সজাগ আছেন নলগিরি
শিশির বিশ্বাস
আগাছায় ভরা একখণ্ড জমির মাঝে মাটি ফুঁড়ে ওঠা উটের কুজের
মতো মস্ত এক পাথর। স্থানে স্থানে ফাটল
ধরেছে। এমন অসংখ্য পাথর
দেখেছি দুবরাজপুরের মামা–ভাগ্নে পাহাড়ে। সন্দেহ নেই‚ আগে এটি রাজগিরের বৈভার পাহাড়ের অংশ ছিল। জল–বাতাসের প্রভাবে ক্রমশ ক্ষয়ে গিয়ে মূল পাহাড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আকারেও ছোট হয়ে গেছে। প্রকৃতির এটাই নিয়ম। জল–হাওয়ার ঘর্ষণে বেলে নরম পাথর ক্ষয় হয় আগে। অপেক্ষাকৃত শক্ত পাথর ক্ষয় হতে সময় লাগে বেশি। তবু এটাও একদিন মিশে যাবে মাটিতে। খানিক তাকিয়ে অতিরিক্ত তেমন কোনও বিশেষত্ব খুঁজে না পেয়ে
পাশে দিবাকরবাবুর দিকে তাকালাম। আসলে
উনিই আজ এখানে নিয়ে এসেছেন। তাই
গল্প শুরুর আগে দিবাকরবাবুর কথা একটু বলা দরকার।
দিবাকরবাবুর দুটি গল্প* অবশ্য ইতিপূর্বে শুনিয়েছি। যারা সে গল্প পড়েননি তাঁদের বলি‚ মাঝবয়সী ছোটখাটো মানুষটি রাজগিরে এক হোটেলের
ম্যানেজার। দেখে বোঝার উপায়
নেই‚ পুরোনো দিনের ইতিহাসের উপর কী গভীর আগ্রহ মানুষটির। বিয়েথা করেননি। হোটেলে তাঁর ছোট ঘরটায় সেলফ ভরতি শুধু বই আর বই। প্রাচীন ভারতের উপর। কাজ শেষে প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত তাই নিয়ে পড়ে থাকেন। প্রথমবার রাজগিরে বেড়াতে এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে সেই যে পরিচয়
হয়েছিল‚ তারপর আর বিচ্ছিন্ন হয়নি। এবারেও তাঁর হোটেলেই উঠেছিলাম। শীতের এই সময়ে রাজগিরে ভয়ানক ভিড় হয়। আগে থাকতে বুকিং না থাকলে ভাল হোটেল পাওয়া মুশকিল। তবে সেজন্য পরোয়া করিনা। বেশ জানি সেই প্রথমবার যেভাবে তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন‚ তেমনই কিছু একটা সুরাহা করে দেবেন। তা ছাড়া আমার রাজগিরে বেড়াতে আসা কখনই হিসেব করে হয় না। শনি–রবি মিলিয়ে দিন তিনেকের ছুটি কোনও কারণে মিলে গেলেই তার সঙ্গে আর এক–আধ দিন জুড়ে বছরের এই সময় অন্তত একবার হলেও ছুটে আসি এখানে। শুধু রাজগির নয়‚ দিবাকরবাবুর সঙ্গলাভের টানেও।
ব্যতিক্রম হয়নি এবারেও। হোটেলে পা দিয়েই জেনেছি‚ ঘর খালি নেই। তবে সেজন্য ব্যস্ত হইনি। কাউন্টারের ছেলেটিই জানিয়েছিল ম্যানেজারবাবু উপরে তাঁর
ঘরের দিকে গেছেন। দেরি না করে ছুটেছি
সেই দিকে। ছোট ঘরটায় দরজা
দিয়ে মাথা গলাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন উনি। ‘আরে এসে গেছেন দেখছি!
দিন কয়েক আপনার কথাই ভাবছিলাম। ভালই হল।’
রাজগিরে এলে থাকার ব্যাপার নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না। সারাদিন প্রায় বাইরে ঘুরেই কাটে। তারপর গভীর রাত পর্যন্ত দিবাকরবাবুর সঙ্গে নানা গল্প। তবে দিবাকরবাবুর হোটেলে ঘর পেলে রাতের আড্ডা আরও জমাট
হয়। নইলে রাতে বন্ধ
হবার আগেই ছুটতে হয় নিজের ঠেকে। সে
এক সমস্যা বই কী। কিন্তু কী আর করা। উৎসুক হয়ে বললাম‚ ‘কেন স্যার? নতুন কিছু খবর?’
