পাইলটবাবার পাথর
শিশির বিশ্বাস
দেহাতি ছেলেটা মাঠ থেকে এক পাল ছাগল নিয়ে
ফিরছিল। সারা গায়ে ধুলো। লিকলিকে
শরীর। হাত–পা আরও সরু। প্রায় কাঠির মতো। মনে হয়
ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। ন্যাড়ামাথায় কষে প্যাঁচানো বড় এক গামছা। কাছে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়ল
হঠাৎ। বড় বড় চোখে হাঁ করে তাকিয়ে
রইল আমার মুখের দিকে। তাতে বরং সুবিধাই হয়েছিল। সেই থেকে ফাঁকা রাস্তায়
ঘুরে মরছি। তবু একটা মানুষের দেখা
মিলল।
আসলে বিকেল পড়ে আসছে তখন। ধু–ধু ফাঁকা মাঠের প্রান্তে সূর্য প্রায় দিগন্ত ছুঁতে চলেছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে
দুবরাজপুরে মামা–ভাগ্নে পাহাড়ে আসা সেটাই
বাকি। অথচ পৌঁছেছি প্রায় ঘণ্টা
দুয়েক হল। ছবিও নেহাত কম তোলা হয়নি। সঙ্গে ডিজিটাল ক্যামেরার
চিপ প্রায় ভরতি। কিন্তু আসল ছবিটাই যে তোলা
হয়নি।
মামা–ভাগ্নে পাহাড়ে যারা এসেছেন‚ তাঁরা জানেন ক্যামেরায়
তোলার মতো লোভনীয় দৃশ্যের অভাব নেই এখানে। জঙ্গল আর গাছপালার ফাঁকে প্রায় এক–দেড় কিলো মিটার জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শুধু বড় বড় গ্রানাইট পাথরের বোল্ডার। তার কোনোটা মাত্র দুই–তিন ফুট উঁচু। আবার কোনোটা বিশ–পঁচিশ ফুট পর্যন্ত। ওজন হাজার টন বা তারও বেশি। মসৃণ বোল্ডারগুলো কোথাও
একটার উপর আর একটা এমনভাবে সাজানো যে‚ বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই।
কেউ যেন অনেক হিসেব কষে নিখুঁত ইঞ্জিনিয়ারিং
দক্ষতায় বোল্ডারগুলোকে একটির উপর আর একটি সাজিয়ে রেখেছে। কতক বোল্ডার তো দাঁড়িয়ে
আছে সামান্য কয়েক ইঞ্চি বেসের উপর। মনে হয় এখনই হয়তো উলটে পড়বে। কিন্তু স্মরণাতীত কাল থেকে
বোল্ডারগুলি তেমনই রয়েছে। সামান্য মাত্র স্থানচ্যুত হয়নি। দুটি বোল্ডারের ফাঁকে
দিব্যি গজিয়ে উঠেছে গাছপালা। তার কতক যথেষ্টই পুরোনো। অগত্যা নানা জনশ্রুতি এই
বোল্ডারগুলিকে নিয়ে। কেউ বলেন‚ রামেশ্বরমে সেতু তৈরির সময়
রামচন্দ্রের বানর সেনার দল যখন হিমালয় থেকে রাশি রাশি পাথর উড়ন্ত রথে আকাশপথে নিয়ে
যাচ্ছিল‚ অসাবধানতায় তাদের কোনও একটা এখানে সামান্য কাত হয়ে গিয়েছিল। বোল্ডারগুলি তখনই পড়ে যায়। আর এক জনশ্রুতি‚ মহাদেবের জন্য বিশ্বকর্মা
এখানে এক রাতের মধ্যে দ্বিতীয় এক কাশীধাম নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তার আগেই ভোর হয়ে যাওয়ায়
অর্ধ সমাপ্ত রয়ে যায়। মহাদেব এখানে পাহাড়েশ্বর। তাঁর মূর্তিও অর্ধসমাপ্ত। পাহাড়েশ্বর মন্দিরে
সিঁদুরমাখা সুবিশাল এক অর্ধগোলকাকৃতি বোল্ডার এখানে নিয়মিত পুজো করা হয়।
বিজ্ঞানের ছাত্র অবশ্য বলবেন অন্য কথা। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বাংলার এই
