প্যাঁচালো মেঠাই
শিশির বিশ্বাস
এ গল্প হবুচন্দ্র রাজার। রবিঠাকুর এঁকে নিয়েই জুতো আবিষ্কার
লিখেছিলেন কিনা জানা নেই। কিন্তু আমাদের এই হবুচন্দ্রর দৌলতে আর একটা আবিষ্কার হয়েছিল। শোনো সেই গল্প।
হবুচন্দ্র তখন সবে সিংহাসনে বসেছেন। ছোট রাজ্য। রাজামশাই বুদ্ধিতেও একটু খাটো। কিন্তু দাপট ভয়ানক। হাঁকডাকে বাঘে–গরুতে এক ঘাটে জল খায়। তা সেই হবুচন্দ্রর মুখে প্রায় ঝামা ঘষে দিয়ে গেছে পাশের রাজ্যের আর এক রাজা। কৌশলে পেরে ওঠেননি তিনি। দিন কয়েক ধরে তাই তিরিক্ষি হয়ে আছেন।
রাজার মেজাজ দেখে মন্ত্রী গবুচন্দ্র
ইদানীং আর রাজদরবারে ঘেঁষছিলেন না। কিন্তু কদিন পরেই মাস পয়লা। মাইনের দিন। এই সময় বেশি কামাই হলে মাইনে কাটা
যেতে পারে। মন্ত্রী গবুচন্দ্র সেদিন তাই ভয়ে ভয়ে
দরবারে এসে হাজির হয়েছেন। একটু আগেভাগেই। কিন্তু কপাল মন্দ। পড়ে গেলেন রাজার সামনে।
ফাঁকা দরবার ঘরে রাজা একাই আলো করে বসে আছেন। সেলাম ঠুকতে যাবেন, রাজা হাঁকলেন, ‘কী খবর মন্ত্রী, কদিন দেখা নেই!’
‘আজ্ঞে, ধড়মড়িয়ে উঠলেন গবুচন্দ্র, ‘গিন্নির বায়না সামাল দিতে শ্বশুরবাড়ি
গেছলাম। কদিনে মেলা খরচ হয়ে গেছে। মাইনে কাটলে মরে যাব হুজুর।’
মন্ত্রী গোবুচন্দ্রের গিন্নি
বেজায় দজ্জাল। রাজা হবুচন্দ্রর ভালই জানা আছে। চতুর গবুচন্দ্র গিন্নির ছুতো দিয়েছিলেন
সেই কারণে। কিন্তু আজ বিধি বাম। রাজা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘মাইনে কিন্তু কাটা পড়বে এবার। তবে দরবারে কামাই করার জন্য নয়। অন্য কারণে?’
‘ক-কী কারণে হুজুর?’ প্রায় আঁতকে উঠলেন গবুচন্দ্র।
‘তোমরা থাকতে ফালতু এক পেঁচোর
কাছে আমাকে অপমানিত হতে হয়!’ রাগে গরগর করে হবুচন্দ্র বললেন।
মাইনে নিয়ে টানাটানি। কিছু একটা করতেই হয়। গবুচন্দ্র তাড়াতাড়ি উত্তর দিলেন, ‘ওসব পেঁচোদের টাইট করতে হলে পেটে
একটু প্যাঁচ রাখা দরকার হুজুর।’
‘প্যাঁচ!’ অবাক হয়ে হবুচন্দ্র বললেন, ‘সেটা কী খাবার? এখুনি আনাও। পেট পুরে খেয়ে পেঁচোটাকে টাইট করে
দিই।’
রাজার সেই কথায় গবুচন্দ্র আকাশ
থেকে পড়লেন। আসল ব্যাপার হল, প্রতিবেশী সেই রাজার নাম পঞ্চানন। ক্ষুব্ধ হবুচন্দ্র তাকে ‘পেঁচো’ বলতে গবুচন্দ্রও পেঁচো অর্থে
প্যাঁচালো বুদ্ধির কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজা এমন উলটো বুঝবেন, ভাবেননি। এদিকে হাতে সময় নেই। হবুচন্দ্র উত্তরের অপেক্ষায় হাঁ করে আছেন। গবুচন্দ্র তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আজ্ঞে হুজুর, ওটা এক রকম মেঠাই। দেখতে প্যাঁচালো মতো।’
‘প্যাঁচালো মেঠাই!’ উৎসাহে জুলজুল করে উঠল হবুচন্দ্রর
চোখ। মিষ্টি তার বেজায় পছন্দ। উলস্ করে জিবের জল টেনে বললেন, ‘খুব ভাল মেঠাই বুঝি?’
