সুকুমার রায়
(প্রফেসর
হুঁশিয়ার আমাদের উপর ভারি রাগ করেছেন। আমরা সেকালের জীবজন্তু সম্বন্ধে নানাকথা
ছাপিয়েছি; কিন্তু কোথাও তাঁর অদ্ভুত শিকার কাহিনীর কোনো উল্লেখ করি নি।
সত্যি এ আমাদের ভারি অন্যায়। আমরা সে-সব কাহিনী কিছুই জানতাম না। কিন্তু প্রফেসর
হুঁশিয়ার তাঁর শিকারের ডায়েরি থেকে কিছু কিছু উদ্ধার করে আমাদের পাঠিয়েছেন। আমরা
তারই কিছু কিছু ছাপিয়ে দিলাম। এ-সব কথা সত্যি কি মিথ্যা তা তোমরা বিচার করে নিয়ো।)
২৬শে
জুন ১৯২২- কারাকোরম্, বন্দাকুশ পাহাড়ের দশ মাইল উত্তর। আমরা এখন
সবসুদ্ধ দশজন- আমি, আমার ভাগ্নে চন্দ্রখাই, দুইজন শিকারী (ছক্কড় সিং আর লক্কড় সিং) আর ছয়জন কুলি। আমার কুকুরটাও সঙ্গে
সঙ্গেই চলেছে।
নদীর
ধারে তাঁবু খাটিয়ে জিনিসপত্র সব কুলিদের জিম্মায় দিয়ে, আমি, চন্দ্রখাই আর শিকারী দুজনকে সঙ্গে করে বেরিয়ে
পড়লাম। সঙ্গে বন্দুক, ম্যাপ আর একটা মস্ত বাক্স, তাতে আমাদের যন্ত্রপাতি আর খাবার জিনিস। দুঘণ্টা পথ চলে আমরা এক জায়গায়
এলাম, সেখানকার সবই কেমন অদ্ভুতরকম। বড়ো-বড়ো গাছ, তার একটারও নাম আমরা জানি না। একটা গাছে প্রকাণ্ড বেলের মতো মস্ত-মস্ত লাল
রঙের ফল ঝুলছে; একটা ফুলের গাছ দেখলাম, তাতে হলদে সাদা ফুল হয়েছে, এক-একটা দেড় হাত লম্বা।
আর-একটা গাছে ঝিঙের মতো কি সব ঝুলছে, পঁচিশ হাত দূর থেকে তার
ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়। আমরা অবাক হয়ে এই-সব দেখছি, এমন সময়
হঠাত্ হুপ্হাপ গুব্গাপ্ শব্দে পাহাড়ের উপর থেকে ভয়ানক একটা কোলাহল শোনা গেল।
আমি
আর শিকারী দুজন তত্ক্ষণাত্ বন্দুক নিয়ে খাড়া; কিন্তু চন্দ্রখাই
বাক্স থেকে দুই টিন জ্যাম বের করে নিশ্চিন্তে বসে খেতে লাগল। ঐটে তার একটা মস্ত
দোষ; খাওয়া পেলে আর তার বিপদ আপদ কিছু জ্ঞান থাকে না। এইভাবে
প্রায় মিনিট দুই দাঁড়িয়ে থাকবার পর লক্কড় সিং হঠাত্ দেখতে পেল হাতির চাইতেও বড়ো
একটা জন্তু গাছের উপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। প্রথমে দেখে মনে হল একটা
প্রকাণ্ড মানুষ, তার পর মনে হল মানুষ নয় বাঁদর, তার পর দেখি মানুষও নয়, বাঁদরও নয়- একেবারে নতুন
রকমের জন্তু। সে লাল লাল ফলগুলোর খোসা ছাড়িয়ে খাচ্ছে আর আমাদের দিকে ফিরে ফিরে ঠিক
মানুষের মতো করে হাসছে। দেখতে দেখতে পঁচিশ-ত্রিশটা ফল সে টপাটপ্ খেয়ে শেষ করল।
আমরা এই সুযোগে তার কয়েকখানা ছবি তুলে ফেললাম। তার পর চন্দ্রখাই ভরসা করে এগিয়ে
গিয়ে তাকে কিছু খাবার দিয়ে আসল। জন্তুটা মহা খুশি হয়ে এক গ্রাসে আস্ত একখানা
