মাকুমামার হস্তী কাণ্ড
শিশির বিশ্বাস
সেবার বড়দিনের ছুটিতে কদিন চিড়িয়াখানা, বটানিক্যাল গার্ডেন, ইডেনে
টেস্ট ম্যাচ দেখেও সময় যখন কাটতে চাইছে না, সেই সময় মাকুমামার
আবির্ভাব। এসেই কোনও ভনিতা
না করে বললেন, ‘চল রে ফুচে,
দিন কয়েক বেড়িয়ে আসি।’
বেড়াতে আমার আপত্তি আছে, এমন বদনাম শত্রুও দিতে পারবে না। কিন্তু সেবার নেতারহাটের সেই ভয়ানক কাণ্ডের পর মাকুমামার
সঙ্গে ফের বেড়াতে যাওয়া ঠিক হবে কিনা ভেবে মুখে জবাব এল না। সেটা আঁচ করে উনি বললেন, ‘খেপেছিস, ফের আর জঙ্গলে
যাই! এবার আর ‘কুইন অফ ছোটনাগপুর’
নয় রে। একেবারে ‘কুইন অফ হিল স্টেশন’ মানে
দার্জিলিং।
শুনে আমার চোখ প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়, ‘বলো কী মামা! এই ঠাণ্ডায়
দার্জিলিং বেড়াতে যাব!’
উত্তরে মাকুমামা মুখটুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘ছা-ছ্যা, তোর মতো ইয়াং ছেলের মুখ দিয়ে শেষে এই কথা বেরোল র্যাঁ ! তোরাই না দেশের ভবিষ্যৎ! কোথায় আমাকে আরও ইন্সপায়ার্ড
করবি! শোন ফুচে, একটা জবর চান্স বাগিয়ে
ফেলেছি। অফিস থেকে জরুরি
কাজে দার্জিলিঙে একজন রিপ্রেজেনটেটিভ পাঠাবার কথা হচ্ছিল। ব্যাপারটা কানে আসতেই ম্যানেজারকে ধরে ম্যানেজ করে ফেলেছি। এমন সুযোগ কি আর হরদম আসে র্যাঁ ? দিন সাতেকের ট্যুর। থ্রি-স্টার হোটেলের খরচ, মায় ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস ফেয়ার,
সব কোম্পানির পয়সায়। মানে ‘এ টু জেড’ ফ্রি। এখন রাজি থাকিস তো বল। ঠাণ্ডা তো একটু হবেই। তা সেই মতো ব্যবস্থা নিলেই হল। কি বলিস?’
এরপর রাজি না হয়ে উপায় কি? তাই রওনা হয়ে পড়েছিলাম নির্দিষ্ট দিনেই। কিন্তু দার্জিলিং পৌঁছে মালুম পাওয়া গেল শীত কাকে বলে! প্রায় দুপুর। কিন্তু রোদ্দুরের যা অবস্থা‚ কলকাতার পৌষ মাসের সকালকেও হার মানায়। রাস্তাঘাট প্রায় জনমানব শূন্য। দু’চারজন যা দেখা যায় তাদের সবাই স্থানীয় মানুষ। টুরিস্টের টিকির দেখাও পাওয়া গেল না। ফাঁকা রাস্তার মোড়ে স্থানীয় ছেলেরা একগোছা রবারের গার্ডার
নিয়ে পায়ে ভলির কসরত দেখাচ্ছে। একটানা
কে কতক্ষণ করতে পারে সেই কম্পিটিশন। খেলা
আর শরীর গরম দুটোই চলছে একসাথে। ঢালু
পাহাড়ি পথ। বলের বদলে তাই গার্ডারের
গোছার ব্যবস্থা। যাই হোক, মালপত্র নিয়ে চটপট হোটেলে ঢুকে পড়লাম আমরা।
