Thursday 22 January 2015

সুন্দরবনের গল্প (মোবাইল ভার্শন): গর্জনের দিন




গল্পটি বর্তমানে ব্লগ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আগ্রহী পাঠক গল্পটি পাবেন ‘মায়াকানন’ প্রকাশিত (বইমেলা ২০২০) লেখকের ‘জল জঙ্গল নরখাদক সমগ্র (১ম খণ্ড)’ গ্রন্থে। দাম: ২০০ টাকা (ভারত)।


প্রথম প্রকাশ: ‘কিশোর ভারতী’ মার্চ ২০০

Wednesday 21 January 2015

চেনা মাটি অচেনা মানুষ : সাতসকালে সুতোর খোঁজে (শিশির বিশ্বাস)




চেনা মাটি অচেনা মানুষ (মোবাইল ভার্শন) : বেলপাহাড়ির পথে (শিশির বিশ্বাস)

চেনা মাটি অচেনা মানুষের কথা:
বেলপাহাড়ির পথে
শিশির বিশ্বাস
 পাহাড় ঘেরা বেলপাহাড়ি। শুধু মাত্র পুব দিক ছাড়া যেদিকে তাকাও নজর আটকে যাবে দিগন্তের সীমারেখার কাছে ধুসর রঙের পাহাড়ে। পাহাড় আর জঙ্গল। অবশ্য বেলপাহাড়িতে পাহাড় নেই। উঁচু–নিচু ঢিপি আর বনবিভাগের তৈরি হালকা–পাতলা একটু জঙ্গল। লাল মোরামের রুখো মাটির দেশ।
বেলপাহাড়িতে প্রথম গিয়েছিলাম সেই আটের দশকের মাঝামাঝি। ফরেস্ট বাংলো বুক করে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়া। তবু তাল কেটে গেল গোড়াতেই। ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার পথ। অথচ বিকেলের মধ্যে ঝাড়গ্রাম পৌঁছেও এই পথটুকু পাড়ি দিতে লেগে গিয়েছিল সাত ঘণ্টার উপর। অনিয়মিত বাস তখন এই পথে রোজকার ব্যাপার। সন্ধের পরে বাস যদিবা একটা পাওয়া গেল, ঝাড়গ্রামের চৌহদ্দি পেরোতেই হঠাৎ করুণ আর্তনাদে ব্রেকডাউন। কাছেই এক গ্যারেজ থেকে মিস্ত্রি ডেকে শুরু হল মেরামতির কাজ। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটার ঘর ছুঁতে চলেছে, কখন বাস চালু হবে ঠিক নেই। পথের দুই ধারে শুধু ফাঁকা মাঠ। তারই মাঝে দু’একটা বড় আকারের শাল–মহুলের গাছ। সেখানে গা ছমছম করা আরও জমাট অন্ধকার। এছাড়া নিশুতি রাতের অন্ধকারে চারপাশে শুধু ঝিঁঝির কোরাস। অন্ধকারে সেই পথের মাঝে কপালে যখন চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে, নজরে পড়ল এক কোনে বাসের টিমটিমে আলোয় নানা বয়সের কয়েকটি আদিবাসী কচিকাঁচা মুখ। সবচেয়ে ছোটটির বয়স বছর ছয়েকের বেশি নয়। কাঁধে বই–খাতার ব্যাগ। সেই সকালে বাস ধরে ঝাড়গ্রামের স্কুলে পড়তে এসেছে ওরা। এখনও ঘরে ফেরা হয়নি। বোধহয় খাওয়াও জোটেনি তারপর। কিন্তু কারও মুখে ক্ষোভ–অভিযোগ নেই। দিব্যি নিশ্চিন্তে গল্প জুড়েছে। চলছে সেদিনের ক্লাসের পড়া নিয়ে আলোচনা। সত্যি, ওদের সেই মুখগুলো সেদিন কিছুটা হলেও স্বস্তি যুগিয়েছিল। প্রসঙ্গত এর দু’দিন পরে ফেরার পথের কথাও এই ফাঁকে সামান্য না বলে পারা গেল না। দু’দিন পরে রবিবার দুপুরে বাস ধরে ঝাড়গ্রাম ফিরছি। বিনপুর থেকে বছর চৌদ্দ বয়সের একটি ছেলে উঠল। পাশে এসে দাঁড়তে সরে সামান্য জায়গা করে দিয়েছিলাম। তারপরেই আলাপ। জানাল, বিকেলে ঝাড়গ্রামে ডিসট্রিক্ট টুর্নামেন্টের ফুটবল ম্যাচ। তাই দেখতে চলেছে। বিনপুর থেকে ঝাড়গ্রামের দূরত্ব কম নয়। আসবার দিনের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়তে বললাম, ‘খেলা দেখে কখন বাড়ি ফিরবে?’
ছেলেটি অম্লান বদনে বলল, ‘এদিকে বাসের অবস্থা ভাল নয় সার। রাত দশটা–এগারোটাও হয়ে যেতে পারে। তেমন হলে ঝাড়গ্রাম স্টেশনেও রাত কাটাতে হতে পারে।’
সামান্য ডিসট্রিক্ট টুর্নামেন্টের ম্যাচ। তাই দেখতে এমন ঝুঁকি! অবাক হয়ে সেই কথা বলতে ছেলেটি অম্লান বদনে বলল, ‘এসব ম্যাচ না দেখলে কী করে শিখব সার।’
ছেলেটি যে ফুটবল অন্ত প্রাণ, প্রকাশ পেতে দেরি হয়নি তারপর। খুব ইচ্ছে কলকাতার কোনও ফুটবল ক্লাবে খেলার। ওদের এদিকে ফুটবলারের খোঁজে কলকাতা থেকে কখনও স্পটার আসেন। যদি তাঁদের নজরে পড়া যায়, ছেলেটির চোখে সেই স্বপ্ন।
আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার। সেদিন আমরাও বেলপাহাড়ি পৌঁছেছিলাম রাত প্রায় বারোটা নাগাদ। নিশুতি রাতে বাস থেকে নেমে অন্ধকার নির্জন বনপথ ধরে ফরেস্ট বাংলোর দিকে হাঁটার সময় নাকে আসছিল শুধু ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধ। বেলপাহাড়ির বাতাসে ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধই শুধু নয়, অন্য এক গন্ধও পাওয়া যায় কখনও। ব্যাপারটা জানা গিয়েছিল বৃদ্ধ বনমালি সোরেনের কাছে। ‘আর কদিন পরেই চৈত মাসে বাতাসে অন্য এক গন্ধ দিবে বাবু। সিটো মহুয়া ফুলের সময় বটে।’
বেলপাহাড়িতে মহুয়া গাছের অভাব নেই। চৈত্র মাস পড়লেই তাই গ্রামে গ্রামে সাড়া পড়ে যায়। প্রতিটি গাছের তলা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে রাখা হয়। মহুয়া ফুলের আয়ু মাত্র একটি রাত। সন্ধেয় ফোটা ফুল সকালেই ঝরে যায়। তখন কুড়িয়ে নেবার পালা। মহুয়া ফুলের লোভে কাছে বাঁশপাহাড়ি আর কাঁকড়াঝোরের জঙ্গল থেকে তখন দু’একটা ভালুকও নাকি চলে আসে কখনও। 
