Saturday 5 January 2019

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোঃ ভাঃ): ভৌতিক কাহিনী (গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু)


ভৌতিক কাহিনী
গৌরাঙ্গপ্ৰসাদ বসু
লকাতা থেকে দার্জিলিং। শিয়ালদা থেকে দার্জিলিং মেলে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে ভাড়া-মোটরে দার্জিলিং।
পুজোর ছুটিতে কলকাতা ছেড়ে আমাদের দার্জিলিং আসা। আমাদের মানে আমার ও আমার বন্ধু কমলের।
শিয়ালদায় রাত ন'টায় ট্রেনে চেপে ভোর আটটায় শিলিগুড়ি পৌঁছলাম। শিলিগুড়িতে দশটার সময় ভাড়া-মোটরে উঠে বসলাম। ঘণ্টা তিন-চারের মধ্যেই দার্জিলিং পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু ঠিক সময়ে দার্জিলিং পৌঁছানো গেল না। ভাড়া-মোটর আমাদের সব রাস্তা নিয়ে যেতে পারেনি, বরং তাকেই আমাদের ঠেলে নিয়ে আসতে হয়েছে মাইল কয়েক। কার্শিয়াং-এর কিছু আগেই মোটরের কল খারাপ হয়ে গেল। পাহাড়ি রাস্তা ভেঙে আমাদেরই মোটর টেনে আনতে হল কার্শিয়াং-এ। তারপর ওখানে মোটর সারিয়ে দার্জিলিং-এ আগমন।
দার্জিলিং-এ যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। ছ'টার আগেই এখানে সন্ধ্যে হয়।
মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলে আগেই চিঠি লিখে জায়গার ব্যবস্থা করেছিলাম। গিয়ে নাম বলতেই ম্যানেজার আমাদের ঘর দেখিয়ে দিলেন। ঘরখানা বেশ দু’দিকে দু'খানা খাট-বিছানা-পত্তর—সে সব হোটেলের! ওসব কিছুই আমাদের আনতে হয়নি।
জিনিষ-পত্তর রেখে হাতমুখ ধুয়ে নীচে খেতে গেল কমল। আমার আর খাওয়ার উৎসাহ ছিল না। পাহাড়ি-পথ মোটরে আসতে এবং মোটর ঠেলে নিয়ে আসতে, দু'বার বমি করেছি। ভারী ঘুম পাচ্ছিল। আলো নিবিয়ে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লাম। শোওয়া মাত্রই ঘুম!
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, গায়ের কম্বল গায়ে নেই—আমি শীতে কাঁপছি। কম্বলটা সরে গেছে বোধ হয়! পা দিয়ে অনেক খুঁজলাম শেষে হাতড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু কম্বল কই?
হাতটা একটু বাড়াতেই কম্বল পেয়ে গেলাম। সরে গেছে বোধ হয়! কম্বল ধরে টান দিলাম কিন্তু কম্বল এলো না কি ব্যাপার? জোরে আর একবার এক টান লাগাতেই কম্বলটা আলগা হয়ে আসছিল কিন্তু পরক্ষণেই কে যেন টেনে নিয়ে গেল কম্বলটাকে। টাগ-অব-ওয়ারে আমি হেরে গেলাম। দস্তুরমত চমকে উঠলাম।
আবার হাতড়াতে শুরু করলাম। কম্বলটা পেলাম, কিন্তু এবার আর কম্বল সরছে না—হাতড়ে বুঝলাম, একটা লোক কম্বলটা গায়ে শক্ত করে জড়িয়ে শুয়ে আছে আমার পাশে।
“এ আবার কে?”—ভাবনা হ’ল। একটু ভয়ও পেলাম। চোর-ডাকাত নাকি? চোর-ডাকাত হ'লে শুয়ে থাকবে কেন? চোর ত’ চুরি করে আমি ভাবতে থাকি, হয়ত খুব শীত লেগেছে—এ হচ্ছে দার্জিলিং-এর শীত। অন্ধকার একটু ফর্সা হলেই উঠে আমাদের ফর্সা করবার মতলব বোধ হয় ওর!
সাহস করে ফের হাত বাড়ালাম, “এই যে দেখছি নাক একটা নাক-হুঁ, একটা নাক-ই বটে!”
“হ্যাঁচ্চো।”
কেমন করে আমার একটা আঙ্গুল ওর ওই একমাত্র নাকে ঢুকে যাওয়াতে এই বিপত্তি। আমার পাশের লোকটি হেঁচে দিল। আমি বেজায় রকম চমকে গেলাম ভয়ও পেলাম খুব।
“এই যে দেখছি কান—একপাটি! কানমলা যাক তা হলে। মনের সুখে আর হাতের সুখে ওর কান মলতে থাকি। রাত দুপরে ভদ্রলোকের ঘরে চুরি করতে ঢোকার ফল, আর আমাকে হেঁচে ভয় দেখানর শাস্তি।
“আঃ-উ-উ-ম” ভারী আরাম পাই আমি ওর এটা কম্বল কেড়ে নেবার দণ্ড।
ভারী শীত। আমার এদিকে গায়ে একটা গেঞ্জি ছাড়া আর কিছুই নেই।
ভাবলাম, ডাকা যাক কমলকে, তারপর দুজন মিলে ওকে মেরে তাড়াব। ডাকাই
যাক!
“কমল-কমল?” খুব নিচু স্বরে ডাকলাম। কমলের সাড়া নেই।
“কমল কমল!” আগের চেয়ে একটু উঁচু পর্দায় ডাকি।
কোন উত্তর নেই। ছেলেটা ভারী ঘুমকাতুরে। ঘুমলে ওর আর জ্ঞান থাকে না। একেবারে মড়ার মত ঘুমোয়।
“কমল-কমল-” একটু, গলা তুলি।
“উঃ!” কমলের খাট আমার বাঁ দিকে সেখান থেকে উত্তর আসে খুব নিচু স্বরে।
“শোন?”
“কি?”
“দ্যাখ ভারী...!”
“কি দেখব? আর কেমন করেই বা দেখব—যা সূচীভেদ্য অন্ধকার।
“দেখতে হবে না—শোন...” আমি চটে উঠি।
“ভারী মুশকিল। একজন লোক এসে আমার কম্বল কেড়ে নিয়ে, খাটে আমার পাশেই শুয়ে আছে। আমি এদিকে শীতে মরছি!”
“আমারও খাটে একজন এসেছে কিন্তু কম্বল কাড়তে পারে নি—একবার টেনে নিয়েছিল কেবল—ফের টেনে এনেছি—পাশে শুয়ে ভারী অত্যাচার শুরু করেছে।”
“ভারী শীত করছে ভাই,—কি করি?”
“আমার এখানেও দুজন। তা না হলে এখানে শুতে পারতিস—আমার কম্বলটা ভাগাভাগি করে গায়ে দিতাম।”
“এখন কি করি তবে? তোর খাটের সেই লোকটি তো আমায় জায়গা ছেড়ে দেবে না।”
“এক কাজ কর....”
“কি?”
“কাতুকুতু দিয়ে তোর পাশের লোকের কাছ থেকে কম্বল কেড়ে নে।”
“ও ভাই আমি পারব না কোথায় বগল কে জানে? বগলের ভিতর আমি হাত ঢোকাতে পারব না যদি হাত কামড়ে দেয়!”
“তবে এক কাজ কর...”
“কি?”
“তোর পাশের লোকটাকে তুই এক লাথি মেরে খাট থেকে ফেলে দে। আমিও আমারটাকে দেখছি।”
“আমি ভাই পারব না। আমার চেয়ে ওর গায়ের জোর ঢের বেশী। কম্বল নিয়ে টাগ-অব-ওয়ার করতে গিয়ে আমি তা টের পেয়েছি। ও তাহলে আমায় মেরেই ফেলবে! কাছে যে ছোরা-ছুরি নেই, তাই বা কে বললে?”
“চেষ্টা কর...”
আমার খাটের অপর বাসিন্দা বোধ হয় আমাদের কথাবার্তা শুনছিল সে আমাদের দু'জনার মধ্যে ছিল অর্থাৎ আমার বাঁ পাশে। হঠাৎ এক প্রকাণ্ড লাথিতে আমি খাট থেকে পড়ে গেলাম!
“বাবাগো”-বলে আমি আর্তনাদ করে উঠি ব্যথায়। আমার পিলে বোধ হয়, ফেটেই গেছে ওর লাথির চোটে।
কমলের গলা শোনা যায় এতক্ষণে, “হ্যা-হ্যাঃ—আমার সাথে চালাকি!—দিয়েছি ব্যাটাকে এক লাথিতে ফেলে, হ্যাঃ!”
“কমল কমল!’’ আমি কেঁদে ফেলি।
“কিরে, তোর কি হল?”
“আমাকে সেই পাজীটা খাট থেকে ফেলে দিয়েছে।”
‘ঘাবড়াস না আয় তুই আমার খাটে এসে শো এই কম্বল দু’জনে গায় দেওয়া যাবে?”
“ভাই কমল বে-কায়দায় পড়ে আমার পা মচকে গেছে আমি আর উঠতে পারছি না।”
“দাঁড়া, আমি আসছি।”
হঠাৎ আলো জলে উঠল! কমল আমাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে তার বিছানায় শোয়ালে।
“সেই লোক দুটো কই?” আমি কমলকে প্রশ্ন করি, “ওদের ধরে পিটুনি দিতে হবে!”
“কই, দেখছি না ত’!” কমল আলমারির পাশ, চৌকির তলা-সব খুঁজে দেখে। “পালিয়েছে—বোধ হয়—’
“কোথা দিয়ে পালাবে?”
“কেন? দরজা!”
“দরজা? দরজা দিয়ে কেমন করে পালাবে? দরজা দেখছিস না ভেতর থেকে বন্ধ! পালাবার পর ভেতর থেকে কে দরজা বন্ধ করবে শুনি?” কমল চটে ওঠে!
“তবে তারা গেল কোথায়? অদৃশ্য তো আর হয়নি।
“কি জানি ব্যাপারটা ভৌতিক বলে মনে হচ্ছে।”
“না—না ভূত নয় কক্ষনো”—আমি তীব্র প্রতিবাদ করি, “ভূত কখনো অমন করে হাঁচতে পারে না ও রীতিমত হেঁচেছে তার উপর আমি ওর কান মলে দেখেছি ওর কান রীতিমত মানুষের কান!”
“মানুষ হলে তারা যাবে কোথায় শুনি? মানুষ তো আর ভূত নয় যে, হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে! ও ভূতই নিশ্চয় মানুষ সেজে এসেছিল।”
হঠাৎ আমার চোখ পড়ে আমারই পরিত্যক্ত বিছানার উপর। বিছানা একেবারে টান করে পাতা-বালিশ সব ফোলানো কম্বল পায়ের নীচে ভাঁজ করা—যেন কেউ শোয়নি!
“কমল দেখছিস?” আমি কমলের দৃষ্টি আকর্ষণ করি বিছানার দিকে! “এ সব ভূতুড়ে কাণ্ড!
“তা হবে।’’ আমি আমার দুঃখ ব্যক্ত করি, “শেষে ভূতের মার খেতে হল আমাকে...
