মহাভারতে কুরুপাণ্ডব যুদ্ধের কথা বলা হলেও‚ আদতে তা যে কুরুপাঞ্চাল যুদ্ধ‚ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। আর সেই যুদ্ধের বীজ বপন হয়েছিল হঠাৎই একদিন পাঞ্চালরাজের রাজসভায়।
ছেলেবেলায় দ্রুপদের সহপাঠী বন্ধু ছিলেন দ্রোণ। ব্রাহ্মণ তনয় দ্রোণের মতিভ্রম হয়েছিল বলা যায়। স্বজাতি অন্য ব্রাহ্মণদের মতো যাগযজ্ঞের কায়দা–কানুন আর সামবেদের গোটা কয়েক মন্ত্র মুখস্থ করতে
পারলেই দিব্যি করে খেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেসব
ফেলে পরশুরামের কাছে শিখতে গেলেন অস্ত্রবিদ্যা। তাই কোথাও আর ঠাঁই হল না। দারিদ্র নিত্য সঙ্গী। প্রায় ভিখিরি দশা বলা যায়। একমাত্র পুত্রর জন্য সামান্য দুধের ব্যবস্থাও করতে পারেননি। দুর্দশা ঘোচাতে এরপর তিনি বাল্যবন্ধু দ্রুপদের দরবারে গিয়েছিলেন
কিছু সাহায্যের আশায়। সাহায্য তো মেলেইনি‚ বরং অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। মানুষটিকে সেই ভয়ানক অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছিলেন মহামতি ভীষ্ম। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামান্য
বলা দরকার।
পাঞ্চাল আর কুরু দুটি রাজ্যই তখন মহাজনপদ। অর্থাৎ‚ সেই খ্রিপূ
সময়ে যথেষ্টই বড় রাজ্য। প্রথমটির অবস্থান
বর্তমান উত্তরপ্রদেশের রোহিলখণ্ড অঞ্চল। দ্বিতীয়টির
অবস্থান বর্তমান দিল্লি সন্নিহিত অঞ্চল। অর্থাৎ
পাশাপাশি দুটি প্রতিবেশী রাজ্য। শক্তিতে কেউ কম
যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বলে‚ এই অবস্থায় দুই রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য। কুরুরাজ্যে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র নামে রাজা হলেও মহামতি ভীষ্মই তখন
রাজ্যের প্রকৃত প্রধান। পাঞ্চাল রাজসভায়
দ্রোণের অপমানিত হবার ঘটনাটি কানে আসতেই তিনি আর দেরি করেননি। কুরু-রাজকুমারদের তৎকালীন অস্ত্রশিক্ষক কৃপাচার্য যথেষ্ট উপযুক্ত হলেও তাঁকে বাতিল
করে দ্রোণাচার্যকে রাজকুমারদের অস্ত্র শিক্ষায় নিয়োগ করেছিলেন। দূরদর্শী বিচক্ষণ মানুষটি বুঝেছিলেন‚ প্রতিবেশী পাঞ্চাল রাজ্যের শক্তিবৃদ্ধি দমন করতে
হলে এই মুহূর্তে রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষার জন্য দ্রোণই একমাত্র ব্যক্তি। রাজপুত্রদের উপযুক্ত করে তুলতে নিজের স্বার্থেই তিনি কার্পণ্য
করবে না। আর স্বয়ং পরশুরামের
কাছে যিনি অস্ত্রশিক্ষা করেছেন‚ তাঁর যোগ্যতা
নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। ভীষ্মের সেই ভাবনায়
যে ভুল ছিল না‚ তা পরে দেখতে পাব।
কুরুরাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষক নিযুক্ত হবার পরে দ্রোণাচার্যের
শুধু আর্থিক সমস্যাই দূর হয়নি‚ অতি অল্প দিনের
মধ্যেই চারদিকে তাঁর সুখ্যাতিও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বৃষ্ণি‚ অন্ধক প্রভৃতি
নানা রাজ্যের রাজপুত্র তাঁর কাছে অস্ত্র শিক্ষার জন্য ছুটে আসতে শুরু করলেন। বাদ গেলেন না কর্ণও।
ভীষ্মের উপকারের প্রতিদান দিতে দ্রোণাচার্যও কার্পণ্য
করেননি। পাঞ্চালরাজের সেই
অপমানের প্রতিশোধ নেবার ব্যাপারটা তো ছিলই। আর
রাজপুত্রদের নাড়াচাড়া করতে গিয়ে অচিরেই অর্জুনের প্রতিভা টের পেয়েছিলেন। বুঝেছিলেন‚ অর্জুনকে অস্ত্রশিক্ষায়
ঠিকমতো শিক্ষিত করে তুলতে পারলে‚ রাজা দ্রুপদের উপর সহজেই প্রতিশোধ নেওয়া যাবে। তাই গুরু পরশুরামের কাছে যা শিখেছিলেন‚ সব উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁকে। অর্জুন তার সবই যে চমৎকারভাবে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন‚ তা জানি আমরা। প্রকৃত প্রতিভা সম্পন্ন আরও দু’জন শিক্ষার্থী দ্রোণাচার্যের কাছে এসেছিলেন। তাদের একজন কর্ণ। কিন্তু
যেহেতু তিনি কুরুবংশের কেউ নয়‚ তাই কুরুরাজ্যের
স্বার্থেই কর্ণকে সবকিছু শেখাননি। হয়তো
