বিট্টু হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল
শিশির
বিশ্বাস
স্কুলে গরমের ছুটি। তারই মধ্যে সেদিন সকালে হঠাৎ বিনুমামার
আগমন। রাজধানী এক্সপ্রেসে সকালেই কলকাতা পৌঁছেছেন। কিছু জরুরি কাজ আছে। সেগুলো
সেরে রাতেই গৌহাটির ট্রেন ধরবেন। তারপর
সেখানে কাজ মিটিয়ে ফিরে যাবেন। শুনে বেজায় মুষড়ে পড়েছিলাম সবাই। কারণ বিনুমামা
মানেই গল্পের ঝুলি। রোমাঞ্চকর সেসব গল্প শুনতে বসলে দম ফেলার অবকাশ থাকে না। আমরা
তাই হাঁ করে থাকি বিনুমামা কবে আসবেন। কিন্তু ব্যস্ত মানুষ তিনি। তাই গল্প শোনার
সময় মেলে সেই রাতে। তাও সারাদিন পরিশ্রমের পর তখন তাঁকে বিরক্ত করতে মায়ের আবার বেজায়
আপত্তি। তবে সেই আপত্তি কানে না তুলে বিনুমামা নিজেই মুখ খোলেন কখনও। মজার কথা হল‚ গল্প শুনতে
মাও বসে পড়েন তখন।
কিন্তু এবার বিনুমামার যা টুর প্রগ্রাম‚
গল্প শোনার সুযোগ নেই। মুষড়ে পড়ারই কথা। কিন্তু বাঁচিয়ে দিল পুপুল। স্নান সেরে
বিনুমামা তখন জলখাবারের প্লেট নিয়ে বসেছেন। দুপুরে আর ফিরবেন না। কাজ সেরে ট্রেন
ধরতে হাওড়া চলে যাবেন। তাই মায়ের ব্যবস্থার ত্রুটি নেই। তারই মধ্যে পুপুল হঠাৎ বলল‚ ‘আজ ওরাং
ন্যাশনাল পার্কের খবরটা পড়েছ মামা?’
পুপুল অবশ্য কথাটা তেমন উদ্দেশ্য নিয়ে পাড়েনি। অল্পদিন আগে
আসাম গিয়েছিলাম। ওরাং ন্যাশনাল পার্ক বেড়াতে গিয়ে খবর পেয়েছিলাম এক বাঘিনীর বাচ্চা
হয়েছে। আমরা দেখতে পাইনি অবশ্য। তবে আগের দিনই অন্য একটা পার্টি দেখে এসেছে। দু’দুটো
বাচ্চা। ওরাংয়ে এমন ঘটনা অনেক দিন পরে। বন-অফিসের সবাই খুব খুশি। আজকের কাগজে‚ সেই ওরাংয়ে
বাচ্চা সহ এক বাঘিনীর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে। বাঘটা নাকি পাশের এক গ্রামে ঢুকে
গরু মেরেছিল। সন্দেহ‚ সেই মড়িতে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে
তাদের। সদ্য ওরাং বেড়িয়ে আসার কারণে খবরটা আমাদের ভাল লাগেনি। পুপুল প্রসঙ্গটা
তুলেছিল সেই কারণে। আর তাতেই যে বিনুমামার গল্পের ঝাঁপি খুলে যাবে ভাবিনি।
বিনুমামার জলখাবারের পর্ব ইতিমধ্যে প্রায় শেষ করে ফেলেছেন।
পুপুলের কথায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সামান্য কী ভাবলেন। তারপর বললেন‚ ‘খবরটা আজ ভোরে
ট্রেনে বসেই কাগজে পড়েছি। ভেরি স্যাড। এভাবে চললে দেশ থেকে এসব বন্যপ্রাণী উধাও
হয়ে যেতে খুব দেরি হবে না। অন্য রাজ্যর
কথা থাক। চোরাগোপ্তা শিকার এই সুন্দরবনেও কী কম? অথচ টাইগার প্রজেক্ট চালু হয়েছে আজ
অনেক দিন হল। বাঘের সংখ্যা কিন্তু বিশেষ বাড়েনি। অথচ এই দেশেই অন্য রকম উদাহরণও
আছে।’
‘কোথায়
মামা?’ শুধু
