খগেন্দ্রনাথ মিত্র
এক টাকা সাড়ে তিন আনার গোলমাল! “আপ’
ও ‘ডাউন’ ট্রেনে টিকিট বিক্রয় পাওয়া যাচ্ছে ছাপ্পান্নখানা; কিন্তু মাশুল বাবদ রয়েছে
মোট একষট্টি টাকা দশ আনা। নতুন বদলি হয়ে এসেই গুনাগার! স্টেশনটি আবার এমন যে উশুল
করাবর জো নেই। পান আর মাছে কি হবে? তা ছাড়া এখন খাবার লোকও তো—
খাতা থেকে মুখ তুলেই ‘ছোটবাবু’ শ্রীরঞ্জন
চৌধুরী হাঁকলেন, “এই ফত্রিঙ্গা-ফত্রি-উঃ! যেমন মশার ডাক, তেমনই ডাকছে বেটার নাক।”
ছোটবাবুর তামাকের অভ্যাস আছে।
পিছনে তার ঘরের দরজায় ফত্রিঙ্গা কম্বল
মুড়ি দিয়ে ঘুমচ্ছিল। একে শীতকাল; তার ওপর রাত তখন দুটো। কিছুক্ষণ আগে ডাকগাড়ি ‘পাস’
হয়েছে, মালগাড়ীখানাও বিঘাটি স্টেশনে ধরে-ধরে। কাজেই ফত্রিঙ্গা নিশ্চিন্ত।
ছোটবাবু একবার ভাবলেন, নিজেই তামাকটুকু
সেজে নেন। কিন্তু ইচ্ছাটা প্রবল হ’ল না। আবার খাতায় টিক দিতে আরম্ভ করলেন।
“এইতো টিকিটের হিসেব দিব্যি মিলে যাচ্ছে।”
সহসা ছোটবাবুর শুষ্ক মুখের ওপর দিয়ে একটু বিষাদের হাসি খেলে গেল। মনে মনে বলেন, “তখন
কি জানতাম, একদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার হয়ে চন্দনপুর স্টেশনেই বদলি হয়ে
আসব। ওঃ! সে কত বছর আগেকার কথা! তখন এখানে এমন বাঁধানো প্ল্যাটফরম, পাকা স্টেশন ঘর,
ওয়েটিংরুম—কিছুই ছিল না। মাঠের মাঝখানে একখানা ছোট খড়ের ঘর, তার চাটাইয়ের বেড়া।
পিছনদিকে পাশাপাশি দুটো খাদ জলে ভরা। তাদের মধ্যে কলমি আর হেলঞ্চ বন। পাড়ের ওপর কাশের
ঝাড়। খাদের ওপারে কোয়ার্টারস—দুটো খাদের মাঝ দিয়ে সেদিকে যাতায়াতের পথ। তার শেষে
একটা বাঁকা নিম গাছ। প্ল্যাটফরমটা ছিল এত নিচু, ট্রেন থেকে নামবার সময় কয়েকবার ত
পড়তে পড়তে রয়ে গেছি। সে সব দিন আর নেই! হাঃ–হাঃ—অক্ষয় আর আমি—’’
ফত্রিঙ্গা কম্বলটা গায়ে-মাথায় জড়িয়ে
নিতে নিতে বললে—“কি বলছেন? ইসপিশ্যাল আসছে?”
শ্রীরঞ্জনবাবুর চমক ভাঙল। বললেন,
“না। একটু তামাক দিবি বাপ?”