“আমাকেই কি ছেড়েছে রে ভাই’ কমল কাঁদ কাঁদ।
“তোকেও কি লাথি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দিয়েছে নাকি?”
“না, তা দেয়নি—তবে কান মলতে কসুর করেনি। নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে হাঁচিয়েছে। ভূতটা কম বজ্জাৎ?”
যাক, আমার মনটা এতক্ষণে আশ্বস্ত হল কিছুটা। ভূতের হাতে মার আমায় একলা খেতে হয়নি।
আপলোড: ৩০/১২/২০১৯

ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): গঙ্গাধর তান্ত্রিকের গঙ্গাযাত্রা

গল্পটি বর্তমানে ব্লগ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আগ্রহী পাঠক গল্পটি পাবেন ‘দেব সাহিত্য কুটির’ প্রকাশিত (জানুয়ারি ২০২১) লেখকের ‘নিশুতি রাতে আসে’ ভৌতিক/অলৌকিক গল্প সংকলনে। দাম: ১৫০ টাকা


 আপলোড: ৯/১২/২০১৯

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): ওয়ারিশ (লীলা মজুমদার)


ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভার্শন)
ওয়ারিশ
লীলা মজুমদার
খাঁদার আর গদাইয়ের যেমনি নামের ছিরি, স্বভাবটিও তেমনি। আমাদের এই কলকাতার উপকণ্ঠে একটা পুরানো পাড়ার আদি বাসিন্দাদের দুই বংশধর। এ গল্প চোখে পড়লে পাছে তারা অসন্তুষ্ট হন, তাই আর রাস্তাটার নাম বললাম না। সেখানকার সব নালা গিয়ে গঙ্গায় পড়েছে, সব মোড়ে একটা করে মোটরের কারখানা। আর পথঘাটের কথাই যদি বল, সব ভাঙা, সব পথে বাস আর প্রাইভেট গাড়িতে পায়ে চলা দায়। বড়দাদামশাই নাক সিঁটকে বলেন, ‘যেমন দুই গুণধর, তারি উপযুক্ত পটভূমিকাও হবে তো। আসলে ওরা মামাতো পিসতুতো ভাই। খাঁদার বাবা এ জন্মে কোন চাকরি রাখতে পারেননি আর গদার বাবা তার শ্বশুরমশাইয়ের ওপর সব দায় চাপিয়ে সরে গেছেন। শ্বশুরবাড়ির কেউ তার নামও করে না। না করে করে এখন প্রায় ভুলেও গেছে। নিজের বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে, কোন কালে তিনি তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠেছিলেন এবং পত্রপাঠ সরেও গেছিলেন। ওর মামাতো ভাই খাঁদার দিব্যি টিকলো নাক ছিল। যখন জন্মেছিল তখন নাকি ওই নাকের জায়গাটা সাংগু ভ্যালির মত চ্যাপ্টা ছিল, উঁচু-নিচুর বালাই ছিল না। তখন ওই দিদিমাই নাকি দুবেলা বিশুদ্ধ ঘানির তেল দিয়ে যেখানে নাক থাকা উচিত, তার দু পাশ দিয়ে চেপে চেপে ঠেলে ঠেলে মালিশ করে এমন বাঁশির মতো টিকলো নাক করে দিয়েছেন। অথচ ছেলের কি তার জন্য এতটুকু কৃতজ্ঞতা দেখা যাচ্ছে? মোট কথা ওদের মা-রা সুদ্ধ বাড়ির সকলেই ওদের মুখ দেখলে রেগে উঠতেন। আবার সারাদিন বাইরে থেকে সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ঢুকলেও কি নিস্তার ছিল?
বড়দাদামশাই রেগে ওদের ভাত বন্ধ করে দিলেন। বললেন তার খরচায় কেউ টো-টো কোম্পানি খুলতে পাবে না। এতে দুই মা কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেছিলেন। কিন্তু গদাই বলল, আরে তোমরা ভাবছ কেন? আমরা মোটর গ্যারেজে মজুরি খাটি। বেশ ভাল খাইদাই। গ্রেট বেঙ্গল মোটর ওয়ার্কসের পেছনে একটা ঘরও পেয়েছি। সেখানেই থাকব ভাবছি। মানে ইয়ে আমাদের আত্মসম্মান বলে একটা জিনিস আছে তো। খাঁদা ওর এক বছরের ছোট এবং বেজায় ভক্ত। সেও বলল, আছেই তো।
দুই মা তাই শুনে কাষ্ঠ হেসে বললেন, তাই নাকি? তাহলে তাই করিস। আরেকটু মাইনে বাড়লে, আমাদেরও কিছু দিস।
এই তো ব্যাপার। এমন ব্যবহার পেলে কার না রাগ হয়? হাজার হোক দুজনেই.... হতে পারে টেনে-টুনে মাধ্যমিক পাস করেছে তো। কেন, গ্যারেজের কাজটা খারাপ হল কীসে? তার চেয়ে পশ্চিমাদের আপিসে কলম পেশার কাজের কি খুব বেশি সম্মান ? তোদের ওই লজঝড়ে গাড়ি বিগড়োলে তো নিজেরা কিছুই করতে পারিস না, পয়সা দিয়ে তোক ডাকতে হয়। আমরা কিন্তু দরকার হলে অনেক কলম পেশার কাজও করতে পারি।
অবিশ্যি এ সব হল রাগের কথা। সত্যি কি আর বড়দাদামশাইকে তুই-তোকারি করে অমন বেয়াড়া কথা ওদের বলা সম্ভব হত? ওরা এগারো ক্লাস থেকে পালাতে পারে, তাই বলে অভদ্র তো আর নয়। খাঁদা আরো বলল, শুনেছি তোর ঠাকুরদারা বনেদি বড়লোক ছিলেন।
এ কথা শুনে খুব আশ্চর্য হয়ে গদাই বলল, তুই কি করে জানলি? কারখানার পেছনে দড়ির খাটিয়াতে বসে একটা প্যাকিং কেসের ওপর খুদে একটা পুরোনো জনতা স্টোভে খাঁদা চার পেয়ালা জল আর দু-চামচ গুঁড়ো দুধের সঙ্গে এক চা-চামচ চা-পাতি আর তিন চা-চামচ চিনি মিশিয়ে ফুটোচ্ছিল। চা-পাতি একটা ছেঁড়া রুমালে বেঁধে নিয়েছিল বলে ছাঁকনি-টাঁকনির দরকার ছিল না। ক্যান্টিনের পরিত্যক্ত দুটি হাতলবিহীন মগে ঢেলে খাওয়া হবে। সোঁদা সোঁদা গন্ধওয়ালা এক রকম মিষ্টি পাঁউরুটির সঙ্গে। এক টাকায় চারটে মাঝারি মাপের পাওয়া যায়।
খাঁদা বলল, মা বলছিল পিসিকে, তাদের চিঠি লিখে আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তাই শুনে মহা রেগে গদাই তোতলামি করতে লাগল, ক–কেন? আমরা কি ভিখিরি না কি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ? তুই দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিলি না কেন?
খাঁদা বলল, না, মানে ভিখিরি বনবি কেন? তোর পৈত্রিক সম্পত্তিতে তো তোর ন্যায্য অধিকার-ই আছে!
কথাটা মন্দ বলেনি খাঁদা, তবে একটা অসুবিধেও আছে। ঠাকুরদার নামধাম কিছুই জানে না, তা খবর করবে কোথায়? এ-কথা বলতেই, খাঁদা পকেট থেকে একটা আধময়লা কাগজের টুকরো বের করে বলল, মা পিসিকে ঐ সবই জিজ্ঞাসা করলে পিসি বলেছিল তোর বাবার নাম অসিতবরণ আচার্য, ঠাকুরদার নাম অম্বিকাচরণ আচার্য। ওঁদের জমিদারি ছিল জলপাইগুড়ির কাছে নীলাম্বুনিধি বলে একটা বড় পরগণায়। তার অনেকটা জঙ্গলে ঢাকা ছিল। আমি নামগুলো টুকে রেখেছিলাম।
গদাই খানিক ভেবে বলল, না রে, মন চাইছে না। বাবাকে তারা তাড়িয়ে দিয়েছিল। ওদের সাহায্য নিতে অপমান লাগে।
খাঁদা বলল, তাড়ায়নি মোটেও। বন্ধুর জাহাজ কোম্পানীর শেয়ার কেনবার জন্য বাপের কাছে পিসেমশাই এক লাখ টাকা চেয়েছিলেন। বাপ দেননি। বলেছিলেন আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে কি দরকার র‍্যাঁ। তাতে রেগেমেগে চলে এসে তোর মায়ের গয়না-গাটি বেচে, শেয়ার কিনে, দেউলে হয়ে, শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠে পিসেমশাই দেহ রাখলেন।
খাঁদার জ্ঞানের প্রসার দেখে অবাক হয়ে গদাই বলল, হুট করে কিছু বলতে পারছি না। একটু ভাবা দরকার।
খাঁদা বলল, অবিশ্যি তা না করে, এখানে, কিম্বা এই রকম আরেকটা কোথাও, এইভাবে জীবন কাটানোও যায়। এই বলে ভাঙা মগে চা ঢালতে লাগল।
বেশি ভাববার সময় পায়নি গদাই, কারণ ঠিক সেই সময়ে, একটা বাংলা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে কারখানার মালিক পার্বতীবাবু, গ্যারেজের দিকের টিনের দরজাটা ক্যাঁচ করে খুলে ঘরে ঢুকলেন। গদাই তাকে আস্ত খাটিয়াতে বসতে দিয়ে বলল, এ চা আপনি খেতে পারবেন না, দাদা।
পার্বতীবাবু বললেন, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমি চা খাই না, জলখাবার খেয়ে এসেছি। কাগজে কি লিখেছে শোন: জলপাইগুড়ি জেলায় নীলাম্বুনিধির কাঠ ব্যবসায়ী অম্বিকাচরণ আচার্যের দ্বিতীয় পুত্র অসিতবরণ, কিম্বা তিনি গত হয়ে থাকলে তার উত্তরাধিকারী কেউ যদি থাকে, তিনি পত্রপাঠ নিম্নলিখিত ঠিকানায় উল্লিখিত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করলে লাভজনক কোন সংবাদ পেতে পারেন। নিজের পরিচয়ের প্রমাণস্বরূপ কিছু কাগজপত্র সঙ্গে আনতে হবে। —গদাই, তোমাদের কাজ দেবার আগে তোমার মামার বাড়ি থেকে যা জেনে এসেছিলাম, তাতে মনে হচ্ছে অসিতবরণ আচার্যের একমাত্র সন্তান অলোকশরণ তুমি, তাই ঠাকুরদার সম্পত্তির কিছুটা পাবে। ওই যে নাম ঠিকানা দেওয়া আছে, ওঁরা তাঁদের উকিল। গিয়ে একবার খবর করলে ভাল হয়। কারণ কারখানায় আমার জামাইকে একটা চাকরি না দিলেই নয়। অর্থাৎ ওদের চাকরিটা গেল।
এরপর আর কথা নয়। বড়দাদামশাই নিজেই লোক পাঠিয়ে দু’জনকে ধরিয়ে নিয়ে গেলেন।
কি হে, বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে মনে হচ্ছে। দুজনে গিয়ে একবার দেখেই এসো না। তবে খুব বেশি আশা কোরো না। অনেকগুলো ওয়ারিশ। জঙ্গল কেটে কেটে কাঠের ব্যবসা করত বুড়ো। তার কি আর খুব বেশি বাকি আছে? তবে মস্ত বাড়ি, মন্দির, অতিথিশালা, দেদার গুদামঘর দেখেছিলাম।