পুপুল নয়। একসাথে প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছি সবাই। আসলে বিনুমামার মুখ দেখে সবাই তখন
বুঝে গেছি‚ গল্পের শিকে হয়তো ছিঁড়তেও পারে।
অনুমানে ভুল হয়নি। বিনুমামা ফের একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে
বললেন‚ ‘হাতে সময় কিছু আছে। তাই বলেই ফেলি।
১৯০০ সালে গুজরাটের গির অরণ্যে যখন সিংহ শিকার নিষিদ্ধ করা হল‚ তখন জঙ্গলে
টিকে মাত্র গোটা কুড়ির মতো সিংহ। ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা নিলেও গির অরণ্যে সেটা
সুষ্ঠুভাবে চালু করা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। আমাদের সুন্দরবনের জঙ্গলে মানুষ বাস
করে না। তাদের বাস জঙ্গলের বাইরে গ্রামে। কিন্তু গির অরণ্যে ‘মাদারি’ নামে এক
জাতির বাস। ওরা চাষবাস করে না। জঙ্গলে গরু–মোষ চরায়।
দুধ থেকে ঘি–মাখন
তৈরিই তাদের জীবিকা। এহেন জঙ্গলে সিংহ সংরক্ষণ খুব সহজ নয়। ব্রিটিশ আমলে সিংহের
সংখ্যা তাই তেমন বাড়েওনি। ১৯৪৭ সালে মাত্রই পঞ্চাশটির মতো। সিংহ সংরক্ষণের প্রকৃত
কাজটা শুরু হয়েছিল তার অনেক পরে। আর তারই ফলস্বরূপ গির অরণ্যে আজ সিংহের সংখ্যা
বেড়ে পাঁচশোর উপর। এজন্য শুধু বন-দপ্তর নয়‚ সাধারণ মানুষের
অবদানও অনেক।’
বিনুমামা থামলেন। এত তাড়াতাড়ি তাঁর কথা ফুরিয়ে যাবে‚ ভাবতে
পারিনি। এ তো গল্প নয়। স্রেফ শুকনো কিছু তথ্য। হাঁ করে তাকিয়ে আছি। মা বিনুমামার
জন্য চা নিয়ে এলেন। সামনে কাপ নামিয়ে দিয়ে বললেন‚ ‘হ্যাঁরে
বিনু‚ শুনেছি কিছুদিন নাকি সাসান গিরের ওদিকে ছিলি।
সেই গল্প?’
মায়ের সেই কথায় প্রায় হাঁফ ছাড়লাম সবাই। বিনুমামা চায়ের
কাপে চুমুক দিয়ে বললেন‚ ‘হ্যাঁ রে দিদি‚ সেই গল্প।
মাস তিনেক ছিলাম মাত্র। তাতেই যে সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল‚ আমাদের মতো
ভেতো বাঙালির ঘুম ছুটে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।’
‘সে
বছর কয়েক আগের কথা রে।’
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বিনুমামা তাঁর গল্প শুরু করলেন‚ ‘সাসান গিরের
কাছে একটা কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল। নানা জায়গা থেকে মালপত্র আসবে। সেগুলো যথাসময়ে
পৌঁছে দেবার কাজেই যেতে হয়েছিল আমাকে। যথেষ্ট ঝামেলার কাজ। দৌড়ঝাঁপের ব্যাপার। অথচ
একটা গাড়িও দেওয়া হয়নি। ট্রেন‚ নয়তো বাসই ভরসা। আবার যেদিন কাজ নেই‚ ঘরে বসে বোর
হবার জোগাড়। ভাগ্যিস বিট্টু দোশিকে পেয়েছিলাম‚ তাই সময়
কেটে যেত।’
‘বিট্টু
দোশি কে?’ বিনুমামা
অল্প থামতেই পুপুল বলল‚ ‘তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?’