অংশে লাল মাটির আধিক্য দেখে বোঝা যায় একসময় এদিকেও কিছু পাহাড় ছিল। লোহার আকরিক সমৃদ্ধ সেই
পাহাড় জল–বাতাসের প্রভাবে ক্রমে
ক্ষয়ে মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে। ব্যতিক্রম এই দুবরাজপুর। এখানেও উটের কুজের মতো এক
পাহাড় ছিল। কিন্তু কঠিন গ্রানাইটের
ভাগ বেশি হওয়ার কারণে এখনো সম্পূর্ণ ক্ষয় হতে পারেনি। অপেক্ষাকৃত নরম অংশ গুঁড়ো হয়ে মাটিতে মিশে
গেলেও কঠিন গ্রানাইট অংশের কিছু এখনো বোল্ডার আকারে রয়ে গেছে। কয়েক লক্ষ বা কোটি বছর পরে
ক্ষয় হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এগুলিও।
সে যাই হোক‚ ছড়িয়ে থাকা সেই বোল্ডারের
ফাঁকে এখন জঙ্গল ঘেরা উঁচু–নিচু পথ। পাখির ডাকে বুঁদ হয়ে
ছায়াঘেরা সেই পথে চলতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই থেমে যায় পদযুগল। হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয়
সেই অদ্ভুত আকৃতির সাজানো বোল্ডারগুলির দিকে। অজান্তেই ক্যামেরায় হাত চলে যায়। অগত্যা ছবি কম তোলা হয়নি। কিন্তু আসল কাজটাই যে বাকি
রয়ে গেছে মনেও পড়েনি তখন। তারই মধ্যে হঠাৎ দেখা পাইলটবাবার সঙ্গে।
গাছপালায় ঘেরা মস্ত এক বোল্ডারের আড়ালে পাতায়
ছাওয়া ছোট এক চালা দেখে তাকিয়েছিলাম। পিছনে বোল্ডারের দেওয়াল থাকলেও বাকি তিনদিক
খোলা। ধুনির সামনে রোগা চিমড়ে
শরীর ন্যাড়ামাথা এক সাধু নিবিষ্ট মনে গাঁজা টানছেন। হঠাৎ তাকালে শরীর নয়‚ ঢাউস আকারের মাথাটাই নজরে পড়ে আগে। পিছনে বোল্ডারের দেওয়ালে
সিঁদুর দিয়ে লেখা ‘পাইলটবাবার আখড়া’। সেদিকে চোখে পড়তে প্রায়
চমকে উঠেছিলাম। অচিন্ত্যর কথা মনে পড়ে
গিয়েছিল। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে
অচিন্ত্য বরাবরই কিছু আলাদা। স্কুল‚ তারপর কলেজে সেরা ছাত্র ছিল। এখন এক মাল্টি ন্যাশনাল
কোম্পানির মস্ত চাকুরে। সেই অচিন্ত্য বছর কয়েক আগে দুবরাজপুর বেড়াতে
এসে এই পাইলটবাবার দেখা পেয়েছিল।
ফিরে গিয়ে গল্প করেছিল আমাদের কাছে। বলা যায় অচিন্ত্যর মতো
মানুষকেও সেদিন পেড়ে ফেলেছিলেন পাইলটবাবা। নির্জন দুপুরে অনেকটা সময় দুই জানে কথা
হয়েছিল। দুবরাজপুরের এই মামা–ভাগ্নে পাহাড় নিয়ে এই পাইলটবাবাই সেদিন অন্য এক গল্প শুনিয়েছিলেন। অদ্ভুত সেই গল্পটা
অচিন্ত্যর মুখে আমরাও একাধিক বার শুনেছি। সে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। স্বর্গ থেকে দেবতারা মস্ত
এক পুষ্পক রথে চড়ে মর্তে এই দুবরাজপুরের কাছে নামছিলেন। হিসেবে কিছু গোলমাল হয়ে
যাওয়ার কারণে দেবতাদের সেই পুষ্পকরথ ভেঙে পড়েছিল দুবরাজপুরে পাহাড়ের উপর। ভয়ানক সেই সংঘর্ষে শুধু
রথই নয়‚ পাহাড়টাও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ধুলো আর ধোঁয়া থিতু হতে
