বাদার বাঘ আর বলাই
শিশির বিশ্বাস
আমাদের বলাই সামন্তর
কাণ্ড! অথচ বাদার গ্রামকে গ্রাম জুড়ে এত যে হইচই হল, কলকাতার কাগজে
কাগজে পাতা জুড়ে হেডলাইন, আসল ব্যাপারটাই
লেখেনি কেউ। জানতেই পারেনি। বেচারা বলাই সামন্তও বলেনি কাউকে! বলতে পারেনি। গোড়া
থেকেই বলি তাহলে।
বেচারা সেদিন জেটিঘাটের
পথে বেরিয়ে পড়েছিল সেই কাকভোরে। একদম চুপিসারে। তাই টেরটিও পায়নি কেউ। আগের দিন
বিকেলে টুরিস্ট পার্টির এক ভটভটিকে প্রায় হাতে–পায়ে ধরে রাজি করিয়েছে। ভোর
সকালেই ছাড়বে। একবার উঠে বসতে পারলে দুপুরের আগেই কালিতলা। তারপর ভ্যান রিকশায় দুলদুলি।
সেখান থেকে হাসনাবাদ হয়ে সন্ধে নাগাদ কলকাতা। ভাবতে গিয়ে বেচারার বুক প্রায়
জুড়িয়ে গিয়েছিল তখন। কী কুক্ষণেই যে আবাদে চাকরি করতে এসেছিল! নষ্টের গোড়া
সুখময়টা। পেয়ারের বন্ধু। খোঁজটা ওই এনেছিল। বিদেশি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়
চাকরি। মাইনেটাও মোটামুটি। কিন্তু তখন কী আর জানে যে, পোস্টিং
এমন ভয়ানক জায়গায়! একেবারে খাস সুন্দরবনের ভিতর!
এমনিতেই একটু ভীতু
স্বভাবের মানুষ। জল আর জঙ্গল দুটোকেই ভয়। তায় আবার বাঘের জঙ্গল! শেষ মুহূর্তে
তাই বেঁকেও দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। কম্পাউন্ডারের চাকরি। মুচলেকা দিয়ে
মাস কয়েক ট্রেনিং নিতে হয়েছে। আপত্তি তাই ধোপে টেঁকেনি। আসতেই হয়েছে। চাপে পড়ে
তখন ভেবেছিল ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু তা তো হয়ইনি, বরং দিন দিন আরও
ঘোরাল হয়েছে। কী করে যেন রটে গেছে, নতুন কম্পাউন্ডারবাবু
নাকি ধন্বন্তরিকেও হার মানায়। ওষুধে কথা বলে। পাস করা ডাক্তারও তার কাছে কিছু নয়।
কথাটা শুনে গোড়ায় একটু মজাই পেত। বলতে নেই, গর্বও হত।
আসল ব্যাপার হল, বাদার এইসব
প্রত্যন্ত গ্রামে কোয়াক অর্থাৎ হাতুড়েদের দেখাই তেমন মেলে না, তায় আবার পাশকরা ডাক্তার! এই যে বলাইদের হেলথ সেন্টার, সপ্তায় অন্তত দু’দিন কলকাতা থেকে ডাক্তার আসার কথা,
কিন্তু মাসে একবারের বেশি তার দেখা মেলে না। তাও মাত্র ঘণ্টা
খানেকের জন্য। অগত্যা বলাই-ই ভরসা। আর বলাইয়ের ভরসা মাস চারেকের ট্রেনিং, আর ডেভিড ওয়ার্নারের একটা বই। ওটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারই দেওয়া। চমৎকার
কাজে লাগছে এখানে। আসল কথা হল বাদার এসব গ্রাম এখনও পড়ে রয়েছে সেই ঝাড়ফুঁক আর
তুকতাকের যুগে। মুড়ি-মুড়কির মতো হরেক ওষুধ আর অ্যান্টিবায়োটিক এখনও পেটে পড়েনি।
অতি সাধারণ ওযুধেও তাই কাজ দেয় বেশ। তারপর জয়েন করার দিন কয়েকের মধ্যেই এক
ব্যাপার হয়েছিল। সেদিন সকালে হেলথ সেন্টারে বসে রোগী দেখছে‚ ধরাধরি করে এক
মরণাপন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে এলো কয়েকজন। পেটে অসহ্য ব্যথা। খানিক
আগেও যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। এখন নেতিয়ে পড়েছে। চোখ মেলার ক্ষমতা নেই।
সেই রোগীর দিকে এক পলক
তাকিয়ে বলাই বলল‚ ‘সাপে কাটেনি তো?’