‘খেপেছিস!’ প্রায় চোখ
উলটে বিনুমামা বললেন‚ ‘গুজরাটে দোশিদের কাপড়ের কারবার।
বিট্টুদেরও তাই। জুনাগড় আর আমেদাবাদে বিরাট ব্যবসা ওদের। সবাই সেখানেই থাকেন।
পৈতৃক বাড়ি–ঘর
সামলাতে বিট্টু একাই গ্রামে পড়ে আছে। বছর পনেরো মাত্র বয়স। পড়ে গ্রামেরই স্কুলে।
অত পয়সাওয়ালা বাড়ির ছেলে‚ দেখে কিছুমাত্র বোঝার উপায় নেই। বাড়িতে
কাজের মানুষ আছে। কিন্তু বেশিরভাগ দিন নিজেই রান্না
করে খায়। এছাড়া আছে রামু নামে পোষা বড়সড় একটা কুকুর। তার দেখাশোনা। এই বিট্টুদের
বাড়িতেই ভাড়া ছিলাম আমি। গোড়ায় অবশ্য ভেবে রেখেছিলাম‚ প্রাথমিক
কাজ কিছুটা সামলে নিতে পারলে জুনাগড়ে কোনও হোটেলে গিয়ে উঠবো। বাসে ঘণ্টা তিনেকের
পথ। সপ্তাহে দিন চারেক এলেই হবে। কিন্তু
বিট্টুর জন্য তা আর হয়ে ওঠেনি। ছেলেটাকে
বেজায় ভালও লেগে গিয়েছিল। আমার মতলব টের পেরে একদিন বলল‚ আংকল‚
কেন জুনাগড় যাবে। আমাদের পছন্দ হচ্ছে না?
‘ধরা
পড়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললাম‚ তা নয় রে বিট্টু। আসলে…।
‘বুঝেছি
আংকল‚ খাওয়ার
ব্যাপারে সমস্যা তো?
তেমন ব্যবস্থা এদিকে নেই। তা ওটা আমার উপর ছেড়ে দাও না। আমি তো
রেঁধেই খাই। কিচ্ছু অসুবিধা হবে না।
‘কেন
হোটেলে যেতে চাইছি‚ বুদ্ধিমান ছেলেটার বুঝতে অসুবিধা
হয়নি। যাই হোক জুনাগড়ে তারপর আর যাওয়া হয়নি।
‘যেখানে
থাকতাম‚ গ্রাম হলেও অনেকটাই অন্য রকম। কাঁচা
বাড়ির সঙ্গে পাকা বাড়িও প্রচুর। রয়েছে ইলেক্ট্রিসিটি‚ টেলিফোন
অফিস। বাজার‚ দোকানপাট। তাই কিছুটা শহরের ছোঁয়াও
পাওয়া যায়। কিন্তু অন্য বিপদও যে আছে‚ টের পেয়ে
গেলাম দিন কয়েকের মধ্যেই। সেদিন ঘরেই রয়েছি। বিকেলে বিট্টু স্কুল থেকে ফিরেই বলল‚ চলো আংকল‚ একটা জিনিস
দেখিয়ে নিয়ে আসি।
‘বলল
বটে‚ কিন্তু
বিট্টু তখনই কোনও গরজ দেখাল না। রান্নাঘরে গ্যাস জ্বেলে চাপাটি আর সবজি বানাল। যখন
খেয়ে উঠলাম‚ বেলা পড়তে বিশেষ বাকি নেই। এই অবেলায়
বিট্টু কী দেখাতে নিয়ে যাবে বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে প্রশ্ন করিনি। বিট্টুও
ভাঙেনি। খাওয়া শেষ করে যখন বের হলাম‚ সূর্য তখন
পশ্চিম আকাশে প্রায় দিগন্তের কাছে। বড় গ্রাম।
অনেকটা পথ ভেঙে আমরা একসময় এসে পৌঁছলাম গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে। আশপাশে গাছের
ডালে শকুনের জটলা। কতক মাটিতে বসে। আমাদের দেখে তারা
সরে দাঁড়াল। তারপরেই মাছির ভনভন শব্দে দেখি অদূরে বড় একটা মরা গরু। দুধেল গাই–গরু বলেই
মনে হল। শকুনের দল অনেকটাই খেয়ে ফেলেছে।
‘এই
সন্ধেয় এতটা পথ হেঁটে বিট্টু কেন ভাগাড়ে নিয়ে এল‚ যখন ভাবছি‚ ও
মুচকি হেসে বলল‚ আংকল এটা কিন্তু ভাগাড় নয়।
‘তাহলে
মরা গরু ফেলে গেছে যে! অবাক হয়ে বললাম।
‘গ্রামের
কেউ ফেলে যায়নি আংকল। সিংহের কাজ। সাসান গিরির জঙ্গল খুব
দূরে তো নয়। রাতে মাঝে মধ্যেই শিকারের খোঁজে ওরা গ্রামে চলে আসে। গত রাতেও হানা
দিয়েছিল। গ্রামের এক গোয়াল থেকে দুধেল গরুটাকে মেরে এনে খেয়ে গেছে। ইচ্ছে ছিল
গ্রামের বাইরে টেনে নেবার। কিন্তু সকাল হয়ে যাওয়ার কারণে আর পারেনি।
‘এমন
সহজভাবে বিট্টু কথাগুলো বলল যে‚ হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। অত বড় দুধেল
গরু। বেশ কয়েক হাজার টাকা দাম। হঠাৎ খেয়াল হল‚ এত বড় একটা
ঘটনা রাতে ঘটে গেছে‚ গ্রামে কোনও রকম হইচই শুনিনি। সব
একদম স্বাভাবিক। ঢোঁক গিলে বললাম‚ যার গরু‚ তার তো খুব
ক্ষতি হয়ে গেল বিট্টু!