এই ব্যাপারে ভীষ্মের কিছু নির্দেশও ছিল। কর্ণ
কিন্তু নিজের চেষ্টায় অনেক কিছুই শিখে ফেলেছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে‚ বা অন্য সময়ে আমরা দেখেছি‚ অস্ত্রচালনায় তিনি অর্জুনের চাইতে বিশেষ কম ছিলেন না।
দ্বিতীয়জনের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলি‚ মহাভারতের এই কাহিনি যে সময়ের‚ আর্য অনার্যের বিভেদ তখন অনেকটা দূর হয়ে গেছে। আর্যদের চোখে অনার্যরা তখন আর ব্রাত্য নয়। এমনকী দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক ভাবে বিবাহও চলছে। অনার্যদের মধ্যে অনেকেই তখন রীতিমতো সম্মানীয় ব্যক্তি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়‚ কুরুরাজ শান্তনু পত্নী সত্যবতী ছিলেন অনার্যকন্যা। ক্ষেত্রজ সন্তান পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যম পাণ্ডব ভীমের জন্মও পবন
নামে এক অনার্য পুরুষের দ্বারা। এমনকী শ্রীকৃষ্ণ
নিজেও ছিলেন অনার্য যাদব বংশের মানুষ। এমন আরও ভূরি ভুরি
উদাহরণ মহাভারতে আছে। এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটিও
এক অনার্য সন্তান‚ একলব্য।
নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্যও দ্রোণাচার্যের কাছে
এসেছিলেন অস্ত্র শিক্ষার জন্য। ছেলেটিকে সামান্য
নাড়াচাড়া করেই তাঁর বুঝতে বাকি থাকেনি‚ অনার্য এই নিষাদপুত্রকে অস্ত্র শিক্ষা দিলে সে অচিরেই অর্জুনকে অতিক্রম করে
যাবে। তারপর নিষাদরাজ
যদি পাঞ্চালরাজের সঙ্গে যোগ দেয়‚ সর্বনাশের
বাকি থাকবে না। ভীষ্ম এবং তাঁর
সব পরিকল্পনাই বিনষ্ট হবে। অগত্যা দ্রোণাচার্য
তাঁকে আর অস্ত্রশিক্ষা দেননি। অল্পদিন পরেই বিদায়
করে দিয়েছিলেন।
একলব্য দুঃখ পেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু হতোদ্যম হননি। বরং
তাঁর জেদ আরও বেড়ে গিয়েছিল। ব্যর্থতার গ্লানি
নিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তনের বদলে চলে গিয়েছিলেন কাছেই এক গভীর নির্জন অরণ্যে। তারপর তিনি যা শুরু করেছিলেন‚ মুনিঋষি হলে তপস্যা বলা হত‚ কিন্তু আমরা তাকে প্রকৃত অধ্যাবসায় বলব। একাগ্রচিত্তে যে অধ্যাবসায়ে সব
কিছুই পাওয়া সম্ভব। দ্রোণাচার্যের একটি মূর্তিকে গুরুজ্ঞানে সামনে রেখে তিনি নতুন
উদ্যমে শুরু করেছিলেন অস্ত্রবিদ্যা চর্চা।
এরপর কী ঘটেছিল‚ মহাভারত যাঁরা পাঠ করেছেন‚ তাঁদের অজানা নয়। তবু বলি‚ কিছুদিন পরে কুরুরাজ্যের রাজপুত্ররা শিকারে বের
হয়েছেন। একটি শিকারি কুকুর
হরিণের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে এসে হাজির হল একলব্যের কাছে। গভীর বনের ভিতর ওই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সে বিকট রবে ডাকতে শুরু
করল। বিরক্ত একলব্য তাকে থামাবার জন্য সাতটি শর কুকুরটির মুখে
নিক্ষেপ করলেন। সেগুলি একবিন্দু
রক্তপাত না ঘটিয়ে এমনভাবে কুকুরটির মুখগহ্বরে প্রবেশ করল যে‚ তার আর ডাকার ক্ষমতা রইল না। কুকুরটি ওই অবস্থায় রাজপুত্রদের কাছে ফিরে এলে ব্যাপার দেখে
সবাই তো হতভম্ব। বিস্মিত রাজপুত্ররা
এরপর কুকুরটিকে অনুসরণ করে অকুস্থলে এসে সবই দেখলেন।
রাজপুরীতে ফিরে গিয়ে অর্জুন আর দেরি করলেন না। ছুটে গেলেন দোণাচার্যের কাছে‚ ‘গুরুদেব আপনি কথা দিয়েছিলেন‚ আপনার সমস্ত বিদ্যা আমাকে দান করবেন। আপনার অন্য কোনও শিষ্য আমাকে অতিক্রম করতে পারবে না। তাহলে একলব্য কীভাবে এই অদ্ভুত কৌশল আয়ত্ত করল? আমাকে তো শেখাননি!’
শর নিক্ষেপের এই অদ্ভুত কৌশল দ্রোণাচার্যর
নিজেরও জানা ছিল না। কিন্তু শিষ্যের
কাছে সেকথা না ভেঙে বললেন‚ ‘চিন্তা করো না বৎস। আমার কথার অন্যথা হবে না।’
পরের দিনই দ্রোণ শিষ্য অর্জুনকে নিয়ে একলব্যের কাছে হাজির
হয়ে বললেন‚ ‘একলব্য‚ তুমি যখন আমাকে গুরু বলে স্বীকার করেছ‚ তাহলে এবার গুরুদক্ষিণা দাও।’
ভীষণ খুশি হয়ে একলব্য বললেন‚ ‘এ আমার পরম সৌভাগ্য গুরুদেব। কী দক্ষিণা চাই‚ আজ্ঞা করুন?’
