Sunday 5 January 2020

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): চন্দনপুরে (খগেন্দ্রনাথ মিত্র)

 


চন্দনপুরে

খগেন্দ্রনাথ মিত্র

ক টাকা সাড়ে তিন আনার গোলমাল! “আপ’ ও ‘ডাউন’ ট্রেনে টিকিট বিক্রয় পাওয়া যাচ্ছে ছাপ্পান্নখানা; কিন্তু মাশুল বাবদ রয়েছে মোট একষট্টি টাকা দশ আনা। নতুন বদলি হয়ে এসেই গুনাগার! স্টেশনটি আবার এমন যে উশুল করাবর জো নেই। পান আর মাছে কি হবে? তা ছাড়া এখন খাবার লোকও তো—

খাতা থেকে মুখ তুলেই ‘ছোটবাবু’ শ্রীরঞ্জন চৌধুরী হাঁকলেন, “এই ফত্রিঙ্গা-ফত্রি-উঃ! যেমন মশার ডাক, তেমনই ডাকছে বেটার নাক।”

ছোটবাবুর তামাকের অভ্যাস আছে।

পিছনে তার ঘরের দরজায় ফত্রিঙ্গা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমচ্ছিল। একে শীতকাল; তার ওপর রাত তখন দুটো। কিছুক্ষণ আগে ডাকগাড়ি ‘পাস’ হয়েছে, মালগাড়ীখানাও বিঘাটি স্টেশনে ধরে-ধরে। কাজেই ফত্রিঙ্গা নিশ্চিন্ত।

ছোটবাবু একবার ভাবলেন, নিজেই তামাকটুকু সেজে নেন। কিন্তু ইচ্ছাটা প্রবল হ’ল না। আবার খাতায় টিক দিতে আরম্ভ করলেন।

“এইতো টিকিটের হিসেব দিব্যি মিলে যাচ্ছে।” সহসা ছোটবাবুর শুষ্ক মুখের ওপর দিয়ে একটু বিষাদের হাসি খেলে গেল। মনে মনে বলেন, “তখন কি জানতাম, একদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার হয়ে চন্দনপুর স্টেশনেই বদলি হয়ে আসব। ওঃ! সে কত বছর আগেকার কথা! তখন এখানে এমন বাঁধানো প্ল্যাটফরম, পাকা স্টেশন ঘর, ওয়েটিংরুম—কিছুই ছিল না। মাঠের মাঝখানে একখানা ছোট খড়ের ঘর, তার চাটাইয়ের বেড়া। পিছনদিকে পাশাপাশি দুটো খাদ জলে ভরা। তাদের মধ্যে কলমি আর হেলঞ্চ বন। পাড়ের ওপর কাশের ঝাড়। খাদের ওপারে কোয়ার্টারস—দুটো খাদের মাঝ দিয়ে সেদিকে যাতায়াতের পথ। তার শেষে একটা বাঁকা নিম গাছ। প্ল্যাটফরমটা ছিল এত নিচু, ট্রেন থেকে নামবার সময় কয়েকবার ত পড়তে পড়তে রয়ে গেছি। সে সব দিন আর নেই! হাঃ–হাঃ—অক্ষয় আর আমি—’’

ফত্রিঙ্গা কম্বলটা গায়ে-মাথায় জড়িয়ে নিতে নিতে বললে—“কি বলছেন? ইসপিশ্যাল আসছে?”

শ্রীরঞ্জনবাবুর চমক ভাঙল। বললেন, “না। একটু তামাক দিবি বাপ?”

স্টেশন থেকে একটা কাঁচা-পাকা সড়ক চলে গেছে সোজা উত্তরে। সড়কটার দু’পাশে ঝোপঝাড়, জঙ্গল। তার মাঝে মাঝে চারণ খেজুর, শিমূল, আম ও বাবলা গাছ নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সড়কের মাঝে দুটি খাল, গরুর গাড়ির চাকায় তৈরি হয়েছে। দু'পাশে মাঠ, মাঠের শেষে গ্রাম। সড়ক ধরে ক্রোশদেড়েক ভাঙলেই চন্দনপুরের বিল। বিলটা শেষ হয়েছে একেবারে অক্ষয়দের গ্রাম মালাড়ার পূবে। ঐ মালাড়াতেই ছিল, শ্রীরঞ্জনবাবুর মামার বাড়ি।

ফত্রিঙ্গা তামাক এনে বলল, “নিন বাবু।”

শ্রীরঞ্জনবাবু হুঁকোটা নিয়ে নচে ধরে এক মনে টানতে লাগলেন; তার বা হাতখানা রইল খাতার ওপর। ক্রমে ধোঁয়ায় তার মুখের চারধার ঢেকে গেল।

“অক্ষয়টা-হাঃ হাঃ-একবার আখ-ক্ষেতে আখ ভাঙতে গিয়ে— কি রে অক্ষয়?—তুই? এই রাতে—? বস্ বস্। সে কি, দাঁড়িয়ে থাকবি?” শ্রীরঞ্জনবাবু আত্মহারা হয়ে পড়লেন।

অক্ষয় জিজ্ঞাসা করলে—“কবে এসেছিস?”

“দুটো রাতও কাটেনি। তোর চিঠি পেয়েছিলাম। যা গোলমাল গেল ক দিন! উত্তর দেওয়া হয়নি। দেখ দেখি ভাই কি গ্রহের ফের! সেই চন্দনপুর স্টেশনেই এলাম ছোটবাবু হয়ে? তারপর কি খবর? কিন্তু এই রাতে তুই?”

অক্ষয়ের আপাদ-মস্তক ঢাকা, কেবল মুখখানা খোলা। তার স্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখ দুটোকে আরও উজ্জ্বল বোধ হচ্ছে; বলেন—“রঞ্জন, তোর চুল সবই পেকে গেছে—”

“পাকবে না? কত বয়স হ’ল বল দেখি? তা ছাড়া—কিন্তু তোর চেহারা বেশ আছে। বসছিস না কেন?”

অক্ষয় টেবিলের কাছ থেকে হাত-কয়েক দূরে সরে গিয়ে টিকিট বাক্সের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। শ্রীরঞ্জনবাবুর মনে হ’ল, অক্ষয়ের ব্যবহারে আন্তরিকতা নেই, সে যেন একটু দূরে সরে গেছে; বললেন, “তামাক খা। ওহহ্‌! আমি ভুলেই গেছি, এই বদ অভ্যাসটা তুই করিসনি। হ্যাঁরে অক্ষয়! বিলের ধারে বটতলায় সেই পোড়া মন্দিরটা এখনও আছে? মাঠের ধারের সেই আমগাছ কটা? আমার মামাদের ভিটে?”

অক্ষয় ঘাড় নেড়ে জানালেন—হাঁ। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই সপরিবারে এসেছিস?”

‘‘নাঃ। নতুন জায়গা—সব দেশে। আমাদের দেশের কথা তোর মনে পড়ে?”

“হ্যাঁ। সেই চিঁড়ে, গুড়, নারকেল আর সকলের ওপর কাকীমার যত্ন এখনও ভুলতে পারিনি।”

মায়ের কথা মনে পড়ে গেল; শ্রীরঞ্জনবাবু একটা নিঃশ্বাস ফেললেন; তারপর বলেন—“যখন দেশে যাব ওদের আনতে, আসবার সময় তোর জন্য চিঁড়ে, গুড়, নারকোল এনে মালড়ায় গিয়ে দিয়ে আসবো।”

“কিন্তু আমি ত আর ওখানে নেই।”

“সে কি? কোথায় আছিস? তোর স্ত্রী ছেলে-মেয়ে—?”

“তারা সকলেই আছে। কেবল আমিই চলে এসেছি।”

“এই বয়সে রাগ করে বিবাগী হয়েছিস? কার ওপর রাগ, স্ত্রীর না ছেলের?”

“কারো ওপরেই আমার রাগ নেই। আর থাকতে পারলাম না।”

“কোথায় যাচ্ছিস? এ কি ছেলেমানুষি? সে হবে না—টিকিট ত আমার হাতে। ছাড়ছি না। বাড়ি না যাও, এখানে থাক। হতভাগারা এল বলে, তোর খোঁজে। আমি নিজে তোর সঙ্গে—”

অক্ষয় একটু হাসলেন; তাঁর চোখে-মুখে নির্লিপ্ত ভাব।

শ্রীরঞ্জনবাবু বললেন, “কোন গুরু পাকড়েছ বুঝি? তিনি কানে মন্ত্র দিয়েছেন, কা তব কান্তা…”

ঠিক তখনই টেলিফোন বেজে উঠল—ঠং-ঠুং-ঠং। বাইরে কোথায় কাকও ডাকছে। দূরে রেললাইনের ধার থেকে একপাল শিয়াল ডেকে উঠল—রাত শেষ হয়ে এল।

“দাঁড়া ভাই। কাজটা সারি”—ভোরের গাড়ির সময় হ’ল” বলে ছোটবাবু তাড়াতাড়ি উঠে হাত থেকে হুঁকোটা টেবিলের পায়ার গায়ে হেলান দিয়ে রেখে টেলিফোনের কাছে গেলেন। তারপর ফোন ধরে হাঁকলেন, “হ্যাঁ, কি? লেট হয়নি? আসছে? ওরে ফত্রিঙ্গা, এই ফতে! গাড়ির ঘণ্টা দে।”

সেখানকার কাজ সেরে টিকিট বাক্সের দিকে যেতে যেতে বললেন, “তারপর ব্যাপারটা কি খুলে বল তো।”

বলতে বলতে হঠাৎই পিছনে তাকিয়ে দেখেন, সেখানে অক্ষয় নেই! এদিক-ওদিক তাকালেন, কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না। দেখলেন, বাইরে যাবার দরজার কাছে বসে ফত্রিঙ্গা তার বিছানাটা গুটিয়ে নিচ্ছে। শ্রীরঞ্জনবাবুর বিস্ময়ের সীমা থাকল না। ঘরের দুটি দরজা, দুটি জানালাই ত বন্ধ। টিকিট দেবার ঘুলঘুলিটাও আঁটা।

শ্রীরঞ্জনবাবু ফত্রিঙ্গাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাবুটি কোথায় গেলেন দেখেছিস?”

“কৌন্ বাবু?”

“যে বাবু একটু আগে এসেছিলেন?”

“কৌনো বাবু ঘরমে ঘুসা নেহি”

শ্রীরঞ্জনবাবু তাড়াতাড়ি তার ঘরের মধ্যে গিয়ে ঘরখানা পরীক্ষা করে এলেন। সেখানেও অক্ষয় নেই!

ফত্রিঙ্গা ঘণ্টা দিচ্ছে। পয়েন্টসম্যান ফাগু এসে সিগনালের তালার চাবি নিয়ে গেল।

শ্রীরঞ্জনবাবু অন্যমনস্কর মত টিকিট বাসের ডালাটা খুললেন, টিকিট দেবার ঘুলঘুলিটার ঢাকা সরিয়ে নিলেন। তৎক্ষণাৎ সেখান দিয়ে একখানা কালো হাত ভেতরে এল। ওপাশ থেকে হাতের মালিক বললে, “বাবু, ষষ্টিপুর সাড়ে তিনখানা”

এরপর শোনা যেতে লাগল টাকা-পয়সার শব্দ, টিকেটে ছাপ দেবার আওয়াজ—ঘটাং—ঘটাং—ঘটাং…

ওদিক থেকে হাতের মালিক বললে, “বাবু! দুটো পয়সা কম নেন। গরীব মানুষ!”

“ধ্যাৎ! কৈ হে, আর কে আছে? এই সরে যাও ওখান থেকে।”

টিকিট দিতে দিতে শ্রীরঞ্জনবাবু নিজের মনেই বলে উঠলেন, “তখন নিশ্চয়ই আমার তন্দ্রা এসেছিল। তন্দ্রার ঘোরে স্বপ্ন দেখেছিলাম।”

স্থির করলেন, অক্ষয়কে তার আগমন-সংবাদ জানিয়ে চিঠি দেবেন। তবুও তিনি মনে শাস্তি পেলেন না।

ক্রমে টিকিট দেওয়া শেষ হ'ল। ওদিকে তখন পূব দিক ফরসা হয়ে এসেছে। গাড়ির হুইসিল শোনা গেল।

শ্রীরঞ্জনবাবু কম্ফর্টারের ওপর মাথায় গোল টুপি চড়িয়ে কলম হাতে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালেন। তাকিয়ে দেখলেন, গাড়ি হোম-সিগন্যাল পার হচ্ছে। ঐ ঝিকমিক করছে ইঞ্জিনের আলো।

আবার ঘণ্টা পড়ল। দেখতে দেখতে গাড়ি এসে থামল। যাত্রীরা উঠছে, নামছে, ছুটছে, চিৎকার করছে; দরজা বন্ধ হচ্ছে, খুলছে। চারধারে ব্যস্ততা ও শব্দ। শ্রীরঞ্জনবাবু গার্ডের গাড়ির কাছ থেকে মাথার ওপর হাত নেড়ে হাঁকলেন, “ঘণ্টা…”

ঘণ্টা পড়ল, গার্ড হুইসিল দিতে দিতে লণ্ঠন দোলাতে লাগল, ইনজিন হুইসিল দিয়ে সশব্দে চলতে আরম্ভ করল। শ্রীরঞ্জনবাবু জন-দুই যাত্রীর কাছ থেকে টিকিট সংগ্রহ করে স্টেশনঘরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন।

এদিকে পূবের আলো ততক্ষণে আকাশ বেয়ে পশ্চিমে পৌঁছেছে, নীচের অন্ধকার গলে পাতলা হয়ে উবে যাচ্ছে; কিছুদূরের মানুষকে বেশ চেনা যায়।

শ্রীরঞ্জনবাবু, দেখলেন, একটি যুবক, তার পাশে একটি কিশোরী, তাদের পাশে একজন লোক আসছে। লোকটার মাথায় বিছানা ও ট্রাঙ্ক। তারা সেই ট্রেন থেকেই নেমেছে। তারাও স্টেশন ঘরের দিকে আসছিল। তার গায়েই স্টেশন থেকে বের হবার দরজা।

তারা তিনজনে শ্রীরঞ্জনবাবুর কাছাকাছি হতেই তিনি তাদের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন। দেখেই বলে উঠলেন, “অক্ষয়ের জামাই না? ঐ ত ওর পাশে কমলা। আর ঐ যে ওদের রাখাল, মধু। নিশ্চয়ই অক্ষয় এসেছে। আমি স্বপ্ন দেখিনি। কিন্তু সে পালাল কেন?”