স্টেশন থেকে একটা কাঁচা-পাকা সড়ক
চলে গেছে সোজা উত্তরে। সড়কটার দু’পাশে ঝোপঝাড়, জঙ্গল। তার মাঝে মাঝে চারণ খেজুর,
শিমূল, আম ও বাবলা গাছ নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সড়কের মাঝে দুটি খাল, গরুর গাড়ির
চাকায় তৈরি হয়েছে। দু'পাশে মাঠ, মাঠের শেষে গ্রাম। সড়ক ধরে ক্রোশদেড়েক ভাঙলেই চন্দনপুরের
বিল। বিলটা শেষ হয়েছে একেবারে অক্ষয়দের গ্রাম মালাড়ার পূবে। ঐ মালাড়াতেই ছিল, শ্রীরঞ্জনবাবুর
মামার বাড়ি।
ফত্রিঙ্গা তামাক এনে বলল, “নিন বাবু।”
শ্রীরঞ্জনবাবু হুঁকোটা নিয়ে নচে ধরে
এক মনে টানতে লাগলেন; তার বা হাতখানা রইল খাতার ওপর। ক্রমে ধোঁয়ায় তার মুখের চারধার
ঢেকে গেল।
“অক্ষয়টা-হাঃ হাঃ-একবার আখ-ক্ষেতে
আখ ভাঙতে গিয়ে— কি রে অক্ষয়?—তুই? এই রাতে—? বস্ বস্। সে কি, দাঁড়িয়ে থাকবি?” শ্রীরঞ্জনবাবু
আত্মহারা হয়ে পড়লেন।
অক্ষয় জিজ্ঞাসা করলে—“কবে এসেছিস?”
“দুটো রাতও কাটেনি। তোর চিঠি পেয়েছিলাম।
যা গোলমাল গেল ক দিন! উত্তর দেওয়া হয়নি। দেখ দেখি ভাই কি গ্রহের ফের! সেই চন্দনপুর
স্টেশনেই এলাম ছোটবাবু হয়ে? তারপর কি খবর? কিন্তু এই রাতে তুই?”
অক্ষয়ের আপাদ-মস্তক ঢাকা, কেবল মুখখানা
খোলা। তার স্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখ দুটোকে আরও উজ্জ্বল বোধ হচ্ছে; বলেন—“রঞ্জন, তোর চুল
সবই পেকে গেছে—”
“পাকবে না? কত বয়স হ’ল বল দেখি? তা
ছাড়া—কিন্তু তোর চেহারা বেশ আছে। বসছিস না কেন?”
অক্ষয় টেবিলের কাছ থেকে হাত-কয়েক
দূরে সরে গিয়ে টিকিট বাক্সের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। শ্রীরঞ্জনবাবুর মনে হ’ল,
অক্ষয়ের ব্যবহারে আন্তরিকতা নেই, সে যেন একটু দূরে সরে গেছে; বললেন, “তামাক খা। ওহহ্!
আমি ভুলেই গেছি, এই বদ অভ্যাসটা তুই করিসনি। হ্যাঁরে অক্ষয়! বিলের ধারে বটতলায় সেই
পোড়া মন্দিরটা এখনও আছে? মাঠের ধারের সেই আমগাছ কটা? আমার মামাদের ভিটে?”
অক্ষয় ঘাড় নেড়ে জানালেন—হাঁ। তারপর
জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই সপরিবারে এসেছিস?”
‘‘নাঃ। নতুন জায়গা—সব দেশে। আমাদের
দেশের কথা তোর মনে পড়ে?”
“হ্যাঁ। সেই চিঁড়ে, গুড়, নারকেল
আর সকলের ওপর কাকীমার যত্ন এখনও ভুলতে পারিনি।”
মায়ের কথা মনে পড়ে গেল; শ্রীরঞ্জনবাবু
একটা নিঃশ্বাস ফেললেন; তারপর বলেন—“যখন দেশে যাব ওদের আনতে, আসবার সময় তোর জন্য চিঁড়ে,
গুড়, নারকোল এনে মালড়ায় গিয়ে দিয়ে আসবো।”
“কিন্তু আমি ত আর ওখানে নেই।”
“সে কি? কোথায় আছিস? তোর স্ত্রী ছেলে-মেয়ে—?”
“তারা সকলেই আছে। কেবল আমিই চলে এসেছি।”
“এই বয়সে রাগ করে বিবাগী হয়েছিস?
কার ওপর রাগ, স্ত্রীর না ছেলের?”
“কারো ওপরেই আমার রাগ নেই। আর থাকতে
পারলাম না।”
“কোথায় যাচ্ছিস? এ কি ছেলেমানুষি?
