Friday 1 January 2021

ভৌতিক বড়গল্প (মোবাইল ভাঃ): ভৈরব মন্ত্র (শিশির বিশ্বাস)

 


ভৈরব মন্ত্র

শিশির বিশ্বাস

সেবার নেতিধোপানি গিয়েছিলাম ধনপতি লশকরের সঙ্গে। বাদায় আমার দেখা মানুষের মধ্যে উনি যে কিছু ব্যতিক্রম, বুঝেছিলাম অল্প দিনের মধ্যেই। তবু এমন ভাবিনি কখনো! হেঁয়ালি ছেড়ে খুলেই বলি।

 গ্রামে চাষ–আবাদ করা পরিবারের মানুষ ধনপতিবাবুকে দেখে সত্যিই বোঝা মুশকিল। ছ’ফুটের মতো লম্বা টকটকে ফর্সা চেহারা। ধপধপে ধুতির উপর শার্ট বা পাঞ্জাবি। পায়ে সৌখিন চটি। এককথায় ধোপদুরস্ত মানুষ। সাতজেলিয়ায় পৈতৃক বাড়ি হলেও পড়ে থাকতেন বারুইপুরের বাসাবাড়িতে। বিয়েথাও করেনি। শুধু সৌখিন নয়, রীতিমতো দিলদরিয়া। পাটভাঙা ধুতি পাঞ্জাবী তাঁকে এক দিনের বেশি পরতে দেখিনি। আসলে দেশের বাড়িতে জমিজমা যথেষ্ট। দুই দাদাই সেখানে থাকেন। নিয়মিত টাকাপয়সা আসে নিশ্চয়। নইলে কোর্টে সামান্য কাজ করে যা উপায় তাতে দিন দশেকও চলার কথা নয়।  

ভদ্রলোক তাঁর সাতজেলিয়ার বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলেন একবার। আক্ষরিক অর্থেই সম্পন্ন পরিবার। অনেকটা জায়গা নিয়ে দু’তলা পাকা বাড়ি। দু’দুটো পাওয়ার টিলার। নিজেদের প্রয়োজন ছাড়াও ভাড়ায় খাটে। গোয়ালে দুধেল গাই। অভাব নেই কিছুর। এ ছাড়া বাড়ির লাগোয়া দুটো পুকুর। তার একটায় শুধুই কই–মাগুরের মতো জাওলা মাছ। অন্যটায় রুই–কাতলা। পরের পুকুরে মাছ বিক্রির জন্য হলেও অন্যটার মাছ বাড়ির খাওয়ার জন্য। যেবার গিয়েছিলাম, খাওয়ার পাতে পুকুরের পাকা কই মাছের হরেক পদ ছিল বাঁধা। সেই পুকুর থেকে মস্ত এক চিতল মাছও ধরা হয়েছিল একদিন। কলকাতায় ফিরে দিন কয়েক বাজারের পোনামাছ মুখে রোচেনি।

এই বাড়ির মানুষ ধনপতি লশকর যে কিছু অন্য রকম হবেন, তাতে আশ্চর্য কী! কতদিন বলেছি, দেশ ছেড়ে কেন যে এখানে পড়ে থাকেন ধনপতিদা!

উত্তরে মানুষটা হেসে বলেছে, ‘ওসব চাষবাস, খেত–খামার আমার পোষায় না সার। দিব্যি আছি।’

ভদ্রলোকের দিব্যি মানে রীতিমতো দিলদরিয়া জীবন। ঘরের জানলা দরজায় দামি পর্দা। ধবধবে বিছানা। একদম টিপটপ। ঠিকে কাজের মানুষ আছে, তারাই সামলায়। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম ভদ্রলোকের কিছু অন্য ব্যাপার রয়েছে। শুধু পানদোষ নয়, নিয়মিত কলকাতার এক নিষিদ্ধ পল্লীতেও যাওয়া–আসা করেন। রাতও কাটান কখনো। সেটা স্বীকার করতেও দ্বিধা নেই। নিজেই একদিন বলেছিলেন, সার, আমার কিন্তু শুধু পানদোষ নয়। অন্য ব্যাপারটাও আছে। বিয়েথা যে করিনি, তা কতকটা ওই কারণেই। অনেকেই পছন্দ করেন না। তাই আগেই জানিয়ে দেই।

কিছু ব্যাতিক্রমী চরিত্রের বলেই ভদ্রলোক নিজের মুখেই বলে ফেলতে পেরছিলেন এসব। সামান্য লেখালেখির অভ্যাস আছে। হরেক চরিত্রের মানুষ নাড়াচাড়া করে আনন্দ পাই। শুধু সেটাই নয়, আরো এক কারণে মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগ তাই আর ছিন্ন হয়নি।

কোর্টে দালালি ছাড়া ধনপতিবাবুর একটা অন্য কাজও ছিল। মানুষটির সঙ্গে সেই সূত্রেই আমার পরিচয়। সাতজেলিয়ার গ্রামের বাড়িতে তেমন না গেলেও শীত পড়লে অন্য একটা কাজও করতেন উনি। কলকাতার টুরিস্টবাবুদের বড় ভটভটি বোট বা লঞ্চে করে ঘুরিয়ে আনতেন সুন্দরবন। ওদিকে প্রায় সবাই পরিচিত হবার কারণে খুব বেশি দৌড়ঝাঁপও তাঁকে করতে হত না। বেশিরভাগ কাজ গোসাবা, সোনাখালি বা বাসন্তীতে ফোন করেই সেরে ফেলতে পারতেন। টুরিস্ট বোটের ব্যবস্থা বা ক্যাটারার পার্টি। একদম নিখুঁত আয়োজন। একবার যারা তাঁর বোটে সওয়ার হয়েছেন, ধনপতিবাবুকে তাঁরা আর ছাড়েননি। শুধু তাই নয়, নতুন নতুন পার্টিও এনে দিয়েছে। তিন থেকে চারদিনের টুর। যারা সুন্দরবন দেখতে চান, তাঁদের পক্ষে ধনপতি লশকরের টুর একদম আদর্শ বলা যায়। ছোট ভটভটিতে অল্প টুরিস্ট নিতেন। ঢুকে পড়তেন হরেক খালের ভিতর। একদম জঙ্গলের গভীরে। এমনকী বাদার গ্রামেও। কাছ থেকে জঙ্গল দেখার জন্য একেবারে আদর্শ টুর। আর যারা সুন্দরবন বেড়ানোর নামে পিকনিক করতে আসেন, ধনপতিবাবুর বোট তাদের পক্ষেও ছিল দারুণ। যেমন খাওয়াদাওয়া তেমন রাত কাটাবার ব্যবস্থা। পার্টির হঠাৎ ফরমাশ হলে অল্প সময়ের মধ্যে কাছের গ্রাম থেকে মুরগির ব্যবস্থাও করে ফেলতে পারতেন। আগেই বলেছি, ওদিকে বহু মানুষ তাঁর পরিচিত। খাতিরও প্রচুর। নদীতে যারা মাছ ধরতে বা অন্য কাজে নৌকো নিয়ে বের হয়, ডেকে টাকা দিয়ে দিলেই যথা সময়ে যথাস্থানে পৌঁছে যেত জিনিস। সেজন্য শীত পড়লে তাঁর কাজের অভাব হত না। রোজগারও হত ভাল।

আগেই বলেছি, ধনপতি লশকরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সুন্দরবনে এই বেড়াতে যাওয়ার সূত্রেই। তারপর মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি আর। সব দেখে সেই প্রথম দফাতেই তাঁকে বলে রেখেছিলাম, তেমন গ্রুপ অর্থাৎ যারা প্রকৃতই সুন্দরবন দেখার ইচ্ছে নিয়ে বেড়াতে যান, সম্ভব হলে তাঁদের সঙ্গে আমাকেও যেন নিয়ে নেওয়া হয়।

ধনপতি লশকর অনুরোধ রেখেছিলেন। বোধ হয় মানুষটির কিছু ভালও লেগে গিয়েছিল আমাকে। তেমন পার্টি পেলেই ফোন করে জানিয়ে দিতেন। আমিও কাঁধে একটা ব্যাগ গুছিয়ে হাজির হয়ে যেতাম সোনাখালির নদীঘাটে। ওখান থেকেই বোট ছাড়ত ওদের। আসলে সুন্দরবন প্রায় নেশার মতো পেয়ে বসেছিল তখন। বছরে চার–পাঁচটা টুরও হয়ে যেত কোনোবার। তবে শীত ছাড়া ধনপতি লশকরের অন্য সময়ের টুরগুলি আমার কাছে লোভনীয় ছিল বেশি। বিশেষ করে পুজোর আগে বা পরে।

এহেন ধনপতি লশকর সেবার আগস্টের মাঝামাঝি ফোন নয়, একেবারে অফিসে এসে হাজির। এসেই বললেন, ‘ভাল একটা টুরের ব্যবস্থা হয়েছে সার। যাবেন নাকি?’