পাঁউরুটি আর প্রায় আধসের গুড় শেষ করে, তার পর পাঁচ-সাতটা
সিদ্ধ ডিম খোলাসুদ্ধ কড়মড়িয়ে খেয়ে ফেলল। একটা টিনে করে গুড় দেওয়া হয়েছিল, সেই টিনটাও সে খাবার মতলব করেছিল, কিন্তু খানিকক্ষণ
চিবিয়ে হঠাত্ বিশ্রী মুখ করে সে কান্নার সুরে গাঁও গাঁও শব্দে বিকট চীত্কার করে
জঙ্গলের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি জন্তুটার নাম দিয়েছি হ্যাংলাথেরিয়াম্।
২৪শে
জুলাই, ১৯২২- বন্দাকুশ পাহাড়ের একুশ মাইল উত্তর। এখানে এত দেখবার
জিনিস আছে, নতুন নতুন এত-সব গাছপালা জীবজন্তু, যে তারই সন্ধান করতে আর নমুনা সংগ্রহ করতে আমাদের সময় কেটে যাচ্ছে।
দুশোরকম পোকা আর প্রজাপতি আর পাঁচশো রকম গাছপালা ফুলফল সংগ্রহ করেছি; আর ছবি যে কত তুলেছি তার সংখ্যাই হয় না। একটা কোনো জ্যান্ত জানোয়ার ধরে
সঙ্গে নেয়ার ইচ্ছা, দেখা যাক কতদূর কি হয়। সেবার যখন কট্ক
টোডন্ আমায় তাড়া করেছিল, তখন সে কথা কেউ বিশ্বাস করে নি।
এবার তাই জলজ্যান্ত প্রমাণ সংগ্রহ করে নিচ্ছি।
আমরা
যখন বন্দাকুশ পাহাড়ে উঠেছিলাম, তখন পাহাড়টা কত উঁচু তা মাপা
হয়নি। সেদিন জরীপের যন্ত্র দিয়ে আমি আর চন্দ্রখাই পাহাড়টাকে মেপে দেখলাম। আমার
হিসেব হল ষোলোহাজার ফুট। কিন্তু চন্দ্রখাই হিসাব করল বেয়াল্লিশহাজার। তাই আজ আবার
সাবধানে দুজনে মিলে মেপে দেখলাম, এবার হল মোটে দু’হাজার সাতশো ফুট। বোধ হয় আমাদের যন্ত্রে কোনো দোষ হয়ে থাকবে! যাহোক এটা
নিশ্চয় যে এপর্যন্ত ঐ পাহাড়ের চুড়োয় আর কেউ ওঠে নি। এ-এক সম্পূর্ণ অজানা দেশ,
কোথাও জন মানুষের চিহ্নমাত্র নাই, নিজেদের
ম্যাপ নিজেরা তৈরি করে পথ চলতে হয়।
আজ
সকালে এক কাণ্ড হয়ে গেছে। লক্কড় সিং একটা গাছে হলদে রঙের ফল ফলেছে দেখে তারই
একটুখানি খেতে গিয়েছিল। এক কামড় খেতেই হঠাত্ হাত-পা খিঁচিয়ে সে আর্তনাদ করে মাটিতে
পড়ে ছট্ফট্ করতে লাগল। তাই দেখে ছক্কড় সিং “ভাইয়া রে, ভাইয়া” বলে কেঁদে অস্থির। যাহোক মিনিট দশেক ঐরকম
হাত-পা ছুঁড়ে লক্কড় সিং একটু ঠাণ্ডা হয়ে উঠে বসল। তখন আমাদের চোখে পড়ল যে একটা
জন্তু কাছেই ঝোপের আড়াল থেকে অত্যন্ত বিরক্ত মতন মুখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তার চেহারা দেখলে মনে হয় যে, সংসারে তার কোনো সুখ নেই,
এ-সব গোলমাল কান্নাকাটি কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। আমি তার নাম
দিয়েছি গোমড়াথেরিয়াম্। এমন খিট্খিটে খুঁতখুঁতে গোমড়া মেজাজের জন্তু আর আমরা
দ্বিতীয় দেখি নি। আমরা তাকে তোয়াজ টোয়াজ করে খাবার দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করেছিলাম।
