ভৌতিক কাহিনী
গৌরাঙ্গপ্ৰসাদ বসু
কলকাতা থেকে দার্জিলিং। শিয়ালদা থেকে
দার্জিলিং মেলে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে ভাড়া-মোটরে দার্জিলিং।
পুজোর ছুটিতে কলকাতা ছেড়ে আমাদের
দার্জিলিং আসা। আমাদের মানে‚ আমার ও আমার বন্ধু কমলের।
শিয়ালদায় রাত ন'টায় ট্রেনে চেপে
ভোর আটটায় শিলিগুড়ি পৌঁছলাম। শিলিগুড়িতে দশটার সময় ভাড়া-মোটরে উঠে বসলাম। ঘণ্টা
তিন-চারের মধ্যেই দার্জিলিং পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু ঠিক সময়ে দার্জিলিং পৌঁছানো গেল
না। ভাড়া-মোটর আমাদের সব রাস্তা নিয়ে যেতে পারেনি, বরং তাকেই আমাদের ঠেলে নিয়ে আসতে
হয়েছে মাইল কয়েক। কার্শিয়াং-এর কিছু আগেই মোটরের কল খারাপ হয়ে গেল। পাহাড়ি রাস্তা
ভেঙে আমাদেরই মোটর টেনে আনতে হল কার্শিয়াং-এ। তারপর ওখানে মোটর সারিয়ে দার্জিলিং-এ
আগমন।
দার্জিলিং-এ যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যে
পেরিয়ে গেছে। ছ'টার আগেই এখানে সন্ধ্যে হয়।
মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলে আগেই চিঠি
লিখে জায়গার ব্যবস্থা করেছিলাম। গিয়ে নাম বলতেই ম্যানেজার আমাদের ঘর দেখিয়ে দিলেন।
ঘরখানা বেশ‚ দু’দিকে দু'খানা খাট-বিছানা-পত্তর—সে
সব হোটেলের! ওসব কিছুই আমাদের আনতে হয়নি।
জিনিষ-পত্তর রেখে হাতমুখ ধুয়ে নীচে
খেতে গেল কমল। আমার আর খাওয়ার উৎসাহ ছিল না। পাহাড়ি-পথ মোটরে আসতে এবং মোটর ঠেলে নিয়ে
আসতে, দু'বার বমি করেছি। ভারী ঘুম পাচ্ছিল। আলো নিবিয়ে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লাম। শোওয়া
মাত্রই ঘুম!
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ আমার
ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, গায়ের কম্বল গায়ে নেই—আমি শীতে কাঁপছি। কম্বলটা সরে গেছে বোধ
হয়! পা দিয়ে অনেক খুঁজলাম শেষে হাতড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু কম্বল কই?
হাতটা একটু বাড়াতেই কম্বল পেয়ে গেলাম।
সরে গেছে বোধ হয়! কম্বল ধরে টান দিলাম কিন্তু কম্বল এলো না‚ কি ব্যাপার? জোরে আর একবার এক টান লাগাতেই কম্বলটা আলগা হয়ে
আসছিল‚ কিন্তু পরক্ষণেই কে যেন টেনে নিয়ে
গেল কম্বলটাকে। টাগ-অব-ওয়ারে আমি হেরে গেলাম। দস্তুরমত চমকে উঠলাম।
আবার হাতড়াতে শুরু করলাম। কম্বলটা
পেলাম, কিন্তু এবার আর কম্বল সরছে না—হাতড়ে বুঝলাম, একটা লোক কম্বলটা গায়ে শক্ত করে
জড়িয়ে শুয়ে আছে আমার পাশে।
“এ আবার কে?”—ভাবনা হ’ল। একটু ভয়ও
পেলাম। চোর-ডাকাত নাকি? চোর-ডাকাত হ'লে শুয়ে থাকবে কেন? চোর ত’ চুরি করে‚ আমি ভাবতে থাকি, হয়ত খুব শীত লেগেছে—এ হচ্ছে দার্জিলিং-এর
শীত। অন্ধকার একটু ফর্সা হলেই উঠে আমাদের ফর্সা করবার মতলব বোধ হয় ওর!
