Friday 3 January 2020

ভাললাগা হরর গল্প (মোবাইল ভাঃ): রাসমণি এসেছে (বাণী রায়)

রাসমণি এসেছে

বাণী রায়

পুজোর ছুটিতে আমাদের হাজারিবাগ রোডে যাওয়া স্থির হল। সকলে বলল হাজারিবাগ জায়গাটা স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল। লোকজনের ভিড় কম, জল–বাতাসও ভালো।

বাবার চেনা এক উকিলবাবুর বাড়ি ছিল ওখানে। আমরা সেইটাই ভাড়া করে ফেললাম।

সকলেরই শরীর খারাপ, বিশেষ করে মায়ের তো রীতিমতো অম্বলের ব্যারাম ধরেছে। কয়েকদিন ধরে সাজ-সাজ রব উঠল। যে যা পারি জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলি, মা-বাবা ফেলে দেন। সরকার মশাই বলেন, ‘দেখ, কথায় বলে বিদেশ-বিভুই। যা-যা নিয়ে যাবে, ফেরত আসবে না। অল্প জিনিস নাও।’

সুশান্ত বলল, ‘কেবল প্রাণটি নিয়ে যাও, ভালোভাবে সেটা যেন ফিরে আসে।’

ছোট বোন কেতকী বলল, ‘তাই বা ফেরে কিনা সন্দেহ। ওখানে যা বাঘের ভয়ের কথা শুনছি। এত ভালো ভালো জায়গা থাকতে বাবা কেন এমন একটা বুনো জায়গা বেছে নিলেন?’

সরকার মশাই বললেন, ‘বাঘ থাকলেই বা ভয় কী? সঙ্গে বন্দুক যাচ্ছে না?’

আমি বললাম, ‘বাবা ছাড়া বন্দুক ছুঁড়বে কে? এরা তো ভয়েই জুজু।’

সুশান্ত বলল, ‘দেখ, আমি ঠিক চালিয়ে দেব। আমি তো পারি। এবারে ফিরে এসে বাবা আমাকে লাইসেন্স করে দেবেন, জান?’

কেতকী ঠাট্টা করল, ‘হ্যাঁ, তুমি একদা একটা বুনো কবুতর মেরেছিলে বটে।’

হাসি-তামাশার মধ্যে আমাদের যাবার দিন এসে গেল। সে কি মোটের বহর! মা আমাদের গল্পের বই খেলার জিনিস বাদ দিয়ে দিলেও গোটা সংসারটি যেন ছালায় ভরে নিয়েছেন।

ওখানে খাবারদাবারের কষ্ট শুনে বাক্স বাক্স বিস্কিট, জ্যাম, জেলি, মাখন, আচার চলল। প্রায় সাতদিনের মতো ফলমূল। 

রামনিধিয়া আর কানাই সিং চলল সঙ্গে। মোটা রান্নাটা ওরাই চালাবে। ওখানে উকিলবাবুর মালী আছে। জল-টল তুলে দেবে সে।

বাবা বলছিলেন, ‘উকিলবাবু বলেছেন চিঠি দিলে ওখানে ভাল ঝি পাওয়া যাবে।’

মা শিউরে উঠলেন, ‘ঝি? না, না। আমার বাড়িতে আর ঝি নয়।’

বাবার মুখ কালো হয়ে উঠল। তিনি চুপ করলেন। চার বছরের উপর হয়ে গেছে, তবু মনে পড়ে সেই রাসমণি ঝিয়ের কথা। কী ন্যাকা সেজে আমাদের বাড়ি কাজ নিয়েছিল, কী ভাবে বিশ্বাসভাজন হয়েছিল, কী ভাবে রাত্রে আমার গায়ের...

মনে করলেও পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভয়ের হাওয়া বয়ে যায়। কতদিন লাগল আমার সুস্থ হয়ে উঠতে। এখনও রাত্রে স্বপ্ন দেখে চমকে উঠি। একা ঘরে শুতে পারি না।

ভয়। এমন ভয়ের তুলনা নেই। দিনরাত্রি কেবল মনে হয়, যেখানেই যাই, ওর নজর এড়াতে পারব না। একলা বাগে পেলেই ও আমার ঘাড়ে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়বে। একা একা চলাফেরাও ভয়ে করতে পারতাম না।

আমার ধারণা ছিল, কলকাতার লোকজনের ভিড়ে রাসমণি গা-ঢাকা দিয়ে আছে। তাই বাইরে যাওয়ার নামে আমার ভারি স্বস্তি বোধ হল। সেখানে বাঘ থাকলেও বাঘের চেয়েও ভয়ানক রাসমণি নেই।

হাজারিবাগ রোড স্টেশনে শেষ রাত্রে গাড়ি এল। আকাশে মেঘ, টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আধো অন্ধকারে ভোর চারটায় আমরা গেঁয়ো পাহাড়টার মূর্তি ধরতেই পারলাম না। ওখানে গাড়ি পাওয়া যায় না। ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। ভোর পাঁচটায় অন্ধকার একটু ফিকে হতেই আমরা কুলির মাথায় লট-বহর চাপিয়ে রওনা হয়ে পড়লাম। শর্টকাট রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছি বলে কুলিরা জংলা মাঠের মধ্য দিয়ে রওনা হল। আমাদের সঙ্গে দুটো টর্চ ছিল। ওরা একটা কালিপড়া ভাঙা লণ্ঠন জোগাড় করেছিল। মিটমিটে আলোয় ভিজে ঘাসের মধ্য দিয়ে চললাম। পথ আর শেষ হয় না। এই যদি শর্টকাট হয়, তবে লং–কাট কী?