মহুয়া, ইউক্যালিপ্টাস ছাড়াও বেলপাহাড়িতে আর রয়েছে সোনাঝুরি। এছাড়া শাল, সেগুন আর পিয়াল। এখানে ওখানে ডাঁই করা কাঠের পাহাড়। ভোর সকালে বাজারে এলেই নজরে পড়বে কাঠ বোঝাই হয়ে সার সার গরুর গাড়ি আসছে পাহাড়ের ওদিকে জঙ্গলের দিকে থেকে। জমা হচ্ছে মহাজনের গুদামে। আর রয়েছে বনমালি সোরেনদের গ্রামগুলো।
বনমালি সোরেনরা কালো মানুষ। অথচ ওদের ঝকঝকে ঘরবাড়িগুলো চোখে পড়ার মতো। নিখুঁতভাবে নিকানো মাটির দেয়াল, উঠোন মায় গোয়ালঘরটি পর্যন্ত। এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বোধ হয় ওদের মজ্জাগত। রবিবার ছুটির দিন। বেলপাহাড়ি আদিবাসী আবাসিক স্কুলের মেয়েদের দেখলাম হাতে ঝাঁটা, ঝুড়ি আর বালতি নিয়ে কাজে নেমে পড়েছে। শুধু স্কুলবাড়িই নয়, পরিষ্কার করে ফেলছে আশপাশের জমা জঞ্জালও। কলকাতা শহরেও হয়তো এমন দৃশ্য দেখা যায় কখনও। নামি কোনও স্কুল বা সংস্থার ছেলেমেয়েরা ঝকঝকে পোষাকে বুকে ব্যাজ আর হাতে পোস্টার, ব্যানার নিয়ে সহর সাফাইয়ে বের হয়। খবর দিয়ে আনা হয় রিপোর্টার আর ক্যামেরা ম্যান। পরের দিন দৈনিক পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয় সেই ছবি। দেখানো হয় টিভির চ্যানেলে। সঙ্গে চটকদার ভাষ্য।
বেলপাহাড়ির গ্রামের পথে হাঁটলেই নজরে পড়বে উঁচু লম্বা গলা আর বেজায় লম্বা পায়ের কিছু অন্য জাতের মুরগি। চরে বেড়াচ্ছে গ্রামের পথে। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলে জানা যাবে লাল মাটির এই অঞ্চলের এক অতি জনপ্রিয় খেলা মোরগের লড়াইয়ের কথা। লম্বা গলা আর পা ওয়ালা এই জাতের মোরগ দারুণ লড়িয়ে। এদের কদর তাই এখানে ঘরে ঘরে। শীত পড়লেই শুরু হয় মোরগের লড়াই। হাটে, বাজারে কিংবা মাঠে–ময়দানে তখন সমানে চলবে এই খেলা। দুটো মোরগের লম্বা পায়ে তীক্ষ্ণ ছুরি বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হবে। চারপাশে হরেক দর্শকের হইহই ভিড়। লড়াইয়ের হাল দেখে ওঠানামা করবে বাজির দর। লড়াই শেষে পরাজিত মোরগটি হবে বিজয়ী মোরগের মালিকের সম্পত্তি। এছাড়া মোট বাজির টাকার কিছু অংশ। এছাড়া বাজিতে যাদের জিত হল তাদের সহর্ষ জয়গান আর সাধুবাদ বাড়তি প্রাপ্য। আর যে মোরগের হার হল, তার মালিক লজ্জায় মুখ লুকোবেন। বাজিতে যাদের হার হয়েছে, তাদের টিটকিরি আর কটু কথা তো আছেই।
ঝাড়গ্রামের অদূরে কুসুমডাঙার মেলা এই মোরগের লড়াইয়ের জন্য বিখ্যাত। মেলার পাঁচদিন সমানে চলে মোরগের লড়াই। দূর থেকে আদিবাসী মানুষেরা তাদের সেরা মোরগ নিয়ে আসে। মোরগের লড়াই এই অঞ্চলে প্রায় জাতীয় উৎসবের মতো।
বেলপাহাড়ির কেন্দ্রবিন্দু সড়কের পাশে ছোট এক বাজার। দু’ধারে মাটির ঘর। তারই মাঝে গোটা কয়েক পাকা বাড়ি। ষ্টেশনারী, মুদি আর কাঁচা আনাজের দোকান। জলখাবারের দোকানে ভোর সকালেই ব্যস্ততা। কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় গরম তেলেভাজা আর মুড়ি। সকালের জলযোগ। ভিতরে ঢুকলে তীব্র ঝাঁঝালো আর মিষ্টি অন্য এক গন্ধও নাকে আসবে। মহুয়ার দেশি মদের খদ্দের জুটে গেছে এই ভোর সকালেই। হাতে হাতে কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় সেই পানীয়। পেটে কয়েক ঢোঁক চালান দিয়ে শুরু হবে দিনের কাজ। শেষ বিকেলে ঘরে ফেরার পথে ফের আর এক প্রস্থ।
বাজারের পিছনে পুরনো দিনের নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। নীল ভেজাবার জন্য তিন ধাপে ছয় সারিতে আঠারোটা ভাঙাচোরা চৌবাচ্চা সেই পুরনো দিনের সাক্ষ্য বহন করে টিকে আছে এখনও। বৃদ্ধ বনমালি সোরেনের কথায়, ‘ইখানে ত বাবু এক সময় জঙ্গল ছিল। ইয়ার পর সাহেবরা জঙ্গল সাফ করল। ক্ষেতি বানাইল। কুঠি হইল। শুরু হইল নীল চাষ। মোদের কপালটাও পুড়ল।’
সাহেবরা এখন আর নেই। নীলচাষও হয় না। তবে তাতে বনমালি সোরেনদের কপাল ফেরেনি। সাহেবরা বিদায় নিলেও ওদের সেই সবুজ অরণ্য আর ফিরে আসেনি। রয়ে গেছে সেই খেত। লালমাটির রুক্ষ এক ফসলি জমি। ওই বর্ষার সময় সামান্য ধান ছাড়া সেই মাটি বনমালিদের আর কিছু দিতে পারে না। বেলপাহাড়ির চারপাশে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে সবুজের কোনও চিহ্ন আমার নজরে পড়েনি। সবে ফাল্গুন মাস। গোটা কয়েক পুকুরে শেষ তলানি লালচে খানিকটা জল টিকে আছে কোনওমতে। কদিন পরে এটুকুও থাকবে না।
বাজারে আনাজ বলতে শুকনো বাঁধাকপি, বেগুন, চালানি আলু আর মার্বেল সাইজের আধপাকা টম্যাটো। সকালের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বৃদ্ধ বনমালি সোরেন বাজারের এক কোণে বাঁধাকপি পাতার গোটা কয়েক ছোট আঁটি সাজিয়ে বসে আছে। ঘন সবুজ রঙের বাতিল পাতা। কলকাতার বাজারে ছুঁড়ে ফেলা হয় ডাস্টবিনে।
‘এগুলো বিক্রি হয় এদিকে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতে আরও অবাক হয়ে বৃদ্ধ মানুষটি বলল, ‘কেনে গো বাবু! খুব মিঠা ত!’