সাহস করে ফের হাত বাড়ালাম, “এই যে
দেখছি নাক‚ একটা নাক-হুঁ, একটা নাক-ই বটে!”
“হ্যাঁচ্চো।”
কেমন করে আমার একটা আঙ্গুল ওর ওই একমাত্র
নাকে ঢুকে যাওয়াতে এই বিপত্তি। আমার পাশের লোকটি হেঁচে দিল। আমি বেজায় রকম চমকে গেলাম
ভয়ও পেলাম খুব।
“এই যে দেখছি কান—একপাটি! কানমলা যাক
তা হলে। মনের সুখে আর হাতের সুখে ওর কান মলতে থাকি। রাত দুপরে ভদ্রলোকের ঘরে চুরি করতে
ঢোকার ফল, আর আমাকে হেঁচে ভয় দেখানর শাস্তি।
“আঃ-উ-উ-ম” ভারী আরাম পাই আমি‚ ওর এটা কম্বল কেড়ে নেবার দণ্ড।
ভারী শীত। আমার এদিকে গায়ে একটা গেঞ্জি
ছাড়া আর কিছুই নেই।
ভাবলাম, ডাকা যাক কমলকে, তারপর দুজন
মিলে ওকে মেরে তাড়াব। ডাকাই
যাক!
“কমল-কমল?” খুব নিচু স্বরে ডাকলাম।
কমলের সাড়া নেই।
“কমল কমল!” আগের চেয়ে একটু উঁচু পর্দায়
ডাকি।
কোন উত্তর নেই। ছেলেটা ভারী ঘুমকাতুরে।
ঘুমলে ওর আর জ্ঞান থাকে না। একেবারে মড়ার মত ঘুমোয়।
“কমল-কমল-” একটু, গলা তুলি।
“উঃ!” কমলের খাট আমার বাঁ দিকে সেখান
থেকে উত্তর আসে খুব নিচু স্বরে।
“শোন?”
“কি?”
“দ্যাখ ভারী...!”
“কি দেখব? আর কেমন করেই বা দেখব—যা
সূচীভেদ্য অন্ধকার।
“দেখতে হবে না—শোন...” আমি চটে উঠি।
“ভারী মুশকিল। একজন লোক এসে আমার কম্বল
কেড়ে নিয়ে, খাটে আমার পাশেই শুয়ে আছে। আমি এদিকে শীতে মরছি!”
“আমারও খাটে একজন এসেছে‚ কিন্তু কম্বল কাড়তে পারে নি—একবার টেনে নিয়েছিল কেবল—ফের
টেনে এনেছি—পাশে শুয়ে ভারী অত্যাচার শুরু করেছে।”
“ভারী শীত করছে ভাই,—কি করি?”
“আমার এখানেও দুজন। তা না হলে এখানে
শুতে পারতিস—আমার কম্বলটা ভাগাভাগি করে গায়ে দিতাম।”
“এখন কি করি তবে? তোর খাটের সেই লোকটি
তো আমায় জায়গা ছেড়ে দেবে না।”
“এক কাজ কর....”
“কি?”
“কাতুকুতু দিয়ে তোর পাশের লোকের কাছ
থেকে কম্বল কেড়ে নে।”
“ও ভাই আমি পারব না‚ কোথায় বগল কে জানে? বগলের ভিতর আমি হাত ঢোকাতে পারব না‚ যদি হাত কামড়ে দেয়!”
“তবে এক কাজ কর...”
“কি?”
“তোর পাশের লোকটাকে তুই এক লাথি মেরে
খাট থেকে ফেলে দে। আমিও আমারটাকে দেখছি।”
“আমি ভাই পারব না। আমার চেয়ে ওর গায়ের
জোর ঢের বেশী। কম্বল নিয়ে টাগ-অব-ওয়ার করতে গিয়ে আমি তা টের পেয়েছি। ও তাহলে আমায়
মেরেই ফেলবে! কাছে যে ছোরা-ছুরি নেই, তাই বা কে বললে?”
“চেষ্টা কর...”
