অঘটন?
গজেন্দ্রকুমার মিত্র
দু’একটা মিরাকল, যে চোখে দেখি নি
তা নয়। আমার নিজের জীবনেই এমন ঘটনা ঘটেছে, যাকে মিরাকল বলাই
উচিত। সে সব কাহিনী লিখেওছি এক পজাসংখ্যা যুগান্তরে‚ ‘কাকতালীয়?’ নাম দিয়ে। শুনেছিও কিছু কিছু।
এক সাধুর মুখে শুনেছি, এক সবজিওলা
বর্ধমান স্টেশনে বসেছিল, লোকাল ট্রেনে মাল নিয়ে কলকাতা আসবে
বলে। মাল বলতে বিশেষ কিছু ছিল না সেদিন, কিছু শাক ছিল মাত্র।
তার মধ্যে কচি চড়ুই শাক বা চাঁপানটেই প্রধান। পাশে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধা, পাড়াগাঁয়ের সদাকুণ্ঠিত জড়োসড়ো বয়ষ্কা এক মহিলা। তিনি বারবারই সেই শাকগুলিতে
হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলেন,
যেন তিনি স্পর্শেই ওদের স্বাদ অনুভব করছেন, আর
মুখে বলতে লাগলেন, ‘বাঃ বাঃ, অনেক দিন
এমন টাটকা শাক দেখি নি বাবা!’
বুড়ীর রকমসকম দেখে মায়া
হ’ল
শাকওলার। বললে, ‘তা নাও না বুড়ীমা, দু
আঁটি তিন আঁটি‚ যা ইচ্ছে। স্বচ্ছন্দে
নাও, পয়সা
লাগবে না।’
মহিলা মাথা নেড়ে বললেন, 'না বাবা,
এখন নিতে পারব না। এখন ঘরকে যাচ্ছি না।’
তারপর একটু থেমে বললেন, ‘তুমি কোথায়
যাবে বললে? শ্যামবাজারে যাও শাক বেচতে? তা বাবা, যদি তোমার দয়া হয়, একদিন
বরং আমার ঘরে দু অঁটি শাক ফেলে দিয়ে এসো। যেদিন বাঁচবে–টাঁচবে।’
‘আমি ঠিকানা পাব
কোথায়?’
‘কিছু না, শ্যামবাজারের বাজার থেকে বেরিয়ে একট, উত্তরে-বাগবাজার,
মুখে যেয়ে জিজ্ঞেস করো মার বাড়িটা কোথায়, কেউ
না কেউ দেখিয়ে দেবেই।’
তা গিছল সে লোকটি। বাজারে
যাবার আগেই গিছল। আলাদা করে চাঁপানটে একটা ছেঁড়া কাপড়ে বেধে নিয়ে। বাড়ী খুঁজে
বের করতেও কোনো অসুবিধে হয় নি। কিন্তু মুশকিল হল‚ লোকটি যখন বলল, এই ঠিকানায় একটি বুড়োমতো মেয়েছেলে থাকে,
আমাকে বলেছেল একটু লটে শাক দিয়ে যেতে‚ তাই আমি এনেছি।’
সেটা আসলে মঠ, সাধুরা থাকেন।
তাঁরা তো অবাক। ‘না বাপ, এখানে কেউ মেয়েছেলেটেলে থাকে না।
দেখতে পাচ্ছ তো সাধুদের আস্তানা। এখানে মেয়েছেলে থাকবেই বা কেন? নিশ্চয় তোমার
ভুল হয়েছে।’
তবু, লোকটি বারবারই
বলতে লাগল, ‘না, সে বুড়ীমা আমাকে অনেক
করে বলেছেল যে।’
বলতে বলতেই নজরে পড়ল, সিড়ির বাঁকে
বিশ্বজননী সারদামণির নানা বয়সের ছবি এক ফ্রেমে বাঁধানো। সে বলে উঠল, ‘বা রে। এই তো। এই বুড়ীমাই তো আমাকে লটে শাকের
কথা বলেছেল। আপনারা বলছ তিনি এখানে থাকে না!’
সাধুরা তো অবাক। মাগো, তোমার দুটো শাক
খাবার ইচ্ছে হয়েছিল তো আমাদের বলনি কেন?