‘তা বলতে পারেন। জানেন‚ খবরটা এখনো কাউকেই বলিনি। তাছাড়া কে–ই বা শুনবে? এক আপনি ছাড়া। এই শীতের মরশুমে সবাই রাজগিরে ছুটে আসে দিন কয়েক ছুটি
কাটাতে। সেই সঙ্গে হট স্প্রিংয়ে
স্নান আর খাওয়াদাওয়া। রোপওয়ে। হইহই করে সাইট–সিন। এসব
নীরস ইট–পাথরের কথা কেউ শুনতে চায়
না। তাই অপেক্ষা করে
থাকি আপনার জন্য।’
দারুণ একটা গল্প যে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে‚ ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি। সামান্য উসকে দিলে এখুনি শুনে ফেলা যায়। কিন্তু এবার রাজগিয়ে এসেছি দিন তিনেকের জন্য। হাতে অনেক সময়। তাই তখনই সাড়া দিলাম না। আমার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন উনি। বিব্রত মুখে বললেন‚ ‘কী কাণ্ড দেখুন দেখি! সারা রাত জার্নি করে এলেন। আর এদিকে আমি ইট–পাথরের গল্প করে যাচ্ছি! চটপট ব্রেকফাস্ট সেরে আগে স্নানটা
সেরে নিন।’
‘স্যার‚ আমি কিন্তু এখনো হোটেল ঠিক করে উঠতে পারিনি।’ সামান্য কাষ্ঠ
হেসে জানিয়ে দিলাম।
‘আপনার হোটেল মানে তো রাতে একটু শোবার ঠেক।’ মৃদু হাসলেন উনি। ‘খোঁজ নিচ্ছি‚ ব্যবস্থা একটা নিশ্চয় হয়ে যাবে। ভাববেন না।’
হোটেলের ভাবনা মাথা থেকে নামতে এরপর আর দেরি করিনি। ঘড়ির কাঁটা ইতিমধ্যে বারোটার ঘর প্রায় ছুঁতে চলেছে। ব্রেকফাস্টের সময় আর নেই। সঙ্গের ব্যাগ দিবাকরবাবুর জিম্মায় দিয়ে ছুটলাম নীচে কমন
বাথরুমের দিকে। হোটেলে দুপুরের
রান্না ইতিমধ্যে প্রায় সারা হয়ে গিয়েছে। স্নান সেরে ধীরেসুস্থে তার সদগতি করে যখন উঠলাম‚ কাউন্টারে দিবাকরবাবু বেজায় ব্যস্ত। খাদ্যান্বেষীর ভিড়ে হোটেল সরগরম। সুতরাং তাঁকে আর ব্যস্ত করা যায় না।
ঠিক করেই এসেছিলাম‚ এবার যে কয়দিন থাকব‚ গৃদ্ধকূট পাহাড়টা ভাল করে ঘুরে দেখব। প্রাচীন রাজগৃহের যে কয়টি স্থান নিশ্চিত ভাবে সনাক্ত করা
গেছে গৃদ্ধকূট তার একটি। পাহাড়ের
উপরে রয়েছে একাধিক প্রাকৃতিক গুহা। বৌদ্ধ
গ্রন্থ অনুসারে তার কয়েকটিতে বাস করে গেছেন স্বয়ং বুদ্ধদেব। শিষ্য আনন্দ। বিশেষজ্ঞরা সেগুলি সনাক্তও করেছেন। কিন্তু উঠতে হলে অনেকটা পাহাড়ি পথ ভাঙতে হয়। ভাল করে দেখতে সময় দরকার। অথচ দিবাকরবাবুর কাছে গল্প শোনার টান রয়েছে। তাই মত পালটাতে হল। ইতিমধ্যে আমার থাকার জন্য পাশে এক লজের ডর্মিটরি ঠিক হয়েছে। ভাবলাম হাতে আরও দুটো দিন যখন রয়েছে সেখানে খানিক গড়িয়ে
নিয়ে আজ বানগঙ্গা গিরিপথের দিকটা ঘুরে আসব।
কিন্তু ভাবনা আর কাজ সবসময় মিল খায় না। সামান্য বিশ্রাম নিতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি‚ হুঁশ নেই। ঘুম যখন ভাঙল ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘর পার হয়ে গেছে। দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম।
প্রাচীন রাজগৃহ প্রাচীরের দক্ষিণ তোরণদ্বার ছিল এই বানগঙ্গা
গিরিপথের উপর। পুবদিকে উদয়গিরি
আর পশ্চিমে সোনাগিরি পাহাড়। দু’দিক থেকে পাথরের প্রাচীর নেমে এসেছে। রাজগিরের এই সুপ্রাচীন নিদর্শন এই বানগঙ্গা গিরিপথেই সবচেয়ে
ভাল অবস্থায় বর্তমান। সেই
প্রাগৈতিহাসিক কালে পাথরের প্রাচীরটি কেমন ছিল‚ তার কিছুটা আঁচ এখানে পাওয়া যায়। কিন্তু সেজন্য নয়। মাস কয়েক আগে ছোট এক খবরে দেখেছিলাম‚ এই গিরিপথের অদূরে কয়েকটি শঙ্খলিপির খোঁজ পাওয়া
গেছে। পাওয়া গেছে একটি
সুপ্রাচীন গৃহের অবশেষ। ইচ্ছে
ছিল দেখে আসব সেগুলো।
কিন্তু দুর্ভাগ্য‚ টাঙা বা রিক্সা কিছুই পাওয়া গেল না। ওদিকে যেতে কেউ রাজি নয়। টুরিস্টদের কেউ যায় না। জায়গাটা বিশেষ নিরাপদও নয়। বড় জোড় তারা শেল ইনস্ক্রিপশন পয়েন্ট অর্থাৎ পুরোনো দিনের
পাথুরে রাস্তার উপর রথ বা শকটের চাকার দাগ যেখানে রয়েছে‚ সেই পর্যন্ত যেতে পারে। তাও নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে। ফেরার সময় পাওয়া যাবে না তাকে। অগত্যা তাতেই রাজি হতে হল।
দিনটা কিন্তু প্রায় বৃথাই গেল বলা যায়। শেল ইনস্ক্রিপশন পয়েন্ট থেকে বানগঙ্গা গিরিপথ মাইল খানেকের
মতো। হেঁটে যথাস্থানে
পৌঁছোতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু
অনেক খুঁজেও উদ্দিষ্ট বস্তুর সন্ধান পাওয়া গেল না। অবশ্য এসব ব্যাপারে পুরোনো অভিজ্ঞতা কিছু আছে। তাই জানতাম সামান্য খবরের উপর নির্ভর করে এসব খুঁজে বের