সে অত্যন্ত বিশ্রী মতো মুখ করে, ফোঁস্ ফোঁস্ ঘোঁত্ ঘোঁত্ করে
অনেক আপত্তি জানিয়ে, আধখানা পাঁউরুটি আর দুটো কলা খেয়ে তার
পর একটুখানি পেয়ারার জেলি মুখে দিতেই এমন চটে গেল যে রেগে সারা গায়ে জেলি আর মাখন
মাখিয়ে আমাদের দিকে পিছন ফিরে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগল।
১৪ই
আগস্ট, বন্দাকুশ পাহাড়ের পঁচিশ মাইল উত্তর- ট্যাপ্ ট্যাপ্ থ্যাপ্
থ্যাপ্ ঝুপ্ ঝাপ্- সকালবেলায় খেতে বসেছি, এমন সময় এইরকম একটা
শব্দ শোনা গেল। একটুখানি উঁকি মেরে দেখি আমাদের তাঁবুর কাছে প্রায় উটপাখির মতন বড়ো
একটা অদ্ভুতরকম পাখি অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কোন দিকে চলবে তার কিছুই
যেন ঠিক-ঠিকানা নেই। ডান পা এদিকে যায় তো বাঁ পা ওদিকে; সামনে
চলবে তো পিছনভাগে চায়, দশ পা না যেতেই পায়ে পায়ে জড়িয়ে হোঁচট
খেয়ে পড়ে। তার বোধ হয় ইচ্ছা ছিল তাঁবুটা ভালো করে দেখে, কিন্তু
হঠাত্ আমায় দেখতে পেয়ে সে এমন ভড়কে গেল যে তক্ষুনি হুমড়ি খেয়ে হুড়্মুড়্ করে পড়ে
গেল। তার পর এক ঠ্যাঙে লাফাতে লাফাতে প্রায় হাত দশেক গিয়ে আবার হেলেদুলে ঘাড়
বাঁকিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। চন্দ্রখাই বলল, “ঠিক হয়েছে,
এইটাকে ধরে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাক।” তখন
সকলের উত্সাহ দেখে কে! আমি ছক্কড় সিংকে বললাম, “তুমি
বন্দুকের আওয়াজ কর, তা হলে পাখিটা নিশ্চয়ই চমকে পড়ে যাবে আর
সেই সুযোগে আমরা চার-পাঁচজন তাকে চেপে ধরব!” ছক্কড় সিং
বন্দুক নিয়ে আওয়াজ করতেই পাখিটা ঠ্যাং মুড়ে মাটির উপর বসে পড়ল, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে ক্যাট্ ক্যাট্ শব্দ করে ভয়ানক জোরে ডানা ঝাপ্টাতে
লাগল। তাই দেখে আমাদের আর এগুতে সাহস হল না। কিন্তু লক্কড় সিং হাজার হোক তেজী লোক,
সে দৌড়ে গিয়ে পাখিটার বুকে ধাঁই করে এক ছাতার বাড়ি বসিয়ে দিল। ছাতার
বাড়ি খেয়ে পাখিটা তত্ক্ষণাত্ দুই পা ফাঁক করে উঠে দাঁড়াল। তার পর লক্কড় সিং-এর
দাড়িতে কামড়ে ধরে তার ঘাড়ের উপর দুই পা দিয়ে ঝুলে পড়ল। ভাইয়ের বিপদ দেখে ছক্কড় সিং
বন্দুকের বাঁট দিয়ে পাখিটার মাথাটা থেঁত্লে দেবার আয়োজন করেছিল। কিন্তু সে আঘাতটা
পাখিটার মাথায় লাগল না, লাগল গিয়ে লক্কড় সিং-এর বুকে। তাতে
পাখিটা ভয় পেয়ে লক্কড় সিংকে ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু দুই ভাইয়ে
এমন মারামারি বেঁধে উঠল যে আমরা ভাবলাম দুটোই এবার মরে বুঝি। দুজনের তেজ কি তখন!