আর একটি কাহিনী
কথাসাহিত্য পত্রিকায় লিখেছিলেন স্বয়ং জ্ঞানাত্মানন্দ, পুজনীয় সুধীর
মহারাজ।
উনি আর এক সাধু, বেলুড় মঠে অফিস
বাড়ীর সিড়িতে বসে এক বিকেলে কথা কইছেন, এক সাহেবের প্রবেশ।
‘কী চাই?’ ওনারা শুধোলেন।
সাহেব বললেন, ‘পথে এক সাধুর
সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল, মাঝবয়সী লোক একজন, সাদা কাপড় পরা। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে খুব ভাল
লেগেছিল তাঁর। পরিষ্কার ইংরেজী বলেন, অথচ সেকালের লোক ধুতির ওপর কোট পরা‚ কিন্তু জ্ঞানের কথা যা বললেন, আধুনিকতম
পাশ্চাত্য ফিলজফী মনে হ’ল তার কাছে জলবৎ সরল। ঠিকানা চাইতে
উনি এই ঠিকানা দিলেন। নামটাও বলেছিলেন‚ সে কাগজটা হারিয়ে গেছে। ওঁরা কি বলতে পারেন এমন কোনাে
সাধর খোঁজ।’
ওঁরা তো অনেক ভেবেও বুঝতে
পারলেন না লোকটি কে। বয়স্ক এবং পাশ্চাত্য দর্শনে পণ্ডিত হলে অবশ্যই গেরুয়া পরা
হবে। সাদা কাপড় পরা হলে কোনো ব্রহ্মচারী, তাহলে তো বয়েস
বেশী হবে না।
তবু ওঁরা দু'চারজন সাধুকে এনে
আলাপ করিয়ে দিলেন। সাহেব ঘাড় নাড়লেন, না, এরা কেউ নন।
হতাশ হয়ে সাহেব ফিরে
যাচ্ছেন‚ সাধুরা বললেন, ‘আর দশ মিনিট
থেকে যান না। এখনই মন্দিরের দোর খুলবে, দর্শন করে যান।’
সাহেব বললেন, ‘কিন্তু আমি তো
বিজাতীয় বিধর্মী খ্রীশ্চান, দর্শন করতে দেবেন আপনারা?’
এঁরা বললেন, ‘আমাদের ঠাকুর বা
গুর, এসব ধর্মের গণ্ডী মানতেন না। আমাদের কাছে জাতধর্মে কোনো
কিছু এসে যায় না। শুধু আপনাকে জুতোটা খুলতে হবে‚ সিঁড়ির নিচেয়।’
থেকে গেলেন সাহেব। কিন্তু
মন্দিরের দরজা খুলতে সাহেব ভেতরে ঢুকেই একটা যেন চিৎকার করে উঠলেন। ‘এই তো‚ এই তো সেই মানুষ‚ যাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল!’
তাঁকে কিছুতেই বোঝানো গেল
না যে ইনি বহু‚ বহুদিন আগে গত হয়েছেন।
এইবার আমরা আসছি একেবারে
সাম্প্রতিক কালে।
এ ঘটনাকে আপনারা মিরাকল
বলবেন‚ কি যোগাযোগ বলবেন, কি ভুল-বোঝা
বলবেন তা আপনারাই জানেন। শুধু, যা ঘটেছিল তাই বলছি।
পাড়ার একটি কালীবাড়ি, প্রায় বছর পচিশ আগে
একরকম ভিক্ষে করে কাদের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল‚ এখন বহু ভক্ত সমাগম হয়। পুজোর প্রণামী ও চাঁদায়
তার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। অনেকটা জমি নিয়ে বড় নাটমন্দির, সেখানে ভগবৎকথা,
সৎপ্রসঙ্গ আলোচনা হয়—পালে-পার্বণে পূজার্থীরা
এসে জড়ো হতে পারেন।
আমি যেদিনের কথা বলছি, সেদিনটা
শ্যামাপজোরই দিন, বিশেষ পুজা রাতে। তবু সকাল থেকেই বহুলোক আসছে, পজাও দিচ্ছে,
দর্শন করে চলে যাচ্ছে কেউ কেউ শুধু প্রণামী দিয়ে।
আমাদের চেনা একটি মেয়ে‚ নাম ধরুন নন্দা‚ সে রাত অবধি উপোস করতে পারবে না।
রাতে বেরোতেও পারবে না বলে ছেলেকে নিয়ে পুজো দিতে এসেছিল। পুজো আর কি, বাক্স করে দু-তিন
টাকার মিষ্টি, তার সঙ্গে ওর নাম–ঠিকানা লেখা একটা কাগজের
স্লিপ। একটা
টাকা দক্ষিণাও সেই সঙ্গে। এমনিই দিয়ে যায় বহু ভক্ত, দিনের পজা সাঙ্গ
হলে এই সব বাক্স আবার ভক্তদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কেউ বা নিজেরাই পরে এসে নিয়ে
যান, কেউ বা অপরকে বরাত দিয়ে যান।