উঁচু গলায় বললে, “বাবাজী যে? ভাল ত? মা কমলা!”

অক্ষয়ের জামাতাবাবাজী, মেয়ে কমলাও এবার তার দিকে ভাল করে তাকাল।

জামাতাবাবাজী নমস্কার করে বললে, “আজ্ঞে হাঁ।”

কমলা তার মেয়ে গৌরীর বয়সী। গৌরী নেই। তিনি বলেন—“কেমন আছ মা? তোমার বাবা ত…”

কমলা তার পায়ের ধুলো নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তিনি দেখলেন, তার দু’চোখে জল টলটল করছে।

তিনি বিস্মিত ও ব্যথিত হয়ে বলে উঠলেন, “তোর চোখে জল কেন মা?”

জামাতাবাবাজী বললে—“জানেন না? সাত দিন হ’ল শ্বশুরমশায় স্বর্গারোহণ করেছেন—”

“সাত দিন হ’ল মারা গেছেন—”

“কিন্তু—আমি যে…

শ্রীরঞ্জনবাবুর মুখ দিয়ে আর একটি কথাও বার হ’ল না। ক্ষণিকের জন্য তিনি স্মৃতির মাঝে চেতনা হারিয়ে ফেললেন। সহসা ফত্রিঙ্গার ডাকে ফিরে দেখেন, জামাতাবাবাজীরা তিনজনে গেট পার হয়ে, পথের ধারে একখানা ছইওয়ালা গরুর গাড়ীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি আর সেখানে দাঁড়ালেন না; স্টেশনঘরের দিকে চলতে লাগলেন।

সেদিন কোয়ার্টারসে যাবার আগে তিনি এক টাকা সাড়ে তিন আনার হদিস পেলেন, কিন্তু অক্ষয়ের সঙ্গে নিশীথে সাক্ষাৎ, স্বপ্ন কি সত্য, তার মীমাংসা করতে পারলেন না।

 আপলোড: ২৩/১০/২০২০

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): অবর্তমান (বনফুল)

 

অবর্তমান

বনফুল

মস্তটা দিন বন্দুক কাঁধে করে একটা চখার পিছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। যাঁরা কখনও এ কার্য করেন নি তারা বুঝতে পারবেন না হয়তো যে, ব্যাপারটা ঠিক কী জাতীয়। ধূ-ধূ করছে বিরাট বালির চর, মাঝে মাঝে ঝাউগাছের ঝোপ, এক ধার দিয়ে শীতের শীর্ণ গঙ্গা বইছে। চারদিকে জনমানবের চিহ্ন নেই। হু-হু করে তীক্ষ্ণ হাওয়া বইছে একটা। কহল গাঁয়ের খেয়াঘাটে গঙ্গা পেরিয়ে প্রায় ক্রোশ দুই বালির চড়া ভেঙে আমি এই পারিপার্শ্বিকের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম সকালবেলা। সমস্ত দিন বন্দুক কাঁধে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বালির চড়া ভেঙে ভেঙে কতখানি যে হেঁটেছি, খেয়াঘাট থেকে কতদূরেই বা চলে এসেছি , তা খেয়াল ছিল না। তবে মনে হচ্ছিল, সারাজীবন ধরে যেন হাঁটছিই, অবিশ্রান্ত হেঁটে চলেছি। চতুর চখাটা কিছুতেই আমার বন্দুকের মধ্যে আসছে না, ক্রমাগত এড়িয়ে এড়িয়ে উড়ে পালাচ্ছে।

আমি এ অঞ্চলে আগন্তুক। এসেছি ছুটিতে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে। আমি নেশাখোর লোক। একটি আধটি নয়, তিনটি নেশা আছে আমার ভ্রমণ, সঙ্গীত এবং শিকার। এখানে এসে যেই শুনলাম খেয়াঘাট পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই গঙ্গায় পাখি পাওয়া যাবে, লোভ সামলাতে পারলাম না, বন্দুক কাঁধে করে বেরিয়ে পড়লাম। লোভ শুনে মনে করবেন না যে, আমি মাংস খাবার লোভেই পাখি মারতে বেরিয়েছি। তা নয়। আমি নিরামিষাশী। আলুভাতে ভাত পেলেই আমি সন্তুষ্ট।

খেয়াঘাট পেরিয়ে সকালের চরে এসে প্রথম যখন পৌঁছলাম, তখন হতাশ হয়ে পড়তে হল আমাকে। কোথায় পাখি। ধূ-ধূ করছে বালির চড়া, আর কোথাও কিছু নেই। গঙ্গার বুকে দু-একটা উড়ন্ত মাছরাঙা ছাড়া পাখি কোথায়! বন্দুক কাঁধে করে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় কাঁআঁ শব্দটা কানে এল। কয়ে চন্দ্রবিন্দু আকার আর অয়ে চন্দ্রবিন্দু আকার দিয়ে যে শব্দটা হয়, চখার শব্দটা ঠিক সে রকম নয়, তবে অনেকটা কাছাকাছি বটে। কাঁ–আঁ শুনেই বুঝলুম চখা আছে, কোথাও কাছে পিঠে। একটু এগিয়ে গিয়েই দেখি, হ্যাঁ ঠিক, চখাই বটে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম মাত্র একটি দেখে। চখারা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় থাকে। বুঝলাম, দম্পতির একটিকে কোন শিকারি আগেই শেষ করে গেছেন। এটির ভব-যন্ত্রণা আমাকেই ঘোচাতে হবে। সাবধানে এগুতে লাগলাম।

কাঁ আঁ—

চখা উড়ে গেল। উড়বে জানতাম। চখা মারা সহজ নয়। দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। বেশ খানিকক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে আবার সাবধানে এগুতে লাগলাম। কাছাকাছি এসেছি, বন্দুকটি বাগিয়ে বসতে যাব, আর অমনি কাঁআঁ—

উড়ে গেল। বিরক্ত হলে চলবে না, চখা শিকার করতে হলে ধৈর্য চাই। এবার চখাটা একটু কাছেই বসল। আমিও বসলাম। উপর্যুপরি তাড়া করা ঠিক নয় একটু বসুক। একটু পরেই উঠলাম আবার। আবার ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম, কিন্তু উল্টো দিকে। পাখিটা মনে করুক যে, আমি তার আশা ছেড়ে দিয়েই চলে যাচ্ছি যেন। কিছুদূর গিয়ে ও-ধার দিয়ে ঘুরে তারপর বিপরীত দিক দিয়ে কাছে আসা যাবে। বেশ কিছুদূর ঘুরতে হল—প্রায় মাইলখানেক। গুড়ি মেরে মেরে খুব কাছেও এসে পড়লাম। কিন্তু তাগ করে ঘোড়াটি যেই টিপতে যাব, আর অমনি কাঁআঁ।

ফের উড়ল। উড়তেই লাগল অনেকক্ষণ ধরে। কিছুতেই আর বসে না। অনেকক্ষণ পরে বসল যদি, কিন্তু এমন একটা বেখাপ্পা জায়গায় বসল যে, সেখানে যাওয়া মুশকিল। যাওয়া যায়, কিন্তু গেলেই দেখতে পাবে। আমার কেমন রোখ চড়ে গেল, মারতেই হবে পাখিটাকে। সোজা এগিয়ে চললাম। আমি ভেবেছিলাম, একটু এগুলেই উড়বে, কিন্তু উড়লো না। যতক্ষণ না কাছাকাছি হলাম, ঠায় বসে রইল। মনে হল, অসম্ভব বুঝি সম্ভব হয়, কিন্তু যেই বন্দুকটি তুলেছি আর অমনি কাঁআঁ।

এবারেও এমন জায়গায় বসল যার কাছে-পিঠে কোন আড়াল-আবডাল নেই চতুর্দিকেই ফাঁকা। কিছুতেই বন্দুকের নাগালের মধ্যে পাওয়া যাবে না। বাধ্য হয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে উড়িয়ে দিতে হল। এবার গিয়ে বেশ ভাল জায়গায় বসল। একটা ঝাউবনের আড়ালে আড়ালে গিয়ে খুব কাছাকাছিও আসতে পারলাম এত কাছাকাছি যে তার পালকগুলো পর্যন্ত দেখা যেতে লাগল। ফায়ার করলাম।

কাঁআঁ—কাঁআঁ—

লাগল না। ঝোপে-ঝোপে যা দু-একটা ছোট পাখি ছিল তারাও উড়ল, মাছরাঙাগুলোও চেঁচাতে শুরু করে দিলে। সমস্ত ব্যাপারটা থিতুতে আধ ঘণ্টারও ওপর লাগল। নদীর ঠিক বাঁকের মুখটাতেই বসল আবার চখাটা গিয়ে।

আমি বসেছিলুম একটা বালির ঢিপির উপর, মুশকিল হল—উঠে দাঁড়ালেই দেখতে পাবে। উঠলাম না। শুয়ে পড়ে গিরগিটির মতো বুকে হেঁটে হেঁটে এগুতে লাগলাম। কিন্তু কিছুদূর গেছি, আর অমনি কাঁআঁ—

আমার মাথাটাই দেখা গেল, না বালির স্তর দিয়ে কোন রকম স্পন্দনই গিয়ে পৌঁছল। তার কাছে, তা বলতে পারি না। উঠে দাঁড়ালাম। রোক আরও চড়ল।

হঠাৎ নজরে পড়ল সূর্য অস্ত যাচ্ছে। নদীর জল রক্ত-রাঙা। পাখিটা ও-পারের চরে গিয়ে বসেছে। সমস্ত দিন আমিও ওকে বিশ্রাম দিইনি। ও-ও আমাকে দেয়নি। এখন দুজনে দুপারে। চুপ করে রইলাম।

সূর্য ডুবে গেল। অস্তমান সূর্য-কিরণে গঙ্গার জলটা যত জ্বলন্ত লাল দেখাচ্ছিল, সূর্য ডুবে যাওয়াতে ততটা আর রইল না। আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে স্নিগ্ধ হয়ে উঠল চতুর্দিক। সমস্ত অন্তরেও কেমন যেন একটা বিষণ্ণ বৈরাগ্য জেগে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে। পূরবী রাগিণী যেন মূর্ত হয়ে উঠল আকাশে, বাতাসে, নদীতরঙ্গে। হঠাৎ মনে পড়ল বাড়ি ফিরতে হবে।।

কত রাত হয়েছে জানি না।

ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি গঙ্গার চরে চরে। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। মধ্যগগনে পূর্ণিমার চাঁদ চতুর্দিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে শেষে বসলাম একটা উঁচু জায়গা দেখে। অনেকক্ষণ চুপ করে বসেই রইলাম। এমন একা জীবনে আর কখনও পড়িনি। প্রথম প্রথম একটু ভয় করছিল যদিও, কিন্তু খানিকক্ষণ পরে ভয়ের বদলে মোহ এসে আমার সমস্ত প্রাণ মন সত্তা অধিকার করে বসল। আমি মুগ্ধ হয়ে বসে রইলাম। মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। মনে হল, কত জায়গায় কতভাবে ঘুরেছি, প্রকৃতির এমন রূপ তো আর কখনও চোখে পড়েনি। রূপ নিশ্চয়ই ছিল, আমার চোখে পড়ে নি। নিজেকে কেমন যেন বঞ্চিত মনে হতে লাগল। তারপর সহসা মনে হল, আজীবন সব দিক দিয়েই আমি বঞ্চিত। জীবনের কোনও সাধটাই কি পুরোপুরি পূর্ণ হয়েছে? জীবনের তিনটি শখ ছিল ভ্রমণ, সঙ্গীত, শিকার। ভ্রমণ করেছি বটে ট্রেনে ষ্টীমারে চেপে এখানে ওখানে গেছি কিন্তু তাকে কি ভ্রমণ বলে? হিমালয়ের উচ্চ চূড়ায়, সাহারার দিগন্ত প্রসারিত অনিশ্চয়তায়, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রের তরঙ্গে, হিমশীতল মেরুপ্রদেশের ভাসমান তুষার-পর্বতশৃঙ্গে যদি না ভ্রমণ করতে পারলাম তাহলে আর কী হল। সঙ্গীতেও ব্যর্থকাম হয়েছি। সারেগামা সেধেছি বটে; কিন্তু সঙ্গীতের আসল রূপটি আলেয়ার মত চিরকাল এড়িয়ে এড়িয়ে গেছে আমাকে। সেদিন অত চেষ্টা করেও বাগেশ্রীর করুণগম্ভীর রূপটি কিছুতেই ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না সেতারে।

ঠিক ঘাটে ঠিক ভাবেই আঙ্গুল পড়েছিল, কিন্তু সেই সুরটি ফুটল না, যাতে আত্মসম্মানী গম্ভীর ব্যক্তি নির্জন-রোদনের অবাঙময় বেদন মূর্ত হয়। শিকারই বা কী এমন করেছি জীবনে? সিংহ হাতি বাঘ গণ্ডার কিছুই মারিনি। মেরেছি পাখি আর হরিণ। আজ তো সামান্য একটা চখার কাছেই হার মানতে হল।

কাঁআঁ—কাঁআঁ—কাঁআঁ—

চমকে উঠলাম। ঠিক মাথার উপরে চখাটা চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখিরা সাধারণত রাত্রে তো ওড়ে না হয়তো ভয় পেয়েছে কোনরকমে। উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলাম।

কাঁআঁ—কাঁআঁ—

আরও খানিকটা নেবে এল। হঠাৎ বন্দুকটা তুলে ফায়ার করে দিলাম।

কাঁআঁ—কাঁআঁ—কাঁআঁ—

লেগেছে ঠিক। পাখিটা ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়ল মাঝগঙ্গায়। উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম, ভেসে যাচ্ছে।

যাক। জীবনে যা বরাবর হয়েছে, এবারও তাই হল। পেয়েও পেলাম না। সত্যি, জীবনে কখনই কিছু পাইনি, নাগালের মধ্যে এসেও সব ফসকে গেছে।

চুপ করে বসে ছিলাম।

চতুর্দিকে ধূ ধূ করছে বালি, গঙ্গার কুলুধ্বনি অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে, জ্যোৎস্নায় ফিনিক ফুটছে। শিকার, চখা, বন্দুক, সমস্ত দিনের শ্রান্তি কোন কিছুর কথাই মনে হচ্ছিল না তখন, একটা নীরব সুরের সাগরে ধীরে ধীরে ভেসে চলেছিলাম। হঠাৎ চমকে উঠলাম। দীর্ঘকায় ঋজুদেহ এক ব্যক্তি নদী থেকে উঠে ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে গামছা দিয়ে গা মুছতে লাগলেন। অবাক হয়ে গেলাম। কোথা থেকে এলেন ইনি, কখন বা নদীতে নাবলেন, কিছুই দেখতে পাইনি।

একটু ইতস্ততের পর জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কে?

