বিরজা হোম ও তার বাধা
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ভৈরব চক্ৰবৰ্ত্তীর মুখে এই গল্পটি শোনা। অনেক দিন আগেকার
কথা। বোয়ালে-কদরপুর (খুলনা) হাইস্কুলে আমি তখন শিক্ষক। নতুন কলেজ থেকে বার হয়ে
সেখানে গিয়েছি।
ভৈরব চক্রবর্তী ঐ গ্রামের একজন নিষ্ঠাবান সেকেলে ব্রাহ্মণপণ্ডিত।
সকলেই শ্রদ্ধা করতো, মানতো। এক প্রহর ধরে
জপ-আহ্নিক করতেন, শূদ্রযাজক ব্রাহ্মণের জলস্পর্শ করতেন না,
মাসে একবার বিরজা হোম করতেন, টিকিতে ফুল বাঁধা
থাকতো দুপুরের পরে। স্ব-পাক ছাড়া কারো বাড়ি কখনো থেতেন না। শিষ্য করতে নারাজ
ছিলেন। বলতেন‚ শিষ্যদের
কাছে পয়সা নিয়ে খাওয়া খাটি ব্রাহ্মণের পক্ষে মহাপাপ। আর একটা কথা, ভৈরব চক্রবর্তী ভাল সংস্কৃত জানতেন কিন্তু কোন স্কুলের
পণ্ডিতি করেননি। টোল করাও পছন্দ করতেন না। ওতে নাকি গবর্নমেন্টের দেয় বৃত্তির
দিকে বড় মন চলে যায়। টোল ইন্সপেক্টরদের খোশামোদ করতে হয়। তবে দুটি ছাত্রকে
নিজের বাড়িতে রেখে খেতে দিয়ে ব্যাকরণ শেখাতেন।
বর্ষা সেবার নামে-নামে করেও নামছিল না, দিনে-রাতে গুমটের দরুন আমরা কেউ ঘুমুতে পারছিলাম না। হঠাৎ
সেদিন একটু মেঘ দেখা দিল পূর্ব-উত্তর কোণে। বেলা তিনটে। স্কুল খুলেছে গ্রীষ্মের
ছুটির পরে। কিন্তু এত দুৰ্দ্দান্ত গরম যে পুনরায় সকালে স্কুল করার জন্য ছেলেরা
তদবির করছে, মাস্টারদেরও উস্কানি তাতে ছিল বারো আনা। হেড
মাস্টার আপিস ঘরে বসে আছেন। গোপীবাবু ইতিহাসের মাস্টার, গিয়ে
উত্তেজিত ভাবে বল্লেন, —সার, মেঘ করেছে—
মুরলী মুখুজ্যে (এই নামেই তিনি এ অঞ্চলের ছাত্রদের মধ্যে
কুখ্যাত) গভীর স্বরে বল্লেন,–কিসের মেঘ ?
—আজ্ঞে, মেঘ যাকে বলে ।
—কি হয়েছে তাতে ?
—আঞ্জে, বৃষ্টি হবে। স্কুলের ছুটি দিলে
ভালো হোত! ছেলেরা অনেক দূর যাবে, ছাতি আনেনি অনেকে।
—বৃষ্টি হবে না ও মেঘে।
খাস ইন্দ্রদেবের আপিসের হেড কেরানীও এতটা আত্মপ্রত্যয়ের
সুরে একথা বলতে দ্বিধা করতো বোধ হয়। কিন্তু সকলেই জানে মুরলী মুখুজ্যের
পাণ্ডিত্যের সীমা-পরিসীমা নেই, আবহাওয়া
তত্ত্বটি তার নখদর্পণে । গোপীবাবু দমে গিয়ে বললেন‚—বৃষ্টি হবে না ?
一না।
—কেন সার ? বেশ মেঘ করে এসেছে তো ?
—মেঘের আপনি কি বোঝেন ? ওকে বলে তাতমেঘ,
ও মেঘে বৃষ্টি হবে না।
আমিও পাশের শিক্ষকদের বিশ্রাম কক্ষ থেকে জানালা দিয়ে মেঘটা
দেখেছিলাম এবং আসন্ন বৃষ্টির সম্ভাবনাতে পুলকিত হয়েও উঠেছিলাম। মুরলী মুখুজ্যের
নির্যাত রায় শুনে আমি তাড়াতাড়ি বাইরে এসে বল্লাম—বৃষ্টি হবে বলে কিন্তু মনে হচ্ছে।
মুরলী মুখুজ্যে বললেন—তাতমেঘ।
মেঘ হলেই বৃষ্টি হয় না।
—কোন মেঘে বৃষ্টি হয় ?