করা বেশ কঠিন কাজ। তাই চেষ্টা ছাড়িনি। তারপর কখন যে বিকেল পার হয়ে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে‚ একেবারেই হুঁশ নেই। আসলে বের হতেই দেরি হয়ে গেছ।
যাই হোক‚ এরপর অযথা কালক্ষেপ না করে ফেরার পথ ধরলাম। পথ মোটেই কম নয়। শীতের বেলা। অন্ধকার দ্রুত ঘন হতে শুরু করেছে। খানিক হাঁটার পর মালুম হল‚ পায়ে হেঁটে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া সহজ নয়। খানিক এগোতেই অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এল। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা ঐতিহাসিক স্থান। প্রতি বছর এত টুরিস্ট আসেন। কিন্তু নিরাপত্তার তেমন ব্যবস্থা নেই। নানা অবাঞ্ছিত ঘটনার কারণে টাঙা বা রিক্সা এখন অনেক দর্শনীয়
স্থানেই যায় না। আজ যে কেউ বানগঙ্গা
গিরিপথের দিকে আসতে চায়নি‚ তা ওই কারণেই। ব্যাপারটা জানা থাকলেও তখন পরোয়া করিনি। কিন্তু এখন এই সন্ধ্যার অন্ধকারে জনমানবহীন পথে চলতে
গিয়ে মনে হল‚ এভাবে হঠকারিতা না করলেই
বোধ হয় ভাল হত। অথচ
সেই আড়াই হাজার বছর আগে কী আঁটোসাঁটোই না ছিল এই নগরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সন্ধ্যা নামলেই নগরের প্রতিটি তোরণদ্বার বন্ধ হয়ে যেতে। তারপর ভিতরে কারো প্রবেশের উপায় ছিল না। বৌদ্ধ গ্রন্থে রয়েছে‚ একবার স্বয়ং রাজা বিম্বিসার
পারিপার্ষদ নিয়ে তপদার উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করতে এসেছিলেন। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে তোরণদ্বার বন্ধ হয়ে গেছে। নিরুপায় বিম্বিসার রাত কাটিয়েছিলেন বেণুবনে বৌদ্ধ শ্রমণদের
সঙ্গে।
ভিতরে জমতে থাকা দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্যই অন্ধকার
পথে চলতে চলতে পুরনো দিনের কথা ভাবছিলাম। রাস্তায় জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু ঝিঁঝির কোরাস। পথের দু’পাশে জঙ্গল থেকে বুনো ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছে। কিন্তু তা উপভোগ করার মতো তখন মনের অবস্থা নেই। ইনস্ক্রিপশন পয়েন্ট পার হলে রোপওয়ের দিক থেকে টাঙা বা
রিক্সার দেখা মিলতে পারে। কিন্তু
যাত্রী বোঝাই থাকায় তারা যে আমাকে তুলে নেবে সেই সম্ভাবনা কম। তবু আশায় গতি বাড়িয়ে দিয়েছি। হঠাৎ পিছনে ঠুন–ঠুন ঘণ্টার আওয়াজ। পিছন
ফিরে তাকাতেই পথের পাশে জঙ্গল ফুঁড়ে বের হয়ে এল দৈত্যাকৃতি বিশাল এক হাতি। হাতি অত বড় হতে পারে চাক্ষুষ না দেখলে‚ বিশ্বাস করতে পারতাম না। এমনও হতে পারে‚ অন্ধকার বলেই প্রাণীটিকে অমন পাহাড় সদৃশ মনে হচ্ছিল। গলায় ঘণ্টা বাঁধা না থাকলে ওই পরিবেশে হয়তো আতঙ্কে জ্ঞান
হারিয়ে ফেলতাম। যাই হোক প্রাণীটিকে
এগিয়ে আসতে দেখে ত্রস্তে সরে দাঁড়িয়েছি‚ মানুষের গলা শুনতে পেলাম‚ ‘মাত ডরিয়ে বাবু। চলে
আইয়ে। এ বহোত আচ্ছে হাথি। ঘাবড়াও মত।’
হাতির পিঠে বসা কালো ছোটখাটো চেহারার মাহুতকে নজরে পড়ল
এবার। প্রায় ঘাম দিয়ে
জ্বর ছাড়ল। এই শীতের টুরিস্ট
মরশুমে রাজগিরে কখনো সার্কাস পার্টি আসে। সন্দেহ নেই‚ হাতিটা তাদের। মাহুত এদিকের জঙ্গলে চরাতে নিয়ে এসেছিল। দিনশেষে ফিরে চলেছে। পথে একা চলেছি দেখে তুলে নিতে চাইছে। প্রায় মেঘ না চাইতেই জল। তবু বললাম‚ ‘অনেক ধন্যবাদ ভাই। অন্তত
হট স্প্রিংয়ের কাছে নামিয়ে দিলেও খুব উপকার হয়।’
‘কেঁও বাবু!’ লোকটা প্রায়
হাঁ–হাঁ করে উঠল‚ ‘চাহে তো আপকো হোটেলমেই উতার দেঙ্গে। হাম তো টিশনপরহি যায়গা।’
বিশাল হাতিটা ইতিমধ্যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সামনের একটা
পা সামান্য তুলে ধরেছে। এভাবে
হাতির পিঠে চড়া অভ্যাস আছে। তবু
হাতির সেই পায়ের উপর দাঁড়িয়েও পিঠের নাগাল পাচ্ছিলাম না। মাহুত প্রায় টেনেই তুলল বলা যায়।
হোটেলে ফিরে আসতে কোনও সমস্যা হয়নি এরপর। কিন্তু বাকি কাজটাই হল না। সন্ধে রাত। দিবাকরবাবুর ঘরেই ছিলেন। এ সময় তেমন কাজ থাকে না তাঁর। উপরে ঘরে ঢুকে দেখি নিবিষ্ট মনে বই পড়ছেন। আমি ঢুকতেই মুখ তুলে তাকালেন। প্রসঙ্গ মনে করাবার আগেই বললেন‚ ‘যে গল্পের কথা সকালে বলেছিলাম। আজ আর বলা গেল না। আগামী কাল শুনবেন।’
অবাক হয়ে বললাম‚ ‘কেন স্যার?’