লোকটি এতক্ষণ আমাকে লক্ষই করেন নি।

আমার কথায় মন্ত্রোচ্চারণ থেমে গেল, ফিরে আমার দিকে চেয়ে রইলেন ক্ষণকাল তারপর বললেন, আমি এখানেই থাকি। আপনিই আগন্তুক, আপনিই পরিচয় দিন।

পরিচয় দিলাম।

ও, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন আপনি? আসুন আমার সঙ্গে, কাছেই আমার আস্তানা।

দীর্ঘকায় ঋজুদেহ পুরুষটি অগ্রগামী হলেন আমি তার অনুসরণ করলাম। একটু দূর গিয়েই দেখি একটি ছোট্ট কুটির। আশ্চর্য হয়ে গেলাম, সমস্ত দিন এ অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছি, এটা চোখে পড়ে নি আমার। ছোট্ট কুটিরটি যেন ছবির মতন, সামনে পরিচ্ছন্ন প্রাঙ্গণ, চতুর্দিক রজনীগন্ধার গাছ, অজস্র ফুল। অনাবিল জ্যোৎস্নায় ধরণীর অন্তরের আনন্দ সহসা যেন পূষ্পায়িত হয়ে উঠেছে গুচ্ছ গুচ্ছ রজনীগন্ধার উর্ধ্বমুখ বিকাশে। মৃদু সৌরভে চতুর্দিক আচ্ছন্ন। আমিও আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি এসেই ঘরের ভিতরে ঢুকেছিলেন। একটু পরেই বেরিয়ে এলেন এবং শতরঞ্জি গোছের কী একটা পাততে লাগলেন।

বসুন।

বসে দেখলাম শতরঞ্জি নয় গালিচা। খুব দামী নরম গালিচা। তিনিও এক প্রান্তে এসে বসলেন। বলা বাহুল্য, আমার কৌতূহল ক্রমশই বাড়ছিল। তবে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম, তিনিও চুপ করে রইলেন। শেষে আমাকেই কথা কইতে হল।

সমস্ত দিন এ অঞ্চলে ঘুরেছি। কিন্তু আপনার দেখা পাই নি কেন ভেবে আশ্চর্য লাগছে।

সব সময় সব জিনিস কি দেখা যায়?

মুখের দিকে চেয়ে ভয় হল, চোখ দুটো জ্বলছে মানুষের নয়, যেন বাঘের চোখ। একটা গল্প শুনুন তা হলে। রাজা রামপ্রতাপ রায়ের নাম শুনেছেন?

না।

শোনবার কথাও নয়। দুজন রামপ্রতাপ ছিল, দুজনেই জমিদার, একজন সুদখোর, আর একজন সুর-খোর।

সুর-খোর?

হ্যাঁ, ও-রকম সুর-পাগল লোক ও-অঞ্চলে আর ছিল না। যত বিখ্যাত ওস্তাদদের আড্ডা ছিল তাঁর বাড়িতে। আমার অবশ্য এসব শোনা কথা। আমার পাঞ্জাবে জন্ম, পাঞ্জাবী ওস্তাদের কাছেই গান বাজনা শিখেছিলুম। বাংলাদেশে এসে শুনলুম, রামপ্রতাপ নামে এক জন গুণী জমিদার আছেন, যিনি সুরের প্রকৃত সমঝদার। প্রকৃত গুণীকে কখনও ব্যর্থমনোরথ হতে হয়নি তার কাছে, গাড়িতে একজনের মুখে কথায় কথায় শুনলুম। তখনই যদি তাঁকে ঠিকানাটাও জিজ্ঞেস করি, তা হলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়, কিন্তু তা না করে আমি সপ্তাহখানেক পরে আর একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, রাজা রামপ্রতাপ রায় কোথায় থাকেন? তিনি বলে দিলেন সুদখোর রামপ্রতাপের ঠিকানা। ডানকুনি স্টেশনে নেবে দশ ক্রোশ হাঁটলে তবে নাকি তাঁর নাগাল পাওয়া যাবে। একদিন বেরিয়ে পড়লাম তার উদ্দেশ্যে। ডানকুনি স্টেশনে যখন নাবলাম, তখন বেশ রাত হয়েছে। সেদিনও পূর্ণিমা। স্টেশনে আর একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। সুদখোর রামপ্রতাপ ও অঞ্চলে প্রসিদ্ধ লোক, সবাই চেনে। যাকে জিজ্ঞেস করলুম, সে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বললে, সোজা চলে যান। চলতে লাগলাম। কতক্ষণ চলেছিলাম তা ঠিক বলতে পারি না। খানিকক্ষণ পরে দেখলাম একটা বিরাট প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি, চারিদিকে কেবল মাঠ আর মাঠ, কোথাও কিছু নেই। মনে হল যেন শেষও নেই।

কিছুদূরে গিয়েই হঠাৎ সামনে প্রকাণ্ড রাজবাড়িটা দেখা গেল, যেন মন্ত্রবলে আবির্ভূত হল সাদা ধবধব করছে। মনে হল যেন মর্মর পাথর দিয়ে তৈরি। মিনার, মিনারেট গম্বুজ, সিংহদ্বার সমস্ত দেখা গেল ক্রমশ। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ, তারপর এগিয়ে গেলাম। প্রকাণ্ড সিংহদ্বারের পাশে দেখি দুজন বিরাটকায় দারোয়ান বসে আছে, দুজনেই নিবিষ্টচিত্তে গোঁফ পাকাচ্ছে বসে। ভিতরে ঢুকব কিনা জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ কোন উত্তরই দিল না, গোঁফই পাকাতে লাগল। একটু ইতস্তত করে শেষে ঢুকে পড়লাম, তারা বাধা দিলে না। ভিতরে ঢুকে দেখি বিরাট ব্যাপার, বিশাল জমিদারবাড়ি জমজম করছে, প্রকাণ্ড কাছারি বাড়িতে বসে আছে সারি সারি গোমস্তারা। কেউ লিখছে, কেউ টাকা গুনছে, কেউ কেউ কানে কলম খুঁজে খাতার দিকে চেয়ে আছে, সবারই গম্ভীর মুখ। সামনে চত্বরে বসে আছে অসংখ্য প্রজা সারি সারি। সবাই কিন্তু চুপচাপ, কারও মুখে টু শব্দটি নেই। আমি তানপুরা ঘাড়ে করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম, কেউ আমার দিকে ফিরেও চাইলে না, আমার ও সাহস হল না কাউকে কোন কথা জিজ্ঞেস করতে, আমি ঘুরেই বেড়াতে লাগলাম। আমার মনের ইচ্ছা রাজা রামপ্রতাপকে গান শোনাব, কিন্তু হঠাৎ দেখতে পেলাম, কিছুদূরে ছোট্ট একটা বাগান রয়েছে, বাগানের মধ্যে ধবধবে সাদা মার্বেল পাথরের উঁচু চৌতারা, আর সেই চৌতারার উপরে কে একজন ধবধবে সাদা তাকিয়া ঠেস দিয়ে প্রকাণ্ড একটা গড়গড়ায় তামাকে খাচ্ছেন। গড়গড়ার কুণ্ডলী-পাকানো নলের জরিগুলো জ্যোৎস্নায় চকমক করছে। বাগানে ছোট্ট একটি একটি গেট, গেটের দু’ধারে উর্দি-চাপরাস-পরা দুজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে ঠিক যেন পাথরের প্রতিমূর্তি। কেমন করে জানি না, আমার দৃঢ় ধারণা হল, ইনিই রাজা রামপ্রতাপ। এগিয়ে গেলাম। দারোয়ান দুজন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, বাধা দিলে না। রাজা রামপ্রতাপের কাছাকাছি এসে ঝুঁকে প্রণাম করলাম একবার।

তিনি গম্ভীরভাবে মাথাটি নাড়লেন একবার শুধু। আস্তে আস্তে বললাম, হুজুরকে গান শোনাব বলে এসেছি, যদি হুকুম করেন—

তিনি সোজা হয়ে উঠে বসলেন, হাতের ইঙ্গিত আমাকেও বসতে বললেন। তারপর কখন যে আমি দরবারী কানাড়ার আলাপ শুরু করেছি আর কতক্ষণ ধরে যে সে আলাপ চলেছে তা আমার কিছু মনে নেই। যখন হুঁশ হল তখন দেখি, একছড়া মুক্তোর মালা তিনি আমার গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন। মালাটা দেখবেন? কুটিরের ভিতর ঢুকে গেলেন তিনি, পরমুহূর্তেই তিনি বেরিয়ে এলেন একছড়া মুক্তোর মালা নিয়ে। অমন সুন্দর এবং অত বড় বড় মুক্তো আমি আর দেখি নি কখনও।

তারপর?

আমাকে মালা পরিয়ে দিয়ে তিনি আস্তে আস্তে উঠে গেলেন। আমি চুপ করে বসেই রইলাম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কিছু মনে নেই। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি, রাজবাড়ি কাছারি চৌতারা লোকজন কোথাও কিছু নেই, ফাঁকা মাঠের মাঝখানে আমি একা শুয়ে ঘুমচ্ছি।

একা! কী রকম?—সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলাম।

হ্যাঁ। ফাঁকা মাঠের মাঝখানে একা কেউ নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, গুণী রাজা রামপ্রতাপ অনেকদিন হল মারা গেছেন। বেঁচে আছে সেই সুদখোর ব্যাটা। তার বাড়ির পথ সবাই আমাকে বলে দিয়েছিল। কিন্তু আমার মনের একান্ত ইচ্ছে ছিল গুণী রামপ্রতাপকে গান শোনাবার, তাই তিনি মাঠের মাঝখানে আমাকে দেখা দিয়ে আমার গান শুনে বকশিশ দিয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলাম। কতক্ষণ তা মনে নেই।

হঠাৎ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, গান শুনবেন?

যদি আপনার অসুবিধে না হয়—

অসুবিধে আবার কী? সুরের সাধনা করবার জন্যেই আমি নির্জনবাস করছি—

আবার উঠে গেলেন। কুটিরের ভিতর থেকে বিরাট এক তানপুরা বার করে বললেন, বাগেশ্রী আলাপ করি শুনুন।

শুরু হয়ে গেল বাগেশ্রী। ওরকম বাগেশ্রীর আলাপ আমি কখনও শুনি নি। যা নিজে আমি কখনও আয়ত্ত করতে পারি নি কিন্তু আয়ত্ত করতে চেয়েছিলাম তাই যেন শুনলাম আজ। কতক্ষণ শুনেছিলাম মনে নেই, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাও জানি না। ঘুম ভাঙল যখন তখন দেখি, আমি সেই ধু ধু বালির চড়ায় একা শুয়ে আছিস কোথাও কেউ নেই। উঠে বসলাম। উঠতেই নজরে পড়লো চখাটা চরে বেড়াচ্ছে, মরে নি।

আমরা তিনজনেই সবিস্ময়ে ভদ্রলোকের গল্পটা রুদ্ধশ্বাসে শুনিতেছিলাম। শিকার উপলক্ষেই আমরা এ অঞ্চলে আসিয়া সন্ধ্যাবেলা এই ডাকবাংলায় আশ্রয় লইয়াছি। পাশের ঘরেই ভদ্রলোক ছিলেন। আলাপ হইলে আমরা শিকারি শুনিয়া তিনি নিজের এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার গল্পটি আমাদের বলিলেন। অদ্ভুত অভিজ্ঞতাই বটে। জিজ্ঞাসা করিলাম, তারপর?