ধনপতিবাবু বললেন বটে, তবে তাঁর মুখ দেখেই মনে হল, না গেলে কিছু নিরাশই হবেন। আসলে আগস্ট মাস। ঘোর বর্ষা। এ সময় সুন্দরবন একেবারেই বেড়াবার উপযুক্ত নয়। ঝড়–বৃষ্টি তো আছেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় ঢেউয়ের তাণ্ডব। কলকাতার আনাড়ি মানুষের পক্ষে সহ্য করা সহজ নয়। তার উপর পার্টি ভাল না হলে আমার মতো মানুষের পক্ষেও মুশকিল। চট করে মুখে জবাব এল না। দেখে উনি বললেন, ‘শীতের সুন্দরবন তো অনেক দেখেছেন সার। একটু অন্যরকম সুন্দরবনও দেখুন এবার।’

কিছু অবাক হয়ে বললাম, ‘এখন বর্ষাতেও টুর কন্ডাক্ট করছেন নাকি?’

‘ঠিক তা নয়।’ সামান্য মাথা চুলকলেন উনি। ‘আসলে এই আগস্ট মাসের শেষ দিকে আমি এমনিতেই ওদিকে যাই। এবার হঠাৎ এক টুর পার্টি পেয়ে গেলাম, তাই মনে পড়ল আপনার কথাও। সুন্দরবনের অনেক তো দেখেছেন। লেখক মানুষ। তা এবার গেলে হয়তো অন্য রকম কিছু দেখাতে পারতাম।’

তবু গড়িমসি করে বললাম, ‘পার্টি কেমন?’

সোজাসাপটা মানুষ ধনপতিবাবু মাথা নাড়লেন। ‘খুব ভাল হবে না হয়তো। ‘বিয়েবাড়ির পার্টি। তবে জনা দশেক মাত্র হেড। বোটে কেবিন, বার্থ যা রয়েছে নিজের মতো থাকতে পারবেন। আর আমি তো রয়েছি।’

কথা শেষ করে উনি যেভাবে আমার মুখের দিকে তাকালেন, না করার উপায় ছিল না। তার উপর সুন্দরবনের প্রকৃতি তথা বিশাল নদী, ছোট–বড় অসংখ্য খাল, অরণ্য, উন্মুক্ত আকাশ, বাদাগ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ, সবকিছুর মধ্যে কেমন এক অন্য আকর্ষণ রয়েছে। নেশা ধরায়। যারা সেই নেশায় মজেছেন, বার বার ছুটে যান। এমন অযাচিত অফার তাই সহজ নয় ছাড়া। না করতে পারলাম না। অফিসে যথেষ্টই কাজের চাপ। তবু ফোন তুলে সেই দণ্ডেই কথা বললাম এরিয়া ম্যানেজার বোস সাহেবের সঙ্গে। দিন সাতেকের ছুটি চাই। সুন্দরবনের দিকে যাব। আমার এই বাতিকের কথা ভালই জানতেন উনি। সামান্য টালবাহানার পর রাজি হলেন। টেলিফোন নামিয়ে আমিও ধনপতিবাবুকে জানিয়ে দিলাম।

বিয়েবাড়ির পার্টি, নেহাত হুজুকে বেড়াতে আসা। টুর খুব যে ভাল হবে না জানাই ছিল। তবে বড় ঝড়–বৃষ্টির পাল্লায় পড়তে হয়নি। আর এই আগস্ট মাসে সুন্দরবনকে যে কিছু ভিন্ন রূপে পাওয়া যায়, মানতেই হল সেটা। অরণ্য আরো অনেক সবুজ, ঝকঝকে। ধনপতিবাবুর দৌলতে এক গ্রামে নেমে পাওয়া গেল চমৎকার আতিথেয়তাও। এক বাড়ির ঝকঝকে উঠোনে বসে কলাপাতায় দুপুরের ভোজ। যাদের সেই অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের কাছে একেবারেই অন্য রকম। তবু দিনরাত স্পীকারের চড়া আওয়াজে খুব যে স্বস্তিতে ছিলাম, এমন নয়। ভেবেছিলাম দিন দুয়ের মধ্যে হয়তো বিয়েবাড়ির বাবুদের ব্যাটারিতে টান পড়বে। কিন্তু হয়নি।

ধনপতিবাবু আমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলেন সেটা। কিন্তু করার ছিল না কিছু। শেষ দিন সকালে বোট সোনাখালির দিকে চলেছে। এক ফাঁকে উনি আমার কাছে এসে গলা নামিয়ে বললেন, ‘আসলে সার বিয়েবাড়ির পার্টি তো, চ্যাঁচামেচি কিছু হবেই। তবু যে আপনাকে নিয়ে এসেছিলাম, তা অন্য কারণে।’

‘কী?’ ধনপতিবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু আগ্রহী হয়ে উঠলাম এবার।

‘সোনাখালি পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। আমি তার আগেই সজনেখালির কাছে নেমে যাব। যাবেন নাকি সঙ্গে?’

ভদ্রলোকের কথায় হঠাৎই মনে পড়ল সেদিন অফিসের কথা। বলেছিলেন, এই সময় ইদানীং উনি প্রতিবছরই এদিকে আসেন। তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কোথায়?’

‘চলুন না ফের জঙ্গলের দিকে।’ মুচকি হাসলেন উনি।

‘ফের জঙ্গল?’ ভেবেছিলাম ভদ্রলোক হয়তো গ্রামের বাড়ির দিকে যাবেন। সেদিন অফিসে মানুষটির কথা শুনে সেই রকমই মনে হয়েছিল। কিছু অবাকই হলাম।

‘হ্যাঁ, জঙ্গলে।’ অল্প থেমে উনি চোখ টিপে মুচকি হাসলেন। ‘বাদার জঙ্গলে অনেক তো দেখেছেন সার। লিখেও থাকেন। সে সব হাতে পেলেই পড়ি। আর তাই তো তেমন রকম টুর হলেই আপনাকে খবর দেই। মনে হয়, এবার অন্য রকম কিছু দেখাতে পারব।’

‘কী?’ ভদ্রলোকের হঠাৎ ওই কথায় কৌতূহলে নেচে উঠল চোখ।

‘ভেবেছিলাম বলব না। তা জানতে চাইছেন যখন, বলেই ফেলি। জায়গাটা নেতিধোপানির কাছে। তবে একটা কথা আগেই জানিয়ে রাখি সার, বলছি বটে, তবে দেখাতেই পারব, এমন নিশ্চয়তা নেই। এবার ভেবে দেখুন।’

এমন কথার পর, দু’বার ভাবার দরকার হয়নি। নেতিধোপানি সুন্দরবনে বেড়াতে আসা প্রত্যেকেরই পরিচিত জায়গা। টুরিস্ট বোট একবার অন্তত ঢুঁ মারবেই। খেয়াল হল, এবার কিন্তু অনেক জায়গায় নিয়ে গেলেও বোট নেতিধোপানির দিকে যায়নি। তবু বললাম, ‘এই সময় নেতিধোপানির দিকে যাবেন, রাতে থাকবেন কোথায়?’

উত্তরে হাসলেন উনি। ‘সেটা আমার উপরেই ছেড়ে দিন সার। ব্যবস্থা করা যাবে সেই আসা করেই তো যাচ্ছি।’

বলা বাহুল্য, এরপর আর কথা চলে না। আমিও রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।

ধনপতিবাবু সজনেখালি নেমে যাবার কথা বললেও, ব্যবস্থা করে ফেললেন তার আগেই। কাজ সেরে এক বরফের নৌকো ফিরছিল সোনাখালির দিকে। রাজি হতে সেই নৌকোতেই উঠে পড়লেন আমাকে নিয়ে। টুরিস্টদের যথাস্থানে নামিয়ে দেবার দায়িত্ব আগে থেকেই দেওয়া ছিল ভটভটির সারেং ছেলেটিকে। সেদিক দিয়ে চিন্তা ছিল না। কিন্তু মামুলি এক বরফ পরিবহনের নৌকো, সামান্য ছইটুকুও নেই, তাতে আমাকে নিয়ে উনি যখন চেপে বসলেন, খানিক চিন্তাই হল।

মুখে কিছু না বললেও আমার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে উনি কিন্তু ঠিকই বুঝলেন। হেসে বললেন, ‘সে কী সার! বাদাবন নিয়ে এত লেখালেখি করেন, আর এইটুকুতেই ঘাবড়ে যাচ্ছেন!’

আমার লেখালেখি বাদার জঙ্গল, মাঝি–মাল্লা আর মউলেদের নিয়েই। অথচ আরামদায়ক বোট ছাড়া কখনো এদিকে আসিনি। থাকাও বোটের কেবিন, নয়তো গ্রামে কোনো সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে। মাথা নাড়তেই হল ভদ্রলোকের কথায়। অল্প ঢোঁক গিলে বললাম, ‘এই নৌকোতেই নেতিধোপানি যাবেন?’