মাকুমামা বাড়িয়ে বলেননি। হোটেলের যা ব্যবস্থা তা এক কথায় রাজসিক। বেল টিপলেই বেয়ারা। ঘুম থেকে উঠতেই বেড-টি, গরম জল। এছাড়া দু’বেলা মুরগির ঠ্যাং তো রয়েছেই। কিন্তু শীতের কামড়ে দু’দিনেই সব পানসে হয়ে গেল। গায়ে ডবল পুলওভার, বাঁদুরে টুপি, দস্তানা, মায় হাঁটু পর্যন্ত পশমের মোজা টেনে দিয়েও শরীরের ভিতরে হাড় পর্যন্ত জমে
আসতে চায়। বিকেল পড়ে এলেই
খাঁখাঁ রাস্তা। পথের পাশে তখন শুরু
হয়ে যায় স্থানীয়দের আগুন পোয়াবার তোড়জোড়। সন্ধের পরেই দোকানপাটের ঝাঁপ পড়তে শুরু করে।
যাই হোক, এর মধ্যেই একে-একে দার্জিলিঙের বিখ্যাত বটানিক্যাল গার্ডেন,
মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, টি-গার্ডেন আর টাইগার হিল থেকে সানরাইজ দেখে ফেললাম। বলা বাহুল্য, সব কিছুই এক রকম বুড়ি ছোঁওয়া গোছের করে। এ ছাড়া উপায় কী? বাইরে বের হলেই যে মন চলে যায় হোটেলের দিকে। কতক্ষণে ফের ঘরে ঢুকে ফায়ার প্লেটে হাত-পা সেঁকতে বসব। অগত্যা সারাদিন হোটেলের ঘরে বসে জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার
চুড়ো‚ নয়তো বাইরের দৃশ্য দেখে কাটিয়ে দিই।
মাকুমামার অবশ্য রেহাই নেই। ওর মধ্যেই আবার অফিসের কাজগুলোও সেরে ফেলতে হচ্ছে। ঘরে বসে যে একটু আরাম করবেন সে সময় নেই? সুতরাং, দিন তিনেকের মধ্যেই
প্রায় ফিউজ হবার জোগাড়। এর
মধ্যে যেদিন টাইগার হিলএ গেলাম সেদিন আবার আধ ইঞ্চির মতো বরফ পড়েছে সেখানে। রাস্তাঘাট, মায় চারপাশের গাছপালা পর্যন্ত ধপধপে সাদা। কাচের ঘরে বসে কাপ দশেক করে গরম কফি খেয়েও সানরাইজ দেখব
কী, শীতের কাঁপুনিতে চোখে
সর্ষে ফুল! আর মাকুমামাতো প্রায় ভ্যানিস হবার অবস্থা। ঠকঠক করে কাঁপতে-কাঁপতে হোটেলে ফিরে ফায়ার প্লেটে হাত-পা সেঁকতে গিয়ে
হঠাৎ হাউমাউ করে উঠলেন, ‘ফুচে রে, আমার
হাত-পায়ের আঙুলগুলো নির্ঘাত কেটে বাদ দিতে হবে এবার। কেমন সিটকে গেছে দ্যাখ! একটুও সাড় নেই।’
ততক্ষণে হাতের দস্তানা খুলে ফেলেছেন তিনি। তাকিয়ে দেখি তাঁর দু’হাতের আঙুল ঠাণ্ডায় জমে মাকড়সার ঠ্যাংয়ের মতো কুঁকড়ে রয়েছে। অনেক মেহনতে ম্যাসেজ-ট্যাসেজ করে শেষে সাড় ফেরানো হল। মাকুমামা অবশ্য বিশেষ আশ্বস্ত হলেন না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাত পায়ের আঙুল খানিক নাড়িয়ে বললেন, ‘ফুচে গতিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। কলকাতা ফিরে স্পেশালিষ্ট না দেখালে ভরসা নেই। তুই চটপট মালপত্তরগুলো গুছিয়ে ফেল দেখি। আমি অফিসের কাজ বাকি যা রয়েছে আজই সেরে দিয়ে আসছি। ওফ্! ম্যানেজার সাহেবের কথায় নেচে খুব আক্কেল হল এবার।’
মাকুমামা অফিসের কাজে বের হয়েছিলেন গজগজ করতে-করতে। সন্ধের মুখে ফিরে এলেন একেবারে নাচতে-নাচতে। হইহই করে বললেন,