—এখন বৃষ্টি হবে আলট্রা স্ট্রটোস মেঘে। যাকে বলে শিট্ক্লাউড।
ーও!
—তাছাড়া হাওয়া বইছে দক্ষিণ থেকে। মনস্কনের আগে হাওয়া ঘুরে
যাবে পুবে।
—ও।
আর কোনো কথা বলতে আমাদের সাহস হোল না। কিন্তু ইন্দ্রদেব
সেদিন বড়ই অপদস্থ করলেন আবহাওয়াতত্ত্ববিদ মুরলী মুখুজ্যেকে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই
মেঘের চেহারা ঘন কালো হয়ে উঠলো, মেঘের চাদর
ঢাকা পড়লো আরও ঘন অর একখানা মেঘের চাদরে। তারপর স্কুলের ছুটি হওয়ার সামান্য কিছু
আগেই ঝম্ ঝম্ মুষলধারে বর্ষ নামলো। পুরো দুটি ঘণ্টা ধরে খাল বিল নালা ডোবা ভাসিয়ে
রামবৃষ্টি হওয়ার পরে বেলা সাড়ে পাচটার সময় আকাশ ধরে গেল। ছেলেরা তখনো পৰ্য্যন্ত
স্কুলেই আটকে ছিল। কোথায় আর যাবে। সবাই আমরা আটকে পড়েছিলাম।
গোপীবাবু জয়গৰ্ব্বে উৎফুল্ল হয়ে মুরলী মুখুজ্জোকে গিয়ে
বলেন-দেখলেন সার, তখন বল্লাম বৃষ্টি আসবে,
তখন ছুটিটা দিলে আর এমন হোত না।
মুরলীবাবু বল্লেন—অমন
হয়ে থাকে। ইতিহাস পড়ান, Higher Mathematics পড়ালে বুঝতেন।
জগতে space and time নিয়ে অনেক আশ্চৰ্য্য ঘটনা ঘটে।
এডওয়ার্ড গার্নেটের প্রবন্ধ পড়ে দেখবেন এ বছরের Mathematical Gazette-এ, বুঝলেন?
—সেটা কি ?
—এ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারল্যাণ্ড পড়েছেন তো ? অঙ্কশাস্ত্রে এ্যালিস্ থ্রু লুকিংগ্লাসের পরীক্ষা আর কি। পড়ে দেখুন।
গোপীবাবু চলে এলেন । অঙ্কশাস্ত্রের কথা উঠলেই স্বভাবতঃ তিনি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েন ।
বৃষ্টি থেমেছে, স্কুল
থেকে বেরিয়ে আমি আর গোপীবাবু চলেছি। দুজনেই আমরা মনে মনে বড় খুশি । হেড
মাস্টারকে আজ বড় জব্দ করা গিয়েছে। রোজ রোজ কেবল চালাকি ! এমন সময় ভৈরব
চক্ৰবৰ্ত্তীর বাড়ির দাওয়ায় দেখি ভৈরব চক্রবর্তী দাড়িয়ে। খুব খুশি মন। আমাকে
দেখে ডেকে বলেন—কেমন ননীবাবু, বিষ্টি
হোল তো ?
—এই যে চক্কোত্তি মশায়, নমস্কার। তা হোল
।
—হবে না? আজ তিন দিন থেকে হোম করছি বিষ্টির
জন্যে। ওর বাবাকে হতে হবে।
অবিশ্যি বৃষ্টির পিতৃদেব কে, তা ভালো জানা ছিল না। বল্লাম—বলেন কি? হোম করার ফল তাহলে ফলেছে বলতে হবে!
গোপীবাবু অৰ্দ্ধস্ফুট স্বরে বলে বসলেন—লাগে তাক, না লাগে তুক। ভৈরব চক্ৰবৰ্ত্তী
কথাটা শুনতে পেয়ে বল্লেন—আসুন দুজনেই আমার বাড়ি মাস্টার
বাবুরা। দেখুন দেখাই।
গোপীবাবু ও আমি দুজনে দাওয়ায় গিয়ে বসলাম। মনটা বেশ ভালো।
দুঃসহ গরমের পর প্রচুর বৃষ্টি হয়ে দিনটি একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। আজ পনেরো
দিন দারুণ গুমটে রাত্রে ঘুমুইনি।
গোপীবাবু কেবল বলছিলেন—আজ
খুব ঘুম হবে, কি বলেন?