‘সে আর বলতে!’ চোখ মটকে মুচকি হাসলেন গবুচন্দ্র।
‘তাহলে দেরি না করে আনাও দেখি। ডবল মাইনে পাবে এমাসে।’
মন্ত্রী গবুচন্দ্র ততক্ষণে সামলে
নিয়েছেন। ফের একটু মুচকি হাসলেন, ‘ওসব রাজভোগ্য জিনিস কি সবাই তৈরি
করতে পারে হুজুর! ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ময়রা খুঁজতে হবে। সময় তো লাগবেই।’
এদিকে মাথায় কিছু চাপলে তর সয়
না হবুচন্দ্রর। বেজায় বিরক্ত হয়ে মাথা ঝাঁকালেন। ‘তা কদিন লাগবে বাপু?’
‘আজ্ঞে দিন পনেরো হুজুর।’ রাজার মেজাজ অনুমান করে গবুচন্দ্র ভয়ে
ভয়ে উত্তর দিলেন।
‘না, পনেরো নয়। সাত দিন সময় দিলাম। প্যাঁচালো মেঠাই তার মধ্যে হাজির করা চাই।’ ফের একবার জিবের জল টেনে রাজা হবুচন্দ্র সেদিনের মতো দরবার মুলতুবি
করে উঠে গেলেন।
সেই দিনই রাজ্য জুড়ে ঢ্যাঁড়া
পিটিয়ে দেওয়া হল, প্যাঁচালো মেঠাই তৈরির জন্য রাজার হেঁশেলে একজন ময়রা চাই।
কিন্তু মোটা মাইনের টোপ সত্ত্বেও
কোনও ময়রার টিকির দেখা নেই। রাজ্যে ময়রার অভাব, এমন নয়। কিন্তু প্যাঁচালো মেঠাই তৈরি তো দূরের কথা, নামই শোনেনি কেউ। গবুচন্দ্র অবশ্য ঢ্যাঁড়া পিটিয়েই
থেমে থাকেননি। জনা কয়েক বাছাই পেয়াদাও লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারও ডাহা ফেল হবার জোগাড়। সব ময়রার এক রা, অমন মেঠাইয়ের কথা তারা বাপের
জন্মে শোনেনি। মোটা মাইনের লোভে রাজার রোষে পড়ে গর্দান
দিতে রাজি নয় কেউ। এরপর এমন হল যে, দূর থেকে পেয়াদা দেখলেই ময়রার
দল যে যেদিকে পারে দৌড় লাগায়। তাদের খোঁজ পাওয়াই দায় হয়ে উঠল।
শেষে দিন পাঁচেকের মাথায় অতি
কষ্টে একজনকে পাকড়াও করা গেল। মন্ত্রী গবুচন্দ্রর কাছে হাজির করেতে সে তো কেঁদেকেটে একশা। হাউমাউ করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমায় বাঁচান হুজুর। আমি ময়রার পেশা ছেড়ে দিইছি অনেক দিন। এখন খেতে হাল চষে খাই।’
চতুর গবুচন্দ্র তার হাত নাকের
কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকেই বুঝলেন, বেমালুম মিছে কথা। কড়া গলায় বললেন, ‘হবুচন্দ্র রাজার রাজত্বে মিছে কথা বলার শাস্তি জানো?’
ধমক খেয়ে লোকটার মুখে আর কথা
নেই। গবুচন্দ্র বললেন, ‘হাতে খাঁটি ঘিয়ের ভুরভুরে গন্ধ
লেগে রয়েছে এখনও। মেঠাইটা মনে হয় ভালই বানাও। প্রাণে বাঁচতে চাও তো যা বলছি করো এবার।’
লোকটার মুখে তখনও কথা নেই। তাকিয়ে রয়েছে ফ্যাল ফ্যাল করে। হবুচন্দ্র বললেন, ‘রসগোল্লা, পানতুয়া বানাতে পারো?’