গায়ের মধ্যে কেমন ছমছম করতে লাগল। জায়গাটায় কেমন যেন বুনো বুনো। আশেপাশে এবড়ো-খেবড়ো মাটির বুকে ঝোপঝাড়। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে, তবু গাছের পাতায় ভিজে স্যাঁতসেঁতে ভাব। অন্ধকারের মধ্যে সূর্য মেঘ ঠেলে দেখা দিতে পারছে না।

আমার মোটই ভালো লাগল না। কেমন এক অজানা ভয়ে গা শিরশির করে উঠল। আমি মায়ের আঁচল চেপে ধরলাম।

কাদা হয়নি পথে, কারণ মাটিটা রুক্ষ লাল। তবু মায়ের পায়ের চটি পিছলে পিছলে যাচ্ছিল। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘একখানা গাড়ি পর্যন্ত পাওয়া যায় না। সারা রাত ট্রেনে জেগে এতখানি পথ হাঁটা মুখের কথা নয়।’

বাবা কাপড় সামলে টর্চ জেলে আগে যাচ্ছিলেন। বললেন, ‘তুমিই তো বললে লোকজনের ভিড়ে গিয়ে দরকার নেই, নিরিবিলি জায়গা বেছে চল। তাই তো এখানে এলাম। নইলে আমার ইচ্ছা ছিল পুরী যাবার।’

মা-বাবার কথা-কাটাকাটি শুনে কুলিগুলো অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘আগে ঠিক করে রাখলে গরুড় গাড়ি পাওয়া যায়।’

মুকুলের ছোট ভাই মনীশ বলে উঠল, ‘ও বাবা, গরুর গাড়ি চড়ে কে?’

সুশান্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘শের হ্যায়?

কুলিরা হেসে উঠল, ‘এটা তো টিসনের রাস্তা, বাবুজি। ইধর শের কাঁহা? তবে পাহাড়ের ওই পাশে মাঝে মাঝে ছোট শের আসে।’

কেতকী বলে উঠল, ‘অ্যাঁ! আসে? মানুষ খায়?’

‘একবার একটা মানুষ ধরেছিল। গরু বাছুর কুকুর লিয়ে যায়। এ রাস্তায় ভয় নেই। এ তো শহর।’

মা ফিসফিস করে বললেন, ‘এই যদি শহুরে রাস্তা হয়, তবে বুনো রাস্তা কার নাম?’

উকিলবাবুর বাড়িখানি শহরের প্রধান রাস্তায় নয়। বড় রাস্তা থেকে একটা গেঁয়ো লাল মাটির পথ মাঠের বুক চিরে সেই বাড়ির দিকে গেছে। রেল লাইনের ধারে পুরনো, বনেদি বাড়ি। মেরামতের অভাবে ভাঙাচোরা। উকিলবাবু সারিয়ে দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু বিশেষ তাড়াতাড়িতে ভালো করে সারানো হয়নি। গোটা বাড়িময় এখানে-ওখানে ফাটল। বাড়ির তিনদিকে বাগান, জঙ্গল হয়ে আছে।

 কোনোমতে বাড়ি পৌঁছে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মা-বাবা জিনিসপত্র কানাই সিং আর মালির সাহায্যে ধরে গুছিয়ে তুলতে লাগলেন। রামনিধিয়া বড় ঘরের চৌকির উপর বিছানা বিছিয়ে দিল। আমি তাড়াতাড়ি সেখানে শুয়ে পড়লাম। বাগানের পাখির ভোরের গান শুনতে শুনতে কখন চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেল।

কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা গুছিয়ে বসলাম। লোক লাগিয়ে জঙ্গল কাটানো জিনিসপত্র কিনে সংসার পাতায় মায়ের কী উৎসাহ। বাবাকেও তাল দিতে হল। হাটে যাওয়া ফার্নিচার ভাড়া করা। আমরা কয়েকজন ভাইবোন মনের আনন্দে বেড়াতে লাগলাম। মাঠের বুকে বেড়ানোতে কী সুখ, বলে বোঝানো যায় না। চারদিকে ধুসর পাহাড়।

এর মধ্যে বাড়ির পাশের মাঠে একটা সাপ বের হল। ভাইরা ঠেঙিয়ে সেটাকে মারল। রামনিধিয়া ভীতু মানুষ। সাপের ভয়ে জড়সড়। বাড়ির ফাটলগুলো মালির হাতে-পায়ে ধরে বুঁজিয়ে ফেলল সে। সন্ধে হলেই আলো ছাড়া এক-পা নড়ত না। এদিক-ওদিক সন্দেহের চোখে চেয়ে বলত, ‘মু কী করিব? মোকে যদি কাটি দেয় তবে মোর মা কাঁদি কাঁদি মরা যাইবে।’

 কানাই সিং লাঠি ঠুকে বলত, ‘আরে, তুমহারা ডর কিউ? লাঠির ঘায়ে সাপের মাথা হামি ছাতু করে দিবে।’

আমার ছোট ভাই শোভন হেসে উঠত। ছুটে গিয়ে কানাই সিংয়ের লাঠি জড়িয়ে ধরে বলত, ‘তুমি কিছু দেখে ভয় পাও না, না কানাই সিং?’

কানাই সিং বুক ফুলিয়ে জবাব দিত ‘না।’

কিন্তু কানাই সিংয়ের মেকি বিক্রম ধরা পড়ে গেল।

বুধবারের হাটে সারা সপ্তাহের খাবার আনাজপত্র কিনে রাখা হত। শখ করে আমরাও হাটে যেতাম। কারণ, হাজারিবাগ রোডে বেড়াবার জায়গা ছিল না। কেবল মাঠ আর বন-জঙ্গল। শুধু সন্ধেবেলা স্টেশনে যাওয়া যেত। সকলেই ওখানে তাই যেতেন। কিন্তু আমরা বেশিক্ষণ সন্ধের পরে বাইরে থাকতে পেতাম না। আমাদের বাড়ি পৌঁছবার গেঁয়ো পথটার রাস্তায় আলো ছিল না। দু-ধারে ধানখেত আর জলা। এই সব স্থানে সাপের আস্তানা। দু-চার দিন আমরা যাতায়াতের পথে সাপ দেখেছি। পায়ের সাড়া পেয়ে চট করে ধানখেতের মধ্যে লুকিয়ে পড়ত। একদিন জলার জলে দেখেছি। হাঁসগুলো ভয় পেয়ে তীরে উঠে এসেছে। কাজেই সূর্য ডোবার আগেই ঊর্ধ্বশ্বাসে আমাদের ফিরতে হত।