অম্লান বদনে দ্রোণ বললেন‚ ‘তোমার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি।’
সেই কথায় অর্জুন চমকে উঠলেও একলব্য কিছুমাত্র দ্বিধা না
করে তীরন্দাজের একান্ত প্রয়োজনীয় ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি মুহূর্তে কেটে ফেলে দ্রোণের
পায়ের কাছে রাখলেন। অভীষ্ট সিদ্ধ হল
কিনা‚ তা নিয়ে দ্রোণাচার্যের তখনও সংশয় ছিল। তাই একলব্যকে এরপর তিনি শর নিক্ষেপ করতে আদেশ করলেন। একলব্য তাই করলেন। কিন্তু
একটি শরও আগের মতো দ্রুতগামী হল না। লক্ষ্যভ্রষ্টও হল
কয়েকটি। খুশি হয়ে অর্জুন
এবং দোণাচার্য রাজধানীতে ফিরে এলেন।
মহাভারতে একলব্যের কথা আর উল্লেখ নেই। তাই এই পর্যায়ে আমাদের কিছু কল্পনার আশ্রয় নিতেই হবে। আমরা জানি‚ একলব্যের মতো
প্রতিভারা হার মানতে শেখেনি। ব্যতিক্রম ছিল
না একলব্যও। এরপর তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি
ছাড়াই শর যোজনা অভ্যাস করতে শুরু করলেন। প্রয়োজন অনুসারে কখনো তির ধরতেন তর্জনী আর মধ্যবার
ফাঁকে। কখনো মধ্যমা আর অনামিকার ফাঁকে। ক্রমাগত অভ্যাসের ফলে এইভাবে শর নিক্ষেপে
তিনি বরং কিছু অতিরিক্ত সুবিধার সন্ধান পেয়েছিলেন। যে ক্ষমতা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন‚ তাকে দৈব ক্ষমতা বললেও কম
বলা হয়। দ্রোণাচার্যের ফন্দি তাই যে পূর্ণ হয়েছিল‚ এমন বলা যায় না।
প্রসঙ্গত বলা দরকার‚ বর্তমান রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশে
ভীল নামে এক অসমসাহসী আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। জানা যায়‚ রাণা প্রতাপের
সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশই ছিল এই ভীল যোদ্ধা। যুদ্ধে তাঁর এই ভীল তীরন্দাজেরা
বরাবরই ছিল মুঘল বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ। এই ভীল জাতির মানুষ আজও তীরধনু্ক সঙ্গে নিয়ে ঘুরে
বেড়ায়। অবর্থ তাদের নিশানা। কিন্তু ভীল তীরন্দাজ শর নিক্ষেপের জন্য কখনো হাতের
বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে না। নিজেদের তারা একলব্যের বংশধর মনে করে। গর্বভরে বলে‚ স্বয়ং একলব্যর কাছ থেকেই
তাদের পূর্বসূরিরা এইভাবে নির্ভুল নিশানায় তীর ছুঁড়তে শিখেছিলেন। সেই পরম্পরা তারা
আজও পালন করে চলেছে।
যাই হোক‚ ডান হাতে শর নিক্ষেপ
করলেও একলব্য অসি‚ খড়্গ প্রভৃতি চালনা করতেন বাঁ হাতে। ডান হাতে অসিচর্ম
ধরতেন এক বিশেষ কায়দায়। অস্ত্র শিক্ষা সম্পূর্ণ করে এরপর একদিন তিনি নিজ রাজ্যে ফিরে
এলেন। ততদিনে নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর মৃত্যু হয়েছে। কনিষ্ঠ পুত্র ধৃতিলব্য দাদার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। একলব্য ফিরে আসতেই বললেন‚ ‘দাদা‚ এবার বিদায় দাও আমাকে।’
এজন্য একলব্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। অবাক হয়ে বললেন‚ ‘ধৃতিলব্য‚ এ কী কথা বলছিস!
পিতার এই রাজ্যে আমাদের দু’জনেরই অধিকার।’
‘তা ঠিক দাদা। তবু এখনই আমার সেই দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। কিছু অন্য কাজ রয়েছে। নিশ্চিত জানি‚ তোমার সুশাসনে রাজ্যের মানুষ যথেষ্টই শান্তিতে থাকবে। আর রাজা একলব্যর রাজ্য
কেউ আক্রমণের সাহস করবে‚ এমন ধৃষ্টতা
কার আছে দাদা?’
একলব্য তাঁর এই ভাইটিকে বিলক্ষণ চিনতেন। বিচলিত হয়ে বললেন‚ ‘ধৃতিলব্য‚ তোর কী মতলব বলতো?’
‘সেকথা জানতে চেয়ো না দাদা। তোমার সামনে আমি মিথ্যে বলতে পারব না।’
কিন্তু একলব্য ছাড়লেন না। বিচক্ষণ মানুষ তিনি। ততক্ষণে
ভাইয়ের মতলব কিছুটা যেন টের পেয়েছেন। কিছুটা নিশ্চিন্ত
হয়ে বললেন‚ ‘তাই তো জানতে চাইছি তোর কাছে।’
‘দাদা।’ অল্প ঠোঁট কামড়ে ধৃতিলব্য
বললেন‚ ‘তুমি ভাল মানুষ হতে পারো। কিন্তু আমি নই। নিষাদ রক্ত বইছে
আমার ধমনীতে। যে দুরাত্মা গুরুদক্ষিণার
ছলে তোমার ক্ষতি করেছে‚ উপযুক্ত শাস্তি সে আমার
হাতে পাবেই। যেদিন সেই দুঃসংবাদ
পেয়েছি‚ সেই দিনেই শপথ নিয়েছি আমি। তুমি বাধা দিও না দাদা।’
একলব্য এমন কিছুই অনুমান করেছিলেন। তাই অনেকটাই নিশ্চিন্ত হলেন। দ্রোণাচার্যের মতো অস্ত্র-কুশলীর চরম ক্ষতি আর যেই হোক ধৃতিলব্যর পক্ষে যে সম্ভব নয়‚ জানতেন তিনি। শুধু বললেন‚ ‘ধৃতিলব্য‚ যখন শপথ নিয়েছ‚ বাধা দেব না। কিন্তু লক্ষ রেখ‚ অযথা ধৃষ্টতা দেখাতে গিয়ে যেন আমার ভাইকে প্রাণ দিতে না হয়।’
‘তাই হবে দাদা। কথা দিচ্ছি।’