লেগেছিল কয়েক দিন। তবে পুষ্পকরথের দেবতারা
বিপদ আঁচ করে সময়মত বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বিপদ ঘটার
আগেই। অনেক পরে তাঁদের উদ্ধার
করতে অন্য পুষ্পক রথ পাঠানো হয়েছিল। তবে দূরে ছিটকে পড়ায় সবার খোঁজ মেলেনি।
বলা বাহুল্য‚ অদ্ভূত সেই গল্প আমরা
গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিলেও পাইলটবাবার টানে অচিন্ত্য তার পরেও দুবরাজপুরে বার কয়েক
ছুটে এসেছে। কিন্তু দেখা হয়নি একবারও। প্রতিবারই নিরাশ হয়ে ফিরতে
হয়েছে। আফসোস রয়েই গেছে তাই। অচিন্ত্যর বিশ্বাস‚ পাইলটবাবা আর পাঁচটা সাধুর
মতো নয়। সত্যিকারের জ্ঞানী পুরুষ। শুধু তাই নয়‚ প্রচুর লেখাপড়াও হয়তো
করেছেন। তারপর সব ছেড়ে দিয়ে
সন্ন্যাসী। সেই পাইলটবাবা আমার চোখের
সামনে! অচিন্ত্য যেমন বলেছিল‚ সেই রোগা–পাতলা চেহারা। নিপাট টাকপড়া মস্ত মাথা। একগাছি চুলও অবশিষ্ট নেই। সারা গায়ে ধুনির ভস্ম।
মানুষটাকে দেখার পর আর না এগিয়ে পারিনি। অন্তত অচিন্ত্যকে তো বলতে
পারা যাবে। সামনে গিয়ে বসে পড়েছিলাম
এরপর। বোধ হয় মিনিট দুইও যায়নি। পাইলটবাবা চোখ মেললেন হঠাৎ। গাঁজার কল্কে নামিয়ে গুম
হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন‚ ‘সে কীরে! এই বয়সে মাথায় এমন টাক
পড়িয়ে ফেলেছিস!’
বাপ–ঠাকুরদার মাথা জোড়া টাক। আমিও ব্যতিক্রম নই। চল্লিশ পার হাবার আগেই
মাথা প্রায় সাফ। বড় এক পানামা হ্যাট তাই
নিত্য সঙ্গী। তবু পাইলটবাবার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়নি। হেসে বললাম‚ ‘সে তো দেখছি আপনারও পাইলটবাবা।’
উনি অবশ্য সেই প্রসঙ্গে কিছু আর বললেন না। মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে
থেকে হঠাৎ বললেন‚ ‘তুই তো সেই অচিন্ত্য
ছোকরার বন্ধু! তা এখানে কেন রে? ভেগে পড়।’
বলা বাহুল্য‚ পাইলটবাবার সেই কথায় মুখ দিয়ে কথা সরল না। বেশ জানি‚ অচিন্ত্যর সঙ্গে পাইলটবাবার দেখা হয়েছিল
অন্তত এগারো বছর আগে। এত দিন আগের কথা বেশ মনে আছে মানুষটার। তার থেকেও বড় কথা‚ আমি যে ওর বন্ধু জেনে
ফেলেছে সেটাও। মানুষটি যে সাধারণ নয়‚ বুঝতে বাকি নেই তখন। সাধে অচিন্ত্যর মতো ছেলে
এতবার ছুটে আসে! হতবুদ্ধি অবস্থা কাটতে তাই
সময় লাগল। কিন্তু কথা বলব কার সঙ্গে? ইতিমধ্যে গাঁজায় দম দিয়ে মানুষটা ফের থম হয়ে গেছেন। বাহ্যজ্ঞান আছে বলে মনে হয়
না। অগত্যা কখন ফের চোখ মেলে
চাইবেন সেই অপেক্ষায় বসে রইলাম।
পাইলটবাবার ধ্যান ভাঙল প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পরে। আমি কথা বলার আগেই লাল চোখ
দুটো আমার উপর সামান্য বুলিয়ে নিয়ে প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন‚ ‘তুই এখনও এখানে বসে আছিস! চলে যেতে বলেছিলাম না!’