আমি আর দুজন কুলি লক্কড় সিং-এর জামা ধরে টেনে রাখছি, সে
আমাদের সুদ্ধ হিঁচড়ে নিয়ে ভাইয়ের নাকে ঘুষি চালাচ্ছে। চন্দ্রখাই রীতিমতো ভারিক্কে
মানুষ; সে ছক্কড় সিং-এর কোমর ধরে লটকে আছে, ছক্কড় সিং তাইসুদ্ধ মাটি থেকে তিন হাত লাফিয়ে উঠে বন্বন্ করে বন্দুক
ঘোরাচ্ছে। হাজার হোক পাঞ্জাবের লোক কি না। মারামারি থামাতে গিয়ে সেই ফাঁকে পাখিটা
যে কখন পালালো তা আমরা টেরই পেলাম না। যা হোক এই ল্যাগ্ব্যাগ পাখি বা
ল্যাগ-ব্যাগর্নিসের কতকগুলো পালক আর কয়েকটা ফোটোগ্রাফ সংগ্রহ হয়েছিল। তাতেই যথেষ্ট
প্রমাণ হবে।
১লা
সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে- আমাদের সঙ্গের খাবার
ইত্যাদি ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। তরিতরকারি যা ছিল, তা তো আগেই
ফুরিয়েছে। টাটকা জিনিসের মধ্যে সঙ্গে কতগুলো হাঁস আর মুরগী আছে, তারা রোজ কয়েকটা করে ডিম দেয়, তা ছাড়া খালি বিস্কুট,
জ্যাম, টিনের দুধ আর ফল, টিনের মাছ, আর মাংস। এই-সব কয়েক সপ্তাহের মতো আছে,
সুতরাং এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের ফিরতে হবে। আমরা এই সব জিনিস
গুনছি আর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছি, এমন সময় ছক্কড় সিং বলল,
যে লক্কড় সিং ভোরবেলা কোথায় বেরিয়েছে, এখন
পর্যন্ত ফেরে নি। আমরা বললাম, “ব্যস্ত কেন, সে আসবে এখন। যাবে আবার কোথায়?” কিন্তু তার পরেও
দুই-তিন ঘণ্টা গেল অথচ লক্কড় সিং-এর দেখা পাওয়া গেল না। আমরা তাকে খুঁজতে বেরুবার
পরামর্শ করছি, এমন সময় হঠাত্ একটা ঝোপের উপর দিয়ে একটা
প্রকাণ্ড জানোয়ারের মাথা দেখা গেল। মাথাটা উঠছে নামছে আর মাতালের মতো টলছে। দেখেই
আমরা সুড়্সুড়্ করে তাঁবুর আড়ালে পালাতে যাচ্ছি, এমন সময় শুনলাম
লক্কড় সিং চেঁচিয়ে বলছে, “পালিয়ো না, পালিয়ো
না, ও কিছু বলবে না।” তার পরের
মুহূর্তেই দেখি লক্কড় সিং বুক ফুলিয়ে সেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার পাগড়ীর
কাপড় দিয়ে সে ঐ অত বড়ো জানোয়ারটাকে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে
লক্কড় সিং বলল, যে সে সকালবেলায় কুঁজো নিয়ে নদী থেকে জল আনতে
গিয়েছিল। ফিরবার সময় এই জন্তুটার সাথে তার দেখা। তাকে দেখেই জন্তুটা মাটিতে শুয়ে
কোঁ-কোঁ শব্দ করতে লাগল। সে দেখল জন্তুটার পায়ে কাঁটা ফুটেছে আর তাই দিয়ে দর্দর্
করে রক্ত পড়ছে। লক্কড় সিং খুব সাহস করে তার পায়ের কাঁটাটি তুলে, বেশ করে মুছে, নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে দিল। তার পর
জানোয়ারটা তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে দেখে সে তাকে পাগড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমরা
সবাই বললাম, “তা হলে এটা ঐরকম বাঁধাই থাক, দেখি ওটাকে সঙ্গে করে দেশে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।” জন্তুটার
নাম রাখা গেল ল্যাংড়াথেরিয়াম্।
সকালে
তো এই কাণ্ড হল; বিকালবেলা আর এক ফ্যাসাদ উপস্থিত। তখন আমরা
সবেমাত্র তাঁবুতে ফিরেছি। হঠাত্ আমাদের তাঁবুর বেশ কাছেই একটা বিকট চীত্কারের শব্দ
শোনা গেল। অনেকগুলো চিল আর পেঁচা একসঙ্গে চেঁচালে যেরকম আওয়াজ হয়, কতকটা সেইরকম। ল্যাংড়াথেরিয়ামটা ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে একটা গাছের