তারপর আর কিছু নেই। রাত হয়েছে, এবার শুতে যান, আপনাদের তো আবার খুব ভোরেই উঠতে হবে। আমারও ঘুম পাচ্ছে—

এই বলিয়া তিনি আস্তে আস্তে উঠিয়া নিজের ঘরে প্রবেশ করিলেন। আমরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। তাহার পর হঠাৎ আমার কৌতূহল হইল, কোন অঞ্চলের গঙ্গার চরে এই কাণ্ড ঘটিয়াছিল জানিতে পারিলে আমরাও একবার জায়গাটা দেখিয়া আসিতাম। জিজ্ঞাসা করিবার জন্য পাশের ঘরে ঢুকিয়া দেখি, ঘরে কেহ নাই। চতুর্দিক দেখিলাম, কেহ নাই।

ডাকবাংলার চাপরাসিকে জাগাইয়া প্রশ্ন করিলাম, পাশের ঘরে যে ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি কোথাকার লোক? চাপরাসি উত্তর দিল, পাশের ঘরে তো কোন লোক নাই, গত দুই সপ্তাহের মধ্যে এখানে আর কেহ আসে নাই। এ ডাকবাংলায় কেহ বড় একটা আসিতে চায় না।

বলিয়া সে অদ্ভুত একটা হাসি হাসিল।

আপলোড: ১১/১০/২০২০

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী (হেমেন্দ্রকুমার রায়)

 
মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী

হেমেন্দ্রকুমার রায়

(১)

মি ঔপন্যাসিক। কেবল এইটুকু বললেই সব বলা হয় না, আমি উপন্যাস লিখে টাকা রোজগার করি অর্থাৎ আমি যদি উপন্যাস না লিখি তাহলে আমার পেটও চলবে না। লেখা আমার পেশা।

কিন্তু এ পেশা বুঝি আর চলে না। বাড়িতে রোজ এত লোকের ভিড় মাসিকপত্রের সম্পাদকদের তাগাদা, চেনা-অচেনা লোকের আনাগোনা, বন্ধুবান্ধবদের তাস-দাবার আড্ডা, এইসব সামলাতে-সামলাতেই প্রতিদিন কেটে যায়। যখন একলা হওয়ার সময় পাই তখন আসে ঘুমের সময়।

কাজেই কিছুদিনের জন্যে কলকাতা ছাড়তে হল। স্থির করলুম অন্তত একখানা উপন্যাস না লিখে আর কলকাতায় ফিরব না। বিদেশে নিশ্চয়ই বাসায় এত চেনা-অচেনা লোকের ভিড় হবে না।

সিধে চলে গেলুম ঝাঁঝা জংশনে। একখানি ছোটখাটো বাংলো ভাড়া নিলুম। সকালে ও বিকালে বেরিয়ে বেড়াই, দুপুর ও সন্ধ্যা বেলাটা কেটে যায় উপন্যাস লেখায়।

ভিড়ের ভয়ে বিদেশে পালিয়ে এলেও মানুষের সঙ্গ বিনা মানুষের প্রাণ বাঁচে না।। ঝাঁঝায় এসেও তিন-চারজন লোকের সঙ্গে আমার অল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠতা হল। একজন হচ্ছেন মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী। তিনি বিধবা, তাঁর স্বামী পেশোয়ারে কাজ করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি ঝাঁঝায় এসে বাস করছেন। তাঁর সন্তানাদি কেউ নেই। ধর্মে তিনি খ্রিস্টান।

আমার আর একজন নতুন বন্ধুর নাম অমূল্যবাবু। এ ভদ্রলোকের বয়স হবে বছর পঞ্চাশ। কলকাতার কোনও কলেজে প্রফেসারি করতেন, এখন অবকাশ নিয়ে এইখানে বসেই লেখাপড়া নিয়ে দিন কাটিয়ে দেন। অমূল্যবাবু পরলোক-তত্ত্ব নিয়ে সারাজীবনই যথেষ্ট আলোচনা করেছেন, মৃত্যুর পরে জীবের কী অবস্থা হয় তার মুখে সর্বদাই সেই কথা শুনতে পাওয়া যায়।

এখানকার রেলের ডাক্তার গোবিন্দবাবুর সঙ্গেও আলাপ হল। তিনি খুব সাদাসিধে ভালোমানুষ লোক এবং সন্ধ্যা হলেই ভূতের ভয়ে কাতর হয়ে পড়েন। সূর্যাস্তের পর তিনি প্রাণান্তেও অমূল্যবাবুর বাড়ির চৌকাঠ মাড়াতে রাজি হন না, কারণ পাছে তাকে কাছে পেয়ে অমূল্যবাবু দু-চারটে পরলোকের কাহিনি শুনিয়ে দেন।

(২)

সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আমি অমূল্যবাবুর সঙ্গে বসে বসে গল্প করছিলুম। কথা হচ্ছিল পৃথিবীতে সত্য-সত্যই পিশাচের অস্তিত্ব আছে কিনা?

অমূল্যবাবুর বিশ্বাস, পৃথিবীতে সেকালেও পিশাচ ছিল, একালেও আছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘পিশাচ কাকে বলে?’

অমূল্যবাবু বললেন, ‘প্রেতাত্মাদের আমাদের মতো দেহ নেই একথা তুমি জান না। দেহ না থাকলেও দুষ্ট প্রেতাত্মাদের আকাঙ্ক্ষা প্রায়ই প্রবল হয়ে থাকে। কিন্তু দেহের অভাবে তারা সে আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারে না। তাই অনেক সময় দুষ্ট প্রেতাত্মারা মানুষের অরক্ষিত মৃতদেহের ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন সেই মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে উঠে জীবিত মানুষদের ধরে রক্তশোষণ করে। এই জীবন্ত মৃতদেহগুলোই পিশাচ।’

অমূল্যবাবু এমন দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলি বললেন যে, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে। উঠল।

আমি বললুম, ‘প্রায়ই শুনতে পাই অমুক লোক রক্তস্বল্পতা রোগে মারা গিয়েছে। আপনি কি বলতে চান যে পিশাচরাই তাদের মৃত্যুর কারণ?’

অমূল্যবাবু বললেন, ‘অনেক সময় হতেও পারে, অনেক সময় নাও হতে পারে।’

ঠিক এই সময়ই মাঝবয়সি মোটাসোটা মিসেস কুমুদিনীদেবী অমূল্যবাবুর বাইরের ঘরে এসে ঢুকলেন। ঢুকেই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘কীসের গল্প হচ্ছে?’

আমি বললুম, ‘অমূল্যবাবু আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছেন।’

কুমুদিনী একখানা চেয়ারের ওপর বসে পড়ে বললেন, ‘ও, ভূতের গল্প বুঝি? বেশ, বেশ, ভূতের গল্প শুনে ভয় পেতে আমি ভালোবাসি! অমূল্যবাবু, আমাকে একটা ভয়ানক ভূতের গল্প বলুন না!’

অমূল্যবাবু বললেন, ‘ভয়ানক ভূত কাকে বলে আমি তা জানি না। তবে আজ আমি পিশাচের গল্প করছিলুম বটে।’

কুমুদিনী খানিকক্ষণ নীরবে অমূল্যবাবুর মুখের পানে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘আচ্ছা অমূল্যবাবু, পিশাচের কথা সত্যিই আপনি বিশ্বাস করেন কি?’

অমূল্যবাবু গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘সত্যি বিশ্বাস করি। খালি তাই নয়, আমার ধারণা সম্প্রতি এই ঝাঁঝাতেই বোধহয় পিশাচের উপদ্রব শুরু হয়েছে।’

আমি সচমকে অমূল্যবাবুর মুখের দিকে মুখ তুলে তাকালুম।

কুমুদিনীরও মুখ ভয়ে ম্লান হয়ে গেল। কিন্তু সে-ভাবটা সামলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনার এমন গাঁজাখুরি ধারণার কারণ কি শুনি?’

অমূল্যবাবু স্থিরভাবেই বললেন, ‘সম্প্রতি এখানে রক্তস্বল্পতা রোগে মৃত্যুর হার বড় বেড়ে উঠেছে। এর কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।’

কুমুদিনী উচ্চস্বরে হাসতে-হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বেশ তো অমূল্যবাবু, আপনি একটা পিশাচকে বন্দী করবার চেষ্টা করুন না!’

অমূল্যবাবু দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘হুম্‌ সেই চেষ্টাই করব।’

ভূত না মানলেও ভূতের ভয় যে ছাড়ে না, অমূল্যবাবুর ওখান হতে সেদিন আসতে-আসতে সে প্রমাণটা ভালো করেই পেলুম। সন্ধ্যার অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ফিরতে-ফিরতে প্রত্যেক আনাচে-কানাচে মনে হতে লাগল, যেন সত্য-সত্যই কোনও জীবন্ত মৃতদেহ আমার দিকে লক্ষ্য স্থির করে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।

(৩)

অমূল্যবাবু প্রতিদিন সকালে আমার বাসায় এসে চা পান করতেন।

সেদিন সকালেও বাংলোর বারান্দায় বসে আমরা দুজনে চা পান করছি, এমন সময়ে দেখলুম সামনের পথ দিয়ে ডাক্তার গোবিন্দবাবু কোথায় যাচ্ছেন।

আমি চেঁচিয়ে তাকে এক পেয়ালা চা পান করবার জন্যে আহ্বান করলুম।

গোবিন্দবাবু কাছে এসে বললেন, ‘চা পান করতে আমি রাজি আছি, কিন্তু ভায়া, শিগগির! আমার একটুও দেরি করবার সময় নেই!’

আমি বললুম, ‘কেন, আপনার এত তাড়াতাড়ি কিসের?’

গোবিন্দবাবু বললেন, ‘মিসেস কুমুদিনী চৌধুরীর মালীর ছেলের ভারি অসুখ! বোধহয় বাঁচবে না।’

জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কী অসুখ?’

‘যা শুনেছি অ্যানিমিয়া বলেই মনে হচ্ছে।’

অমূল্যবাবু চা পান করতে করতে হঠাৎ পেয়ালাটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ডাক্তার, ঝাঁঝায় এত অ্যানিমিয়ার বাড়াবাড়ির কারণ কী বলতে পারো?’

গোবিন্দবাবু বললেন, ‘না। কিন্তু এই রোগের এতটা বাড়াবাড়ি দেখে আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেছি!’

অমূল্যবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মিসেস কুমুদিনী চৌধুরীর মালীর ছেলেকে আমি জানি। তার নাম গদাধর, সে রোজ আমাকে ফুল দিয়ে যায়। তিনদিন আগেও তাকে আমি দেখেছি, জোয়ান সোমত্ত ছেলে! আর তুমি বলছ ডাক্তার, এরই মধ্যে তার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। অ্যানিমিয়া রোগে এত তাড়াতাড়ি কারুর অবস্থা খারাপ হয় না। চল ডাক্তার, তোমার সঙ্গে আমরাও গিয়ে গদাধরকে একবার দেখে আসি।’

আমার বাংলো থেকে মিসেস চৌধুরীর বাংলোয় যেতে চার-পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। মিসেস চৌধুরীর বাগানের এক কোণে মালীর ঘর। আমরা সকলে গিয়ে সেখানে উপস্থিত হলুম।

ঘরের ভিতরে একপাশে বুড়ো মালী মাথায় হাত দিয়ে ম্লানমুখে বসে আছে। গদাধর শুয়ে আছে একখানা চৌকির ওপরে। তার মুখ এমন বিবর্ণ ও রক্তশূন্য যে দেখলেই মনে হয়, মৃত্যুর আর বেশি দেরি নেই।

ডাক্তারবাবু তাকে পরীক্ষা করে চুপি-চুপি আমাদের বললেন ‘আজকের রাত বোধহয় কাটবে না।’

অমূল্যবাবু গদাধরের পাশে গিয়ে বসলেন। তারপর রোগীর গায়ের কাপড়টা খুলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কী দেখতে লাগলেন। খানিকক্ষণ পরে গদাধরের গলা ও বুকের মাঝখানে একটা জায়গার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, ‘ডাক্তার, এটা কিসের দাগ?’

গোবিন্দবাবু বললেন, ‘ওটা ক্ষতচিহ্ন বলেই মনে হচ্ছে। যা নোংরা ঘর, ইঁদুর-টিদুর কামড়েছে বোধহয়।’

অমূল্যবাবু গদাধরের বাপকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার ছেলেকে সেবা করে কে?’

বুড়ো মালী বললে, ‘বাবু, গিন্নিমা (অর্থাৎ মিসেস চৌধুরী) গদাধরকে বড় ভালোবাসেন, ঠিক নিজের ছেলের মতোন। ওকে দেখাশুনো করেন তিনিই, ওর জন্যে দিনে তার বিশ্রাম নেই রাতে তার ঘুম নেই।’

অমূল্যবাবু উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘রোগীর ভালোরকম সেবা–যত্ন হচ্ছে না। গদাধরকে আমি আমার বাড়িতে নিয়ে যাব! ডাক্তার, তোমার রেলের দু-চারজন কুলিকে ডাকো, গদাধরকে তারা এখনি আমার বাড়িতে নিয়ে চলুক। আমার বিশ্বাস একে আমি নিশ্চয় বাঁচাতে পারব।’

অমূল্যবাবুর এই অদ্ভুত বিশ্বাসের কারণ কী আমরা বুঝতে পারলুম না। রোগ হয়েছে রোগীর দেহে, এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি নিয়ে গেলে তার কী উপকার হতে পারে? যাই হোক, তাঁর কথামতই কাজ করা হল।

গদাধরকে যখন বাগানের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই সময় মিসেস কুমুদিনী তাঁর বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের দেখে নেমে এসে তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘একি ব্যাপার, গদাধরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’

অমূল্যবাবু বললেন, ‘আমার বাড়িতে। এখানে ওর ঠিকমত সেবা আর চিকিৎসা হচ্ছে না।’

কুমুদিনীর দুই চোখে একটা ক্রোধের ভাব ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। ধীরে-ধীরে তিনি বললেন, ‘বেশ, আপনারা যা ভালো বোঝেন করুন। গদাধরের আরাম হলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না।’

(৪)

সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। গাছপালার আর্তনাদ ও মেঘের গর্জনের সঙ্গে-সঙ্গে পাহাড়ের ওপর থেকে হুড়হুড় করে বৃষ্টিধারা নেমে আসার শব্দ। শুনতে-শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়লুম।

অনেক রাতে আচম্বিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকারে ধড়মড়িয়ে বিছানার ওপর উঠে বসে মনে হল, জানলার শার্সির ওপরে বাইরে থেকে কে যেন ঠকঠক করে আওয়াজ করছে।

প্রথমটা ভাবলুম আমারই মনের ভুল। বাইরে তখনও সমান তোড়ে বৃষ্টি ঝরছে, বাজ ডাকছে ও ঝড় হই-হই করছে, এমন দুর্যোগে শার্সির ওপরে করাঘাত করতে আসবে কে?