‘আসলে
গল্পের আগে আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই। খুব দূরে নয় যদিও‚ তবু এই রাতে সম্ভব নয়। আগামী কাল বিকেলে একটু আগে ফেরার চেষ্টা করবেন।’
পরের দিন গৃদ্ধকূটের দিকে গেলেও তাই কিছু তাড়াতাড়িই ফিরে
এসেছি। দিবাকরবাবু তৈরি
হয়েই ছিলেন। প্রায় তখনি আমাকে
নিয়ে বের হয়ে পড়লেন।
উষ্ণ প্রস্রবণের আগে বৈভার পাহাড়ের উত্তর ঢাল বরাবর যে
আধকাঁচা রাস্তাটা পশ্চিম দিকে চলে গেছে‚ সেই পথ ধরে খানিক এগিয়ে দিবাকরবাবু থামলেন একসময়। জায়গাটা একেবারেই নিরিবিলি। চারপাশে অসংখ্য গাছপালা আর ঝোপঝাড়। পাশ কাটিয়ে দিবাকরবাবু এরপর যেখানে আমাকে নিয়ে এলেন‚ তার কথা তো গল্পের শুরুতেই বলেছি। মাটি ফুঁড়ে ওঠা উটের কুজের মতো বিশাল এক পাথর। খানিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে দিবাকরবাবুর দিকে তাকাতে উনি তখনই
কোনও উত্তর দিলেন না। নিবিষ্ট
ভাবে তাকিয়ে রইলেন পাথরটির দিকে।
ইতিমধ্যে আলো অনেকটাই মরে এসেছে। ঘন গাছপালার মাঝে জায়গাটা ইতিমধ্যেই কিছু অন্ধকার। ফিরতে হবে। রাজগির জায়গাটা এমনিতেই খুব নিরাপদ নয়। শুনতে পাই‚ ইদানীং আরও অবনতি হয়েছে। সামান্য অপেক্ষার পর বললাম‚ ‘সামনে মাটির নিকানো বেদীতে শুকনো ফুল‚ পোড়া ধুপকাঠি রয়েছে দেখছি। স্থানীয় মানুষ পুজো দেয় বোধ হয়।’
‘ঠিকই বলেছেন।’ বলতে বলতে
কাছেই এক বুনো ফুলের ঝোপ থেকে গোটা কয়েক ফুল ছিঁড়ে দিবাকরবাবু বেদির উপর ছড়িয়ে দিয়ে
আমার দিকে তাকালেন। ‘তবে স্থানীয় মানুষ নয়। শুধু বিরজুবাবা। কখনো এদিকে এলে বেদি ঝাড়পোঁছ করে বুনো ফুল আর গোটা কয়েক
ধুপকাঠি উনিই জ্বেলে দিয়ে যান।’
দিবাকরবাবুকে দেখে ততক্ষণে আমিও গোটা কয়েক বুনো ফুল বেদির
উপর ছড়িয়ে দিয়েছি। কাজ শেষ করে উঠে
দাঁড়াতে যাব‚ হঠাৎ এক ঝলক হালকা মিষ্টি
গন্ধ নাকে এসে লাগল। উঠে
দাঁড়িয়ে বললাম‚ ‘এদিকে পদ্মফুলের জলা আছে
নাকি স্যার? তেমন গন্ধ পেলাম।’
‘তাহলে পেয়েছেন গন্ধটা।’ দিবাকরবাবুর কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা। ‘তাহলে বলি
আপনাকে‚ এখানে কাছাকাছি কোথাও পদ্মফুলের
জলা নেই। গন্ধটা ওই পাথর
থেকে বের হয়। তবে সব সময় নয়। সবাই সেই গন্ধ পায়ও না। যেমন এই মুহূর্তে আপনি পেলেও আমি কোনও গন্ধ পাইনি।’
‘কী বলছেন স্যার!’ অবাক
হয়ে বললাম। কমে এলেও গন্ধটা
কিন্তু এখনও আছে। পাচ্ছেন না?’
‘না।’ মৃদু মাথা
নাড়লেন উনি। ‘তবে আজ না হলেও আগে বার কয়েক সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিরজুবাবার কথায়‚ গন্ধটা পাথরের গায়ে সব সময়ই পাওয়া যায়। অন্তত তিনি পান।’
বিরজুবাবার কথা দিবাকরবাবু আগেও বলেছেন। তেমন গুরুত্ব দেইনি। এবার নড়ে উঠলাম‚ ‘কে বিরজুবাবা?’
