Friday 1 January 2021

অলৌকিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): কপিল সিদ্ধাইয়ের কবচ (শিশির বিশ্বাস)

 


কপিল সিদ্ধাইয়ের কবচ

শিশির বিশ্বাস

গল্প পদিপিসির কাছে শোনা। পদিপিসির অন্য এক গল্প আগে শুনিয়েছি। সে গল্প যারা পড়েননি তাদের বলি আমাদের এই পদিপিসি খ্যাতনামা লেখিকার বিখ্যাত গল্পের পদিপিসি নয়। অতি সামান্য মানুষ। বাড়ি বাড়ি কাজ করে দিন গুজরান করতেন। কয়েক মাস আমাদের বাড়িতেও ছিলেন। স্বামীহারা নিরক্ষর মহিলাটির তখন এক অন্য পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল।

পূর্ব বাংলার দক্ষিণের জেলা নোয়াখালী অথবা চট্টগ্রামের মানুষ ছিলেন। অল্প দিন হল দেশ ছেড়ে আসার কারণে শহর কলকাতার কথা তেমন রপ্ত করে উঠতে পারেননি। তবু আমাদের কাছে তাঁর গল্পের আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার। জমিয়ে দারুণ গল্প বলতে পারতেন যে।

একটু গোড়া থেকেই বলি তাহলে। নদীনালার দেশ পূর্ববাংলা বরাবরই মাছের দেশ। সেই মাছ ধরাই ছিল পদিপিসিদের জীবিকা। শুধু পুরুষ নয় প্রয়োজনে বাড়ির মেয়েদেরও লেগে পড়তে হতো কাজে। বর্ষায় নদীনালা যখন জলে পূর্ণ তখন সুবিধা ছিল। গ্রামে থেকেই কাজ চলত। বাড়ির মেয়েদের তখন শুধু ঘরের কাজ। কিন্তু যখন নদীখালের জলে টান ধরত তখন নৌকো নিয়ে বাড়ি সুদ্ধ সবাই চলে যেত অনেক দূরে মোহনার কাছে। সেখানেই কোনো সুবিধাজনক জায়গায় অস্থায়ী ঘরপুরুষেরা দিনভর মাছ ধরত। মেয়েদের কাজ সেই মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা। তারই মধ্যে কোনো এক ফাঁকে মাঠ থেকে তোলা শাক দিয়ে ভাত আর তেঁতুলের টক। শুঁটকির উৎকট গন্ধে মাছ খাওয়ার কথা কেউ ভাবতেও পারত না।

কথাগুলো যত সহজে বলা গেল প্রকৃত কাজ অত সহজ ছিল না। নদী মোহনার নির্জন বিদেশ বিভূঁই স্থানে আস্তানা গেড়ে এভাবে দিনের পর দিন বাস করা খুব সহজ নয়। পদিপিসিই একদিন বলেছিলেনপ্রতি বছর বাঘের আক্রমণ আর সাপের কামড়ে মারা পড়ত একাধিক মানুষ। তা গরীব মানুষের জীবনের দাম কানাকড়িও নয়। কেউ মাথাও ঘামাত না। এর উপর ছিল ডাকাত। চড়াও হলে কয়েক মাসের মেহনত বরবাদ। সব লুঠ করে নিয়ে চলে যেত। তারপর কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ঘরে ফিরে আসা। এছাড়া ছিল মেছো ভূত। পূব বাঙলায় ওদের বলা হত মাইছা দেউসারা দিন মাছ ধরে ঝুড়ি বোঝাই হয়েছে। সব শুকোতে দেওয়া যায়নি। সন্ধেয় হঠাৎ সেই ঝুড়ির দিক থেকে খচমচ আওয়াজ। টের পেয়ে হইহই করে সবাই ছুটে যাবার আগেই ঝুড়ির অর্ধেক সাফ।

সেদিন রাতে পদিপিসির গল্প শুরু হয়েছে। কলকাতার লাগোয়া হলেও আমাদের শহরতলী অঞ্চল তখনো গ্রামই বলা যায়বাইরে ঝিমধরা অন্ধকার। ঝিঁঝির কোরাস। ভূতের কথা উঠতে আমরা ছোটরা তাঁর কাছে ঘেঁসে এসেছিলাম। পিসি আজ তাহলে একটা ভূতের গল্পই বলো।

তাহলে শোন বাপু।কিছুমাত্র না ভেবে পদিপিসি শুরু করলেনতাহলে মাইছা দেউ নয় বরং অন্য এক গল্প বলি। সেবার মাছ ধরতে যাওয়া হয়েছিল নদীমোহনা ছাড়িয়ে নির্জন এক দ্বীপে। চারদিকে শুধু মাকড়শার জালের মতো খাল। ধারেকাছে গ্রাম জনমানুষ বলতে কিছু নেই। এত দূরে যাওয়া হবে বলে দলও সেবার বেশ ভারি ছিল। সব মিলিয়ে গোটা তিরিশের মতো নৌকো। কয়েকশো মানুষ। কুমিরখালির চরে গোলপাতায় ছাওয়া শতখানেকের মতো ঘর। অস্থায়ী এক গ্রাম বলা যায়। চরের ঘাস হালকা ঝোপঝাড় সাফ করে মাঠ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। মাছ শুঁটকি করার জন্য ঝুরঝুরে বালি বোঝাই মাঠ। দিনভর মেয়েরাই তার দেখভাল করে। তবে জোয়ানমদ্দ চেহারার পুরুষ মানুষও থাকে কয়েকজন। অত বড় মাঠ পাহারা দেওয়া কী সহজ কাজ!

কেন?’ পদিপিসি সামান্য থামতেই একজনের প্রশ্নভুতের ভয় বুঝি?’

না রে পাগল।পদিপিসি হেসে উঠলেনমাইছা দেউ মানে মেছোভূত অত ভয়ানক নয়ওদের সামাল দেওয়া যায়। যায় না অন্যদের। এক তো দ্বীপের চরে রোদ পোয়াতে আসা কুমিরের দেখা মিলতো হামেশাই। তার উপর ছিল বড় শেয়ালের তাণ্ডব।

বড় শেয়াল! সে কী!

বলছি রে বাপু। বড় শেয়াল হল বাঘ। সুন্দরবনে গিয়ে ওদের তো নাম করতে নেই। মা বনবিবির পোষ্য যে গোঁসা হন তিনি। তাই বাদার মানুষ বাঘকে বড় শেয়াল বলেই ডাকে। তা কুমিরখালি চরে গাছপালা সাফ করে ফেললে কী হবে সুযোগ পেলেই নদী পার হয়ে হানা দিয়ে যায় তারা। তা সুন্দরবনের বাঘ আবার শুধু হরিণ–শুয়োর নয় তেমন হলে মাছেও আপত্তি নেই। এদিকে  দিনভর চরের বালিতে কয়েকশো মন মাঝ শুকোনো হচ্ছে। গন্ধে তারা হানা দিয়ে যায় মাঝেমধ্যেই। যত না খায় নষ্ট করে বেশি। তাই কড়া নজর রাখতে হয়। চোখে পড়লেই লাঠিসোটা নিয়ে হইহই করে তাড়া। সেই তাড়া খেয়ে সরে পড়ে বেশিরভাগই। তবে ব্যতিক্রমও হয়ে যায় কখনো। সেবার এমনই এক বাঘ হানা দিয়েছিল কুমিরখালির চরে। প্রথম যেদিন নজরে পড়ে লাঠিসোটা নিয়ে তাড়া করতে পালিয়ে গেলেও পরের দিনই হানা দিয়েছিল ফের।