তখনো আসা করে আছি, হয়তো পথেই কোনো বোটের ব্যবস্থা করে ফেলবেন। এদিকে চেনাজানা তো কম নয়। কিন্তু উত্তরে ধনপতিবাবু আমার সেই আশায় এক বালতি জল ঢেলে দিলেন, ‘তবে কী সার। দেখলেন না ইঞ্জিন ফুল স্পীডে করে দিতে বললাম। বিকেলের মধ্যেই পৌছতে হবে।’

নেতিধোপানিতে বহুবার যাওয়া হয়েছে। সন্ধের পর কেউ থাকে না ওখানে। তবে বনদপ্তরের গার্ডদের জন্য এক অ্যাকমডেশন বোটের ব্যবস্থা আছে। তাতে জনা পাঁচেক গার্ড কোনোমতে রাত কাটায়। প্রায় কেঁপে গিয়ে বললাম, ‘রাতে ওখানে থাকবেন কোথায়?’

‘আরে চলুন না। ফরেস্ট হাউসে ব্যবস্থা একটা করে নিতে পারব।’

এখানে বলে রাখি, এ যে সময়ের কথা, নেতিধোপানিতে তখনো ফরেস্ট অফিস হয়নি। নড়বড়ে কাঠের জেটি পেরিয়ে জঙ্গলে নামলেই দু’ধারে মামুলি তারের জাল দেওয়া দীর্ঘ পথ সরু খাল পার হয়ে ভিতরে ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত চলে গেছে। মিনিট কয়েক দেখেই ফিরে আসতে হয়। তাই অবাকই হলাম কিছু।

‘ফরেস্ট হাউস! নেতিধোপানিতে ফরেস্ট হাউস হয়েছে নাকি?’

উত্তরে উনি সামান্য ইতস্তত করে মাথা নাড়লেন। ‘আমিও দেখিনি অবশ্য। তবে শুনেছি। আসলে সেই জানুয়ারির পর ওদিকে আর তো যাওয়া হয়নি। শুনেছি, গত ছয় মাসে অনেক কিছুই নাকি পালটে গেছে। দেখা যাক।’

অগত্যা কথা হয়নি আর। আসলে বিজন জল–জঙ্গলের দেশে কীভাবে রাত কাটবে, তা ভাবতেই বুক শুকিয়ে আসছিল। অথচ বলার উপায় ছিল না। ওদিকে রোদের হাত থেকে মাথা বাঁচাতে ধনপতিবাবু তখন ছাতা মেলে ফেলেছেন। অগত্যা ছাতা মেলে ফেললাম আমিও।

বিকেল নয়, নেতিধোপানি যখন পৌঁছলাম সন্ধে হতে তখন বাকি নেই বেশি। নদীর বুকে অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। কিন্তু কোথায় কী। অবাক হয়ে দেখলাম জেটির অদূরে নদীর উপর ফরেস্ট গার্ডদের যে অ্যাকমডেশন বোট বাঁধা থাকে সেটাও নেই আজ।

নৌকোর দুই মাঝি ততক্ষণে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সোনাখালির বরফ–কারবারি গদাধর মণ্ডলের সামান্য কর্মচারী ওরা। কিছু প্রাপ্তির আশায় ফেরার পথে এদিকে আসতে রাজি হয়েছে। ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে। মালিকের কাছে হেনস্তা হতে হবে হয়তো। একজন ধরা গলায় বলল, ‘বনবাবুদের বোট তো দেখছি না! কত্তাবাবু নামবেন কোথায়? আমরা কিন্তু আর দেরি করতে পারব না। কপালে কী যে আছে আজ কে জানে!’

‘কপালে খারাপ কিছু নেই তোদের।’ ওদের ভাবনা এককথায় উড়িয়ে দিলেন ধনপতিবাবু। ‘আমি ধনপতি লশকর নিয়ে গিয়েছিলাম তোদের, মালিককে সেই কথাই বলবি। চিঠিও একটা লিখে দেব না হয়। এরপরও তোদের মালিক গদাধর যদি ঝামেলা করে, আমার বাসায় ফোন করিস একবার। আর ঘাবড়াসনি একদম। বেশিক্ষণ তোদের সময় নষ্ট করব না।’

‘সে তো হল। কিন্তু এখানে নামবেন কোথায় কত্তাবাবু?’ ধনপতিবাবুকে বিলক্ষণ চেনে ওরা। মানুষটির কথায় কিছু শান্ত হয়ে প্রশ্ন করল অন্যজন।

এমন বিপদেও ভদ্রলোককে কিন্তু বেশ খুশিই মনে হচ্ছিল। উত্তরে হেসে বলল, ‘ওটাই মুশকিল হল দেখছি। খাল ধরে একটু দক্ষিণে চল দেখি। কোনো কারণে অ্যাকমডেশন বোট ওদিকেও রাখতে পারে।’

দ্বিরুক্তি না করে ওরা নৌকো পাশের বড় নদী ধরে খানিক দক্ষিণে এগিয়ে ঢুকে পড়ল বাঁ দিকের এক খালে। শেষ বিকেলে দুই দিকে গা ছমছম জঙ্গল। অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির কোরাস। খালের চড়ায় একদল হরিণ ধানিঘাস খেতে এসেছিল। আওয়াজ পেয়ে ছুটে পালাল। আজকাল সুন্দরবনের হরিণ মানুষকে তেমন আর ভয় পায় না। অভিজ্ঞতায় হয়তো বুঝে ফেলেছে, সুন্দরবনে বেড়াতে আসা মানুষের কাছ থেকে তেমন ভয়ের কারণ নেই এখন। এভাবে ছুটে পালানো কিছু আশ্চর্য বইকী! হতে পারে, এটা টুরিস্ট বোট নয়। আর এই সন্ধেয় টুরিস্ট বোট ঢোকে না এই খালে!

তবে এসব ভাবার সময় ছিল না তখন। বরং ভাবছিলাম অন্য কথা। সুন্দরবনে অনেকবার এসেছি। ফরেস্ট গার্ডদের অ্যাকমডেশন বোটও দেখেছি। সেই বোটে বাড়তি দুজনের রাত কাটানো খুবই মুশকিল। খানিক আগে কিন্তু অন্য রকম শুনেছিলাম। বলেছিলেন ফরেস্ট হাউসের কথা। কিন্তু এখন সেকথা একবার মুখে আনতেও দেখলাম না। তবে কী নতুন ফরেস্ট হাউস বড় নদীর ধারে নয়, তৈরি হয়েছে ভিতরে এই খালের ধারে? কিন্তু বলি বলি করেও সেকথা বলা হল না। সুন্দরবনে এতবার এসেছি। কাটিয়েছি রাতের পর রাত, কিন্তু ভিতরে এমন আশঙ্কার মেঘ কখনো উদয় হয়নি।

রাতের অন্ধকার সেভাবে নামেনি এখনো। তবু খাল ধরে নৌকো যত ভিতরে এগোচ্ছে, ক্রমশ কেমন ঝিম ধরে আসছে চারপাশ। এই সন্ধেয় মানুষটা কোথায় নিয়ে চলেছে! নৌকোর দুই মাঝির অবস্থাও যে খুব আলাদা নয়, টের পাওয়া যাচ্ছিল তাদের মুখ দেখেই। তার মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল, বিশাল এক কুমির ভুস করে ভেসে উঠেছে নৌকোর পাশে। লম্বায় আমাদের নৌকোর চাইতেও বড়।

দেখে দুই চোখ তখন ঠিকরে আসার জোগাড়। এ যা কুমির, ইচ্ছে করলে লেজের এক ঝাপটায় উলটে দিতে পারে নৌকো। ব্যাপার দেখে দুই মাঝির প্রাণও তখন আমার মতো খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। ব্যতিক্রম একমাত্র ধনপতিবাবু। কুমিরটাকে দেখে কিছু খুশিই হয়ে উঠলেন যেন। বললেন, ‘খুব বেশি দেরি নেই রে। আর অল্পই যেতে হবে তোদের।’

ওরা অবশ্য উত্তর দিল না। সেই অবস্থাও ছিল না বোধ হয়। গুম হয়ে রইল। তবে ধনপতিবাবুর অনুমানে যে ভুল নেই, বোঝা গেল অল্প পরেই।

খালের অনেক ভিতরে ঢুকে পড়েছি তখন। আলোও কমে এসেছে আরো। দুই পাশের নিস্তব্ধ অরণ্যে শুধুই ঝিঁঝির কোরাস। তারই মধ্যে হঠাৎই সামনে এক বাঁক পার হতে নজরে পড়ল খালের মাঝে বড় এক বোট বাঁধা। শুধু বোট বললে ভুল হবে সেকালের রীতিমতো সৌখিন ময়ূরপঙ্খী নৌকো। আজকাল তেমন আর দেখা যায় না। ঝকঝকে বাহারি রং শুধু নয়, কেবিনের দরজা–জানলায় সাটিনের দামি পর্দা। বাইরে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে বসে এক মাঝ বয়সী মানুষ আনমনে গড়গড়া টানছিলেন। গৌরবর্ণ লম্বা–চওড়া শরীর হলেও অদ্ভুত তাঁর মুখের গড়ন। চাপা নাকের নীচে প্রশস্ত ভারী ওষ্ঠ। চাপা চিবুক। শরীরের অনুপাতে মুখশ্রী মোটেই মানানসই নয়। তবে দুই চোখ রীতিমতো ধারাল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দূর থেকে আমাদের দেখেই ঘাড় তুলে সোজা হয়ে উঠলেন।