শুনে সঙ্গের সবাই প্রায় হাঁ–হাঁ করে উঠল। ‘সাপে কাটলে
এখানে আসব কেন? গ্রামেই ওঝা–গুণিন
রয়েছে। সাপে কাটার সামান্য দাগও নেই কোথাও। সুস্থ মানুষ রাতে বিছানায় শুয়েছিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ওই অবস্থা। ক্রমেই খারাপ হচ্ছে আরো।’
ব্যথার ওষুধ দেওয়াই যায়।
কিন্তু বলাইয়ের সন্দেহ তবু যায় না। বরাবরই সিনসীয়ার মানুষ। মাস চারেকের ট্রেনিংয়ে
বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেয়নি। সেখানেই জেনেছে‚ বাদা অঞ্চলে কালাচ
সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। প্রায় নব্বুই ভাগ। অথচ তীব্র বিষধর নিশাচর
এই সাপটাকে প্রায় দেখাই যায় না। পরিচিত অন্য বিষধর সাপ গোখরো
কেউটে বা চন্দ্রবোড়ার মতো ভয়ানক আকার–আকৃতিরও নয়। বিষদাঁত
অতি সূক্ষ্ম। ছোবলের দাগ প্রায় থাকেই না। তেমন জ্বালা যন্ত্রণাও হয় না। নিশাচর এই
সাপ রাতে ইঁদুরের খোঁজে চলে আসে গৃহস্থের ঘরের ভিতর। গ্রামের সাধারণ মানুষের চৌকি
বা খাটে শোয়ার অভ্যাস নেই। বেশির ভাগ মেঝেয় বিছানা পেতে ঘুমোয়। শিকারের খোঁজে
কালাচ সাপ প্রায়ই চলে আসে এসব মানুষের কাছে। ঘুমের ভিতর নড়াচড়ায় হাত–পা সাপের গায়ে পড়লেই ছোবল দিয়ে পালিয়ে যায়। অথচ তেমন জ্বালা–যন্ত্রণা না হবার কারণে ঘুমের ভিতর মানুষটি টেরও পায় না। সকালে ঘুম থেকে
উঠে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন পেটব্যথা বা অন্যান্য অসুবিধার কথা
বলে‚ সাপের কামড় বলে বুঝতে পারে না কেউ। অথচ
কালাচ ভয়ানক বিষাক্ত সাপ। দেড় ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা না হলে বাঁচানো মুশকিল।
বলাই চট করে হিসাব করে
নিলো‚ রাত দেড়টায় যদি সাপে কামড়ায়‚ এখন বেলা নয়টা‚ অর্থাৎ সাড়ে সাত
ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। নেহাত বাদাগ্রামের মানুষ বলেই এখনো রোগের অন্য লক্ষণ সেভাবে
প্রকাশ পায়নি। বলাই এরপর শুধু জানতে চেয়েছিল‚ রাতে মানুষটি
চৌকিতে শুয়েছিল কিনা। উত্তর পেয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করেনি তারপর। রোগীকে বেডে
শুইয়ে অ্যান্টিভেনাম স্যালাইন চালু করে দিয়েছিল। প্রথমে দশটা ভায়াল। রোগ লক্ষণ
ক্রমে প্রকট হতে শুরু করেছে দেখে পরে আরো দশটা। রোগীর সেই অবস্থা দেখে সবাই যখন
প্রাণের আশা এক রকম ছেড়েই দিয়েছে ব্যতিক্রম বলাই। সব মিলিয়ে চল্লিশটার মতো ভায়াল
পুশ্ করে রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে পেরেছিল।
সেই শুরু। নতুন
কম্পাউন্ডারবাবু বলাই সামন্তর নামডাক চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। বলাইয়ের অবশ্য
মনে হয়েছিল‚ শুধু অ্যান্টিভেনাম নয়‚ রোগীর শারীরিক
সক্ষমতাও বেঁচে ওঠার পিছনে এক কারণ। নইলে যে সময় রোগীকে তার কাছে আনা হয়েছিল‚ বাঁচার কথা নয়। যাই হোক‚ ভিতরে একটা চাপা উৎকণ্ঠা নিয়েই