থতমত খেয়ে জবাব দিতে যাচ্ছিলাম। উনি ফের খরখরে গলায় বললেন‚ ‘অন্ধকার হয়ে আসছে বাপু। কী এক ছবি তুলতে এসেছিলি‚ সে খেয়াল আছে তো?’
পাইলটবাবার কথায় প্রায় চমকে উঠলাম এরপর। সত্যিই ইতিমধ্যে সূর্য কখন
যে দিগন্ত ছুঁতে চলেছে‚ আলো কমে এসেছে অনেক‚ একেবারেই খেয়াল করিনি। প্রায় ধড়মড়িয়ে উঠলাম।
পাইলটবাবা একবিন্দু ভুল বলেননি। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আজ এখানে আসা‚ সেই কাজটাই যে বাকি রয়ে
গেছে!
অনেক দিন আগে স্কুলে পড়ি তখন। খ্যাতনামা এক পরিচালকের
একটা বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম। তাতে একটা দৃশ্য ছিল। আলো পড়ে আসছে‚ ধুধু প্রান্তরের মাঝে এক
সড়কের অদূরে ভাঙাচোরা বোল্ডারের এক পাহাড়। তার মাথায় দাঁড়িয়ে দুটো তালগাছ। অসাধারণ দৃশ্যটা মনের ভিতর
গেঁথে গিয়েছিল। দৃশ্যটা যে দুবরাজপুরের এই
মামা–ভাগ্নে পাহাড়ের‚ জানা ছিল না তখন। পরে যখন জানতে পেরেছিলাম‚ খুব ইচ্ছে হয়েছিল ওই
দৃশ্যটা চর্মচোখে একবার দেখব।
তারপর নিজেই জড়িয়ে পড়লাম ফোটোগ্রফির লাইনে।
তারই কিছু কাজে এসেছিলাম শান্তিনিকেতন। আজ একফাঁকে সময় করে ছুটে এসেছি দুবরাজপুরে
এই মামা–ভাগ্নে পাহাড়ে।
ভেবেছিলাম দৃশ্যটা সহজেই পেয়ে পাব। কিন্তু ইতিমধ্যে পরিবেশ যে
পালটে যেতে পারে একবারও ভাবিনি। চারপাশে নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে। রাস্তা থেকে জোড়া তালগাছ
সহ কিছুতেই সেই দৃশ্যটা চোখে ধরা দিচ্ছিল না। অথচ বোল্ডারের মাথায় সেই জোড়া তালগাছ‚ সেই পাহাড় সবই রয়েছে। কিন্তু সেই ভিউটাই আসছে না। চারপাশে নতুন নতুন ঘরবাড়ি
ওঠায় রাস্তা থেকে সেই দৃশ্য প্রায় হারিয়ে গেছে এখন। নিরাশ হলেও হাল ছাড়িনি অবশ্য। হাতে সময়ও রয়েছে। তা ছাড়া ক্যামেরায় তোলার
মতো অন্য দৃশ্যর তো অভাবে নেই। তাই নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম তখন। তারপর অনেকটা সময়
পাইলটবাবার আখড়ায়। এদিকে বিকেলের আলো যে ক্রমে কমে আসছে‚ একেবারেই খেয়াল করিনি। হাতে সময় খুবই কম। সন্ধের আগেই পছন্দের ভিউটা
পাওয়া দরকার।
পাইলটবাবার ঠেক থেকে বেরিয়ে তাই প্রায় পাগলের
মতো ঘুরছিলাম। শেষ বিকেল। পথে মানুষজন কম। তবু বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা
করা হল। কিন্তু লাভ হল না। সবাই প্রায় দেহাতি মানুষ। ব্যাপারটা বোঝানো একেবারেই
সহজ নয়। দু’একজন মাথা নেড়ে পথ বাতলালেও সেদিকে গিয়ে কোনও সুরাহা হল না। বরং এইভাবে দৌড়ঝাঁপ করতে
গিয়ে একটু পরেই বুঝলাম‚ আরও বেয়াড়া জায়গায় চলে
এসেছি। ঘরবাড়ির আড়ালে তালগাছ
দুটোও ঢাকা পড়ে গেছে। এদিকে আলো কমে আসতে শুরু করেছে। কমে আসছে পথে মানুষজনও।
রোগা দেহাতি ছেলেটার সঙ্গে দেখা সেই সময়। গোড়াতেই বলেছি মাঠে ছাগল
চরিয়ে দিনশেষে ঘরে ফিরছিল ছেলেটা। বয়স বছর পনেরোর বেশি নয়। এমন একজনের কাছে সমস্যার
কথা জানানো যখন পণ্ডশ্রম হবে কিনা ভাবছি‚ ছেলেটা হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে
পড়ল। অগত্যা মনস্থির করে সমস্যার কথা বলেই ফেললাম তাকে। উদোম গায়ে রোগা হালকা-পাতলা ছেলেটা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। আমি থামতেই বলল‚ ‘স্যার তাহলে এখানে ছবি তোলার কাজ করছেন! আমরা এদিকে খুঁজেই যাচ্ছি!’
বলা বাহুল্য‚ ছেলেটির সেই কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে
পারলাম না। হাঁ করে তাকিয়ে আছি। ছেলেটি বলল‚ ‘ছবি নিয়ে ভাববেন না স্যার। পুরো পাহাড়টা চাই
তো। সেই সিনেমার মতো। মাথায় জোড়া তালগাছ। বিলকুল পেয়ে যাবেন। চলুন আমার সঙ্গে।’
‘একদম‚ একদম ভাই।’ উৎসাহে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম।
ছেলেটি এরপর দেরি করল না। ছাগলের পাল পথে
দাঁড় করিয়ে রেখে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ছোট এক মাঠ পার হয়ে গাছপালার হালকা এক জঙ্গলে
ঢুকে পড়ল। নিতান্তই অপরিচিত জায়গা। ছেলেটা কোথায় নিয়ে চলেছে
ভেবে গোড়ায় কিছু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু গোটা কয়েক ছোটবড় মাটির ঢিপি‚ বোল্ডার টপকে আসতেই চোখের
সামনে পাহাড়ের অনেকটা ধরা দিতে কিছুটা যেন ভরসা পেলাম। একটু পরে পাহাড়ের মাথায় জোড়া তালগাছ দুটোও
নজরে পড়ল। ধ্যানগম্ভীর হয়ে পাশাপাশি
দাঁড়িয়ে আছে। একটি কিছু বড়। অন্যটা ছোট। স্থানীয় অনেকে এদেরই মামা–ভাগ্নে বলে। কেউ আবার গাছ দুটোর অদূরে
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বোল্ডার দুটিকেও বলে মামা–ভাগ্নে। ছেলেটা আমাকে নিয়ে এরপর
উঁচু এক পাহাড়ি ঢিপির উপর উঠে এল। ‘এবার দেখুন তো স্যার‚ ভিউটা ঠিকমতো পাচ্ছেন
কিনা?’