হয়তো ঝোড়ো হাওয়া ঘরের ভিতরে ঢুকতে চায়!

আবার বিছানার ওপরে শুয়ে পড়লুম, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে তখনই শার্সির ওপরে আবার শব্দ হল ঠক ঠক ঠক। ঠক ঠক ঠক। ঠক ঠক ঠক।

সবিস্ময়ে বিছানার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়লুম। আর তো কোনওই সন্দেহ নেই। কে এল? এই বন-জঙ্গল-পাহাড়ের দেশে এই ঝড়-বৃষ্টি-অন্ধকারে কে আমার ঘরের ভিতরে ঢুকতে চায়?

অজানা বিদেশে বলে শোবার সময় বালিশের তলায় রোজই একটা টর্চ' রেখে দিতুম। টপ করে টর্চটা তুলে নিয়েই জ্বেলে জানলার ওপরে আলোটা ফেললুম! সেই তীব্র আলোকে দেখলুম, বন্ধ শার্সির ওপরে দুই হাত ও মুখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত মূর্তি! ঝোড়ো হাওয়ায় রাশি-রাশি কালো-কালো লম্বা চুল এসে তার সারা মুখখানাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে এবং সেই চুলের ফাঁকে-ফাঁকে আগুনের মতোন দপদপ করে জ্বলছে তার দুটো বিস্ফারিত চক্ষু।

পর মুহূর্তে মুখখানা আলোক-রেখার ভিতর থেকে সাঁৎ করে সরে গেল!

এ কী দুঃস্বপ্ন! ভয়ে মুষড়ে আলো নিবিয়ে বিছানার ওপরে কাঁপতে কাপতে বসে পড়লুম।

আতঙ্কে সারারাত আর ঘুম হল না। কেবলই মনে হতে লাগল, শার্সির কাচ ভেঙে ওই বুঝি এক অমানুষিক মূর্তি ঘরের ভিতরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে।

(৫)

জানলা দিয়ে সকালের আলো ঘরের ভিতর এসে পড়েছে, কিন্তু তখনও আমি জড়ভূতের মতো বিছানার ওপরে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছি। এমন সময় বাইরে থেকে শুনলুম আমার নাম ধরে ডাকছেন অমূল্যবাবু। আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তাড়াতাড়ি উঠে। দরজা খুলে দিলুম।

অমূল্যবাবু ঘরের ভিতরে এলেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘এত ভোরে আপনি যে! গদাধরের অসুখ বেড়েছে নাকি?’

অমূল্যবাবু বিছানার ওপরে উঠে বসে হাসিমুখে বললেন, ‘অসুখ বেড়েছে কি, এই অল্প সময়েই গদাধর প্রায় সেরে উঠেছে!’

আমি সবিস্ময়ে বললুম, ‘বলেন কি! কী করে সারল?’

অমূল্যবাবু বললেন, ‘গদাধরের কোনও অসুখ তো হয়নি, সে পড়েছিল পিশাচের পাল্লায়।’

চেষ্টা করেও আমি হাসি থামাতে পারলুম না। কৌতুকভরে বললুম, ‘আপনি কি চারিদিকেই এখন পিশাচের স্বপ্ন দেখছেন?’

অমূল্যবাবু অটলভাবেই বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছা হয় বল, আমি কোনই প্রতিবাদ করব না। গদাধর কেন বেঁচেছে জানো? কাল দিনরাত তার শিয়রে বসে আমি পাহারা দিয়েছি বলে। কারুকে তার ত্রিসীমানায় আসতে দিইনি। কাল রাতে আবার কেউ যদি তার রক্ত শোষণ করত, তা হলে আজ আর তাকে জীবিত দেখতে পেতে না।’

আমি সবিস্ময়ে বললুম, ‘রক্তশোষণ! অমূল্যবাবু, কী আপনি বলছেন? কে তার রক্তশোষণ করত?’

অমূল্যবাবু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘তোমার কথার কোনও জবাব আগে আমি দেব না। কাল রাতে আমি স্বচক্ষে কী দেখেছি তোমার কাছে আগে সেই কথাই বলতে চাই। তুমি জানো, আমার বাড়ি দোতলা। গদাধরকে আমি দোতলার ঘরেই শুইয়ে রেখেছিলুম। পাহারা দেওয়ার জন্যে তার পাশে বসে কাল সারারাত আমি কাটিয়ে দিয়েছি। কালকের রাতের ঝড়-বৃষ্টির কথা তুমিও টের পেয়েছ বোধহয়। মাঝরাতে ঝড়বৃষ্টির বেগ অত্যন্ত বেড়ে ওঠে। সেই সময় বই পড়তে পড়তে হঠাৎ আমি মুখ তুলে দেখি, জানলার ঠিক বাইরেই একটা স্ত্রী-মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দোতলার ঘর, মাটি থেকে সেই জানলাটা অন্তত বিশ ফুট উঁচু, সেখানে কোনও স্বাভাবিক মানুষের মূর্তির আবির্ভাব যে সম্ভবপর নয়, একথা তুমি বুঝতেই পারছ! আমি অবাক হয়ে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ঘরের আলো তার মুখের ওপরে গিয়ে পড়েছিল, তাকে দেখেই আমি চিনতে পারলুম। কে সে, কিছু আন্দাজ করতে পারো?’

আমি হতভম্বের মতো ঘাড় নেড়ে জানালুম ‘না।’

অমূল্যবাবু বললেন, ‘সে মূর্তি হচ্ছে মিসেস কুমুদিনী চৌধুরীর। ...কুমুদিনী খুব হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালুম। তারপর শার্সি খুলে খড়খড়ির পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিলুম সজোরে! আমাকে বাধা দেওয়ার জন্যে মূর্তিটা তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল কিন্তু বাধা দিতে পারলে না। আমার মনে হল, জানলা বন্ধ করবার সময় তার ডান হাতখানা পাল্লার তলায় পড়ে চেপটে গেল! তারপরেও জানলার ওপরে আরও কয়েকবার করাঘাতের শব্দ শুনতে পেলুম, কিন্তু সেদিকে আমি আর ভ্রুক্ষেপও করলুম না। এখন বল, আমার কথা পাগলের গল্প বলে। মনে হচ্ছে?’

আমি রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলুম, ‘অমূল্যবাবু, অমূল্যবাবু! আপনি কী বলছেন! মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী।’

অমূল্যবাবু বাধা দিয়ে বললেন, ‘শোননা। টেলিগ্রামে আমি আরো এক খবর আনিয়েছি। পেশোয়ারে মিসেস কুমুদিনী চৌধুরীর স্বামী মারা যান অ্যানিমিয়া রেগে। আর মিসেস কুমুদিনী চৌধুরীও তার মৃত্যুর পনেরো দিন আগে দেহত্যাগ করেন!’

আমার সর্বশরীর কেমনধারা করতে লাগল, টেবিলের একটা কোণ ধরে তাড়াতাড়ি চেয়ারের ওপরে বসে পড়লুম।

অনেকক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নিয়ে অমূল্যবাবুর কাছে আমিও কাল রাত্রে যা দেখেছি, সেই ঘটনাটা খুলে বললুম।।

অমূল্যবাবু কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ দরজার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন।

ফিরে দেখলুম, বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় এসে উঠলেন মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী। তাঁকে দেখেই সর্বপ্রথমে আমার চোখ পড়ল তাঁর ডান হাতের দিকে। তাঁর ডান হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা।

কুমুদিনীও আসতে-আসতে অমূল্যবাবুকে আমার ঘরে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, তাঁর মুখে-চোখে এমন একটা অমানুষিক বিশ্রী ভাব জেগে উঠল যা কোনও দিন কোনও মানুষেরই মুখে আমি লক্ষ করিনি!

তারপরেই দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে তীরের মতন তিনি বারান্দার ওপর থেকে নেমে এলেন এবং সেইরকম বেগেই সামনের দিকে ছুটে চললেন।

আমি দ্রুতপদে এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘মিসেস চৌধুরী, সাবধান! ট্রেন।’

কিন্তু আমার মুখের কথা মুখে রইল; আমার বাংলোর সামনে দিয়ে যে রেলপথ চলে গেছে, কুমুদিনী তার ওপরে গিয়ে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতেই, একখানা ইঞ্জিন হুড়মুড় করে একেবারে তার দেহের ওপর এসে পড়ল

ভয়ে আমি দুই চোখ বুজে ফেললুম। সঙ্গে-সঙ্গে শুনলুম তীক্ষ্ণ এক মর্মভেদী আর্তনাদ, তারপরেই সব স্তব্ধ।

খানিকক্ষণ আচ্ছন্নের মতন দাঁড়িয়ে রইলাম, আমার চারিদিকে পৃথিবী যেন ঘুরতে লাগল এবং সেই অবস্থাতেই শুনলুম অমূল্যবাবু বলছেন, ‘স্থির হও ভাই, স্থির হও! ট্রেনে যে চাপা পড়ল, ও কোনও মানুষের দেহ নয়, ও হচ্ছে কোনও পিশাচের আশ্রিত দেহ।’

(৬)

ঝাঁঝার গোরস্থানে মিসেস কুমুদিনী চৌধুরীর দেহ কবর দেওয়া হল।

তারপর মাস খানেক কেটে গেল। এই ভীষণ ঘটনার ছাপ আমাদেরও মনের ওপর থেকে ধীরে-ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসতে লাগল। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত একটা বিষয় সম্বন্ধে এখনও কারও মনের ধাঁধা ঘুচল না।।

ঝাঁঝায় রক্তস্বল্পতা রোগের বাড়াবাড়ি এখনও কমলো না কেন, তাই নিয়ে প্রায়ই আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়।

অমূল্যবাবু পর্যন্ত ধাঁধায় পড়ে গেছেন। তিনিও মাঝে-মাঝে আশ্চর্য হয়ে বলেন, ‘তাই তো হে, রক্তস্বল্পতা রোগটা এখানে সংক্রামক হয়ে দাঁড়াল নাকি? এর কারণ তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

কিছুদিন পরে একদিন নদীর ধার থেকে ফিরতে আমার রাত হয়ে গেল। সে রাতটা ছিল চমৎকার! পরিপূর্ণ পূর্ণিমা নদীর জলকে যেন মেজে-ঘষে রূপোর মতো চকচকে করে তুলেছে এবং চারিদিক ধবধব করছে প্রায় দিনের বেলার মতো। এই পূর্ণিমার শোভা দেখবার জন্যেই এতক্ষণ আমি নদীর ধারে অপেক্ষা করছিলুম।

বিভোর হয়ে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বাসার পথে ফিরে আসছি। গভীর স্তব্ধতার ভিতরে ঝিল্লীরব ছাড়া আর কোনও কিছুরই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। পথও একান্ত নির্জন।

প্রাণে হঠাৎ গান গাইবার সাধ হল। এমন রাতের সৃষ্টি তো গান গাইবার জন্যেই।

কিন্তু গান গাইবার উপক্রম করতেই সামনের দিকে তাকিয়ে যা দেখলুম, তাতে আমার বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল।

পথের একটা মোড়ে পৌঁছতেই দেখি অদূরে মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী।

আমার দেখবার কোনও ভ্রম হয়নি, তেমন উজ্জ্বল পূর্ণিমায় ভ্রম হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না।

ভাগ্যে কুমুদিনী অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন, তাই আমাকে তিনি দেখতে পাননি। আমি তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়ালে সরে গেলুম।

কুমুদিনী সেই পথ ধরে একদিকে অগ্রসর হলেন, আমি স্তম্ভিত নেত্রে লক্ষ করলুম, তার দেহ যেন মাটির ওপর দিয়ে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে না শূন্য দিয়ে ভেসে যাচ্ছে একখানা মেঘের মতন!

পথের বাঁকে সেই অদ্ভুত ও ভীষণ মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল। এবং আমিও ছুটতে লাগলুম রুদ্ধশ্বাসে আতঙ্কে ও বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে!

ছুটতে ছুটতে একেবারে অমূল্যবাবুর বাড়িতে! অমূল্যবাবু বৈঠকখানায় একলা বসে বই পড়ছিলেন, হঠাৎ আমাকে সেইভাবে সেখানে গিয়ে পড়তে দেখে নির্বাক বিস্ময়ে আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রইলেন।

আমি প্রায়-রুদ্ধস্বরে বলে উঠলুম, ‘মিসেস চৌধুরী, মিসেস চৌধুরী! অমূল্যবাবু, এই মাত্র মিসেস চৌধুরীকে দেখতে পেলাম!’

অমূল্যবাবু সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, তার মানে?

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ‘নদীর পথ দিয়ে ফিরে আসছিলাম, মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী প্রায় আমার পাশ দিয়ে চলে গেলেন।’

‘তুমি ঠিক দেখেছ?’

‘আপনাকে যেমন ঠিক দেখছি, তাকেও ঠিক তেমনি দেখেছি।’

‘ওঠো, ওঠো! আর দেরি নয়, এখনি আমার সঙ্গে চল। এখন কোনও কথা। জিজ্ঞাসা করো না।’

অমূল্যবাবু হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর বাগানের কোণ থেকে একটা শাবল ও একখানা কোদাল তুলে নিয়ে কোদালখানা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এস!’