‘বাঘটা যে সুবিধের নয় এরপর বুঝে ফেলতে সময় লাগেনি। সেই কারণেই এরপর দিনের বেলা ছেলেদের সবাই যখন নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে যেত চরে থেকে যেত কয়েকজন। অনুমানে ভুল হয়নি। বাঘটা দিনের বেলা নদী পার হয়ে হানা দিচ্ছিল মাঝেমধ্যেই। তারপর দিন কয়েক কাঁচা মাছ দিয়ে আহার সারার পর সাধ হয়েছিল মানুষের মাংস দিয়ে একটু স্বাদ পালটাবার। দুপুরের দিকে মেয়েদের কয়েকজন যখন ঘরে রান্নায় ব্যস্ত বাঘটা চুপিসাড়ে মাছ শুকোবার মাঠ নয় চলে এসেছিল এদিকের চালাঘরের দিকে। তারপর ঢুকেও পড়েছিল এক ঘরের ভিতর। কিন্তু কাজ সারতে পারেনি। ঘরের ভিতর তখন কড়াইতে ডাল চাপিয়েছে মনোহর সর্দারের বউ বৃন্দে। তেজে সেও কম যায় না। বাঘ ঘরে ঢুকতে গন্ধে সেও বুঝে ফেলেছে ব্যাপারটা। তই ঘাড় ফিরিয়ে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেনি। উনুন থেকে জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ টেনে বের করে উঁচিয়ে ধরেই পরিত্রাহি চিৎকার।

বাঘবাঘ!

বাঘটা সবে তখন দরজা দিয়ে ভিতরে মাথা গলিয়েছে। যদি পালিয়ে যেত প্রাণে বাঁচত বোধ হয়। কিন্তু কপালে শনি তাই শিকার ধরার আশা তখনো ছাড়েনি। উলটে ঘড়ামকরে রক্ত জল করা হাঁক। ভেবেছিল হাঁকের দাপটে শিকারের হাতের আগুন খসে পড়লেই টপ করে তুলে নেবেকিন্তু বৃন্দেও কম নয়। ভয়ে পিছোতে গিয়ে উনুনের পাশে চিৎপাত হয়ে পড়লেও হাতের জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ ছাড়েনি। ততক্ষণে সড়কি আর কুড়ুল হাতে ছুটে এসেছে অনেকেই। বেগতিক বুঝে বাঘটা এরপর পালাবার উপক্রম করেছিল ঠিকই। কিন্তু সেই চেষ্টা আর সফল হয়নি। তার আগেই সড়কি ছুঁড়ে পেড়ে ফেলা হয়েছিল। তারপর কুড়ুলের কোপে নিকেশ।

তারপর?’ তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করেছিলাম আমি। এত তাড়াতাড়ি পদিপিসির গল্প শেষ হয়ে যাক একেবারেই পছন্দ নয়।

তারপর আর কী? ফিরে আসার বেশ কয়েক মাস পরে খুলনার বাজারে সেই বাঘের ছাল বিক্রি করে মিলেছিল পুরো হাজার টাকা। কিনেছিল এক লালমুখো মেলেটারি (মিলিটারি)  সাহেব। অত বড় বাঘের চামড়া আগে নাকি দেখেননি তিনি। মামুলি এক বাঘের চামড়া বেচে অত টাকা পাওয়া যাবে আশাই করেনি কেউ। সেবার প্রাপ্তি বলতে ওই টাকাটাই! ভাগ করে নিয়েছিল সবাই।

কেন মাছ? মাছ যা শুঁটকি হল?’

তা শুঁটকি কিছু আনা গিয়েছিল। কিন্তু বেচা যায়নি। কে কিনবে? যখন ফেরা হল গঞ্জের হাটই নেই। সব লোপাট।

কেন?’

সেটাই তো আসল গল্প রে বাপু। বাঘের গল্প তো ফাউ।পদিপিসি সামান্য দম নিয়ে ফের শুরু করলেনবাঘের ঝামেলায় পড়লেও সেবার শুরুটা কিন্তু ভালই হয়েছিল। মাছও ধরা পড়ছিল ভালই। তার একটা কারণ দলের সঙ্গে হরেন ছিল সেবার। হরেনের বয়স বেশি নয় কিন্তু অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল ওর। জলের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারত সেখানে মাছের বড় ঝাঁক আছে কিনা। হরেনের অনুমানে ভুল হত কদাচিৎ। সেইভাবে জাল ফেললে এক দফাতেই প্রায় নৌকো ভরতি মাছ।

এ ব্যাপারে হরেনের এতটাই নামডাক হয়েছিল যে মরশুম এলে দূরের গ্রাম থেকেও ডাক আসতো ওর। কিন্তু সেবার এক ঘটনার পর হরেন আর নৌকোয় মাছধরা দলের সঙ্গে বের হয়নি। সেই অবস্থাও ছিল না। ভয়ানক সেই ঘটনার কথা তারপর মাসের পর মাস আশপাশের গোটা কয়েক গ্রামে মুখে মুখে ফিরেছে। কোনো সমাধান হয়নি।

দম নেবার জন্য পদিপিসি থামলেন। বলা বাহুল্য নিমেষে সামনে বসা শ্রোতাদের মুখে প্রশ্নের ঝড়। কেন? কী হয়েছিল পিসি?’

সে এক ভয়ানক ব্যাপার।বলতে বলতে পদিপিসি হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গেলেন। চোখের দুই কোল চিকচিক করে উঠল। তারপর মুহূর্তে সামলে নিয়ে ফের শুরু করলেনজলের তলায় মাছের ঝাঁকের হদিশ টের পেলেও সারা বছর তো আর মাছধরার কাজ থাকত না। হরেন তাই সময়ে অন্য কাজও করত। সেবার হরেন পাশের বাড়ির প্রমথকে নিয়ে ভিন গাঁয়ের চৌধুরীবাড়ি গিয়েছিল জন খাটতে। দুজনের প্রায় একই বয়েস। সর্বক্ষণের সঙ্গী।

