বনফুল
সমস্তটা দিন বন্দুক কাঁধে করে একটা
চখার পিছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। যাঁরা কখনও এ কার্য করেন নি তারা বুঝতে
পারবেন না হয়তো যে, ব্যাপারটা ঠিক কী জাতীয়। ধূ-ধূ করছে বিরাট বালির চর, মাঝে মাঝে
ঝাউগাছের ঝোপ, এক ধার দিয়ে শীতের শীর্ণ গঙ্গা বইছে। চারদিকে জনমানবের চিহ্ন নেই। হু-হু
করে তীক্ষ্ণ হাওয়া বইছে একটা। কহল গাঁয়ের খেয়াঘাটে গঙ্গা পেরিয়ে প্রায় ক্রোশ দুই
বালির চড়া ভেঙে আমি এই পারিপার্শ্বিকের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম সকালবেলা। সমস্ত
দিন বন্দুক কাঁধে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বালির চড়া ভেঙে ভেঙে কতখানি যে হেঁটেছি, খেয়াঘাট
থেকে কতদূরেই বা চলে এসেছি , তা খেয়াল ছিল না। তবে মনে হচ্ছিল, সারাজীবন ধরে যেন হাঁটছিই,
অবিশ্রান্ত হেঁটে চলেছি। চতুর চখাটা কিছুতেই আমার বন্দুকের মধ্যে আসছে না, ক্রমাগত
এড়িয়ে এড়িয়ে উড়ে পালাচ্ছে।
আমি এ অঞ্চলে আগন্তুক। এসেছি ছুটিতে
বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে। আমি নেশাখোর লোক। একটি আধটি নয়, তিনটি নেশা আছে আমার‚ ভ্রমণ, সঙ্গীত এবং শিকার। এখানে এসে
যেই শুনলাম খেয়াঘাট পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই গঙ্গায় পাখি পাওয়া যাবে, লোভ সামলাতে
পারলাম না, বন্দুক কাঁধে করে বেরিয়ে পড়লাম। লোভ শুনে মনে করবেন না যে, আমি মাংস খাবার
লোভেই পাখি মারতে বেরিয়েছি। তা নয়। আমি নিরামিষাশী। আলুভাতে ভাত পেলেই আমি সন্তুষ্ট।
খেয়াঘাট পেরিয়ে সকালের চরে এসে প্রথম
যখন পৌঁছলাম, তখন হতাশ হয়ে পড়তে হল আমাকে। কোথায় পাখি। ধূ-ধূ করছে বালির চড়া, আর
কোথাও কিছু নেই। গঙ্গার বুকে দু-একটা উড়ন্ত মাছরাঙা ছাড়া পাখি কোথায়! বন্দুক কাঁধে
করে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় কাঁআঁ শব্দটা কানে এল। কয়ে চন্দ্রবিন্দু আকার আর
অয়ে চন্দ্রবিন্দু আকার দিয়ে যে শব্দটা হয়, চখার শব্দটা ঠিক সে রকম নয়, তবে অনেকটা
কাছাকাছি বটে। কাঁ–আঁ শুনেই বুঝলুম চখা আছে, কোথাও কাছে পিঠে। একটু এগিয়ে গিয়েই দেখি,
হ্যাঁ ঠিক, চখাই বটে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম মাত্র একটি দেখে। চখারা সাধারণত জোড়ায়
জোড়ায় থাকে। বুঝলাম, দম্পতির একটিকে কোন শিকারি আগেই শেষ করে গেছেন। এটির ভব-যন্ত্রণা
আমাকেই ঘোচাতে হবে। সাবধানে এগুতে লাগলাম।
কাঁ আঁ—
চখা উড়ে গেল। উড়বে জানতাম। চখা মারা
সহজ নয়। দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। বেশ খানিকক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে আবার সাবধানে এগুতে