আমার খাটের অপর বাসিন্দা বোধ হয় আমাদের
কথাবার্তা শুনছিল সে আমাদের দু'জনার মধ্যে ছিল‚ অর্থাৎ
আমার বাঁ পাশে। হঠাৎ এক প্রকাণ্ড লাথিতে আমি খাট থেকে পড়ে গেলাম!
“বাবাগো”-বলে আমি আর্তনাদ করে উঠি
ব্যথায়। আমার পিলে বোধ হয়, ফেটেই গেছে ওর লাথির চোটে।
কমলের গলা শোনা যায় এতক্ষণে, “হ্যা-হ্যাঃ—আমার
সাথে চালাকি!—দিয়েছি ব্যাটাকে এক লাথিতে ফেলে, হ্যাঃ!”
“কমল‚ কমল!’’ আমি কেঁদে ফেলি।
“কিরে, তোর কি হল?”
“আমাকে সেই পাজীটা খাট থেকে ফেলে দিয়েছে।”
‘ঘাবড়াস না‚ আয় তুই আমার খাটে এসে শো‚ এই কম্বল
দু’জনে গায় দেওয়া যাবে?”
“ভাই কমল‚ বে-কায়দায় পড়ে আমার পা মচকে গেছে‚ আমি আর উঠতে পারছি না।”
“দাঁড়া, আমি আসছি।”
হঠাৎ আলো জলে উঠল! কমল আমাকে পাঁজাকোলা
করে নিয়ে তার বিছানায় শোয়ালে।
“সেই লোক দুটো কই?” আমি কমলকে প্রশ্ন
করি, “ওদের ধরে পিটুনি দিতে হবে!”
“কই, দেখছি না ত’!” কমল আলমারির পাশ,
চৌকির তলা-সব খুঁজে দেখে। “পালিয়েছে—বোধ হয়—’
“কোথা দিয়ে পালাবে?”
“কেন? দরজা!”
“দরজা? দরজা দিয়ে কেমন করে পালাবে?
দরজা দেখছিস না ভেতর থেকে বন্ধ! পালাবার পর ভেতর থেকে কে দরজা বন্ধ করবে শুনি?” কমল
চটে ওঠে!
“তবে তারা গেল কোথায়? অদৃশ্য তো আর
হয়নি।
“কি জানি ব্যাপারটা ভৌতিক বলে মনে
হচ্ছে।”
“না—না‚ ভূত নয় কক্ষনো”—আমি তীব্র প্রতিবাদ করি, “ভূত কখনো অমন করে
হাঁচতে পারে না‚ ও রীতিমত হেঁচেছে‚ তার উপর আমি ওর কান মলে দেখেছি‚ ওর কান রীতিমত মানুষের কান!”
“মানুষ হলে তারা যাবে কোথায় শুনি?
মানুষ তো আর ভূত নয় যে, হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে! ও ভূতই নিশ্চয়‚ মানুষ সেজে এসেছিল।”
হঠাৎ আমার চোখ পড়ে আমারই পরিত্যক্ত
বিছানার উপর। বিছানা একেবারে টান করে পাতা-বালিশ সব‚ ফোলানো
কম্বল পায়ের নীচে ভাঁজ করা—যেন কেউ শোয়নি!
“কমল দেখছিস?” আমি কমলের দৃষ্টি আকর্ষণ
করি বিছানার দিকে! “এ সব ভূতুড়ে কাণ্ড!
“তা হবে।’’ আমি আমার দুঃখ ব্যক্ত করি,
“শেষে ভূতের মার খেতে হল আমাকে...
“আমাকেই কি ছেড়েছে রে ভাই‚’ কমল কাঁদ কাঁদ।
“তোকেও কি লাথি দিয়ে খাট থেকে ফেলে
দিয়েছে নাকি?”
“না, তা দেয়নি—তবে কান মলতে কসুর
করেনি। নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে হাঁচিয়েছে। ভূতটা কম বজ্জাৎ?”
যাক, আমার মনটা এতক্ষণে আশ্বস্ত হল
কিছুটা। ভূতের হাতে মার আমায় একলা খেতে হয়নি।
আপলোড: ৩০/১২/২০১৯
No comments:
Post a Comment