়ে চাপা গলায় পাশে বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে বললেন‚ ‘হুঁ‚ গাড়ির শব্দটা তাহলে ভুল শুনিনি দেখছি।’
‘উনি তোমার মাকড়শা দেখতে এসেছেন।’ কথা শেষ করে
বৃদ্ধা এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। ঘুরে ভিতরে চলে গেলেন।
বৃদ্ধও দেরি না করে ফের জনসনের দিকে তাকালেন। ‘আপনি তাহলে
আমার মাকড়শা দেখতে এসেছেন?’
‘একদম।’ জনসন ততক্ষণে মত পালটে ফেলেছে। এসেই যখন পড়েছে‚ দেখেই যাবে। ঘাড়
ঝাঁকিয়ে বলল‚ ‘একদম তাই। কত লাগবে?
জনসনের দিকে বৃদ্ধ নীরবে তাকিয়ে রইল খানিক। মুখমণ্ডলের লালচে বলিরেখায় গোটা কয়েক ভাঁজ পড়ল আরও। তারপর সংক্ষিপ্ত উত্তর‚ ‘পুরো পঞ্চাশ।’
‘পঞ্চাশ ডলার! জনসন ভুরু কোঁচকাল। ‘বড্ড বেশি!’
‘তাহলে যেতে পারেন।’ বৃদ্ধ কাঁধ ঝাঁকালেন। ‘আমারও সময় নেই‚ হাতের কাজ
ফেলে এসেছি।’ থুক করে ফের একদলা চিবোনো তামাক ফেলে হাঁটা
দিলেন তিনি।
জনসন তাড়াতাড়ি বলল‚ ‘ঠিক আছে‚ ঠিক আছে। ওই পঞ্চাশই দেব।’ পকেট থেকে
তাড়াতাড়ি ওয়ালেট বের করল ও।
বৃদ্ধ মুখ ফেরালেন। অল্প
ঠোঁট চেটে জুলজুল করে তাকিয়ে রইলেন জনসনের ভারি ওয়ালেটের দিকে। ব্যাপারটা নজরে পড়তে জনসন তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ওয়ালেট পকেটে
চালান করে দিল। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল দক্ষিণা।
‘থ্যাংকস।’ প্রায় ছোঁ মেরে সেটা হস্তগত করে বৃদ্ধ চোখের
সামনে মেলে খানিক দেখলেন। তারপর
ভাঁজ করে পকেটে ফেলে বললেন‚ ‘আসুন আমার সঙ্গে।’
নোংরা ঘাসে ঢাকা পথ দিয়ে বৃদ্ধ এরপর ওকে খামারের পিছনে এক হলঘরে নিয়ে এলেন। চাপা আলোর আধো অন্ধকারে ঘরের দেয়ালে সামনে কাচ দেওয়া বড়
আকারের সারি সারি কাঠের বাক্স। সব
মিলিয়ে গোটা বারোর মতো। ভিতরে
শুকনো ডালপালা আর পাথরের টুকরো। ওদের
সামনেই এক বাক্সে বড় এক মাকড়শা নিবিষ্ট মনে জাল বুনে চলেছে।
‘এটা এক ধরণের গোল মাকড়শা।’ বৃদ্ধ বললেন।
‘জানি‚ বাগানেই বেশি দেখা যায়।’ বিরক্তি ভরা গলায় জনসন বলল। আসল কথা হল‚ সময় নষ্ট করে মাকড়শার জাল বোনা দেখতে ও আসেনি এখানে।
‘আপনি মাকড়শা চেনেন?’
‘অল্পস্বল্প।’ জনসনের উত্তর‚ ‘সেই ছেলেবেলা থেকে।’
‘তাহলে তো ওদের শিকার ধরা দেখেছেন! কীভাবে শিকার ধরে মেরে
ফেলে‚ জালের ফাঁদে বন্দি করে
আহারের কাজ সারে। দারুণ
জিনিস! তাই না?’