সত্যি‚ এত ভাল ভিউ আগে পাইনি। যদিও স্মৃতির কোঠায় জামে
থাকা সেই ছবির মতো নয়। তবু সময় নষ্ট না করে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে‚ অ্যাপারচার পালটে পর পর
ছবি নিচ্ছিলাম। কোনও দিকেই হুঁশ ছিল না। হঠাৎ খেয়াল হল‚ আমাদের ডান দিকে খানিক
উঁচুতে প্রায় গোল বিশাল একটা বোল্ডার পাহাড়ের ঢালে অদ্ভুত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মামা–ভাগ্নে পাহাড়ে অনেক বোল্ডারকেই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তাদের কোনটাই এমন
নিরেট গোলাকৃতি নয়। একটু অবাক হয়েই পাশে ছেলেটাকে বললাম‚ ‘দারুণ তো বোল্ডারটা! নিরেট গোল!’
‘গোল তো হবেই। ওটা যে পাইলটবাবার পাথর।’ চট জলদি উত্তর এল।
‘পাইলটবাবার পাথর!’ অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম এরপর। সামান্য অপ্রতিভ গলায়
ছেলেটি বলল‚ ‘ত–তাইতো বলে সবাই। এক কাজ করবেন স্যার? পাইলটবাবার ওই পাথরের উপরে উঠলে কিন্তু আরও ভাল ভিউ পাবেন।’
কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু ফুট বিশেক উঁচু ওই মসৃণ প্রায়
গোলাকৃতি বোল্ডারের উপর ওঠা অসম্ভব ব্যাপার। লম্বা মই দিয়ে হয়তো ওঠা যায়। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা সহজ
নয়। সেই কথাই বললাম তাকে। ছেলেটি কিন্তু দমল না। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল‚ ‘সে জন্য ভাববেন না স্যার। বলেন তো আমি তুলেও নিতে পারি।’
ওই হালকা পাতলা ছেলেটার পক্ষে কী ভাবে তা
সম্ভব যখন ভাবছি‚ ছেলেটি প্রায় তড়বড়িয়ে সেই বোল্ডারের উপর উঠে পড়ল। ছাগল বাঁধার এক গোছা দড়ি
কাঁধে ঝোলানো ছিল‚ সেটা নামিয়ে দিয়ে বলল‚ ‘দড়িটা ধরুন স্যার। আমি টেনে তুলে নিচ্ছি।’
প্রায় স্পাইডার ম্যানের কায়দায় ছেলেটাকে
বোল্ডারের উপরে চড়ে বসতে দেখে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। সে ফের তাগাদা লাগাল‚ ‘দড়িটা ধরুন স্যার।’
প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাতটা বাড়িয়ে দিতে
যাচ্ছি। পিছন থেকে কে চেঁচিয়ে উঠল‚ ‘হেই‚ ও কাকে তুলছিস রে হতভাগা! চোখের মাথা খেয়েছিস?’
পাথরের উপরে ছেলেটি চমকে উঠল সেই কথায়। মস্ত জিব কেটে হাতের দড়ি
ফেলে মুহূর্তে সেই বোল্ডারের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পিছনে সেই কণ্ঠস্বরে শুধু ছেলেটি নয়‚ চমকে উঠেছিলাম আমিও। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি অনুমান সঠিক। স্বয়ং পাইলটবাবা। কিন্তু এবার মানুষটির দিকে
তাকিয়ে প্রায় শিউরে উঠলাম আমি। পাইলটবাবা আর একটু আগের দেহাতি ছেলেটি‚ দু’জনের প্রায় একই রকম চেহারা। সেই লিকলিকে চিমড়ে শরীর। একই রকম ঢাউস ন্যাড়া মাথা। মাথায় গামছা প্যাঁচানো
থাকায় ছেলেটির ন্যাড়া মাথা চট করে নজরে পড়ে না‚ এই যা। একজনের গায়ে ধুনির ভস্ম‚ অন্যজনের গায়ে মেঠো ধুলো। চামড়ায় শ্বেতির মতো অদ্ভুত
সাদা রং তাতে সম্পূর্ণ ঢাকা দেওয়া যায়নি। দাড়ি–গোঁফের জঙ্গলে পাইলটবাবার মুখের অনেকটা ঢাকা পড়ে গেলেও দু’জনের মুখের আদলেও যেন ফারাক নেই বিশেষ। ওই সময় হঠাৎ খেয়াল হল‚ মাঠে গরু–ছাগল চরানো