‘ফুচেরে, মেরে দিয়েছি। হুঁ-হুঁ বাবা আমিও হলুম তোর মাকুমামা। পাটনা অফিসের ম্যনেজার এবার ভোগা দিলেও সেটা আজ সুদে আসলে
উশুল করে ফেলেছি।’
মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। মাকুমামা দম নিয়ে বললেন, ‘সে এক কাণ্ড বুঝলি। আজ অফিসে এক লালমুখো সাহেবের সঙ্গে আলাপ। নাম রবার্ট লক। আমাদের অস্ট্রেলিয়ার এক অফিসের ম্যানেজার। সস্ত্রীক ভারত ভ্রমণে বের হয়েছেন। দিন দুই হল দার্জিলিং বেড়াতে এসেছেন। আজ আমাদের অফিসে এসেছিলেন খোঁজ-খবর নিতে। তা অফিসের জরুরি কাজে এই শীতের মধ্যেও দার্জিলিং এসেছি
শুনে ভদ্রলোক তো দারুণ খুশি। পিঠ
চাপড়ে বললেন, তোমাদের মতো
লোকেরাই আমাদের কোম্পানির অ্যাসেট মিঃ বোস।
‘তো চান্স পেয়ে আমিও লম্বাচওড়া এক লেকচার ঝেড়ে
দিলুম। শুনে সাহেব তো যাকে
বলে একদম ফ্লাট। তক্ষুনি ওদের সঙ্গে
জলদাপাড়া যাবার অফার দিয়ে ফেললেন। আমিও
তো এই রকমই একটা চাইছিলুম। লুফে
নিয়েছি তৎক্ষণাৎ।’
এই পর্যন্ত বলে মাকুমামা থামলেন একটু। তারপর আমার চাঁদিতে টোকা মেরে বললেন, ‘অতএব আগামী কাল আর কলকাতায় ফিরছি না। পরিবর্তে সাহেবের সাথে ড্যাং-ড্যাং করে জলদাপাড়ায়। দারুণ জায়গা নাকি। ওয়ার্ল্ড ফেমাস।’ মাকুমামা
থামলেন। আমার বুঝতে বাকি
রইল না যে, জলদাপাড়া সম্বন্ধে কোনও
ধারণাই নেই ওনার। তাহলে
নাচতেন না এভাবে। কিন্তু তখনই আর
ভাঙলাম না কিছু। এই ভয়ানক শীতের
ভিতর দার্জিলিং এসে জুত হয়নি মোটেই। এবার
ফেরবার পথে যদি জলদাপাড়াটা ঘুরে যাওয়া যায় তবে সেটাই লাভ। সুতরাং চেপেই গেলাম।
পরদিন শিলিগুড়ি পৌঁছে মাদারিহাটের বাস ধরা হল। অতি অমায়িক মানুষ লক দম্পতি। ভ্রমণের নেশা। প্রায় সারা পৃথিবী চষে ফেলেছেন। বাসে বসে সেই সব টুকরো গল্পে মাতিয়ে দিলেন। এর আগেও ওরা একবার ভারতে ঘুরে গেছেন। সেই সময় নর্থ বেঙ্গলেও এসেছিলেন। এদিকের অনেক কিছুই ওঁদের পরিচিত।
যাই হোক, দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মাদারিহাট। ধুলোয় ভরা রাস্তা ধরে খানিক এগিয়ে লেভেল ক্রসিং পার
হলেই ফরেস্ট অফিস। রেল স্টেশনের ঠিক
পিছনে। গেটের পাশেই বড়
একটা সাইনবোর্ড। সেদিকে চোখ পড়তেই
থমকে গেলেন মাকুমামা। লক
দম্পতি ততক্ষণে এগিয়ে গেছেন। মাকুমামা
চারপাশে তাকালেন একবার, ‘হ্যাঁ রে
ফুচে, হঠাৎ আবার ফরেস্ট অফিস কেন রে? তারপর
ফোঁস-ফোঁস করে বার কয়েক নিঃশ্বাস টেনে বললেন, ‘কাছাকাছি জঙ্গল-টঙ্গল আছে। নাকি? কেমন গন্ধ পাচ্ছি যেন! ব্যাপার কী বল দেখি?’