—নিশ্চয়। তার আর ভুল? ভৈরব চক্রবর্তী
আমাদের নিয়ে গেলেন ঘরের মধ্যে। সেখানে সত্যিই হোমের আগুনের কুণ্ডু—বালি বিছিয়ে তৈরি, বেলকাঠ ও জগ্গিডুমুরের ডালের
বাড়তি সমিধ (যজ্ঞের কাঠ) এক পাশে গোছানো। পূৰ্ণপাত্রে সিধে সাজানো, তামার টাটে নারায়ণশীলা ! সিঁদুর বেলপাতা তামার বড় থালায়।
হোম হয়ে গিয়েছে, উপকরণের অবশেষ এদিক ওদিক ছড়ানো।
ভৈরব চকত্তি বল্পেন—দেখলেন মাস্টারবাবু? হোম করার ফল আছে কি না দেখলেন। গোপীবাবু বল্লেন—আপনি অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করেন?
—নিশ্চয়ই। নিজের চোখে দেখা । অপদেবতার কাণ্ড দেখেছি যে কত।
পঞ্চমুণ্ডির আসনে জপ করার সময়!
—বলুন না দু'একটা ঘটনা ?
—ন, সে-সব বলবো না। থাক গে। কিন্তু
আজ এক বছরও হয়নি একটা অলৌকিক কাণ্ড দেখেছিলাম আমার এক যজমান-বাড়ি। সেইটাই বলি।
একটু চা করতে বলি?
এমন সময় আবার কালে মেঘ করে বৃষ্টি শুরু হোল। অন্ধকার হয়ে
এল চারিদিক। ঝড় উঠলো খুব ঠাণ্ড হাওয়ার। ছড় ছড় করে পাকা
জাম পড়তে লাগল চকৃত্তি মশায়ের বাড়ির সামনের গাছটা থেকে। নতুন জলে ব্যাঙ ডাকতে
লাগলে চারিদিকে।
চা এল। আমরা ছাতি নিয়ে বেরুইনি। এই বৃষ্টি মাথায় করে
যাবার উপায় নেই। বেশ জমিয়ে গল্প শুনবার জন্যে ভৈরব চক্ৰবৰ্ত্তীর মাটির দাওয়ায়
মাদুরের ওপর বসে গেলাম।
ভৈরব চক্রবর্তী আমাদের চা দিয়ে তামাক সেজে নিয়ে এলেন ।
তারপর শুরু করলেন গল্প বলতে :
আর বছর ভাদ্র মাসের কথা। এখনো বছর পোরেনি। আমার এক
যজমান-বাড়ি থেকে খবর পেলাম তার একটি মেয়ের বড় অসুখ । আমাকে তার বাড়িতে গিয়ে
বিরজা হোম করতে হবে মেয়েটির জন্য। বিরজা হোমে পূর্ণ আহুতি দিলে শক্ত রুগী ভালো
হয়ে যায়। আমি এমন সারিয়েছি।
আমাকে তারা নৌকো করে নিয়ে গেল গোবরডাঙ্গা স্টেশন থেকে
যমুনা নদীর ওপর দিয়ে। অজ পাড়াগা। ঘরকতক ব্রাহ্মণ ও বেশির ভাগ গোয়ালা ও বুনোদের
বাস। যমুনার ধারেই গ্রাম। গ্রামের মেয়েরা নদীর ঘাটেই স্নান করতে আসে।
—গ্রামের নাম কি?