শুনে ময়রার ধড়ে যেন প্রাণ এল। মস্ত মাথা হেলিয়ে বলল, ‘পারি হুজুর। অধম যদুময়রার তৈরি রসগোল্লা-পানতুয়ার কেমন কদর, বাজারে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। তবে এক নম্বর ছানা আর ক্ষীর চাই।’
‘সব পাবে।’ প্রায় হাঁপ ছাড়লেন হবুচন্দ্র। ‘কাল সকালের মধ্যেই বানিয়ে ফেল। শুধু আকারটা গোল করা চলবে না। অন্য রকম কিছু। ধরে নাও তারই নাম প্যাঁচালো মেঠাই। খেয়ে রাজা খুশি হলেই হেঁশেলে মোটা
মাইনের চাকরি।’
মন্ত্রী হবুচন্দ্রর কথায় যদুময়রা
তো বেজায় খুশি। সেই দণ্ডেই লেগে পড়ল কাজে। শুধু রসগোল্লা-পানতুয়া নয়, মাথা খাটিয়ে তার সঙ্গে বেনারসি
চমচম আর রসমালাই পাঞ্চ করে পরের দিন ভোরের আগেই বানিয়ে ফেলল রসে জবজব এক আজব মেঠাই।
সকালে দরবার বসতেই গবুচন্দ্র
থালা ভরতি সেই মেঠাই নিয়ে হাজির রাজা হবুচন্দ্রর সামনে। নতুন রকমের সেই মেঠাই দেখে রাজা তো বেজায় খুশি। জুলজুল করে উঠল দু’চোখ। তারপর হামলে পড়ে একটা মুখে দিয়েই
থু–থু করে উঠলেন, ‘ছ্যা-ছ্যা, এ কী মেঠাই খাওয়ালে মন্ত্রী! এ যে পানতুয়া আর রসগোল্লার মতো! সঙ্গে চমচমের ভেজাল! এর নাম প্যাঁচালো মেঠাই! ফাঁকিবাজির জায়গা পায়নি! কোন ময়রার কাজ? গর্দান নেব তার।’
রাতভর খেটেখুটে তৈরি। মন্ত্রীর কথায় যদুময়রার বড়ো আশা ছিল, খুশি হয়ে রাজা মশাই তাকে হেঁশেলের
প্রধান তো বটেই, চাই কী একটা গালভরা শিরোপাও দেবেন। বড়ো উৎসাহ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দরবারের এক কোণে। ডাক পড়লেই এগিয়ে যাবে। তার বদলে ওই হুঙ্কার শুনে চোখ উলটে সেখানেই চিতপাত। তাতে অবশ্য সুবিধাই হল গবুচন্দ্রর। সামলে নিয়ে ঢোঁক গিলে বললেন, ‘একদম ঠিক কথা। তবে হতচ্ছাড়া ময়রার গর্দান বুঝি আর নেবার দরকার হবে না। হুজুরের এক হুঙ্কারেই ব্যাটার প্রাণপাখি খালাস হয়ে গেছে।’
রাজা বললেন, ‘কিন্তু সাত দিন যে শেষ হয়ে এলো
বাপু! মেঠাই কবে মিলবে?’
‘আর দিন সাতেক সময় দিন হুজুর।’ মাথা চুলকে গবুচন্দ্র জানালেন, ‘যা হোল, এরপর ভাল করে না বাজিয়ে কাউকে
কাজে লাগাতে ভরসা হয় না।’
মন্ত্রীর সেই অকাট্য যুক্তি মানতেই
হল হবুচন্দ্রকে। রাজদরবার থেকে বিদায় নিয়ে গবুচন্দ্র
সেই দিনই ফের ডেকে পাঠালেন পেয়াদা সর্দারকে। সাফ জানিয়ে দিলেন, যা অবস্থা, ঘাড়ের উপর মাথা রাখতে চাইলে ফের ময়রা খুঁজে আনতে হবে। আজই।
মন্ত্রী এক দিন সময় দিয়েছিলেন। দিন দুয়েক গলদঘর্ম হয়ে খোঁজাখুঁজির
পরে পেয়াদার দল ধরে আনল একজনকে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে মন্ত্রীর সামনে এসে সে প্রায় মড়াকান্না জুড়ে দিল, ‘হুজুর আমি ময়রা নই। বয়সকালে বদ সঙ্গে ভিড়ে পৈতৃক কাজকারবার
কিছুই শেখা হয়নি। চোরের দায়ে ধরা পড়ে একটা ঠ্যাং-ও গেছে। এখন ডালমুট ভেজে দিন চালাই। খোঁড়া মানুষ। ছুটেও পালাতে পারিনি। পেয়াদা জোর করে ধরে এনেছে।’
লোকটার নাম রামভরসা। তার কথা যে মিথ্যে নয়, গবুচন্দ্র দেখেই বুঝলেন। কিন্তু হাল না ছেড়ে বললেন, ‘কী ডালমুট বানাও?’