লম্বা-লম্বা পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছিল; চীত্কার শুনবামাত্র সে,
ঠিক শেয়াল যেমন করে ফেউ ডাকে সেইরকম ধরনের একটা বিকট শব্দ করে,
বাঁধন-টাঁধন ছিঁড়ে, কতক লাফিয়ে কতক দৌড়িয়ে এক
মুহূর্তের মধ্যে গভীর জঙ্গলের ভিতর মিলিয়ে গেল। আমরা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না
পেরে, ভয়ে ভয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে গিয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড জন্তু- সেটা কুমিরও নয়, সাপও নয়,
মাছও নয়, অথচ তিনটারই কিছু আদল আছে- সে এক হাত
মস্ত হাঁ করে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে; আর একটা ছোটো নিরীহ গোছের
কি যেন জানোয়ার হাত-পা এলিয়ে ঠিক তার মুখের সামনে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। আমরা মনে
করলাম, এইবার বেচারাকে খাবে বুঝি, কিন্তু
পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল, কেবল চীৎকারই
চলতে লাগল; খাবার কোনো চেষ্টা দেখা গেল না। লক্কড় সিং বলল,
““আমি ওটাকে গুলি করি।” আমি বললাম, “কাজ নেই, গুলি যদি ঠিকমতো না লাগে, তা হলে জন্তুটা ক্ষেপে গিয়ে কি জানি করে বসবে, তা কে
জানে?” এই বলতে বলতেই ধেড়ে জন্তুটা চীত্কার থামিয়ে সাপের মতো
এঁকেবেঁকে নদীর দিকে চলে গেল। চন্দ্রখাই বলল, “এ জন্তুটার
নাম দেওয়া যাক চিল্লানোসরাস্।” ছক্কড় সিং বলল, “উ বাচ্চাকো নাম দেও, বেচারাথেরিয়াম্।”
৭ই
সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে- নদীর বাঁক ধরে হাঁটতে
হাঁটতে আমরা পাহাড়ের একেবারে শেষ কিনারায় এসে পড়েছি। আর কোনোদিকে এগোবার জো নাই।
দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড়, সোজা দুশো তিনশো হাত নীচে সমতল জমি
পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। যেদিকে তাকাই সেই দিকেই এরকম। নীচের যে সমতল জমি সে একেবারে
মরুভূমির মতো; কোথাও গাছপালা, জনপ্রাণীর
চিহ্নমাত্র নাই। আমরা একেবারে পাহাড়ের কিনারায় ঝুঁকে পড়ে এই-সব দেখছি, এমন সময় আমাদের ঠিক হাত পঞ্চাশেক নীচেই কি যেন ধড়্ফড়্ করে উঠল। দেখলাম বেশ
একটা মাঝারি গোছের তিমি মাছের মতো মস্ত কি একটা জন্তু পাহাড়ের গায়ে আঁকড়ে ধরে
বাদুড়ের মতো মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছে।
তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে এইরকম আরো পাঁচ-সাতটা
জন্তু দেখতে পেলাম। কোনোটা ঘাড় গুঁজে ঘুমাচ্ছে, কোনোটা লম্বা
গলা ঝুলিয়ে দোল খাচ্ছে, আর অনেক দূরে একটা পাহাড়ের ফাটলের
মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে কি যেন খুঁটে খুঁটে বের করে খাচ্ছে। এইরকম দেখছি এমন সময় হঠাত্
কট্ কটাং কট্ শব্দ করে সেই প্রথম জন্তুটা হুড়ুত্ করে ডানা মেলে একেবারে সোজা
আমাদের দিকে উড়ে আসতে লাগল। ভয়ে আমাদের হাত-পাগুলো গুটিয়ে আসতে লাগল; এমন বিপদের সময়ে যে পালানো দরকার, তা পর্যন্ত আমরা
ভুলে গেলাম। জন্তুটা মুহূর্তের মধ্যে একেবারে আমাদের মাথার উপরে এসে পড়ল। তার পর
যে কি হল তা আমার ভালো করে মনে নাই- খালি একটু একটু মনে পড়ে, একটা অসম্ভব বিটকেল গন্ধের সঙ্গে ঝড়ের মতো ডানা ঝাপটানো আর জন্তুটার ভয়ানক