গেল দুজনে প্যাসেঞ্জার গাড়িতে, সেকেন্ড ক্লাসে, কারণ থার্ড ক্লাস তো কবে উঠে গেছে। কি ভাগ্যে বড়দাদামশাই দুজনার জন্যে দুটো করে মোটা নীল পেন্টেলুন আর লম্বা হাতা গরম সোয়েটার কিনে দিয়েছিলেন। স্টেশন থেকে অর্ধেক পথ বাস যায়। সন্ধ্যাবেলায় একটা বনের ধারে ওদের নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার বলল, বনের মধ্যে দিয়ে দশ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। টর্চ আছে আশা করি, কারণ বুনো জানোয়ার যে একেবারে নেই তা নয়। ওদিকটা বুড়ো কেটে সাফ করেছিল, সব জন্তু একদিকে জড়ো। হয়েছে। চোরাকারবারিদের পোয়া বারো।
বাস চলে গেলে চারদিকটা যেন বড় বেশি অন্ধকার বলে মনে হতে লাগল। ক্রমে সেটা চোখ সওয়া হয়ে গেল, তারার আলোয় ওরা পথটা স্পষ্ট দেখতে পেল। টর্চের ব্যাটারি খরচ করতে হল না। হয়তো ঘণ্টা দুই হেঁটেছে, নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে কখন থেমেও গেছে। তার মধ্যে কানে এল কান্নার মতো একটা শব্দ। কেউ কষ্ট পাচ্ছে, এ ওরা সইতে পারত না। তাড়াতাড়ি হাঁটা পথ ছেড়ে টর্চ জ্বেলে বনের মধ্যে ঢুকে, একটু এগোতেই একটা আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়ল। গাছতলায় কে একটা ছোট জানোয়ার ধরার দাঁত কল পেতে গেছে আর তাতে অদ্ভুত ফিকে প্রায়-রুপোলী রঙের শেয়ালের একটা পা ধরা পড়েছে। সে করুণভাবে চারিদিকে চাইছে আর মানুষের ছেলের মতো কাঁদছে। তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছাই রঙের শার্ট প্যান্ট পরা, সাদা দাড়িওয়ালা একজন বুড়ো মানুষ কাতরভাবে তাকিয়ে আছেন। মনে হল বোধহয় পঙ্গু, তাই নিজে কিছু করতে পারছে না।
ওদের কিছু বলতে হল না। ছুটে গিয়ে ফাঁদের দাঁত খুলে শেয়ালটাকে ছেড়ে দিতে ওদের দু-মিনিটও লাগল না। আশ্চর্যের বিষয়, সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে পালাল না। পোষা কুকুরের মতো ওদের গা ঘেঁষে, মুখ চেটে দিল। ওরা উঠে পড়লে তবে বনে ঢুকে পড়ল।
গদাই, খাঁদা বুড়ো মানুষটির দিকে চাইল। তিনি একটু একটু হাসছিলেন। তারপর বললেন, তুমি আজ একটা ভাল কাজ করলে, তোমার নাম অলোকশরণ, অসিতবরণের একমাত্র সন্তান তুমি। অসিত ভাল ব্যবহার করেনি, মনের দুঃখে তার মা অকালে মারা যান। উইলে তোমাকে সব চাইতে পুরনো বড় গুদোম ছাড়া কিছু দেওয়া হয়নি। অপমান বোধ করে সেটি নিতে অস্বীকার কোরো না। ওর মধ্যে যা আছে তার মূল্য তোমরাই বুঝবে। সুখী হয়ো দুজনে।
এই বলে বুড়ো এমনি হঠাৎ বনের অন্ধকারে ঢুকে গেলেন যে মনে হল বুঝি বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। ওরা এ-ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে, আবার হাঁটা ধরল। ভোরের আগে পাহাড়ের কোল ঘেঁষা নীলাম্বুনিধির কুঠিবাড়িতে ওরা পৌঁছেছিল। ওদের আগেই কলকাতার উকিলমশাইও সেখানে পৌঁছেছিলেন। বাড়ির সকলেই গদাইয়ের নিকট আত্মীয় হলেও, ওকে পেয়ে খুব একটা আহ্লাদ প্রকাশ করেনি। বরং একটু তাচ্ছিল্যের ভাব দেখা গেল। কলকাতায় ওঁরা উকিলের সঙ্গে দেখা করে সব কথা জানিয়েছিলেন। তিনিও প্রয়োজন মতো অনুসন্ধান করে, গদাইয়ের পরিচয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে, তবে তাকে এখানে আসতে বলেছিলেন।
বড় বাড়িতে কেউ তাদের যায়নি, প্রায় পোড়োবাড়ির মতো অবস্থার অতিথিশালায় উঠে হাত মুখ ধুয়ে ওরা উকিলবাবুর সঙ্গে গুদোম ঘরটার দখল নিতে চলল। তিনি হেসে বললেন, এ ঘরটিতে যত রাজ্যের পুরনো ভাঙাচোরা মোটর গাড়িতে ঠাসা। বুড়োর ঐ এক শখ ছিল, যাকে বলে মোটরগাড়ি পাগল। ওই ঘর আর তার মধ্যে যা কিছু ভাঙাচোরা ধনসম্পদ আছে, সবটার মালিক এখন তুমি।
এই বলে হাসতে হাসতে গুদোমের মস্ত লোহার দরজা খুলে দিলেন। আগে এটাই যে প্রকাণ্ড গ্যারেজ ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু ঠাকুরদা কেন, গদাইরাও গাড়ি পাগল, খাঁদাও।
দরজাটাকে হাট করে খুলে দিতেই ঘরটা সকালের আলোয় ভরে গেল। আর গদাই, খাঁদা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখল যে প্রথম দিককার ছাদখোলা ফোর্ড গাড়ি থেকে আরম্ভ করে দশ বারোটা বিখ্যাত বিদেশী গাড়ির কোনটা কম কোনটা বেশি ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। আর সবার পেছনে চাটাই-চাপা যেটা ছিল, সেটার ওপরকার চাটাই সরাতেই একটা হয়তো ১৯১০ সালের রোলস রয়েস অক্ষত দেহে ঝকমক করতে লাগল।
তাই দেখে দুজনার মাথা ঘুরে গেল। তারা টলতে টলতে দুটো গাড়ির ধুলোয় ঢাকা ফুটবোর্ডে ধপাধপ বসে পড়ল। এর জন্য উকিলবাবুও প্রস্তুত ছিলেন না। বুড়ো নাকি এদিকে কাউকেই আসতে দিতেন না। নিজের লোক দিয়ে গাড়ির কাজ করাতেন।
উকিল বললেন, বাবা, আমি খুব খুশি হয়েছি। এবার তোমাদের দুঃখ ঘুচবে। তোমার বাবা আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন।
গুদোমে আরেকটা জিনিস ছিল। দেয়ালের দিকে মুখ করা একটা বড় রঙিন ফটো। সেটা ঘুরাতেই দেখা গেল, বনে দেখা সেই বুড়ো মানুষ আর তার কোলে বসা সেই সাদা শেয়াল। উকিল বললেন, ইনি তোমার ঠাকুরদা। সাদা শেয়ালটাকে বনে কুড়িয়ে পেয়ে পুষেছিলেন।
এদেশে সাদা শেয়াল হয় না, ওটা অ্যালবিনো নয়, তবু ফিকে রং। তোমার ঠাকুরদা যেদিন মারা গেলেন, শেয়ালটা বনে পালিয়ে গেল। যাই হোক এই গুদামে লাখ লাখ টাকার জিনিস আছে। কাজে লাগিও।
খাঁদাও মন দিয়ে সব কথা শুনছিল, কিন্তু গদাই শেষটা কেন মুচ্ছো গেছিল, তা উকিলবাবু বুঝে উঠতে পারেননি। খাঁদা পেরেছিল।
 আপলোড: ১০/১১/২০১৯

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): রিকশাওয়ালা (সজনীকান্ত দাস)


রিকশাওয়ালা
সজনীকান্ত দাস
ন্ধ্যা অতিক্রান্ত হইয়াছে। সকাল হইতেই থাকিয়া থাকিয়া ঝুপ ঝুপ করিয়া বৃষ্টি নামিয়া জনসঙ্কুল শহরের দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত জন্মাইতেছিল। পথিকেরা আকাশের খামখেয়ালিপনায় বিরক্ত হইতেছিল; পথ চলিতে চলিতে বৃষ্টি নামে; কোন বাড়ির গাড়িবারান্দায় আশ্রয় লইয়া তাহারা কোন রকমে একটু মাথা বাঁচাইয়া লয়; বৃষ্টি ধরিয়া আসে। ভরসা করিয়া গাড়িবারান্দার আশ্রয় ছাড়িয়া তাহারা যেমনই একটু অগ্রসর হয় অমনই আবার একপশলা বৃষ্টি শুরু হয়।
সমস্ত দিন মেঘ করিয়া ছিল, একটানা না হইলেও বৃষ্টির বিরাম ছিল না। তবুও কেমন একটা গুমোট গরমের ভ্যাপসানিতে কলিকাতার সিক্তসন্ধ্যা থমথম করিতেছিল। এমন দিনে সাধারণত কেহ ঘরের বাহির হয় না। নেহাত প্রয়োজনে ছোট ভাই বিনোদকে সঙ্গে লইয়া স্ট্র্যান্ড রোড ধরিয়া কুমারটুলি অভিমুখে চলিতেছিলাম। তখন বৃষ্টি একটু ধরিয়া আসিয়াছে। শীকরভারাক্রান্ত বায়ুস্তর ভেদ করিয়া গঙ্গার ওপারের কারখানাগুলির আলো মাতালের চোখের মত ঘোলাটে দেখাইতেছিল, ল্যাম্প-পোস্ট ও টেলিগ্রাফ পোস্টগুলির গায়ে কিংবা টেলিগ্রাফের তারে তারে সঞ্চিত জলের উপর গ্যাসের আলো পড়িয়া চকচক করিতেছে। পথে লোকজন বা যানবাহনাদির বিশেষ বালাই ছিল না, ক্বচিৎ কদাচিৎ এক–আধখানা ট্যাকসি কিংবা ছ্যাকরা গাড়ি ঊর্ধ্বশ্বাসে কাদা ছিটাইয়া ছুটিতেছিল; দূরে একখানা রিকশা ঠুনঠুন ঘণ্টা বাজাইয়া মন্থরগতিতে চলিয়াছে। পিছনের আলোটি চোখের সম্মুখে একটি লাল রেখা টানিয়া দিতেছে।
বৃষ্টির ভয়ে দ্রুত চলিতে লাগিলাম। নিমতলা পার হইতেই বেশ সমারোহ সহকারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। একটি গাছতলা আশ্রয় করিয়া কোন রকমে মাথা রক্ষা করিতেছি। দেখি, সেই রিকশাওয়ালা বিশেষ শ্ৰান্তভাবে সেখানে উপস্থিত হইয়া হাঁপাইতে লাগিল। রিকশাখানা খালি। রিকশাওয়ালা সম্ভবত বহুদূরের সওয়ারী লইয়া তাহাকে গন্তব্য স্থলে পৌঁছাইয়া ফিরিতেছে।
বৃষ্টি থামিবার গতিক দেখিলাম না। তবু ভাল, একখানা রিকশা পাওয়া গেল। এই সামান্য পথটুকু-কয় পয়সাই বা দিতে হইবে! পরিশ্রান্ত রিকশাওয়ালা ততক্ষণে মুখ মাথা মুছিয়া সুস্থ হইয়াছে। কষাকষি করিয়া দুই আনা ভাড়া স্থির হইল। বিনুকে উঠাইয়া দিয়া নিজে উঠিতে যাইতেছি, রিকশাওয়ালা বলিল, হুজুর, দুজনকে পারব না।
বলিলাম, সে কি রে, এই রোগা রোগা দুজন লোক, আর কতটুকুই বা রাস্তা ! আজ্ঞে না হুজুর, পারব না। একটু আশ্চর্য হইলেও চটিয়া গেলাম। বলিলাম, দুনিয়াশুদ্ধ রিকশাওয়ালা দুজন তিনজন লোক নয়। তুই ব্যাটা নিবি না কেন ? অমন ষাঁড়ের মত শরীর তোর!