লাগলাম। কাছাকাছি এসেছি, বন্দুকটি বাগিয়ে বসতে যাব, আর অমনি‚ কাঁআঁ—
উড়ে গেল। বিরক্ত হলে চলবে না, চখা
শিকার করতে হলে ধৈর্য চাই। এবার চখাটা একটু কাছেই বসল। আমিও বসলাম। উপর্যুপরি তাড়া
করা ঠিক নয়‚ একটু বসুক। একটু পরেই উঠলাম আবার। আবার ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম,
কিন্তু উল্টো দিকে। পাখিটা মনে করুক যে, আমি তার আশা ছেড়ে দিয়েই চলে যাচ্ছি যেন।
কিছুদূর গিয়ে ও-ধার দিয়ে ঘুরে তারপর বিপরীত দিক দিয়ে কাছে আসা যাবে। বেশ কিছুদূর
ঘুরতে হল—প্রায় মাইলখানেক। গুড়ি মেরে মেরে খুব কাছেও এসে পড়লাম। কিন্তু তাগ করে
ঘোড়াটি যেই টিপতে যাব, আর অমনি কাঁআঁ।
ফের উড়ল। উড়তেই লাগল অনেকক্ষণ ধরে।
কিছুতেই আর বসে না। অনেকক্ষণ পরে বসল যদি, কিন্তু এমন একটা বেখাপ্পা জায়গায় বসল যে,
সেখানে যাওয়া মুশকিল। যাওয়া যায়, কিন্তু গেলেই দেখতে পাবে। আমার কেমন রোখ চড়ে গেল,
মারতেই হবে পাখিটাকে। সোজা এগিয়ে চললাম। আমি ভেবেছিলাম, একটু এগুলেই উড়বে, কিন্তু
উড়লো না। যতক্ষণ না কাছাকাছি হলাম, ঠায় বসে রইল। মনে হল, অসম্ভব বুঝি সম্ভব হয়,
কিন্তু যেই বন্দুকটি তুলেছি আর অমনি কাঁআঁ।
এবারেও এমন জায়গায় বসল যার কাছে-পিঠে
কোন আড়াল-আবডাল নেই‚ চতুর্দিকেই ফাঁকা। কিছুতেই বন্দুকের নাগালের মধ্যে পাওয়া
যাবে না। বাধ্য হয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে উড়িয়ে দিতে হল। এবার গিয়ে বেশ ভাল জায়গায়
বসল। একটা ঝাউবনের আড়ালে আড়ালে গিয়ে খুব কাছাকাছিও আসতে পারলাম‚ এত কাছাকাছি যে তার পালকগুলো পর্যন্ত
দেখা যেতে লাগল। ফায়ার করলাম।
কাঁআঁ—কাঁআঁ—
লাগল না। ঝোপে-ঝোপে যা দু-একটা ছোট
পাখি ছিল তারাও উড়ল, মাছরাঙাগুলোও চেঁচাতে শুরু করে দিলে। সমস্ত ব্যাপারটা থিতুতে
আধ ঘণ্টারও ওপর লাগল। নদীর ঠিক বাঁকের মুখটাতেই বসল আবার চখাটা গিয়ে।
আমি বসেছিলুম একটা বালির ঢিপির উপর,
মুশকিল হল—উঠে দাঁড়ালেই দেখতে পাবে। উঠলাম না। শুয়ে পড়ে গিরগিটির মতো বুকে হেঁটে
হেঁটে এগুতে লাগলাম। কিন্তু কিছুদূর গেছি, আর অমনি কাঁআঁ—
আমার মাথাটাই দেখা গেল, না বালির স্তর
দিয়ে কোন রকম স্পন্দনই গিয়ে পৌঁছল। তার কাছে, তা বলতে পারি না। উঠে দাঁড়ালাম। রোক
আরও চড়ল।
হঠাৎ নজরে পড়ল সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
নদীর জল রক্ত-রাঙা। পাখিটা ও-পারের চরে গিয়ে বসেছে। সমস্ত দিন আমিও ওকে বিশ্রাম দিইনি।
ও-ও আমাকে দেয়নি। এখন দুজনে দুপারে। চুপ করে রইলাম।