চৌধুরী কত্তারা জমিদার মানুষ। খেতের কাজে সারা বছরই লোকজনের দরকার। সেবার হরেন আর প্রমথও গিয়েছিল। মাস দেড়েকের কাজ। রাতে দুজনের শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল কত্তাবাবুদের কাছারিঘরে। মস্ত কাছারিঘরের একদিকে ঢালাও তক্তপোষ। দশবরোজন অনায়াসে শুতে পারে। ঘরের অন্য দিকে কত্তাবাবুদের গাজনের থান। জোড়া ত্রিশূল বসানো সিঁদুর মাখা নক্সাকাটা সেগুন কাঠের হাত দেড়েক লম্বা গাজনের আসন থাকে সেখানে। প্রতিদিন ধূপধুনো দেওয়া হয়। কত্তাবাবুদের এই গাজনের আসন নিয়ে তল্লাটে হরেক কথা শোনা যেত। সারা বছর কাছারিঘরে রাখা থাকলেও চৈত্র মাস পড়লে শুরু হত উৎসব। আশপাশের দশবারোটা গ্রাম থেকে সন্ন্যাস নিয়ে আসতো কয়েকশো মানুষ। সেই আসন মাথায় নিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে ঘোরা হত আশপাশের গোটা কয়েক গ্রামের বাড়ি বাড়ি। সঙ্গে শিবপার্বতীর নাচগান। সে এক হইহই ব্যাপারধামা ভরতি সিধে মিলত। সারা মাস ধরে চালডাল জমা হত কম নয়। তবে চৌধুরীবাবুরা তার পরোয়া করতেন না। গাজন উপলক্ষে খরচ করতেন দুই হাতেচড়ক সংক্রান্তির দিন কয়েক আগে থাকতে ঢালাও খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। কুঠিবাড়ির মাঠে সেই উপলক্ষে মস্ত মেলা। চড়ক দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসত। এককথায় মহোৎসব। তারপর উৎসব মিটে গেলে গাজনের আসন ফের এনে রাখা হত কাছারিঘরের যথাস্থানে।

কত্তাবাবুদের এই গাজনের আসন নিয়ে নানা গল্পকথা লোকমুখে ভেসে বেড়াত। ভীষণ জাগ্রত নাকি ওই আসন। স্বয়ং মহাদেব বাঁধা রয়েছেন।

কাছারিঘরের যেদিকে গাজনের আসন সেদিকটা ঘেরা থাকলেও অন্য প্রান্তে খোলা বারান্দার দিকে বেড়া ছিল না। গ্রামের কাছারিঘরে তেমন থাকেও না। সারাদিন অবারিত দ্বার। হরদম মানুষ যাওয়াআসা করে। বারান্দায় ঝোলানো থাকে অন্তত গোটা দশেক হুঁকো। বাঁশের চোঙা ভরতি তামাক আর তাওয়ায় টিকের আগুন। তা সেদিন দিনভর খাটাখাটুনির পর হরেন আর প্রমথ কাছারিঘরের সেই তক্তপোষে শুয়েছিল। ওরা দু’জনই ছিল সেদিন। অনেক রাতে খুব কাছেই আচমকা মচমচ আওয়াজে হরেনের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল হঠাৎ

‘সেদিন শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী। খোলা বারান্দার দিক থেকে জ্যোৎস্নার ফুটফুটে আলো ঘরে এসে পড়েছে। গোড়ায় ভেবেছিল বিড়াল বোধ হয়। কিন্তু ফুটফুটে আলোয় ঘরের ভিতর তেমন কিছু নজরে পড়ল না। তারপরেই চোখ পড়ল বারান্দার ওধারে বাইরে উঠোনের দিকে। মুহূর্তে ধক্‌ করে উঠল বুকের ভিতর।

অল্প থেমে পদিপিসি শুরু করলেন আবারসেকালে গ্রামের জমিদার বা ধনী পয়সাওয়ালা মানুষের বসতবাড়িতে দুটো অংশ থাকত। একটা ভিতরবাড়ি। সেদিকে শোবার ঘর রান্নাঘর ঢেঁকিঘর প্রভৃতির দরজা। সেখানে বাইরের মানুষ খুব একটা যেত না। এ ছাড়া ছিল বাইরের বাড়ি। সেদিকে কাছারি গোয়াল ধানচাল রাখার ঘর। এছাড়া গোবর লেপা বিশাল এক ঝকঝকে উঠোন। ফসল ঝাড়াই মাড়াইয়ের কাজ হত সেখানেই। সেই উঠোন কত বড় হত না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। ঝাঁট দিতে দুজন মানুষ ঘেমে নেয়ে উঠত।

জ্যোৎস্নার আলোয় হরেন পরিষ্কার দেখতে পেল সেই উঠোনের মাঝে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়। এই রাতে প্রাকৃতিক কাজে কারো বের হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু এই মানুষ একেবারেই অন্য রকম। সম্পূর্ণ অপরিচিত। সে সময় গ্রামে সবাই মোটামুটি চেনাপরিচিত। এক হাটে কেনাকাটা করতে আসে বিশ গাঁয়ের মানুষ। চেনা হয়ে যায়। কিন্তু এমন কাউকে কোনো দিন দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। সম্পূর্ণ অপরিচিত। অত উঁচুলম্বা মানুষও আগে চোখে পড়েনি। দুই চোখ যেন আগুনের ভাঁটা। তাকানো যায় না। ছাই মাখা খালি গা। জট পড়া লম্বা চুল চুড়ো করে বাঁধা। গলায় রুদ্রাক্ষ।

নিশুতি রাতে সদ্য ঘুম ভেঙে চোখের সামনে ওই দৃশ্য সহ্য করা সহজ নয়। হরেনও পারেনি। পাশেই শুয়ে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু প্রমথ। ডাকতে গিয়ে গলা দিয়ে স্বর বের হল না। থম হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। অদূরে উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা হঠাৎই নড়ে উঠল তারপরপায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল কাছারিঘরের দিকে। সামান্য নীচু হয়ে খোলা বারান্দা পার হয়ে ঘরের ভিতর এসে গাজনের আসনের দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই ফের সেই মচমচ আওয়াজ। সারা কাছারিঘর কেঁপে উঠল যেন। মানুষটি তখন মাত্র হাত কয়েক দূরে। প্রায় নিঃশ্বাস ফেলা দূরত্বে। দারুণ আতঙ্কে হরেন কাঠ হয়ে রয়েছে তখন। চোখ বন্ধ। ওই সময় হঠাৎই একদল কুকুর কাছারিঘরের পিছনে খালের দিক থেকে খ্যাঁকখ্যাঁক শব্দে চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল। 

আর তারপরে কাছেই ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ। হরেন চোখ মেলে দেখল জটাজুটধারী বিশাল শরীরের মানুষটা প্রায় বাতাসের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। তাই দেখে স্বস্তিতে দম ফেলতে যাবে পাশে প্রমথ হঠাৎ উঠে বসে তক্তপোষ থেকে নেমে পড়ল।

ওর মতো প্রমথও যে ঘুম ভেঙে সব দেখেছে টের পেল হরেন। তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরে বলল কোথায় যাচ্ছিস?

ঠোঁটের উপর আঙুল তুলে প্রমথ চাপা গলায় বলল দাঁড়া সাধুবাবা কোথায় যায় দেখে আসি। গাজনের আসনের দিকে তখন থম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন উনি। হঠাৎ কুকুরের পাল ডেকে উঠতেই ছুটে চলে গেলেন। তুই যাবি নাকি?

প্রমথ বরাবরই ডানপিটে গোছের। ভয়ানক সাহস। ওই নিশুতি রাতে হঠাৎ সাধুবাবাকে দেখে একটুও ঘাবড়ায়নি! হরেনের ভয় কিন্তু কিছুমাত্র কাটেনি তখনো। নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।

অগত্যা প্রমথ একাই চলে গিয়েছিল তারপর। ফিরে এলো মিনিট পনেরো পরে। হরেন তাকিয়ে দেখল অমন ডাকাবুকো প্রমথর চোখমুখ দারুণ আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে। সারা শরীর কাঁপছে।

কী হয়েছে রে প্রমথ? কৌতূহলে হরেন জিজ্ঞাসা করল।

জবাব দিতে প্রমথর অনেকটা সময় লাগল। কাঁপতে কাঁপতে ফের হরেনের পাশে শুয়ে পড়ে বলল হরেন এখানে আমি আর কাজ করব না। কালই বাড়ি ফিরে যাব।

কেন?