নন্দা সকাল করেই এসেছে, কিন্তু ঢুকে দেখল
এবার বড্ড যেন ভীড়। এরই মধ্যে বহ, মেয়েছেলে জড়ো হয়েছে। রেকাবি ও বাক্সে বহু লোকের
পুজোও পৌছে গেছে। নন্দার বেশীক্ষণ থাকার উপায় নেই, বাড়ির কর্তা বিদেশে ঘোরেন,
যে কোনো মুহর্তে এসে পড়তে পারেন। তাছাড়া যা দিনকাল‚ খালি বাড়ি এক ঘণ্টা পড়ে থাকলেও
চুরি হতে পারে।
সে কোনমতে পুজারীর
সহকারীকে পুজোটা জিম্মা করে দিয়ে নেমে এল নাটমন্দির থেকে। কিন্তু বিষম গোল বাধাল
তার ছেলে।
সে প্রচণ্ড বায়না ধরল, ‘কৈ, পেসাদ কৈ ? পেসাদ দিলে না ? পেসাদ
খাবো আমি, মিষ্টি খাবো…।’
যত তাকে বোঝায় নন্দা, ‘পজো হোক। একট, পরে এসে প্রসাদ
নিয়ে যাবো। তখন যত খুশী খেয়ো।' ততই তার কান্না বেড়ে যায়। দু’বছরের
ছেলে, সে অত বোঝে না। সে চায় মিষ্টি খেতে। শেষ পর্যন্ত
মাটিতে লুটোপুটি খেয়ে কাঁদতে শুরু করে। টেনে নিয়ে যেতে গেলেও হিতে বিপরীত হয়।
এই যখন অবস্থা, লজ্জায়
উৎকণ্ঠায় নন্দ ঘেমে উঠেছে‚
ওদিক থেকে একটি আধবয়সী মহিলা নেমে এসে বললেন, ‘নেন ভাই, আপনার
বাক্স, আমি ঠাকুরমশাইকে বলে আগে একটু উচ্ছগ্য করায়ে আনলাম।
আহা, ও কি অত বোঝে, শিশু–মিষ্টি খাবে, সেইটাই বোঝে।’
লজ্জিত হলেও বেঁচে গেল
নন্দা, বাক্সর দিকে চেয়ে দেখল, ওরই বাক্স বটে, পাড়ার দোকানের ছাপা বাক্স, ওর হাতে লেখা স্লিপ। ছেলেও শান্ত হয়ে উঠে ওর
হাত ধরে মন্দিরের বাইরে এল। বাক্স খুলে অবশ্য একট, ধোঁকা লেগেছিল একবার, কারণ নন্দার যতদূর মনে আছে, সে সাধারণ কস্তুরো
সন্দেশ কিনেছিল। এখন দেখছে বড় ‘আবার খাবো’ সন্দেশ, এগুলো একটাকা করে দাম। চারটে আছে। ওর তো বরাত ছিল তিন টাকার সন্দেশ।
হয়ত মাধব দোকানীই শুনতে
ভুল করেছে। কাল ওকে একটা টাকা দিয়ে দিলেই হবে।
প্রসাদ ছেলেও খেল, ছেলের মাও খেল।
পুজার চিহ্নস্বরুপ বেলপাতা, জবাফুলের পাপড়ি, একট, সিঁদুরমাখা ফুল‚ পূজারী ঠাকুরের কিছুই ভুল হয় নি।
তারপর রান্না শেষ করে, ছেলেকে চান
করিয়ে খাইয়ে নিজে খেতে বসতে যাবে, পাশের বাড়ির সরোদিদি
এসে ডাকাডাকি করতে লাগলেন।
‘কী ব্যাপার দিদি। আপনি?’
‘তুই পেসাদ আনতে
যাসনি, ঠাকুর মশায়ের ছেলে নাম ডাকছে বার বার তাই আমিই চেয়ে
নিয়ে এলাম। বলি
আমাকেই দিন, আমি পৌঁছে দেব তাকে। ভুলে গেছিস বুঝি?’
বলতে বলতে সরোদিদি ওর
হাতে বাক্সটা দিয়ে চলে গেলেন। নন্দা অবাক হয়ে দেখল, সেই বাক্স,
সেই ওর হাতে লেখা স্লিপ।
খুলে দেখল, ভেতরে ছটা
কস্তুরো সন্দেশ। তিন টাকারই। মাধব দোকানীর কিছুমাত্র ভুল হয় নি।
আপলোড: ৮/৩/২০১৯
Darun laglo
ReplyDeleteBhalo laglo
ReplyDeleteঅসাধারণ।
ReplyDeleteযিনি রাম, তিনিই কৃষ্ণ। এযুগে তিনি রামকৃষ্ণ।
ReplyDeleteঅলৌকিক গল্পসমগ্রতে পড়েছিলাম।পুনর্বার পড়লাম,এত ভালো লাগলো!ধন্যবাদ শিশিরবাবু।
ReplyDeleteআবার পড়লাম। খুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteঅনবদ্য লাগল দাদা 🙏💐💖
ReplyDeleteআগেও একবার কোথাও পড়েছিলাম। খুবই সরল লেখা, ভক্তিবাদীরা বেশ আনন্দ পাবেন। গজেন্দ্রবাবুর যত কেরামতি ঔপন্যাসিক হিসেবে তার সিকি আনাও এই লেখায় নেই।
ReplyDeleteতবে লেখায় বেশ কয়েকটা বানান ভুল রয়েছে। সংশোধন করে নিন।
সেই তো! ভক্তের জন্য কত রূপেই না মা আসেন! ঠাকুর আসেন!
ReplyDelete