জনসন হঠাৎ যেন একটু অস্বস্তি বোধ করল। লাল হয়ে গেল মুখ। বৃদ্ধ একেবারে ওর মনের কথা ধরে ফেলেছেন! বৃদ্ধ অবশ্য সান্ত্বনা দিয়ে বললেন‚ ‘আরে না না‚ লজ্জা পাবার কিছু নেই। ছোটবেলায় আমি নিজেও তাই ছিলাম। শুধু পিঁপড়ে বা পোকামাকড় কেন? আরও কত কিছু ধরে খাইয়েছি! সব মনেও নেই এখন।’
‘আপনি‚ আপনি বুঝি এটা অনেক দিন
শুরু করেছেন?’ স্রেফ প্রসঙ্গ পালটাতে জনসন বলল।
‘তা বলতে পারেন। অনেকেই ওদের ভয় পায়। আমার কাছে তা নয়। বরং অন্য রকম সম্পর্ক।’
জনসন ইতিমধ্যে অন্য এক বাক্সের দিকে চোখ ফিরিয়েছে। ভিতরে বড় জাতের এক কালো মাকড়শা দুই দাঁড়া দিয়ে সদ্য ধরা
শিকারের রস চুষে খিদে মেটাতে ব্যস্ত। জনসন
নরম গলায় বলল‚ ‘দর্শক তেমন হয় না বোধ
হয়। হাইওয়ে থেকে বড্ডই দূরে।’
‘দরকার নেই।’ বুড়ো প্রায় উড়িয়ে দিল ওর কথা। ‘আসলে এটা আমার একটা নেশা বলতে পারেন। ব্রীডিংও করাই।’
বৃদ্ধের ওই শেষ কথায় জনসন কিছু অবাকই হয়ে গেল। এমন আগে শোনেনি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বললেন‚ ‘ওটা মূলত কয়েকটা কলেজের জন্য। ছেলেদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে লাগে।’
‘তাহলে তো ওখানে থেকে ভালই রোজগার!’
‘তা হয়‚ তবে আমার পছন্দ নয়। ভাবছি বন্ধই করে দেব। নির্মম কাটাছেঁড়া!’
কথা শেষ করে বৃদ্ধ সশব্দে একদলা চিবোনো তামাক মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন‚ ‘তাছাড়া নিজেও কিছু কাজ শুরু করেছি। ব্যাপার কী জানেন‚ সামান্য মাকড়শা হলেও ওরা গরু–ঘোড়া থেকে আলাদা কিছু নয়। ঠিক মতো ব্রীডিং করাতে পারলে…।’
বৃদ্ধ আরও কিছু বলতেন হয়তো। কিন্তু
সময় নষ্ট করে মাকড়শা দেখতে এসে এসব কথা ভাল লাগছিল না জনসনের। কথার মাঝেই বলল‚ ‘স্যার‚ আমার হাতে কিন্তু সময় কম। একটু…।’
‘আরে!’ বৃদ্ধ প্রায় ধড়মড়িয়ে উঠলেন। ‘শুধু বাজে গল্প করে যাচ্ছি। তাহলে চলুন আগে ‘প্রাইজ উইনার’কে দেখিয়ে আনি। আমার সেরা মাকড়শা। মনে হয়‚ যা চাইছেন‚ পেয়ে যাবেন।’
সরু এক অন্ধকার গলি পার হয়ে বৃদ্ধ ফার্মের পিছনে গাছপালার ভিতর দিয়ে একটা ঘরের
কাছে নিয়ে এলো ওকে। সামনে গাছপালা থাকায়
চট করে নজরে পড়ে না। দরজায়
আনকোরা ল্যাচ সহ তালা।
‘বুঝলেন স্যার‚ সেরা পোষ্যদের
জন্য কিছু আলাদা ব্যবস্থা করতে হয়েছে।’
‘সেরা পোষ্য!’ ‘জনসন হঠাৎ কিছু হকচকিয়ে গেল। ‘কী? ট্যারেন্টুলা?’