ওই সাধু মানুষ নয়। রাক্ষস।

প্রমথর সেই জবাব শুনে হরেন তো থ হবার জোগাড়। কাঁপা গলায় বলল কেন রে?

উত্তরে প্রমথ একবারে সব বলতে পারেনি। সারা শরীর তখন ঠকঠক করে কাঁপছে। কাটাকাটা অসংলগ্ন ভাবে যা জানাল তা সত্যিই খুব ভয়ানক। কাছারিঘরের পিছনে অল্প দূরে এক খাল। নদীর সঙ্গে যোগ থাকায় জোয়ারভাটা খেলে। সারা বছর জল থাকে। ফুটফুটে জ্যোৎস্না থাকায় ঘর থেকে বেরিয়ে সাধুকে খুঁজে পেতে বেশি দেরি হয়নি প্রমথর। সাধু দ্রুত পায়ে হনহন করে সেই খালের দিকে চলেছে। অগত্যা প্রমথ আর এগোয়নি। দূরে দাঁড়িয়ে নজর রাখছিল।

খালের পাড়ে এক জায়গায় জলে ভেসে আসা একটা আধপচা মড়ার দখল নিয়ে একপাল কুকুর চ্যাঁচামেচি শুরু করেছে। প্রমথ অবাক হয়ে দেখল সাধুবাবা প্রায় ছুটে সেই কুকুরের পালের ভিতর ঢুকে পড়ল। জলে নেমে মৃতদেহটা তুলে আনল উপরে। পচে ফুলে ওঠা দেহ। নিমেষে ঝুঁকে পড়ল সেই আধপচা মড়ার উপর। জ্যোৎস্নার আলোয় দূর থেকেও প্রমথর ভুল হয়নি দেখতে সাধুবাবা মুখ নামিয়ে সেই মড়া খাচ্ছে। পিছনে খানিক দূরে কুকুরের জটলা। ফাঁকেফাঁকে তারাও ছোঁ মেরে মৃতদেহের একআধ খাবলা মাংস ছিঁড়ে নিচ্ছে। ওই ভয়ানক দৃশ্য প্রমথ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেনি। পালিয়ে এসেছে। আর এক দিনও এখানে থাকবে না সে।

পরের দিন ভোরে কত্তাবাড়ির এক কাজের বউ কাছারিঘর ঝাঁট দিতে এসে প্রথম খেয়াল করল হরেন বা প্রমথ তখনো বিছানায় শুয়ে। বিড়বিড় করে সমানে ভুল বকছে। গায়ে ধুম জ্বর।

 ‘তাদের নিয়ে বাড়ির কয়েকজন যখন ব্যস্ত তার মধ্যেই অন্য এক ব্যাপারে চৌধুরীবাড়ি তো বটেই সারা গ্রাম প্রায় তোলপাড় হবার জোগাড়। চৌধুরীবাবুদের কাছারিঘরের পিছনে খালের পাড়ে একটা আধপচা মড়া পড়ে রয়েছে। শেয়ালকুকুরের দল তার অনেকটাই খেয়ে ফেলেছে।

গ্রামে মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেবার রেওয়াজ আছে। সলিল সমাধি বলা হয়। সেই মৃতদেহ কখনো খালেও ভেসে আসে। কিন্তু সেই মৃতদেহ জল থেকে পাড়ে টেনে তোলা শেয়াল বা কুকুরের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজটা কার ভেবে কিনারা করতে পারেনি কেউ। গ্রামে তাই নিয়ে সকাল থেকে শোরগোল। যারা ব্যাপারটার উপর আলোকপাত করতে পারত সেই হরেন আর প্রমথ তখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। জ্বর ক্রমশ বাড়ছে। সেই সাথে ভয়ানক কাঁপুনি। ধরাধরি করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলেও দুজনের জ্বর বেড়েই চলল ক্রমশ।

ডাক্তারবদ্যি ডেকেও বিশেষ ফল হল না। শেষ পর্যন্ত মারাই গেল প্রমথ। মাস কয়েক ভুগে হরেন সেরে উঠল বটে তবে শরীরে সামান্য শক্তিও নেই। দুইপা হাঁটলেই ধুঁকতে থাকে। তবে সেই রাতের কথা এরপর জানা গিয়েছিল হরেনের কাছেই। তাতে রহস্য ঘনীভূতই শুধু নয় ভয়ানক আতঙ্কও ছড়িয়েছিল চারদিকে। সেই নিশুতি রাতে চৌধুরীবাবুদের কাছারিঘরে কে এসেছিল তার কিনারা হয়নি। বরং আতঙ্ক আরো ডালপালা ছড়িয়েছিল।

সে যাই হোক হরেন প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রায় পঙ্গু তখন। সারাদিন ঘরে বসে। কয়েক পা গেলেই হাঁফ করে যায়। এভাবে প্রায় বছর পাঁচেক কেটে গেছে তারপর। সময়ের প্রভাবে হরেন আরো কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে তখনহাঁটাচলা করতে লাঠির দরকার হয় না। তা সেবার গ্রামের সবাই মোহনায় শুঁটকিমাছের কাজে বের হবে সাঁইদার নগেন সর্দার বলল হ্যাঁরে হরেন মোটামুটি যখন চলাফেরা করতে পারিস আমাদের সঙ্গে চল। কিছু উপায় তো  হবে।

অসুস্থ মানুষ হরেনের মনের অবস্থা তখন একেবারেই ভাল নয়। ভিতরে সেই জোরটাই নেই। এমন ভাল প্রস্তাব পেয়েও ঢোঁক গিলে বলল আমি কি আর পারব জ্যাঠা! হাজার হোক জাল টানা মাছ ধরার কাজ।   

তোকে জাল টানতে হবে না সাঁইদার নগেন সর্দার বলল যে জন্য পাঁচ গ্রামে তোর ডাক পড়ত সেই কাজই শুধু করবি। তুই নেই গত কবছর প্রাণান্ত পরিশ্রম করেও আড়তের মহাজনকে খুশি করতে পারা যায়নি। তেমন মাছই ধরা পড়েনি। নৌকোয় বসে তুই শুধু মাছের ঝাঁকের হদিস দিবি। তাতেই হবে।

সেও কি আর পারব এখন জ্যাঠা। ভিতরে সেই জোরটাই তো নেই।

হরেন ভরসা না পেলেও নগেন সর্দার তাকে ছাড়েনি। একরকম জোর করেই কাজে নিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে মেয়ে–বউদের দলে আমিও ছিলাম সেবার। সব তাই নিজের চোখে দেখা।

একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে পদিপিসি থামলেন। আমাদের মুখে কথা নেই। হাঁ করে তাকিয়ে আছি। সেই মুখের দিকে এক পলক চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে তিনি শুরু করলেন আবারআগেই বলেছি সেবার যাওয়া হয়েছিল নদীমোহনা ছাড়িয়ে আরো দূরে নির্জন এক দ্বীপে। একেবারে বাঘ আর কুমিরের রাজত্বে। দল বড় ছিল। তাই পরোয়া করেনি কেউ। বাঘের গল্প তো আগেই বলেছি। খুচরো এক ডাকাতদলও হানা দিয়েছি একদিন। সঙ্গে দেশি বন্দুক থাকলেও সড়কি রামদা হাতে মাছমারা পালোয়ানদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। পালিয়ে বেঁচেছিল।

মাছমারা মানুষ এসব নিয়ে পরোয়া করে না। সেবারও করেনি। তাদের আসল ভাবনা মাছ কেমন ধরা পড়ল তাই নিয়ে। কিন্তু কপাল খারাপ জালে সেবারও তেমন মাছ উঠছিল না। হরেন অবশ্য চেষ্টার কসুর করেনি। শেষে একদিন সাঁইদার নগেন সর্দারকে বলল জ্যাঠা এদিকে মাছের ঝাঁক তেমন নেই এবার। একদিন সাগরের দিকে নৌকো নিয়ে যাবে নাকি?

 তো তাই হল। সেদিন গোটা পাঁচেক নৌকো আর বাছাই একদল সঙ্গী নিয়ে সাঁইদার ধাওয়া করেছিল দূর সাগরে। সে এতটাই দূর যে কূল দেখা যায় না। গ্রামের খালেবিলে মাছ ধরা মানুষ সবাই সাগরের এত গভীরে আগে মাছ ধরতে আসেনি। চারপাশে শুধু নীল জল আর জল। তাকালে বুক কেঁপে ওঠে। তবে জোরাল ঢেউ নেই। মা গঙ্গার নাম নিয়ে সবচেয়ে বড় জাল জলে নামানো হল। সেই জাল জলে ফেলতে যেমন অনেকটা সময় লাগে টেনে তুলতেও মেহনত। সময় লাগে অনেক।

দুপুরে নামানো হয়েছিল জাল। সেই জাল টেনে তুলতে বিকেল। ইতিমধ্যে ভাটা শুরু হয়ে গেছে। নজর রাখতে হচ্ছিল জলের টানে নৌকো যেন আরো দূরে চলে না যায়। ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। তা অনেক মেহনতে জাল টানা যখন শেষ হল জালে মাছ পড়েছে কম নয়। সেই মাছের লাফালাফি দেখে লাফালাফি ওদেরও। এতদিন পরে সত্যিই আজ ভাল পরিমাণ মাছ পড়েছে জালে। গ্রামের নৌকো। অত মাছের টান সামলে জাল নৌকোয় তোলা সহজ নয়। সেই চেষ্টাও  করা হয়নি। যথা সম্ভব জলের উপর তুলে খলবল করে লাফানো মাছ ঝুড়ি দিয়ে ছেঁকে দ্রুত নৌকোয় তোলা শুরু হল। ঝুড়ি ভরে তখন নৌকোয় মাছ তোলা হচ্ছে হঠাৎ একজনের ঝুড়িতে বড় কিছু আটকাল। গোড়ায় ভেবেছিল মাছই বুঝি। কিন্তু অত বড় মাছ জালে আটকালে লাফালাফিতে আগেই টের পাওয়ার কথা। কৌতূহলে কয়েকজন জলে হাত বাড়িয়ে সামান্য চেষ্টায় যা তুলে আনল তা দেখে সবাই তো হতভম্ব! কয়েক মুহূর্ত কারো মুখে টু–শব্দ নেই।

হতভম্ব হবার মতোই ব্যাপার। জালের ভিতর মাছের লাফালাফি। তার মধ্যে সামান্য হাতড়াতে উঠে এসেছে আস্ত একটা মানুষ!

মরা?’

পদিপিসি থামতেই আমাদের রুদ্ধশ্বাস প্রশ্ন। উত্তরে অল্প মাথা নাড়লেন উনি। তাহলে তো ব্যাপারই ছিল না। না মানুষটা মরা নয়। সারা শরীরে বহুদিনের পুরনো পুরু শ্যাওলার আস্তর। অথচ শরীর রীতিমতো গরম। একদম স্বাভাবিক মানুষের মতো। তবে জ্ঞান নেই অচেতন। নিঃশ্বাসও বইছে না।

পুরু শ্যাওলায় ঢাকা হঠাৎ সেই দেহের দিকে তাকালে মানুষ বলে বোঝা মুশকিল। তবে অতি কাছ থেকে উপস্থিত মানুষগুলোর চিনতে ভুল হয়নি। শহরের শিক্ষিত মানুষ হলে তারা ওই অবস্থায় কী করত বলা মুশকিল। হয়তো ভয় পেয়ে ফের জলেই ফেলে দিত। কিন্তু গ্রামের সেই নিরক্ষর মানুষগুলো কর্তব্যে অবহেলা করেনি। সাঁইদার নগেন সর্দার মুহূর্তে মনস্থির করে ফেলল মানুষটার শরীর যখন গরম দেহে নিশ্চয় প্রাণ আছে। জালে যখন উঠেছে ফের জলে ফেলে দেওয়া যায় না। আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হোক। সেখানে বয়োজ্যেষ্ঠ সতুমোড়ল রয়েছে। সলাপরামর্শ করে যা হোক কিছু একটা করা যাবে।

ইচ্ছে ছিল অন্তত আর একবার জাল টানা হবে। কিন্তু সে আর হল না। জাল গুটিয়ে সবাই ফেরার পথ ধরল। নৌকোয় অন্য সময় ছই থাকলেও জাল টানার সময় কাজের সুবিধার জন্য খুলে ফেলা হয়। মানুষটাকে তাই  খোলা নৌকোর উপর শুইয়ে রাখা হয়েছিল। পড়তি বেলা হলেও চড়া রোদ তখনোসেই রোদে মানুষটার গায়ের শ্যাওলা কিছু নেতিয়ে পড়েছে হঠাৎ কাছে বসা একজন চেঁচিয়ে উঠে বলল কী কাণ্ড! ওনার যে শ্বাস বইতে শুরু করেছে!

মুহূর্তে সাড়া পড়ে গেল নৌকোয়। সত্যিই সামান্য হলেও মাঝেমধ্যে নিশ্বাস পড়ছে মানুষটার। শুধু তাই নয় ক্ষীণ হলেও হাতের কব্জিতে নাড়িও পাওয়া যাচ্ছে। সেই অবস্থায় ওরা যখন আস্তানায় এসে পৌঁছল খবর শুনে ছুটে এলো সবাই। খবর গেল সতুমোড়লের কাছে। সতুমোড়ল গাঁয়ের প্রাচীন মানুষ। এত দূরের পথ আপদে বিপদে পরামর্শ দেবার জন্যই তাঁকে সঙ্গে আনাতিনি যখন দেখতে এলেন জল থেকে তোলা মানুষটার তখন নিশ্বাস প্রায় স্বাভাবিক। তবে জ্ঞান ফেরেনি। সতুমোড়ল সেদিকে খানিক তাকিয়ে বললেন কী সর্বনাশ! এ তোরা কী করেছিস! ইনি যে কপিল সিদ্ধাই! হায় হায়!