শকেগা নেহি বাবু। —বলিয়া সে সেই বৃষ্টির মধ্যেই বৃক্ষতল ছাড়িয়া গাড়ি লইয়া বাহির হইয়া পড়িল। অমন শক্ত-সমর্থ লোকের ব্যাকুতাপূর্ণ ‘শকেগা নেহি' শুনিয়া মনটা নরম হইল। তাহার দৃষ্টিতে  এমন একটা অদ্ভুত শঙ্কা ও কাতরতা মাখানো ছিল যে, আমার মন অস্বস্তিতে ভরিয়া গেল।
বৃষ্টি আর গাছের পাতার আচ্ছাদন মানিল না। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ভিজিতে লাগিলাম। রিকশাওয়ালা তখন কিছুদূর চলিয়া গিয়াছে। হাঁকিয়া বলিলাম, দশ পয়সা দিব। সে একবার মুখ ফিরাইয়া দেখিল এবং পরমুহূর্তেই গাড়ি লইয়া দৌড়াইতে শুরু করিল। বহুদূর হইতে রিকশাখানার ঠুনঠুন আওয়াজ কানে আসিতে লাগিল। পিছনের লাল আলোটি তখনও বর্ষাস্নাত অন্ধকার পথে একটি গতিশীল সিঁদুরটিপের মত দেখাইতেছিল।
সিক্তদেহে পথে নামিয়া পড়িলাম। সেদিন শ্রাবণ নিশীথিনীর গাঢ় তমিস্রা ভেদ করিয়া একটি কঠোর মুখের মলিন বেদনাকাতর দৃষ্টি আমার মনে ঘুরিয়া ফিরিয়া জাগিতে লাগিল।
কিছুদিন পরের কথা। এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেসে ছবি দেখিয়া একটি পরিচিত লোকের অপেক্ষায় হগ সাহেবের বাজারের কোণে দাঁড়াইয়াছিলাম। হঠাৎ এক রিকশাওয়ালার সহিত দুই বিপুলকায় মাড়োয়ারির বিশুদ্ধ হিন্দিতে বচসা হইতেছে শুনিতে পাইলাম। মাড়োয়াড়ি যুগলের গলা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে দেখিয়া ব্যাপার কি জানিবার জন্য একটু ঔৎসুক্য হইল। কাছে গিয়াই দেখি, স্ট্রান্ড রোডের সেই রিকশাওয়ালা। বচসার কারণ সে দুইজনকে লইতে পারিবে না। ওই দুইটি বিপুলকায় বস্তাকে একসঙ্গে গাড়িতে উঠিতে দিতে যে কোনও রিকশাওয়ালার আপত্তি হইতে পারিত এবং তাহাতে আশ্চর্য হইবার বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু পূর্বের কথা স্মরণ করিয়া আমি বিস্মিত হইলাম। সেই লোক তাহাতে সন্দেহ নাই। মাড়োয়ারি দুইজন অন্য যানের উদ্দেশ্যে প্রস্থান বিল। রিকশাওয়ালাকে পরীক্ষা করিবার কৌতূহল হইল। তাহার সহিত ভাড়া স্থির করিয়া তাহাকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিয়া বলিলাম, আমার আর একজন সঙ্গী আছে। করুণ ভাবে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সে আমাকে অন্য গাড়ি দেখিতে অনুরোধ করিল দুইজনকে সে লইতে পারিবে না। আমি এতদূর বিস্মিত ও কৌতূহলাক্রান্ত হইলাম যে, বন্ধুর অপেক্ষা না করিয়াই রিকশাতে চড়িয়া বসিলাম।
সেদিনও আকাশ ব্যাপিয়া মেঘ করিয়া আসিতেছিল; ঘন ঘন মেঘগর্জন ও বিদ্যুৎচমকে কলিকাতার চঞ্চল আকাশ স্তব্ধ হইয়া আসিয়াছিল। আসন্ন দুর্যোগের আশঙ্কায় রাস্তায় লোক চলাচল অনেকটা কম। রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিলাম, অবিলম্বে বৃষ্টি নামিবে, শীঘ্র বাড়ি পৌঁছানো চাই। জোরে টানিতে গিয়া রিকশাওয়ালা গলদঘর্ম হইয়া উঠিল; অবাক হইলাম। আমার মত ক্ষীণকায় পুরুষকে টানিতে এতটা পরিশ্রম হইবার কথা নয়। আগের দিনের মত একটা অজানা অস্বস্তিকর অনুভূতি মনে জাগিতে লাগিল। অমন বিপুলকায় একটা লোক আমার মত একটি সামান্য বোঝাকে টানিতে পারিতেছে না, ইহার কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাইলাম না। একটা অস্পষ্ট অলৌকিক ভয় মনকে পীড়া দিতে লাগল।
বেচারার দুরবস্থা দেখিয়া মায়া হইল। শুধু বোঝা টানার পরিশ্রম ছাড়াও অন্য কোনও যন্ত্রণা তাহার হইতেছিল, তাহারও আভাস পাইতেছিলাম। নানা কল্পনা করিয়া কোনও কিনারা করিতে পারিলাম না। তাহাকে যথেচ্ছ রিকশা টানিতে বলিয়া একটা সিগারেট ধরাইলাম। কৌতূহল নিবৃত্তি করিবার যথেষ্ট ঔৎসুক্য হওয়া সত্ত্বেও চুপ করিয়া কি ভাবে কথাটা পাড়িব ভাবিতে লাগিলাম।
হঠাৎ চড়বড় করিয়া বৃষ্টি নামিল। রিকশাওয়ালা চকিত হইয়া উঠিল। একটা বাড়ির গাড়িবারান্দার ধারে আসিয়া তাহাকে থামিতে বলিলাম। দুজনে গাড়িবারান্দার নিচে আসিয়া মাথা মুছিয়া বৃষ্টি থামিবার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
রিকশাওয়ালাকে একটা সিগারেট দিলাম। সে বিনীত সেলাম করিয়া সিগারেট লইয়া ফুটপাথের উপর উবু হইয়া বসিয়া সেটিকে ধরাইল। আমি দাঁড়াইয়া রহিলাম। মনের অদম্য কৌতূহল আমাকে ভিতর হইতে ঠেলা দিতে লাগল, কিন্তু পাছে বেফাঁস কিছু জিজ্ঞাসা করিয়া ফেলি—এই ভয় হইতে লাগিল। তাহার নাম কি, কোথায় থাকে, তাহার কে আছে, এগুলি বেশ সহজ ভাবেই জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম। তাহার নাম মকবুল, হাতিবাগানের বস্তিতে থাকে, এক বৃদ্ধা ফুফু ছাড়া তাহার কেহ নাই; শিশু অবস্থা হইতেই সে পিতৃমাতৃহীন। ফুফুর হাতেই মানুষ হইয়াছে। বিবাহ হইয়াছে কি না জিজ্ঞাসা করাতে সে গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বাবু, যে বোঝা তাহাকে নিরন্তর টানিয়া বেড়াইতে হইতেছে, তাহা লইয়াই সে অস্থির ইহার উপর জরুর বোঝা বহিতে সে অক্ষম। বলিলাম, বুড়ী ফুফু ছাড়া তাহার কেহ নাই, অথচ অহরহ বোঝা বহিতে হইতেছে, ইহার অর্থ তো বুঝিলাম না। মকবুল চুপ করিয়া রহিল। আমি তাহাকে চিন্তা করিবার অবসর না দিবার জন্য বলিলাম, একটা বিষয়ে আমার ভারি কৌতূহল আছে। কিছুকাল আগে নিমতলাঘাটের কাছে তাহাকে দেখিয়াছিলাম, আজও দেখিলাম; দুই দিনই সে একজনের অধিক সওয়ারী লইতে অস্বীকার করিয়াছে অথচ সে দুর্বল নয়। ইহার নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। যদি বিশেষ আপত্তি না থাকে তাহা হইলে…
মকবুল চমকিয়া উঠিল। তাহার মুখ অস্বাভাবিক রকম বিবর্ণ হইয়া গেল। হাত দিয়া মাথার রগ টিপিতে টিপিতে সে বলিল, বাবু, সে বড় ভয়ানক কথা। যে কথা মনে হইলেই সে আতঙ্কে শিহরিয়া উঠে, তাহার বুকের তাজা রক্ত হিম হইয়া যায়, মুখে সেকথা সে প্রকাশ করিবে কেমন করিয়া?