‘আধপাগল এক বাউণ্ডুলে সাধু। ছোটখাটো চেহারা হলে কী হবে‚ এক সময়ের দাগি আসামী। বার কয়েক জেলের ঘানি টানা বিরজু সিং। স্থানীয় পুলিশের ভয়ানক মাথা ব্যথার কারণ সেই বিরজু সিং
হঠাৎই এক ঘটনায় সব ছেড়ে সাধু হয়ে গেল। এখন কখন কোথায় থাকে ঠিক নেই। বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়ায়।’
সন্ধ্যার অন্ধকার ইতিমধ্যে ঘন হতে শুরু করেছে। বাড়ছে ঝিঁঝির কোরাস। দিবাকরবাবু আমাকে নিয়ে ফেরার পথ ধরলেন। চলতে চলতেই বললেন‚ ‘বুঝতেই পারছেন‚ এ গল্প বিরজুবাবার। শুনেছি তাঁর কাছেই। মুশকিল হল‚ মানুষটা লেখাপড়া জানে না। একটু খ্যাপাটেও বটে। সব গুছিয়ে বলতে পারেনি। তাই অনেক জায়গাতেই ফাঁক রয়ে গেছে। কিছু ভরাট করার চেষ্টা করেছি মাত্র। আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি‚ হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারবেন।’
পথে দিবাকরবাবু কিছু আর বলেননি। মুখ খুললেন একেবারে হোটেলে নিজের ঘরে ফিরে। আসার পথে নীচে চায়ের কথা বলে এসেছিলেন। চা পৌঁছোতে চুমুক দিয়ে বললেন‚ ‘এই রাজগিরে অনেক দিন হয়ে গেলেও তখনও বিরজুবাবাকে
চিনতাম না আমি। নামও
শুনিনি। সেদিন হাতে তেমন
কাজ নেই। সোনভাণ্ডার চত্বরে
ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ কোত্থেকে এক
সাধুবাবা এসে হাজির। কালো
ছোটখাট পেটানো শরীর। মাথায়
জট পড়া ময়লা চুল। মুখে অবিন্যস্ত
দাড়ির জটলা। গলায় কয়েক প্যাঁচ
নানা রঙের পুঁতির মালা। অফ
সিজন। সোনভাণ্ডার সেদিন
প্রায় জনশূন্য। একাই ঘুরে দেখছিলাম। স্থানীয় প্রবাদ‚ সোনভাণ্ডার রাজা জরাসন্ধের কোষাগার। কিন্তু তা যে নয়‚ বাইরে দেয়ালে খ্রি ৩য় শতকের দীর্ঘ ব্রাক্ষ্মীলিপিই তার প্রমাণ। ভৈরদেব জৈন সাধকদের জন্য গুহাটি ওই সময় খনন করিয়েছিলেন। লিপিতে তা পরিষ্কার লেখা আছে। অথচ এগুলি রক্ষার তেমন কোনও ব্যবস্থাই নেই। ওই সময় লোকটা হঠাৎই হাজির হল সামনে। হাত নেড়ে বললেন‚ চিন্তা করিসনি বাপু। আমার
নলগিরি আছে। সেই রক্ষা করবে। এই ঘরের মাঝে পুজোর জন্য দেবমূর্তি ছিল। চুরি হয়ে যাবে সেই ভয়ে সাহেবরা খুঁড়ে নিয়ে গেছে। সেই মূর্তি এখন কোথায় কে জান!
‘দেহাতি হিন্দিতে কথা বলছিলেন উনি। পাগলের প্রলাপ ভেবে উড়িয়েই দিতাম। কিন্তু লোকটার ওই শেষের কথাতেই চমকে উঠলাম। বর্তমানে অনেকেই জানেন না‚ সোনভাণ্ডারের মেঝেতে ফুট তিনেক উঁচু মন্দির আকৃতির
শিখরযুক্ত এক চারকোনা পাথর বসানো ছিল। চারদিকে খোদাই করা চারজন জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি। সন্দেহ নেই‚ উপস্থিত জৈন সন্তরা প্রতিদিন পুজো করতেন সেটিকে। ১৮৯৫ সালে আলেকজান্ডার ক্যাডি সাহেবের তোলা একটি ছবিতে
সেটি দেখা যায়। তারপর আর হদিশ নেই।
‘আগ্রহে বললাম‚ সাধুজি‚ আপনি অনেক খবর জানেন দেখছি!
‘জানি তো‚ সাধুবাবা অনাবিল হাসলেন‚ কিন্তু সব গুলিয়ে যায় বাপু। গুছিয়ে কিছুই তাই বলতে পারব না। লেখাপড়া তো শিখিনি। সামান্য নিষাদী মানুষ।
‘কথা শেষ করে লোকটি যেমন এসেছিলেন‚ তেমনই ছুটে চলে গেলেন। ফের প্রশ্ন করার আগেই। কিন্তু ভিতরে এক ঝাঁক প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেলেন।
‘ফিরে এসে খোঁজ নিতে বিরজুবাবা সম্পর্কে যা জানতে
পারলাম‚ তা প্রায় গল্পকথার মতো। আগেই বলেছি‚ বিরজুবাবার আগে নাম ছিল বিরজু সিং। এদিকের ডাকসাইটে খুনে গুণ্ডা। খোদ পুলিশও সমীহ করে চলত। নিতান্ত দায়ে না পড়লে ঘাঁটাত না। তবু ধরা পড়েছে বার কয়েক। কিন্তু প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস। কেউ সাক্ষী দিতে রাজি হয়নি।
‘তো চলছিল এই ভাবেই। তারপরেই ঘটে যায় সেই ঘটনা। দিল্লির এক মূর্তি পাচারকারী দলের নজরে পড়েছিল সূরজকুণ্ডে
গুপ্ত আমলের মূর্তি দুটো। বিদেশে
পাচার হবে। রফা হয়েছিল অনেক
টাকায়। তাই যাদের কাজে
লাগানো হয়েছিল‚ তারা অনেক দিনের অভিজ্ঞ। এসব কাজে যথেষ্টই দক্ষ। প্রয়োজনে দু’চারটে খুন করতেও হাত কাঁপে না। দলে বিরজু সিংকে নেওয়া হয়েছিল একটাই কারণে‚ এদিকে অন্ধকার জগতের একছত্র মানুষ বলেই। সেও রাজি হয়ে গিয়েছিল। প্রায় কিছুই করতে হবে না তাকে। অথচ হাতে আসবে মোটা টাকা। এমন সুযোগ কে আর ছাড়তে চায়।
‘বিরজু সিং’ও ছাড়েনি। কিন্তু তারপরেই ঘটে গেল এক ভয়ানক ঘটনা।’
দিবাকরবাবু অল্প থামলেন। হাঁ করে শুনছিলাম। তাড়াতাড়ি বললাম‚ ‘কী?’