সেদিনও পথ বেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ফিরছি। শোভনের হাত ধরে টানতে টানতে আমি নিয়ে আসছি পায়ের দিকে লক্ষ রেখে। কানাই সিং হাতে চটের থলে ভরে তরকারি, ময়দার ঠোঙা, ঘিয়ের টিন আনছে। সুশান্ত আমাদের সঙ্গে আসেনি। খেড়ুয়া নদীর ধারে বেড়াতে গেছে। অন্যরা পেছনে গল্প করতে করতে ফিরছে। সকলের শেষে মালির হাতে ঠ্যাং-বাঁধা দুইজোড়া মোরগ।

আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করলেও মাঠের মধ্যে টুপ করে সূর্য ডুবে গেল। দেখতে দেখতে গাঢ় অন্ধকার নেমে এল। আমি বললাম, ‘বাড়িটার দোষ এই, একেবারে একটেরে। রাত্তির বেলায় পৌঁছনোই দায়। রাস্তায় আলো নেই। ওইধারে বড় রাস্তায় কত আলো, লোকজন।’

মুকুল বলল ‘তাই বলে বড় রাস্তার সেই বাড়িতে থাকতে পারতে? ভুতুড়ে বাড়িটায়?’

আমরা বড় রাস্তার মোড়ে সেই বাড়িখানার নাম রেখেছিলাম ভূতুড়ে বাড়ি। প্রকাণ্ড বাড়িখানা ঝোপঝাড় লতাপাতায় ঢাকা। কেমন যেন একটা নিরানন্দ মুখ ভার করা ভাব। দেখলেই মনে হয় ভিতরে যেন একটা চাপা রহস্য থমথম করছে।

বাড়িটা এক ধনী বেনের। প্রতি বছর হাজারিবাগ বেড়াতে আসেন পরিবার নিয়ে। তাঁর স্ত্রী দারুণ পর্দানশিন। তাই আব্রুর উদ্দেশ্যে বাডিখানা এমনি করে গাছপালা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন যাতে সদর রাস্তা থেকে কিছু চোখে না পড়ে।

বাড়িটার কাছে এলেই বিশেষ করে আমার একটা অস্বস্তি বোধ হত। মনে হত সেই বাড়ির মধ্যে কী যেন একটা আছে, আর তার লক্ষ্য বুঝি আমি। একদিন একঝাড় মর্নিংগ্লোরি লতার ফাঁকে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। বাড়ির কেউ বিশ্বাস করেননি। কিন্তু সেদিন থেকে বাড়িটাকে ভূতুড়ে বাড়ি' বলা হত।

আমি বললাম, ‘না বাবা, ভূতুড়ে বাড়িতে লক্ষ টাকা দিলেও থাকতে পারব না। তার চেয়ে আমার বুনো বাড়িই ভালো।’

এধারে অন্ধকার এত গভীর কালো হয়ে উঠেছে যে, চোখের পল দেখা যাচ্ছে না। মুকুলের কাছে ছোট টর্চটা ছিল। সে আগে পথ দেখিয়ে চলতে শুরু করল।

হঠাৎ কেমন একটা ডাক শোনা গেল, কোন এক জন্তুর। আমরা আগে শুনিনি। আমাদের ডানদিকে ধানখেত আর জলা। বাঁদিকে মাঠ দূরে পাহাড়। সেদিক থেকে ডাকটা এদিকে এগিয়ে আসছে।

এটা আবার কী ডাকে? শেয়াল নাকি? মালি উত্তর দিল, ‘না। ফেউ ডাকিছে।’

ফেউ ডাকিছে! বলে কী! আমাদের মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল, ‘ফেউ ডাকিছে কেন? বাঘ আসিছে নাকি?’

মালি নির্বিকারভাবে বলল, ‘হ বাঘ আসিছে।’

আমরা লাফিয়ে উঠলাম, ‘বল কী? এখানে, শহরের মধ্যেও বাঘ আসে নাকি?’

মালি ডাল-ভাত খাবার মতো স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আজ মাসখানেক ধরে বাঘ ইধার পানে  আসিছে। হুড়াং, চিতা হইছে। হাঁসটো মারিছে, কুকুরটা লিছে।’

আমরা তখন ভয়ে কাঠ। এধারে ফেউয়ের ডাক ক্রমেই এগিয়ে আসছে। অন্ধকারে বোধহয় এখনই কোথাও বাঘের ডাক বেজে উঠবে। তারপর? আমরা ছুটতে শুরু করলাম। শোভন ছোট। ও আমাদের সঙ্গে ছুটে পারবে কেন? এধারে সাহসী কানাই সিং ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। তার হাতপা নিজের বশে নেই। আমরা তাকে উৎসাহ দিলাম, ‘লাঠিটা বাগিয়ে ধরে থাকো। এলেই এক ঘা দেবে।’

কানাই সিং কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘শের লাঠি দিয়ে রোখা যাবে না। আমি কী করবে?’