সূর্য ডুবে গেল। অস্তমান সূর্য-কিরণে
গঙ্গার জলটা যত জ্বলন্ত লাল দেখাচ্ছিল, সূর্য ডুবে যাওয়াতে ততটা আর রইল না। আসন্ন
সন্ধ্যার অন্ধকারে স্নিগ্ধ হয়ে উঠল চতুর্দিক। সমস্ত অন্তরেও কেমন যেন একটা বিষণ্ণ
বৈরাগ্য জেগে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে। পূরবী রাগিণী যেন মূর্ত হয়ে উঠল আকাশে, বাতাসে,
নদীতরঙ্গে। হঠাৎ মনে পড়ল‚ বাড়ি ফিরতে হবে।।
কত রাত হয়েছে জানি না।
ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি গঙ্গার চরে চরে।
রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। মধ্যগগনে পূর্ণিমার চাঁদ‚ চতুর্দিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে শেষে বসলাম একটা উঁচু জায়গা দেখে। অনেকক্ষণ চুপ করে বসেই রইলাম।
এমন একা জীবনে আর কখনও পড়িনি। প্রথম প্রথম একটু ভয় করছিল যদিও, কিন্তু খানিকক্ষণ
পরে ভয়ের বদলে মোহ এসে আমার সমস্ত প্রাণ মন সত্তা অধিকার করে বসল। আমি মুগ্ধ হয়ে
বসে রইলাম। মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। মনে হল, কত জায়গায়
কতভাবে ঘুরেছি, প্রকৃতির এমন রূপ তো আর কখনও চোখে পড়েনি। রূপ নিশ্চয়ই ছিল, আমার চোখে
পড়ে নি। নিজেকে কেমন যেন বঞ্চিত মনে হতে লাগল। তারপর সহসা মনে হল, আজীবন সব দিক দিয়েই
আমি বঞ্চিত। জীবনের কোনও সাধটাই কি পুরোপুরি পূর্ণ হয়েছে? জীবনের তিনটি শখ ছিল‚ ভ্রমণ, সঙ্গীত, শিকার। ভ্রমণ করেছি
বটে‚ ট্রেনে
ষ্টীমারে চেপে এখানে ওখানে গেছি কিন্তু তাকে কি ভ্রমণ বলে? হিমালয়ের উচ্চ চূড়ায়,
সাহারার দিগন্ত প্রসারিত অনিশ্চয়তায়, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রের তরঙ্গে, হিমশীতল মেরুপ্রদেশের
ভাসমান তুষার-পর্বতশৃঙ্গে যদি না ভ্রমণ করতে পারলাম তাহলে আর কী হল। সঙ্গীতেও ব্যর্থকাম
হয়েছি। সারেগামা সেধেছি বটে; কিন্তু সঙ্গীতের আসল রূপটি আলেয়ার মত চিরকাল এড়িয়ে
এড়িয়ে গেছে আমাকে। সেদিন অত চেষ্টা করেও বাগেশ্রীর করুণগম্ভীর রূপটি কিছুতেই ফুটিয়ে
তুলতে পারলাম না সেতারে।
ঠিক ঘাটে ঠিক ভাবেই আঙ্গুল পড়েছিল,
কিন্তু সেই সুরটি ফুটল না, যাতে আত্মসম্মানী গম্ভীর ব্যক্তি নির্জন-রোদনের অবাঙময়
বেদন মূর্ত হয়। শিকারই বা কী এমন করেছি জীবনে? সিংহ হাতি বাঘ গণ্ডার কিছুই মারিনি।
মেরেছি পাখি আর হরিণ। আজ তো সামান্য একটা চখার কাছেই হার মানতে হল।
কাঁআঁ—কাঁআঁ—কাঁআঁ—
চমকে উঠলাম। ঠিক মাথার উপরে চখাটা
চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখিরা সাধারণত রাত্রে তো ওড়ে না‚ হয়তো ভয় পেয়েছে কোনরকমে। উৎসুক
হয়ে চেয়ে রইলাম।