বলিতে বলিতে সে সভয়ে রিকশাখানির দিকে চাহিল। কি যেন একটা ভয়াবহ কিছু দেখিয়া সে শিহরিয়া উঠিল। পরক্ষণেই সে উন্মত্তের মত ছুটিয়া গিয়া তেরপলের পর্দা দিয়া রিকশাখানি মুড়িয়া ফেলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে আসিয়া হতাশভাবে বসিয়া পড়িল। তখনও ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ ঝলকে কি যেন একটা অনন্ত রহস্যের ক্ষণিক আভাস মাত্র পাইতেছিলাম, জলভারাক্রান্ত বাতাস কলিকাতার পাষাণ-প্রাচীরে প্রতিহত হইয়া একটা একটানা উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করিতেছিল। রাস্তায় জনমানবের চিহ্ন ছিল না।
তাহাকে আর একটা সিগারেট দিয়া আমি তাহার কাছ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইলাম। কি যেন একটা অজানা ভয়ে আমার মনও পীড়িত হইতে লাগিল। ব্যাপারটা আগাগোড়া এমন অস্বাভাবিক মাঝে মাঝে সমস্তটা স্বপ্ন বলিয়া উড়াইয়া দিতেছিলাম; কিন্তু সম্মুখে উপবিষ্ট রিকশাওয়ালার অস্বাভাবিক দীপ্তি সম্পন্ন চোখ দুইটি আমার মনে এক অলৌকিক ভয় জাগাইতেছিল—আমি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিলাম।
কিন্তু এভাবে বসিয়া থাকা চলে না, বাড়ি যাইতে হইবে। এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে বিস্তারিত না জানিয়াও যাওয়া যায় না। বলিলাম, মকবুল, এসব কথা ভাবিতে যদি তোমার কষ্ট হয়, কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। বৃষ্টি অনেকটা কমিয়া আসিয়াছে এখন যাওয়া যাইতে পারে।
সজোরে আমার পা দুইটি চাপিয়া ধরিয়া অধীরভাবে সে বলিয়া উঠিল, আর একটু দাঁড়ান বাবু। যে কথা তিন বছর ধরিয়া বলিবার জন্য আমি ব্যাকুল, অথচ কাহাকেও মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিলাম, আজ আমাকে বলিতে দিন; এ যন্ত্রণা আর সহিতে পারিতেছি না।
নিবিড় সহানুভূতিতে চিত্ত ভরিয়া গেল। ভুলিয়া গেলাম, আমি মকবুল অপেক্ষা সামাজিক হিসাবে শ্রেষ্ঠ লোক; তাহার সহিত এভাবে কলিকাতার রাস্তার ফুটপাথে দাঁড়াইয়া আলাপ করাটা আমার পক্ষে হীনতাসূচক। সেই ব্যথাক্লিষ্ট মানুষটির গোপন কথা শুনিবার জন্য উৎকর্ণ হইয়া রহিলাম। মকবুল অতি ধীরে ধীরে থামিয়া থামিয়া হিন্দি–মিশ্রিত বাংলায় যাহা বলিল এবং যাহা বলিল না সবটুকু মিলাইয়া যাহা বুঝিলাম, তাহাই ভাষায় লিপিবদ্ধ করিতেছি।
মকবুল বলিল, বাবু, আমি আপনাকে ব্যাপারটা ঠিক বুঝাইতে পারিব কি না জানি না। ঘটনাটা এমন অসম্ভব আর এমনই ভয়াবহ যে, বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু খোদার কসম বাবু, আমি একটিও মিথ্যা বলিব না। আমি আজ তিন বৎসর ধরিয় এই গাড়িতে এক মৃতদেহ টানিয়া বেড়াইতেছি। একজনের অধিক লোককে গাড়িতে তুলিয়া টানিতে পারিব কেমন করিয়া? আর একজন নিরন্তর আমার রিকশার সিটের একধারে বসিয়া আছে! অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহাকে নড়াইতে পারি নাই। আমি ছাড়া কেহ তাহাকে দেখিতেও পায় না। অগত্যা তাহাকে বহন করিয়া চলিয়াছি। ইহার হাত হইতে আমার নিস্তার নাই। মৃতদেহটি পচিয়া ভারী হইয়া গিয়াছে; আমি অহরহ দুর্গন্ধে অস্থির হইতেছি। মৃতদেহের ভার টানিয়া টানিয়া আমার সবল দেহ জীর্ণ হইয়া আসিল এই অদৃশ্য শবদেহের ভারে আমি জর্জরিত হইয়া পড়িয়াছি, আমি আর বাঁচিব না বাবু।
মনে হইল, উপকথা শুনিতেছি। মনে হইল, কলিকাতার আবেষ্টনী ধোঁয়া হইয়া কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে জনশূন্য মরুভূমির মাঝখানে আমরা দুইজনে পড়িয়া আছি। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আমার সমস্ত চেতনা বিলুপ্তপ্রায় হইল। আমি স্তব্ধ হইয়া শুনিতে লাগিলাম…
তিন বছর আগেকার কথা। সেদিন প্রবল বর্ষণে কলিকাতা শহর জলধারার আবরণে বিলুপ্ত হইয়াছিল। রাত্রি নয়টা দশটার সময় আমি এই গাড়িখানা লইয়া হাওড়া স্টেশনে সওয়ারীর প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। সেখানে দুই-চারখান মাত্র গাড়ি ছিল, লোকের ভিড় ছিল না বলিলেই হয়। অমন দিনে সাধারণত কুকুর-বিড়ালেরাও বাড়ির বাহির হয় না। কিন্তু অভাব যাহাদিগকে পীড়া দেয়, তাহারা কুকুর-বিড়ালেরও অধম। আমি বিবাহ করিবার লোভে অর্থ সঞ্চয় করিতেছিলাম। বহিঃপ্রকৃতির সহস্র বাধাও আমার সঙ্গিনী পিয়াসী মনকে দমাইতে পারে নাই। বিবাহ করিবার কি অদম্য স্পৃহা আমার ছিল বাবু, তাহা আপনাকে বুঝাইতে পারিব না। নহিলে অমন দিনে মানুষে ঘরের বাহির হয় না। আজ বিবাহ করিবার বিন্দুমাত্র প্রবৃত্তি আমার নাই; প্রতি মুহূর্তেই আমার শরীরের রক্ত জল হইয়া আসিতেছে; আমি আর বেশিদিন বাঁচিলে পাগল হইয়া যাইব। শুধু ফুফুর মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেছি! সে আমার এই অবস্থার কথা জানিতে পারিলে কষ্ট পাইবে।
মকবুল আবার চুপ করিল। যাহা শুনিতেছিলাম, তাহা পরিষ্কার ধারণা করিবার মত শক্তি আমার ছিল না। জলের ঝাপটা লাগিয়া সর্বাঙ্গ ভিজিয়া গেল; অন্ধকার আকাশে তীব্র বিদ্যুৎস্ফুরণ হইতে লাগিল। কলিকাতার ঘরবাড়ি লেপিয়া মুছিয়া গিয়াছে; আকাশের নিচে গ্যাসের স্তিমিত আলোকে আমরা দুইটি প্রাণী এক অজানিত রহস্যলোকের দ্বার উন্মোচন করিবার ব্যর্থ প্রয়াস করিতেছি—
—সওয়ারী জুটিল দুইজন। প্রচুর ভাড়া চাহিলাম, তাহারা তাহাতেই স্বীকৃত হইল। দুইজনের কেহই প্রকৃতিস্থ ছিল না। একজন নেশায় একেবারে চুর হইয়া ছিল, অন্যজনের তখনও হুঁশ ছিল। এই ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যেই বাগবাজার পর্যন্ত যাইতে হইবে।
সওয়ারী দুইজন ভিতরে বসিল। আমি ভাল করিয়া পর্দা মুড়িয়া দিলাম। গঙ্গার ধারে ধারে সোজা উত্তর দিকে চলিতে লাগিলাম; দোকানপাট সব বন্ধ হইয়া গিয়াছে। একটা পানের দোকানে এক উড়িয়া বামুন সুর করিয়া কি পড়িতেছিল, রাস্তায় এখানে-ওখানে দুই-একজন লোক চলিতেছিল, গাড়িঘোড়া একেবারেই ছিল না। আমি নির্বিঘ্নে পথের মাঝখান দিয়া রিকশা টানিয়া লইয়া চলিলাম। কুমারটুলির কাছাকাছি গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আর কতদূর যাইতে হইবে ? উত্তর পাইলাম, সিধা চালাও।
আমার সর্বাঙ্গ ভিজিয়া গিয়াছিল। পরিশ্রমে আর ক্লান্তিতে চোখ ঘুমে জড়াইয়া আসিতেছিল। মনে হইতেছিল, আর টানিতে পারিব না। এমন সময়ে পর্দা ঠেলিয়া এক বাবু আমার হাতে পয়সা দিয়া এক বাক্স সিগারেট আনিতে বলিলেন। একটা গাছতলায় গাড়ি রাখিয়া সিগারেট আনিতে গেলাম। কাছাকাছি দোকান ছিল না। এদিক-ওদিক ঘুরিয়া একটি বিড়ির দোকানের সন্ধান পাইলাম। সিগারেট কিনিয়া ফিরিয়া আসিয়া হাঁকিয়া বাবুদের সিগারেটের বাক্সটা লইতে বলিলাম। কেহ উত্তর দিল না। ভাবিলাম, মাতাল বাবুরা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তেরপলের পর্দা তুলিয়া সিগারেট দিতে গিয়া এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখিয়া মূৰ্ছিতপ্রায় হইলাম। বাবু, সেই মুহূর্ত হইতে আমার জীবনের সমস্ত শান্তি অন্তর্হিত হইয়াছে; কাহার পাপের বোঝা মাথায় লইয়া আমি আজ তিন বৎসর কাল, প্রায়শ্চিত্ত করিয়া ফিরিতেছি জানি না। আর কতকাল এ যন্ত্রণা সহিতে হইবে খোদাতালাই বলিতে পারেন।
সামান্য আলো আসিতেছিল; দূরে গ্যাস-পোস্ট। গাছের তলে বেশ একটু অন্ধকার, বৃষ্টির বিরাম ছিল না। পর্দা তুলিয়া সেই অস্পষ্ট আলোকে দেখিলাম, গাড়িতে মুখ বাঁধা একজন মাত্র লোক। বুক দিয়া দরদর ধারে রক্ত পড়িতেছে, সর্বাঙ্গ রক্তে ভিজিয়া গিয়াছে। প্রাণ আছে বলিয়া মনে হইল না! কেমন করিয়া কি হইল প্রথমটা কিছু ঠাহর করিতে পারিলাম না, বিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইয়া ঘামিতে লাগিলাম। ধীরে ধীরে চেতনা ফিরিয়া আসিল। মনে বিষম ভয় হইতে লাগিল। চোখের সম্মুখে ফাঁসিকাষ্ঠের ভয়াবহ দৃশ্য ফুটিয়া উঠিল। সমস্ত দোষটা আমার ঘাড়ে যে চাপিবে তাহাতে সন্দেহ নাই আমার কথা কে বিশ্বাস করিবে?