আর চেপে রাখার উপায় নেই। আমি আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললাম, ‘সেকী মামা! তুমি জলদাপাড়া
বেড়াতে এসে জিজ্ঞাসা করছ, কাছে জঙ্গল-টঙ্গল
আছে কিনা? জলদাপাড়া তো একটা জঙ্গলেরই নাম। বিরল একশৃঙ্গ গণ্ডারের বাসভূমি। তাই দেখতেই তো সবাই আসে এখানে।’
শুনে মাকুমামার তো প্রায় খাবি খাওয়ার জোগাড়। আলুভাজার মতো মুখ করে বললেন, ‘এসব আগে বলিসনি তো! কী
হবে এবার বল দেখি?’
‘কিচ্ছুটি হবে না মামা।’ সান্ত্বনা দিলাম আমি, ‘এ তোমার সেই পালামৌ জঙ্গল নয়। গণ্ডার নিতান্তই নিরীহ প্রাণী।’
শুনে প্রায় ফুঁসে উঠলেন উনি, ‘তুই আমায় গাড়ল পেয়েছিস যে, যা খুশি বোঝাবি? আমি হলফ করে বলতে পারি, এ জঙ্গলে শুধু গণ্ডার নয়, বাঘ, ভালুক, বুনো হাতি, সব রয়েছে। ফুচেরে, আমি চললুম। তুই
সাহেবকে যা হোক কিছু বুঝিয়ে বলিস।' বলেই হনহন করে উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
আমি ছুটে ঠেকাতে যাচ্ছি, পিছন থেকে লক সাহেবের গলা শোনা গেল। অগত্যা থামতেই হল তাঁকে। তাকিয়ে দেখি সাহেব ইতিমধ্যে ফরেস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে
আসছেন। ভদ্রলোকের লাল মুখটা
আরও লাল হয়ে উঠেছে। থমথমে। ইতিমধ্যে এদিকে যে অনেক কিছু ঘটে গেছে সেসব লক্ষ্যই করলেন
না তিনি। কাছে এসে বললেন, ‘সরি মিঃ বোস। তোমাদের হলং নিয়ে যেতে পারলাম না।’
ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছি হাঁ করে। সেটা অনুমান করে সাহেব বললেন, ‘হলং-এ একটা টুরিস্ট লজ
রয়েছে। মাদারিহাট থেকে
মাইল পাঁচেক দূরে। একদম ডিপ ফরেস্টের
ভিতর। গণ্ডার দেখার ব্যবস্থা
করা হয় সেখান থেকেই। লজের
বারান্দায় বসেও বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে। কিন্তু ফরেস্ট অফিস থেকে জানাল, হলং-এ এই মুহূর্তে ঘর
একটিও খালি নেই। আমারই
ভুল হয়েছে। দার্জিলিং থেকেই
যোগাযোগ করে আসা উচিত ছিল।’
শুনে মুহূর্তে চাঙ্গা হয়ে উঠলেন মাকুমামা। একগাল হেসে বললেন,
‘না-না তাতে কী হয়েছে সার। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই তো। তাহলে চলুন ফিরে যাই এবার।’ বলেই মালপত্র
তুলে তাড়া লাগালেন, ‘ফুচে, শিগগির পা চালিয়ে
চল বাবা। বিকেলের বাস চলে
গেলে সাহেবদের অসুবিধা হবে বেজায়।’
দেখে সাহেব তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আরে না-না, তাই বলে নিরাশ হবার কিছু নেই মিঃ বোস। অন্য আর একটা ব্যবস্থাও আছে। এখান থেকে হাসিমার খুব দূরে নয়। সেখানে বরদাবাড়িতে আর একটা টুরিস্ট লজ রয়েছে। জঙ্গলে গণ্ডার দেখানো হয় সেখান থেকেও। সেই ব্যবস্থাই করেছি।’
প্রায় নিমপাতা গেলার মতো মুখ করে মাকুমামা এরপর একটু
ঘাড় নাড়লেন শুধু।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বরদাবাড়ি পৌঁছে গেলাম সবাই। নিরিবিলি হলেও জায়গাটা বেশ জমজমাট। ঝকঝকে রাস্তা। মিলিটারি কোয়ার্টার। কাছেই নাকি এয়ার ফোর্সের ক্যাম্প, রানওয়ে রয়েছে। কাঁটাতার ঘেরা মস্ত কম্পাউন্ডের ভিতর টুরিস্ট লজে প্রায়
রাজসিক ব্যবস্থা। মালপত্র নামিয়ে
স্নান সেরে আসতেই দেখি টিফিন রেডি। বেয়ারা
ট্রে’তে গরম কফি আর স্যান্ডউইচ
দিয়ে গেল।
সব দেখে মাকুমামা ধড়ে ততক্ষণে কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। স্যান্ডউইচের সদ্ব্যবহার করতে-করতে বললেন, ‘এখানে জঙ্গল
কোথায় রে ফুচে? চারদিকে তো শুধু মিলিটারি কোয়ার্টার,
আর গুলি-গোলার আওয়াজ। এসব কী আর জঙ্গলের ভিতর হয় রে?’