বেগতিক দেখে তার হাতের মাল-পত্র আমরা ভাগাভাগি করে বইলাম। শোভনকে কাঁধে তুলেই কানাই সিং হনহন করে সকলের আগে ছুটতে লাগল। টর্চের আলোর জন্য পর্যন্ত দাঁড়াল না।

আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে মাল-পত্রের গাদা বয়ে ওর পেছনে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করতে লাগলাম ‘থামো কানাই সিং। আলো আগে যাক। নইলে সাপের ঘাড়ে পা দেবে।’

কানাই সিং তালগাছের মতো পা দুটো দুই দিকে ছুঁড়ে পালাতে পালাতে বলল, ‘পথ আমার চিনা আছে দিদিমণি। আপনারা আলো দেখে আসুন।’

আমার তখন অব সঙ্গীন অবস্থা। সকলের বড় আমি। যদি ভয় দেখাই, ছোট ভাই-বোনেরা ভয় পাবে আরো বেশি। বাড়ির পথ যেন শেষ হয় না। এদিকে ফেউ ডেকেই চলেছে। দূরে মাঠের মধ্যে আবছা মতো কী যেন দেখলাম। মালিকে বললাম, ‘ওটা কী মালি?’

মালি নিশ্চিন্তে উত্তর দিল ‘হায়েনা বা।’

আমরা দ্বিগুণ বেগে ছুট লাগালাম। ময়দার থলে ফেঁসে কেতকী ময়দা-মাখা হয়ে গেল।

আনাজপাতি গড়িয়ে পড়ল। কে দেখে? আমরা তিন লাফে বাড়ি।

রামধনিয়া কানাই সিংয়ের ভয়ের কথা শুনে বেজায় খুশি। এতদিন ধরে সাপের ভয়ে মরা হয়ে সবার ঠাট্টা কুড়িয়েছে, কিন্তু এবার কানাই সিংয়ের শেরের ভয় তাকে টেক্কা দিল।

মা চিন্তিত সুরে বাবাকে বললেন, ‘দেখ, না দেখে বাড়ি ভাড়া করার ফল বোঝা যাচ্ছে। ফাটা, ভাঙা তো আছেই! সাপের ভয়ে সর্বদা সামলে চলতে হয়। এদিকে বড় রাস্তা থেকে এত দূরে বাড়ি। বাঘের কথাও শোনা যাচ্ছে। আজ বাছারা ভয়ে আধমরা হয়ে ফিরেছে। এখন কী করা যায়?’

বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী আর করা যাবে? তোমরা যদি এত ভিতু হও তবে কলকাতায় দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকলেই পারতে। এসব পাড়াগেঁয়ে জায়গায় কত কী বেরোয়। সব কি আর সত্যি, হয়তো বাঘডাশা বা বনবিড়াল। সাঁওতাল মালির কথায় বিশ্বাস কী? হয়তো ছয়মাসে একটা হাঁস মারা যায়। ওরা বাঘের ভয়ে অস্থির।’

বাবা যা কিছুই বলুন না কেন, পরদিন সকালে আমাদের বাড়ি থেকে কিছুদূরে রাস্তায় একটা ছোট বাছুর মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। সারা গায়ে তার ক্ষতচিহ্ন, গলায় বাঘের দাঁতের দাগ। বকনা বাছুর, সদ্য হয়েছে।

মা কেঁপে উঠলেন শুনে ‘যদি কাল ওদের ঘাড়ে বাঘ লাফিয়ে পড়ত! আমার মন্দ কপাল। আমার ছেলেপিলেরা কেবলই বিপদে পড়ে! মানুষ বাঘের হাত থেকে একবার রুবিকে ফিরে পেয়েছি। এখন আবার বাঘের কবলে পড়ল। আমার মনে হয় চলে যাওয়াই ভালো।’

বাবা বললেন, ‘তা তো বলবেই। সবে অম্বলটা কমে গেছে কিনা। আমিও শরীর কিছু ভাল বোধ করছি। এক মাসের জন্য বাড়ি নেওয়া হয়েছে। দশ দিনের মধ্যেই ফিরে যেতে চাইছ? ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যের দিকেও তো দেখা উচিত। বারোমাস এক জায়গায় থাকা ভালো কি? আচ্ছা এবার থেকে আমি না হয় বন্দুক ঘাড়ে ওদের পেছনে দারোয়ানি করতে যাব। তাহলে হবে তো?

আমি ব্যবস্থাটা শুনে আনন্দে সকলকে খবর দিতে গেলাম। বাবা সঙ্গে থাকলে ভয় কিসের?

আমরা ধীরে ধীরে হাজারিবাগ রোডের সমস্ত দিক দেখে বেড়াতে লাগলাম। বাবা বন্দুক হাতে সঙ্গে থাকতেন, লণ্ঠন নিয়ে কানাই সিং থাকত। সকলে এক সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে যত শিগগির সম্ভব সন্ধ্যার আগে ফিরে আসতাম। তারপর চলত ক্যারাম, লুডো, গল্প, পড়াশোনা। সকাল বেলায় বাজারে যেতাম। খাওয়া-দাওয়ার ভারি সুখ ছিল। মোরগের ঝোল হত প্রায়ই।

একদিন গেলাম রজদহে। আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল দূরে। লোকে পিকনিক করতে যায়।

দুপুরে তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে দুখানা গরুর গাড়ি করে আমরা রওনা হলাম। বাবা, সুশান্ত, মুকুল, কানাই সিং, রামধনিয়া হেঁটে চলল।

ওখানে গিয়ে দেখি বহু লোক। রান্না-খাওয়া করছে কোনো কোনো দল। সুশান্ত বলল, দেখ দেখ দিদি, ওই ভূতুড়ে বাড়ির লোকেরা।

একখানা বড় পাথরের উপর বসে আছেন সর্বাঙ্গে ভারী ভারী সোনার গয়না পরা বেনে-গিন্নি। আশেপাশে তার খাবার বাসন-পত্র ঘষে মেজে তুলছে ক’টি ঝি-চাকর। কর্তা, বড় দুই ছেলে, ছেলের সঙ্গে বউ আছেন।

বেনে-গিন্নি আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এলেন। ওঁরা এখানে রান্না খাওয়া করেছেন। বিকালের চা খেয়ে তবে ফিরবেন। মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানে বাঘ বের হয়?’