‘আজ যেখানে আপনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম।’ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে দিবাকরবাবু বললেন‚ ‘তখন সেখানেই ছিল পুলিশের ছোট এক আউটপোস্ট। রাত দুপুরে বিরজু হঠাৎ ছুটতে ছুটতে হাজির হয় সেখানে। জনা তিনেক পুলিশ তখন ঘুমে ঢুলছে। বিরজু তাদের জানায়‚ জনাকয়েক মূর্তিচোর সূরজকুণ্ডের দুটো মূর্তি চুরি করতে এসেছিল। দেখতে পেয়ে মানা করেছিল। ওরা শোনেনি। অগত্যা সে খুন করেছে তাদের। দেহগুলো সেখানেই পড়ে আছে।
‘গোড়ায় বিরজু সিংয়ের কথা বিশ্বাস করেনি তারা। কিন্তু অমন একটা খবর শোনার পর বসে থাকাও সম্ভব হয়নি। অগত্যা বিরজুকে সঙ্গে নিয়ে আউটপোস্টের দুই পুলিশ হাজির
হয়েছিল অকুস্থলে। তারপর ব্যাপার দেখে
মুখে কথা সরেনি কারও। ষণ্ডা
চেহারার চার চারটে মানুষ খুন হয়ে পড়ে আছে। ভারি পাথর বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে থেঁতলে মারা হয়েছে তাদের। বিরজুর মতো ছোটখাটো চেহারার মানুষের পক্ষে ব্যাপারটা কীভাবে
সম্ভব‚ কেউ থই করতে পারেনি।
‘বিরজুকে অ্যারেস্ট করা হল। এত দিনে বাগে পাওয়া গেছে লোকটাকে। কড়া শাস্তির
ব্যবস্থার জন্য চাপ এল উপর মহল থেকে। পুলিশের
পক্ষ থেকে লাগানো হয়েছিল বড় বড় ডাকসাইটে উকিল। বিরজুর নিজের কোনও উকিল ছিল না। সরকার থেকে তার হয়ে সওয়াল করার জন্য মামুলি যে উকিল দাঁড়
করানো হয়েছিল‚ এজলাসে তাঁর একটিই প্রশ্ন
ছিল‚ বিরজুর মতো ছোটখাটো চেহারার
একজন মানুষের পক্ষে ওই বিশাল চেহারার চারজন মানুষকে খুন করা সম্ভব কিনা। আর থেঁতলে মারার সেই পাথরটাই বা কোথায়?
‘তাবড় তাবড় উকিলদের কেউ সেই প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য
জবাব দিতে পারেননি। পুলিশের
নিজের কাছেও সেই ব্যাখ্যা ছিল না। অগত্যা
বেকসুর খালাস হয়ে গেল বিরজু। এরপর
পুরনো পথে আর ফিরে যায়নি সে। সাধু
হয়ে এখন বিরজুবাবা। আধপাগল মানুষ‚ কখন কোথায় থাকে ঠিক নেই। মাঝে মধ্যেই উধাও হয়ে যায়। হঠাৎ ফিরেও আসে তারপর।’
দিবাকরবাবু থামলেন। আমি বললাম‚ ‘গল্পটা যেন শেষ হল না স্যার। অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেল।’
‘বাকি তো রইলই।’ ধীরস্থির
মানুষ দিবাকরবাবুকে কেমন অন্যরকম মনে হচ্ছিল তখন। ভিতরে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি বললাম‚ ‘বাকিটা আজ থাক স্যার। আরও
একটা দিন তো আছি। পরে শুনব।’
দিবাকরবাবু অল্প হাসলেন। ইতিমধ্যে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন তিনি। খানিক থম হয়ে থেকে বেল টিপে ফের দু’কাপ চা পাঠাবার নির্দেশ দিয়ে বললেন‚ ‘জানেন তো‚ রাজপ্রহরী গল্পের সেই বাণেশ্বর প্রসাদের দেখা
তারপর আর পাইনি। আপসোস
থেকেই গেছে। তাই এই গল্পের পরের
কথা বলতে গিয়ে ভিতরে একটা অন্য অনুভূতি যেন কাজ করে। সহজ থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে।’
একটু পরেই চা এসে গেল। ধূমায়িত কাপে গোটা কয়েক চুমুক দিয়ে দিবাকরবাবু শুরু করলেন
আবার‚ ‘বিরজু সিংয়ের সব শোনার পর লেগে রইলাম বিরজুবাবার
খোঁজে। লোকও লাগিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই একদিন খোঁজ পেলাম তাঁর। যেখানে আজ আপনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেই পাথরটার কাছে। সামনে নিকানো বেদীতে ধুপকাঠি জ্বেলে ফুল ছড়িয়ে
দিচ্ছে। পাথরের গা থেকে
মাঝেমধ্যে যে পদ্মফুলের গন্ধ বের হয়‚ ততদিনে টের পেয়ে গেছি আমি। কাজ শেষ করে বিরজুবাবা উঠে দাঁড়াতে বললাম‚ ‘বিরজুবাবা‚ আপনার সব কথা শুনেছি আমি। তারপর সেই থেকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
‘অ্যাঁ‚ একটা খুনেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন! জেলে ভরবেন নাকি?