দিন কাটছিল বলাইয়ের। তার মধ্যেই ঘটে গেল আর এক ব্যাপার।
সেদিনও হেলথ সেন্টারে রোজকারমতো রোগী দেখছে‚ ধরাধরি করে আহত এক
ব্যক্তিকে এনে হাজির করল কয়েকজন। সেদিকে তাকিয়ে বলাইয়ের নিজের মাথাই ঘুরে যাবার
জোগাড়। লম্বা–চওড়া জোয়ান চেহারার একটা মানুষ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। ডান
হাতটা কাঁধের কাছ থেকে ছিঁড়ে প্রায় খুলে এসেছে। বীভৎস ব্যাপার। শেষ রাতে সঙ্গীকে
নিয়ে নাকি খালে মাছ ধরতে গিয়েছিল। কাজের ঘোরে বুঝতেই পারেনি, মানুষের গন্ধে কখন সাঁতরে চলে এসেছে বাদার বাঘ। হুঁশ যখন হল, তিনি তখন প্রায় নাকের ডগায়। তবে নৌকোয় উঠতে পারেনি। দু’জন দাঁড় বাগিয়ে হইহই করে উঠতে জল থেকেই থাবাটা সামান্য বাড়িয়ে
দিয়েছিল। তাতেই ওই অবস্থা। প্রচুর রক্তক্ষরণে ইতিমধ্যে নেতিয়ে পড়েছে মানুষটা।
যন্ত্রণায় অস্ফুট স্বরে কাতরাচ্ছিল। সঙ্গের অন্যরা সান্ত্বনা দিচ্ছিল তাকে,
‘ডাক্তারবাবুর কাছে এসে পড়েছিস যখন চিন্তা নেই। মরা মানুষ বাঁচিয়ে
তুলতে পারেন উনি। ভালো হয়ে যাবি।
কিন্তু চিকিৎসা করবে কী!
এ তো আর সাপে কাটা নয়। মানুষটির অবস্থা দেখে ওর নিজেরই তখন নাড়ি ছেড়ে যাবার
জোগাড়। মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। ওই অবস্থায় কোনওমতে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে গোটা
দুই ইনজেকশন দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে হাসনাবাদে। রীতিমতো আশ্বস্ত হয়ে চলেও গেছে
মানুষগুলো। কিন্তু সেই থেকে রাতের ঘুম গেছে বেচারার।
এর দিন কয়েকের মধ্যেই
ফের আর এক কাণ্ড! রাত দুপুরে হঠাৎ ভয়ানক হইচই‚ চিৎকার চ্যাঁচামেচি। খবর পাওয়া গেল, বাঘ ঢুকেছিল
গ্রামে। কাদের গোয়ালে ঢুকে গরু নিয়ে পালিয়েছে। পরদিন সকালে নজরে পড়ল
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশে নরম মাটিতে তেনারই পায়ের ছাপ। নদীর ধারেই
স্বাস্থ্যকেন্দ্র। লাগোয়া একটা ঘরে বলাইয়ের আস্তানা। বাঘটা সাঁতরে সেখান দিয়েই
গ্রামে ঢুকেছে। এরপর বলাই সামন্তর মনের অবস্থা আর না বলাই ভালো। রাতে এক আধবার
বাইরে বেরুতেই হয়। গত রাতেও বেরিয়েছিল। কী সর্বনেশে ব্যাপার! বেচারা সেই দণ্ডেই
ঠিক করে ফেলেছিল, খুব হয়েছে, আর এক
মুহূর্ত এখানে নয়।
কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল
গ্রামের সবাই। আপদে বিপদে একমাত্র ভরসা ডাক্তারবাবুকে তারা যেতে দেবে না কিছুতেই।
তখনকার মতো সে অনুরোধ এড়াতে না পারলেও বলাই মতলব পালটায়নি। ঠিক করে ফেলেছে, আর কাউকে জানিয়ে
নয়‚ নিঃশব্দেই সেরে ফেলতে হবে কাজ। সেই
সুযোগটাই পাওয়া গেছে এবার। গতকাল জেটিঘাটে আলাপ এক টুরিস্ট পার্টির সঙ্গে। ভটভটি
নিয়ে সুন্দরবন বেড়াতে এসেছে। রাত কাটিয়ে খুব ভোরে চলে যাবে ঝিঙেখালির দিকে।