দাদাকে প্রণাম করে ধৃতিলব্য বিদায় নিলেন। একলব্য ভেবেছিলেন‚ ব্যর্থ হয়ে ধৃতিলব্য অচিরেই ফিরে আসবে। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি। এই ঘটনার অনেক দিন পরে তিনি যখন ধৃতিলব্যর খোঁজ পেলেন‚ সেদিন প্রকৃতই বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তখন আর তাঁর কিছু করার ছিল না। কিন্তু সে তো অনেক পরে। বরং আগের কথায় ফিরে আসি।
ইতিমধ্যে রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। বাল্যবন্ধু দ্রুপদের কাছে অপমানিত হবার কথা দ্রোণাচার্য একদিনের
জন্যও ভেলেননি। তিনি রাজকুমারদের
কাছে এবার গুরুদক্ষিণা চাইলেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে
বন্দি করে আনতে হবে।
আদেশ হতেই কুরুরাজ্যে সাজ সাজ রব উঠল। বিশাল বাহিনী নিয়ে রাজকুমাররা ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাঞ্চাল রাজ্যের
উপর। শক্তিতে পাঞ্চাল রাজ্যও কম নয়। কিন্তু মূলত অর্জুন আর ভীমের রণকৌশলের কাছে রাজা দ্রুপদকে পরাজয়
মানতে হল। তাঁকে বন্দি করে
আনা হল দ্রোণাচার্যের কাছে।
দ্রোণের বুকের আগুন এতদিনে তৃপ্ত হল। সহাস্যে বললেন‚ ‘দ্রুপদ‚ আমি ব্রাহ্মণ‚ বাল্য বন্ধুকে প্রাণে মারব এমন পাষণ্ড নই। তাই ভয় পেয়ো না। মনে আছে‚ সেদিন রাজদরবারে বসে বলেছিলে‚ একমাত্র রাজাই রাজার বন্ধু হতে পারে। তাই বন্ধুত্ব ফিরে পাবার জন্য অর্ধেক পাঞ্চাল রাজ্য ফিরিয়ে দিচ্ছি
তোমাকে। বাকি অর্ধেক আমি
রাখলাম। এবার হয়তো আমাকে
বন্ধু বলে স্বীকার করতে পারবে।’
বলা বাহুল্য‚ দ্রোণের সেই কথায় দ্রুপদের সারা শরীর ক্ষোভে জ্বলে গেলেও
কিছুই করার ছিল না। তিনি দ্রোণের প্রস্তাব
মেনে নিলেন। গঙ্গার দক্ষিণে
চর্মণ্বতী নদী পর্যন্ত অঞ্চল দ্রুপদের অধিকারে রইল। দ্রোণাচার্য গঙ্গার উত্তরে অহিছত্র দেশ পেলেন।
রাজা দ্রুপদ মুক্তি পেলেন বটে। কিন্তু অর্ধেক রাজ্য এবং সেই সঙ্গে সম্মান খুইয়ে তিনি তখন ক্ষোভে
ফুঁসছেন। অপমানিত দ্রোণ রাজা
দ্রুপদকে হত্যা করার কথা ভাবেননি। কিন্তু দ্রুপদ প্রতিশোধ
নিতে চাইলেন দ্রোণকে হত্যা করে। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী
কুরুরাজ্যকে কীভাবে ধ্বংস করা যায়‚ সেই চিন্তা করতে লাগলেন।
এই সময় তিনি যাজ আর উপযাজ নামে দুই ব্রহ্মর্ষির খোঁজ পেলেন। জানতে পারলেন‚ দুই ভাইয়ের অসাধ্য কিছু নেই। প্রতিকারের
জন্য দ্রুপদ উপযাজকেই ধরলেন আগে। ঋষি‚ ব্রহ্মর্ষিদের সেকালে তুষ্ট করতে খুব বেগ পেতে
হত না। রাজা দ্রুপদেরও
হয়নি। প্রভূত প্রণামীতে তুষ্ট হয়ে উপযাজ বললেন‚ ‘হে রাজন‚ কুরুরাজ্যকে দমন করতে হলে অর্জুন ভীম প্রভৃতি
সহ পঞ্চপাণ্ডবকে আগে কুরুদের থেকে আলাদা করতে হবে। কাজটা কঠিন হলেও সম্ভব।
শুধু এই জন্য রাজা দ্রুপদ উপযাজের কাছে আসেননি। তিনি বললেন‚ ‘কিন্তু আমার যে একটি পুত্র সন্তানও চাই‚ যে দ্রোণাচার্যকে হত্যা করে পিতার অপমানের প্রতিশোধ
নিতে পারবে। আপনি অলৌকিক ক্ষমতা
সম্পন্ন ব্রহ্মর্ষি। বৈদিক সাম–মন্ত্র আপনার কণ্ঠস্থ। আমাকে তেমন একটি পুত্রসন্তান দিন।’
উপযাজ বললেন‚ ‘গণনা করে দেখেছি‚ দ্রোণাচার্যের
সমকক্ষ পুত্রসন্তান এখনই তোমার ভাগ্যে নেই। কিছুদিন অপেক্ষা কর বরং।’
সুতরাং দ্রুপদ অপেক্ষা করে রইলেন। পার হয়ে গেল একটি বছর। উপযাজের তরফে কোনও সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু দ্রুপদ কতদিন আর অপেক্ষা করবেন! সময় বয়ে যায়। শেষে তাঁর তাগাদায় উপযাজ একদিন আসল কথা বলেই ফেললেন‚ ‘রাজা‚ তুমি বরং আমার দাদা যাজের কাছে একবার যাও। তাঁরও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তাছাড়া আমার প্রতি কিঞ্চিৎ ঈর্ষা পরায়ণও। তাই ইচ্ছে থাকলেও আমার একার পক্ষে তোমার কাজ সম্পূর্ণ করা সাধ্যের
বাইরে।’
বিলম্ব না করে রাজা দ্রুপদ এবার যাজের কাছে এলেন। যাজ বললেন‚ ‘রাজা‚ তুমি উপযুক্ত সময়তেই আমার কাছে এসেছ। পুত্র লাভের জন্য আগামী কয়েক দিন তোমার জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ। শুধু পুত্র নয়‚ তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য সর্ব-সুলক্ষণা একটি কন্যারও
প্রয়োজন। উপযাজ সেই ব্যবস্থা
করবেন। তবে পুত্রেষ্টি
যজ্ঞের খরচ কম নয়। তার উপর এই যজ্ঞে
উপযাজকেও প্রয়োজন। এবার ভেবে দেখ।’
কিন্তু রাজা দ্রুপদের তখন ভাবার সময় নেই। যুদ্ধ‚ তারপর অর্ধেক
রাজ্য হারিয়ে তাঁর রাজকোষের হাল তখন মোটেই ভাল নয়। তবু রাজি হয়ে গেলেন। শুরু
হল পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আয়োজন। রাজপুরীর অদূরে
বিশাল যজ্ঞক্ষেত্র তৈরি হল। যাজ এবং উপযাজ যথাসময়ে