বেনে-গিন্নি উত্তর দিলেন, ‘এতকাল ধরে আসছি দিদি, বাঘের গল্পই শুনেছি মাত্র। দূরে বনের ধারে কখনো কখনো বের হত। এবারে যেন ঘরের গোড়ায় বাঘের হামলা শুরু হয়েছে। সন্ধে লাগতেই ফেউ ডাকে। চাকর-বাকর ভয়ে বের হয় না পথে। যা মুশকিল হয় রাতবিরেতে দরকার হলে।’

আমি বললাম, ‘বাঘ দেখেছেন?’

‘দেখিনি বটে তবে ছোট জাতের হায়না বা চিতা হবে হয়তো। বড় জানোয়ার ধরে না। আমাদের হাঁস–মুরগির খোঁয়াড় প্রায় শেষ করে দিয়েছে মাঠের দিক থেকে ঢুকে। একমাস দেড় মাস এসেছি রোজ একটা করে নেবেই। কদাচিৎ বাদ যায়। মনে হয় বাঘডাশা বা খাটাশ আসে। ফাঁদ পেতে দেখেছি ধরা পড়ে না।’

বাঘের কথা শুনে সুশান্ত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বুক ফুলিয়ে বলে উঠল, ‘আমি এক গুলিতে ওই বাঘডাশা কি খাটাশকে শেষ করে দিতে পারি।’

মা বলেন, ‘থাক, আর বীরত্বে কাজ নেই।’

‘বেনে-গিন্নি খুশি হয়ে বললেন, ‘বেশ তো বাবা। ফি হাটে কিনে কিনে হাঁস-মুরগি আর রাখতে পারি না। বেশ ছেলেটি আপনার, দিদি। একটু মিষ্টি খাও। ও বিন্দে ঝি, মিষ্টির হাঁড়িটা আনো তো এদিকে।’

মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও বেনে-গিন্নি আমাদের ঘরে-তৈরি পান্তুয়া, মিহিদানা প্লেট ভরে দিলেন। ঘোমটা-ঢাকা একটা ঝি প্লেট ধুয়ে বাস্কেটে ভরতে লাগল। আমরাও আমাদের চিকেন স্যান্ডউইচ ও কড়াইশুঁটির কচুরির ভাগ দিলাম।

মোটা বিন্দে-ঝি থপ–থপ করে রূপোর পানের বাক্স এনে পান দিল। মা বললেন ‘ঘোমটায় মুগ্ধ-ঢাকা যে আপনার ঝিয়ের? লজ্জা না কি?’

বেনে-গিন্নি ফিসফিস করে বললেন, লজ্জা না ঠিক। তবে মানুষটি বড় ঠাণ্ডা, বড় ভাল। ওর মুখে সাদা-সাদা দাগ আছে। তিন বছর বয়সে নাকি পুড়ে গিয়েছিল। তাই ঢেকে রাখে। কী ধর্মে মন! রোজ সন্ধের পর দোর দিয়ে জপতপ পুজো-আহ্নিকে ঝাড়া একটি ঘণ্টা। প্রাণ দিয়ে খাটে সংসারের জন্যে।’

মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পুরনো নাকি?’

‘বেশি দিন নয়। মাস দশেক মাত্তর। রানিগঞ্জে আমরা থাকি তো। ওখানেই একদিন ধরে পড়ল। আশ্রয় নেই। তাই রয়েছে।’

‘ঝি পান দিতে এলে দেখলাম সারা গা ঢেকে রাখলেও হাতে তার বড় বড় সাদা দাগ। লোকের চোখের আড়ালেই লুকিয়ে লুকিয়ে ফিরছে। চেহারা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

ঝি দেখলেই এখনও আমার গা কাঁপে। আমি ওখান থেকে উঠে জলের বুকে পাথরের উপর বসলাম।

উঁচু-নিচু পাথরের গা বেয়ে জল পাক দিয়ে ফিরছে। জলের সুর যেন আমার কানে কানে বলছে, রুবি, সাবধান। রাসমণি কিন্তু ধরা পড়েনি।

মন খারাপ হয়ে গেল। এখানে চা খাওয়া শেষ হলে যাবার জন্য তৈরি হলাম। বেনে গিন্নি তো যাবেন বড় রাস্তার ভুতুড়ে বাড়িতে। আমরা যাব মাঠ ভেঙ্গে। ঝিটার দিকে এক–আধবার আড়চোখে দেখলাম। রাসমণি ছিল রোগা এ থপথপে মোটা। পুড়ে গিয়ে এর মুখে দাগ। হাতের দাগ তো স্বচক্ষেই দেখলাম। তবু গায়ের মধ্যে ছমছম করে কেন? রাসমণি সারা জন্মের মতো আমার সাহস নিয়ে গেছে। হায় হায়!

বেনে গিন্নির সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। উনি একদিন বেড়াতে এলেন। তারপর আমরাও একদিন গেলাম।

ভূতুড়ে বাড়িতে পা দিতে গা যেন শিউরে উঠল। যত যাই হোক, এখানে যেন গুপ্ত কিছু আছে। কোনো ভয়।

সুশান্ত হাঁস-মুরগির খাঁচা দেখল। বাড়ির পেছন দিক দেখল। মাঠ থেকে সোজা ঢোকা যায়। বেনে-গিন্নি বললেন, ‘এক একদিন পাখিগুলোর ঘাড় মটকে ফেলে রেখেই পালায়। হুড়ারগুলো ভারি বজ্জাত।’

বিন্দে তাড়াতাড়ি সরে গিয়েছিল। এখন হঠাৎ চোখে পড়ল মুরগির খাঁচার পাশে ঝোপের আড়াল থেকে একদৃষ্টে দেখছে আমাদের। ঘোমটা-ঢাকা তার মুখ আমরা দেখতে না পেলেও অনুভবে বুঝলাম। আমার ভালো লাগল না। সেই ঘটনার পরে যে কোনো ঝি দেখলেই আমি অস্থির হয়ে পড়ি। তাই সুশান্তকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলাম।