ততক্ষণে আমাদের নৌকো পাশে ভিড়েছে। ভদ্রলোক গড়গড়ার নল হাতে নিয়ে তাকালেন আমাদের দিকে। ভুরু সামান্য কুঁচকে উঠলেও দ্রুত সামলে নিয়ে বললেন, ‘আরে ধনপতি যে! আসুন ভাই, আসুন। আপনি আসবে বলেই অপেক্ষা করে আচি।’

‘আজ্ঞে দাদা,’ হাত কচলে ধনপতিবাবু অল্প হাসলেন, ‘আপনার খোঁজ যখন পেয়েছি, সঙ্গ ছাড়তে পারি? তাই তো সুযোগ পেলেই ছুটে আসি।’

‘তা সঙ্গের মানুষটি কে?’ ভুরু কুঁচকে ভদ্রলোক চোখ ফেরালেন আমার দিকে।’

‘আজ্ঞে দাদা, উনি সুভদ্র সমাদ্দার। লেখক মানুষ। তাই পরিচয় করাতে নিয়ে এলাম।’

‘আরে তাই নাকি! আসেন, আসেন ভাই। বুঝলেন না, সে একদিন ছিল, ভূতনাথ দত্তর কাছারিতে আপনার মতো গুণী মানুষ তো কম ছিল না। কথা বলেও সুখ পেতাম। তা সে সব এখন কোথায়। একা এই জঙ্গলে পড়ে আছি।’

ভদ্রলোকের কথায় প্রায় হাঁফ ছাড়লেন ধনপতিবাবু। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘সার, উনি ভূতনাথ দত্ত। আমার দাদার মতো। তা ওনার অনুমতি যখন পাওয়া গেছে, বোটে উঠে পড়ুন। আমি মাঝিদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে আসছি।’

আমি অবশ্য রাজি হলাম না। শোভনও নয়।

বরফ নৌকোর মালিক গদাধর মণ্ডলের নামে ধনপতিবাবু চিঠি ইতিমধ্যে একটা লিখেই রেখেছিলেন। পাওনাগণ্ডার সঙ্গে সেটাও এক মাঝির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘জোয়ার শুরু হতে দেরি নেই। সেই জোয়ার ধরে সোনাখালি পৌঁছোতে বেশি রাত হবে মনে হয় না। আর মালিক যদি…’

আশানুরূপ প্রাপ্তিযোগ ছাড়াও তেলের টাকাও বাড়তি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুজনেই বেশ খুশি তখন। ধনপতিবাবু কথা শেষ করার আগেই সমস্বরে জনিয়ে দিল, ওসব নিয়ে কত্তাবাবুর চিন্তার কারণ নেই। জোয়ার ধরে অল্প রাতের মধ্যেই তারা পৌঁছে যেতে পারবে। বুঝিয়ে বলতে পারবে মালিককেও।

অতঃপর আমরা বোটে উঠতেই ওরা নৌকো ঘুরিয়ে চলে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি ইতিমধ্যে দুটো চমৎকার গদির আসন পেতে দেওয়া হয়েছে আরাম কেদারার পাশে। সঙ্গে মোটা তাকিয়া। সামনে মস্ত বারকোশে গোটা কয়েক কাঁশার গ্লাস আর ঢাকনা দেওয়া দারুণ পালিশ করা ঝকঝকে দুটো কালো রঙের ঘড়া। সন্ধের এই মরা আলোতেও ঝিলিক দিয়ে উঠছিল। জিনিসটা যে কোনো ধাতু নয়, স্রেফ মাটির বুঝতে সময় লেগেছিল তারপর।

 যাই হোক, আমরা ঘাড় ফেরাতেই উনি বললেন, ‘বসেন, বসেন আপনারা। বোটে জায়গার অভাব, তাই আর আরাম কেদারা দিতে পারলাম না। মার্জনা চেয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

শুনে প্রায় হাঁ–হাঁ করে উঠলাম। ধনপতিবাবু বললেন, ‘কী যে বলেন দাদা! এতক্ষণ তো বসে ছিলাম স্রেফ নৌকোর বাঁশের পাটাতনে। তবু যে পেয়েছি আপনাকে, সেটাই ভাগ্য! বলব কী দাদা, বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। দাদাকে পাব কী পাব না! এর আগেও এসেছিলাম একবার। দেখা না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে।’

‘সে খবর শুনেছি ভাই।’ ধনপতিবাবু থামতেই ভূতনাথ দত্ত মাথা নাড়লেন। ‘তা কী আর করা যাবে। সময়টা আর আগের মতো নেই যে। ক্রমেই পালটে যাচ্ছে। নইলে এই ভূতনাথ দত্তর কোনো কাজে নড়চড় হয়েছে কখনো! এই বাদায় বাঘে–গরুতে এক ঘাটে জল খেয়েছে! বাঘে গরুতে এক ঘাটে!’

‘সে কী আর জানি না দাদা! তা ভালই তো আছেন দেখছি!’

‘কোথায় আর ভাল বাপু!’ আক্ষেপে সামান্য কপাল চাপড়ালেন উনি। ‘এই যে সেদিন চেষ্টা করেও আসতে পারলাম না। আপনি খামোখা হেনস্তা হলেন। সেটা কী ভাল লেগেচে আমার? একেবারেই নয়।’

‘এমন কী আর হেনস্তা দাদা! ঝাড়া হাত–পা মানুষ। ওই রাতটাই যা একটু সমস্যা হয়েছিল।’

সমানে কথা বলে যাচ্ছিলেন ওনারা। বোঝা যায়, অনেক দিন পরে দেখা, তাই কথার ঝাঁপি খুলে ফেলেছেন। নতুন মানুষ আমি। সেই কথার ভিতর ঢুকে পড়ার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ইতিমধ্যে চারপাশে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। খালের দুই পাশে জঙ্গলের ভিতর অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির কোরাস। নতুন জোয়ারে খালের ভিতর শুধুই উথাল–পাথাল ঢেউ। অন্ধকারে ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাসের নরম সাদা আলো ছাড়া ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে তারার মেলা। তবু থম হয়ে বসে অদূরে ঘন জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে খুব স্বস্তি বোধ হচ্ছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোক রাতে এই খালের ভিতরেই থাকবেন নাকি? বোটে এতক্ষণ রয়েছি, দ্বিতীয় কোনো মানুষ দেখিনি।

ভাবতে গিয়ে খেয়াল হয়, মিথ্যেই ভয় পাচ্ছি। বোটে অন্য কেউ যদি না–ই থাকবে, আমাদের বসার গদি, জলের গ্লাস কে দিয়ে গেল? যখন বরফ নৌকোর দুই মাঝির সঙ্গে কথা বলছিলাম, সন্দেহ নেই, তখনই কেউ রেখে গেছে। আমরা খেয়াল করিনি। আকাশের আলো ওই সময় হঠাৎই কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল যেন। খেয়াল হল, শুক্লপক্ষের একাদশী আজ। খালের পাড়ে মস্ত কেওড়া গাছের আড়ালে বড়সড় চাঁদ। সেই আলো বাইরে বড় নদীতে পড়ে চারপাশে বাড়তি ঝলকানি। এই জঙ্গলের ভিতর তারই কিছু অংশ। খানিক আগে অদূরে গাছপাতার ঘন কালো রঙে তাই এখন সামান্য হলেও সবুজের আভা। অদূরে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সেই কথাই ভাবছিলাম, হঠাৎই কেবিনের ভিতর থেকে চুড়ির আওয়াজ ভেসে আসতে প্রায় চমকে উঠলাম। বোটে অন্য মানুষ আছে কিনা ভাবছিলাম, অথচ একজন মহিলাও রয়েছেন। এযাবৎ কিছুমাত্র আওয়াজ পাইনি।

‘কাণ্ড দেখ!’ ভিতরে সেই চুড়ির আওয়াজে ভূতনাথ দত্ত প্রায় ধড়মড়িয়ে উঠে আমার দিকে চোখ ফেরালেন। ‘নতুন মানুষ আপনি। দেখুন দেখি কিছুমাত্র হুঁশ নেই! আপনার সঙ্গীর সঙ্গে শুধু গল্পই করে যাচ্ছি! আর ধনপতি, আপনিও কেমন মানুষ বলুন তো। একবারও মনে করাননি!’

আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘তাতে কী দাদা! এই নতুন পরিবেশে সময় কিন্তু খারাপ কাটেনি। তাই আর কথা বলিনি।’

‘না–না, তা বললে হয়। আজ নতুন অতিথি আপনি।’ প্রবল বেগে ঘাড় ঝাঁকালেন ভদ্রলোক। তারপর ধনপতিবাবুর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ‘ভাল মাধ্বী আনা হয়েছে। এই সন্ধেয় সামান্য হয়ে যাক তাহলে।’

‘সে আমি তখনই দেখে নিয়েছি দাদা।’ উত্তরে একগাল হাসলেন ধনপতিবাবু। চোখ দুটো চকচক করে উঠল। হাত বাড়িয়ে সামনে একটা ঘড়ার ঢাকনা সামান্য তুলতেই নেশা ধরানো দারুণ এক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। খুব দামি কোনো মদ বলেই মনে হল। বুক ভরে বড় একটা শ্বাস টেনে ঘড়ার ঢাকনা ফের বন্ধ করে দিয়ে বললেন, ‘সারকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি, আজ এসব থাক দাদা।’

ঘড়া ভরতি মদ যে যথেষ্টই মহার্ঘ, গন্ধেই বুঝতে পারছিলাম। তার উপর ধনপতি লশকরের মতো নেশাড়ু মানুষ! তাড়াতাড়ি বললাম, ‘তাতে কী ধনপতিদা! কিছু মনে করব না আমি।’

‘নাহ্‌, আজ থাক সার।’ আমার কথায় চোখ দুটো ফের চকচক করে উঠলেও ধনপতিবাবু সামলে নিলেন আবার। ‘তবে জিনিসটা কিন্তু দারুণ সার। সুন্দরবনের মধু থেকে তৈরিই শুধু নয়, অন্তত দশ বছর বিশেষ ধরনের জালায় স্টোর করে রাখা। একবার শুরু করলে থামা যাবে না। ওদিকে অন্য ব্যাপারও আছে। তারপর খিদেও তো পেয়েছে আপনার। পায়নি?’

খিদে যে পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই দুপুরের টুরিস্ট বোট ছেড়ে আসার পর পেটে কিছুই পড়েনি। এতক্ষণ যে খেয়াল হয়নি, তার কারণ ভিতরের চাপা আশঙ্কা। উত্তরে সামান্য ঘাড় নাড়লাম মাত্র। ধনপতিবাবু অবশ্য সেদিকে তেমন নজর দিলেন মনে হল না। পাশে ভূতনাথ দত্তর দিকে সামান্য ঝুঁকে ছোট করে বললেন, ‘দাদা আজ কাকে নিয়ে এলেন?’

উত্তরে ভূতনাথ দত্ত সামান্য মাথা নাড়লেন মাত্র। তারপর গলা চড়িয়ে ভিতরের মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘চারু তোকে বলা হয়নি, আজ কিন্তু একজন নতুন অতিথি এসেছে। ব্যবস্থা হয়েছে?’

উত্তরে ভিতর থেকে ফের চুড়ির আওয়াজ।

ভূতনাথ দত্ত ব্যস্ত হয়ে আমার দিকে ঘাড় ফেরালেন এবার। ‘মহাশয়, চলুন তাহলে। খালি পেটে গল্প হয় না। ভিতরে চলুন। কিছু জলখাবারের ব্যবস্থা হয়েছে।’

বলতে বলতে আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন উনি। উঠে পড়লাম আমরাও।

দরজার পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকে যতটা চমকাবার ততটাই চমকে উঠলাম যেন। বাইরে থেকে তেমন বোঝা না গেলেও যথেষ্টই বড় কেবিন। তা ছাড়া বোটে এমন সাজানো গোছানো কেবিন থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাসই হত না। মেঝেতে পুরু কার্পেট। একধারে সুসজ্জিত খাট। তারপরেও মেঝেতে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা। সেখানে ধপধপে চাদর বিছিয়ে দুটো আসন পাতা হয়েছে। সামনে ঝকঝকে বড় কাঁসার থালায় ভেজানো মুড়ি–চিঁড়ে, বড় মর্তমান কলা, পাটালি গুড়। পাশে বাটি ভরতি দুধ।

ঘরে ঢুকতেই উনি আমাদের বসে পড়তে অনুরোধ করলেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সে কী দাদা! আপনি বসবেন না?’

‘এই সময় আমি খাই না কিছু। বসে পড়ুন আপনারা।’

ইতস্তত করছিলাম তবু। কিন্তু ধনপতিবাবুকে দিব্যি বসে পড়তে দেখে আর বাক্যব্যয় করলাম না।

কলকাতার মানুষ। চিঁড়ে–মুড়ি সহযোগে এমন জলখাবার বহুদিন খাওয়া হয়নি। থালার উপর সবে বাটির দুধ ঢেলেছি, দুই পায়ে ভারি তোড়ার ঝম–ঝম আওয়াজে এক মহিলা পাশের কেবিন থেকে ঘরে ঢুকলেন। বড়সড় দেখতে হলেও বয়স বছর পঁচিশের বেশি নয় বলেই মনে হল। ফর্সা আকর্ষণীয় চেহারা। গোড়ালির সামান্য উপরে পরা শাড়ি কিছু খাটো হলেও গা ভরতি সোনা–রূপোর হরেক গয়না। কোমরে ভারি চন্দ্রহার। মাথায় টানা আঁচলের ফাঁকে কান ভরতি এক গোছা করে ছোট–বড় সোনার মাকড়িই শুধু নয়, নাকে ঝিলিক দিচ্ছে বড় টানা নথ। হাত ভরতি সোনার চুড়ি, ডানায় মোটা তাগা। দুই পায়ের একাধিক আঙুলে প্যাঁচানো আঙ্গোট। বড় এক বাটি হাতে দু’জনের থালায় খই দিলেন অনেকটা করে। কনকচূড়া ধানের খইয়ের কথা পড়েছি। কেমন স্বাদ, খেয়ে দেখা হয়নি। কিন্তু মহিলা থালায় যখন মুঠো ভরে দিচ্ছিলেন, চমৎকার এক গন্ধ নাকে আসছিল। মনে হল, তেমনই কোনো ধানের খই।

অগত্যা খাওয়াটা কিছু বেশিই হয়ে গেল। পাশে ধনপতিবাবু কিছু বেশিই খেলেন আরো। শুধু খই নয়, বাড়তি চিঁড়ে–মুড়িও নিলেন। অতিরিক্ত এক বাটি দুধ, কলা আর পাটালি। ভূতনাথ দত্ত ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশে। খেতে খেতে সমানে গল্পও করে যাচ্ছিলেন। ধনপতিবাবু হঠাৎই তাঁকে বললেন, ‘এটি দাদার নতুন সেবাদাসী বুঝি? আগের বার তো দেখিনি!’

‘তা, তা বললে কিছু বলার নেই আমার!’ মুখে বললেও ভূতনাথ দত্তর কণ্ঠে হঠাৎই কিছু উষ্মা ঝরে পড়ল, ‘চারুমতি আমার খাস অন্দরমহলের।’

‘ভুল হয়ে গেছে দাদা!’ রীতিমতো হোঁচট খেয়ে জিব কাটলেন ধনপতিবাবু। ‘বেজায় ভুল হয়ে গেছে। আসলে…’

‘আরে তাতে কী।’ সান্ত্বনা দিলেন ভূতনাথ দত্ত। ‘হাজার হোক, খুব ভুল তো বলেননি। সেবার হঠাৎই এক সওদাগরের নৌকো পাকড়াও হয়েছিল। ব্যাটা মাশুলের কড়ি না মিটিয়ে সরে পড়ার মতলবে ছিল। কিন্তু ভূতনাথ দত্তর পাইকদের ফাঁকি দেয় সাধ্য কী! চারুমতিও ছিল সেই নৌকোয়। খবর কানে আসতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম অন্দরমহলের দুই খাস দাসীকে। তারা দেখে এসে যে খবর দিয়েছিল, তাতে আর দেরি করা যায়নি। একদম সর্ব সুলক্ষণা, পীনপয়োধর পদ্মিনী। খুঁত একটাই, কুমারী নয়। তা সওদাগর নৌকোর মেয়ে কী আর কুমারী হয়! তাই তুলে আনলেও খুব অমর্যাদা করিনি। গোড়ায় ভেবেছিলাম চারুমতিকে বিয়ে করেই অন্দরমহলে তুলব। পরে ভাবলাম, এই বয়সে ফের বিয়ের চক্করে পড়া ঠিক হবে না! ঘরে তিনটে বউ! তাই আর সেদিকে যাইনি। তবে খুব অমর্যাদাও করিনি। অন্দরমহলে তিন বউয়ের সঙ্গেই রেখেছি। খুশি চারুমতিও।’