আমার সামনেই গোটা কয়েক আঁটি বিক্রি হয়ে গেল। নাহ্‌, নিজের দেশটার প্রায় কিছুই জেনে উঠতে পারিনি এখনও।

চেনা মাটি অচেনা মানুষ : বীজ (শিশির বিশ্বাস)


Tuesday 20 January 2015

কিশোর ঐতিহাসিক উপন্যাস (For Mobilt & PC) : হঠাত্ এল হার্মাদ (শিশির বিশ্বাস)

গল্পটি বর্তমানে ব্লগ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আগ্রহী পাঠক গল্পটি পাবেন ‘জয়ঢাক প্রকাশন’ প্রকাশিত লেখকের ‘হঠাৎ এল হার্মাদ’ গ্রন্থে। 


Wednesday 7 January 2015

ফেসবুক থেকে নিবন্ধ (মোবাইল ভার্শন): খাম্বা বাবা (শিশির বিশ্বাস)

ফেসবুক থেকে: নিবন্ধ (মোবাইল ভার্শন)
খাম্বাবাবা
শিশির বিশ্বাস
হেলিওডোরস স্তম্ভ
ল্পটা পুরোনো মধ্যপ্রদেশের বিদিশা জেলায় ছোট এক জনপদ বেশনগর বিশেষজ্ঞদের অনুমান এখানেই ছিল সুপ্রাচীন বিদিশা নগরী স্থানটি বিশ্ববিখ্যাত সাঁচি স্তূপ থেকে মাত্রই পাঁচ মাইল দূরে পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বেশ নদী অদূরেই এক আশ্রম কয়েকজন সাধুর বাস আশ্রমের চত্বরে গাড় সিঁদুর লেপা একটি একশিলা স্তম্ভ লম্বায় সাড়ে ছয় মিটারের মতো স্থানীয় মানুষের কাছে স্তম্ভটি অতি জাগ্রত দেবতা খাম্বা বাবা প্রতিদিন পুজো হয় আর জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় খাম্বা বাবার উৎসবের মাসে পূণ্যার্থী আসে দূরদূরান্ত থেকে সৌভাগ্য এবং পুত্র লাভের আশায় বলি পড়ে স্তম্ভের গায়ে তেলসিঁদুর চড়ানো হয় বিশ্বাস খাম্বা অর্থাৎ স্তম্ভ রূপধারী বাবা স্বয়ং মহাদেব তাঁর কৃপায় কোনও আশাই অপূর্ণ থাকে না
প্রবাদ বহুকাল আগে হীরাপুরী নামে এক সাধু এখানে বাস করতেন হঠাৎই একদিন তাঁর আশ্রমে অতিথি হয়ে এলেন জটাজুটধারী এক যোগীপুরুষ হীরাপুরী সেই যোগীপুরুষকে দেখেই চিনতে পারলেন। আগন্তুক আর কেউ নয় স্বয়ং মহাদেব তিনি সেই যোগীপুরুষকে তাঁর আশ্রমেই অবস্থান করতে অনুরোধ করলেন হীরাপুরীর সেবায় যোগীপুরুষ তুষ্ট হয়েছিলেন তিনি তাঁকে নিরাশ করলেন না খাম্বার রূপ ধরে আশ্রম প্রাঙ্গণে রয়ে গেলেন খাম্বা বাবার মাহাত্ম্য চারপাশে ছড়িয়ে পড়েতে এরপর আর দেরি হয়নি
চলছিল এই ভাবেই ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে স্তম্ভটি নজরে আসে আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম সাহেবের কোম্পানির শাসন অবসানের পরে তিনি তখন এদেশে আর্কিওলজিক্যাল দপ্তরের ডিরেক্টর জেনারেল হয়ে এসেছেন উৎসাহী মানুষটি প্রাচীন ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের খোঁজে চষে ফেলছেন সারা দেশ আশ্রমের চত্বরে যখন তিনি স্তম্ভটি দেখেন সর্বত্র তেলসিঁদুরের গাঢ় প্রলেপ অনেক কিছুই ঢাকা পড়ে গেছে তবু জহুরির চোখে জহরত চিনতে ভুল হয়নি স্তম্ভটি দেখার পরে তিনি তাঁর রিপোর্টে লিখছেন 'perhaps the most curious and novel discoveries that I have ever made'একশিলা স্তম্ভটির গঠনশৈলী পর্যালোচনা করে তিনি এটিকে গুপ্তযুগের বলে সনাক্ত করেছিলেন সুপ্রাচীন স্তম্ভের গায়ে কিছু লিপি থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে কিন্তু তেলসিঁদুরের পুরু আস্তরণ থাকায় ক্যানিংহাম সাহেব তেমন কিছু খুঁজে পাননি আশ্রমের অনুমতি না মেলায় রং তুলে ফেলাও সম্ভব হয়নি
হেলিওডোরাস স্তম্ভের নিম্নভাগে ব্রাহ্মী লিপি
অগত্যা অপেক্ষা করতে হল আরও তিরিশটি বছর ১৯০৯ সালে গোয়ালিয়র রাজ্যের সুপারিন্টেডিং ইঞ্জিনিয়ার মি. লেকের নির্দেশে স্তম্ভের গোড়ার দিকে কিছু অংশের সিঁদুর তুলে ফেলা হতে প্রথম লিপির সন্ধান পাওয়া গেল কিন্তু সবটা নয় লিপির অনেকটাই তখনো ইটপাথরে গাঁথা স্তম্ভের বেদীর তলায় রয়ে গেছে এর বেশি তখন আর এগোনো সম্ভব হয়নি বলা যায় প্রকৃত অনুসন্ধান শুরু হয় এর পাঁচ বছর পরে প্রত্নতাত্ত্বিক ড. ভাণ্ডারকারের তত্ত্বাবধানে পুরো দশ দিন লেগেছিল স্তম্ভের রং  পরিষ্কার করতে পুরোনো ভিত্তিপ্রস্তর ভেঙে ফেলে নতুন করে বসান হল স্তম্ভটিকে খ্রিপূ সময়ের ব্রাহ্মী হরফে লিখিত লিপিগুলি উদ্ধার হতে জানা গেল গুপ্তযুগ নয় স্তম্ভটি আরও কয়েকশো বছরের পুরোনো খ্রিপূ ১ম শতকের শুঙ্গ বংশীয় রাজা কাশীপুত্র ভগভদ্রর বিদিশার রাজসভায় তক্ষশীলার ইন্দো-গ্রীক রাজা অ্যান্টিয়ালকিডাসের দূত ছিলেন হেলিওডোরস গ্রীক রাজদূত হেলিওডোরস বিদিশায় বাসুদেব মন্দির প্রাঙ্গণে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে এক গড়ুর স্তম্ভ স্থাপনা করেছিলেন খাম্বা বাবা সেই স্তম্ভ স্তম্ভলিপিতে হেলিওডোরস তাঁর আরাধ্য বাসুদেবকে দেবাদিদেব বলে স্তুতি করেছেন
কৌতূহলী পাঠকের জন্য প্রথম সাতটি লাইন বিবৃত করা যেতে পারে:
১) দেবদেবস বাসুদেবস গরুড়ধ্বজ অয়ং।
২) কারিতে ইয় হেলিওদোরেণ ভাগ।
৩) বতেন দিয়স পুত্রেণ তখসিলাকেন।
৪) যোন দূতেন আগতেন মহারাজাস।
৫) অন্তলিকিতস উপতা সকারু রজো।
৬) কাসী পুত্র ভাগভদ্রস ত্রাতারস।
৭) বসেন চতু দশেন রাজেন বধমানস।
অর্থাৎ দেবাদিদেব বাসুদেবের এই গড়ুরধ্বজা তক্ষশিলা নিবাসী ডিয়ন পুত্র ভাগবত অনুরাগী হেলিওডোরাস কর্তৃক স্থাপিত যিনি গ্রিক রাজা অ্যান্টিয়ালকিডাসের রাজদূত রূপে কাশীপুত্র ভগভদ্রের রাজত্বকালের চর্তুদশ বছরে তাঁর বিদিশার রাজ দরবারে আগমন করেন
মূল রহস্যের সমাধান হলেও প্রশ্ন রয়ে গেল বাসুদেবের সেই মন্দির নিয়ে কোথায় গেল সেটি? তবে কী স্তম্ভটি অন্য কোনও স্থান থেকে আনা হয়েছিল স্থানটি পর্যবেক্ষণের পরে অনুমান করা গিয়েছিল বর্তমান আশ্রমটি হয়তো সেই মন্দিরের স্থানেই নির্মিত ১৯৬৩৬৫ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক এম.ডি খারে সেই আশ্রম-বাড়িটি ভেঙে সরিয়ে দিয়ে খনন কাজ শুরু করতেই বের হয়ে পড়ল খ্রিপূ ৩য় শতকে নির্মিত উপবৃত্তাকার বিশাল এক মন্দিরের ভিত এযাবত কাল জ্ঞাত এইটিই ভগবান বাসুদেবের প্রাচীনতম মন্দির         
                                       