সে হবে না—টিকিট ত আমার হাতে। ছাড়ছি না। বাড়ি না যাও, এখানে থাক। হতভাগারা এল বলে,
তোর খোঁজে। আমি নিজে তোর সঙ্গে—”
অক্ষয় একটু হাসলেন; তাঁর চোখে-মুখে
নির্লিপ্ত ভাব।
শ্রীরঞ্জনবাবু বললেন, “কোন গুরু পাকড়েছ
বুঝি? তিনি কানে মন্ত্র দিয়েছেন, কা তব কান্তা…”
ঠিক তখনই টেলিফোন বেজে উঠল—ঠং-ঠুং-ঠং।
বাইরে কোথায় কাকও ডাকছে। দূরে রেললাইনের ধার থেকে একপাল শিয়াল ডেকে উঠল—রাত শেষ হয়ে
এল।
“দাঁড়া ভাই। কাজটা সারি”—ভোরের গাড়ির
সময় হ’ল” বলে ছোটবাবু তাড়াতাড়ি উঠে হাত থেকে হুঁকোটা টেবিলের পায়ার গায়ে হেলান
দিয়ে রেখে টেলিফোনের কাছে গেলেন। তারপর ফোন ধরে হাঁকলেন, “হ্যাঁ, কি? লেট হয়নি? আসছে?
ওরে ফত্রিঙ্গা, এই ফতে! গাড়ির ঘণ্টা দে।”
সেখানকার কাজ সেরে টিকিট বাক্সের দিকে
যেতে যেতে বললেন, “তারপর ব্যাপারটা কি খুলে বল তো।”
বলতে বলতে হঠাৎই পিছনে তাকিয়ে দেখেন,
সেখানে অক্ষয় নেই! এদিক-ওদিক তাকালেন, কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না। দেখলেন, বাইরে যাবার
দরজার কাছে বসে ফত্রিঙ্গা তার বিছানাটা গুটিয়ে নিচ্ছে। শ্রীরঞ্জনবাবুর বিস্ময়ের সীমা
থাকল না। ঘরের দুটি দরজা, দুটি জানালাই ত বন্ধ। টিকিট দেবার ঘুলঘুলিটাও আঁটা।
শ্রীরঞ্জনবাবু ফত্রিঙ্গাকে জিজ্ঞাসা
করলেন, “বাবুটি কোথায় গেলেন দেখেছিস?”
“কৌন্ বাবু?”
“যে বাবু একটু আগে এসেছিলেন?”
“কৌনো বাবু ঘরমে ঘুসা নেহি”
শ্রীরঞ্জনবাবু তাড়াতাড়ি তার ঘরের
মধ্যে গিয়ে ঘরখানা পরীক্ষা করে এলেন। সেখানেও অক্ষয় নেই!
ফত্রিঙ্গা ঘণ্টা দিচ্ছে। পয়েন্টসম্যান
ফাগু এসে সিগনালের তালার চাবি নিয়ে গেল।
শ্রীরঞ্জনবাবু অন্যমনস্কর মত টিকিট
বাসের ডালাটা খুললেন, টিকিট দেবার ঘুলঘুলিটার ঢাকা সরিয়ে নিলেন। তৎক্ষণাৎ সেখান দিয়ে
একখানা কালো হাত ভেতরে এল। ওপাশ থেকে হাতের মালিক বললে, “বাবু, ষষ্টিপুর সাড়ে তিনখানা”
এরপর শোনা যেতে লাগল টাকা-পয়সার শব্দ,
টিকেটে ছাপ দেবার আওয়াজ—ঘটাং—ঘটাং—ঘটাং…
ওদিক থেকে হাতের মালিক বললে, “বাবু!
দুটো পয়সা কম নেন। গরীব মানুষ!”