‘আজ্ঞে চাকা ডালমুট। গাড়ির চাকার মতো দেখতে কিনা। গাঁয়ের ছেলেপুলেরা খায়।’
চাকা ডালমুট ভালই চেনেন গবুচন্দ্র। ডালবাটা ঝাঁজরিতে ফেলে সস্তা তিসির
তেলে ভাজা। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘একটু প্যাঁচালো মতন করে ওই জিনিসই
তৈরি করে ফেল দেখি। তবে নোনতা নয়। রাজা ওসব পছন্দ করেন না। মিষ্টি হওয়া চাই। ভাল ঘিয়ে ভাজা।’
মন্ত্রীর কথায় রামভরসা কিন্তু
মোটেই ভরসা পেল না। ডালমুট কীভাবে মিষ্টি হবে‚ তাও আবার ঘিয়ে ভাজা! কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি মুখ্যু মানুষ। ও পারব না হুজুর। বরং বলেন তো কটকটি বানিয়ে দিতে পারি। ওটা ভালই জানি। খেতেও মিষ্টি।’
গোবুচন্দ্রর তখন শিরে সংক্রান্তি। মাথা ঠিক রাখাই মুশকিল। ফস করে বলে ফেললেন, ‘তবে তাই হোক।’
ময়দা আর ডালবাটা মিশিয়ে তৈরি
কটকটি একটু শক্ত মতো হলেও খেতে মন্দ নয়। তার উপর রাতভর মাথা খাটিয়ে নারকেল-টারকেল দিয়ে রামভরসা বেশ যত্ন করেই তৈরি করেছিল জিনিসটা। ভুরভুর করছে এলাচ, কর্পূরের সুগন্ধ।
যথাসময়ে সেই মেঠাই নিয়ে গবুচন্দ্র
দরবারে হাজির হতেই হবুচন্দ্র সময় নষ্ট না করে তার একটা তুলে সবে মুখে দিয়েছেন। কড়াৎ করে একটা শব্দ। মুহূর্তে আঁ-আঁ আর্তনাদে হবুচন্দ্র গালে হাত
দিয়ে ঢলে পড়লেন সিংহাসনে।
দু’দুটো দাঁত ছিটকে পড়ল মেঝেয়। আসলে রাজার দুটো দাঁত আগে থেকেই একটু
নড়বড়ে ছিল। কটকটি বেকায়দায় সেই দাঁতে পড়তেই
যত বিপত্তি।
রাজদরবারে তারপর সে এক কাণ্ড! বেগতিক বুঝে গবুচন্দ্র আর সেখানে
নেই। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে এক দৌড়ে ঘরে
এসে বউকে বললেন, ‘গিন্নি, আর রক্ষা নেই। এখুনি রাজ্য ছেড়ে না পালালে ধড়ে মাথা
থাকবে না। সব গোছাও শিগগির।’
দজ্জাল হলেও গবুচন্দ্রের গিন্নি
বুদ্ধিমান। সব খবরই রাখেন। আর আজ দরবারে যে গুরুতর কিছু ঘটেছে, তাও বুঝতে বাকি নেই। মুখ ঝামটে বললেন, ‘এই বুদ্ধি নিয়ে মন্ত্রী! রাজাকে একটা মেঠাই খাওয়াতে পারলে
না! এমন মুখপোড়া মানুষের গর্দান যাওয়াই উচিত।’
‘তুমি বুঝছ না গিন্নি!’ গবুচন্দ্র প্রায় হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, ‘এ রাজ্যে আর ময়রা নেই! সব ভেগেছে।’
‘ঝ্যাঁটা মারো মুকে।’ ঝাঁজিয়ে উঠলেন গবুচন্দ্র-গিন্নি, ‘তুমি এখুনি দরবারে খবর পাটিয়ে
দাও। মেঠাই আমিই তৈরি করে দেব।’
‘ত-তুমি!’ গিন্নির কথায় ধড়ে যেন প্রাণ এল গবুচন্দ্রর। আসলে দজ্জাল গিন্নির কেরামতি যে কম