এখানে জঙ্গলটা যে কোনদিকে, এই অল্প সময়ে আমিও বুঝে উঠতে পারিনি। বললাম,
‘লজের চারপাশটা যেমন জমজমাট তাতে আর যাই হোক, জায়গাটা
জঙ্গলের মধ্যে নয় বলেই মনে হচ্ছে।’
‘তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক ফুচে। খুশিতে প্রায় ডগমগ হয়ে উঠলেন মাকুমামা। কে বলে ভগবান নেই? তখন অত করে ডাকলুম বলেই না ব্যবস্থাটা এমন পালটে গেল! জঙ্গলের বদলে একেবারে মিলিটারি চৌহদ্দির ভিতর! ওফ্!
সাহেব স্রেফ জানটা খেয়ে নেবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল রে! খুব বেঁচে গেছি! বুঝলি ফুচে, চানের
আগে এক ফাঁকে ওধারে কিচেনে উঁকি মেরেছিলাম। বুনো মুরগির রোস্টের ব্যবস্থা হচ্ছে দেখে এলাম। এসব জিনিসের টেস্টই আলাদা রে!’
মাকুমামাকে এতখানি উৎসাহিত হতে দেখে অবাক হলাম। কারণ আগামীকাল ভোরেই হাতির পিঠে জঙ্গলে বের হবার কথা। বুনো মুরগির গন্ধে মামা সেসব ভুলে গেলেন নাকি! সেটা ব্যক্ত করতেই একটু উঁচু দরের হাসি হাসলেন
তিনি। ‘খেপেছিস? শোন ফুচে,
আগামীকাল ভোরে আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। একদম তরাই-জঙ্গলের আসল ম্যালেরিয়া। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই। জঙ্গলে যেতে চাস তো তোরা যা। যে কদিন আছি এই মিলিটারি চৌহদ্দি ছেড়ে আর বের হচ্ছি না।’
দুর্ভাগ্য মাকুমামার এত উৎসাহ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। খানিক বাদে লজের ইনচার্জ বারীণবাবু এলেন আমাদের খোঁজখবর
নিতে। আলাপী মানুষ। জমিয়ে গল্প শুরু করে দিলেন। লক সাহেব জঙ্গলের নানা খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। সে গল্প শুরু হতেই মাকুমামার উৎকণ্ঠা বাড়ছিল। এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জঙ্গল এখান থেকে কত দূরে সার?
বারীণবাবু বললেন,
‘দূরে মানে? আপনারা তো জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছেন।’
‘অ্যাঁ!’ মাকুমামার মুখটা
খানিক হাঁ হয়ে গেল শুধু।
‘আজ্ঞে হ্যাঁ সার।’ অল্প হেসে বারীণবাবু বললেন, ‘হাসিমারার বেশিরভাগটাই তো
জঙ্গলের ভিতর। আমাদের
এই লজের পুব আর উত্তরে ওই যে কাঁটাতারের বেড়া দেখছেন, ওটা পার হলেই শুরু হয়ে গেল জঙ্গল।’
জানলা দিয়ে মাত্র হাত বিশেক দূরে কাঁটাতারের বেড়াটার
দিকে তাকিয়ে মাকুমামার গলা দিয়ে তখন কথা সরছিল না। কোনও মতে শুধু বললেন, ‘ও-ওটা জঙ্গল!’