বুঝিলাম, অন্য লোকটি মুখ বাঁধিয়া ছোরার আঘাতে এই লোকটিকে হত্যা করিয়া পলাইয়াছে। তাহাকে ধরিবার কোনও উপায় নাই, তাহার চেহারাটাও মনে আসিল না।
লোকটা নিশ্চয়ই মরিয়া গিয়াছে। গায়ে হাত দিয়া দেখিলাম, তখনও গরম। ভাবিলাম, কোনও হাসপাতালে লইয়া যাই, চিৎকার করিয়া লোক জড়ো করি, কিন্তু সাহস হইল না। তাজা খুন দেখিয়া ভয়ে আমি তখন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। আত্মরক্ষা করার কথাটাই প্রথমে মনে আসিল। সভয়ে চারিদিকে চাহিয়া মৃত মরণাপন্ন দেহটি সেই বৃক্ষতলে ফেলিয়া রাখিয়া গাড়ি লইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিলাম।
কেমন করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম, কেমন করিয়া সেই রাত্রিতেই গাড়িখানি ধুইয়া মুছিয়া আস্তাবলে রাখিলাম, আমার কিছুই স্মরণ নাই। তারপরে সাত আট দিন ধরিয়া আমি দারুণ জ্বরে বেহুঁশ হইয়া পড়িয়াছিলাম। ফুফুর মুখে শুনিয়াছি, সে কয়দিন আমি খুন রক্ত ফাঁসি ইত্যাদি নানা ভুল বকিয়াছিলাম।
সম্পূর্ণ আরোগ্য হইবার পরও গাড়ি লইয়া বাহির হইতে সাহস হইতেছিল না, গাড়িখানির দিকে নজর দিতেও ভরসা পাইতেছিলাম না। কিন্তু পেট তো চালাইতে হইবে। আবার একদিন সকালে মনের সহিত অনেক যুদ্ধ করিয়া গাড়িখানি বাহির করিতে গেলাম। গাড়িতে হাত দেওয়ামাত্র মনটা ছ্যাৎ করিয়া উঠিল। রক্তের চিহ্নমাত্র ছিল না, তবু যেন রক্ত দেখিতে পাইলাম। মনের দুর্বলতা জোর করিয়া উড়াইয়া দিয়া গাড়ি লইয়া বাহির হইলাম। সওয়ারী জুটিল। মাঝে মাঝে গা ছমছম করিতেছিল বটে, কিন্তু দিনের আলোয় লোকে ভিড়ে সে ভাব বেশিক্ষণ মনে থাকিতে পায় নাই। থাকিয়া থাকিয়া মনে হইতেছিল, অন্যায় করিয়াছি হয়তো লোকটা বাঁচিতে পারিত। বিপদের ভয় না করিয়া যদি তৎক্ষণাৎ কোনও হাসপাতালে তাহাকে লইয়া যাইতাম হয়তো সে বাঁচিয়া উঠিত। লোকটা যদি মরিয়াই থাকে, নিজেকে তাহার মৃত্যুর কারণ বলিয়া মনে হইতে লাগিল। সে ভাবটাও কাটাইয়া উঠিলাম। কে জানে, পরের দিকে নজর দিতে গিয়া হয়তো মহা ফ্যাসাদে পড়িয়া যাইতাম! বাঁচিবার নসীব থাকিলে সে এমনই বাঁচিবে! এইভাবে নানা মানসিক দ্বন্দ্বে প্রথম দিনটা কাটিয়া গেল। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।
সমস্ত রাত্রি কেমন যেন একটা অস্বস্তিতে কাটিল; ঘুমাইতে পারিলাম না। ভয় হইল, আবার বুঝি জ্বর হইবে। সেই রক্তাক্ত-দেহ মুখ-বাঁধা লোকটিকে যেন চারিদিকে দেখিতে লাগিলাম। মাথা গরম হইয়াছে ভাবিয়া চোখেমুখে জল দিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিলাম, ঘুমও আসিল। কিন্তু ভোরবেলায় আবার একটা দুঃস্বপ্ন দেখিয়া ভীষণ ভয়ে ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে যেন গুমরিয়া গুমরিয়া আমার কানে কানে বলিয়া গেল তুই আমাকে খুন করিয়াছিস! আমি আল্লা নাম স্মরণ করিয়া উঠিয়া বসিলাম।
সেদিন গাড়ি লইয়া বাহির হইতে যাইব মনে হইল কে যেন আমার পিছু লইয়াছে, পিছনের পথের উপর যেন রক্তের দাগ দেখিলাম। হায় আল্লা! এ কি হইল! কাহার পাপের বোঝা কাহার ঘাড়ে চাপাইলে তুমি! আমি যেখানে যাই, সেখানেই যেন কোনও অদৃশ্য কেহ আমার পিছু লইতে লাগিল। ভাবিলাম, আমি কি পাগল হইয়া গেলাম।
বুঝিলাম, আমাকে ভূতে পাইয়াছে। ওঝার কাছে গেলাম, সে অনেক ঝাড়ফুঁক করিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না সে আমার পিছু ছাড়িল না।
মকবুল চুপ করিয়া গামছা দিয়া কপালের ঘাম মুছিল। আমার কাছে একটা সিগারেট লইয়া সেটা ধরাইয়া আবার বলিতে লাগিল—
দুই-একদিন পরে সন্ধ্যার সময় হেদুয়ার মোড়ে দাঁড়াইয়া ছিলাম, এমন সময়ে বৃষ্টি নামিল। বৃষ্টি হইতে বাঁচাইবার জন্য গাড়িখানা তেরপল মুড়ি দিতে যাইতেছি, দেখি পিছনে পিছনে কে যেন আসিতেছে। ফিরিয়া তাকাইলাম, কেহ নাই। তাড়াতাড়ি গাড়িখানা ঢাকিয়া বাড়ি ফিরিবার ইচ্ছা হইল। গাড়ির ছপ্পর হইতে পর্দাখানা ফেলিতে যাইব, দেখি গাড়ির ভিতরে সে বসিয়া মুখ বাঁধা, বুক দিয়া রক্ত গড়াইতেছে! ভয়ে শিহরিয়া উঠিয়া পা ফেলিয়া দিয়া মূৰ্ছিতের মত সেখানে বসিয়া পড়িলাম।
আমার এই অদ্ভুত যন্ত্রণার কথা আপনাকে কেমন করিয়া জানাইব বাবু? আপনি কি বুঝিতে পারিবেন? গাড়ির ভিতর রক্তাক্ত কলেবরে সে নিশ্চয়ই বসিয়া আছে। সেই হইতে আজ পর্যন্ত ওই গাড়িতেই বসিয়া থাকে সে; আমার পিছনে আর তাহাকে দেখি না সে নিশ্চিন্ত হইয়া গাড়ির ভিতরেই থাকে, আমি তাহাকে টানিয়া লইয়া বেড়াই।
মকবুল চোখ বুজিয়া চুপ করিয়া রহিল। অনেকক্ষণ ওই ভাবে থাকিয়া আবার বলিতে লাগিল বাবু, সেই দিন হইতে আজ পর্যন্ত ওই মড়ার বোঝা আমি টানিয়া ফিরিতেছি। একজনের অধিক সওয়ারী তাই আর টানিতে পারি না। মড়া পচিয়া দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে আমাকে তাহাই সঙ্গে করিয়া ফিরিতে হইতেছে। অথচ আল্লার দোহাই বাবু, ওই লোকটার মৃত্যুতে জ্ঞানতঃ আমার কোনও অপরাধ নাই।
আমি ওই নিরক্ষর লোকটিকে কি সান্ত্বনা দিব! চুপ করিয়া রহিলাম।
—বাবু, বোঝা সব সময়েই বহিতে হয়, কিন্তু বর্ষারাত্রি ছাড়া অন্য সময়ে ওই মৃতদেহ আমি দেখিতে পাই না। দেখিয়া দেখিয়া বোঝা টানিয়া টানিয়া অনেকটা সহিয়া গিয়াছে, কিন্তু আজিও মাঝে মাঝে ভয় পাইয়া উঠি। ভিতরে ভিতরে আমার শরীর জীর্ণ হইয়া আসিয়াছে; এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা আমি আর বেশিদিন সহ্য করিতে পারিব না।
—এই গাড়িখানি ছাড়িয়া দিবার সামর্থ্য আমার নাই বাবু। এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে ইহার সহিত জুড়িয়া দিয়াছে, আমি তাহার কাছে সম্পূর্ণ শক্তিহীন। আজ তিন বৎসর ধরিয়া আমার এই ভীষণ কর্তব্য আরম্ভ হইয়াছে; কবে শেষ হইবে খোদাতালাই জানেন!
মকবুল উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, বৃষ্টি ধরিয়া আসিয়াছে বাবু, আপনি গাড়িতে বসুন। আমি পরদিন তাহাকে আমার সহিত দেখা করিতে বলিব কি না ভাবিতে ভাবিতে গাড়ির নিকট গেলাম। মকবুল মুখ ফিরাইয়া কম্পিত হস্তে পর্দাখানি তুলিয়া ধরিল। আমি ভিতরে বসিতেই সে পর্দাখানি ফেলিয়া দিয়া গাড়ি টানিতে শুরু করিল।
পর্দা-ফেলা অন্ধকার রিকশাখানির ভিতর বসিতেই আমার গা ছমছম করিতে লাগিল। মনে হইল সিটের অন্য পাশে আমার গা ঘেঁষিয়া পচিয়া ফুলিয়া ওঠা এক মৃতদেহ স্থির হইয়া বসিয়া আছে। একটা পচা দুর্গন্ধও নাকে আসিতে লাগিল। সভয়ে পর্দা তুলিয়া ফেলিয়া মকবুলকে রিকশা থামাইতে বলিয়া বলিলাম, আমার বাড়ি বেশি দূর নয়, আমি হাঁটিয়াই যাইতে পারিব। রিকশাখানির ভিতরে চাহিবার আর সাহস হইল না।
মকবুল বুঝিল। একটু শীর্ণ হাসি হাসিয়া গাড়িখানি তুলিয়া ধরিয়া মন্থর গতিতে চলিতে লাগিল। আমি সেখানে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। রিকশাখানির দিকে চাহিবার সামর্থ্য পর্যন্ত আমার হইল না। বহুক্ষণ পর্যন্ত রিকশাখানির ঠনঠন আওয়াজ কানে আসিতে লাগিল। সে-রাত্রে ভাল করিয়া ঘুমাইতে পারিলাম না।
আপলোড: 31/10/2019

Friday 4 January 2019

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): ছায়া পূর্বগামিনী (ভবানী মুখোপাধ্যায়)


ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভার্শন)
ছায়া পূর্বগামিনী
ভবানী মুখোপাধ্যায়
টেলিফোনের ঘণ্টা আবার বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি কল-টা ধরার জন্য ওঠার উদ্যোগ করতে করতে হেমাঙ্গ বলে ওঠে, ‘আচ্ছা ফোন এলেই তুমি অমন লাফিয়ে উঠছ কেন! কী হয়েছে?’