‘নাহ্।’ বৃদ্ধ দরজা খুলে ভিতরে একবার চোখ বুলিয়ে
নিয়ে ঢুকে পড়লেন। ‘ওসব ভয়ানক বিষাক্ত মাকড়শা। কামড়ালেই মৃত্যু। রাখি না আমি। আপনি চলে আসুন।’
কিছুটা হতাশ হয়েই জনসন ঘরের ভিতরে পা দিয়েছিল। এতগুলো ডলার খরচ করে সামান্য ট্যারেন্টুলাও দেখতে পাবে
না! কিন্তু ঘরে ঢুকেই হঠাৎ
কেমন থমকে গেল। ভিতরে
বেজায় অন্ধকার। খুটখাট শব্দে
খানিক চেষ্টায় বৃদ্ধ একটা আলো জ্বাললেন বটে‚ কিন্তু এত কম পাওয়ার‚ ঘরের অন্ধকার দূর হল সামান্যই। যথাসাধ্য চোখ বুলিয়েও ঘরের প্রায় কিছুই দেখতে নজরে
পড়ল না। তবে পিছনের দেয়ালে
সরু একটা প্যাসেজ দেখতে পেল। ওদিকে
আরও ঘর আছে হয়তো। ইতস্তত করে বলল‚ ‘ঘরে আলো ভয়ানক কম। আর আলো নেই?’
‘আছে তো।’ বৃদ্ধ হাসলেন। ‘কিন্তু সুইচ
দিতেও জ্বলল না। বোধ
হয় বাইরে মেইন সুইচে কিছু গোলমাল। আপনি
দাঁড়ান একটু।’
কথা শেষ করে বৃদ্ধ দরজা টেনে বেরিয়ে
গেলেন। জনসন ভিতরে অপেক্ষা
করছিল। ঘরের ডিম আলোটাও
ওই সময় নিভে গেল। ডোর ক্লোজার থাকায়
দরজা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ও তাড়াতাড়ি
দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু
দরজার ল্যাচ বাইরে থেকে লক হয়ে গেছে। অনেক
টেনেও খুলতে পারল না। ভেবেছিল
বৃদ্ধ এখনই হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু অন্ধকারে খানিক অপেক্ষার পরেও যখন বৃদ্ধর সাড়া
পাওয়া গেল না‚ জনসন একটু ঘাবড়েই গেল। ঘরের ডিম আলো বৃদ্ধ যখন জ্বালছিল‚ সুইচের জায়গাটা লক্ষ করেছিল। অনুমান করে ও সেদিকে হাত বাড়াল। অন্ধকারে গোড়ায় তেমন কিছু না পেলেও খানিক চেষ্টার পর হাতে
যা আটকাল মুহূর্তে শিরশির করে উঠল শরীর। দড়ির মতো শক্ত এক মাকড়শার জাল।
মাকড়শার জাল এমন হতে পারে জনসন স্বপ্নেও ভাবেনি কখনও। আতঙ্কে হাত টেনে নিয়ে প্রায় ছিটকে উঠল। বন্ধ দরজায় আঘাত করে সমানে চিৎকার করলে লাগল‚ ‘দরজা খুলুন। দরজা খুলুন শিগগির।’
কিন্তু বাইরে সামান্য সাড়াও পাওয়া গেল না। বৃদ্ধ এখনও ফেরেনি। শখ মেটাতে এসে এমন অবস্থায় পড়বে‚ জনসন ভাবতেই পারেনি। ভয়ানক ঘাবড়ে গেলেও মাথা অবশ্য কাজ করছিল তখনও। হতচ্ছাড়া বুড়োর অপেক্ষায় পড়ে থাকলে চলবে না। কিছু একটা উপায় করতেই হবে। তারপর বুড়োর
ব্যবস্থা। ভাবতে গিয়ে হঠাৎই ওর মনে পড়ল ঘরের পিছন দিকের দেয়ালে সরু প্যাসেজটার কথা। ইতিমধ্যে অন্ধকারে চোখও কিছু থিতু হয়ে গেছ। খুব সামান্য হলেও দেখা যাচ্ছে। ট্যারেন্টুলার মতো বিষাক্ত মাকড়শা যখন নেই‚ বেশি ভয় পাওয়ার মানে হয় না। প্যাসেজের ওদিকে বেরোবার কোনও
পথ আছে কিনা দেখে নেওয়া যায়।
ঘরের মেঝে একেবারেই পরিষ্কার নয়। কাঠ