আসল ব্যাপারটা যে কী সেটা ধরতেই পারলেন না বারীণবাবু। বরং উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘চলুন বিকেলে ওদিকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। মিনিট তিনেক হাঁটলেই একটা নালা পড়বে। সেটা পার হলেই শুরু হবে আসল জঙ্গল। তারপর আর একটু এগোলেই তোরসা নদী। আগামীকাল গণ্ডার দেখতে ওই তোরসা পার হয়ে যেতে হবে আপনাদের। তবে ওই তোরসার দু'ধারে কাশবনেই রয়েছে বাঘের আস্তানা। দিন কয়েক আগেই তো একটা বাঘ কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে ঘোরাফেরা
করে গেছে। তবে এখানে বাঘ তেমন
বিপজ্জনক নয়। সে হল বুনো হাতির
পাল। তারপর কোনও দাঁতাল
যদি রোগ হয়ে যায়, তবে তো কথাই
নেই। এই তো মাত্র দিন
কয়েক আগে একপাল বুনো হাতি খোদ এয়ার ফোর্সের রানওয়েতে আস্তানা নিয়েছিল। অনেক কষ্টে কাঁসর-ঘণ্টা আর পটকা ফাটিয়ে তাড়ানো হয়। দিন কয়েক এয়ারপোর্ট বন্ধ। কাগজে দেখেননি? শুধু কী হাতি? ওই রানওয়ের পাশেই মাসখানেক আগে আস্তানা
গেড়েছিল বিশাল এক পাইথন। মস্ত
এক হরিণ গিলে পড়ে ছিল দিন কয়েক।’
বারীণবাবুর গল্প আরও কতক্ষণ চলত ঠিক নেই। কিন্তু এ যাত্রায় মাকুমামাকে উদ্ধার করল টুরিস্ট লজের
বেয়ারা। জানিয়ে দিল‚ খাবার তৈরি। সুতরাং উঠতে হল সবাইকে। বুনো মুরগির স্বাদ সত্যিই যে আলাদা সেটা মালুম পাওয়া
গেল খাওয়ার টেবিলেই। খোদ
মামা কিন্তু প্রায় কিছুই খেলেন না। কুইনিন
গেলার মতো মুখ করে সামান্য কিছু মুখে দিয়েই উঠে পড়লেন। খাওয়া সেরে ঘরে এসে দেখি মাকুমামা বিছানায় নির্জীবের
মতো শুয়ে আছেন।
আমি ঢুকতেই কোঁ-কোঁ করে বললেন, ‘ফুচে রে, বেশ
বুঝতে পারছি এ যাত্রায় আর রেহাই নেই আমার। তোর মামিকে গিয়ে খবরটা দিস।’ ভেউভেউ করে
কেঁদে উঠলেন উনি।
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘ভেবো না মামা। এখানে এত মানুষ। ভয়ের কী আছে? গণ্ডার দেখতে জঙ্গলে না গেলেই তো হল। তা ছাড়া শুনলে তো, এখানে বাঘ এমন কিছু বিপজ্জনক নয়। মানুষকে এড়িয়েই চলে।’
মামা অবশ্য কিছুমাত্র সান্ত্বনা পেলেন না। ফের কোঁ–কোঁ করে বললেন‚ ‘তুই আমায়
পাগল পেয়েছিস ফুচে? যা খুশি তাই বোঝাবি! বাঘ সম্বন্ধে তুই আমার থেকে ভাল জানিস? তা ছাড়া শুনলি
তো, এসব জায়গায় বুনো হাতিও কী মারাত্মক! খোদ মিলিটারির সঙ্গে টক্কর দেয়। ওরে ফুচে রে, আমার পাশে আয় বাবা। আমার
নিঃশ্বাস কেমন বন্ধ হয়ে আসছে লেগেছে।’
মামার শেষ দিকের কথাগুলো কেমন প্রলাপের মতো শোনাল। শুধু যে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন তাই নয়, গায়ে জ্বরও এসে পড়েছে সামান্য। সান্ত্বনা দিতে তাই পাশে এসে বসলাম। তাতে মামা বোধ হয় ভরসা পেলেন। খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন, ‘ফুচে রে, বাঁচতে চাস
তো চল পালিয়ে সন্ধের বাসে কেটে পড়ি। এখানে আর একটা বেলাও নিরাপদ নয়।’
আমি হেসে ফেললাম,
‘কী যে বল মামা তার ঠিক নেই! এত দূর এসে হাতির
পিঠে চড়ে জঙ্গল না দেখে ফিরছি না আমি। তারপর সাহেবরা ফেরে তো ভাল, নয়তো দু’জন দুপুরের বাস
ধরব। ভেবো না তুমি।’
শুনে প্রায় যেন আঁতকে উঠলেন মাকুমামা, ‘ফুচে, আমায় একলা ফেলে
যাবি রে! আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলি। তোর নিজের কথা একবার ভেবেছিস? বাঘ ভালুকের জঙ্গলে খালি হাতে যাবি গণ্ডার দেখতে!