মাঠে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। কালো অন্ধকার নেমে আসছে। সুশান্ত বলে উঠল, ‘আরে, ব্যাটারি যে ডাউন! দিদি, চট করে এগিয়ে যাও। আমি বিষ্ণুর দোকান থেকে ব্যাটারি কিনে আসছি।’

আমি অস্বীকার করতে লজ্জা পেলাম। নিত্য যাতায়াত করছি। পথ আমার মুখস্থ। রাতের এখনও দেরি আছে। আমি একাই গেঁয়ো পথটায় নামলাম।

কিন্তু একটু যেতেই বুঝলাম ভালো করিনি একা এসে। সূর্য অস্ত যাওয়া মাত্র, মাঠ অন্ধকার হয়ে গেছে। চোখে ভালো দেখা যায় না। এখানে ওখানে ধানখেতের মধ্যে যেন খসখস শব্দ। ভয় হতে লাগল সাপের ঘাড়ে পা না দিয়ে বসি।

বাঘের ভয়ে অন্ধকারের আগেই যে যার ঘরে লুকিয়েছে। আমি একেবারে একা। কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। এখনি বোধহয় মাঠের বুকে ফেউয়ের ডাক বেজে উঠবে। তারপরে তার আগমন হবে ব্যাঘ্র মহোদয়ের।

হঠাৎ লক্ষ করে দেখলাম, আরো একটি প্রাণী আমার মতো তাড়াতাড়ি আমার পেছনে মাঠ পার হচ্ছে। অন্ধকারে বোঝা না গেলেও, মনে হল দেহাতি কোনো লোক। হয়তো আমাদেরই পাড়ার কেউ।

মনে আশ্বাস এল বাঘ এলেও একজন লোক তো পাবো। দু-এক বার ফিরে দেখলাম। হনহন করে ঘোড়ার মতো বেগে আসছে সে যেন আমাকে ধরতে চায়।

মনকে বোঝালাম, এটাই স্বাভাবি। মানুষ দেখে মানুষ তো এগিয়ে আসবেই। কিন্তু লোকটির যেন সর্বাঙ্গ দিয়ে একটা নিষ্ঠুর ইচ্ছা ফুটে বের হচ্ছে। ভয় হল গায়ে আমার সোনার গয়না যদি চোর-ডাকাত হয়। এদিকে জলা, অন্য দিকে মাঠ। পালাই কোথায়? একমাত্র বাড়িই ভরসা। দৌড়বার মতো হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিলাম। ওমা, মুহূর্তে এই লোকটাও জলার বেগ বাড়িয়ে দিল। না ভুল নয়, তার লক্ষ্য আমি।

দারুন ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। কেন সুশান্তকে যেতে দিলাম? ছোট হলেও বিএ পড়া ছেলে তো। এখন কী করি? আমি ছুটতে শুরু করলাম অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে।

যে কোনো প্রকারেই হোক সে আমাকে ধরবে।

প্রাণের ভয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির গেটে এসে গেলাম। হাতাটুকু পেরোবার আগে ফিরে দেখলাম। ঘন অন্ধকারে সাদা শাড়ি জড়ানো যে, সে তো পুরুষ নয়! বুকের মধ্যে ভয় লাফিয়ে উঠল। সে কে তবে? মাথার মুখের কাপড় ইতিমধ্যে সরে গেছে, হাঁপাচ্ছে সে–ও। সন্ধের হালকা আলোয় স্পষ্ট তার মুখ দেখলাম। সে রাসমণি! রাসমণি এখানেও এসেছে!

তারপরে এক চিৎকার দিয়ে কেমন করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে মায়ের কোলে ঢলে পড়লাম আর মনে নেই।

মা বললেন, ‘রুবির কী করে ভুল হবে?’

বাবা বললেন, ‘মনে ভয় পুষে রাখলে অমনি হয়। দড়িকেও সাপ মনে হয়, কলকাতা ফিরে ওকে ভালো মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাতে হবে। এখানে রাসমণি আসবে কোথা থেকে? এতদিনে সে মরে ভূত হয়ে গেছে।’

মা বললেন, ‘রুবি বলছে পাড়ার বাড়িগুলো খুঁজে দেখতে যেখানে যেখানে ঝি আছে। বেনে-গিন্নির ঝি-টাকেও দেখা দরকার।’

বাবা চটে উঠলেন, ‘তোমাদের মাথা খারাপ হয়েছে? নিজেরাই তো বলছ রাসমণি ছিল রোগা, বেনেবাড়ির ঝি ঢাউস মোটা। তাছাড়া ওর সারা গায়ে দাগ, তাও তো দেখেছ? ভদ্রলোকের বাড়ির ঝি এভাবে খোঁজা চলে? কী ভাববেন তারা? রাসমণি যদি এসেই থাকে, তাহলে লোকের বাড়ি ঝি গিরি করছে কে বললে? সে তো বনে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারে। ওর তো রান্না করা খাবার ডাল ভাত লাগবে না। কাজেই খাবার ভাবনা নেই।’

মা শিউরে উঠলেন, ‘এত নিরিবিলি জায়গায় আসাই আমার ভুল হয়েছে। চল, কালই চলে যাই।’

বাবা বললেন, ‘সে আমি জানি। এসেই তোমরা যা শুরু করেছ! দু’তিন দিন কোনোমতে কাটিয়ে চলে যাব। রুবিকে বাড়ির বার হতে দিও না। অত ভিতু যখন।’

তাই ঠিক হল। মা আমাকে চোখে চোখে রেখে নিশ্চিন্ত হলেন বাড়ির সীমানায়। বাড়ির পেছনে ঝোপঝাড়, সেদিকে আমার যাওয়া বন্ধ হল।