‘কিচ্ছু
না আংকল।’
হাত নেড়ে আমার আশঙ্কা উড়িয়ে দিল বিট্টু‚ ‘বন-দপ্তর
থেকে লোক এসে সকালেই সব লিখে নিয়ে গেছে। অল্প দিনের মধ্যেই মালিক উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ
পেয়ে যাবেন। এসব নিয়ে কেউ আর এখন ব্যস্ত হয় না। আসলে গির অরণ্যে সিংহের সংখ্যা
বেড়ে যাবার কারণে ওদের খাবারে কিছু টান পড়েছে। মাঝে–মধ্যেই এখন জঙ্গল ছেড়ে গ্রামে হানা
দিচ্ছে। সে যাক আংকল‚ আজ তোমাকে নিয়ে এসেছি একটা দারুণ
দৃশ্য দেখাব বলে।
‘কী
দৃশ্য‚ ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি। বললাম‚ বাকি মাংস
খেতে সিংহের দল আজ রাতেও তাহলে আসছে?
‘একদম
আংকল। আজ শুক্লপক্ষের চাঁদনী রাত। তাই
নিয়ে এসেছি। এসব তো দেখতে পাও না তোমরা।
‘ইতিমধ্যে
অন্ধকার নেমে এসেছে। দ্বাদশীর বড় একটা চাঁদ ঝুলে আছে আকাশে। অল্প বাতাস। বিট্টু
আমাকে নিয়ে অদূরে এক পাথুরে ঢিপিতে গিয়ে উঠল। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি।
ঘণ্টা দুয়েক পরেই দেখি গোটা ছয়েক সিংহের একটা পাল এগিয়ে আসছে মড়ির দিকে। বিট্টু
বাড়িয়ে বলেনি। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে অমন দৃশ্য‚ দারুণ এক
অভিজ্ঞতা বই কী। যাই হোক‚ একটু পরেই সিংহগুলো মড়ির কাছে গিয়ে
আয়েস করে খেতে বসে গেল। নির্জন রাতে এরপর শুধু কড়মড় শব্দ। আর মাঝেমধ্যে মাংসের ভাগ
নিয়ে তাদের চাপা হুঙ্কার। সেই চাপা হুঙ্কারেও নির্জন রাত ভেঙে খানখান হবার জোগাড়।’
‘বাপরে!’ প্রায় আঁতকে
উঠল পুপুল। ‘ওইভাবে
দাঁড়িয়ে দেখলে! ভয় করেনি?
তায় আবার রাত্তির!’