সেই কথায় উপস্থিত সবার মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। কপিল সিদ্ধাইকে তল্লাটে কেউ চাক্ষুষ দেখেনি। কিন্তু তাঁর নাম শুনেছে অনেকেই। বিশেষ করে যারা বয়সে প্রাচীন। মানুষটার বয়সের নাকি গাছপাথর নেই। যোগসিদ্ধ পুরুষ। কুম্ভক করে বছরের পর বছর পড়ে থাকতে পারেন। খাদ্য জল বা বাতাস কোনো কিছুর দরকার হয় না তখন। তাই তিনি সিদ্ধাই অর্থাৎ সিদ্ধ পুরুষসিদ্ধাইবাবা নামেও পরিচিত। সতুমোড়ল কপিল সিদ্ধাইয়ের কথা শুনেছিলেন নিজের দাদুর কাছে। তাঁর ছোটবেলায় কপিল সিদ্ধাইকে একবার অল্পদিনের জন্য দেখা গিয়েছিল গ্রামের শ্মশানে। দেখতে দূর দূর থেকে ভেঙে পড়েছিল মানুষ। এমনকী খুলনা বরিশাল থেকেও মানুষ তাঁকে দেখতে এসেছিল। শ্মশানের পাশে সিদ্ধাইবাবার জন্য একটা আশ্রমও গড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একদিন সেই যে তিনি নদীতে চান করতে নামলেন তারপর আর ওঠেননি। তল্লাটে কেউ আর দেখেনি তাঁকে।

এসব শুনে সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিল নগেন সর্দার। দলের সাঁইদার তিনি। এতগুলো মানুষ নিয়ে বের হয়েছেন ঘরে ফিরিয়ে দেবার দায়িত্বও তাঁর। অথচ ভুলটা তাঁরই। ঘটনাচক্রে কুম্ভকযোগে থাকা কপিল সিদ্ধাই তাদের মাছধরা জালে আটকে যাওয়ার পর উচিত ছিল তখনই ফের জলে নামিয়ে দেওয়া। কিন্তু মানবিক কারণে তিনি সেটা করতে পারেননি। এখন যে ফের জলে ভাসিয়ে দেবেন সে উপায়ও নেই। সতুমোড়লও সে কাজ করতে মানা করে দিয়েছেন। জল থেকে তোলার পর কপিল সিদ্ধাইয়ের যোগাবস্থা ভঙ্গ হতে শুরু হয়েছে। তাই ফের নিঃশ্বাস বইছে। নাড়িও পাওয়া যাচ্ছে।

অতঃপর কী করা হবে কিছুই যখন কেউ বুঝে উঠতে পারছে না ভয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে সবাই। কাজকর্ম নাওয়াখাওয়া বন্ধ। এই অবস্থায় সন্ধের মুখে হঠাৎই উঠে বসলেন মানুষটি। দেখে সবাই তাঁর পায়ের পাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রক্ষা করো বাবা।

উনি চোখ না মেলেই বললেন অসময়ে আমার কুম্ভক ভঙ্গের কারণ তোমরা নও বাপু আমি নিজেই।

কপিল সিদ্ধাইয়ের সেই কথায় কিছু ভরসা পেলেও মুখে কথা নেই কারো। তাকিয়ে আছে হাঁ করে। উনি বললেন তোদের মধ্যে হরেন কে আছে? আমার কাছে নিয়ে আয় তাকে।

দ্রুত আনা হল হরেনকে। প্রণাম করে সামনে বসতেই উনি চোখ না মেলেই শান্ত কণ্ঠে বললেন বাবা যে মারা গেছে তার জন্য কিছু করতে পারব না। কিন্তু তুই জীবিত রয়েছিস যখন ফের আগের মতোই সুস্থ হয়ে ওঠ আবার।  

বলা বাহুল্য কপিল সিদ্ধাইবাবার সেই কথা হরেনের উপর করুণার কারণ কেউ যখন বুঝে উঠতে পারছে না। খোদ হরেনও হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বাবা নিজেই মুখ খুললেন আবার সেদিন অযথাই ভয় পেয়েছিলি তোরা। সেই রাতে চৌধুরীদের কাছারিঘরে আমিই গিয়েছিলাম। আগের দিন কুম্ভকযোগ ভেঙে জেগে উঠেছি। রাতের নির্দিষ্ট ক্ষণের মধ্যেই ফের কুম্ভকযোগ শুরু করবতার আগে কয়েক জায়গায় প্রণাম করার দরকার ছিল। চৌধুরী বাড়ির গাজনের আসনও তার একটি। সেই রাতে সেইজন্যই গিয়েছিলাম ওখানে। বিছানায় শুয়ে তোরা আমাকে দেখে যে ভয় পেয়েছিলি বুঝেছিলাম। ভেবেছিলাম যাবার আগে তোদের ভয় ভাঙিয়ে দিয়ে যাব। কিন্তু সেই সময় হঠাৎই একদল ক্ষুধার্ত কুকুরের চিৎকার শুনে বুঝতে পারি খালে ভেসে আসা এক মৃতদেহর দখল নিয়ে লড়াই বেধেছে তাদের। মৃতদেহর গলায় রয়েছে একমুখী রুদ্রাক্ষর মালা। মৃতদেহ সলিল সমাধি দেবার সময় খুলে দেওয়া হয়নি বুঝতে পেরেই ছুটে গিয়েছিলাম সেটা খুলে দেবার জন্য।

কিন্তু মৃতদেহটি ডাঙায় তুলে দেখি পচে ফুলে ওঠা দেহের সঙ্গে রুদ্রাক্ষের মালা এমনভাবে এঁটে গেছে সাধারণ উপায়ে খোলা মুশকিল। এদিকে হাতে সময় খুব কম তখন। যোগে বসার সময় ঘনিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি করতে মৃতদেহের গলার সেই রুদ্রাক্ষের মালা দাঁত দিয়ে কাটতে হয়েছিল। উচিত ছিল তোদের ভুলটা ভাঙিয়ে যাওয়া। কিন্তু যোগে বসার সময় বয়ে যায় দেখে তা আর হয়নি। সেই অন্যায়ের কারণে আজ অসময়ে যোগভঙ্গ হল।

কথা শেষ করে সিদ্ধাইবাবা হরেনের মাথায় হাত রেখেছিলেন। মুহূর্তে তাঁর সেই হাত কেমন কেঁপে উঠল হঠাৎ। খানিক থম হয়ে থেকে সেই প্রথম চোখ মেলে তাকালেনচারপাশে অল্প মাথা ঘুরিয়ে বড় করে একবার শ্বাস টানলেন। তারপর হাতের মুঠো খুলে কী একটা পুঁতির মতো জিনিস হরেনের হাতে দিয়ে বললেন কবচটা রেখে দে। এক মাস পূর্ণ হলে নদীতে ফেলে দিস।

কথা শেষ করে কপিল সিদ্ধাইবাবা আর দেরি করলেন না। সূর্য অস্ত গেলেও সামান্য আলো রয়েছে তখনো। উঠে হনহন করে হেঁটে গেলেন অদূরে মোহনার দিকে। ভাটা শেষ হয়ে তখন জোয়ার শুরু হয়েছে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে। উনি দুই হাত তুলে প্রণাম করলেন একবার। তারপর ধীর পায়ে জলে নেমে ডুব দিলেন। আর দেখা গেল না। পিছনে নির্বাক মানুষগুলি তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে।

একটানা কথা বলে পদিপিসি থামলেন। মুহূর্তে শ্রোতাদের কণ্ঠে রুদ্ধশ্বাস প্রশ্নতারপর?’