কাঁআঁ—কাঁআঁ—
আরও খানিকটা নেবে এল। হঠাৎ বন্দুকটা
তুলে ফায়ার করে দিলাম।
কাঁআঁ—কাঁআঁ—কাঁআঁ—
লেগেছে ঠিক। পাখিটা ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে
পড়ল মাঝগঙ্গায়। উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম, ভেসে যাচ্ছে।
যাক। জীবনে যা বরাবর হয়েছে, এবারও
তাই হল। পেয়েও পেলাম না। সত্যি, জীবনে কখনই কিছু পাইনি, নাগালের মধ্যে এসেও সব ফসকে
গেছে।
চুপ করে বসে ছিলাম।
চতুর্দিকে ধূ ধূ করছে বালি, গঙ্গার
কুলুধ্বনি অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে, জ্যোৎস্নায় ফিনিক ফুটছে। শিকার, চখা, বন্দুক,
সমস্ত দিনের শ্রান্তি কোন কিছুর কথাই মনে হচ্ছিল না তখন, একটা নীরব সুরের সাগরে ধীরে
ধীরে ভেসে চলেছিলাম। হঠাৎ চমকে উঠলাম। দীর্ঘকায় ঋজুদেহ এক ব্যক্তি নদী থেকে উঠে ঠিক
আমার সামনে দাঁড়িয়ে সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে গামছা দিয়ে গা মুছতে লাগলেন।
অবাক হয়ে গেলাম। কোথা থেকে এলেন ইনি, কখন বা নদীতে নাবলেন, কিছুই দেখতে পাইনি।
একটু ইতস্ততের পর জিজ্ঞাসা করলাম,
আপনি কে?
লোকটি এতক্ষণ আমাকে লক্ষই করেন নি।
আমার কথায় মন্ত্রোচ্চারণ থেমে গেল,
ফিরে আমার দিকে চেয়ে রইলেন ক্ষণকাল তারপর বললেন, আমি এখানেই থাকি। আপনিই আগন্তুক,
আপনিই পরিচয় দিন।
পরিচয় দিলাম।
ও, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন আপনি? আসুন
আমার সঙ্গে, কাছেই আমার আস্তানা।
দীর্ঘকায় ঋজুদেহ পুরুষটি অগ্রগামী
হলেন আমি তার অনুসরণ করলাম। একটু দূর গিয়েই দেখি একটি ছোট্ট কুটির। আশ্চর্য হয়ে গেলাম,
সমস্ত দিন এ অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছি, এটা চোখে পড়ে নি আমার। ছোট্ট কুটিরটি যেন ছবির
মতন, সামনে পরিচ্ছন্ন প্রাঙ্গণ, চতুর্দিক রজনীগন্ধার গাছ, অজস্র ফুল। অনাবিল জ্যোৎস্নায়
ধরণীর অন্তরের আনন্দ সহসা যেন পূষ্পায়িত হয়ে উঠেছে গুচ্ছ গুচ্ছ রজনীগন্ধার উর্ধ্বমুখ
বিকাশে। মৃদু সৌরভে চতুর্দিক আচ্ছন্ন। আমিও আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি এসেই
ঘরের ভিতরে ঢুকেছিলেন। একটু পরেই বেরিয়ে এলেন এবং শতরঞ্জি গোছের কী একটা পাততে লাগলেন।
বসুন।
বসে দেখলাম শতরঞ্জি নয়‚ গালিচা। খুব দামী নরম গালিচা। তিনিও
এক প্রান্তে এসে বসলেন। বলা বাহুল্য, আমার কৌতূহল ক্রমশই বাড়ছিল। তবে কিছুক্ষণ চুপ
করে রইলাম, তিনিও চুপ করে রইলেন। শেষে আমাকেই কথা কইতে হল।
সমস্ত দিন এ অঞ্চলে ঘুরেছি। কিন্তু
আপনার দেখা পাই নি কেন ভেবে আশ্চর্য লাগছে।
সব সময় সব জিনিস কি দেখা যায়?