কট্ কটাং আওয়াজ। একটুখানি ডানার ঝাপটা আমার গায়ে লেগেছিল তাতেই আমার দম বেরিয়ে
প্রাণ বের হবার যোগাড় করেছিল। অন্যসকলের অবস্থাও সেইরকম অথবা তার চাইতেও খারাপ।
যখন আমার হুঁশ হল তখন দেখি সকলেরই গা বেয়ে রক্ত পড়ছে। ছক্কড় সিং-এর একটা চোখ ফুলে
প্রায় বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে, লক্কড় সিং-এর বাঁ হাতটা এমন
মচকে গিয়েছে যে সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, আমারও সমস্ত বুকে
পিঠে বেদনা ধরে গিয়েছে; কেবল চন্দ্রখাই এক হাতে রুমাল দিয়ে
কপালের আর ঘাড়ের রক্ত মুছছে, আর-এক হাতে একমুঠো বিস্কুট নিয়ে
খুব মন দিয়ে খাচ্ছে। আমরা তখনই আর বেশি আলোচনা না করে জিনিসপত্র গুটিয়ে বন্দাকুশ
পাহাড়ের দিকে ফিরে চললাম।
[ প্রফেসর হুঁশিয়ারের ডায়েরি এইখানেই শেষ। কিন্তু আমরা আরো খবর জানবার জন্য
তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম। তার উত্তরে তিনি তাঁর ভাগ্নেকে পাঠিয়ে দিয়ে লিখলেন,
“এর কাছেই সব খবর পাবে।” চন্দ্রখাই-এর সঙ্গে
আমাদের যে কথাবার্তা হয় খুব সংক্ষেপে তা হচ্ছে এই-
আমরা।
আপনারা যে-সমস্ত নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন সে-সব কোথায় গেলে দেখতে পাওয়া যায়?
চন্দ্র।
সে-সব হারিয়ে গেছে।
আমরা।
বলেন কি! হারিয়ে গেল? এমন সব জিনিস হারিয়ে ফেললেন!
চন্দ্র।
হ্যাঁ, প্রাণটুকু যে হারায় নি তাই যথেষ্ট। সে-দেশের ঝড় তো আপনারা
দেখেন নি। তার এক-এক ঝাপটায় আমাদের যন্ত্রপাতি, বড়ো-বড়ো
তাঁবু আর নমুনার বাক্স, সব কাগজের মতো হুস্ করে উড়িয়ে নেয়।
আমাকেই তো পাঁচ-সাতবার উড়িয়ে নিয়েছিল। একবার তো ভাবলাম মরেই গেছি। কুকুরটাকে যে
কোথায় উড়িয়ে নিল, সে তো আর খুঁজেই পেলাম না। সে যা বিপদ!
কাঁটা কম্পাস, প্ল্যান ম্যাপ, খাতাপত্র
কিছুই আর বাকি রাখে নি। কি করে যে ফিরলাম, তা শুনলে আপনার ঐ
চুল দাড়ি সব সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠবে। আধপেটা খেয়ে, কোনোদিন
না খেয়ে, আন্দাজে পথ চলে, দুই সপ্তাহের
রাস্তা পার হতে আমাদের পুরো তিনমাস লেগেছিল।
আমরা।
তা হলে আপনাদের প্রমাণ-টমান যা কিছু ছিল সব নষ্ট হয়েছে?
চন্দ্র।
এই তো আমি রয়েছি, মামা রয়েছেন, আবার কি
প্রমাণ চাই, আর এই আপনাদের জন্য কতকগুলো ছবি এঁকে এনেছি;
এতেও অনেকটা প্রমাণ হবে।
আমাদের
ছাপাখানার একটা ছোকরা ঠাট্টা করে বলল, “আপনি কোন থেরিয়াম?”
আর-একজন বলল, “উনি হচ্ছেন গপ্পথেরিয়াম- বসে
বসে গপ্প মারছেন।” শুনে চন্দ্রখাই ভীষণ রেগে আমাদের টেবিল
থেকে একমুঠো চীনেবাদাম আর গোটা আষ্টেক পান উঠিয়ে নিয়ে গজ্গজ্ করতে করতে বেরিয়ে
গেল। ব্যাপার তো এই। এখন তোমরা কেউ যদি আরো জানতে চাও, তা
হলে আমাদের ঠিকানায় প্রফেসর হুঁশিয়ারকে চিঠি লিখলে আমরা তার জবাব আনিয়ে দিতে পারি।
]
সন্দেশ, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য- ১৩৩০
আপলোড: ১/১/২০১৮
আপলোড: ১/১/২০১৮
ধন্যবাদ শিশিরদা । এই গল্পের একটি প্যাস্টিসে বা অনুবর্তী গল্প লিখেছি ম্যাজিক ল্যাম্পের শারদীয়া ২০১৮ সংখ্যায় । আপনাকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করি ।
ReplyDelete