‘সে তো অবশ্যই দাদা। হাজার হোক মানি মানুষ।’ বিগলিত উত্তর ধনপতিবাবুর।

বাদার ঘোর জঙ্গলের মধ্যে এই অসময়ে দিব্যি সখের বোট ভিড়িয়ে এক সেবাদাসী নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন ভদ্রলোক! ব্যাপারটা কিছু অবাক হবার মতো অবশ্যই। কিন্তু হঠাৎই সেটা যেন চরমে পৌঁছল! নিতান্তই নতুন মানুষ আমি। সবে মাত্র পরিচয়, কিন্তু পূর্ব পরিচিত হলেও ধনপতি লশকরের সঙ্গেও কী নিজের পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে এমন খোলাখুলি আলোচনা সম্ভব! বিশেষ করে যার সম্বন্ধে আলোচনা তাঁর সামনেই। ভাবতে গিয়ে আমার নিজের কান–মাথা প্রায় ঝাঁঝাঁ করে উঠল। ভেবেছিলাম ধনপতিবাবুও বিষয়টি হয়তো পাশ কাটিয়ে যাবেন। কিন্তু উলটোই হল বরং। খেতে খেতেই চারুমতিকে নিয়ে দিব্যি কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তবে সত্যি বলতে কী, ওই অবস্থায় সেসব কথা আমার কানে ঢুকলেও মগজে পৌঁছয়নি।

একরকম নিঃশব্দেই খেয়ে উঠেছিলাম তারপর। খাওয়া শেষ হতেই ধনপতিবাবু বললেন, ‘সার, আপনি দাদার সঙ্গে কিছুক্ষণ কেবিনে বসুন। আমি বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট টেনে আসি।’

বলতে যাচ্ছিলাম, তাহলে আমিও বাইরে যাই বরং। কিন্তু তার আগেই ভূতনাথ দত্ত ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি নতুন মানুষ। এখন বাইরে না যাওয়াই ভাল। বরং বসুন এখানে। খানিক গল্প করা যাক। সেই থেকে আপনার সঙ্গে তেমন কথা বলারই সুযোগ পাইনি।’

ইতিমধ্যে মহিলা মেঝের পাতা চাদর, এঁটো থালা–বাটি গুছিয়ে নিয়ে গেছে। ধনপতিবাবু দরজার কাছে গিয়েও হঠাৎ পাশে কেবিনের দেয়ালে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেয়ালে কুলুঙ্গি গোছের ছোট এক তাকে একটা পোড়ামাটির মূর্তি। ভদ্রলোক সেই কুলুঙ্গিতে মাথা ঠেকিয়ে মিনিট খানেক থম হয়ে রইলেন। শেষে জোড়হাতে প্রণাম করে কেবিন থেকে বের হয় গেলেন।

ছোট মূর্তিটা কেবিনের ভিতর থাকলেও এতক্ষণ চোখে পড়েনি। এবার দৃষ্টি পড়তেই নড়ে উঠলাম। নিমেষে মাথা থেকে হারিয়ে গেল আগের সব ব্যাপার। পাশে ভূতনাথবাবুকে বললাম, ‘ছোট ওই মূর্তিটা একটু দেখতে পারি দাদা?’

‘কী? ওই ভৈরব?’

‘ভৈরব! ভৈরব কী?’ থতমত খেয়ে বলে ফেললাম। আসলে মূর্তিটা দেখতে চেয়েছিলাম অন্য কারণে। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্বর উপর ঝোঁক আছে। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, ঠিক এমন একটা পোড়ামাটির পুতুল মূর্তি চন্দ্রকেতুগড়ে এক ভদ্রলোকের কাছে দেখেছি আগে। তাঁর কাছেই শুনেছিলাম মূর্তিটি অন্তত দেড়–দুই হাজার বছরের পুরনো। চন্দ্রকেতুগড়ের মাটির তলায় বা প্রাচীন গড়ের জলার কাদায় এমন নানা মূর্তি পাওয়া গেছে। সবই সেই প্রাচীন দিনের। অগত্যা কিছু অবাক হবারই কথা। এত প্রাচীন কাল আগের ওই মূর্তির পরিচয় উনি জানলেন কী করে! অবাক হয়ে বললাম, ‘ওটি যে ভৈরবের মূর্তি, জানলেন কী করে! যতদূর জানি, অনেক পুরনো দিনের জিনিস। অন্তত দেড়–দুই হাজার বছর।’

‘পুরনো আমলের বলেই তো জানি ভাই।’ ভূতনাথ দত্ত অল্প হাসলেন। ‘ওই ধনপতিই পেয়েছে ওটা।’

‘কোথায়?’

‘কোথায় আবার? এই নেতিধোপানির জঙ্গলে। জানেন নিশ্চয়, এদিকে মাঝে–মধ্যেই আসেন উনি। আগে অবশ্য এত ঘন ঘন আসতেন না। সেবার হঠাৎই এক খবর পেলেন, জঙ্গলের ভিতর এক মউলে একটা পোড়ামাটির অদ্ভুত মূর্তি খুঁজে পেয়েছে। এমন হরেক পোড়ামাটির ছোট মূর্তি এদিকে মাঝে–মধ্যেই পাওয়া যায়। অনেকের সংগ্রহের বাতিক আছে। ধনপতির অবশ্য সে বাতিক নেই। তবে খবর পেলেই ছুটে যান। বিক্রি করে কিছু আয় হয়। তা খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন সেই মউলের কাছে। গিয়ে শোনেন, ইতিমধ্যে গ্রামের বৃন্দাবন দাস সেটা এক টাকায় কিনে নিয়ে গেছে। এদিকের জেলে–মউলেদের কাছে এসব জিনিস ওই রকম দামেই হাত বদল হয়। অথচ যাদের সংগ্রহের বাতিক আছে, তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় অনেক বেশি। উনি সেটা জানতেন বলেই ধাওয়া করেছিলেন বৃন্দাবন দাসের বাড়িতে।

‘বৃন্দাবন দাস গ্রামের ওঝা। ঝাড়ফুঁক করে রোগ–বালাই সারায়। তেমন নামডাক নেই অবশ্য। কেউ যায়ও না। কিন্তু হঠাৎই রটে গেল বৃন্দাবন ওঝার ঝাড়ফুঁকে নাকি মন্ত্রের মতো কাজ হয়। বাড়িতে লোক ছুটে আসছিল দূর দূর থেকে। দিন কয়েক চলেছিল ভালই। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ এক রাতে রক্তবমি হয়ে মরো–মরো অবস্থা। দিন দুয়েক হল সামান্য উঠে বসতে পারছে। এমন মানুষের কাছে পুতুলটা কেনার কথা কিভাবে পাড়বে, ভেবে পাচ্ছিল না ধনপতি। কিন্তু অবাক কাণ্ড! ধনপতিবাবুকে দেখেই লোকটা হাঁ করে তাকিয়ে রইল খানিক। তারপর ঝাড়ফুঁকের জিনিসপত্রের ঝুলির ভিতর থেকে মূর্তিটা বের করে নিজেই বলল, ‘এটা আপনি নিয়ে যান বাবু। আমার দরকার নেই।

‘কেন?

‘বেজায় অবাক হয়েই ধনপতি বলে ফেলেছিলেন।

‘উত্তরে বৃন্দাবন সামান্য ঢোঁক গিলে বলল, বাবু, আপনি যে এসেছেন সেটাই আমার ভাগ্য। গত রাতে যে ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছি, তারপর ওটা আর এক বেলা কাছে রাখার জো নেই।

‘বৃন্দাবন ঝাড়ফুঁক করা ওঝা মানুষ। এমন অনেক সংস্কার আছে ওদের মধ্যে। ধনপতি তাই আর উচ্চবাচ্য করেননি।

‘মূল্য স্বরূপ পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে দিতে গিয়েছিলেন। বৃন্দাবন হাঁ–হাঁ করে উঠল, দাম নিতে পারবে না। সে উপায় নেই।

‘তা ধনপতিকে একটা কড়ি যেমন খরচ করতে হয়নি, জিনিসটা হাতে নিয়েই বুঝেছিলেন, পোড়ামাটির এমন অনেক মূর্তি, চৌকো পাটা আগে হাতে এলেও, এমন জিনিস কখনো দেখেননি। ভুঁড়ি সর্বস্ব ছোট এক বামন মূর্তি। খাটো মোটা মোটা হাত–পা। তুলনায় মাথা অনেক বড়। চাপা নাক, অদ্ভুত রকমের পুরু ঠোঁট আর পাকানো দুই চোখের দিকে তাকালে গা শিরশির করে। অভিজ্ঞ মানুষ ধনপতি দেখেই বুঝেছিলেন, জিনিসটা বেশ দামেই বেচতে পারবেন। সেই মউলের কাছেই শুনেছিলেন, নেতিধোপানির জঙ্গলে ভাঙা ইট ভরতি যে জায়গা থেকে সে এটা কুড়িয়ে পেয়েছে, সেখানে এমন আরো থাকা সম্ভব। কিন্তু খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে ভাঙা ইটের ভিতর থেকে একটা গোটা নরকঙ্কাল বের হয়ে পড়ায় সাহস পায়নি।

‘সেকথা মনে পড়তেই ধনপতি আর দেরি করেননি। ফেরার পথে সেই মউলেকে সঙ্গে নিয়ে ধাওয়া করেছিলেন নেতিধোপানির জঙ্গলে। যদি সেগুলো পাওয়া যায়। কিন্তু মেলেনি একটিও। জোয়ারের তোড়ে ইতিমধ্যে ধুয়ে সাফ হয়ে গেছে পুরো জায়গা। একটি ইটও নেই সেখানে। নেই সেই নরকঙ্কালটিও। দেখে মউলে তো ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার জোগাড়। এতদিন ধরে এই জঙ্গলে আসছে, অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ানো ভাঙাচোরা ইটগুলো নজরে পড়েছে প্রতিবার। এই সামান্য কয়েক দিনের মধ্যে জোয়ারের জলে সব ধুয়ে গেল, বিশ্বাস হতে চাইছিল না। তা ধনপতির সঙ্গে সেদিন আমার দেখা এই নেতিধোপানির জঙ্গলেই।’

ভূতনাথ দত্ত থামলেন। অবাক হয়ে শুনছিলাম। তাড়াতাড়ি বললাম, ‘তারপর?’