আমি যন্ত্রচালিতের মতন তার সঙ্গে চললুম।

আবার সেই নদীর পথ! চারিদিক তেমনি নীরব ও নির্জন, আকাশে তেমনি স্বপ্নময় চাঁদের হাসি। নিবিড় বনজঙ্গল ও পাহাড়ের পর পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে যেন ছবিতে আঁকা। কিন্তু সে সব দৃশ্য দেখবার মতো মনের অবস্থা তখন আমার ছিল না, আমার প্রাণ থেকে সমস্ত কবিত্ব তখন কর্পূরের মতন উবে গিয়েছিল। ঘাসের ওপরে বড়-বড় গাছের ছায়া নড়ছে আর আমি চমকে-চমকে উঠছি। নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে একটা পেঁচা চেঁচিয়ে উঠল, শিউরে উঠে আমি ভাবলুম, ঝোপে-ঝাপে আড়ালে-আবছায়ায় যে-সব অশরীরী দুষ্ট আত্মা রক্ত তৃষায় উন্মুখ হয়ে আছে, ওই নিশাচর পাখিটা যেন তাদেরই সাবধান করে জানিয়ে দিলে তোমরা প্রস্তুত হও, পৃথিবীর শরীরী প্রাণী আসছে।

ওই তো ঝাঁঝার গোরস্থান। কবরের পর কবর সারি-সারি দেখা যাচ্ছে, তাদের ওপরে ইটের বা পাথরের গাঁথুনি। পাশ থেকে নদীর জলের তান ভেসে আসছে অশ্রান্ত তালে। আমার মনে হল, এতক্ষণ ওই সব কবরের পাথরের ওপরে যে-সব ছায়াদেহ বসে-বসে রাত্রিযাপন করছিল, আচম্বিতে জীবিত মানুষের আবির্ভাবে অন্তরালে গিয়ে নদীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে তারা ভয়াবহ কানাকানি করছে!

একটা ঝোপের ভিতরে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে অমূল্যবাবু বললেন, ‘এইখানে স্থির হয়ে লুকিয়ে বসে থাকি এসো। সাবধান, কোনও কথা বলো না।’

সারারাত সেইখানে আড়ষ্ট হয়ে দুজনে বসে রইলুম। সেদিনকার সে-রাতটাকে আর পৃথিবীর রাত বলে মনে হল না, ইহলোকে থেকেও আমরা যেন পরলোকের। বাসিন্দা হয়েছি!

চাঁদ পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে। পূর্বদিকে ধীরে-ধীরে যেন মৃত রাত্রির বুকের রক্ত ঝরে পড়তে লাগল। ভোর হচ্ছে।

হঠাৎ অমূল্যবাবু আমার গা টিপলেন। চমকে ফিরে দেখি, নিবিড় বনের ভিতর থেকে মেঘের মতো গতিতে এক অপার্থিব নারীমূর্তি বাইরে বেরিয়ে আসছে মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী!

অমূল্যবাবু আমার কানে কানে বললেন, ‘আজকের রাতের মতো পিশাচীর রক্তপিপাসা শান্ত হল।’

মিসেস চৌধুরীর দেহ ধীরে-ধীরে গোরস্থানের ভিতরে গিয়ে ঢুকল। একটা কবরের ওপরে গিয়ে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়াল। তারপর আচমকা শূন্যে দুই হাত তুলে এমন প্রচণ্ড তীক্ষ্ণস্বরে হী-হী-হী-হী-হী-হী-হী করে অট্টহাস্য করে উঠল যে আমার সমস্ত বুকটা যেন বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল! সে কী পৈশাচিক শীতল হাসি! তারপর দেখলুম, তার দেহটা ধীরে-ধীরে মাটির ভিতরে নেমে যাচ্ছে। খানিক পরেই সে একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল!

পূর্ব-আকাশে সূর্যের প্রথম ছটা জেগে উঠল। অমূল্যবাবু এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ‘আর অপেক্ষা নয়! শিগগির আমার সঙ্গে এস!’

আমরা মিসেস চৌধুরীর কবরের ওপরে গিয়ে দাঁড়ালুম। অমূল্যবাবু বললেন, ‘আমি শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ছি তুমি কোদাল দিয়ে মাটি তোলো!'

তার এই অদ্ভুত আচরণের কারণ কি জিজ্ঞাসা করলুম না, কারণ আমি তখন আচ্ছন্নের মতো ছিলুম। তিনি যা বলেন, আমি তাই করি।

অল্পক্ষণ পরেই কফিনটা দেখা গেল। অমূল্যবাবু বললেন, ‘দেখ, এইবারে আমি কফিনের ডালাটা খুলব তারপর আমি যা করব তুমি তাতে আমাকে বাধা দিও না। খালি এইটুকু মনে রেখো, কফিনের ভেতরে যে দেহ আছে তা কোনও মানুষের দেহ নয়!’

‘অমূল্যবাবু দুই হাতে টেনে কফিনের ডালাটা খুলে ফেললেন। আমি স্তম্ভিত চক্ষে দেখলুম কফিনের ভিতর শুয়ে আছে মিসেস চৌধুরীর মোটাসোটা স্থূল দেহটা। সে দেহ দেখলে মনে হয় না তা কোনও দিন ট্রেনে কাটা পড়েছিল। সেটা একমাস আগে কবর দেওয়া কোনও গলিত মৃতদেহও নয়! তার তাজা মুখ অত্যন্ত প্রফুল্ল, তার ওষ্ঠাধারের চারপাশে তরল রক্তধারা লেগে রয়েছে এবং তার জীবন্ত চোখ দুটো সহাস্য দৃষ্টিতে আমার মুখের পানে তাকিয়ে আছে!

অমূল্যবাবু দুই হাতে শাবলটা হঠাৎ মাথার ওপরে তুলে ধরলেন, তারপর সজোরে ও সবেগে শাবলটা মৃতদেহের বুকের ওপরে বসিয়ে দিলেন।

ইঞ্জিনের বাঁশির আওয়াজের মতো এক তীব্র দীর্ঘ আর্তনাদে আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তারপর সব চুপচাপ।

 আপলোড: ৯/৯/২০২০

ভৌতিক হরর গল্প (মোঃ ভাঃ): ওরা মৃত নয় (শিশির বিশ্বাস)

গল্পটি ব্লগ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে।
—শিশির বিশ্বাস

ছবি: শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য (সৌজন্য: সন্দেশ)

আপলোড: ৪/৮/২০২০

স্পাই থ্রিলার (মোবাইল ভাঃ): এজেন্ট ০১৩ (শিশির বিশ্বাস)

 

এজেন্ট–০১৩

শিশির বিশ্বাস

য়ার ফোর্সের একজন পাইলটের কাজ অন্যদের কাছে যত রোমাঞ্চকরই মনে হোক আসলে একেবারেই গতানুগতিক। অন্তত উইং কমান্ডার অভি পাটোয়ারির কাছে। সেই ভোর সকালে ঘুম থেকে ওঠা। দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়ে এয়ার বেসের কন্ট্রোল সেন্টারে রিপোর্ট। জানতে পারা যাবে দিনের মিশন কিছু রয়েছে কিনাঅতঃপর ক্যান্টিনে ব্রেকফার্স্ট। খালি পেটে পাইলটদের ককপিটে বসা বারণ

বলা বাহুল্য এয়ারবেসের হ্যাঙ্গারে ততক্ষণে অন্য কাজ শুরু হয়ে গেছেনির্ধারিত ফাইটার প্লেন রি–ফুয়েলিং আর রুটিন চেকআপ। পাইলট নিজেও বসে নেই। ব্রেকফাস্ট শেষ করে চলে এসেছেন নিজের প্লেনের কাছে। পরনে ফ্লাইট স্যুট। মাথায় হেমলেট। ককপিটে উঠে যথাস্থানে বসেই ক্যানোপি নামিয়ে দিয়ে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে টেক–অফ সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা। সেটা পাওয়া গেলেই হাত বাড়াও স্টার্টারের দিকে ফাইটার জেট চলতে শুরু করবে প্রধান রানওয়ের দিকে। তারপর রানওয়ে ধরে ক্রমান্বয়ে গতি বাড়িয়ে যাওক্রমে চড়া হতে থাকবে ইঞ্জিনের গর্জন। নির্দিষ্ট স্পিডে পৌঁছলেই নাক উঁচিয়ে ফাইটার ডানা মেলে দেবে আকাশেবিপুল গর্জনে পৌঁছে যাবে অনেক উঁচুতে। যেদিন যেমন মিশন সেই অনুসারে এল.ও.সি বরাবর এক দেড় ঘন্টা চক্কর দিয়ে ফের নেমে আসা।  

যত রোমাঞ্চই থাক উইং কমান্ডার অভি পাটোয়ারির কাছে ধরাবাঁধা এই কাজ এখন নিতান্তই গতানুগতিক। এয়ার ফোর্সের একজন জঙ্গী পাইলটের অতি পছন্দের যে কাজ তা মেলে কদাচিৎ। বছর কয়েক আগে কার্গিল যুদ্ধের সময় তেমন একটা সুযোগ এসেছিল। তবে অভি পাটোয়ারি তখন একেবারেই নতুন। গ্রাউন্ড ডিউটি। কর্গিল যুদ্ধে ফাইটার নিয়ে আকাশে ওড়ার সুযোগ হয়নি। যাদের সেই সুযোগ মিলত তাদের কাছেই শুনত রোমহর্ষক সব গল্প। পাহাড়ের মাথায় কিভাবে শত্রু বাঙ্কার গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তবু গোড়ার দিকে অন্য খবরও আসতকিন্তু তারপর বন্ধু দেশ থেকে যখন লেজার গাইডেড মিসাইল হাতে এসে গেল ইন্ডিয়ান জঙ্গী পাইলটেদের দাপটে অন্য পক্ষে শুধুই হাহাকার। অভি পাটোয়ারির আপশোশ তাই রয়েই গেছে।

সেই আপশোশ মিটিয়ে নেবার একটা সুযোগ মিলতেও পারে এবার। গত কাল থেকেই তাই উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। পাকিস্তানে এক জঙ্গী শিবির আচমকা আঘাতে সেদিন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওদিক থেকে তাৎক্ষণিক কিছু প্রাত্যাঘাত হয়তো আসতেও পারে। এয়ারবেসে তাই হাই অ্যালার্ট চলছেব্যস্ততা চরমে। তার উপর আজ সকাল থেকে সীমানার ওপারের আকাশ শুনশান। একটি যাত্রীবাহী বিমানও নেই। পাকিস্তান হঠাৎই তাদের এয়ারস্পেস বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাপারটা অতি সন্দেহজনকএমন ব্যবস্থা একমাত্র বিমান আক্রমণের আগেই নেওয়া হয়ে থাকে। অগত্যা  রেডার কন্ট্রোল স্টেশনে এক ঝাঁক ফ্লাইট কন্ট্রোলার স্ক্রিনের উপর চোখ রেখে বসে আছে।

ওদিকে এয়ারেবেসে একঝাঁক পাইলটের সঙ্গে উইং কমান্ডার অভি পাটোয়ারিও ফ্লাইট স্যুট পরে প্রস্তুতসকালে কন্ট্রোল রুমে রিপোর্ট করতেই জানতে পেরেছে আজ প্রথম দফায় যে ছয়টা মিগ মিশনে বের হবে তার মধ্যে সেও রয়েছে। খবরটা জানার পরেই উৎসাহে ফুটছে। ভিতরে অন্য এক তাগিদ। ছটফটানি। পছন্দের ফাইটার মিগ–২১ বাইস নিয়ে নিয়মিতই উড়তে হয়। কিন্তু আজকের মতো উত্তেজনার লেশমাত্রও তাতে নেই। শত্রু দেশের জঙ্গী বিমানের সঙ্গে আকাশ যুদ্ধ! ওদের ভাষায় ‘ডগ ফাইট’ এসবের রোমাঞ্চই আলাদা। ফাইনাল সিগন্যাল আসতেই সোজা রানওয়েতে।

তাপমাত্রা আজ দশ ডিগ্রির আশপাশে। অতি পরিচিত মিগ–২১ বাইসন রানওয়ের পাশে তৈরি হয়ে রয়েছেযে যার প্লেনে উঠে বসেছে তারপরপ্রথমেই অভি পাটোয়ারির ফাইটার। আগে ওড়ার সুযোগ ওরই। ক্যানোপি নামিয়ে দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা একবার তুলে ধরল ওতারপরেই গ্রাউন্ড স্টার্ট বাটন প্রেস করতেই প্লেন রানওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করল। গতি বাড়ার সঙ্গে ইঞ্জিনের গরগর শব্দ বাড়তে থাকল ক্রমশ। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আজকের মিশন কিছু আলাদা। ফাইটারের দু’দিকের ডানার নীচে লোড করা রয়েছে একাধিক মিসাইল। টেক অফ স্পিড অন্য সময়ের থেকে কিছু বেশিই হবে আজ। অগত্যা থ্রটল করে রানওয়ের উপর বিমানের গতি যথানিয়মে বাড়িয়ে চলল অভিটেক অফ স্পীডে পৌঁছতেই ছোট্ট ঝাঁকুনি দিয়ে ফাইটার মাথা উঁচিয়ে ভেসে পড়ল আকাশে।

উড়ন্ত জঙ্গী বিমানে ইঞ্জিন স্পীড এয়ার স্পীড আর ফ্লাইং অলটিচুডের দিকে সর্বদা নজর রাখা পাইলটের এক জরুরি কাজ। দ্রুত সেইমতো ব্যবস্থা। এর অন্যথা হলেই বিপদ। অধিকাংশ ফাইটার জেট দুর্ঘটনায় পড়ার পিছনে এটাই বড় কারণ। মিগ–২১ ফাইটারও ব্যতিক্রম নয়। এক দমে ১৫ হাজার ফিট উঁচুতে উঠে এসে ফাইটারের গতি ৬০০ কিমিতে ফিক্স করে অভি পাটোয়ারি এরপর দ্রুত হাত বাড়াল রেডার সুইচের দিকে