মাধবীর দিকে তির্যক দৃষ্টি হেনে ফোনটা ধরল হেমাঙ্গ। মাধবী কিন্তু নীরবে নিস্পন্দ ভঙ্গিতে স্থির হয়ে বসে রইল। ঠোট দুটি ঈষৎ খোলা, একাগ্রচিত্তে টেলিফোনের কথাসূত্র ধরার চেষ্টা করছে, অথচ জানে এইখানে বসে অপর প্রান্ত থেকে কি কথা আসছে তা জানা অসম্ভব।
হেমাঙ্গ ফিরে এসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে, ‘ঘড়ির দোকান থেকে ফোন করছিল। ওরা বলছে কাল শনি, পরশু রবি, তার পরদিন ঈদের ছুটি। সেই মঙ্গল বারের আগে আর ঘড়ি মেরামত হবে না।’
পরিপূর্ণ নিটোল স্বাস্থ্য হেমাঙ্গর, সাধারণ বাঙালী ঘরের পক্ষে কিঞ্চিৎ বেমানান। সামনের মাথায় চুল কম, টাক পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু পিছন দিকের বাবরি দেখবার মতন।
মাধবীর দিকে যখন তাকাল হেমাঙ্গ তখন তার চোখ দুটি যেন জ্বলছে।
মাধবী বলে, তোমাকে কিন্তু হেস্টিংস স্ট্রীটের অ্যাটর্নি বলে মনে হয় না, দেখায় যেন মাউন্টেড পুলিশ। কিংবা ওদের ঘোড়ার মতন তেমনই তেড়ে উঠতে পার, তবে অবশ্য হাঙ্গামা যদি বাধে।
স্ত্রীর মুখের দিকে সবিস্ময়ে তাকায় হেমাঙ্গ কি অদ্ভুত মাধবীর ভঙ্গি, তেমনই বিচিত্র কথাবার্তা। সব কিছু লক্ষণ এবং ভঙ্গিমা দেখে কারো মনে হবে না যে মাধবী পরম প্রেমে আত্মহারা হয়ে আছে।
হেমাঙ্গ কর্কশ গলায় বলে, ‘তুমি কিন্তু আমাকে কিছুতেই বললে না টেলিফোন এলেই কেন চঞ্চল হয়ে উঠছ? যেন কোন অজানা জনের সংবাদের প্রতীক্ষায় রয়েছে, ব্যাপার কি মাধবী?’
‘ছিঃ, পাগলামি করো না।'
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেমাঙ্গ আবার রুক্ষ গলায় বলে, ‘নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে, আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না। আমাকে সব বলতেই হবে।'’
দুই হাতে কপালটা চেপে কিছুক্ষণ বসে রইল মাধবী, তারপর মৃদু গলায় বলল, ‘তোমাকে আগে বলিনি-- তুমি হয়তো কি ভাববে, আমাকে পাগল মনে করবে, কিন্তু স্বপ্নটা, উঃ…’
ধীর গলায় হেমাঙ্গ প্রশ্ন করে ‘কি স্বপ্ন?’
সেই ভাবেই গালে হাত রেখে ক্ষণকাল বসে বইল মাধবী, তারপর যেন আত্মকথনের ভঙ্গিতে টেবিলের উপর দৃষ্টি রেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘হয়তো অদ্ভুত মনে হবে, কিন্তু ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখলাম যেন আমার ছোটভাই নীলু আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আমি বলছি কিরে নীলু, এত রাত্তিরে কোথা থেকে ? নীলু বললে দিদিভাই আমি আর বেঁচে নেই। বারোটার সময় মারা গেছি। কথাটা শুনে আমার ভারি মন খারাপ হয়ে গেল, হয়তো নিছক কল্পনা, স্বপ্ন মাত্র, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি স্পষ্ট তাকে দেখেছি, এমনি যেন আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। ওদিকে দেখছি পাশে শুয়ে তুমি অঘোরে ঘুমচ্ছ। কিছুক্ষণ থেমে মাধবী আবার বলতে শুরু করে, নীলু একথাও বলল আমি আজ সকালের ভিতরই খবর পাবো যে এ স্বপ্ন সত্যি, দিল্লী থেকে ট্রাঙ্ককলে খবর আসবে যে নীলু কাল রাতে মারা গেছে।
সোজা ওর মুখের দিকে তাকায় হেমাঙ্গ। সে একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, মাধবী হঠাৎ এসব বলে কি, হল কি ওর! হেমাঙ্গ সান্ত্বনার সুরে বলে, ‘বেশ তো, এখন তো প্রায় দশটা বাজে, কেউ তো ফোন করেনি, আর ধর যদি…।’ ইতস্তত করে হেমাঙ্গ, তারপর আবার বলে, ‘নীলু কিছুকাল ধরেই তো ভুগছিল, অবশ্য তোমরা দু’জনে খুবই ঘনিষ্ঠ, কিন্তু তবু যা সত্য তাকে মেনে নিতে হবে, অনেক আগে থেকেই তো এই দুঃসংবাদের জন্য তৈরি হয়ে আছ। যদি সত্যই এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে…’
মাধবী যেন ঘুমের ঘোরে কথা বলছে, সেই ভাবেই টেবিলের দিকে চোখ রেখে বলে, ‘তোমার কথাই সত্য, কিন্তু স্বপ্নের ভেতর নীলু আরো কিছু বলেছে। সে কি বলেছে জানো?’ সোজা হয়ে হেমাঙ্গর মুখের পানে তাকায় মাধবী। তারপর স্পষ্ট গলায় বলে, ‘আমাকে সাবধানে করেছে নীলু, বলেছে আজ রাত বারোটার পর আমারও সব শেষ হবে…’
বিস্মিত হেমাঙ্গ বলে ওঠে, ‘বল কি, আজই বাত বারোটা? যতসব গাঁজা, তোমাকে আমি কতদিন বলেছি ওই সব ভূত-প্রেত আর গোয়েন্দা কাহিনী পড়া ছাড়ো। তুমি কিছুতেই কথা শুনবে না।’
মাধবীর কণ্ঠস্বর ক্ষীণ কিন্তু তীক্ষ্ণ, সে যেন আর্তনাদ করে উঠল, ‘না, আমি আর বাঁচব না। আর বড়জোর চোদ্দ-পনের ঘণ্টা। ঘড়ির দিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাধবী বলল, ‘আর কটা ঘণ্টা মাত্র।’
কান্নায় ভেঙে পড়ে মাধবী।
এক মুহূর্তের জন্য হেমাঙ্গর মনে করুণা হয়েছিল, সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্যে মাধবীকে বুঝি স্পর্শ কবার ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু সে ইচ্ছা দমন করে পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বার করে নাড়াচাড়া করে, তারপর কণ্ঠস্বর ঈষৎ মোলায়েম করে বলে, দেখ, এ সব তোমার বানানো গল্প কিনা কে জানে, যদি সত্যি বলেই ধরি তাহলেও স্বপ্ন। আর যদি স্বপ্ন হয় তাহলে দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্নকে মনে করে রেখে বসে থেকেও কোন লাভ নেই, তাকে ভুলতে হয়, ভুলতে শেখো। তা নিয়ে বৃথা মন খারাপ করে বসে থেকে লাভ কি?
তন্দ্রাচ্ছন্ন ভঙ্গিতে বলে মাধবী, ‘নীলু বললে, যখন খবরটা পৌছবে তখন বুঝবে আমার কথা সবটুকু সত্যি। সে যে ভবিষ্যৎবাণী করছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।’
হেমাঙ্গ বললে, ‘ছাই প্রমাণ পাবে, কিছুই প্রমাণ হবে না। তুমি জানতে তোমার ভায়ের কঠিন অসুখ, সে অনেকদিন ধরে ভুগছিল। মাধবী তুমি লেখাপড়া জানা মেয়ে, নিশ্চয়ই জানো মাঝে মাঝে ভাই-বোনের মধ্যে এই জাতীয় সংবাদ আদান প্রদান ঘটে থাকে। ওকে বলে টেলিপ্যাথি কোথায় কি হচ্ছে ওরকম বোঝা যায়।’
জানলার কাছ থেকে সরে এসে পরম প্রীতিভরে মাধবীর মাথায় হাত রাখে হেমাঙ্গ। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বেশ মোলায়েম কণ্ঠে বলে, ‘শোন মাধবী, ব্যাপারটা বেশ করে তলিয়ে ভাবো। আজ এই উনিশশো পঞ্চান্নয় তোমার এই ব্রাইট স্ট্রীটের বাড়িতে এই ধরনের ভৌতিক বাণী কি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, তার চেয়ে মাথাটা মাটির দিকে করে আর পা দুটি ওপরে করে হাঁটতে শেখা বরং সহজ। এসব কাণ্ড কখনও ঘটে না। তাছাড়া নীলু তোমাকে যেরকম ভালবাসে, সে কখনই এই ভাবে স্বপ্নে ভয় দেখাবে না। সুতরাং উঠে পড়, যা কাজ আছে কর, খাও, দাও ফুর্তি কর। শুনছ?’
হেমাঙ্গ লক্ষ্য করল মাধবী কাঁপছে, তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধটা সজোরে ধরে, সাহস ও শক্তি দেওয়াটাই তার উদ্দেশ্য। স্বপ্নের ব্যাপারটি নেহাত একটা মনগড়া ফাঁকা আওয়াজ যে নয় তা এতক্ষণে বিশ্বাস হয়েছে হেমাঙ্গর, একটু আগেও ভেবেছে মাধবী অভিনয় করছে, ওকে বিভ্রান্ত করাটাই হয়তো তার ফন্দি।
মাধবী একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে বলে, ‘আচ্ছা, তুমি যা বলছ তাই হয়তো ঠিক। আমারই কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। স্বপ্নটা হয়তো আমার মনোবিকার।’
একটু পরেই আবার টেলিফোন বেজে উঠল।
আবার মুখে হাত চেপে মাখা নিচু করে চুপ করে বসে রইল মাধবী। অতি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল হেমাঙ্গ টেলিফোন রিসিভ করতে। ফিরে এল কিন্তু অনেক পরে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। সোজাসুজি প্রশ্ন করল মাধবী, ‘কি, দিল্লী থেকে খবর এল তো ? নীলু তাহলে নেই!’
মাথা নেড়ে সায় দেয় হেমাঙ্গ। সে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এতক্ষণ পর্যন্ত যা হাসি ঠাট্টার বিষয় ছিল, এখন তা নিষ্ঠুর সত্য হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।
কি যেন বলার চেষ্টা করল হেমাঙ্গ, কিন্তু তার মুখে কথা যোগায় না, বিষয়টির ভয়ংকরত্বে সে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সান্ত্বনা দিয়ে তবু আর একবার টেলিপ্যাথির কথা উচ্চারণ করে।
সব কাজকর্ম ছেড়ে সারাদিনটা মাধবীর সঙ্গে কাটাবে স্থির করল হেমাঙ্গ। মাধবী কিন্তু ভীষণ আপত্তি জানাল। অবশেষে বলল, ‘একা থাকলে তবু একটু শান্তি পাব, অনেক ভাল থাকব হয়তো, একটু আমাকে না হয় একা থাকতে দাও।’
বেরিয়ে যাওয়ার সময় হেমাঙ্গ গম্ভীর গলায় বলল, ‘সত্যি বলছি, তখন তোমাকে ঠাট্টা করেছি বলে এখন মনে কষ্ট হচ্ছে, ওই টেলিফোনের কথাটি বলা উচিত হয়নি আমার।'
মাধবী বেশ ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে, ‘তাতে কি, বেশ করেছ, সংসারে এমন ঘটেই থাকে।’

হেমাঙ্গর গাড়ির আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই মাধবী তাড়াতাড়ি গিয়ে টেলিফোনটা ধরে, ওপার থেকে সাড়া আসতেই কান্নায় আকুল হয়ে উঠল মাধবী। অপর পক্ষ কোমল গলায় প্রশ্ন করে, ‘হল কি তোমার? বলতেই হবে সব খুলে।’
অতিকষ্টে, মাঝেমাঝে চাপা কান্নায় বাধা পেয়ে, ওপার থেকে শোনা কথায় আঘাত পেয়ে কোন রকমে সমগ্র কাহিনী শেষ করলে মাধবী। কিন্তু স্বপ্নের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে এমন কতকগুলি নতুন কথা বলল যা হেমাঙ্গকে বলেনি।
‘প্রতুলদা, আমার বিছানায় নীলু যখন বসেছিল, তখন আমি ওকে প্রশ্ন করলাম যা ঘটবার তা ঘটবেই, তবু আমাকে সাবধান করার হেতু কি! আমি জানতে চাইলাম, কোন উপায় আছে কি বাঁচবার? নীলু বলল একেবারে নেই বলে কোন কথা নেই, পালাবার পথ নিশ্চয়ই আছে, ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচার রাস্তা হল অতিশয় সাবধানে থাকা। তাহলে হয়তো পরিত্রাণ পেতে পার। কিন্তু প্রতুলদা, তারপর আমার মুখের দিকে অতি বিষণ্ণ চোখ মেলে বলল কিন্তু মাধুদি তোমার যেরকম কাণ্ড, প্রতুলদাকে নিয়ে যেভাবে মেতে আছ তাতে যে তুমি অত সহজে নিষ্কৃতি পাবে মনে হয় না।'
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, অপর প্রান্ত থেকে যে কথা ভেসে আসছে অতিশয় আগ্রহ ভরে তাই শুনছে মাধবী। তারপর অতি ক্ষীণ গলায় বলে, ‘প্রতুলদা, আমি বেশ বুঝতে পারছি এ যাত্রা আর নিস্তার নেই, স্বপ্নের একাংশ যখন ফলে গেছে তখন অপর দিকটাও নিশ্চয়ই ফলে যাবে। কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। প্রতুলদা আমাদের...’