‘ভয়
আবার করেনি!’ বিনুমামা
বললেন‚ ‘ছয় ছয়টা বন্য সিংহের থেকে আমাদের
দূরত্ব বড়জোর বিশ গজ। তবে জানতাম‚ নিতান্ত নরখাদক না হলে বাঘ বা সিংহ
কখনও মানুষ শিকার করে না। তবু স্বীকার করতেই হবে‚ বড় ভরসা জুগিয়েছিল
পাশে দাঁড়ানো বিট্টুর নির্লিপ্ত মুখ।
‘সারাদিন
শকুনের খাঁই মিটিয়ে সামান্য মাংসই অবশিষ্ট ছিল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই সাফ। পরিষ্কার
চাঁদের আলোয় গোটা কয়েক হাড় আর মাথাটা ছাড়া কিছুই আর প্রায় অবশিষ্ট নেই।
‘মুখ
চাটতে চাটতে সিংহের পাল উঠে দাঁড়াল এরপর। আমার আশংকা হচ্ছিল‚ ওই সামান্য
মাংসে অতগুলো সিংহের পেট ভরা মুশকিল। ফের হয়তো গ্রামে হানা দিতে পারে। তেমন হলে এই
রাতে হেঁটে ঘরে ফিরব কী করে? কিন্তু সেই আশঙ্কা সত্যি হয়নি। সিংহের দল ফের জঙ্গলের পথ
ধরতে আমরাও নিশ্চিন্তে ফিরে এসেছিলাম।
‘ফেরার
পথে সেই আশঙ্কার কথা এক ফাঁকে বিট্টুকে বলেওছিলাম। তাতে ও যা জানাল তাতে বুকের
রক্ত প্রায় হিম হবার জোগাড়। ইদানীং তেমন
ঘটনা এদিকে নাকি মাঝেমধ্যেই ঘটছে। সেই কারণে এখন ঘরে ঘরে মোটর বাইক। রাতে বেরুতে
হলে সাধারণত সেই বাহনই ব্যবহার করে সবাই।
‘ওর
কথায় খেয়াল হল‚ বিট্টুর নিজেরও একটা মোটর বাইক আছে।
কিন্তু বেশি দূরের পথ না হলে বড়ো একটা ব্যবহার করতে দেখিনি। আজও তাই! অথচ বাইকটা
আজ ব্যবহার করতেই পারত। সেই কথা বলতে ছেলেটা সামান্য হাসল শুধু। একটু পরে বলল‚ তা ঠিক আংকল। তবে
আমার কিন্তু হাঁটতে বেশ লাগে। আপনার ভাল লাগে না?
‘বিট্টুর
এই কথার কোনও উত্তর সেদিন দিতে পারিনি। তবে এরপর একটু সতর্কই থাকতাম। বিশেষ করে
রাতের দিকে। আগেই বলেছি‚ সপ্তাহে বার তিনেক কাজের জন্য জুনাগড়
যেতে হত। ফিরতে অনেক দিনই রাত হয়ে যেত। বাস থেকে নেমে কিছুটা হাঁটা পথ। খুব বেশি
নয় অবশ্য। তবু বিট্টুকে বলে রেখেছিলাম‚ ফিরতে রাত
হয়ে গেলে ও যেন বাস স্টপেজে থাকার চেষ্টা করে।
‘ছেলেটা
আমার সেই অনুরোধ এরপর ফেলেনি কখনও। আমার ফিরতে দেরি হয়ে গেলে বাস স্টপেজে বসে
থাকত। কোনও দিন ওর কুকুর রামুও সঙ্গে থাকত। অত বড় তাগড়াই চেহারার কুকুর খুব বেশি
আমি দেখিনি। পরে জানতে পেরেছিলাম‚ জুনাগড়ের
নবাবের কুকুর পোষার সখ ছিল। প্রচুর খরচ করে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা জাতের
কুকুর আনাতেন। ব্রিডিংও করাতেন। তারপর দেশ ভাগের পর তিনি হঠাৎই পাকিস্তানে চলে
যান। পোষা কিছু কুকুর তিনি পরিচিত কয়েকজনকে দিয়ে গিয়েছিলেন। রামু তাদেরই কোনও বংশধর।
‘আগেই বলেছি‚ স্কুল আর
পড়ার সময়টুকু বাদ দিলে বিট্টু তার এই কুকুর নিয়েই পড়ে থাকত। ওদের গ্রামে মাংস
পাওয়া যেত না। বস্তুত গুজরাট রাজ্যে মাছ–মাংসর প্রচলন তেমন নেই। রামুর জন্য
সেটা এক সমস্যা ছিল বিট্টুর। যতদিন ছিলাম‚ তাই জুনাগড়