তক্ষশীলার গ্রিক রাজা অ্যান্টিয়ালকিডাসের রৌপ্যমুদ্রা

মন্দিরের গর্ভগৃহের ক্ষেত্রফল ছিল ৮.১৩ বর্গ মিটার প্রদক্ষিণ পথ আড়াই মিটার চওড়া এছাড়া বড় আকারের সভামণ্ডপ তথা দর্শন গৃহ  পাওয়া গেছে সভামণ্ডপের এক কাঠের দরজার অস্তিত্ব শুধু বর্তমান স্তম্ভটি নয় মন্দিরের পুব দিকে উত্তরদক্ষিণ বরাবর আরও সাতটি স্তম্ভ ছিল হেলিওডোরাস স্তম্ভটি অষ্টম বিভিন্ন সময়ে ভক্তবৃন্দ মঙ্গল কামনায় এগুলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু বর্তমান স্তম্ভটি ছাড়া আর কোনটিরই সন্ধান মেলেনি
অনুমান করা যায় বাসুদেবের মন্দিরের প্রাঙ্গণে হেলিওডোরসের স্তম্ভ সহ যে আটটি স্তম্ভ ছিল কালের প্রভাব এবং পরবর্তীকালে কালাপাহাড়ি তাণ্ডবে মন্দিরের সঙ্গে সেগুলিও ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল বর্তমান হেলিওডোরস স্তম্ভটিও অর্ধ ভগ্ন স্তম্ভ শীর্ষের গড়ুর মূর্তিটি বিনষ্ট হয়ে গেছে সন্দেহ নেই ভগ্ন মন্দির প্রাঙ্গনে ভগ্ন অর্ধভগ্ন স্তম্ভগুলি হেলায় পড়ে ছিল পাথরগুলি যে যার মতো তুলে নিয়ে কাজে লাগিয়েছে এইভাবেই এই সেদিন ১৭৯৪ সালে কাশীর রাজা চৈত সিংয়ের দেওয়ান জগত সিং সম্রাট অশোক নির্মিত সারনাথের বিখ্যাত ধর্মরাজিকা স্তূপ থেকে ইটপাথর নিয়ে নিজের কাজে লাগিয়েছিলেন বিখ্যাত স্তূপটি ওই সময় পর্যন্ত মোটামুটি ভাল অবস্থাতেই ছিল আজ এই স্তূপের ভিত্তিটুকু ছাড়া আর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই
যাই হোক সম্ভবত ওই সময় আশ্রমের সাধু হীরাপুরী অনাদরে পড়ে থাকা একটি স্তম্ভকে শিবজ্ঞানে ফের স্থাপনা করে পূজা শুরু করায় রক্ষা পেয়ে গেছে হেলিওডোরাস স্তম্ভটি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের অন্তত একটি ছেঁড়া পাতা উদ্ধার করা গেছে অঞ্চলটিতে ব্যাপক অনুসন্ধান হলে ভগ্ন দুএকটি স্তম্ভও হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব কিন্তু তা আর হয়নি এ দেশের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের আরও কয়েকটি পাতা চাপা পড়ে রয়েছে ওই অঞ্চলের মাটির তলায় হয়তো কোনও দিন উদ্ধার করা যাবে
স্থানটির কিছু পূর্ব দিকে খ্রিপূ ৩য় শতকে নির্মিত একটি বৌদ্ধ স্তূপের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে স্তূপটি সাঁচি স্তূপের পূর্ববর্তী
প্রসঙ্গত আর একটি কথা বলতেই হয় হেলিওডোরসের এই গড়ুর স্তম্ভটির কল্যাণে বাংলা সাহিত্যে সংযোজিত হয়েছে একটি অনন্যসাধারণ ঐতিহাসিক গল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্তম্ভটিকে নিয়েই লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত স্বপ্ন-বাসুদেবগল্পটি বিষয়টি তাঁকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত গল্পটি তিনি বার কয়েক ফিরে লিখেছিলেন প্রায় দুই হাজার বছর আগে সেদিনের বিদিশা নগরী তথা আজকের বেশনগরের এক চমৎকার ছবি আঁকা আছে এই গল্পে

আলোকচিত্র: বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সৌজন্যে।
১৬/১২/২০১৫

Tuesday 6 January 2015

নিবন্ধ (For Mobile & PC): মায়াপুর ও বল্লালঢিপি (শিশির বিশ্বাস)


















হাসির গল্প (মোবাইল ভাঃ): মাকুমামার হস্তী কাণ্ড (শিশির বিশ্বাস)