মুখের দিকে চেয়ে ভয় হল, চোখ দুটো
জ্বলছে‚ মানুষের নয়, যেন বাঘের চোখ। একটা গল্প শুনুন তা হলে। রাজা
রামপ্রতাপ রায়ের নাম শুনেছেন?
না।
শোনবার কথাও নয়। দুজন রামপ্রতাপ ছিল,
দুজনেই জমিদার, একজন সুদখোর, আর একজন সুর-খোর।
সুর-খোর?
হ্যাঁ, ও-রকম সুর-পাগল লোক ও-অঞ্চলে
আর ছিল না। যত বিখ্যাত ওস্তাদদের আড্ডা ছিল তাঁর বাড়িতে। আমার অবশ্য এসব শোনা কথা।
আমার পাঞ্জাবে জন্ম, পাঞ্জাবী ওস্তাদের কাছেই গান বাজনা শিখেছিলুম। বাংলাদেশে এসে শুনলুম,
রামপ্রতাপ নামে এক জন গুণী জমিদার আছেন, যিনি সুরের প্রকৃত সমঝদার। প্রকৃত গুণীকে কখনও
ব্যর্থমনোরথ হতে হয়নি তার কাছে, গাড়িতে একজনের মুখে কথায় কথায় শুনলুম। তখনই যদি
তাঁকে ঠিকানাটাও জিজ্ঞেস করি, তা হলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়, কিন্তু তা না করে
আমি সপ্তাহখানেক পরে আর একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, রাজা রামপ্রতাপ রায় কোথায় থাকেন? তিনি
বলে দিলেন সুদখোর রামপ্রতাপের ঠিকানা। ডানকুনি স্টেশনে নেবে দশ ক্রোশ হাঁটলে তবে নাকি
তাঁর নাগাল পাওয়া যাবে। একদিন বেরিয়ে পড়লাম তার উদ্দেশ্যে। ডানকুনি স্টেশনে যখন
নাবলাম, তখন বেশ রাত হয়েছে। সেদিনও পূর্ণিমা। স্টেশনে আর একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। সুদখোর
রামপ্রতাপ ও অঞ্চলে প্রসিদ্ধ লোক, সবাই চেনে। যাকে জিজ্ঞেস করলুম, সে একটা রাস্তা দেখিয়ে
দিয়ে বললে, সোজা চলে যান। চলতে লাগলাম। কতক্ষণ চলেছিলাম তা ঠিক বলতে পারি না। খানিকক্ষণ
পরে দেখলাম একটা বিরাট প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি, চারিদিকে কেবল মাঠ আর মাঠ,
কোথাও কিছু নেই। মনে হল যেন শেষও নেই।
কিছুদূরে গিয়েই হঠাৎ সামনে প্রকাণ্ড
রাজবাড়িটা দেখা গেল, যেন মন্ত্রবলে আবির্ভূত হল‚ সাদা ধবধব করছে। মনে হল যেন মর্মর
পাথর দিয়ে তৈরি। মিনার, মিনারেট গম্বুজ, সিংহদ্বার সমস্ত দেখা গেল ক্রমশ। অবাক হয়ে
দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ, তারপর এগিয়ে গেলাম। প্রকাণ্ড সিংহদ্বারের পাশে দেখি দুজন
বিরাটকায় দারোয়ান বসে আছে, দুজনেই নিবিষ্টচিত্তে গোঁফ পাকাচ্ছে বসে। ভিতরে ঢুকব কিনা
জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ কোন উত্তরই দিল না, গোঁফই পাকাতে লাগল। একটু ইতস্তত করে শেষে ঢুকে
পড়লাম, তারা বাধা দিলে না। ভিতরে ঢুকে দেখি বিরাট ব্যাপার, বিশাল জমিদারবাড়ি জমজম
করছে, প্রকাণ্ড কাছারি বাড়িতে বসে আছে সারি সারি গোমস্তারা। কেউ লিখছে, কেউ টাকা গুনছে,
কেউ কেউ কানে কলম খুঁজে খাতার দিকে চেয়ে আছে, সবারই গম্ভীর মুখ। সামনে চত্বরে বসে
আছে অসংখ্য প্রজা সারি সারি। সবাই কিন্তু চুপচাপ, কারও মুখে টু শব্দটি নেই। আমি তানপুরা
ঘাড়ে করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম, কেউ আমার দিকে ফিরেও চাইলে না, আমার ও সাহস
হল না কাউকে কোন কথা জিজ্ঞেস করতে, আমি ঘুরেই বেড়াতে লাগলাম। আমার মনের ইচ্ছা রাজা
রামপ্রতাপকে গান শোনাব, কিন্তু হঠাৎ দেখতে পেলাম, কিছুদূরে ছোট্ট একটা বাগান রয়েছে,
বাগানের মধ্যে ধবধবে সাদা মার্বেল পাথরের উঁচু চৌতারা, আর সেই চৌতারার উপরে কে একজন
ধবধবে সাদা তাকিয়া ঠেস দিয়ে প্রকাণ্ড একটা গড়গড়ায় তামাকে খাচ্ছেন। গড়গড়ার কুণ্ডলী-পাকানো
নলের জরিগুলো জ্যোৎস্নায় চকমক করছে। বাগানে ছোট্ট একটি একটি গেট, গেটের দু’ধারে উর্দি-চাপরাস-পরা
দুজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে‚ ঠিক যেন পাথরের প্রতিমূর্তি। কেমন করে জানি না, আমার
দৃঢ় ধারণা হল, ইনিই রাজা রামপ্রতাপ। এগিয়ে গেলাম। দারোয়ান দুজন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে
রইল, বাধা দিলে না। রাজা রামপ্রতাপের কাছাকাছি এসে ঝুঁকে প্রণাম করলাম একবার।
তিনি গম্ভীরভাবে মাথাটি নাড়লেন একবার
শুধু। আস্তে আস্তে বললাম, হুজুরকে গান শোনাব বলে এসেছি, যদি হুকুম করেন—
তিনি সোজা হয়ে উঠে বসলেন, হাতের ইঙ্গিত
আমাকেও বসতে বললেন। তারপর কখন যে আমি দরবারী কানাড়ার আলাপ শুরু করেছি আর কতক্ষণ ধরে
যে সে আলাপ চলেছে তা আমার কিছু মনে নেই। যখন হুঁশ হল তখন দেখি, একছড়া মুক্তোর মালা
তিনি আমার গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন। মালাটা দেখবেন? কুটিরের ভিতর ঢুকে গেলেন তিনি, পরমুহূর্তেই
তিনি বেরিয়ে এলেন একছড়া মুক্তোর মালা নিয়ে। অমন সুন্দর এবং অত বড় বড় মুক্তো আমি
আর দেখি নি কখনও।
তারপর?