কয়েকশো বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ঋষিকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন। ইতিমধ্যে দূর দূর থেকে রাজা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ
জানিয়ে আনা হয়েছে। তাঁদের উপস্থিতিতে
যথা সময়ে যজ্ঞ শুরু হল।
যজ্ঞ যখন শেষ পর্যায়ে‚ ঘি‚ মাংস‚ সোমরস প্রভৃতি নানা দ্রব্য আহুতি দেবার কারণে
বিশাল যজ্ঞমঞ্চ তখন ধোঁয়ায় ভরতি। অল্প
দূরের কিছুও ভাল দেখা যাচ্ছে না। যাজ দ্রুপদমহিষীকে
ডেকে বললেন‚ ‘রাজ্ঞী‚ শীঘ্র আসুন। আপনার দুই সন্তানের আবির্ভাবের মুহূর্ত আসন্ন।’
পুত্রেষ্টি
যজ্ঞে প্রধান মহিষীর উপস্থিতি প্রয়োজন। সন্তান পাবার আশায় উৎসুক হয়ে তাঁরা যজ্ঞমঞ্চে উপস্থিতও থাকেন। কিন্তু এই পুত্রেষ্টি যজ্ঞে দ্রুপদমহিষী বিশেষ খুশি ছিলেন না। একে তো এই যজ্ঞ আয়োজনের কারণে তাঁর প্রচুর অলঙ্কার যাজ এবং
উপযাজকে ভেট দিতে হয়েছে। তার উপর যজ্ঞ থেকে
যে পুত্র–কন্যার আবির্ভাব হবে তারা
উভয়েই প্রাপ্তবয়স্ক। সন্তান বুকে নিয়ে
রানির কোল আলো হবার সম্ভাবনা নেই। তবু তিনি যজ্ঞমঞ্চে
ছিলেন। কিন্তু ভয়ানক ধোঁয়ার
কারণে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। অনেকের মতোই এক
ফাঁকে উঠে গিয়েছিলেন। তারপর যাজ যখন তাঁকে
যজ্ঞমঞ্চে আহ্বান জানালেন‚ মঞ্চ তখনও ঘন ধোঁয়ায় সমাচ্ছন্ন। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ব্রহ্মর্ষি যাজের আহ্বান দ্রুপদমহিষী পক্ষে অমান্য করা
সম্ভব ছিল না। তাই তিনি সামান্য
ছলনার আশ্রয় নিলেন। দূর থেকেই বললেন‚ ‘মহর্ষি‚ আমার দেহ এখন অশুচি। অল্প অপেক্ষা করুন‚ আমি স্নান সেরে বস্ত্র বদলে আসছি।’
কিন্তু যাজের তখন অপেক্ষা করার সময় ছিল না। যজ্ঞে পূর্ণ আহুতির মুহূর্ত আসন্ন। তিনি বললেন‚ ‘আর সময় দেওয়া সম্ভব নয়। উপযাজ অন্তিম মন্ত্রে
পৌঁছে গেছে। আমি এখনি যজ্ঞাগ্নিতে
পূর্ণ আহুতি দেব। আপনি আসুন বা না
আসুন অভীষ্টলাভ হবেই।’ বলতে বলতে যাজ যজ্ঞাগ্নিতে পূর্ণ আহুতি দিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই যজ্ঞগৃহ সুগন্ধে আমোদিত হয়ে উঠল। দেখতে দেখতে ধূম্রজাল অন্তর্হিত হল। অবাক হয়ে সবাই দেখলেন নিভে আসা যজ্ঞবেদির পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে
ধনুর্বাণ এবং বর্ম-মুকুটধারী
এক কুমার‚ হাতের খড়্গ আন্দোলিত করে
মুহূর্তে তিনি সিংহনাদ করে উঠলেন। তাঁর
পাশে এক অপরূপ সুন্দরী শ্যামবর্ণা কুমারী কন্যা। দেখে উপস্থিত সবাই সাধু—সাধু করে উঠলেন। জয়ধ্বনি উঠল ব্রহ্মর্ষি
যাজ‚ উপযাজ এবং রাজা দ্রুপদের নামে। সেই মুহূর্তে আকাশবাণী হল‚ ‘এই রাজপুত্র দ্রোণ বধ করে পাঞ্চালরাজের বাসনা পূর্ণ করবে। আর সর্ব নারীর শ্রেষ্ঠা এই কন্যা কৃষ্ণা কুরুবংশ ধ্বংসের কারণ
হবে।’
যজ্ঞ থেকে উৎপন্ন সেই তেজদীপ্ত পুত্র‚ এবং অপরূপ সুন্দরী কন্যা দেখে শুধু রাজা দ্রুপদ
নয়‚ খুশি হলেন দ্রুপদমহিষীও। জন্মমুহূর্তে ধৃষ্ট অর্থাৎ প্রগলভ আচরণ এবং তেজদীপ্ত চেহারার
জন্য পুত্রের নাম রাখা হল ধৃষ্টদ্যুম্ন। শ্যামবর্ণ
আর আকাশবাণী অনুসারে কন্যার নাম রাখা হল কৃষ্ণা।
গল্প বলতে বসে বোধ হয় মহাভারতের চর্বিতচর্বণ হয়ে
যাচ্ছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। এই গল্পের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছোতে হলে মহাভারতের কিছু প্রসঙ্গ
উত্থাপন প্রয়োজন। তাই সংক্ষেপে বলি‚ ধৃষ্টদ্যুম্নের ইচ্ছায় রাজা দ্রুপদ যখন তাঁকে অস্ত্রশিক্ষার জন্য দ্রোণাচার্যের
কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন‚ দৈববাণীর কথা
জেনেও দ্রোণাচার্য তাঁকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। সেটা কী নিছক অর্থের লোভে‚ নাকি দৈববাণী অনিবার্য জেনে‚ অথবা মহানুভবতার কারণে‚ মহাভারতকার পরিষ্কার করে জানাননি।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রোণ কীভাবে নিহত হয়েছিলেন‚ আমরা জানি। যাজ‚ উপযাজ যত বড় ব্রহ্মর্ষিই
হোন‚ তাঁদের কথা হুবহু ফলেছিল‚ এমন নয়। স্বয়ং দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করে ধৃষ্টদ্যুম্ন অস্ত্রচালনায়
দক্ষ হয়েছিলেন সন্দেহ নেই। পাণ্ডব পক্ষের প্রধান
সেনাপতিও হয়েছিলেন তিনি। ভীষ্ম‚ দ্রোণ‚ কর্ণের মতো কৌরব পক্ষের একের পর এক প্রধান সেনাপতির যখন পতন হয়ে চলেছে‚ তখন তিনি যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্তমান। তবু তাঁর একার পক্ষে দ্রোণকে বধ করা সম্ভব হয়নি। অংশ গ্রহণ করতে হয়েছিল আরও একাধিক ব্যক্তিকে। যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি যখন একেবারেই পাণ্ডব