মাকুমামার হস্তী কাণ্ড
শিশির বিশ্বাস
সেবার বড়দিনের ছুটিতে কদিন চিড়িয়াখানা, বটানিক্যাল গার্ডেন, ইডেনে টেস্ট ম্যাচ দেখেও সময় যখন কাটতে চাইছে না, সেই সময় মাকুমামার আবির্ভাব এসেই কোনও ভনিতা না করে বললেন, ‘চল রে ফুচে, দিন কয়েক বেড়িয়ে আসি
বেড়াতে আমার আপত্তি আছে, এমন বদনাম শত্রুও দিতে পারবে না কিন্তু সেবার নেতারহাটের সেই ভয়ানক কাণ্ডের পর মাকুমামার সঙ্গে ফের বেড়াতে যাওয়া ঠিক হবে কিনা ভেবে মুখে জবাব এল না সেটা আঁচ করে উনি বললেন, ‘খেপেছিস, ফের আর জঙ্গলে যাই! এবার আরকুইন অফ ছোটনাগপুরনয় রে একেবারেকুইন অফ হিল স্টেশনমানে দার্জিলিং
শুনে আমার চোখ প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়, ‘বলো কী মামা! এই ঠাণ্ডায় দার্জিলিং বেড়াতে যাব!’
উত্তরে মাকুমামা মুখটুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘ছা-ছ্যা, তোর মতো ইয়াং ছেলের মুখ দিয়ে শেষে এই কথা বেরোল র‍্যাঁ ! তোরাই না দেশের ভবিষ্যৎ! কোথায় আমাকে আরও ইন্সপায়ার্ড করবি! শোন ফুচে, একটা জবর চান্স বাগিয়ে ফেলেছি অফিস থেকে জরুরি কাজে দার্জিলিঙে একজন রিপ্রেজেনটেটিভ পাঠাবার কথা হচ্ছিল ব্যাপারটা কানে আসতেই ম্যানেজারকে ধরে ম্যানেজ করে ফেলেছি এমন সুযোগ কি আর হরদম আসে র‍্যাঁ ? দিন সাতেকের ট্যুর থ্রি-স্টার হোটেলের খরচ, মায় ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস ফেয়ার, সব কোম্পানির পয়সায় মানেএ টু জেডফ্রি এখন রাজি থাকিস তো বল ঠাণ্ডা তো একটু হবেই তা সেই মতো ব্যবস্থা নিলেই হল কি বলিস?’
এরপর রাজি না হয়ে উপায় কি? তাই রওনা হয়ে পড়েছিলাম নির্দিষ্ট দিনেই কিন্তু দার্জিলিং পৌঁছে মালুম পাওয়া গেল শীত কাকে বলে! প্রায় দুপুর কিন্তু রোদ্দুরের যা অবস্থা কলকাতার পৌষ মাসের সকালকেও হার মানায় রাস্তাঘাট প্রায় জনমানব শূন্য দুচারজন যা দেখা যায় তাদের সবাই স্থানীয় মানুষ টুরিস্টের টিকির দেখাও পাওয়া গেল না ফাঁকা রাস্তার মোড়ে স্থানীয় ছেলেরা একগোছা রবারের গার্ডার নিয়ে পায়ে ভলির কসরত দেখাচ্ছে একটানা কে কতক্ষণ করতে পারে সেই কম্পিটিশন খেলা আর শরীর গরম দুটোই চলছে একসাথে ঢালু পাহাড়ি পথ বলের বদলে তাই গার্ডারের গোছার ব্যবস্থা যাই হোক, মালপত্র নিয়ে চটপট হোটেলে ঢুকে পড়লাম আমরা
মাকুমামা বাড়িয়ে বলেননি হোটেলের যা ব্যবস্থা তা এক কথায় রাজসিক বেল টিপলেই বেয়ারা ঘুম থেকে উঠতেই বেড-টি, গরম জল এছাড়া দুবেলা মুরগির ঠ্যাং তো রয়েছেই কিন্তু শীতের কামড়ে দুদিনেই সব পানসে হয়ে গেল গায়ে ডবল পুলওভার, বাঁদুরে টুপি, দস্তানা, মায় হাঁটু পর্যন্ত পশমের মোজা টেনে দিয়েও শরীরের ভিতরে হাড় পর্যন্ত জমে আসতে চায় বিকেল পড়ে এলেই খাঁখাঁ রাস্তা পথের পাশে তখন শুরু হয়ে যায় স্থানীয়দের আগুন পোয়াবার তোড়জোড় সন্ধের পরেই দোকানপাটের ঝাঁপ পড়তে শুরু করে
যাই হোক, এর মধ্যেই একে-একে দার্জিলিঙের বিখ্যাত বটানিক্যাল গার্ডেন, মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, টি-গার্ডেন আর টাইগার হিল থেকে সানরাইজ দেখে ফেললাম বলা বাহুল্য, সব কিছুই এক রকম বুড়ি ছোঁওয়া গোছের করে এ ছাড়া উপায় কী? বাইরে বের হলেই যে মন চলে যায় হোটেলের দিকে কতক্ষণে ফের ঘরে ঢুকে ফায়ার প্লেটে হাত-পা সেঁকতে বসব অগত্যা সারাদিন হোটেলের ঘরে বসে জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়ো নয়তো বাইরের দৃশ্য দেখে কাটিয়ে দিই
মাকুমামার অবশ্য রেহাই নেই ওর মধ্যেই আবার অফিসের কাজগুলোও সেরে ফেলতে হচ্ছে ঘরে বসে যে একটু আরাম করবেন সে সময় নেই? সুতরাং, দিন তিনেকের মধ্যেই প্রায় ফিউজ হবার জোগাড় এর মধ্যে যেদিন টাইগার হিলএ গেলাম সেদিন আবার আধ ইঞ্চির মতো বরফ পড়েছে সেখানে রাস্তাঘাট, মায় চারপাশের গাছপালা পর্যন্ত ধপধপে সাদা কাচের ঘরে বসে কাপ দশেক করে গরম কফি খেয়েও সানরাইজ দেখব কী, শীতের কাঁপুনিতে চোখে সর্ষে ফুল! আর মাকুমামাতো প্রায় ভ্যানিস হবার অবস্থা ঠকঠক করে কাঁপতে-কাঁপতে হোটেলে ফিরে ফায়ার প্লেটে হাত-পা সেঁকতে গিয়ে হঠাৎ হাউমাউ করে উঠলেন, ‘ফুচে রে, আমার হাত-পায়ের আঙুলগুলো নির্ঘাত কেটে বাদ দিতে হবে এবার কেমন সিটকে গেছে দ্যাখ! একটুও সাড় নেই
ততক্ষণে হাতের দস্তানা খুলে ফেলেছেন তিনি তাকিয়ে দেখি তাঁর দুহাতের আঙুল ঠাণ্ডায় জমে মাকড়সার ঠ্যাংয়ের মতো কুঁকড়ে রয়েছে অনেক মেহনতে ম্যাসেজ-ট্যাসেজ করে শেষে সাড় ফেরানো হল মাকুমামা অবশ্য বিশেষ আশ্বস্ত হলেন না ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাত পায়ের আঙুল খানিক নাড়িয়ে বললেন, ‘ফুচে গতিক সুবিধার মনে হচ্ছে না কলকাতা ফিরে স্পেশালিষ্ট না দেখালে ভরসা নেই তুই চটপট মালপত্তরগুলো গুছিয়ে ফেল দেখি আমি অফিসের কাজ বাকি যা রয়েছে আজই সেরে দিয়ে আসছি ওফ্‌! ম্যানেজার সাহেবের কথায় নেচে খুব আক্কেল হল এবার
মাকুমামা অফিসের কাজে বের হয়েছিলেন গজগজ করতে-করতে সন্ধের মুখে ফিরে এলেন একেবারে নাচতে-নাচতে হইহই করে বললেন, ‘ফুচেরে, মেরে দিয়েছি হুঁ-হুঁ বাবা আমিও হলুম তোর মাকুমামা পাটনা অফিসের ম্যনেজার এবার ভোগা দিলেও সেটা আজ সুদে আসলে উশুল করে ফেলেছি
মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম মাকুমামা দম নিয়ে বললেন, ‘সে এক কাণ্ড বুঝলি আজ অফিসে এক লালমুখো সাহেবের সঙ্গে আলাপ নাম রবার্ট লক আমাদের অস্ট্রেলিয়ার এক অফিসের ম্যানেজার সস্ত্রীক ভারত ভ্রমণে বের হয়েছেন দিন দুই হল দার্জিলিং বেড়াতে এসেছেন আজ আমাদের অফিসে এসেছিলেন খোঁজ-খবর নিতে তা অফিসের জরুরি কাজে এই শীতের মধ্যেও দার্জিলিং এসেছি শুনে ভদ্রলোক তো দারুণ খুশি পিঠ চাপড়ে বললেন, তোমাদের মতো লোকেরাই আমাদের কোম্পানির অ্যাসেট মিঃ বোস