বলতে বলতে হা–হা করে হেসে উঠলেন উনি।
‘সে ক্ষমতা আমার নেই সাধুবাবা। আসলে বিরজু সিং নয়। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি বিরজুবাবাকে। তিনি নিষাদী। অন্য এক মানুষ।
‘তা কী কারণে? বিরজুবাবা
এবার আর হাসলেন না।
‘এই পাথর থেকে কখনও পদ্মর গন্ধ বের হয়। আমার মনে হয়ে‚ সেই কারণ একমাত্র আপনিই বলতে পারবেন।
‘বেরবে না! মুহূর্তে বিরজুবাবার
জবাব‚ ও যে নলগিরি। মস্ত এক সাধু ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। সেই থেকে ওর গায়ে পদ্মফুলের গন্ধ। খুব বড় সাধু কিনা। তাঁর ইচ্ছেয় সেই থেকে ও এই নগরের প্রহরী।
‘বিরজুবাবার সেই কথার অর্থ পুরো বুঝতে না পারলেও
কিছুটা যেন অনুমান করতে পারলাম। সারা
শরীর হঠাৎ কেমন শিরশির করে উঠল। তাড়াতাড়ি
বললাম‚ বিরজুবাবা‚ কে তিনি?
‘সে তো জানি না বাপু। বিরজুবাবা ঠোঁট ওলটালেন‚ শুধু মনে আছে দিব্যকান্তি শরীর। আমি তো সামান্য‚ অমন যে মদমত্ত নলগিরি‚ সেও তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। সারা নগরে সে এক হইহই কাণ্ড। খবর পেয়ে স্বয়ং রাজাও ছুটে এসেছিলেন।
‘বিরজুবাবা‚ সেই মূর্তি চুরির রাতে ঠিক কী ঘটেছিল?
ভিতরের উত্তেজনা কোনও মতে দমন করে রুদ্ধশ্বাসে বললাম।
‘পুলিশ অনেক জেরা করেছিল তারপর। বলিনি। কেউ
বিশ্বাসও করত না। কিন্তু আজ আপনাকে
বলতে বাধা নেই। এক মুহূর্ত অপেক্ষা
না করে বিরজুবাবা বললেন‚ সেদিন কাজটা যাতে নির্বিঘ্নে
হয়‚ সেজন্য চারপাশে নজর রাখাই
কাজ ছিল আমার। কিছুটা
কৌতূহলও ছিল। বেআইনি অনেক কাজ
করেছি‚ পাথরের মূর্তি চুরির এই
কাজ কখনও করিনি। জানা
থাকলে সুবিধাই হবে। ওরা অন্ধকারে ছেনি–হাতুড়ি দিয়ে মূর্তিগুলো খোলার কাজ করছিল। নির্জন রাতে হালকা ঠুক–ঠুক শব্দ। আমি
দাঁড়িয়ে ছিলাম খানিক দূরে বিপুলগিরি পাহাড়ের কাছে। পাশেই মাটি ফুঁড়ে ওঠা মস্ত এক উটের কুজের মতো পাথর। হঠাৎ মনে হল‚ এভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে না থেকে পাথরটার উপর চড়ে বসলেই তো
হয়। উঁচু থেকে চারপাশে
আরও ভাল নজর রাখা যাবে।
‘কী বলব বাপু‚ সামান্য দম নিয়ে বিরজুবাবা বললেন‚ পাথরটার উপরে চড়ে বসেছি‚ হঠাৎ নড়ে উঠল সেটা। চমকে উঠে দেখি‚ পাথর কোথায়! পাহাড়ের মতো মস্ত এক হাতি। প্রায় হাত আড়াই লম্বা রুপোয় বাঁধানো তীক্ষ্ণ গজদাঁত। গলায় জরির কাজ করা দড়িতে ঘণ্টা। চার পা মুড়ে বসে ছিল হাতিটা। আমি পলক ফেলার আগেই সে উঠে দাঁড়াল। ছুটে গেল লোকগুলোর দিকে। ওদের হাতে ছেনি–হাতুড়ি ছাড়া পকেটে পিস্তলও ছিল। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি। একে একে চারজনকেই পা দিয়ে পিষে ফেলেছিল সেই হাতি। বিরজু সিং খুনে গুণ্ডা। মানুষের আতঙ্ক। পুলিশের মাথাব্যথা। কিন্তু নিজেই আতঙ্কে হিম হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। অসাড় হয়ে গিয়েছিল হাতপা। ভেবেছিলাম‚ হাতিটা আমাকেও শুঁড়ে পেঁচিয়ে আছড়ে ফেলবে এরপর। কিন্তু তা হয়নি। ওদের চারজনকে পিষে মেরেই হাতিটা আমাকে নিয়ে ছুটেছিল পুলিশ
ফাঁড়ির দিকে। তখন এখানেই ছিল
ছোট এক আউটপোস্ট।
‘তারপর? বিরজুবাবা থামতে
প্রশ্ন করলাম।
‘তারপর আর কী? অল্প হাসলেন
উনি‚ হঠাৎ হুঁশ ফিরতে তাকিয়ে
দেখি‚ জঙ্গলের ভিতর এই পাথরের
উপরে বসে আছি। অদূরে
গাছপালার ফাঁকে পুলিশ ফাঁড়ি। ও যে
নলগিরি‚ নগরের সেরা রণহস্তী‚ তা অবশ্য জানতে পেরেছিলাম অনেক পরে। সেসব অনেক কথা বাপু। জানতে চেয়ো না। গুছিয়ে বলতে পারব না। শুধু বলি‚ খুনে গুণ্ডা
বিরজু সিংয়ের জীবন তছনছ হয়ে গেল তারপর। কোর্টে মামলা উঠল। সাগরেদ তো কম ছিল না। তারা ভাল উকিল দিতে চাইল। মানা করে দিলাম। তবু বেকসুর খালাস হয়ে গেলাম। জীবনটাই পালটে গেল।’
‘দিবাকরবাবু থামলেন। কয়েক মুহূর্ত মুখে কোনও কথাই সরল না। তারপর গলা ঝেড়ে নিয়ে বললাম‚ ‘বিরজুবাবার এই অদ্ভুত গল্প কি বিশ্বাস করা যায়
স্যার?’