—সাতবেড়ে। তারপর শুনুন। গ্রামে গিয়ে পৌছুলম বিকেলে। খুব
বন-জঙ্গল গ্রামের মধ্যে। একটা ভাঙা শিবমন্দির আছে, সেকেলে ছোট ইটের তৈরি। মন্দিরের মাথায় বট অশ্বখের গাছ গজিয়েছে। প্রকাণ্ড বড়
একটা শিবলিঙ্গ বসানো মন্দিরের মধ্যে, চামচিকের নাদিতে আকণ্ঠ ডোবা অবস্থায়। পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুদিন আগেই।
এই সময় আমাদের জন্য ভৈরব চক্রবত্তীর বড় মেয়ে শৈল চালভাজা
ও ছোলাভাজা নিয়ে এলো তেলমুন মেখে। ভৈরব চক্ৰবৰ্ত্তী বিপত্নীক, তার মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে সবে ক'দিন হোল, চলে গেলে চক্ৰবৰ্ত্তী
মশাই নিজেই রান্না করে খান।
আমরা সকলেই থাবার খেতে আরম্ভ করে দিলাম। ভৈরব চক্ৰবৰ্ত্তীও
সেই সঙ্গে। এখনও দিব্যি দাতের জোর, ওই বয়সে এমন চাল-ছোলাভাজা যে খেতে পারে, তার বহুদিনেও দাত নষ্ট হবে না।
তিনি খেতে খেতেই বলে চল্লেন‚ এই শিবমন্দিরটার কথা মনে রাখবেন, এর সঙ্গে আমার গল্পের সম্পর্ক আছে। তারপর আমরা গিয়ে সে
বাড়ি উঠে হাত-পা ধুয়ে জল খেয়ে ঠাণ্ডা হবার পর গৃহস্বামী একটি ঘরে আমায় নিয়ে
গেলেন। অমুস্থ মেয়েটি সেই ঘরে শুয়ে আছে। বয়েস তেরো-চোদ হবে, নিতান্ত রোগা নয়, বেশ মোটালোটা ছিল বোঝা যায়। গলায় একরাশ মাদুলি। মেয়েটি চোখ বুজে একপাশ ফিরে
শুয়ে আছে। আমি ঘরের মধ্যে ঢুকতেই এবার সে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে আবার পাশ ফিরলে।
মেয়েটির গায়ে জ্বর। বেশ জ্বর, তিনের কাছাকাছি হবে। চোখে ক্লান্ত দৃষ্টি, চোখের কোণ সামান্য লাল। নাড়ি দেখলাম, বেশ নাড়ি, শক্তই আছে । হঠাৎ
কোনো ভয়ের কারণ আছে বলে মনে হোল না। তাছাড়া, আমার ওপর মেয়ের চিকিৎসার ভার নেই, আমি এসেছি হোম করতে!
গৃহস্বামী বল্লেন—আপনি
আশীৰ্ব্বাদ করুন, পায়ের ধুলো দিন মাথায় ওর।
পায়ের ধুলো মাথায় দিতে যাচ্ছি এমন সময় হঠাৎ গৃহস্বামী
আছাড় খেয়ে পড়ে গেল খাটের পাশে। আমি চমকে উঠলাম। হাত নড়ে গেল। লোকজন দৌড়ে এল
কি হয়েছে দেখতে। কিছুই সেখানে নেই, না একটা-কলার খোসা না কিছু। লোকটি পড়লে কি করে? পায়ের ধুলো দেবার কথা চাপা পড়ে গেল। গৃহস্বামীর মাথায় ও মুখে ওর বড় শালা
ঠাণ্ডা জল দিতে লাগলো। মেয়েটি ফুপিয়ে কাদতে লাগলো। সে এক হৈ-চৈ ব্যাপার।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি তান্ত্রিক হোম করি। কিছু
কিছু দৈব ঘটনা বুঝি। লক্ষণ, প্রতিলক্ষণ, চিহ্ন আর ইঙ্গিত এই নিয়ে দৈব। গোড়াতেই এর লক্ষণ খারাপ বলে
যেন মনে হচ্ছে। তবে কি হোমে বসবো না? সন্ধ্যার কিছু পরে শিবমন্দিরের সামনের রাস্তায় পায়চারি করছি। বড় গরম।
বাড়ির মধ্যে হাওরা নেই। রাস্তায় তবু একটু হাওয়া বইছে। হঠাৎ আমার কানে গেল, কে যেন বলছে—শুনুন, শুনুন। দুবার কানে গেল কথাটা। এদিক ওদিক চাইতেই চোখে পড়লো
শিবমন্দিরের মধ্যে ঠিক দোরের গোড়ায় একটি কে মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে।
বল্লাম—আমায় বলছেন ?
—হ্যাঁ। ও খুকীর জন্য বিরজা হোম করবেন না। ও বাঁচবে না।
—কে আপনি ?