তো চান্স পেয়ে আমিও লম্বাচওড়া এক লেকচার ঝেড়ে দিলুম শুনে সাহেব তো যাকে বলে একদম ফ্লাট তক্ষুনি ওদের সঙ্গে জলদাপাড়া যাবার অফার দিয়ে ফেললেন আমিও তো এই রকমই একটা চাইছিলুম লুফে নিয়েছি তৎক্ষণাৎ
এই পর্যন্ত বলে মাকুমামা থামলেন একটু তারপর আমার চাঁদিতে টোকা মেরে বললেন, ‘অতএব আগামী কাল আর কলকাতায় ফিরছি না পরিবর্তে সাহেবের সাথে ড্যাং-ড্যাং করে জলদাপাড়ায় দারুণ জায়গা নাকি ওয়ার্ল্ড ফেমাসমাকুমামা থামলেন আমার বুঝতে বাকি রইল না যে, জলদাপাড়া সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই ওনার তাহলে নাচতেন না এভাবে কিন্তু তখনই আর ভাঙলাম না কিছু এই ভয়ানক শীতের ভিতর দার্জিলিং এসে জুত হয়নি মোটেই এবার ফেরবার পথে যদি জলদাপাড়াটা ঘুরে যাওয়া যায় তবে সেটাই লাভ সুতরাং চেপেই গেলাম
পরদিন শিলিগুড়ি পৌঁছে মাদারিহাটের বাস ধরা হল অতি অমায়িক মানুষ লক দম্পতি ভ্রমণের নেশা প্রায় সারা পৃথিবী চষে ফেলেছেন বাসে বসে সেই সব টুকরো গল্পে মাতিয়ে দিলেন এর আগেও ওরা একবার ভারতে ঘুরে গেছেন সেই সময় নর্থ বেঙ্গলেও এসেছিলেন এদিকের অনেক কিছুই ওঁদের পরিচিত
যাই হোক, দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মাদারিহাট ধুলোয় ভরা রাস্তা ধরে খানিক এগিয়ে লেভেল ক্রসিং পার হলেই ফরেস্ট অফিস রেল স্টেশনের ঠিক পিছনে গেটের পাশেই বড় একটা সাইনবোর্ড সেদিকে চোখ পড়তেই থমকে গেলেন মাকুমামা লক দম্পতি ততক্ষণে এগিয়ে গেছেন মাকুমামা চারপাশে তাকালেন একবার, ‘হ্যাঁ রে ফুচে, হঠাৎ আবার ফরেস্ট অফিস কেন রে? তারপর ফোঁস-ফোঁস করে বার কয়েক নিঃশ্বাস টেনে বললেন, ‘কাছাকাছি জঙ্গল-টঙ্গল আছে নাকি? কেমন গন্ধ পাচ্ছি যেন! ব্যাপার কী বল দেখি?’
আর চেপে রাখার উপায় নেই আমি আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললাম, ‘সেকী মামা! তুমি জলদাপাড়া বেড়াতে এসে জিজ্ঞাসা করছ, কাছে জঙ্গল-টঙ্গল আছে কিনা? জলদাপাড়া তো একটা জঙ্গলেরই নাম বিরল একশৃঙ্গ গণ্ডারের বাসভূমি তাই দেখতেই তো সবাই আসে এখানে
শুনে মাকুমামার তো প্রায় খাবি খাওয়ার জোগাড় আলুভাজার মতো মুখ করে বললেন, ‘এসব আগে বলিসনি তো! কী হবে এবার বল দেখি?’
কিচ্ছুটি হবে না মামাসান্ত্বনা দিলাম আমি, ‘এ তোমার সেই পালামৌ জঙ্গল নয় গণ্ডার নিতান্তই নিরীহ প্রাণী
শুনে প্রায় ফুঁসে উঠলেন উনি, ‘তুই আমায় গাড়ল পেয়েছিস যে, যা খুশি বোঝাবি? আমি হলফ করে বলতে পারি, এ জঙ্গলে শুধু গণ্ডার নয়, বাঘ, ভালুক, বুনো হাতি, সব রয়েছে ফুচেরে, আমি চললুম তুই সাহেবকে যা হোক কিছু বুঝিয়ে বলিস' বলেই হনহন করে উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করলেন
আমি ছুটে ঠেকাতে যাচ্ছি, পিছন থেকে লক সাহেবের গলা শোনা গেল অগত্যা থামতেই হল তাঁকে তাকিয়ে দেখি সাহেব ইতিমধ্যে ফরেস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে আসছেন ভদ্রলোকের লাল মুখটা আরও লাল হয়ে উঠেছে থমথমে ইতিমধ্যে এদিকে যে অনেক কিছু ঘটে গেছে সেসব লক্ষ্যই করলেন না তিনি কাছে এসে বললেন, ‘সরি মিঃ বোস তোমাদের হলং নিয়ে যেতে পারলাম না
ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছি হাঁ করে সেটা অনুমান করে সাহেব বললেন, ‘হলং-এ একটা টুরিস্ট লজ রয়েছে মাদারিহাট থেকে মাইল পাঁচেক দূরে একদম ডিপ ফরেস্টের ভিতর গণ্ডার দেখার ব্যবস্থা করা হয় সেখান থেকেই লজের বারান্দায় বসেও বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে কিন্তু ফরেস্ট অফিস থেকে জানাল, হলং-এ এই মুহূর্তে ঘর একটিও খালি নেই আমারই ভুল হয়েছে দার্জিলিং থেকেই যোগাযোগ করে আসা উচিত ছিল
শুনে মুহূর্তে চাঙ্গা হয়ে উঠলেন মাকুমামা একগাল হেসে বললেন, ‘না-না তাতে কী হয়েছে সার ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই তো তাহলে চলুন ফিরে যাই এবারবলেই মালপত্র তুলে তাড়া লাগালেন, ‘ফুচে, শিগগির পা চালিয়ে চল বাবা বিকেলের বাস চলে গেলে সাহেবদের অসুবিধা হবে বেজায়
দেখে সাহেব তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আরে না-না, তাই বলে নিরাশ হবার কিছু নেই মিঃ বোস অন্য আর একটা ব্যবস্থাও আছে এখান থেকে হাসিমার খুব দূরে নয় সেখানে বরদাবাড়িতে আর একটা টুরিস্ট লজ রয়েছে জঙ্গলে গণ্ডার দেখানো হয় সেখান থেকেও সেই ব্যবস্থাই করেছি
প্রায় নিমপাতা গেলার মতো মুখ করে মাকুমামা এরপর একটু ঘাড় নাড়লেন শুধু
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বরদাবাড়ি পৌঁছে গেলাম সবাই নিরিবিলি হলেও জায়গাটা বেশ জমজমাট ঝকঝকে রাস্তা মিলিটারি কোয়ার্টার কাছেই নাকি এয়ার ফোর্সের ক্যাম্প, রানওয়ে রয়েছে কাঁটাতার ঘেরা মস্ত কম্পাউন্ডের ভিতর টুরিস্ট লজে প্রায় রাজসিক ব্যবস্থা মালপত্র নামিয়ে স্নান সেরে আসতেই দেখি টিফিন রেডি বেয়ারা ট্রেতে গরম কফি আর স্যান্ডউইচ দিয়ে গেল
সব দেখে মাকুমামা ধড়ে ততক্ষণে কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছেন স্যান্ডউইচের সদ্ব্যবহার করতে-করতে বললেন, ‘এখানে জঙ্গল কোথায় রে ফুচে? চারদিকে তো শুধু মিলিটারি কোয়ার্টার, আর গুলি-গোলার আওয়াজ এসব কী আর জঙ্গলের ভিতর হয় রে?’