এরমধ্যে খবর এল কাকা-কাকিমা ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আসবেন। নির্দিষ্ট দিনে কেতকী, অতুল, মনীশ সকলে স্টেশনে যাবার ধুম তুলল। সন্ধ্যার পরের গাড়ি ধরে ওরা আসছেন। বাবা অগত্যা বাড়িতে রামধনিয়া ও মালিকে পাহারায় রেখে সুশান্তকে বসিয়ে গেলেন। কানাই সিং লাঠি ঘাড়ে লণ্ঠন হাতে চলল। ফেরার পথে ওঁরা মালপত্র-সহ গরুর গাড়িতে আসবেন।

মা আজ রান্নাঘরে গোটা দিন আছেন। রামধনিয়া ওঁকে সাহায্য করছে। মালি ফরমাশ মতো এটা-ওটা আনছে ছুটে ছুটে। সুশান্ত বাবার ঘরে বসে একমনে কী যেন ভাবছে। কথা বলতে গেলাম উত্তর দিল না। অগত্যা আমি আমাদের ঘরে ঢালা বিছানায় শুয়ে পড়লাম গল্পের বই হাতে। সেদিনের ওই ঘটনায় দারুণ ভয়ে শরীরটা ভালো ছিল না। দু’রাত্রি ঘুম হয়নি, চমকে উঠেছি। ক্লান্তি চোখে হঠাৎ ঘুম নেমে এল।

 এ বাড়িতে বিজলি নেই। ঘরের মধ্যে লণ্ঠন জ্বলছে, কিন্তু বাইরে উঠোন অন্ধকার। ঝোপেঝাড়ে ঢাকা বাইরেটা হলেও আমাদের ঘরটি কী নিরাপদ! মায়ের কল্যাণস্পর্শ মাখানো, বাবার পাহারায় রাখা। আরামে, শান্তিতে চোখে ঘুম নেমে এল। রাসমণি এখানে আমার নাগাল পাবে না।

ঘুম যেন ক্রমেই গাঢ় হয়ে আমাকে টেনে নিতে লাগল ঘুমের দেশে। হাত-পা ভারী হয়ে উঠল। ক্রমে যেন নিঃশ্বাসও কেমন থমকে গেল।

চমকে উঠলাম। সত্যি তো, নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। গোটা দেহের উপর যেন পাথরের ভার। চোখ খুলেই মুখের উপর একজোড়া হিংস্র দৃষ্টি দেখলাম। একখানা বীভৎস মুখ, সাদা-সাদা দাগে ভরতি ঝুঁকে আছে আমার মুখে উপর। চিৎকার করে উঠতে গেলাম, পারলাম না। তার হাত আমার মুখ চেপে ধরে আছে। তার শরীর আমাকে চেপে রেখেছে। সে আমার চিরজীবনের আতঙ্ক রাসমণি!

মাকে ডাকতে গেলাম, বাবাকে ডাকতে গেলাম। বুঝলাম আজ আর নিস্তার নেই। কীভাবে যেন ভ্যাম্পায়ার ঢুকেছে আমার রক্ত খেতে। কথা বলার পথ বন্ধ, দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। চাপা গলায় হিস হিস করে রাসমণি বলে উঠল, ‘কেমন জব্দ? একবারে দাঁত বসিয়েছি, আর কি ছাড়ি? এত রক্ত খেলাম তোর মতো মিষ্টি রক্ত পাইনি রে!’

রাসমণির সরু চোঙার মতো ঠোঁট রক্তের নেশায় আমার গলার কাছে নেমে এল। সেই ধারালো, লাল ছোপ ধরা দাঁতের সারি বার হয়ে এল ঠোঁটের ফাঁকে।

আমার চোখের জলে বালিশ ভিজে গেল। রাসমণির হাত থেকে আর মুক্তি নেই। সমস্ত জীবনের আশা-আকাঙ্খার শেষ এখানেই। জানোয়ারের মতো একটা ঘৃণ্য রক্তচোষার হাতে মরতে হবে? উপায় কি? নড়াচড়ার পথ নেই আমার। শেষ জ্ঞানটুকু দিয়ে ভগবানকে ডাকলাম, ‘বাঁচাও।’

রাসমণি বীভৎস হাসি মুখে আমার গলার নলিতে মুখ নামাল। করাতের মতো দাঁতের ছোঁয়া লাগাল গলায়। আর এক মিনিট মাত্র আমার আয়ু। এখনি নলি ছিঁড়ে ফেলবে, রক্ত চুষে খাবে। এই বুঝি কামড় বসাল।

এমন সময় আমার মূর্ছা অবস্থার মধ্যে একটা শব্দ এল কানে অতি কাছে বন্দুকের গর্জন গুড়ুম।

আমাকে ছেড়ে রাসমণি ভয়ানক স্বরে আর্তনাদ করে উঠল, তারপরে একলাকে দরজা দিয়ে পালাল। আমার অজ্ঞান হয়ে পড়বার আগে মনে হতে লাগল, কে বন্দুক ছুড়ে আমাকে বাঁচাল? বাবা কি ফিরেছেন?

*       *       *     *

রাসমণির কাহিনি অদ্ভুত। বেনে-গিন্নির সেই বিন্দে ঝি–ই রাসমণি। কপালদোষে আমরা এখানে এসে পড়া মাত্র আমার উপর নজর রেখেছিল সে। রোজ রোজ হাঁস-মুরগি, জীবজন্তু খেয়ে থপথপে মোটা হয়ে পড়েছিল। বয়সও তো পঞ্চাশের উপর। রোজ সন্ধ্যায় জপতপের ছুতোয় বেনে-গিন্নির কাছে ছুটি নিয়ে রাসমণি ঘরে দোর দিত। তারপর অন্ধকারে জানালার শিক খুলে জানালা দিয়ে মাঠে-ঘাটে বার হত শিকারের আশায়। জানালার শিক আলগা করে রেখেছিল আগেই। ফেউয়ের ডাক রোজ রাসমণি ডাকত, যাতে ভয় পেয়ে লোকজন সরে থাকে, ওর কীর্তি কারুর চোখে না পড়ে। জীবজন্তু ধরে রক্ত শুষে খেত, ছোট বাচ্চাদেরও পেলে ছাড়ত না। তাছাড়া বেনে-গিন্নির হাঁস-মুরগি তো ছিলই। কোথায় তার মুখ-হাত পুড়ে গিয়েছিল। কেউ বোধহয় ছ্যাঁকা দিয়েছিল বা নাইট্রিক অ্যাসিড ছুড়েছিল। ফলে গা-মুখ ঢেকে রাখবার অজুহাত পেয়েছিল সে।