তারপর দিন কয়েকের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল।পদিপিসি শুরু করলেন আবারআসলে সিদ্ধাইবাবার কথা অন্যরা তেমন বুঝতে না পারলেও অভিজ্ঞ সতুমোড়ল কিছুটা হলেও অনুমান করতে পেরেছিলেন। সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন দিন কয়েক একটু সাবধানে থাকিস সবাই। কিছু একটা বিপদ ঘটতে পারে মনে হচ্ছে। সিদ্ধাইবাবা সেই হুঁশিয়ারিই দিয়ে গেলেন।

শুধু সতর্ক করা নয় সিদ্ধাইবাবার দেওয়া সেই কবচ তিনি যত্ন করে হরেনের গলায় সেই দিনই পরিয়ে দিয়েছিলেন।

সিদ্ধাইবাবার সেই কবচ যে সামান্য নয় বোঝা গিয়েছিল দিন কয়েকের মধ্যেই। সেদিন বিকেলে মাছ ধরে ফিরে আসা হয়েছে। ঝুড়ি ভরতি বড় বড় মাছ ফালি দিয়ে দড়িতে শুকোতে দেওয়ার কাজ চলছে। ছোট মাছ মেয়েরাই বালির উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ নদীর বাঁকের আড়াল থেকে বড় একটা ছিপ নৌকো পাড়ে এসে থামল। নজরে পড়তে ব্যাপার বুঝেতে তখন বাকি নেই কারো। ডাকাতের নৌকো।

এমন ঘটনা একআধবার প্রতি বছরই ঘটে। আগেই বলেছি দিন কয়েক আগেও একবার ঘটেছে। তাই পরোয়া করেনি কেউ। ডাকাত দলের সঙ্গে দেশি বন্দুক একআধটা থাকে। তবে এপক্ষেও মজুত থাকে শান দেওয়া ডজন কয়েক সড়কি আর রামদা। বাদাজঙ্গলের পশুর গাছের শক্ত ডাল কেটে তৈরি মুগুরের মতো লাঠি। তাই নদীর বাঁকে ছিপ নৌকোর দেখা মিলতে তারাও দেরি করেনি। হাতে হাতে সড়কি রামদা আর লাঠি নিয়ে মুহূর্তে তৈরি হয়ে গিয়েছিল আয় শয়তানের দল।

মাছমারা মানুষের সেই রণংদেহী মূর্তি দেখে অনেকেই আর পাড়ে নামতে সাহস পায় না। কখনো দুচারটে লাশ পড়ে যেতে পিটটান দেয়। এবারও ব্যতিক্রম হবে না ভেবেছিল সবাই। ডাকাতের দল পাড়ে নামার আগেই হইহই করে অস্ত্র উঁচিয়ে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরেই প্রমাদ গণতে হল। এ পক্ষকে অস্ত্র হাতে ছুটে আসতে দেখেই ডাকাত নৌকোর পাটাতনের তলা থেকে বের হয়ে এলে দুদুটো জাঁদরেল মেশিনগান।

তখন মহাযুদ্ধের সময়। সীমানার ওপারে বর্মায় জোর কদমে যুদ্ধ চলছে। সেই অস্ত্র পৌঁছে গিয়েছে বাদাবনের ডাকাত দলের হাতেও। কাছে যেতেই সমানে গুলি ছুটতে শুরু করল ট্যাক্‌ট্যাক্‌ট্যাক্‌

গাঁয়ের মানুষ সবাই। মেশিনগান আগে দেখেনি কেউ। নামও শোনেনি। বন্দুকের মুখ দিয়ে লাগাতার আগুন আর গুলির শব্দে থমকে গিয়েছিলকিন্তু অবাক কাণ্ড! ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটলেও একটি মানুষের গায়ে কুটোর আঁচড়টিও লাগেনি। তবু লাগাতার গুলির শব্দে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সবাই। অবাক ডাকাতের দলও। মেশিনগানে কিছু গোলমাল হয়েছে ভেবে থমকে গিয়েছিল। সেই সময় হরেন এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। মারমার চিৎকারে হঠাৎই মস্ত এক লাফে প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল ডাকাত দলের সেই ছিপ নৌকোর উপর।

হরেনের ওই কাণ্ড দেখে অবাক হলেও অনেকেই তখন প্রমাদ গণেছে। অসুস্থ দুর্বল ছেলেটাকে গলা টিপে মেরেই ফেলবে হয়তো। কিন্তু হল উলটো। হরেন ওদের নৌকোয় লাফিয়ে পড়তেই তাগড়াই চেহারার জনা আষ্টেক ডাকাত দারুণ আতঙ্কে লাফিয়ে পড়ল জলে। এমনকী দুই মেশিনগানধারীও।

কেন কেন?’

পদিপিসি থামতেই প্রশ্ন ছুটল সামনে বসা শ্রোতাদের মুখ থেকে।

সে এক রহস্য বাপু?’ পদিপিসি শুরু করলেন আবারসমাধান হয়নি। অসুস্থ দুর্বল মানুষ হরেন কোন শক্তিতে আচমকা ওইভাবে ছুটে গিয়ে ডাকাতের নৌকোয় প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল আর তাকে দেখে দারুণ আতঙ্কে কেনই বা ডাকাতগুলো জলে লাফ দিল তার সমাধান করা যায়নি। খোদ হরেনও বলতে পারেনি কিছু। রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে। যেমন রহস্য রয়ে গেছে জলে লাফিয়ে পড়ে ডাকাত লোকগুলোর একজনও প্রাণ বাঁচাতে পারেনি দেখে। পরের দিন ভোরে তাদের লাসগুলো আশপাশেই ভেসে উঠেছিল। প্রত্যেকের ঘাড় মুচড়ে ভেঙে দেওয়া।

সে কী!