আমাকে মালা পরিয়ে দিয়ে তিনি আস্তে
আস্তে উঠে গেলেন। আমি চুপ করে বসেই রইলাম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কিছু মনে নেই।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি, রাজবাড়ি‚ কাছারি‚ চৌতারা‚ লোকজন‚ কোথাও কিছু নেই, ফাঁকা মাঠের মাঝখানে
আমি একা শুয়ে ঘুমচ্ছি।
একা! কী রকম?—সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ। ফাঁকা মাঠের মাঝখানে একা‚ কেউ নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম,
গুণী রাজা রামপ্রতাপ অনেকদিন হল মারা গেছেন। বেঁচে আছে সেই সুদখোর ব্যাটা। তার বাড়ির
পথ সবাই আমাকে বলে দিয়েছিল। কিন্তু আমার মনের একান্ত ইচ্ছে ছিল গুণী রামপ্রতাপকে গান
শোনাবার, তাই তিনি মাঠের মাঝখানে আমাকে দেখা দিয়ে আমার গান শুনে বকশিশ দিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলাম। কতক্ষণ
তা মনে নেই।
হঠাৎ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, গান শুনবেন?
যদি আপনার অসুবিধে না হয়—
অসুবিধে আবার কী? সুরের সাধনা করবার
জন্যেই আমি নির্জনবাস করছি—
আবার উঠে গেলেন। কুটিরের ভিতর থেকে
বিরাট এক তানপুরা বার করে বললেন, বাগেশ্রী আলাপ করি শুনুন।
শুরু হয়ে গেল বাগেশ্রী। ওরকম বাগেশ্রীর
আলাপ আমি কখনও শুনি নি। যা নিজে আমি কখনও আয়ত্ত করতে পারি নি কিন্তু আয়ত্ত করতে চেয়েছিলাম
তাই যেন শুনলাম আজ। কতক্ষণ শুনেছিলাম মনে নেই, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাও জানি না।
ঘুম ভাঙল যখন তখন দেখি, আমি সেই ধু ধু বালির চড়ায় একা শুয়ে আছিস কোথাও কেউ নেই।
উঠে বসলাম। উঠতেই নজরে পড়লো চখাটা চরে বেড়াচ্ছে, মরে নি।
আমরা তিনজনেই সবিস্ময়ে ভদ্রলোকের
গল্পটা রুদ্ধশ্বাসে শুনিতেছিলাম। শিকার উপলক্ষেই আমরা এ অঞ্চলে আসিয়া সন্ধ্যাবেলা
এই ডাকবাংলায় আশ্রয় লইয়াছি। পাশের ঘরেই ভদ্রলোক ছিলেন। আলাপ হইলে আমরা শিকারি শুনিয়া
তিনি নিজের এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার গল্পটি আমাদের বলিলেন। অদ্ভুত অভিজ্ঞতাই বটে। জিজ্ঞাসা
করিলাম, তারপর?
তারপর আর কিছু নেই। রাত হয়েছে, এবার
শুতে যান, আপনাদের তো আবার খুব ভোরেই উঠতে হবে। আমারও ঘুম পাচ্ছে—
এই বলিয়া তিনি আস্তে আস্তে উঠিয়া
নিজের ঘরে প্রবেশ করিলেন। আমরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। তাহার পর হঠাৎ আমার
কৌতূহল হইল, কোন অঞ্চলের গঙ্গার চরে এই কাণ্ড ঘটিয়াছিল জানিতে পারিলে আমরাও একবার
জায়গাটা দেখিয়া আসিতাম। জিজ্ঞাসা করিবার জন্য পাশের ঘরে ঢুকিয়া দেখি, ঘরে কেহ নাই।
চতুর্দিক দেখিলাম, কেহ নাই।
ডাকবাংলার চাপরাসিকে জাগাইয়া প্রশ্ন
করিলাম, পাশের ঘরে যে ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি কোথাকার লোক? চাপরাসি উত্তর দিল, পাশের ঘরে
তো কোন লোক নাই, গত দুই সপ্তাহের মধ্যে এখানে আর কেহ আসে নাই। এ ডাকবাংলায় কেহ বড়
একটা আসিতে চায় না।
বলিয়া সে অদ্ভুত একটা হাসি হাসিল।
আপলোড: ১১/১০/২০২০
No comments:
Post a Comment