পক্ষের অনুকূল নয়‚ ব্রহ্মাস্ত্র হাতে দোণাচার্য
একাই যেভাবে পাণ্ডব-পক্ষের সৈন্য ক্ষয় করে চলেছেন‚ তাতে সেই দিনই পাণ্ডব-পক্ষের
পরাজয় সুনিশ্চিত। তখন আসরে অবতীর্ণ
হলেন কৃষ্ণ। তারই পরামর্শে ভীম
মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামে এক হাতিকে বধ করে দ্রোণকে শুনিয়ে বললেন‚ ‘আমি অশ্বত্থামাকে একটু আগে হত্যা করেছি।’
পুত্রের মৃত্যু সংবাদে দ্রোণ মর্মাহত হলেও বিশ্বাস করতে
পারলেন না। ভীমের কাছেই ছিলেন
যুধিষ্ঠির। তিনি যুধিষ্ঠিরের
কাছে সংবাদের সত্যতা জানতে চাইলেন। কৃষ্ণের প্ররোচনায়
যুধিষ্ঠিরও বললেন‚ ‘অশ্বত্থামা হতঃ।’ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির তারপর
‘ইতি কুরঞ্জঃ’ বলেছিলেন বটে‚ তবে তা এত আস্তে যে‚ যুদ্ধক্ষেত্রের শোরগোলে
দ্রোণের কানে পৌঁছোয়নি। মহাভারতকার জানিয়েছেন‚ বৃদ্ধ বয়সে প্রাণাধিক প্রিয় একমাত্র পুত্রের
মৃত্যু সংবাদে তিনি এতটাই আঘাত পেয়েছিলেন যে‚ অদূরে ধৃষ্টদ্যুম্নকে ধনুকে
শর যোজনা করতে দেখেও আত্মরক্ষার চেষ্টা করেননি। সেই শরাঘাতে আহত হয়ে তিনি যখন রথে অস্ত্র ত্যাগ করে পুত্রের
সঙ্গে নিজের মৃত্যু কামনা করছেন‚ সেই সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন
ছুটে এসে বিনাবাধায় তাঁর শিরশ্ছেদ করেছিলেন।
আমাদের এই কাহিনি প্রায় শেষ অঙ্কে পৌঁছে গেছে। অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধের শেষে কৌরব পক্ষের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনার
মধ্যে অবশিষ্ট মাত্র তিন যোদ্ধা‚ কৃপ‚ কৃতবর্মা ও অশ্বত্থামা। পাণ্ডব শিবিরে কিন্তু তখন যথেষ্ট সংখ্যক সেনাই শুধু নয়‚ ধৃষ্টদ্যুম্ন সহ পঞ্চপাণ্ডব
এবং তাঁদের পাঁচ পুত্রও জীবিত।
ভীমের গদাঘাতে মৃত্যুপথযাত্রী দুর্যোধন হতদ্যোম হয়ে পড়লেও
দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা তখনও আশা ছাড়েননি। তার
উপর পিতার হত্যাকারী ধৃষ্টদ্যুম্নকে অন্যরা ভুলে গেলেও তিনি ভুলতে পারেননি। ক্ষোভ নিবৃত হয়নি এক বিন্দুও। যুদ্ধের সেই শেষ দিনে হঠাৎই পেয়ে গেলেন সেই সুযোগ।
যুদ্ধজয়ের আনন্দে আমোদ ফুর্তি আর ভূরিভোজনের পরে গভীর
রাতে পাণ্ডব শিবিরে সবাই তখন নিদ্রামগ্ন। প্রহরীর
ব্যবস্থা সেদিন অনেকটাই শিথিল। সুবর্ণ সুযোগটা
কাজে লাগাতে অশ্বত্থামা আর দেরি করেননি। কিন্তু
এই অন্যায় কাজে কৃপ ও কৃতবর্মাকে রাজি করানো সহজ ছিল না। কিন্তু বয়সে অনেক নবীন হয়েও অশ্বত্থামা তাঁদের রাজি করাতে পেরেছিলেন। তখন অবশ্য তিনি জানতেন না‚ এমন কিছু অনুমান করে শ্রীকৃষ্ণ আগেই পঞ্চপাণ্ডব আর প্রিয় বন্ধু সাত্যকীকে নিয়ে
শিবির ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। (লক্ষণীয়‚ শ্রীকৃষ্ণ সেদিন ইচ্ছে করলে শিবিরের অন্যদেরও
রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু সন্দেহ নেই‚ তাঁর মনোগত ইচ্ছে ছিল‚ যুদ্ধ শেষে তাঁর যাদব বংশের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী
যেন অবশিষ্ট না থাকে। সেই কারণে তিনি
কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধে যাদবদের
অংশ গ্রহণ করতেও দেননি। বিচক্ষণ শ্রীকৃষ্ণ
কিন্তু সেদিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্য এক পাঠ ভুলে গিয়েছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী বিহীন মদমত্ত যাদবরা অল্প দিনের মধ্যে আত্মকলহে
শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর চোখের সামনেই।)
এদিকে গভীর রাতে অশ্বত্থামা দুই সঙ্গী নিয়ে প্রহরী বিহীন
পাণ্ডব শিবিরে যখন পৌঁছুলেন‚ দেখেন শিবিরের
দ্বার আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ভীম দর্শন এক পুরুষ। তাঁর পরনে ব্যাঘ্রচর্ম। চুড়ো করে বাঁধা চুল। গলায়
বুনো ফুলের মালা। হাতে সুবিশাল
ত্রিশূল আর ধনুর্বাণ। কোমরে খড়্গ।
মহাভারতকার তাঁকে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব বলে উল্লেখ করেছেন। অশ্বত্থামা অবশ্য তেমন ভাবেননি। কাছে না গিয়ে দূর থেকেই ধনুকে শর যোজনা করলেন। অশ্বত্থামা দ্রোণাচার্যর পুত্র। অস্ত্রশিক্ষা করেছেন তাঁরই কাছে। ধনুকে একসাথে একাধিক শর যোজনা করে নিক্ষেপ করেছিলেন তিনি। কী আশ্চর্য! দ্বারদেশের সেই প্রহরী একটি শরও তাঁর দেহে বিদ্ধ হতে দিলেন না। তার আগেই মুখগহ্বরে নিয়ে নিষ্ক্রিয় করে দিলেন। তারপর বাঁ হাত দিয়ে সেগুলি মুখ থেকে টেনে বের করে পলকা কাঠির