“ধ্যাৎ! কৈ হে, আর কে আছে? এই সরে
যাও ওখান থেকে।”
টিকিট দিতে দিতে শ্রীরঞ্জনবাবু নিজের
মনেই বলে উঠলেন, “তখন নিশ্চয়ই আমার তন্দ্রা এসেছিল। তন্দ্রার ঘোরে স্বপ্ন দেখেছিলাম।”
স্থির করলেন, অক্ষয়কে তার আগমন-সংবাদ
জানিয়ে চিঠি দেবেন। তবুও তিনি মনে শাস্তি পেলেন না।
ক্রমে টিকিট দেওয়া শেষ হ'ল। ওদিকে
তখন পূব দিক ফরসা হয়ে এসেছে। গাড়ির হুইসিল শোনা গেল।
শ্রীরঞ্জনবাবু কম্ফর্টারের ওপর মাথায়
গোল টুপি চড়িয়ে কলম হাতে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালেন। তাকিয়ে দেখলেন, গাড়ি হোম-সিগন্যাল
পার হচ্ছে। ঐ ঝিকমিক করছে ইঞ্জিনের আলো।
আবার ঘণ্টা পড়ল। দেখতে দেখতে গাড়ি
এসে থামল। যাত্রীরা উঠছে, নামছে, ছুটছে, চিৎকার করছে; দরজা বন্ধ হচ্ছে, খুলছে। চারধারে
ব্যস্ততা ও শব্দ। শ্রীরঞ্জনবাবু গার্ডের গাড়ির কাছ থেকে মাথার ওপর হাত নেড়ে হাঁকলেন,
“ঘণ্টা…”
ঘণ্টা পড়ল, গার্ড হুইসিল দিতে দিতে
লণ্ঠন দোলাতে লাগল, ইনজিন হুইসিল দিয়ে সশব্দে চলতে আরম্ভ করল। শ্রীরঞ্জনবাবু জন-দুই
যাত্রীর কাছ থেকে টিকিট সংগ্রহ করে স্টেশনঘরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন।
এদিকে পূবের আলো ততক্ষণে আকাশ বেয়ে
পশ্চিমে পৌঁছেছে, নীচের অন্ধকার গলে পাতলা হয়ে উবে যাচ্ছে; কিছুদূরের মানুষকে বেশ
চেনা যায়।
শ্রীরঞ্জনবাবু, দেখলেন, একটি যুবক,
তার পাশে একটি কিশোরী, তাদের পাশে একজন লোক আসছে। লোকটার মাথায় বিছানা ও ট্রাঙ্ক।
তারা সেই ট্রেন থেকেই নেমেছে। তারাও স্টেশন ঘরের দিকে আসছিল। তার গায়েই স্টেশন থেকে
বের হবার দরজা।
তারা তিনজনে শ্রীরঞ্জনবাবুর কাছাকাছি
হতেই তিনি তাদের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন। দেখেই বলে উঠলেন, “অক্ষয়ের জামাই না?
ঐ ত ওর পাশে কমলা। আর ঐ যে ওদের রাখাল, মধু। নিশ্চয়ই অক্ষয় এসেছে। আমি স্বপ্ন দেখিনি।
কিন্তু সে পালাল কেন?”
উঁচু গলায় বললে, “বাবাজী যে? ভাল
ত? মা কমলা!”
অক্ষয়ের জামাতাবাবাজী, মেয়ে কমলাও
এবার তার দিকে ভাল করে তাকাল।
জামাতাবাবাজী নমস্কার করে বললে, “আজ্ঞে
হাঁ।”
কমলা তার মেয়ে গৌরীর বয়সী। গৌরী
নেই। তিনি বলেন—“কেমন আছ মা? তোমার বাবা ত…”
কমলা তার পায়ের ধুলো নিয়ে সোজা হয়ে
দাঁড়াতেই তিনি দেখলেন, তার দু’চোখে জল টলটল করছে।
তিনি বিস্মিত ও ব্যথিত হয়ে বলে উঠলেন,
“তোর চোখে জল কেন মা?”
জামাতাবাবাজী বললে—“জানেন না? সাত
দিন হ’ল শ্বশুরমশায় স্বর্গারোহণ করেছেন—”
“সাত দিন হ’ল মারা গেছেন—”
“কিন্তু—আমি যে…
শ্রীরঞ্জনবাবুর মুখ দিয়ে আর একটি
কথাও বার হ’ল না। ক্ষণিকের জন্য তিনি স্মৃতির মাঝে চেতনা হারিয়ে ফেললেন। সহসা ফত্রিঙ্গার
ডাকে ফিরে দেখেন, জামাতাবাবাজীরা তিনজনে গেট পার হয়ে, পথের ধারে একখানা ছইওয়ালা গরুর
গাড়ীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি আর সেখানে দাঁড়ালেন না; স্টেশনঘরের দিকে চলতে লাগলেন।
সেদিন কোয়ার্টারসে যাবার আগে তিনি
এক টাকা সাড়ে তিন আনার হদিস পেলেন, কিন্তু অক্ষয়ের সঙ্গে নিশীথে সাক্ষাৎ, স্বপ্ন
কি সত্য, তার মীমাংসা করতে পারলেন না।
No comments:
Post a Comment