গেলেই এক–দেড়
কেজি খাসির মাংস রামুর জন্য নিয়ে আসতাম।
‘রামুও
বেশ বুঝে গিয়েছিল ব্যাপারটা। আমি জুনাগড়ের দিকে গেলেই ও বুঝে যেত‚ আজ মাংস
আসবে। বিট্টু অবশ্য সন্ধের পর ওকে নিয়ে বড়ো একটা বের হতে চাইত না। একদিন জিজ্ঞাসা
করতে বলেছিল‚ সেদিন তো দেখতেই পেলে‚ এদিকে মাঝে–মধ্যেই এখন
সাসান গির জঙ্গল থেকে সিংহ চলে আসছে। ওরা মানুষকে এড়িয়ে চলে ঠিকই। কিন্তু অন্য
কিছু পেলে নাও ছাড়তে পারে। তাই রাতে রামুকে নিয়ে বের হওয়ায় বিপদ আছে।
‘কিন্তু
ব্যাপার হল‚ আমি জুনাগড়ের দিকে গেলে ফিরতে রাত
হয়ে যেত। সম্ভবত রামু তাতেই বুঝে ফেলত সেদিন আমি জুনাগড়ের দিকে গিয়েছি। বিট্টু আমাকে
আনতে বাস স্টপেজের দিকে রওনা হলেই ডাকাডাকি জুড়ে দিত। বিট্টু তাই ওকে কখনও সঙ্গে
নিয়ে আসত। সেদিনও জুনাগড় যেতে হয়েছিল। বাস থেকে যখন নামলাম‚ রাত প্রায়
নয়টা। দেশের এই পশ্চিম প্রান্তে সূর্যাস্ত হতে কিছু দেরি হয়। সেই হিসেবে রাত নটা
এমন কিছু বেশি রাত নয়। বাস থেকে নেমে দেখি বিট্টু একাই আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
সঙ্গে মোটর বাইক। বরাবর আমাকে নিতে পায়ে হেঁটেই আসে ও। আজ ব্যতিক্রম দেখে একটু
অবাকই হলাম। তবে তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করিনি। বিট্টুও কোনও কথা না বলে আমাকে পিছনে
তুলে বাইকে স্টার্ট দিয়েছিল। কিন্তু বাইক স্টার্ট নিল না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। বার
কয়েক চেষ্টা করেও যখন হল না আমিই বললাম‚ থাক বিট্টু।
হেঁটেই যাই বরং। অল্পই তো পথ।
‘ঘাড়
নেড়ে কিছুটা বিরক্তি ভরা গলায় বিট্টু বলল‚ তাই চলো আংকল।
গন্ধমাদনটাকে এখানেই রেখে যাই বরং।
‘বলল
বটে‚ কিন্তু
তারপরেও বাইকটা মেরামতের জন্য হাজির হল খানিক দূরে এক গ্যারেজে। কিন্তু ফল হল না।
নেহাৎই ছোট গ্যারেজে। যে ছোকরাটি ছিল‚ সামান্য
ঠুকঠুক করে শেষে জানিয়ে দিল‚ হেড মিস্ত্রি খানিক আগে চলে গেছে‚ আজ আর হবে
না।
‘অগত্যা
বাইক সেই গ্যারেজে রেখে দু’জন
হাঁটা পথ ধরলাম। গ্রামের সরু পথ। দু’পাশে গাছপালার ফাঁকে ছড়ানো ছিটানো
বাড়ি–ঘর।
পথে আলোর ব্যবস্থা আছে বটে‚ তবে নামমাত্র। তাতে অন্ধকার দূর হয়েছে
সামান্যই। আকাশে চাঁদও নেই আজ। অবশ্য সেজন্য খুব যে সমস্যা হচ্ছিল‚ এমন নয়।
চেনা পথ। তবু আজ যেন কিছু অন্য রকম। বড্ড নির্জন। গ্রামের পথ হলেও এই রাতে পথে দু’চারজন মানুষ
থাকেই। আজ শুনশান।
‘অর্ধেক পথ তখন চলে এসেছি। বিট্টু হঠাৎ বলল‚ আংকল‚ কাণ্ড দেখেছ! রামুকে আজ আনিনি। কী করে শিকল খুলে চলে এসেছে আমাদের খোঁজে!
‘অর্ধেক পথ তখন চলে এসেছি। বিট্টু হঠাৎ বলল‚ আংকল‚ কাণ্ড দেখেছ! রামুকে আজ আনিনি। কী করে শিকল খুলে চলে এসেছে আমাদের খোঁজে!