সামান্য লেখালেখির অভ্যাস আছে। তাই বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ভদ্রলোকের কথা শেষ হয়নি এখনো। অনুমান মিথ্যে নয়। আমার কথায় তিনি মুখ খুললেন আবার।

‘তারপরের ব্যাপারটা বেশি নয় খুব। ধনপতিকে দেখেই সোজা বলেছিলাম, দাদাভাই, পোড়ামাটির মূর্তিটা দিয়ে দিন আমাকে। ও স্বয়ং ভৈরব। আপনি রাখতে পারবে না। ভয়ানক ক্ষতিও হতে পারে। বরং কিছু কাজে লাগবে আমার। এই ভূতনাথ দত্তর কাছে কিছু প্রতিদানও পাবেন। 

‘তা বুদ্ধিমান মানুষ উনি। আমার কথা অমান্য করতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন, ভৈরব কী দাদা?

‘তা ভৈরবের বৃত্তান্ত তো দু’এক কথায় বোঝানো যায় না। সামান্যই বলতে পেরেছিলাম। তাতেই আর দ্বিরুক্তি করেননি। দিয়ে দিয়েছিলেন। ধনপতির সেই উপকার এই ভূতনাথ দত্তর পক্ষে ভোলা সহজ নয়। ভুলিওনি তারপর। মাঝে মধ্যেই আসেন এদিকে। পুরুষ মানুষ। এমন কিছু বয়সও নয়। সাধ–আহ্লাদ মিটিয়ে যান।’

কীসের সাধ–আহ্লাদ? সামান্য ওই পোড়ামাটির মূর্তি ভূতনাথবাবুর কী উপকারে লাগে? এমন হরেক প্রশ্ন তখন ভিড় করেছে মনের ভিতর। তবু সেসব সরিয়ে রেখে বললাম, ‘ভৈরব কী দাদা? যদি বলেন একটু।’

‘আপনি অতিথি। তার উপর লেখক মানুষ। না বলার কারণ নেই। আর সেসব তো এই দেশেরই কথা!’ ভূতনাথ দত্ত মাথা নাড়লেন। ‘আপনি নিজেই তো বললেন, অনেক পুরনো দিনের জিনিস ওটি। একটুও ভুল বলেননি। কিন্তু কত দিন আগের বলতে পারেন?’

উত্তরে মাথা নাড়লাম, ‘ঠিক জানি না। তবে শুনেছি, অন্তত দুই হাজার বছর আগের।’

‘অত নয়।’ অল্প মাথা নাড়লেন উনি। ‘তবে  হাজার বছর তো অবশ্যই। সারা বাংলায় তখন বৌদ্ধ ধর্মের প্লাবন। সাধারণ মানুষ সবাই প্রায় বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী। যেহেতু বৌদ্ধধর্মে তখন তন্ত্র চর্চার ব্যাপক প্রভাব, তাই রাজকোষের অর্থে গড়ে উঠেছিল বহু বৌদ্ধ বিহার আর মঠ। এই যে বাদা অঞ্চল সুন্দরবন, এখানেও গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার আর মঠ। এই সব বৌদ্ধ মঠে শুধু ধর্ম বা তন্ত্র চর্চাই নয়। নিজ নিজ অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থাও ছিল মঠের প্রধানদের হাতে। মঠের প্রধানের কথাই ছিল আইন। তাঁরাই বিধান দিতেন, দেশের রাজার হয়ে কর আদার করতেন। অথচ তাঁদের কোনো আরক্ষী বা পেয়াদা ছিল না। তবু সাধারণ মানুষ রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বৌদ্ধ মঠে এসে মিটিয়ে দিয়ে যেতেন। মঠের প্রধানদের তারা শুধু ভক্তি নয় ভয়ও করত।

‘সবাই জানত, মঠের প্রধান ক্রুদ্ধ হলে তার পরিণতি ভয়ানক। নিমেষে কাউকে ভেড়া–ছাগল পর্যন্ত করে দিতে পারেন। ভয় না পেয়ে উপায় কী? আসলে এই প্রধানরা ছিলেন খুব উঁচু স্তরের তন্ত্র সাধক। বহু বছরের সাধনায় তাঁরা অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সবাই জানত, তন্ত্র সম্মত বেশ কয়েকজন অপদেবতা বা শক্তি তাঁদের কাছে বাঁধা হয়ে রয়েছে। প্রয়োজন হলে মঠের প্রধান ব্যবহার করেন তাদের। অল্প সময়ের মধ্যে কাজ হাসিল করে ফেলতে পারে তারা। অমান্যকারীর পরিণতি হয় ভয়ানক।

‘ভৈরব এমনই এক শক্তি। সাধারণ মৃৎশিল্পী দিয়েই তৈরি হত মূর্তিগুলো। অনেকে ঘরে রেখে ধুপ-ধুনো দিয়ে নিয়মিত পুজোও করতেন। কিন্তু ভৈরবের প্রকৃত ক্ষমতা আরোপ হত এক–আধটি মূর্তিতে মাত্র। বছরের এক বিশেষ রাতে মঠের অধ্যক্ষ তাকে মন্ত্রপূত করতেন। ভৈরব মন্ত্রের প্রভাবে মাটির তৈরি মূর্তিটি তখন অসীম ক্ষমতা লাভ করত। মঠের প্রধানের যে কোনো নির্দেশ অল্প সময়ের মধ্যে পালন করে ফেলত। শুধু মঠের প্রধানই নয়, মঠের অন্য অনেকেও কম–বেশি এমন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। শাসন সংক্রান্ত কাজের সুবিধার জন্য তাঁরা এমন কিছু ভৈরব অন্যদেরও দিতেন। নিজ অঞ্চলের আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা, কর আদায় প্রভৃতি কাজ তাঁরাও করতেন। গৃহে মন্ত্রপূত ভৈরব রাখার জন্য কিছু নিয়মও মানতে হত তাঁদের। অন্যথা হলেই বিপদ। মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারত। অসীম ক্ষমতাশালী হবার সম্ভাবনা সত্ত্বেও অনেকই তাই এই মন্ত্রপূত ভৈরব কাছে রাখতে চাইতেন না। পশার জমে উঠলেও বৃন্দাবন ওঝা হঠাৎ রক্তবমি হয়ে যে মরতে বসেছিল, তা ওই কারণে।’

ভূতনাথ দত্ত থামলেন। সেকালের তন্ত্র সাধনা নিয়ে এমন নানা গল্প কথা শোনা যায়। ভৈরব না হলেও হাকিনী, ডাকিনীর কথা নিজেই শুনেছি। আজও অনেক তান্ত্রিক নাকি এসব অপদেবতার চর্চা করেন। নির্দেশ পেলেই তারা জেগে উঠে কাজ হাসিল করে আসে। এসব কাজে অতি সামান্য ভুলেও নাকি তান্ত্রিকের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আজকাল কেউ তাই এসবের চর্চা তেমন করেন না। হারিয়েই যেতে বসেছে। তাই বলে প্রায় হাজার বছর আগে যে ভৈরবকে মন্ত্রপূত করা হয়েছিল, তার ক্ষমতা কী এত বছর পরেও থাকা সম্ভব! নীরবে ভাবছিলাম তাই। আমার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে উনি টের পেয়ে বললেন, ‘যাই ভাবুন, মনে রাখবেন এই ভৈরব মন্ত্রপূত করেছিলেন হলদি মঠের প্রধান। অসীম ছিল তাঁর তন্ত্রশক্তির ক্ষমতা। সারা জীবনে ওই একটিমাত্র ভৈরবের মূর্তিই মন্ত্রপূত করেছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর মঠের অন্য আচার্যরাও ব্যবহার করেছেন। তারপর এদিকের এক জমিদারের হাতে এসেছিল। গোড়ায় নিতান্তই এক ছোট জমিদার ছিলেন তিনি। তারপর সেই ভৈরব মন্ত্রের প্রভাবে অল্প দিনের মধ্যেই বিশাল এক জমিদারির মালিক হয়ে উঠেছিলেন। রাজা বলত সবাই।

‘রাজার মতোই ছিল তাঁর ক্ষমতা। কিন্তু চিরকাল কী সমান যায়? নিশ্চয় জানেন, বঙ্গের এই বাদা অঞ্চল বরাবরই মৃত্যুপুরী। দক্ষিণের সাগর থেকে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে মাঝেমধ্যেই। তার বেশিরভাগই তেমন বড় নয় অবশ্য। বাদার মানুষ পরোয়াও করে না। জানে, এই ঝড়–তুফান নিয়েই তাদের দিন কাটাতে হবে। বাঁচার হরেক উপায় খুঁজে নেয়। বদর নামে তাঁর নিজেরই এক মাঝি ছিল। মাল বোঝাই মস্ত নৌকোয় হাল ধরে বসলে, ঝড়–তুফানের সাধ্য কী তার সেই নৌকোর ক্ষতি করে!