এক থাবায় কখন ভ্যানিস হয়ে যাবি, টেরটিও পাবিনে!’
সঙ্গদোষ বলে কথা। সকাল থেকে বাসের ধকল। বেলায় ভরপেট খাওয়ার পর ঘুম পাচ্ছিল খুব। মামার সেই প্রলাপ শুনতে-শুনতে পাশে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। তারপর স্বপ্ন দেখছি, হাতির পিঠে চেপে সাহেবদের সঙ্গে জঙ্গলে চলেছি গণ্ডারের খোঁজে। চারপাশে নলখাগড়ার ঘন ঝিমঝিম-করা জঙ্গল। ঝমঝম শব্দে আমাদের হাতি সেই জঙ্গল ভেঙে পথ করে চলেছে। ক্বচিৎ এক আধটা ময়ূরের ডাক ভেসে আসছে শুধু। আমাদের হাতি তখন মস্ত এক গাছের তলা দিয়ে চলেছে। উপরে ঘন ডালপালার আড়ালে ঝুলছিল বিশাল এক পাইথন। হঠাৎ সেটা মস্ত এক হাঁ করে হাতির পিঠ থেকে ছোঁ মেরে তুলে
নিয়েছে আমাকে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার
করার চেষ্টা করছি। কোনও শব্দই বের
হচ্ছে না। তারপরেই মট করে
ভেঙে গেল ঘুমটা। চোখ মেলে দেখি দিব্যি
বিছানাতেই শুয়ে রয়েছি। স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছি পাশে মাকুমামার দিকে চোখ পড়তে থমকে গেলাম। প্রায় ফিটের রোগীর মতো পড়ে রয়েছেন বিছানায়। দু’চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। কুলকুলিয়ে ঘামছেন সমানে। বলির পাঁঠার মতো ঠকঠকিয়ে কাঁপছে সারা শরীর। মুখে শব্দটি নেই।
একবার মনে হল, উনিও বোধ হয় আমার মতো ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু চোখ মেলে কেউ ঘুমোয় নাকি? তাহলে কী অন্য কিছু? ব্যাপারটা
মনে হতেই মামার চোখের সোজা জানলার বাইরে তাকালাম। কী সর্বনাশ! জানলার বাইরে খানিক দূরে গাছপালার আড়ালে মস্ত এক দাঁতাল হাতি। জুলজুল করে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। হঠাৎ সেটা গাছপালা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল হুড়মুড় করে।
প্রায় দৈত্যাকৃতি সুবিশাল প্রাণীটিকে দেখে তাক লেগে গেল! এত বড় হাতি আগে দেখিনি। শুঁড়ের দু’পাশে সুবিশাল গজদাঁতের ডগায় কাদার দাগ। হাঁ করে তাকিয়ে আছি‚ চিঁ-চিঁ করে মাকুমামা বললেন, ‘ফুচে
রে, বুনো হাতি। আমার হাত-পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। নাড়াতে পারছি না। জানলার ধার থেকে এখুনি আমায় সরিয়ে দে বাবা।’
বুনো হাতি! মাকুমামার কথা প্রায় বজ্রপাতের মতোই কানে বাজল। কী সর্বনাশ! এ সম্ভাবনার কথা ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি! মামার আশঙ্কা
যে অমূলক নয় তা বুঝতেও বিলম্ব হল না। চিড়িয়াখানা বা সার্কাসের হাতি অনেক দেখেছি। কিন্তু এমন তেল চকচকে শরীর কারও দেখিনি। তার উপর গজদাঁতের ডগায় কাদা! কোনও সন্দেহ নেই আর। শোবার খাটের লাগোয়া জানলা। তাড়াতাড়ি বন্ধ করতে গেলাম। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। বিশাল আকৃতির হাতিটা ততক্ষণে জানলার ওধারে। মস্ত এক ময়াল সাপের মতো শুঁড়ের ডগাটা গরাদের ফাঁকে দুলছে। আঁতকে হাত সরিয়ে নিলাম।
ওদিকে বিছানায় মাকুমামা কোঁ-কোঁ করে উঠলেন, ‘ফুচে
রে, আমায় টেনে নামা শিগগির। ব্যাটা জানলার ফাঁকে শুঁড় গলিয়ে এক আছাড়ে পটকে দেবে
নির্ঘাত। কী হবে রে এবার?’