‘তাকিয়ে
দেখি‚ অন্ধকারে
আমাদের পিছনে রামু। নিঃশব্দে কখন হাজির হয়েছে‚ একেবারেই
টের পাইনি। রামুকে দেখে একটু অবাকই হলাম। বিট্টু বাড়িতে না থাকলে ওকে সাধারণত ঘরেই
আটকে রেখে যায়। সেই রামু কী করে শিকল খুলে চলে এলো‚ বুঝে উঠতে
পারলাম না। সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। বিট্টু হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল‚ আংকল‚ রামুর বেজায়
খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে। মাংসটা ওকে দিয়েই দাও বরং।
‘রামুর
জন্য আজও জুনাগড় থেকে ফেরার সময় কেজি দেড়েক মাংস নিয়ে এসেছিলাম। প্যাকেটটা আমার
হাতেই ছিল। আগেই বলেছি‚ এই সময় অনেক দিনই রামু আমাদের সঙ্গে
থাকে। হাতে মাংসের প্যাকেট থাকলেও বিট্টু কোনও দিনই এমন অনুরোধ করেনি। সেই কথাই
বলতে যাব‚ কিন্তু বিট্টু তার আগেই প্রায় ছোঁ মেরে
আমার হাত থেকে কাগজে মোড়া মাংসের প্যাকেটটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল পিছনে
রামুর উদ্দেশে। অন্ধকারে রামুকেও দেখলাম ছুটে গিয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল
প্যাকেটটার উপর।
‘বিট্টু
অবশ্য দেরি করল না। আমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে বলল‚ আংকল‚ রামুর জন্য
দেরি করার দরকার নেই। খাওয়া হলে নিজেই চলে আসবে।’
বিনুমামা থামলেন। একসাথে সবাই প্রায় হইহই করে উঠলাম‚ ‘তারপর বাড়ি
গিয়ে দেখলে‚ বিট্টু দোশির রামু যথাস্থানে রয়েছে।
পথে যাকে দেখেছিলে সে অন্য কেউ। বাপরে কী ভয়ানক!’
‘ঘর
পর্যন্ত আর যেতে হয়নি রে।’
বিনুমামা অল্প হাসলেন। ‘বিট্টু আমার হাত ধরে ওইভাবে টানতে
দেখেই বুঝে ফেলেছিলাম ব্যাপারটা। দেরি না করে দ্রুত পা চালিয়েছিলাম তারপর। প্রায়
এক ছুটে ঘরে। আসলে সেদিন বিকেলেই খবরটা ছড়িয়ে গিয়েছিল‚ গ্রামের পথে
দল ছাড়া এক সিংহের দেখা পাওয়া গেছে। খবর পেয়ে বন-দপ্তর থেকে গাড়ি নিয়ে লোকজনও
এসেছিল। কিন্তু খুঁজে না পেয়ে ভেবেছিল‚ জঙ্গলে ফিরে
গেছে আবার। চলে গিয়েছিল তারা। দল ছাড়া এসব সিংহ কখনও একটু বিপজ্জনক। খাবারের
খোঁজেই চলে আসে ওরা। এ ব্যাপারে পুরনো অভিজ্ঞতা থাকায় গ্রামের সবাই অবশ্য সতর্কই
ছিল। বিট্টু সেই কারণেই সেদিন আমাকে আনতে বাইক নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য‚ বাইক হঠাৎ
খারাপ হয়ে যাওয়ায় কাজে আসেনি। শুনে ঘাবড়ে যেতে পারি ভেবে বিট্টুও ভাঙেনি আমার কাছে।
কিন্তু অন্ধকার পথে খানিক আসতে যখন টের পেল‚ সিংহটা পিছু
নিয়েছে। সম্ভবত আমার হাতে মাংসের প্যাকেটটাই তার লক্ষ্য। তখন আর দেরি করেনি।
বিট্টুর মতো অমন দুঃসাহসী ছেলে খুব বেশি দেখিনি।’
আপলোড: ১০/১/২০১৮
দারুন রোমাঞ্চকর গল্পটা
ReplyDeletebapre! bejay sahos
ReplyDeleteDarun galpo! Jaegata jeno chokher samne dekhte pachhilam!
ReplyDelete