আর পাথরের টুকরোয় ভরতি। তারই
মধ্যে সন্তর্পণে পা ফেলে একসময় প্যাসেজটা খুঁজে পেল জনসন। খানিক এগোতেই আর একটা ঘর। প্রথমটার থেকে কিছু ছোটই মনে হল। তবে কেমন একটা পুরোনো পচা গন্ধ। ও সাবধানে চারপাশে চোখ ঘোরাল। অল্প দূরে দেওয়ালের উপর দিকে চিলতে এক আলোর রেখা চোখে
পড়তে প্রায় লাফিয়ে উঠল ও। দেয়ালের
উঁচুতে ছোট একটা বন্ধ জানলা। আলোর
রেখা তারই ফাঁক গলে আসছে।
আবর্জনায় এই ঘরটাও ভরতি। বরং
কিছু বেশিই। সাবধানে পা ফেলে
জনসন একটু পরেই সেই বন্ধ জানলার নিচে পৌঁছুল। পাশেই দেয়াল থেকে কিছু একটা ঝুলছে। কৌতূহলে
হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুহূর্তে চমকে উঠল। ভেড়ার একটা কাঁচা চামড়া। প্রায় শুকিয়ে এসেছে এখন। তাহলে এই গন্ধটাই এতক্ষণ নাকে আসছিল! গা গুলিয়ে উঠলেও যথাসাধ্য সামলে নিয়ে জনসন কাঠকুটোর
উপর পা রেখে খানিক উঁচু হয়ে বন্ধ জানলার পাটা হাতড়ে ছিটকিনি খুঁজতে লাগল। খানিক চেষ্টার পরে বুঝতে পারল‚ জানলার পাটা ছিটকিনি এঁটে বন্ধ নয়। পেরেক দিয়ে সাঁটা। তবে ভরসার কথা‚ কোনও পেরেকই সম্পূর্ণ বসেনি। সম্ভবত বুড়োর শক্তিতে কুলোয়নি। চেষ্টা করলে খুলে ফেলা অসম্ভব নয়।
কার্যক্ষেত্রে তেমন হল না অবশ্য। এসব
কাজ একেবারেই অভ্যাস নেই। খানিক
চেষ্টায় একটা পাট খুলতে পারলেও অন্যটা কিছুতেই খোলা যাচ্ছিল না। ভয়ানক শক্ত হয়ে এঁটে রয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়ার উপায় নেই। বাকি পাটটা খুলতে পারলেই ভয়ানক এই ঘর থেকে বেরুতে পারবে। প্রাণপণে পাটটা আঁকড়ে ধরে জনসন তখন সমানে বিড়বিড় করছে‚ ‘আয় বাপু। উঠে আয় এবার।’
কাজের ঘোরে বেচারার তখন অন্য দিকে হুঁশ ছিল না। নয়তো পাশের দেওয়ালে মৃদু আওয়াজটা শুনতে পেত। আধো অন্ধকার দেওয়ালে মৃদু একটা আওয়াজ‚ টপ–টপ–টপ–টপ। কোনও অন্ধ ব্যক্তি যেন পা বাড়াবার আগে পথের উপর লাঠি ঠুকে চলেছে‚ টপ–টপ–টপ–টপ।
দুর্ঘটনা তাই ঘটেই গেল। জনসন
তখন জানলার পাট খুলতে ব্যস্ত। আচমকা
মাথার পিছনে দারুণ আঘাতে মুখ ভয়ানক ভাবে ঠুকে গেল জানলার নিচে দেওয়ারে উপর। বোঁ করে ঘুরে উঠল মাথা। নাক দিয়ে রক্ত গড়াতে শুরু করল।
সামলে উঠতে অনেকটা সময় লাগল ওর। তারপর পিছন ফিরে তাকাল। কে মারল এভাবে?
জানলার একটা পাট খুলে ফেলায় ঘরের ভিতরের অন্ধকার এখন অনেকটাই হালকা। জনসন দেখল‚ অদূরে দেয়ালের কোনে কাঠের বড় এক খোঁয়াড় মতো। তারই ভিতরে গুটিসুটি হয়ে কিম্ভুত দর্শন একটা প্রাণী।
তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওটা যে মাকড়শা‚ সেটা বুঝে উঠতে কিছু সময় লাগল জনসনের। তাহলে এটাই বুড়োর প্রাইজ উইনার! এক্সপেরিমেন্টের ফসল!