নয়, তার কিছু ইতিমধ্যে টের পেয়েছেন তিনি। খানিক হাঁপ ছেড়ে বললেন, ‘তা ছানা, ঘি, ক্ষীর এসব কত কী লাগবে বলো দেখি। ধারকর্জ করে নিয়ে আসি। এরপর বাজার বন্ধ হয়ে গেলে বিপদ।’
‘কিচ্চু লাগবেনি। ঘরে সব রয়েছে।’
গিন্নির সেই নিশ্চিন্ত মুখ দেখে
গবুচন্দ্র বিশেষ ভরসা পেলেন না। মাসের শেষ। ঘরে থাকার মধ্যে আছে সেরটাক চিনি। এছাড়া দিন কয়েক আগে ছেলেপুলের বায়নায়
লুচি খাওয়ার জন্য ডালডা আনা হয়েছিল। কিন্তু ময়দার টিন খুলে নিরাশ হতে হয়েছে। অনেক দিন পড়ে থেকে ময়দায় পোকা ধরে গন্ধ ছেড়েছে। একেবারেই খাওয়ার অবস্থায় নেই। ব্যাপারটা তাই আর এগোয়নি। গবুচন্দ্র চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘শুধু চিনি আর ওই সস্তার ডালডায় কী মেঠাই হবে গো গিন্নি?’
‘কেন, অতগুলো ময়দা রয়েছে না?’
গিন্নির উত্তরে প্রায় খাবি খেয়ে
গবুচন্দ্র বললেন, ‘সে যে পোকাধরা পচা ময়দা গিন্নি! টোকো গন্ধ ছেড়েছে। খাওয়ার যুগ্যি নেই!’
‘তাই বলে অতগুলো ময়দা ফেলা যাবে
নাকি!' ফের ঝাঁজিয়ে উঠলেন গবুচন্দ্র গিন্নি, ‘এবার ওই টোকো ময়দার একটা হিল্লে করে
ফেলব।’
অগত্যা বুকের ধড়ফড়ানি ফের বাড়তে
শুরু করল গবুচন্দ্রর। বুঝে ফেললেন, তাঁর গর্দান তো গেছেই, গোঁয়ার গিন্নির গর্দানও যাবে এবার। কচি ছেলেপুলেগুলো বানের জলে ভেসে যাবে। হায় হায়! কিন্তু সে কথা আর কাকে বলবেন। তাই গুম হয়ে রইলেন।
ওদিকে দাঁতের যন্ত্রণায় দিন
দুই রাজার তরফে আর সাড়া পাওয়া যায়নি। তিন দিনের মাথায় কিছু সুস্থ হতে দরবারে এসেই হাঁক ছেড়ে মন্ত্রীকে তলব করলেন তিনি। সেই খবর নিয়ে পেয়াদা ছুটে এল গবুচন্দ্রর
বাড়িতে। ভয়ে কাঠ হয়ে গবুচন্দ্র তখন খাটের
তলায় সেঁধুবেন কিনা ভাবছেন। সামলে দিলেন গিন্নি। পালটা ধমক দিয়ে পেয়াদাকে জানিয়ে দিলেন, ‘রোসো বাপু। রাজামশাইকে গিয়ে বলো, উনি মেঠাই নিয়ে একটু পরেই দরবারে যাচ্ছেন।’
গবুচন্দ্রর বউ দেরি না করে এরপর
বসে গেলেন মেঠাই তৈরির কাজে। সেই পোকা ধরা টোকো পচা ময়দা জলে ঘন করে গুলে দু’ফোঁটা রং মিশিয়ে তৈরি হল খামি। ফুটো এক নারকেলের মালায় ভরে পেঁচিয়ে
পেঁচিয়ে ডালডায় ফেলে ভাজা হল জুত করে। তারপর ফেলা হল চিনির রসে।
ইতিমধ্যে প্রাণের আশা প্রায়
ছেড়েই দিয়েছেন গবুচন্দ্র। কিন্তু রসে ভেজা চোখ জুড়ানো সোনালি রঙের সেই মেঠাই দেখে বুকে বল এল একটু। প্যাঁচের উপর প্যাঁচ দিয়ে জিনিসটা
খাসা তৈরি করেছে গিন্নি। অবশ্য চেখে দেখতে ভরসা হল না। ইতিমধ্যে সোনালি রঙের এক বারকোশে গিন্নি সাজিয়ে ফেলেছে সেগুলো। দেরি না করে গবুচন্দ্র ছুটলেন রাজদরবারের