‘যায় না।’ সামান্য নীরবতার
পর দিবাকরবাবু বললেন‚ ‘কিন্তু নিরক্ষর
বিরজু সিং বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘বিনয় পিটক’–এর
সেই কাহিনী জানবে কেমন কর!’
‘হয়তো কারও কাছে শুনে…।’
‘হতে পারে।’ আমার কথা
শেষ হবার আগেই দিবাকরবাবু বললেন‚ ‘প্রাচীন রাজগৃহে রাজপথের যে ঘটনার চিত্র অজন্তার দেয়ালে শিল্পী অমর করে গেছেন‚ স্রেফ শুনে তার মর্ম কি নিরক্ষর খুনে বিরজুর
পক্ষে উদঘাটন করা সম্ভব!’
থামলেন উনি। অজন্তার সপ্তদশ গুহার দেওয়ালে সেই ছবি আমিও দেখেছি। রাজপথের প্রতিটি গৃহের অলিন্দ থেকে নারী–পুরুষ রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছেন। বিশাল আকার যে উন্মত্ত রণহস্তী নলগিরি সামান্য আগেই এক
নিরীহ পথচারীকে আছড়ে মেরেছে‚ সে হাঁটু মুড়ে নতজানু হয়ে বসে পড়েছে সৌম্যকান্তি সন্ন্যাসী
গৌতম বুদ্ধর পায়ে। তিনি নলগিরির মস্তক
স্পর্শ করে আশীর্বাদ করছেন। অথচ
এই গৌতম বুদ্ধকে হত্যা করার জন্যই পাঠানো হয়েছিল তাকে।
নীরবে সেই ছবির কথাই ভাবছিলাম। দিবাকরবাবু বললেন‚ ‘তারপর পাথরটির গা দিয়ে ওই পদ্মের গন্ধ। তার ব্যাখ্যাই বা কী দেবেন?’
উত্তরে যুক্তি কিছু একটা দেওয়াই যেত। কিন্তু সায় দিল না। অল্প মাথা নাড়লাম শুধু। উনি কিন্তু না থেমে বললেন‚ ‘নিষাদী শব্দের অর্থ মাহুত। বিরজুবাবা প্রথম দিন আমার কাছে নিজের ওই পরিচয়টাই দিয়েছিল। সেদিন নলগিরির পিঠে একজন মাহুত যে ছিল‚ তা বলাই বাহুল্য। শিল্পী অবশ্য তাঁকে আঁকেননি। স্বয়ং ভগবান যাকে আশীর্বাদ করছেন তার পিঠে সামান্য এক
নিষাদীকে হয়তো দেখাতে চাননি তিনি।’
দিবাকরবাবুর ওই কথায় হঠাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে
উঠল। সেদিন সন্ধেয় বানগঙ্গা
থেকে ফেরার পথে চমৎকার মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে আসছিল। অবস্থার বিপাকে তখন বিশেষ গুরুত্ব দেইনি। ভেবেছিলাম মামুলি বুনো ফুল। এবার খেয়াল হল‚ সেটা নলগিরি পাথরের গা থেকে বের হওয়া পদ্মেরই গন্ধ। সেদিন হাতির পিঠে সারাটা পথ সেই গন্ধ পেয়েছিলাম। একেবারেই তলিয়ে ভাবিনি। অথচ বলতে গিয়েও মুখে কথা জোগাল না। বিমূঢ়ের মতো স্থির হয়ে বসে রইলাম।
দিবাকরবাবু বললেন‚ ‘ইচ্ছা ছিল বিরজুবাবার কাছে নিয়ে যাব আপনাকে। কদিন হল রাজগিরেই ছিল। কিন্তু আজ খবর নিতে গিয়ে শুনলাম‚ গতকাল থেকে খোঁজ নেই তাঁর।’
‘বিরজুবাবাকে বোধ হয় গত সন্ধেয় দেখেছি স্যার।’ কিছুটা সামলে নিয়ে ঢোঁক গিলে ব্যক্ত করলাম‚ ‘কালো ছোটখাটো শরীর। মাথা ভরতি অবিন্যস্ত ঝাঁকড়া চুল। গালে দাড়ি।
হাতে মাহুতের অঙ্কুশ। রণহস্তী নলগিরি আজও…।’
ভগবান শাক্যমুনির আশীর্বাদে নলগিরি আর তার মাহুত রাজগৃহ
নগরে আজও যে কখনও সজাগ হয়ে ওঠেন‚ সেকথা আর বলা হয়ে উঠল না।
আপলোড: ১১/৯/২০১৮
Asadharon lekhoni apnar
ReplyDeleteঅসম্ভব এক ঐতিহাসিক সত্যিকে তুলে ধরেছেন
ReplyDeleteআমি বাকরুদ্ধ। অসাধারণ লেখা।
ReplyDeleteDarun
ReplyDeleteExcellent story
ReplyDeleteKhub sundor lekha.
ReplyDeleteEto bhalo lage porte. Mon bhalo kore dey.
ReplyDeleteKhub sundar golpo..thank you
ReplyDelete