শুধু মাথাটাই আকারে ফুটবলের চাইতে বড়। সেই
অনুপাতে ধড়। এটাই কী পিছন থেকে
থাবা মেরেছিল ওকে! তারপর ছুটে
ফিরে গেছে আস্তানায়? কী ভয়ানক!
ভয়ে মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠলেও একটু পরে জনসনের মনে হল‚ মিথ্যেই আশঙ্কা করছে সে। হাজার হোক‚ মাকড়শার খাদ্য মানুষ নয়‚ নেহাৎই পোকামাকড়। তবু
সাবধান না হয়ে উপায় নেই। কিছু
একটা হাতিয়ার দরকার। ভাবতে
গিয়ে হঠাৎই পায়ের কাছে জানলার ভাঙা পাটটা নজরে পড়ল। সাবধানে হাত বাড়াতে যাবে‚ মাকড়শাটা নড়ে উঠল হঠাৎ। অগত্যা থেমে গেল জনসন। ভেবেছিল‚ ওর দিকে তাকিয়ে থাকা মাকড়শাটাও হয়তো স্থির হয়ে যাবে। কিন্তু তেমন হল না। সাবধানে পা ফেলে ধীর গতিতে দেয়াল বেয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। অদ্ভুত হালকা একটা শব্দ‚ টপ–টপ–টপ–টপ…।
ধীর গতিতে এগিয়ে আসা সেই প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে জনসনের সারা শরীর হঠাৎ কেঁপে উঠল। জীবনে এত ভয় কখনও পায়নি। এই প্রথম যেন টের পেল‚ মাকড়শা বাড়ির মানুষগুলোর আসল উদ্দেশ্য।
দারুণ আতঙ্কে শরীর প্রায় হিম হয়ে গেছে তখন। ওর চোখের সামনেই দেয়াল বেয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে এলো মাকড়শাটা। কাছে এসে সামনের একটা পা বাড়িয়ে দিল। জনসন হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতেই প্রাণীটা
পা টেনে নিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়াল। মাথা
ঘুরিয়ে সামান্য জরিপ করে নিল। তারপর পা ফেলে এগিয়ে এলো আরও। মুখের দু’পাশে তীক্ষ্ণ দাঁড়া দুটো নড়ে উঠল হঠাৎ। সামনের একটা পা জনসনের কাঁধের উপর বাড়িয়ে দিল। তীক্ষ্ণ রোঁয়া জামা ফুঁড়ে চামড়ার গিয়ে বিঁধল।
ভয়ে জনসন প্রায় কাঠ হয়ে গিয়েছে তখন। তবু সহজাত প্রতিক্রিয়ায় পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করল। এক পা যেতেই পিছনের দেয়ালে আটকে গেল। জায়গা নেই। ততক্ষণে মাকড়শাটা সামনের অন্য একটা পা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
সময় নেই। হঠাৎ যেন সাড় ফিরে এলো জনসনের। হাত বাড়িয়ে এই প্রথম সমস্ত শক্তি দিয়ে বাধা দেবার চেষ্টা করল। পেরে উঠল না। প্রাণীটার পায়ে যেন অসুরের শক্তি। অক্লেশে জনসনের অন্য কাঁধের উপর রাখল সেটা। প্রাণভয়ে জনসন এই প্রথম চিৎকার করে উঠল‚ ‘বাঁচাও‚ বাঁচাও।’
ইতিমধ্যে মাকড়শাটা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে জনসনকে প্রায় মুখের কাছে টেনে এনেছে। মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অল্প সময়। মুখের দু’দিকে তীক্ষ্ণ ছয় ইঞ্চি দাঁড়া দুটো আগে থেকেই নড়ছিল। এবার হালকা আলোয় দুই দাঁড়ার ডগায় বিষের ফোঁটা চকচক করে
উঠল। নিমেষে বিঁধিয়ে
দিল জনসনের বুকের মাঝে। তীব্র
যন্ত্রণায় জনসন আর্তনাদ করে উঠলেও গলা দিয়ে অতি সামান্য মাত্র শব্দ বের হল।