হ্যাঁ রে বাপু। শুধু সতুমোড়লই বলেছিল এ সবই সিদ্ধাইবাবার কবচের কারণে। তিনিই রক্ষা করেছেন।

পদিপিসি থামলেন অল্প। তারপর দম নিয়ে বললেনআমার গল্প কিন্তু শেষ হয়নি বাপুবাকি আছে এখনো। সেই ডাকাতের ঘটনার পরে ওখানে কাজ হয়েছিল আরো দিন কয়েক। তারপরেই হঠাৎ শুরু হল বৃষ্টি। অসময়ের বৃষ্টি থেমে যায় দুএক দিনের মধ্যেই। এবারেও সবাই তাই ভেবেছিল। কিন্তু সেই যে শুরু হল টিপটিপে বৃষ্টি চলতেই লাগল। সঙ্গে দমকা বাতাস। সেই বৃষ্টিবাদলার ভিতর মাছ ধরাই যায়। কিন্তু রোদের দেখা নেই। শুকোবার প্রশ্নই আসে না। বরং আগের মাছই রোদ না পেয়ে পচতে শুরু করেছে। তাই মাছ ধরাও বন্ধ। কী বলব টানা প্রায় দিন দশেক চলল সেই ব্যাপার। তারপর রোদ উঠল একদিন। কেউ বলল একের পর এক বাধা যখন এবার ফিরে গেলে হয়। কেউ বলল টানা বৃষ্টিতে অনেক শুকোনো মাছও নষ্ট হয়ে গেছে। আরো দিন কয়েক থেকে যাওয়াই ভাল। তো তাই ঠিক হল। এত পথ ভেঙে আসা হয়েছে। দিন কয়েক থেকে আরো কিছু শুঁটকি নিয়ে যাওয়া ভাল।

কিন্তু মানুষের ভাবনা কী আর সব সময় পূর্ণ হয়? সেবার আমাদেরও হয়নি। বৃষ্টি থামতে সবে দিন দুই হল ফের মাছ ধরা শুরু হয়েছে। একদিন মাছ ধরতে বের হয়েও তাড়াতাড়ি ফিরে এলো সবাই। যে খবর পাওয়া গেল তা একেবারেই ভাল নয়। আগের দিনই ওরা নদীতে বেশ কিছু মরা গরুমোষ ভেসে যেতে দেখেছে। কিছু মানুষও নজরে পড়েছে তার ভিতর। ওরা খুব একটা গা করেনি। কিন্তু আজ আর এড়িয়ে যাবার উপায় ছিল না। নদীতে সমানে ভেসে চলেছে মরা গবাদি পশু আর মানুষের লাসউৎকট পচা গন্ধ। তাই দেখে উজানের দিকে কী ঘটেছে বুঝতে বাকি থাকেনি কারো। তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে সবাই।

ভাটির দেশের মানুষ আমরা। ঘূর্ণিঝড় প্লাবন কয়েক বছর অন্তরই হয়। বিপুল বেগে ধেয়ে আসা বাতাসে ভেঙে পড়ে ঘরবাড়ি আর গাছপালা। সঙ্গে ধেয়ে আসে প্লাবন। ফুলে ওঠা সাগর আর নদী থেকে বিশ–তিরিশ হাত উঁচু ঢেউ আছড়ে এসে পড়ে। নিমেষে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মারা পড়ে হাজার হাজার মানুষ আর গবাদি পশু। উজানের দিকে তেমন কিছুই যে ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই মেলানো যাচ্ছিল না ঘূর্ণিঝড় প্লাবন ধেয়ে আসে সমুদ্রের দিক থেকে। ওরা সেই সাগরের কাছেই রয়েছে। অথচ সামান্য বৃষ্টিবাদল ছাড়া এদিকে কিছুই তো হয়নি! মামুলি ডালপাতায় তৈরি কুঁড়েঘরগুলোর পর্যন্ত কোনো ক্ষতি হয়নি।

হিসেব মেলাতে না পারলেও ওরা এরপর দেরি করেনি আর। মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে পরের দিন ভোরেই নৌকো নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ঘরের দিকে। তারপর বিকেলের আগেই টের পেয়েছিল অনুমান অভ্রান্ত। নৌকো যত উজানের দিকে এগোচ্ছে যতদূর চোখ যায় ভাঙা গাছপালায় চারদিকে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থা। নদীর জলে ভেসে আসছে শুধু মরা গবাদি পশু আর মানুষের পচা লাশ। তারপর যখন লোকালয় শুরু হল প্রায় শ্মশান যেন। একটি বাড়িঘর গাছপালা কিছুই অক্ষত নেই। ভেঙেচুরে ছয়লাপ হয়ে রয়েছে। সাতখালির বাঁকে বড় গঞ্জের হাট। একটা বাড়িঘর দোকান সেখানে আস্ত নেই। ভেঙেচুরে মাটিতে মিশে গেছে। ভাটির দেশের মানুষের ঝড়তুফান গাসওয়া। মানুষ মরে বেঁচেও থাকে কেউ। কিন্তু এমন ঝড়তুফান আগে কেউ দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না।

বাড়ি ফিরবে কী পথের মাঝে এসব দেখে নৌকোয় সবার তো তখন দম বন্ধ হবার জোগাড়! খবর কিছু পাওয়া যায় কিনা সেই আশায় নামা হল গঞ্জের ঘাটে। অনেক খোঁজ করার পর দেখা মিলল কয়েক জনের। তারা তো আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক। প্রশ্ন করতে তারাই অবাক হয়ে বলল ভাটিতে মাছ ধরতে গিয়েছিলে ঝড়ে কিছু হয়নি তোমাদের! এদিকের কিছুই যে আস্ত নেই। সব তছনছ হয়ে গেছে। হায় হায়! গত একশো বছরেও এমন হয়নি!

পদিপিসি থামলেন। আমরা দম ফেলে প্রশ্ন করলামতারপর।

তারপর আর কী!পদিপিসি ঠোঁট ওলটালেনএরপর নৌকো নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে গ্রামে ফিরে আসা। ভিতরে প্রস্তুতি ছিলই। তবু ঘরে ফিরে কারো কান্না যেন বাঁধ মানে না। প্রতি ঘরেই মৃত্যুর মিছিল। তবু যারা বেঁচেছিল আমাদের দেখে তাদের মুখে কিছু খুশির ছোঁওয়াও ফুটে উঠেছিল। দারুণ কষ্টের ভিতর আশার আলো। তা নয়তো কী? ভাটিতে মাছ ধরতে যাওয়া মানুষগুলো যে এভাবে অক্ষত শরীরে ফিরে আসবে কেউ ভাবতেও পারেনি।

ভয়ানক ডামাডোলের মধ্যে হরেনের গলায় সিদ্ধাইবাবার সেই কবচের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সবাই। এমনকী হরেনেরও খেয়াল ছিল না। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই টের পায় বুকের কাছটা জ্বলে যাচ্ছে। হুঁশ হতে বোঝে জায়গাটা জ্বলে যাবার কারণ কপিল সিদ্ধাইয়ের সেই কবচ। ভয়ানক গরম হয়ে উঠেছে সেটা। দেরি না করে তক্ষুনি সে ছুটে এসে হাজির হয়েছিল সতুমোড়লের কাছে।

সব শুনে তিনি কপাল চাপড়ে বললেন সর্বনাশ হয়েছে রে! সিদ্ধাইবাবা বলেছিলেন না তিরিশ দিনের মাথায় কবচটা নদীতে ফেলে দিতে?

বলেছিলেন তো। তিরিশ দিন কি হয়েছে?

সতুমোড়ল তৎক্ষণাৎ মাটিতে দাগ কেটে হিসেব কষে বললেন দ্যাখ ভুলে গেলেও সিদ্ধাইবাবার কবচ ভোলেনি। আজই তিরিশ দিন পূর্ণ হয়েছেতাই ওই হুঁশিয়ারি। এখনই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া দরকার।

তো তাই হয়েছিল তারপর। নদীর ঘাটে গিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই কবচ।

আপলোড: ২৪/১/২০২১

2 comments:

  1. দারুন লাগল।অনেকদিন পর মনের মত একটা গল্প পড়লাম।

    ReplyDelete