অনুরোধ করতে রাজিও হয়েছেন ওরা। এবার চুপিসারে উঠে বসতে পারলে চিন্তা নেই।
আলো তেমন ফোটেনি তখন। পুব
আকাশটা সামান্য লাল হয়েছে মাত্র। নদী, ফাঁকা মাঠের উপর হালকা কুয়াশার চাদর।
জনমানুষের চিহ্ন নেই। এমনকী মীন, অর্থাৎ বাগদাপোনা ধরতেও কেউ
বের হয়নি। ইদানীং এ গায়ে মীন ধরার কাজে সামান্য হলেও ভাটা পড়েছে। দিন কয়েক আগে
নদীতে মীন ধরতে নেমে কুমিরের পেটে গেছে একজন। দূরে নদীর মাঝে দু'একটা নৌকো শুধু দেখা যাচ্ছে। নদী রাবর উঁচু বাঁধের উপর পায়ে-চলা পথটা তাই
একেবারেই নির্জন। বলাইয়ের বুকের ভিতর মৃদু কাঁপুনিটা তাই ক্রমশ বাড়ছিল। জেটিঘাট
এখনও প্রায় মিনিট দশেকের পথ। যথাসম্ভব দ্রুতই পা চলছিল। আরও বাড়িয়ে দিল।
সামনেই নদীর বাঁক। পাশেই
একটা পোড়ো জমি। সামান্য ঝোপঝাড়। কাছে পথের ধারে মস্ত এক খেজুর গাছ। হঠাৎ সেদিকে
নজর পড়তে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বলাই। হালকা ঝোপের ভিতর নড়ে উঠল কিছু। ঘাবড়ে
গেলেও গোড়ায় মনে হয়েছিল কারো গরু-মোষ হয়তো। ছাড়া পেয়ে এই ভোরে চরতে
বেরিয়েছে। কিন্তু ভুল ভাঙল মুহূর্তে। কী ভয়ানক ব্যাপার! ঝোপ ঠেলে ততক্ষণে বাঁধের
ওপর যিনি উঠে এসেছেন,
তিনি আর কেউ নন, বাদাবনের মহারাজ স্বয়ং!
ঝকমকে হলদে রঙের উপর কালো ডোরাকাটা শরীরটা এই আবছা আলোতেও ঝিলিক দিচ্ছে। বলাই
এমনিতেই ভীতু স্বভাবের মানুষ। স্রেফ এই বাঘের ভয়েই সাত সকালে চাকরি ছেড়ে
পালাচ্ছে। আর সেই পথেই যে এভাবে শিয়রে সমন এসে হাজির হবে ভাবতেই পারেনি। ব্যাপার
দেখে ততক্ষণে তার সারা শরীর প্রায় পাথর হবার জোগাড়। চিৎকার করতে গিয়ে দেখে গলা
শুকিয়ে কাঠ। স্বরই বের হচ্ছে না। নড়বার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই।
ওদিকে খেজুর গাছের
সামান্য ওধারে প্রাণীটা সম্ভবত গোড়ায় লক্ষ্য করেনি বলাইকে। প্রায় সপ্তাখানেক
শিকার জোটেনি। পেটের দায়ে আজ নদী পার হয়ে গাঁয়ে এসেছিল এক আধটা গরু ছাগলের
খোঁজে। কিন্তু সুবিধা হয়নি। আলো ফোটার আগেই তাই চুপিসারে সরে পড়ার মতলবে ছিল।
ভালই জানে, দেরি হলেই বিপদ। গাঁয়ের এই দু-পেয়ে মানুষগুলোর মতো খতরনক চিজ আর দুটি
নেই! নজরে পড়ে গেলেই সর্বনাশ। সেবার কিছু দেরি করে ফেলার কারণে প্রাণটাই যেতে
বসেছিল প্রায়! হাজার কয়েক মানুষ হইহই রবে ঘিরে ফেলেছিল চারপাশ। শেষে এক ধানখেতে
সারাদিন ঘাপটি মেরে থেকে কোনওমতে রেহাই। পেটের খিদে তাই পেটে চেপেই ফের নদীর ওপারে
জঙ্গলে ফিরছিলেন তিনি। হঠাৎ নজর পড়ল, অদূরে খেজুর গাছের
ওধারে বলাইয়ের দিকে। বাঘ বেচারার দু-চোখ নিমেষে স্থির হয়ে গেল। শক্ত হয়ে উঠল
লেজটা। তারপরেই ছুটল অদূরে সেই খেজুর গাছের দিকেই।
বলাইয়ের আত্মারাম
খাঁচাছাড়া হবার জোগাড় হয়েছিল আগেই। অজান্তেই দু’চোখ বন্ধ হয়ে এলো এবার। ছুটে