এখানে জঙ্গলটা যে কোনদিকে, এই অল্প সময়ে আমিও বুঝে উঠতে পারিনি বললাম, ‘লজের চারপাশটা যেমন জমজমাট তাতে আর যাই হোক, জায়গাটা জঙ্গলের মধ্যে নয় বলেই মনে হচ্ছে
তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক ফুচে খুশিতে প্রায় ডগমগ হয়ে উঠলেন মাকুমামা কে বলে ভগবান নেই? তখন অত করে ডাকলুম বলেই না ব্যবস্থাটা এমন পালটে গেল! জঙ্গলের বদলে একেবারে মিলিটারি চৌহদ্দির ভিতর! ওফ্‌! সাহেব স্রেফ জানটা খেয়ে নেবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল রে! খুব বেঁচে গেছি! বুঝলি ফুচে, চানের আগে এক ফাঁকে ওধারে কিচেনে উঁকি মেরেছিলাম বুনো মুরগির রোস্টের ব্যবস্থা হচ্ছে দেখে এলাম এসব জিনিসের টেস্টই আলাদা রে!’
মাকুমামাকে এতখানি উৎসাহিত হতে দেখে অবাক হলাম কারণ আগামীকাল ভোরেই হাতির পিঠে জঙ্গলে বের হবার কথা বুনো মুরগির গন্ধে মামা সেসব ভুলে গেলেন নাকি! সেটা ব্যক্ত করতেই একটু উঁচু দরের হাসি হাসলেন তিনিখেপেছিস? শোন ফুচে, আগামীকাল ভোরে আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে একদম তরাই-জঙ্গলের আসল ম্যালেরিয়া বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই জঙ্গলে যেতে চাস তো তোরা যা যে কদিন আছি এই মিলিটারি চৌহদ্দি ছেড়ে আর বের হচ্ছি না
দুর্ভাগ্য মাকুমামার এত উৎসাহ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না খানিক বাদে লজের ইনচার্জ বারীণবাবু এলেন আমাদের খোঁজখবর নিতে আলাপী মানুষ জমিয়ে গল্প শুরু করে দিলেন লক সাহেব জঙ্গলের নানা খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন সে গল্প শুরু হতেই মাকুমামার উৎকণ্ঠা বাড়ছিল এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জঙ্গল এখান থেকে কত দূরে সার?
বারীণবাবু বললেন, ‘দূরে মানে? আপনারা তো জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছেন
অ্যাঁ!’ মাকুমামার মুখটা খানিক হাঁ হয়ে গেল শুধু
আজ্ঞে হ্যাঁ সারঅল্প হেসে বারীণবাবু বললেন, ‘হাসিমারার বেশিরভাগটাই তো জঙ্গলের ভিতর আমাদের এই লজের পুব আর উত্তরে ওই যে কাঁটাতারের বেড়া দেখছেন, ওটা পার হলেই শুরু হয়ে গেল জঙ্গল
জানলা দিয়ে মাত্র হাত বিশেক দূরে কাঁটাতারের বেড়াটার দিকে তাকিয়ে মাকুমামার গলা দিয়ে তখন কথা সরছিল না কোনও মতে শুধু বললেন, ‘-ওটা জঙ্গল!’
আসল ব্যাপারটা যে কী সেটা ধরতেই পারলেন না বারীণবাবু বরং উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘চলুন বিকেলে ওদিকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি মিনিট তিনেক হাঁটলেই একটা নালা পড়বে সেটা পার হলেই শুরু হবে আসল জঙ্গল তারপর আর একটু এগোলেই তোরসা নদী আগামীকাল গণ্ডার দেখতে ওই তোরসা পার হয়ে যেতে হবে আপনাদের তবে ওই তোরসার দু'ধারে কাশবনেই রয়েছে বাঘের আস্তানা দিন কয়েক আগেই তো একটা বাঘ কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে ঘোরাফেরা করে গেছে তবে এখানে বাঘ তেমন বিপজ্জনক নয় সে হল বুনো হাতির পাল তারপর কোনও দাঁতাল যদি রোগ হয়ে যায়, তবে তো কথাই নেই এই তো মাত্র দিন কয়েক আগে একপাল বুনো হাতি খোদ এয়ার ফোর্সের রানওয়েতে আস্তানা নিয়েছিল অনেক কষ্টে কাঁসর-ঘণ্টা আর পটকা ফাটিয়ে তাড়ানো হয় দিন কয়েক এয়ারপোর্ট বন্ধ কাগজে দেখেননি? শুধু কী হাতি? ওই রানওয়ের পাশেই মাসখানেক আগে আস্তানা গেড়েছিল বিশাল এক পাইথন মস্ত এক হরিণ গিলে পড়ে ছিল দিন কয়েক
বারীণবাবুর গল্প আরও কতক্ষণ চলত ঠিক নেই কিন্তু এ যাত্রায় মাকুমামাকে উদ্ধার করল টুরিস্ট লজের বেয়ারা জানিয়ে দিল খাবার তৈরি সুতরাং উঠতে হল সবাইকে বুনো মুরগির স্বাদ সত্যিই যে আলাদা সেটা মালুম পাওয়া গেল খাওয়ার টেবিলেই খোদ মামা কিন্তু প্রায় কিছুই খেলেন না কুইনিন গেলার মতো মুখ করে সামান্য কিছু মুখে দিয়েই উঠে পড়লেন খাওয়া সেরে ঘরে এসে দেখি মাকুমামা বিছানায় নির্জীবের মতো শুয়ে আছেন
আমি ঢুকতেই কোঁ-কোঁ করে বললেন, ‘ফুচে রে, বেশ বুঝতে পারছি এ যাত্রায় আর রেহাই নেই আমার তোর মামিকে গিয়ে খবরটা দিসভেউভেউ করে কেঁদে উঠলেন উনি
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘ভেবো না মামা এখানে এত মানুষ ভয়ের কী আছে? গণ্ডার দেখতে জঙ্গলে না গেলেই তো হল তা ছাড়া শুনলে তো, এখানে বাঘ এমন কিছু বিপজ্জনক নয় মানুষকে এড়িয়েই চলে
মামা অবশ্য কিছুমাত্র সান্ত্বনা পেলেন না ফের কোঁকোঁ করে বললেনতুই আমায় পাগল পেয়েছিস ফুচে? যা খুশি তাই বোঝাবি! বাঘ সম্বন্ধে তুই আমার থেকে ভাল জানিস? তা ছাড়া শুনলি তো, এসব জায়গায় বুনো হাতিও কী মারাত্মক! খোদ মিলিটারির সঙ্গে টক্কর দেয় ওরে ফুচে রে, আমার পাশে আয় বাবা আমার নিঃশ্বাস কেমন বন্ধ হয়ে আসছে লেগেছে
মামার শেষ দিকের কথাগুলো কেমন প্রলাপের মতো শোনাল শুধু যে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন তাই নয়, গায়ে জ্বরও এসে পড়েছে সামান্য সান্ত্বনা দিতে তাই পাশে এসে বসলাম তাতে মামা বোধ হয় ভরসা পেলেন খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন, ‘ফুচে রে, বাঁচতে চাস তো চল পালিয়ে সন্ধের বাসে কেটে পড়ি এখানে আর একটা বেলাও নিরাপদ নয়
আমি হেসে ফেললাম, ‘কী যে বল মামা তার ঠিক নেই! এত দূর এসে হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গল না দেখে ফিরছি না আমি তারপর সাহেবরা ফেরে তো ভাল, নয়তো দুজন দুপুরের বাস ধরব ভেবো না তুমি