দিকে।
সিংহাসনে গুম হয়ে বসে ছিলেন
হবুচন্দ্র। মন্ত্রীকে দেখেই হেঁকে উঠতে যাবেন, তার আগেই গবুচন্দ্র মোলায়েম
গলায় বললেন, ‘হুজুর কী আদেশ করবেন জানি। তবে সাতদিন এখনও পূর্ণ হয়নি। আসল প্যাঁচালো মেঠাই এবার কিন্তু তৈরি।’ বলতে বলতে গবুচন্দ্র বারকোশে ঢাকা দেওয়া কাপড়টা তুলে ফেললেন।
আগের দু’বারের কথা ভেবে হবুচন্দ্র গোড়ায়
তেমন পাত্তা দেননি। কিন্তু ঢাকা সরতেই বারকোশ ভরতি অদ্ভুত
মেঠাইগুলোর দিকে তাকিয়ে দু’চোখ জুলজুল করে উঠল। মস্ত বারকোশ ভরতি শুধু প্যাঁচের পর প্যাচ। রসে ভেজা প্যাঁচালো মেঠাইগুলোর চমৎকার সোনালি রং যেন আলোর রোশনাই। বারকোশের সোনালি রংও তার কাছে চাপা
পড়ে গেছে। হবুচন্দ্রর মনে হল, এ জিনিস আসল প্যাঁচালো মেঠাই
না হয়ে যায় না। গবুচন্দ্র সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি
নিমেষে হামলে পড়লেন তার উপর।
রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে গবুচন্দ্র
ততক্ষণে বুঝে ফেলেছেন, গিন্নির দৌলতে লড়াই প্রায় জেতা হয়ে গেছে। তবু হবুচন্দ্র প্রথমবার তার একটা মুখে দিতেই টোকো পচা ময়দার কথা ভেবে আঁতকে উঠে
চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তারপরেই চোখ মেলে দেখলেন, হুসহাস শব্দে রাজা একের পর একটা মুখে পুরেই চলেছেন।
হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন
গবুচন্দ্র। হবুচন্দ্র খেতে খেতেই বললেন, ‘এমন মুচমুচে গরম-গরম মেঠাইয়ের কথা আগে কেন বলনি
হে? আহা! এই না হলে প্যাঁচালো মেঠাই! আর মিষ্টির সঙ্গে ওই হালকা টক আস্বাদটা একেবারে লা জবাব!’
হাঁপ ছেড়ে গবুচন্দ্র বললেন, ‘প্যাঁচালো মেঠাই নয় হুজুর। গিন্নি ওর নাম দিয়েছে জিলিপি।’
‘তাহলে জিলিপির প্যাঁচ বলো। পেটে পড়তেই দেখছি মাথায় পাঁচ খেলতে
শুরু করেছে। এক কাজ করো,’ আরও এক খাবলা জিলিপি মুখে পুরে
আয়েশে চিবোতে চিবোতে হবুচন্দ্র বললেন, ‘হতভাগা পেঁচোর রাজ্যে মালপত্র তো আমাদের রাজ্যের উপর দিয়েই
যায়। আজই ওদের জানিয়ে দাও, এজন্য দ্বিগুণ ট্যাক্সো দিতে
হবে এবার থেকে। আর তোমার মাইনে ডবল তো হচ্ছেই, সেই সাথে গিন্নির জন্য বিশ ভরির
চন্দ্রহার।’
শারদীয়া ২০১৩ শিশুমেলা
আপলেড: ৮/৭/২০১৫
অসাধারণ
ReplyDelete😅😄😃😍
ReplyDeleteDaruun laglo
ReplyDeleteদারুন
ReplyDeleteমজার
ReplyDelete������������ আপনার জবাব নেই। জিও
ReplyDeleteচমৎকার।
ReplyDeleteদারুন দারুন।
ReplyDelete