কারণ ছিল। ওদের ছয়টা ফাইটার আকাশে ওড়ার পরেই এয়ারবেসের রেডারে হঠাৎই ফুটে উঠেছিল গোটা কয়েক বিন্দু। সেই বিন্দুগুলির দিকে তাকিয়ে অভিজ্ঞ রেডার অপারেট অফিসারের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি আসলে সেগুলি কী। অন্তত হাফ ডজন জঙ্গী বিমান পাকিস্তানের দিক থেকে এল.ও.সি লক্ষ্য করে ছুটে আসছেমুহূর্তে সেই খবর চলে গেছে দিকে দিকে। ব্যতিক্রম নয় অভি পাটোয়ারিও। ১৫ হাজার ফিট উঁচুতে ফাইটার থিতু করে তাই হাত বাড়িয়েছিল রেডারের দিকে।

ককপিটের স্বচ্ছ ক্যানোপির ভিতর দিয়ে সহজেই চারপাশে নজর রাখা যায়। আকাশে ঘন মেঘ না থাকলে দেখা যায় বহু দূর পর্যন্ত। তবু জঙ্গী বিমানের পাইলটের কাছে রেডারই হল আসল চোখ।

ডানদিকে রেডার কন্ট্রোল প্যানেলে হাত বাড়িয়ে চট করে সুইচ অন করে দিল ওএকটু একটু করে রেডার স্ক্রিনে ফুটে উঠল চারপাশের আকাশ। সেদিকে তাকিয়ে দু’চোখ প্রায় বিস্ফারিত হয়ে উঠল অভি পাটোয়ারি। এয়ারবেস থেকে অল্প আগে যে ইনফরমেশন পেয়েছে তার সঙ্গে মিল সামান্যই ব্যাপারটা সামলে নিতে অবশ্য সময় লাগল না। একজন পাইলটকে এজন্য প্রস্তুত থাকতেই হয়।

আকাশের উঁচুতে ফাইটার জেটের রেডারের সামনে থাকে খোলা আকাশ। গ্রাউন্ড রেডার থেকে অনেক নিখুঁত হিসেব পাওয়া যায় রেডার ডায়ালে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে হাফ স্কোয়াড্রন নয় সামনে শত্রুপক্ষের অন্তত দেড় স্কোয়াড্রন ফাইটার। সম্ভবত জে এফ-১৭ আর মিরাজ। ওর মিগ–২১ থেকে অনেক উন্নত আর আধুনিক। তবে তার সবগুলোই অধিকৃত কাশ্মীরের ওধারে পাকিস্তানের আকাশে। অর্থাৎ কন্ট্রোল লাইন তথা এল.ও.সির অনেক দূরে। অযথা ব্যস্ত হবার দরকার নেই। তবে এয়ারবেসে জানিয়ে দেওয়া দরকার। এই মুহূর্তে খবরটা ওদের কাছে যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। এয়ারবেস থেকে মোট ছয়টা প্লেন আকাশে উড়েছে। শত্রু বিমানের তুলনায় সংখ্যাটা একেবারেই সামান্য।

শুধু সংখ্যায় কম নয় টেকনিকাল দিক দিয়েও মিগ–২১ শত্রুপক্ষের বিমানগুলোর চাইতে অনেক পিছিয়ে। অনেক পুরোনো দিনের। তাই একটানা বেশি ধকল সহ্য করতে পারে না। তবু অভিজ্ঞতায় জানে ওর এই ফাইটারে সুবিধাও কিছু কম নয়। আকারে ছোট অথচ সুপারসনিক হবার কারণে অতি দ্রুত দিক পরিবর্তন করতে পারে। ফলে নিখুঁতভাবে লক্ষ্য স্থির করতে শত্রুপক্ষের অতি দক্ষ পাইলটও সমস্যায় পড়ে যায়। আকাশে বায়ুযুদ্ধ ওদের পরিভাষায় ‘ডগ ফাইট’–এ এটা বেজায় অ্যাডভান্টেজ। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মিগ ফাইটারের এই অ্যাডভান্টেজ সম্বল করে ভিয়েতনামী পাইলট আমেরিকার অপেক্ষাকৃত উন্নত মানের বিমান বাহিনীকে বহু ক্ষেত্রে টেক্কা দিয়ে গেছে

বাকি পাঁচটি ফাইটার অনেকটাই পিছনে তখনো। ফ্রন্ট প্যানেলের উপর দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে সামান্য বাঁকা হাসি ফুটে উঠল অভি পাটোয়ারির ঠোঁটের কোনায়। সারা দুনিয়ায় মিগ–২১ এখন বুড়ো ঘোড়া। জনান্তিকে অনেকেই বলে ফ্লাইং কফিন। কিন্তু ও নিজে তো তেমন নয়। এ পর্যন্ত ডগফাইটের ট্রেনিং অভিজ্ঞতা নেহাত কম তো নয়কীভাবে আকাশ যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দিতে হয় ভালই জানা আছে। আর যতই বুড়ে ঘোড়া হোক কাজটা মিগ–২১ ফাইটারে সওয়ার হয়ে সম্পূর্ণ করায় কিছু সুবিধেও তো রয়েছেআর এই মুহূর্তে ওর ফাইটার কাজ করে চলেছে একদম নিখুঁতবিন্দুমাত্র গোলমাল নেই। এয়ারস্পীড ইন্ডিকেটারে চোখ রেখে ফাইটারের গতি কিছু কমিয়ে দিল ও। তারপর নেভিগেশন সুইচের দিকে হাত বাড়িয়ে দ্রুত আরও উপরে। এই মুহূর্তে আকাশের যত উঁচুতে থাকা যায় ততই সুবিধা।

কিন্তু ভাবনার সঙ্গে বাস্তব সব সময় মেলে না। সামনে শত্রুপক্ষের ফাইটারের ঝাঁক তখনো অধিকৃত কাশ্মীরের আকাশে ঢোকেনি। সন্দেহ নেই ইতিমধ্যে ভারতের আকাশে ছয়টা মিগ দেখে বুঝে নিতে চাইছে পিছনে এমন আরো কতগুলো রয়েছেওরা কী ওখান থেকেই দূর পাল্লার মিসাইল ছুঁড়বে? না কী এগিয়ে আসবে আরো?

ককপিটে বসে অভি পাটোয়ারি সেই হিসেবই করছিল। হঠাৎই অধিকৃত কাশ্মীরের কোনো এয়ারবেস থেকে চকিতে উড়ে এল একসঙ্গে দশটা ফ্যালকন অর্থাৎ এফ–১৬ ফাইটার। শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্য মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে গেল যেনফ্যালকন অত্যাধুনিক বিমান। ডগ ফাইট অর্থাৎ আকাশ যুদ্ধে আরও নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করার ব্যবস্থা আছেসন্দেহ নেই পিছনের ফাইটারগুলো ডগ ফাইটে অংশ নেবে প্রয়োজন হলেই। আসল কাজের দায়িত্ব মঞ্চে নতুন আসা দশটা ফ্যালকনেরঅতি অল্প সময়ের মধ্যেই এয়ার টু এয়ার নয়তো এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল ছুটে আসবে অধিকৃত কাশ্মীরের আকাশে দশটা ফ্যালকন থেকেই। টার্গেটে শুধু ওদের ছয়টা ফাইটার নয় এদিকের আর্মি ঘাঁটিগুলোও।

বেশি ভাবার সময় নেই। দলের অন্য পাঁচটি ফাইটার অনেক পিছনে। এই মুহূর্তে যা করবার করতে হবে ওকেই। এয়ারবেস থেকে ওই সময়েই মেসেজ চলে এল শত্রুপক্ষের ফ্যালকন তাদের রেডারেও ধরা পড়েছে। শত্রুর মোকাবিলায় বিভিন্ন এয়ারবেস থেকে রওনা হয়ে পড়েছে এক ঝাঁক সুখোই–৩০ মিরাজ–২০০০ আর মিগ–২৯। 

মাভৈ। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে মুহূর্তে সবচেয়ে কাছের ফ্যালকন–১৬ ফাইটারকে নিশানা করে ক্ষেপনাস্ত্র ‘লক’ করে ফেলল অভি পাটোয়ারি। কাজটা খুব সহজ নয় অবশ্য। অত্যন্ত জটিল। তবু বেশি সময় লাগল না মুহূর্তে এয়ারবেসে খবরটা জানিয়ে দিয়ে ফাইটার ছোটাল এল.ও.সি অর্থাৎ কন্ট্রোল লাইনের দিকে

ক্ষেপণাস্ত্রলককরার অর্থ হল দুই বিমানের মাঝে কোনও বাধা অর্থাৎ পাহাড় বা অন্য কোনো আকাশযান এসে না পড়লে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়লে সোজা গিয়ে আঘাত করবে নিশানা করা বিমানে এখন লক্ষ্যের যত কাছে আসা যায় ততই আঘাতের মাত্রা বেশি। সেই উদ্দেশ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিল কন্ট্রোল লাইনের দিকে। হঠাৎই টার্গেট প্লেন পিছন ফিরে পালাতে শুরু করলব্যাপারটা বুঝতে বাকি থাকে না অভি পাটোয়ারির। টার্গেট লক করতেই অত্যাধুনিক ফ্যালকন–১৬ তার রেডারে ধরে ফেলেছে ব্যাপারটা। উদ্দেশ্য মুলতুবি রেখে তাই সরে পড়তে চাইছে। প্রায় গোঁত্তা খেয়ে নামতে শুরু করেছে নীচের দিকেলক্ষ্য কোনো পাহাড়ের আড়াল

কাছাকাছি আরো নয়টা ফ্যালকন। দূরের আকাশে আরও দেড় স্কোয়াড্রন শত্রু বিমান। সামান্য এগোলেই কন্ট্রোল লাইন পার হয়ে পাকিস্তান কাশ্মীর। কিন্তু কোনো কিছুই দমাতে পারল না বৈমানিক অভি পাটোয়ারিকে। মাথার ভিতরে তখন একই ভাবনা মারো সুযোগ যখন পাওয়া গেছে মারো ওকে

প্রায় পনোরো হাজার ফুট উঁচুতে ডগফাইট চলল প্রায় মিনিট পাঁচেকফ্যালকনের পিছু নিয়ে অভি পাটোয়ারি তখন ঢুকে পড়েছে পাকিস্তান কাশ্মীরের আকাশে। মিগ–২১ ফাইটারের গতি ঘণ্টায় ৯০০ কিমি। দুই বিমানের দূরত্ব কমে এসেছে অনেকটাই। সুযোগটা তাই আর হাতছাড়া করেনি ও। হাত বাড়িয়ে শর্ট রেঞ্জের আর–৭৩ এয়ার টু এয়ার মিসাইল চার্জ করলজয় হিন্দ!

একরাশ আগুন ঝরিয়ে মিসাইলটা নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাত করল অদূরে শত্রু বিমানকে। জ্বলে উঠল দাউ–দাউ করে।

লক্ষ্য ধরাশায়ী হতে অভি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে নিজের প্লেন ঘোরাল। সুবিধা থাকলেও পরের লক্ষ্য স্থির করার উপায় নেইবেচারা বুড়ো ঘোড়া মিগ–২১ ফাইটারের উপর বিগত কয়েক মিনিট বড্ড বেশি রকম চাপ দিয়ে ফেলা হয়েছে। এয়ার বেসে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই। ফাইটারের স্পীড আরও কিছু বাড়াতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু সেটা ঠিক হবে কিনা ভাবছিল ওতার মধ্যেই ঘটে গেল অঘটনটা। হঠাৎই পিছনে ইঞ্জিনের ভিতর থেকে বেয়াড়া একটা শব্দমুহূর্তে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হতে শুরু হল

যা বুঝবার ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে অভি পাটোয়ারি। বেচারা বুড়ো ঘোড়ার ইঞ্জিন ধকলটা আর টানতে পারেনি। আগুন ধরে গেছে সেই মুহূর্তে পিছনে অন্য এক ফাইটারের পাইলট ফ্লাইট লেফটেনান্ট বিনোদ কামতের সতর্কবার্তা ইয়ার ফোনে ভেসে এল পাটোয়ারি সার ইউ আর অন ফায়ার, গো আউট…

ব্যাপারটা আর মিনিটখানেই পরে হলেই ও সীমান্ত পার হয়ে যেতে পারত। কিন্তু অযথা  আপশোশ করে লাভ নেই। বেসামাল ফাইটার ততক্ষণে গোঁত্তা খেয়ে নামতে শুরু করেছে। সময় নষ্ট না করে ও ইজেক্ট লিভারে টান দিতে মুহূর্তেই হাওয়ায় উড়ে গেল শরীরটা  

জলন্ত ফাইটার থেকে সঠিকভাবে সেফ ইজেক্ট করা খুব সহজ নয়। ককপিটের ক্যানোপি খুলে যেতেই প্রচণ্ড বেগে ছিটকে বেরিয়ে আসে শরীর। দেহের প্রতিটি পেশী আর ভারসাম্য সঠিকভাবে ধরে রাখতে না পারলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অনেকেই। কিন্তু বৈমানিক অভি পাটোয়ারির ক্ষেত্রে তেমন কিছুই হয়নি। বরং যথা সময়ে প্যারাসুট খুলে যাবার পর মাথায় অন্য ভাবনা পাক খেতে শুরু করেছে। বাতাস বইছে পুব দিক থেকে। অর্থাৎ একেবারেই অনুকূল নয় উলটো দিকে থেকে হলে মাটিতে পড়ার আগে সীমান্ত পার হয়ে যেতেও পারত।  এক্ষেত্রে আরও পশ্চিম অর্থাৎ পাকিস্তান কাশ্মীরের দিকে ভেসে যাবার সম্ভাবনা। শত্রু দেশের মাটিতে ল্যান্ড করা একজন জঙ্গী পাইলটের কাছে মোটেই স্বস্তির নয়। উন্মত্ত জনতার হাতে পড়লে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। পাকিস্তান পুলিশের হাতে পড়লেও ভাল কিছু ঘটবে এমন সম্ভাবনা কম। কার্গিল যুদ্ধের সময় পাইলট নচিকেতা ধরা পড়েছিল ওদের হাতে। গুলি করে মারা হয়েছিল তাঁকে। অজান্তেই অভির হাত চলে গেল কোমরের পিস্তলের দিকে। যাই হোক না কেন সহজে হার মানবে না।