—আমি যে-ই হই । যদি ভাল চান, হোম করবেন না।
আমি বিস্মিত হোলাম। নির্জন, অন্ধকার, ভাঙা মন্দির। সেখানে এখন
মেয়েমানুষ আসবে কে? এমন আশ্চৰ্য্য কথাই বা বলে কেন? আমার খানিকটা রাগও হোল। আমার ইচ্ছার ওপর বাধা দেয় এমন লোক
কে?
মানুষ তো দূরের কথা, অপদেবতাকেও কখনও গ্রাহ করিনি। মায়ের আশীৰ্ব্বাদে সবই সম্ভব হয়। ভৈরব চক্রবর্তীকে
ভয় দেখানো সহজ নয়।
আমার এই অদ্ভুত দর্শনের কথা বাড়ি ফিরে কাউকে বল্লাম না।
রাত্রে বসে হোমের জিনিসপত্রের ফর্দও করে দিলাম। তারপর রাত আটট বাজল, গৃহস্বামী আমাকে রান্নাবান্না করতে বল্লেন। এইবার আমার
গল্পের আসল অংশে আসবো। তার আগে ওদের বাড়িটার সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার ।
বাড়িটা খুব পুরনো কোঠা বাডি, কোনো ছিরি সৌষ্ঠব নেই, কিন্তু দোতলা। পল্লীগ্রামে
দোতলা বাড়ি বড় একটা দেখা যায় না। যমুনা নদীর ধারে ঠিক নয় বাড়িটা, সামান্ত দূরে। মধ্যে কেবলমাত্র একখানা বাড়ি। ঐ বাড়ির ছাদ
আর এ বাড়ির ছাদের মধ্যে দশ-বারো ফুট চওড়া একফালি জমির বাবধান।
ছাদের ওপর একখানা মাত্র ঘর। সেই ঘরে আমার বিছানা পাতা
হয়েছে। পাশে খোলা ছাদে তোলা উনুনে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সোনামুগের ডাল, আতপ চাল, বড়ি, আলু আর ঘি । আমি একাই রাঁধছি, রান্নার সময় কাছে কেউ থাকে আমি পছন্দ করিনে। রান্নার আগে একবার চা করে খেলাম।
পরের তৈরি চা খেয়ে তৃপ্তি পাইনে।
রান্না করতে রাত হয়ে গেল। রাত সম্পূর্ণ অন্ধকার। একটু
জিরিয়ে তামাক খেয়ে নিয়ে ভাত বেড়ে নিলাম হাঁড়ি থেকে আঙট-কলার পাতে। তারপর খেতে
বসবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হোল ছাদে আমি একা নেই। এদিক ওদিক চাইলাম, কেউ কোথাও নেই, রাত বেশি হয়েছে, বাড়ির লোকও নিচের তলায় খেয়েদেয়ে
শুয়েছে, গ্রামই নিষুতি হয়ে গিয়েছে। কেবল যমুনা
নদীতে জেলেদের আলোয় মাছ ধরার ঠুক ঠুক্ শব্দ হচ্ছিল।
হঠাৎ খেতে খেতে মুখ তুলে চাইলাম।
আমার সামনে ছাদের ধারে ওটা কি গাছ? কালো মতো, লম্বা তাল গাছের মতো। এতক্ষণ ছাদে বসে রান্না-বাড়া করছি, কই অত বড় একটা গাছ নজরে পড়েনি তো এর আগে? ছিল নিশ্চয়ই, নয়তো এখন দেখছি কি করে। কি গাছ ওটা! সত্যি, যখন চা থেলাম, তখন দুটো বাড়ির মধ্যেকার ওই
রাস্তাটা দিয়ে একখানা গরুরগাড়ির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে আমাকে ওদিকে তাকাতে
হয়েছিল। তখন, কই তো অত বড একটা তাল গাছ—উঁহু, কই! নাঃ, দেখিনি ।
কিন্তু তাল গাছটা এমনভাবে—ও কি রকম তাল গাছ? ওকি! ওকি!