মতো অনায়াসে দ্বিখণ্ডিত করে ছুঁড়ে ফেললেন। দেখতে
দেখতে তিন যোদ্ধার তূণীর শূন্য হয়ে গেল। কিন্তু
একটি শরও সেই দ্বাররক্ষীর দেহে বিদ্ধ করা গেল না।
সেই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে কৃপ আর কৃতবর্মা যখন তাঁকে স্বয়ং
মহাদেব বলেই ভাবতে শুরু করেছেন‚ পিতার কাছে
শোনা বহুদিন আগের এক ঘটনার কথা অশ্বত্থামার মনে পড়ে গেল। ঠিক এই ভাবেই এক অরণ্যচারী তীরন্দাজ কুকুরের মুখের ভিতর একাধিক
শর নিক্ষেপ করেছিলেন। একবিন্দু রক্তপাতও
হয়নি। এরপর অন্ধকারেও তাঁর দৃষ্টি এড়াল না‚ দ্বাররক্ষীর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি নেই। অশ্বত্থামা
এরপর আর দেরি করেননি। অস্ত্র ত্যাগ করে
ছুটে গেলেন সেই দ্বাররক্ষীর কাছে।
জোড়হাতে বিনম্র কণ্ঠে বললেন‚ ‘হে বীরশ্রেষ্ঠ‚ আপনাকে আমি চিনেছি। আপনি নিষাদরাজ একলব্য।’
উত্তরে সেই দ্বাররক্ষী নিঃশব্দে মৃদু হাসলেন শুধু। কিন্তু অশ্বত্থামার থামার উপায় ছিল না। নতমস্তকে বললেন‚ ‘কৌরব এবং পাণ্ডব উভয়পক্ষই যুদ্ধের আগে আপনাকে কামনা করেছিলেন। কিন্তু উভয়ের সেই আবেদন আপনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবু এই রাতে পাণ্ডব শিবির প্রহরায় নিযুক্ত রয়েছেন দেখে আমি প্রকৃতই
বিস্মিত! দেব‚ অনুগ্রহ করে আমার উদ্দেশ্য পূর্ণ হতে দিন।’
‘দ্বিজ‚’ বিনীত কণ্ঠে দ্বাররক্ষী বললেন‚ ‘আপনার অনুমান অভ্রান্ত। আমি নিষাদরাজ একলব্য। কিন্তু গুরুপুত্র হলেও আপনি অন্যায় উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে উপস্থিত
হয়েছেন। তাই অনুরোধ‚ এই দণ্ডেই স্থান ত্যাগ করুন।’
নিষাদরাজের সেই কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে‚ হতচকিত হয়ে অশ্বত্থামা কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন। কিন্তু হাজার হলেও তিনি ধীসম্পন্ন বৈদিক ব্রাহ্মণ তনয়। বুঝতে বিলম্ব হল না‚ একলব্য যে চরিত্রের মানুষ‚ গুরুপুত্রের কোনও ক্ষতি তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। সন্দেহ নেই‚ সেই কারণেই অল্প আগে আক্রান্ত হয়েও মানুষটি কোনও প্রতিআক্রমণ করেননি। সাহস ফিরে পেয়ে অশ্বত্থামা করজোড়ে বললেন‚ ‘হে বীরশ্রেষ্ঠ‚ বুঝতে পারছি‚ পাণ্ডব শিবিরে এমন কেউ রয়েছেন‚ যাঁর প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাঁকে রক্ষার জন্যই এই রাতে আপনি ছুটে এসেছেন।’
‘দ্বিজ‚’ সামান্য ইতস্তত করে নিষাদরাজ বললেন‚ ‘আপনি গুরুপুত্র। বিজ্ঞ ব্যক্তি। পূর্বের মতোই আপনার অনুমান অভ্রান্ত।’
‘কে তিনি?’ ব্যগ্র হয়ে অশ্বত্থামা
বললেন‚ ‘হে পুরুষ-শ্রেষ্ঠ‚ আমি আপনার গুরুপুত্র অশ্বত্থামা‚ শপথ নিয়ে বলছি‚ তাঁর কোনও ক্ষতি আমি করব না।’
‘তিনি‚’ সামান্য ইতস্তত করে নিষাদরাজ বললেন‚ ‘তিনি ধৃষ্টদ্যুম্ন।’
নিষাদরাজের সেই উত্তরে অশ্বত্থামার পা থেকে মাথা পর্যন্ত
কেঁপে উঠল। কিন্তু মানুষটির
মুখে তার একবিন্দু প্রকাশ ঘটল না। শুধু বললেন‚ ‘ধৃষ্টদ্যুম্ন! দ্রুপদপুত্র
দুরাত্মা এই মানুষটির প্রতি আপনার এই দায়বদ্ধতার কারণ কী দেব?’
চরম কৌতূহলে অশ্বত্থামা নিষাদরাজের দিকে তাকালেন বটে। কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়াই সেখানে দেখতে পেলেন না। স্থির নেত্রে মানুষটি তখন তাকিয়ে রয়েছেন অশ্বত্থামার দিকে।
আসলেন নিষাদরাজ তখন সামনে উপস্থিত মানুষটির ভিতরটা পড়ে
নিতে চাইছিলেন। কতটা বিশ্বাস করা
যায়‚ যাচাই করে নিতে চাইছিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্য তাঁর দায়বদ্ধতা আছে বইকী। চরম দায়বদ্ধতা। কুরু-পাঞ্চাল এই যুদ্ধে তিনি শত অনুরোধেও কোনও পক্ষেই
যোগদান করতে পারেনি। একপক্ষে তাঁর অস্ত্রগুরু
দ্রোণাচার্য। অন্যপক্ষে এই ধৃষ্টদ্যুম্ন।
পুত্রেষ্টি যজ্ঞে পাঞ্চালরাজের পুত্রের স্বীকৃতি পেলেও আসলে যে তাঁরই সহদর ভাই। তাই
কোনও পক্ষেই যেতে পারেননি তিনি। দ্রুপদ রাজার আমন্ত্রণে
পুত্রেষ্টি যজ্ঞে তিনিও হাজির ছিলেন। যজ্ঞকুণ্ড থেকে
উৎপন্ন কুমারকে দেখে চমকে উঠেছিলেন সেদিন। সহদর
ধৃতিলব্য বরাবরই জেদি প্রকৃতির। তবু যখন শপথ নিয়ে
সে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিল‚ বিচলিত বোধ
করেননি। জানতেন প্রগলভ সহদর
একদিন প্রতিজ্ঞা ভুলে ফিরে আসবে। সেই প্রথম টের পেয়েছিলেন‚ হাজার হোক‚ ধৃতিলব্য তাঁরই ভাই। কিন্তু সেদিন কিছুই আর করার ছিল না। যজ্ঞ সভায় উপস্থিত থেকেও কিছুই করতে পারেননি। আজও কিছুই প্রকাশ করতে পারলেন না। শুধু বললেন‚ ‘দ্বিজ‚ গুরুপুত্র হলেও সেই কৈফিয়ৎ
আপনাকে দেব‚ ভাবলেন কী করে?