দুঃশ্চিন্তাগুলো তাই মাথা থেকে নামিয়ে ফেলতে পেরেছিল আগেইযথাসময়ে প্যারাসুট ল্যান্ড করতে গা–ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে সময় লাগেনি ভাগ্যই বলতে হবে পাহাড়ের ঢালে যেখানে নেমেছে কাছাকাছি জনমানুষ নেই। চারপাশে হালকা ঝোপঝাড়। লোকালয় কিছু দূরেই মনে হচ্ছে। সময় নষ্ট না করে দড়িদড়া সহ প্যারাসুট চটপট গুটিয়ে ফেলল। কাছেই এক ঝোপের ভিতর গুঁজে দিয়ে চলতে শুরু করলকাছাকাছি মানুষ নেই বটে কিন্তু নামতে দেখেছে অনেকেই। পুলিশ আর আর্মি তো বটেই স্থানীয় মানুষও হয়তো বাদ যায়নি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্থান ত্যাগ করে দূরে সরে পড়াই মঙ্গল।

 হিসেবে ভুল হয়নি। ঘণ্টা খানেকও পার হয়নি তখন। কাছাকাছি মানুষের আওয়াজে টের পেল ওকে খোঁজা শুরু হয়ে গেছে। যে রকম চিৎকার চ্যাঁচামেচি হচ্ছে তা কোনোমতেই পুলিশ বা আর্মির নয়। সাধরণ মানুষ। তবে যথেষ্ট মাথা খাটিয়ে গোটানো প্যারাসুট ও একটা ঝোপের মধ্যে গুঁজে দিয়েছে। এখনই খুঁজে বের করা অসাধ্য। তবু আরও সতর্ক হলযে পাহাড়–জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ও পথ চলেছে তার খানিক নীচেই পাহাড়ের গা বেয়ে পাকা সড়ক। নামতে হলে ওই সড়ক পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যা অবস্থা এখনি সেটা সম্ভব নয়। রাতের জন্য অপেক্ষা করা দরকার।

উইং কমান্ডার অভি পাটোয়ারি যথেষ্ট সতর্ক হয়েই পথ চলছিল এরপর। বলা বাহুল্য সেই কারণে খুব বেশি এগোতে পারেনি। দুপুরের দিকে সুর্য তখন পশ্চিম আকাশে। হঠাৎই পাহাড়ের গায়ে পাথর সাজিয়ে তৈরি একটা গুহামতো নজরে পড়লসম্ভবত ভেড়াওয়ালাদেরএই ধরণের গুহার কাছে সাধারণত কোনো জলের উৎস থাকে। কিন্তু সেজন্য নয় অভি সন্ধে পর্যন্ত গা ঢাকা দেবার জন্য গুহাটাকে বেছে নিল দুটো কারণেএক গা ঢাকা দেবার পক্ষে পরিত্যক্ত গুহাটা যথেষ্টই আরামদায়ক। দুই ঘন ঘন চড়াই ভাঙার কারণে পরিশ্রম কম হয়নি। তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুককিন্তু চারপাশে যা অবস্থা চলছে জল খুঁজতে যাওয়া মানেই অযথা বিপদ ডেকে আনা। গুহার কাছেই বড় একটা ক্যাকটাসের ঝাড়। জলের সমস্যা সহজেই মেটানো যেতে পারে। পকেট থেকে ছুরি বের করে অভি তাই কাজে লেগে পড়ল। ক্যাকটাস ঝাড়ের খানিকটা কেটে নামিয়ে সাবধানে চেঁছে এক টুকরো পুরে দিল মুখের ভিতর। সামান্য চিবোতেই জলে ভরে গেল মুখ। আহ্‌!

সন্ধের অপেক্ষায় সেই গুহার ভিতর অভি পাটোয়ারির খুব বেশিক্ষণ কাটেনি তারপর। গুহার নীচের দিকে সড়কের উপর মাঝে মধ্যে দু–একটা গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎই বাড়ল সেটা। সেই শব্দে অভির বুঝতে বাকি রইল না এক ঝাঁক আর্মির গাড়ি ওর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। এখানে থাকা নিরাপদ নয় আর। কাছেই ঝাঁকড়া কিছু বুনো গাছের ঝোপ। ও গুহা থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়ল তার ভিতর।

ভাগ্যিস মতলবটা করেছিল। একটু পরেই দেখতে পেল আর্মির এক সেপাই চড়াই ভেঙে চলে এসেছে গুহার কাছে। উঁকি মেরে ভিতরটা দেখল একবার। তারপর চলে গেল অন্য দিকে। ঝোপের ভিতর প্রায় নিঃশ্চল হয়ে পড়ে ছিল অভি। হাঁপ ছাড়তে যাবে হঠাৎই দ্বিতীয় একজন উঠে এল গুহার কাছে। মামুলি সেপাই নয়। জবরদস্ত এক মেজর র‍্যাঙ্কের অফিসার। গুহার কাছে এসে চারপাশে একবার চোখ ঘোরালেন মানুষটি। তারপরেই চাপা গলায় হেঁকে উঠলেন ‘ম্যান ইউ আর কট নাউ। ধরা পড়ে গেছচটপট বেরিয়ে এস

মানুষটার হঠাৎ ওই কথায় অভি একটুও অবাক হল না অবশ্য। ওর নিজের বোকামির কারণেই এভাবে ধরা পড়তে হল তেষ্টা মেটাবার জন্য ওভাবে ক্যাকটাসের ঝাড় কাটতে যাওয়াটাই ভুল হয়েছে। দেখেই ধরে ফেলেছে মানুষটি।  

কোমরে গোঁজা জোড়া পিস্তল। কিন্তু এই অবস্থায় লড়াই করতে যাওয়া বোকামি। বিশেষ করে অন্য পক্ষ যখন হাতে অস্ত্র তোলেনি। তবু ইতস্তত করছিল। অদূরে আর্মি অফিসার চাপা গলায় ফের হেঁকে উঠলেন ‘ডোন্ট ফিয়ার ম্যান। আ অ্যাম ফ্রেন্ড।’

কথা শেষ করে মানুষটি যেভাবে হাত নাড়লেন তাতে উইং কমান্ডার অভি পাটোয়ারির বুঝতে বাকি রইল না পাকিস্তান আর্মির পোষাক পরা অফিসারটি আর যাই হোক শত্রু নয়। নিজের চোখ–কানকেও তখন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না ওর। মূহূর্তে বের হয়ে এসে কোনোমতে বলল ‘আপনি আপনি কে?’

‘এজেন্ট ০১৩।’

মুহূর্তে উত্তর এলেও উইং কমান্ডার অভি পাটোয়ারি তখনো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আসলে নিজের চোখ–কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না

‘ইয়েস ম্যান।’ বিহ্বল অভি পাটোয়ারির মুখের দিকে তাকিয়ে আগন্তুক ফের মুখ খুললেন ‘সাপোজ অ্যান আদার রবীন্দ্র কৌশিক দো হি ইজ ডায়েড। লেকিন হাম হ্যায়। হ্যায় হামারা দেশ অর রহেগা ভিডোন্ট ওয়ারি

বলা বাহুল্য সামনে মানুষটার ওই কথার পর অভি পাটোয়ারির মতো ডাকাবুকো উইং কমান্ডারের মুখেও কোনো কথা জোগাল নাদারুণ বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল

অন্য পক্ষ অবশ্য সময় নষ্ট না করে বললেন ‘শোনো ম্যান তোমার সঙ্গে আমার আর হয়তো দেখা হবে না। তবে আমি আছি। নিরাপদে দেশে ফিরে যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারব।’

ব্যাপারটা তখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না অভি পাটোয়ারির। আগের মতোই হাঁ করে তাকিয়ে রইল শুধু। চারপাশে আর্মি জায়গাটা যেভাবে ঘিরে ফেলেছে কীভাবে দেশে ফিরে যাবার ব্যবস্থা হবে কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না মানুষটা রসিকতা করছে না তো!

অভির সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অন্য পক্ষের ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি ফুটে উঠল। কোমরে বাঁধা চামড়ার ছোট ব্যাগের জিপার এক টানে খুলে ফেলে ভিতর থেকে টেনে বের করল দেহাতি কাশ্মীরীদের মতো দুই টুকরো পোশাক। হাঁটু ছাপিয়ে নামা আধময়লা ঢিলে ‘ফেরান’ আর শালোয়ারএগিয়ে দিয়ে বললেন ‘চটপট ড্রেস পালটে নাও। জুতো দিতে পারলাম না। আপাতত খালি পায়েই চলতে হবে। নিজের ড্রেসগুলো পুড়িয়ে ফেলতে যেও না আবার। তোমার প্যারাসুট এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেভাবে ওটা লুকিয়ে রেখেছ সেই ভাবেই লুকিয়ে ফেল কোথাও। অন্তত আগামী তিন–চারটে দিন কারো যেন নজরে না পড়ে। ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের মানুষ তুমি পারবে না?’

উইং কমান্ডার অভি পাটোয়ারি সারা শরীর এতক্ষণে চনমন করে উঠলহঠাৎ অবস্থার বিপাকে হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসটা ফিরে এসেছে আবারগা ঝাড়া দিয়ে বলল ‘পারব স্যার। তবু দুএকটা প্রশ্ন ছিল। স্থানীয় ভাষা তেমন জানা…’

‘নো প্রব্লেম।’ অভি পাটোয়ারির কথার মাঝেই অন্য পক্ষ ছোট এক চিরকুট এগিয়ে দিলেন। ‘পুরো জায়গা আর্মি ঘিরে ফেলেছে। স্থানীয় কারো এদিকে আসার সম্ভাবনা নেই। ফেরানের হাতার ভিতর দিকে একটা থাম্ব কম্পাস আঁটা রয়েছে। আর এই চিরকুটে ল্যাটিটিউড–লগনিটিউড মার্ক করা আছে। জায়গাটা খুব দূরে নয়। মাইল চারেকের মধ্যে। রাত কিছু গভীর হলে পাহারায় ঢিলে পড়বে। বেরিয়ে পড়বে সেই সময়ভেড়ার পাল নিয়ে দু’জন ভেড়াওয়ালা তাঁবু গেড়েছে ওখানে। তাদের কাছে গিয়ে শুধু বলবে এজেন্ট জিরো ওয়ান থ্রি। ব্যাস দু–তিন দিন নিশ্চিন্তে ওদের তাঁবুতে ভেড়াওয়ালা হয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে। এর মধ্যে ব্যবস্থা হয়ে যাবে

থামলেন উনি। ইতিমধ্যে বহু চিন্তা পাক খেতে শুরু করেছে অভি পাটোয়ারির মাথায়। যত সহজে ব্যাপারটা উনি বললেন বাস্তব অত সহজ নয়। ভারতীয় জঙ্গী বিমানের পাইলটের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না মিসিং খবরটা হয়তো আগামী কালের মধ্যেই ইন্ডিয়ান মিডিয়ায় জানিয়ে দেওয়া হবেঅগত্যা তার খোঁজে পাকিস্তানী সেনা–পুলিশ এল.ও.সি বরাবর পুরো তল্লাট ছিঁড়ে ফেলবে। ভেড়াওয়ালার তাঁবুও বাদ যাবে না সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলকিন্তু সামনের মানুষটা বোধ হয় অন্তর্যামী। ফের অল্প হাসলেন তিনি

‘ঘাবড়িও না ম্যান। ইন্ডিয়ান আর্মির তরফে মিডিয়াকে এখনো জানানো হয়নি খবরটা। তবে সন্ধের মধ্যেই তোমার খবর পেয়ে যাবে ওরামিডিয়াকে তাই আর কিছু জানানো হবে নাআর যেহেতু জায়গাটা এল.ও.সির খুব কাছে। দিন দুয়েকের মধ্যে তোমার খোঁজ না পেলে পাকিস্তান আর্মির স্বভাবতই ধারণা হবে হয় তুমি এল.ও.সির ওধারে ল্যান্ড করেছো নয়তো যে কোনো ভাবেই হোক বর্ডার ক্রস করে সরে পড়েছ। সার্চিংয়ে ঢিলে পড়ে যাবে। চিন্তা নেই। তাহলে এবার চলি বন্ধু। জয় হিন্দ।’

কথা শেষ করে মুহূর্তে স্থানত্যাগ করলেন উনি। সেদিকে তাকিয়ে অভি পাটোয়ারি দ্রুত স্যালুট ঠুকল ‘জয় হিন্দ।’

এই গল্প বেশি ভারি করার দরকার নেই আর। শুধু বলি এজেন্ট–০১৩ যেমন বলেছিলেন ঠিক সেই ভাবেই উইং কমান্ডার অভি পাটোয়ারি এক দেহাতি ভেড়াওয়ালাদের সঙ্গে মিশে ঠিক তিন দিনের মাথায় পাহাড়ি বন–জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এল.ও.সি ক্রস করে ফিরে এসেছিলেন দেশে যথাস্থানে ইন্ডিয়ান আর্মি তাঁকে রিসিভ করে নিয়েছিল। কেউ জানতে পারেনি।*

…………………………………………………………………………………………

 *গল্পে উল্লেখিত রবীন্দ্র কৌশিকের কথা যাঁদের জানা নেই তাঁদের বলি ভারতের সিক্রেট সার্ভিস র–এর এই এজেন্ট পাকিস্তান সেনা বাহিনীতে যোগ দিয়ে মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। বাকিটা ইতিহাস।

ছবি: রঞ্জন দত্ত (সৌজন্য: ‘শুকতারা’)

আপলোড: ২৫/৮/২০২০