পালাবে কী, পা দুটো এমন কাঁপতে লাগল যে, দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতাও তখন অবশিষ্ট নেই। ধুপ করে বসে পড়ল পথের উপর।
ভবলীলা সাঙ্গ হবার কথা নিমেষেই। বেচারা ভেবেছিলও তাই। কিন্তু প্রায় মিনিটখানেক
পার হয়ে গেল, অথচ তেমন কিছুই যখন হল না, চোখ মেলল সামান্য। কী কাণ্ড! বাঘটার চিহ্নমাত্র নেই। গোড়ায় মনে হয়েছিল,
চোখের ভুল হয়তো। কিন্তু পরে বুঝল, তা নয়‚ বেঁচেও রয়েছে
বহালতবিয়তে। তবু ভয়ে ভয়ে চারপাশে ফের ঘাড় ঘোরাল বার কয়েক। বাঁধের দু’ধার, নদী। নাহ্, নেই কোথাও।
ভয়ানক প্রাণীটা যেন হাওয়ায় উবে গেছে। বলাই দেরি করল না আর। এমন অলৌকিকভাবে
প্রাণ ফিরে পেতে বুকের ভিতর সাহসটা তখন ফিরেছে কিছু। মুহূর্তে উঠে দাড়িয়ে পিছন
ফিরে দৌড় লাগাল। এক দৌড়ে ফের নিজের ঘরে ঢুকে কোনোমতে দরজায় খিল তুলে দিয়ে ধপাস
করে বসে পড়ল মেঝেয়। সারা শরীর দিয়ে তখন দরদর করে ঘাম ঝরছে।
সামান্য থিতু হতে লাগল
প্রায় ঘণ্টাখানেক। তারপরেই সন্দেহটা উঁকি মারল ভিতর। বাদার বাঘের মুখ থেকে এভাবেও
কী বেঁচে ফেরা সম্ভব! নাকি সবটাই স্রেফ চোখের ভুল? হায় হায়, পালাবার
চমৎকার সুযোগটা আজ নষ্ট হল এভাবে!
বন্ধ ঘরের ভিতর বসে বলাই
যখন এসব ভাবছে ততক্ষণে হইহই ব্যাপার শুরু হয়ে গেছে ওদিকে। গাঁয়ের সনাতন ব্যাপারী
ভোর সকালে বের হয়েছিল মাছ ধরতে। হঠাৎ সেই খেজুর গাছের কাছে আসতে কানে এলো চাপা
কুঁই-কুঁই আওয়াজ। চারপাশে কিছু দেখতে না পেয়ে শেষে খেজুর গাছের মাথায় চোখ
ফেরাতেই তো তার আক্কেল গুড়ুম হবার জোগাড়। কী ভয়ানক ব্যাপার! প্রায় বিশ হাত
লম্বা খেজুর গাছের ডগায় চড়ে পাতা আর কাটার আড়ালে বসে জলজ্যান্ত এক বাঘ!
আওয়াজটা তার গলা থেকেই আসছে। সনাতন তো আর বলাই নয়, বাদার মানুষ। মুহূর্তে পিছন ফিরে
দৌড়াতে দৌড়োতে বাঘ—বাঘ বলে পরিত্রাহি চিৎকার।
তারপর সে এক হইহই
ব্যাপার। মস্ত খেজুর গাছের ডগায় চড়ে বসে আছে বাদার বাঘ। এমন ব্যাপার দেখা তো
দূরের কথা, কেউ শোনেওনি কখনো। আজব দৃশ্য দেখতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে এসেছিল চারদিক
থেকে। কলকাতা থেকে রিপোর্টারের ঝাঁক। সে খবর ছাপাও হয়েছিল কাগজে। সেই বাঘ ফের গাছ
থেকে নামিয়ে জঙ্গলে ফেরত পাঠাতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল বনদপ্তরের কর্মীদের। অদ্ভুত
ব্যাপারের কারণটা অবশ্য জানতে পারেনি কেউ। তবে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের অনেকেই মত প্রকাশ
করেছিলেন, ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে স্রেফ প্রাণের ভয়েই গাছে
চড়ে বসেছিল বাঘটা। তারপর আর নেমে আসতে পারেনি। বেচারা বলাইও কিছু বলেনি কাউকে।
তবে বাদার চাকরিটা ছাড়েনি আর। থেকে গিয়েছিল বহালতবিয়তেই।
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
আপলোড: ৬/৫/২০১৯
No comments:
Post a Comment