শুনে প্রায় যেন আঁতকে উঠলেন মাকুমামা, ‘ফুচে, আমায় একলা ফেলে যাবি রে! আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলি তোর নিজের কথা একবার ভেবেছিস? বাঘ ভালুকের জঙ্গলে খালি হাতে যাবি গণ্ডার দেখতে! এক থাবায় কখন ভ্যানিস হয়ে যাবি, টেরটিও পাবিনে!’
সঙ্গদোষ বলে কথা সকাল থেকে বাসের ধকল বেলায় ভরপেট খাওয়ার পর ঘুম পাচ্ছিল খুব মামার সেই প্রলাপ শুনতে-শুনতে পাশে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি তারপর স্বপ্ন দেখছি, হাতির পিঠে চেপে সাহেবদের সঙ্গে জঙ্গলে চলেছি গণ্ডারের খোঁজে চারপাশে নলখাগড়ার ঘন ঝিমঝিম-করা জঙ্গল ঝমঝম শব্দে আমাদের হাতি সেই জঙ্গল ভেঙে পথ করে চলেছে ক্বচিৎ এক আধটা ময়ূরের ডাক ভেসে আসছে শুধু আমাদের হাতি তখন মস্ত এক গাছের তলা দিয়ে চলেছে উপরে ঘন ডালপালার আড়ালে ঝুলছিল বিশাল এক পাইথন হঠাৎ সেটা মস্ত এক হাঁ করে হাতির পিঠ থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছে আমাকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করছি কোনও শব্দই বের হচ্ছে না তারপরেই মট করে ভেঙে গেল ঘুমটা চোখ মেলে দেখি দিব্যি বিছানাতেই শুয়ে রয়েছি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছি পাশে মাকুমামার দিকে চোখ পড়তে থমকে গেলাম প্রায় ফিটের রোগীর মতো পড়ে রয়েছেন বিছানায় দুচোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে কুলকুলিয়ে ঘামছেন সমানে বলির পাঁঠার মতো ঠকঠকিয়ে কাঁপছে সারা শরীর মুখে শব্দটি নেই
একবার মনে হল, উনিও বোধ হয় আমার মতো ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন কিন্তু চোখ মেলে কেউ ঘুমোয় নাকি? তাহলে কী অন্য কিছু? ব্যাপারটা মনে হতেই মামার চোখের সোজা জানলার বাইরে তাকালাম কী সর্বনাশ! জানলার বাইরে খানিক দূরে গাছপালার আড়ালে মস্ত এক দাঁতাল হাতি জুলজুল করে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে হঠাৎ সেটা গাছপালা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল হুড়মুড় করে
প্রায় দৈত্যাকৃতি সুবিশাল প্রাণীটিকে দেখে তাক লেগে গেল! এত বড় হাতি আগে দেখিনি শুঁড়ের দুপাশে সুবিশাল গজদাঁতের ডগায় কাদার দাগ হাঁ করে তাকিয়ে আছি চিঁ-চিঁ করে মাকুমামা বললেন, ‘ফুচে রে, বুনো হাতি আমার হাত-পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে নাড়াতে পারছি না জানলার ধার থেকে এখুনি আমায় সরিয়ে দে বাবা
বুনো হাতি! মাকুমামার কথা প্রায় বজ্রপাতের মতোই কানে বাজল কী সর্বনাশ! এ সম্ভাবনার কথা ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি! মামার আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা বুঝতেও বিলম্ব হল না চিড়িয়াখানা বা সার্কাসের হাতি অনেক দেখেছি কিন্তু এমন তেল চকচকে শরীর কারও দেখিনি তার উপর গজদাঁতের ডগায় কাদা! কোনও সন্দেহ নেই আর শোবার খাটের লাগোয়া জানলা তাড়াতাড়ি বন্ধ করতে গেলাম কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে বিশাল আকৃতির হাতিটা ততক্ষণে জানলার ওধারে মস্ত এক ময়াল সাপের মতো শুঁড়ের ডগাটা গরাদের ফাঁকে দুলছে আঁতকে হাত সরিয়ে নিলাম
ওদিকে বিছানায় মাকুমামা কোঁ-কোঁ করে উঠলেন, ‘ফুচে রে, আমায় টেনে নামা শিগগির ব্যাটা জানলার ফাঁকে শুঁড় গলিয়ে এক আছাড়ে পটকে দেবে নির্ঘাত কী হবে রে এবার?’
কিন্তু মামাকে নামাব কী! ততক্ষণে তিনি দুহাতে প্রায় সাঁড়াশির মতো জাপটে ধরেছেন আমাকে নড়ব সে উপায়টিও নেই খানিক চেষ্টা করেও সুবিধে হল না মোটেই ইতিমধ্যে হাতিটা শুঁড় তুলে কানাডিয়ান ইঞ্জিনের মতো ফোঁস করে এক ঝলক গরম বাতাস আমাদের উপর স্প্রে করে গরাদের ফাঁকে শুঁড় গলিয়ে দিয়েছে হা ভগবান! মুহূর্তে অন্তিম আর্তনাদ বের হয়ে এল গলা দিয়ে কিন্তু খেল দেখালেন মাকুমামা
বাবাগো মেরে ফেললেগগনবিদারী হাহাকারের মধ্যেও ছেঁড়া ধনুকের মতো হঠাৎ আমাকে নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন নীচে
সশব্দে খাট থেকে ছিটকে পড়ে মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল আমার কিছু মনে নেই তারপর জ্ঞান ফিরতে দেখি ঘরের ভিতর মানুষে ভরতি উদ্বিগ্ন মুখে লক দম্পতি তো বটেই, বারীণবাবুও রয়েছেন ওদিকে মাকুমামাকে জলের ঝাপটা দেওয়া হচ্ছে আমাকে চোখ মেলতে দেখে বারীণবাবু বললেন, ‘ব্যাপার কী বল দেখি?’
আমি কোনওমতে বললাম, ‘বুনো হাতি!’
শুনে বারীণবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘বুনো হাতি! বুনো হাতি কোথায় পেলে? আরে ও তো আমাদের যাত্রাপ্রসাদ এখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ভি.আই.পি হাতি দেশের নামীদামী ভি.আই.পিরা ওই যাত্রাপ্রসাদের পিঠে চড়ে জঙ্গল দেখে যায় অমন শান্ত হাতি আমাদের আর দুটি নেই
আঁ!' তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম আমি তবে যে হাতিটা তখন জানলা দিয়ে শুঁড় গলিয়ে দিল!’
আরে ভাই, সে তো চকলেট খাবার জন্য আমাদের যাত্রাপ্রসাদ আবার চকলেটের দারুণ ভক্ত এখানকার টুরিস্টরাই ওকে অভ্যাসটা ধরিয়েছেন হঠাৎ নতুন মানুষ দেখে ওই চকলেটের লোভেই তখন জানলা দিয়ে শুঁড় গলিয়ে দিয়েছিল
মুচকি হেসে বারীণবাবু থামলেন ওধার থেকে মাকুমামার গলা শোন গেল ওই সময় কোমরে হাত চেপে ব্যথায় নাক-মুখ কুঁচকে কখন উঠে বসেছেন ককাতে-ককাতে বললেন, ‘ফুচে রে, ওসব কিছু বিশ্বাস করিসনি আর একটা অ্যাম্বুলেন্স দ্যাখ বাবা কলকাতায় নিয়ে চল এখুনি কোমরে বোধ হয় কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে আমার
ছবি: দিলীপ দাস
নারায়ণ পুস্তকালয়: আষাঢ় ১৩৯৫