আমাকে রাজদহে দেখে ওর এত লোভ হয়েছিল যে, ও আর সামলাতে না পেরে সেদিন একা পেয়ে আমাকে তাড়া করেছিল। আর বাড়ি থেকে বার হওয়া বন্ধ হওয়ায় আমাদের বাড়ির পেছনের ঝোপে রাত্রিবেলা লুকিয়ে সুযোগ খুঁজত। আমার রক্ত খাবার তর আর ওর সইছিল না।

বাড়ির বেশিরভাগ মানুষ স্টেশনে গেছে। মালি পেঁয়াজ আনতে ছুটেছে। মা রামধনিয়াকে নিয়ে রান্নাঘরে এক উনুনে মাংস অন্য উনুনে পোলাও চাপাচ্ছেন। পৃথিবী ভুলে গেছেন তিনি। তাছাড়া দরজা বন্ধ সুশান্ত পাহারায় আছে।

সুশান্ত! সুশান্ত অবাধ্য বেপরোয়া তাই আমার প্রাণ বাঁচল। বেনে-গিন্নির হাঁস–মুরগি খাওয়া বাঘ অথবা বাঘডাশা খাটাশ হোক, বা হুড়ার অথবা চিতে সুশান্ত সেদিন মারার একটা চেষ্টা করবে ঠিক করেছিল। বাবা থাকলে বন্দুক পাওয়া যায় না। আজ বাবা নেই সুশান্ত বন্দুক নিয়ে জন্তুটাকে মেরে সকলের বাহবা নেবে স্থির করেছিল। তাই মালি বের বের হয়ে পড়তেই দরজা ভেজিয়ে রেখে গোপনে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েছিল। মলি এখনই ফিরে এসে দরজা এঁটে দেবে। ভয় কী?

আমাদের ফেরার দিন স্থির হয়ে গেছে বুঝে সুশান্ত যেমন মরিয়া মরিয়া রাসমণিও। ঝোপের আড়ালে আগে থেকেই ঘাপটি মেরে ছিল। দরজা ভেজিয়ে সুশান্ত বের হয়ে যেতেই সে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে আমার ঘরে ঢুকল। রক্তের লোভে সে তখন পাগল হয়ে গেছে। চক্ষের নিমেষে কাজ সেরে পালিয়ে যাবে ভেবেছিল।

কিন্তু রাসমণি জানত না অল্প দূর যেতেই মালির সঙ্গে সুশান্তর দেখা হয়ে গেল। পাড়া থেকে পেঁয়াজ নিয়ে মালি ফিরছিল। সুশান্তকে দেখে বলল, ‘দাদাবাবু, বাড়িতে ঢুকল কে?’

সুশান্ত অবাক হয়ে বলল, ‘কেউ না তো। তুমি তাড়াতাড়ি যাও। আমি আসছি।’

মালি বলল, ‘না দাদাবাবু, একজন মেয়েলোক ঢুকল। আপনিও বের হলেন, উনিও ঢুকলেন বটে।’

‘একজন মেয়েলোক শোনার সঙ্গে সঙ্গে সুশান্ত ঊর্ধ্বশ্বাসে ফের বাড়ির দিকে ছুটল। রাসমণির কথা ওর মনে পড়ে গেছে।

তারপর? একটু দেরি হলে আমার প্রাণ আর থাকত না। সুশান্ত বন্দুক নিয়েছিল চুরি করে। সেই বন্দুকের গুলি আমাকে বাঁচাল এবার।

সুশান্তর ছোঁড়া গুলি রাসমণির গোড়ালিতে লেগে দেওয়াল ঘেঁষে চলে গিয়েছিল। রাসমণি আহত হলেও তাই বেঁচে গেল। হাজারিবাগ রোডে আর ওকে দেখা যায়নি। এবার খোঁড়া হয়ে অন্য জায়গায় শিকার খুঁজবে। কেউ ওকে পুড়িয়ে দিয়েছে, সুশান্ত খোঁড়া করে দিল।

পরের দিনই আমরা কলকাতায় চলে এলাম। কাকা-কাকিমাও সব শুনে থাকতে চাইলেন না আর।

আর একবার বেঁচে গেলাম। কিন্তু আমার সারা ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে আতঙ্ক হয়ে রইল রাসমণি। সর্বদা মনে বাজতে লাগল: রাসমণি এখনও মরেনি।

আপলোড: ৪/৮/২০২০


8 comments:

  1. প্রথম আর তৃতীয়টা পড়েছিলাম৷এবার ২য়টাও পড়লাম৷অসাধারণ৷

    ReplyDelete
  2. ভীষন ভয়ানক।এই গল্পটা পড়ার ইচ্ছা ছিল। আজ সেটা পূরণ হল।

    ReplyDelete
  3. রাসমণি এখনও মরেনি— অসাধারণ, এবং টানটান রহস্য-রোমাঞ্চে ভরপুর এই গল্প পাঠে অপরিসীম তৃপ্তি পেলাম।

    ReplyDelete
  4. Asadharan bolleo Kom hoy..r dada ager golpogulo pabo..???

    ReplyDelete
  5. এই রাসমনি আর রাইমনি আমার অত্যন্ত পছন্দের। ভয় পাই, তাও পড়ি

    ReplyDelete
  6. Ageo porechi , Abar porlam . Darun lage !!

    ReplyDelete