অপর প্রান্ত থেকে প্রতুলদা বলে ওঠে, ‘ননসেন্স, কি সব বাজে বকছ, একটু শক্ত হও, লক্ষ্মীটি, এই সময়ে মনটাকে অত দুর্বল করতে নেই।’
এবার জোর গলায় বলে মাধবী, ‘না প্রতুলদা, ব্যাপারটা সবটুকু একেবারে ননসেন্স নয়। আজ সকালেই লক্ষ্য করেছি উনি আমাকে বেশ সন্দেহ করছেন, বেশ বাঁকা বাঁকা কথাও বলেছেন, আমি সব সয়ে গেছি। এমন কি এই ইঙ্গিতও করেছেন যে কোন ভালবাসার জনের ফোন পাওয়ার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি। এরপর আর কি বলবে?’
‘ও বাবা, এত সব কাণ্ড ঘটেছে? ‘হ্যাঁ, সেই জন্যেই আমি বিশ্বাস করছি যে নীলুর ব্যাপারটা নিছক উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়।’
প্রতুল বলল, কিন্তু মাধবী, আমি না হয় ধরছি নীলুর কথাই ঠিক, তবু জিনিসটা অবিশ্বাস্য। ধর, আমাদের এই ব্যাপার হেমাঙ্গ জানল, তা সে কি তোমাকে খুন করবে, অন্তত তুমি তো সেই কথাই বলছ?’
‘জানি না কি করবে না করবে। শুধু এইটুকু বুঝছি আমার ভয় হয়েছে, ভীষণ ভয়। আজ আর আমাদের দেখা করার দরকার নেই। অন্তত বিপদটুকু না কাটা পর্যন্ত দেখা না করাই ভাল। আজ যদি দেখা না হয় আমাদের, তাহলে হয়তো নীলুর কথাটা বিফল হতে পারে। খানিকটা আত্মত্যাগ। বলা যেতে পারে। নীলু বলেছিল তোমার যা অবস্থা তাতে হয়তো তুমি সামলাতে পারবে না। তাহলে আজ আর যাচ্ছি না....।'
অনেক বিতর্কের পর ওপ্রান্তে প্রতুলের কণ্ঠস্বর রাজী হল, তারপর শান্ত গলায় সান্ত্বনা দিয়ে বলে, কিন্তু মাধবী, কথা দাও তুমি এসব কথা নিয়ে মোটে চিন্তা করবে না। এতটুকু মাথা ঘামাবে না। আমি আবার তোমাকে রাত বারটার পর ফোন করব।’
‘আচ্ছা, তাই কর প্রতুলদা, আমাকে তুমি ঠিক রাত বারটার পর ফোন করবে, স’বারোটার ভেতর। ...তাহলে বুঝব বিপদ কাটল আর তুমিও জানবে কি খবর!’
‘কিন্তু…।’ প্রতুল কি প্রশ্ন করতে যায়।
মাধবী তাড়াতাড়ি বলে, ‘কোন ভয় নেই, একবার শুলেই ওর জ্ঞান থাকে না, একেবারে পাথর হয়ে যায়। এমনিতেই এত ঘুম, তায় আজ আবার শনিবার, ক্লাব হয়ে ফিরবে, বুঝতেই পারছ এতটুকু জ্ঞান থাকবে না। ঠিক তাহলে বারটার পর ফোন করবে। তুমিই ফোন করো, যদি বুঝতে পারে, বলব রং নাম্বার।’
খাওয়া দাওয়া অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে, হেমাঙ্গ শুতে গেছে অনেক আগে। আয়নার দিকে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলে চুপ করে বসে আছে মাধবী। হেমাঙ্গকে অনেক বুঝিয়ে শুতে পাঠানো হয়েছে। কিছুতেই সে শোবে না, বলেছিল, ‘তুমিও বরং শুয়ে পড়, আজ আর সেলাই করে কাজ নেই, সারাদিন ধরে মনটা ক্লান্ত হয়ে আছে, বিশ্রামের প্রয়োজন।’
মাধবী চুপ করেছিল। তবু বারবার বলেছে হেমাঙ্গ, ঠিক বলছ তোমার শরীর ভাল আছে?’
মাধবীর চোখের কোণে জল দেখে হেমাঙ্গ শুতে গেছে তারপর। এতক্ষণে মাধবী একটু স্বস্তি বোধ করছে, শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি, আর কতটুকুই বা বাকি, এর মধ্যে কি আর ঘটতে পারে? স্বপ্নের প্রথম দিকটা মিলেছে, তাই শেষটাও মিলবে এমন কথা নেই। কাল শরীর বুঝে না হয় প্লেনে চলে যাবে দিল্লী। নীলুর কথাটাও তো মোছা যায় না মন থেকে। জানলার ধারে গিয়ে পর্দাগুলি ঠিকমত টেনে দেয় মাধবী। জানলার নিচেই ছোট্ট বাগান, কত বিচিত্র মরসুমি ফুল ফুটে আছে, এই স্নান আলোয় অস্পষ্ট কার্পেটের মত মনে হয়।
কত কাছে অথচ কত দূরে। জানলায় কোন পর্দা নেই, নতুন ফ্যাশান, যদি এই জানলার ফাঁকে উড়ে যাওয়া যেত, সত্যি যদি পাখনা থাকত, কত মজাই না হত, হেমাঙ্গর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ডানা মেলে উড়ে চলে যেত মাধবী, কত দূর-দিগন্তের পারে মেঘের সঙ্গে গিয়ে মিশত।
কিন্তু কি সব কথা ভাবছে মাধবী, পাগলের মত। ডানাই বা মেলবে কেন, কলহ যদি হয় সামনের দরজাও খোলা রয়েছে তারপর প্রশস্ত রাজপথ।
এখন সে অনেক ভাল আছে, এত ভাল আছে যে এই উদ্দাম চিন্তার উদ্ভট সম্ভাবনায় সে হাসতে পারছে।
এই স্তব্ধতার মধ্যে কিসের যেন একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল, অপূর্ব তার ঝঙ্কার ! প্রথমটা কিছুতেই বুঝতে পারে না মাধবী শব্দটা কিসের। পরে মনে পড়ল সিঁড়ির উপরকার ঘড়িটার ঘণ্টা বাজার আগে এমনই শব্দ হয়। তারপর ঘণ্টা বাজল, এক, দুই, তিন…
ভাল করে কান পেতে শোনে মাধবী। বারটাই বাজল শেষ পর্যন্ত। তবু কিছুক্ষণ সেইভাবে বসে রইল ও। বারটা যে বেজেছে সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া চাই।
অনেকক্ষণ চুপ করে কপালে হাত রেখে বসে রইল মাধবী। সেই অশুভ মুহূর্ত পার হয়ে সে এসেছে নবীন জীবনে, সঙ্কটের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে। বারবার ভাবে বিপদ তাহলে কাটল!
পা টিপে একবার হেমাঙ্গ বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল, মুখে তার বিজয়িনীর দীপ্ত ভঙ্গিমা। তারপর পাশের ঘরে টেলিফোনটির সামনে বসে পড়ল। টেলিফোনটা বাজলেই সেটা যাতে ধরতে পারে। মনে মনে এক দুই করে সাত মিনিট, আট মিনিট পর্যন্ত সময় গুনল। তারপর আর তার এতটুকু অপেক্ষা করার ধৈর্য থাকে না। চোরের মত অতি সন্তর্পণে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে কম্পিত কণ্ঠে ওপ্রান্তে অপারেটরকে প্রতুল লাহিড়ীর ফোন নাম্বারটা জানাল।
অনেক পরে ওপার থেকে প্রতুলের কণ্ঠ শোনা যায়, ‘হ্যালো।’
অনুযোগের সুরে মাধবী বলে, ‘কি হল তোমার ? কখন বারটা বেজে গেছে, স’বারোটাও হয়ে গেল, তোমার সাড়া নেই কেন?’
‘সেকি! এর মধ্যে বারোটা পনের! হতেই পারে না, এখন তো পৌনে বারটা, তোমাদের ঘড়ি নিশ্চয়ই ভীষণ ফার্স্ট চলছে।’
হঠাৎ পিছনে কি যেন খসখস করে উঠল। সচকিত মাধবী সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে পিছনে তাকিয়ে দেখে রবারের স্লিপার পায়ে হেমাঙ্গ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, চোখের চাউনিটা কেমন যেন উদ্‌ভ্রান্তের মত।
উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাধবী বলে, ‘ওঃ, তুমি বুঝি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছ…’
তারপর সহসা রিসিভারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উদ্দাম গতিতে মাধবী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পিছনে যেন হেমাঙ্গও দৌড়ে আসছে, তার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা সেই জানলার ধারে এসে পৌছায় মাধবী। ভীষণ আতঙ্কে তার সারা শরীর কম্পমান। তারপর হঠাৎ জানালার উপরে উঠেই শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
হয়তো তখনও ডানা মেলে দেওয়ার স্বপ্নের ঘোর তার কাটেনি।
‘মাধবী, মাধবী!’ চিৎকার করে ওঠে হেমাঙ্গ, কিন্তু কাছে আসার অনেক আগেই মাধবীর অচেতন দেহ মরসুমি ফুলের ওপর লুটিয়ে পড়েছে।
অনেক দূরে থানার ঘড়িতে বারোটা বাজল।
আপলোড: ২৬/১০/২০১৯