শুধু জানতে চাই‚ যে শপথ আপনি করেছেন‚ তাতে এখনো স্থির রয়েছেন কিনা?’
নিষাদরাজের সেই কথায় অশ্বত্থামা তৎক্ষণাৎ বললেন‚ ‘দেব‚ আমি অশ্বত্থামা। আপনার গুরুপুত্র। শপথ যখন নিয়েছি‚ অন্যথা হবে না। আপনি
বিন্দুমাত্র চিন্তা করবেন না।’
‘দ্বিজ‚ তাহলে সেই কথাই রইল। আজ গুরুপুত্রের
ইচ্ছা যে পূর্ণ করতে পারলাম‚ সেও আমার পরম
সৌভাগ্য। আর এক গুরুদক্ষিণা।’
অশ্বত্থামাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে নিষাদরাজ একলব্য বিদায়
নিয়ে চলে গেলেন।
তার পরের ঘটনাক্রম মহাভারতকারই জানিয়েছেন। অশ্বত্থামা সেই রাতে পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করে প্রথমেই ঘুমন্ত
ধৃষ্টদ্যুম্নের শিরশ্ছেদ করেছিলেন। শাস্ত্রজ্ঞ সেই
বৈদিক ব্রাহ্মণপুত্র এই যুক্তি দিয়ে তাঁর দোষ স্খালন করেছিলেন যে‚ শত্রুকে নিপাত করার জন্য ন্যায়–অন্যায়‚ সত্য–মিথ্যা বলে কিছু নেই। দ্রোণাচার্যকে বধ
করার দিন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ একই কথা বলেছিলেন যুধিষ্ঠিরকেও।*
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
* মহাভারতের কাহিনির জন্য রাজশেখর বসু রচিত
‘মহাভারত’ গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
ami eta jene khub anondo pelam
ReplyDeleteখুব তথ্যবহুল
ReplyDeleteApurbo sundor rachana. Dhritilobyer upakhyaner utso jante pari ki? Naki somostotai kalpona? Ta holeo chamatkar.
ReplyDeleteধৃতিলব্য শিশিরবাবুর সৃষ্টি । কিন্তু ধৃষ্টদুম্ন নিষাদ সন্তান এটা ব্যাসদেব ইঙ্গিত দিয়েছেন । অসামান্য লেখা শিশিরবাবু ।
Deleteধৃতিলব্য শিশিরবাবুর সৃষ্টি । কিন্তু ধৃষ্টদুম্ন নিষাদ সন্তান এটা ব্যাসদেব ইঙ্গিত দিয়েছেন । অসামান্য লেখা শিশিরবাবু ।
Deleteখুব ভালো লাগলো....
ReplyDeleteOsadharon laglo
ReplyDeleteকৃষ্ণের যে এক লাখ সংসপ্তক নারয়নী সেনা কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধে করেছিল তারা কি যাদব নয় ?
ReplyDeleteনারায়ণী সেনার সবাই যাদব ছিল‚ এমন মনে হয় না। তেমন হলে তাদের যাদব সৈন্যই বলা হত। সম্ভবত নারায়ণী সেনা যাদব বাহিনীর কোনও এক রেজিমেন্টের নাম। যেখানে যাদব সেনার সঙ্গে অন্য সম্প্রদায় থেকে নেওয়া প্রচুর সংখ্যক ভাড়াটে সৈন্যও ছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাদের কৃতিত্ব বিরাট কিছু নয়।
Deleteএই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে অনবদ্য। তা সত্তেও কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়। লেখকের লেখনিতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষ পর্বে একলব্যের উপস্থিতি এবং অশ্বথামার সঙ্গে তার কথোপকথন যথেষ্ট কুহক সৃষ্টিতে ব্যর্থ্য হয়েছে। যা অনভিপ্রেত। মুল মহাভারতে একলব্যের মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক ছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। শুধু তাই কেন তিনি সমগ্র মহাভারতের নিয়ন্ত্রক ছিলেন।
ReplyDeleteকর্ণ দ্রোণের কাছে অস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন? মহাভারতে পড়েছি ওনার অস্ত্রগুরু পরশুরাম
ReplyDeleteমহাভারতের বিভিন্ন ভার্শনে বিভিন্ন রকম বক্তব্য রয়েছে। রয়েছে অনেক প্রক্ষিপ্ত অংশ। আমি রাজশেখর বসুর ‘মহাভারত’ অনুসরণ করেছি। গল্পের শেষে সেই স্বীকৃতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞবৃন্দও গ্রন্থটিকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করেছেন। এই গ্রন্থে দ্রোণাচার্যকেই কর্ণের অস্ত্রগুরু বলা হয়েছে (পৃ–৫৫‚ ৭ম মুদ্রণ)। তবে কর্ণ শুধু দ্রোণাচার্য নয়‚ আরও অনেকের কাছেই অস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন। গল্পেও তেমনই ইঙ্গিত রয়েছে। ধন্যবাদ।
DeleteKhubi tothyosomridhho lekha and Dhritilobbo charitroti osadharon sristi. Sudu Korno kono Guru Droner kache ostrosikkha korechilen bole mone hoi na.
ReplyDeleteDarun lekha...khub valo laglo..
ReplyDeleteদারুন লাগলো লেখনি। ধন্যবাদ..
ReplyDeleteঅশ্বত্থামা দুষ্ট ধৃষ্টদুম্ন্যকে কোন অস্ত্রাঘাতে নয়, গলায় পা দিয়ে চাপ দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে খতম করেন।
ReplyDelete