মাকড়শাটা ইতিমধ্যে দেয়াল বেয়ে ফের তার আস্তানায় ঢুকে পড়েছে। ওদের জীবনকথা জনসনের অজানা নয়। অল্প সময়ের মধ্যেই জালে আটকানো পোকার মতো শরীর এবার অসাড়
হয়ে আসবে। তারপর…! ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল ও। সময় বোধ হয় আছে এখনও। যন্ত্রণা যথাসাধ্য উপেক্ষা করে জনসন জানলার পাট আঁকড়ে
ধরতে গেল। যদি এই মৃত্যুপুরী
থেকে বের হওয়া যায়। কিন্তু পারল না। হাত ততক্ষণে সিসের মতো ভারি হয়ে গেছে। অসাড় আঙুল। জানলার পাটের কাছে হাত পৌঁছুল না। বরং টাল রাখতে না পেরে সশব্দে পড়ে গেল মেঝের উপর। চেষ্টা করেও উঠতে পারল না।
শরীর অসাড় হয়ে গেলেও জ্ঞান হারায়নি। জনসন দেখতে পেল‚ দেয়ালে আস্তানার ভিতর মাকড়শাটা পা গুটিয়ে স্থির হয়ে রয়েছে তখনও। হঠাৎই তার উঁচু পিঠটা কেমন ঝিকমিক করে উঠল। কিছু নড়ছে। মুহূর্তে নেংটি ইঁদুরের মতো ছোট একটা মাকড়শা মেঝেতে লাফ দিয়ে
পড়ল। পিছনে আর একটা। জনসনের মনে পড়ল কিছু মাকড়শা পিঠে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে
বেড়ায়। মা শিকার পেলেই
নেমে আসে ওরা।
ততক্ষণে পিলপিল করে অজস্র মাকড়শার বাচ্চা সার বেঁধে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। জনসনের চোখের পাতা তখন স্থির। চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারল না। সারির প্রথম বাচ্চাটা ইতিমধ্যে ওর পায়ের কাছে পৌঁছে সামনের
পা গুলো বাড়িয়ে দিয়েছে। চিৎকার
করতে গিয়েও জনসনের গলা দিয়ে শব্দ বের হল না। জ্ঞান হারাবার আগে দেখতে পেল‚ খুদে দানোটা পা থেকে এক টুকরো মাংস কেটে নিয়েছে।
খামার বাড়ির অন্য এক ঘরে দুটি মানুষ
তখন কফির কাপ হাতে গল্পে ব্যস্ত। বৃদ্ধা কফিতে বড় একটা চুমুক দিয়ে বললেন‚ ‘জ্যাক কত সময় লাগবে আর?’
‘বেশিক্ষণ নয়।’ বৃদ্ধের উত্তর‚ ‘জানই তো সেই রবিবারের পর কোনও ব্যবস্থা আর করা যায়নি। তেমন আসেই না কেউ।’
‘হাইওয়ের ধারে নতুন একটা সাইনবোর্ড তো লাগাতে পারো। বেশ রংচঙে।’
‘নাহ্!’ বৃদ্ধ ঘাড় ঝাঁকাল। ‘এই ঠিক আছে। বেশি
ভিড় মানেই বেশি ঝামেলা।
‘গাড়িটার কথা খেয়াল আছে তো।’ বৃদ্ধার কথায় সামান্য
উদ্বেগ। ‘তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করতে হবে কিন্তু। ডুগলকে আজ রাতেই ফোন করে দাও বরং।’
ছবি: রঞ্জন দত্ত (সৌজন্য: নবকল্লোল পত্রিকা)
মূল গল্প: The Petting Zoo
আপলোড: ২৯/১১/২০১৮
Asadharon..
ReplyDeleteযদি ভয়ের গল্পের ঠিকঠাক উদাহরণ দিতে হয় তবে সেটাা এই গল্পটা, এই গল্পটা, এই গল্পটা । মনে থাকবে এই গল্পটির লাইন বাই লাইন ।
ReplyDeleteAsomvob rokomer valo 😊
ReplyDeleteবাপরে,দৃশ্যগুলো পুরো সিনেমার মত চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কি দুর্দান্ত অনুবাদ। তেমনই দারুণ গল্প।
ReplyDeleteঅসাধারণ। এমন গল্প এই প্রথম পড়লাম।
ReplyDeleteঅসাধারণ। এমন গল্প এই প্রথম পড়লাম।
ReplyDelete