ছেলেটার কথা একেবারেই দেহাতি মানুষের মতো নয়। রীতিমতো লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মানুষ।
‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস
এখনও! মাথাজোড়া তোর ওই টাক দেখে তখনই সরে পড়তে বলেছিলাম। কানে তুলিসনি! ওদিকে আমার
সাগরেদরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে! আজই শেষ দিন। তোর কপাল ভাল‚ সময়মতো এসে পড়েছিলাম। তাই বেঁচে গেলি। ভ্যাবা গঙ্গারাম কোথাকার!’ খরখরে চোখে এক ঝলক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে পাইলটবাবা এরপর একই
কায়দায় উঠে পড়লেন সেই বোল্ডারের উপর। তারপর ছেলেটির মতোই পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বিশাল বোল্ডারটা এরপরেই
কেমন দুলতে শুরু করল। দেখে আর দাঁড়াইনি তারপর। প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে
শুরু করেছি। তার একটু পরেই পিছনে কড়–কড়াৎ করে ভয়ানক বাজ পড়ার শব্দ। জোরাল বাতাস। মুহূর্তে ধুলোয় চারপাশ প্রায় অন্ধকার। অগত্যা দাঁড়িয়ে পড়তেই হল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি
আকাশে মস্ত এক আগুনের গোলা। দেখতে দেখতে সেটা মিলিয়ে গেল শূন্যে। হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। ইতিমধ্যে বাতাসের বেগ
অনেকটাই কমেছে। চারপাশ কিছুটা পরিষ্কার
হতে অনেকক্ষণ নজর করেও গোলাকার বিশাল সেই বোল্ডারটা যথাস্থানে দেখতে পেলাম না। অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ছোট শহর দুবরাজপুর। জানতাম‚ অযথা দেরি করলে পরে ফিরতে
সমস্যা হতে পারে। তাই বাস পেতেই উঠে
বসেছিলাম। লজে ঢুকতেই রিসেপশনের
ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে বলল‚ ‘স্যার আজ দুবরাজপুর গিয়েছিলেন না? শুনেছেন কিছু।’
বুঝতে পারছিলাম দুবরাজপুরে উড়ন্ত চাকি বা
ফ্লাইং সসারের কথা ইতিমধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। তবু জবাব না দিয়ে তাকিয়ে আছি। ছেলেটি বলল‚ ‘স্যার‚ একটু আগে টিভির খবরে জানাল‚ বাজ পড়ে দুবরাজপুর মামা–ভাগ্নে পাহাড়ের জোড়া তালগাছের বড় গাছটা আজ জ্বলে গেছে হঠাৎ।’
আগুনের গোলায় বড় তালগাছটা যে জ্বলে গেছে‚ একেবারেই খেয়াল করিনি তখন। সেই অবস্থাও ছিল না। থতমত
খেয়ে বললাম‚ ‘সে কী‚ জ্বলে গেছে গাছটা! বাজ পড়ে! খবরে আর কিছু বলেনি?’
‘না তো! তবে খবর শুনে এদিকে সবার খুব আপশোশ‚ পাহাড়ের মাথায় জোড়া তালগাছ আর দেখতে পাবে না
কেউ! এছাড়া আর কিছু হয়েছে নাকি স্যার?’
হয়েছে তো অবশ্যই। নিজের চোখেই দেখেছি। কিন্তু বেশ জানি‚ সে কথা বিশ্বাস করবে না
কেউ। তাই চুপ করে রইলাম। বলা হল না‚ পাহাড়ের মাথায় জোড়া তালগাছের শেষ ছবিটা বোধ
হয় আমিই তুলে রাখতে পেরেছি।
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
আপলোড: ৩০/৯/২০১৮
প্রথম প্রকাশ: ‘দোলনা’ ১৪২৪
শারদীয়া সংখ্যা
অসাধারন। আপনার লেখাগুলো পড়ি আর অন্য জগতে হারিয়ে যাই।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
DeleteOsadharon.
ReplyDeleteদুর্দান্ত।
ReplyDelete