কিন্তু মামাকে নামাব কী! ততক্ষণে তিনি দু’হাতে
প্রায় সাঁড়াশির মতো জাপটে ধরেছেন আমাকে। নড়ব সে উপায়টিও নেই। খানিক চেষ্টা করেও সুবিধে হল না মোটেই। ইতিমধ্যে হাতিটা শুঁড় তুলে কানাডিয়ান ইঞ্জিনের মতো ফোঁস
করে এক ঝলক গরম বাতাস আমাদের উপর স্প্রে করে গরাদের ফাঁকে শুঁড় গলিয়ে দিয়েছে। হা ভগবান! মুহূর্তে অন্তিম আর্তনাদ বের হয়ে এল গলা দিয়ে। কিন্তু খেল দেখালেন মাকুমামা।
‘বাবা–গো মেরে ফেললে’
গগনবিদারী হাহাকারের মধ্যেও ছেঁড়া ধনুকের মতো হঠাৎ আমাকে নিয়ে লাফিয়ে
পড়লেন নীচে।
সশব্দে খাট থেকে ছিটকে পড়ে মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল আমার। কিছু মনে নেই তারপর। জ্ঞান ফিরতে দেখি ঘরের ভিতর মানুষে ভরতি। উদ্বিগ্ন মুখে লক দম্পতি তো বটেই, বারীণবাবুও রয়েছেন। ওদিকে মাকুমামাকে জলের ঝাপটা দেওয়া হচ্ছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে বারীণবাবু বললেন, ‘ব্যাপার কী বল দেখি?’
আমি কোনওমতে বললাম, ‘বুনো হাতি!’
শুনে বারীণবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘বুনো হাতি! বুনো হাতি
কোথায় পেলে? আরে ও তো আমাদের যাত্রাপ্রসাদ। এখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ভি.আই.পি হাতি। দেশের নামীদামী ভি.আই.পি’রা ওই যাত্রাপ্রসাদের
পিঠে চড়ে জঙ্গল দেখে যায়। অমন
শান্ত হাতি আমাদের আর দুটি নেই।’
‘আঁ!' তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম
আমি। তবে যে হাতিটা তখন
জানলা দিয়ে শুঁড় গলিয়ে দিল!’
‘আরে ভাই, সে তো চকলেট খাবার
জন্য। আমাদের যাত্রাপ্রসাদ
আবার চকলেটের দারুণ ভক্ত। এখানকার
টুরিস্টরাই ওকে অভ্যাসটা ধরিয়েছেন। হঠাৎ
নতুন মানুষ দেখে ওই চকলেটের লোভেই তখন জানলা দিয়ে শুঁড় গলিয়ে দিয়েছিল।’
মুচকি হেসে বারীণবাবু থামলেন। ওধার থেকে মাকুমামার গলা শোন গেল ওই সময়। কোমরে হাত চেপে ব্যথায় নাক-মুখ কুঁচকে কখন উঠে বসেছেন। ককাতে-ককাতে বললেন, ‘ফুচে রে, ওসব কিছু
বিশ্বাস করিসনি। আর
একটা অ্যাম্বুলেন্স দ্যাখ বাবা। কলকাতায়
নিয়ে চল এখুনি। কোমরে বোধ হয় কম্পাউণ্ড
ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে আমার।’
ছবি: দিলীপ দাস
নারায়ণ পুস্তকালয়: আষাঢ় ১৩৯৫
haaste haastei more jachhiii.... :D :D :D
ReplyDeletedarun ............
ReplyDelete