আমি ততক্ষণ বিভীষিকা দেখে ভাত ফেলে উঠে পড়েছি।
তাল গাছ না।
এখনো ভাবলে—এই দেখুন
গায়ে কাটা দিয়েছে। যদিও আমার নাম ভৈরব চক্কত্তি, তান্ত্রিক। পিছনের ছাদের কার্নিসের ওপর দাড়িয়ে এক বিরাটকায় অসুর কিংবা
দৈত্যের মত মূৰ্ত্তি, তার তত বড় বড় হাত প-সেই মাপে।
মাথাটা একটা ঢাকাই জালার মত, চোখ দুটো আগুনের
ভাটার মত রাঙা, আগুন ঠিকরে পড়ছে! আমার দিকেই
তাকিয়ে আছে অসুরট, যেন আমাকে জালিয়ে ভস্ম করে
ফেলবে।
বিরাট মূৰ্ত্তি। তালগাছের মতই লম্বা। অনেক উচুতে তার মাথাট।
নিচু চোখে সেটা আমার দিকে চেয়ে আছে।
ভালো করে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। দু’দুবার চোখ রগড়ালাম। দুবার চা খেয়ে কি এমন হোল? না। ওই তো সেই বিরাট, তাল শাল নারকোল গাছের মত তে-ঢ্যাঙা বেখাপ্পা অপদেবতার মূৰ্ত্তি বিরাজ করছে
সামনে জমাট অন্ধকারের মতো। এবার ভালো করে দেখে মনে হোল পিছনের ছাদে সেটা দাড়িয়ে
নয়, কোথাও দাড়িয়ে নেই—দুই বাড়ির
মধ্যেকার ফাকটাতে দাড়িয়ে বলা যায়! কারণ ওই জীবের নাভিদেশ থেকে ওপর পর্য্যন্ত
আমার সামনে। তার নিচেকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমার দৃষ্টিরেখার নিচে।
এ বর্ণনা করতে যত সময় লাগলো, অতটা সময় লাগেনি আমার বারকয়েক দেখতে জীবটাকে। এক থেকে দশ গুনতে যত সময় লাগে, ব্যস। আমি বলতে পারি অন্য যে কেউ ওই বিকট অপদেবতার মূৰ্ত্তি
অন্ধকারে নির্জনে ছাদে গভীর রাতে দেখলে আর গোলার ধানের ভাত খেতো না পরদিন।
আমি অপদেবতা দেখেছি, পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসলে জপের শেষের দিকে প্রায়ই ভয় দেখাতো। কিন্তু সে এ ধরনের
বিকট ও বিরাট ব্যাপার নয়। ভয় পেয়ে গেলাম। ঠক্ ঠক্ করে কাপতে লাগলাম। চক্ষে
অন্ধকার দেখে পড়ে যাই আর কি। পড়লেই হয়ে যেতো। দুর্বল মানুষ মরে ওদের হাতে। মন
সবল হোলে ওরাই পালায়।
নিজেকে তখুনি সামলে নিলাম। তারামন্ত্র জপ শুরু করলাম জোরে
জোরে। সেই দিকে চেয়ে মন্ত্র জপ করতে করতে ক্রমে মূৰ্ত্তি মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
মূৰ্ত্তিটা আমার সামনে সবসুদ্ধ দাড়িয়ে ছিল এক থেকে ত্রিশ
গুনতে যতটা সময় নেয় ততটা। এর খুব বেশী হবে না কখনো। সেটা মিলিয়ে যেতে আর একবার
চোখ রগড়ালাম, কিছুই নেই। বিশ্বাস করুন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিচের তলা থেকে কান্নাকাটি উঠলো। রুগী
মেয়েটি মারা গিয়েছে।
—তখুনি?
—তখুনি। এ ব্যাপারের কোনো ব্যাখ্যা দিতে আমি রাজী নই। যা
ঘটেছিল অবিকল তাই নিবেদন করলাম আপনার কাছে। বিশ্বাস করুন বা না করুন।
আপলোড: ২/২০১৮
ভালো গল্প
ReplyDeleteখুব সুন্দর উদ্যোগ। গল্পটা দারুণ।
ReplyDeleteকতবার পড়েছি ইয়ত্তা নেই,তাও পুরোনো হয় না।
ReplyDeleteঅসাধারণ
ReplyDeleteপ্রথম পড়লাম এই গল্পটা । খুব ভালো লাগলো । তাছাড়া বিভূতি বাবুর ছোটগল্প গুলি খুবই ভালো।
ReplyDeleteঅসাধারণ গল্পটা
ReplyDeleteবেশ ভয়ের
ReplyDeleteবেশ সুন্দর
ReplyDeleteঅসাধারণ লাগল 🙏
ReplyDelete