‘কিন্তু কোনোটা যদি সত্যিকারের মারণ ঘূর্ণিঝড় হয়, সর্বনাশের বাকি থাকে না তখন। মারণ ঝড়ে কতবার যে এই বাদা অঞ্চল বসতি শূন্য হয়েছে তার হিসেব নেই। সেবারেও এমন এক ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল এদিকে।’

অল্প থেমে ফের বলতে শুরু করলেন উনি, ‘সেদিন দুপুর থেকে হঠাৎই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। বিকেল হতেই জোরাল বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি। কেউ গুরুত্ব দেয়নি তেমন। দূরদর্শী মানুষটি কিন্তু বুঝেছিলেন, ঝড়ের গতিপ্রকৃতি একেবারেই সুবিধের নয়। পুজোর ঘরে ছুটে গিয়ে ভৈরবের সামনে প্রার্থনায় বসেছিলেন তারপর। আশা ছিল, অসীম ক্ষমতাধর ভৈরব তাঁর মন্ত্রের প্রভাবে রক্ষা করবেন। কিন্তু রাত যত বাড়তে লাগল, বাড়তে থাকল ঝড়ের তাণ্ডব। সেই সঙ্গে আছড়ে পড়তে লাগল বিশ–তিরিশ হাত উঁচু ঢেউ। সেই প্রলয় কাণ্ড রোধ করার ক্ষমতা ভৈরবের ছিল না। ভোর হবার আগেই তছনছ হয়ে গিয়েছিল সব। মানুষটির অত বড় রাজবাড়ি, রাজত্ব, অত জনমানুষ, কেউ রক্ষা পায়নি। রক্ষা পায়নি স্বয়ং ভৈরবও। চাপা পড়ে ছিল ধ্বংসস্তূপের ভিতর। কিন্তু হাজার হলেও হলদি মঠের প্রধান আচার্যের মন্ত্রপূত ভৈরব। সেই ভৈরব মন্ত্রের শক্তি আগের মতো না থাকলেও যা ছিল, তাও অনেক। গুনিন বৃন্দাবন ওঝার হাতে পড়তেই জেগে উঠেছে আবার। তারপর ধনপতির হাত হয়ে আমার কাছে। ওনাকে যে এত খাতির করি সে ওই কারণে।’

‘ভৈরবের মূর্তিটা একটু দেখতে পারি দাদা?’ আগেও একবার বলেছিলাম। ভূতনাথ দত্ত থামতে ফের অনুরোধ করলাম।

আগের বার মানুষটি আমার অনুরোধে একেবারেই কর্ণপাত করেননি। কিন্তু এবার কিছুটা থমকে গেলেন যেন। থম হয়ে কী ভাবলেন খানিক। তারপর ইতস্তত করে বললেন, ‘আপনি অতিথি মানুষ। তায় নিয়ে এসেছে ধনপতি, না করার উপায় নেই। দেখেই আসুন তাহলে। তবে খুব কাছে যাবেন না।’

অনুমতি হতে আর দেরি করিনি। উঠে কেবিনের দেয়ালে কুলুঙ্গির সামনে এসে দাঁড়ালাম। আগেই বলেছি পরিচিত একজনের কাছে প্রায় এমনই একটি মূর্তি দেখেছি। খুব একটা ব্যতিক্রম নয় তার থেকে। সেই ভুঁড়ি সর্বস্ব বেঁটে বামন। খাটো মোটা হাত–পা। ঝাঁকড়া চুল। পুরু ঠোঁট আর দুই চোখে কড়া দৃষ্টি। দুটিতে পার্থক্য তেমন নেই। আগের পুতুলটির দু’এক স্থান ভাঙা ছিল। এটা একদম অটুট। দেখে মনে হয়, মাত্র দিন কয়েক আগের তৈরি। এত বছর আগে তৈরি পোড়ামাটির ছোট মূর্তি, নোনা জলকাদায় পড়ে ছিল বহু বছর। অথচ ঝকঝকে পালিশ একদম অটুট! পরে রং করা হয়নি তো! ভাবতে ভাবতে অজান্তেই হাত দিয়েছিলাম কুলুঙ্গির সেই মূর্তির উপর। মুহূর্তে টেনে নিলাম হাত। আঙুলে প্রায় ছ্যাঁকা লাগল যেন, এতটাই গরম!

‘আহ্!’

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ছ্যাঁকা লাগা আঙুলের দিকে তাকাতে যাব, অদূরে খাটে বসা ভূতনাথ দত্ত প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন। তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোক বুকে হাত চেপে মস্ত হাঁ করে হাঁপাচ্ছেন।

একটু আগে যে মানুষটি দিব্যি কথা বলছিলেন, হঠাৎ এমন কী হল বুঝতে না পেরে ছুটে গেলাম। ‘কী, কী হয়েছে দাদা?’

জবাব দেবার মতো অবস্থা তখন নেই তাঁর। সেই ভাবেই বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে থাকলেন। তারপর মিনিট দুই পরে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মাথা নাড়লেন। ‘ও কিছু নয়। বয়স তো হয়েছে। হাঁপানির টানটা হঠাৎই বাড়ে কখনো। যাই হোক, কুলুঙ্গির কাছে আপনার আর না যাওয়াই ভাল। বসুন এখানে।’

ইচ্ছে ছিল মূর্তিটা কাছে গিয়ে আর একবার দেখার। কিন্তু ভদ্রলোকের ওই কথার পর ইচ্ছেটা ত্যাগ করতেই হল। সামান্য ইতস্তত করে বললাম, ‘ভৈরবের মূর্তিটা ভয়ানক গরম দেখলাম! কেন বলুন তো দাদা?’

উত্তরে এই প্রথম একরাশ ক্ষোভ ঝরে পড়ল ভদ্রলোকের কণ্ঠে। মুখ বিকৃত করে বললেন, ‘আপনাকে, আপনাকে বলেছিলাম না বেশি কাছে যাবেন না? অথচ দিব্যি হাত দিয়ে ফেললেন! কী বিপদ হতে পারত জানেন? এতক্ষণে আমার এই সখের বোট ডুবেও যেতে পারত। দু’দুটো কুমিরের আস্তানা এই খালে!’

ভদ্রলোকের সেই কথায় মিইয়ে গেলাম একেবারে। কুমিরের ব্যাপারটা মিথ্যে নয়। একটু আগে তাদের একটা নিজের চোখেই দেখেছি। কিন্তু মূর্তির গায়ে হাত দেবার সঙ্গে এত বড় একটা বোটের জলে ডুবে যাবার কী সম্পর্ক বুঝে উঠতে পারলাম না। নীরবে বসে আছি, হঠাৎ খেয়াল হল, ধনপতিবাবু সেই যে সিগারেট টানতে বাইরে গেছেন, আর ফেরেননি। অথচ প্রায় ঘণ্টা খানেক পার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কোথায় গেলেন উনি! ভূতনাথবাবুকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও ভরসা হল না। ভদ্রলোকের মুখের ভাব এখনো স্বাভাবিক হয়নি। মনে হল, এখনো বেশ রেগে রয়েছেন আমার উপর। প্রশ্ন করতে ভরসা হল না।

ওই সময় পাশের কেবিন থেকে চুড়ি, কোমরের গোট, তোড়া প্রভৃতির মৃদু আওয়াজ কানে এল। হঠাৎই খেয়াল হল পাশের কেবিন থেকে এমন আওয়াজ অনেকক্ষণ ধরেই কানে আসছে। কিন্তু ভূতনাথ দত্তর গল্পে মজে একেবারেই গুরুত্ব দিইনি তখন। এবার কান পেতে অল্প শুনতেই সারা শরীর প্রায় শিরশির করে উঠল। এ আওয়াজ স্বাভাবিক নয়। সর্বাঙ্গে গহনা পরিহিতা রমণীর সঙ্গে সহবাস কালীন আওয়াজ। চাপা শীৎকারও কানে এল। রতিক্রিয়ার চরম মুহূর্তে রমণী কণ্ঠে শিহরণ ধ্বনি।

খানিক আগে খাবার সময় চারুমতি নামে সেই মহিলা পাশের কেবিন থেকে বের হয়ে পরিবেশন করেছিলেন। বোটে ওই কেবিনেই রয়েছেন। ভূতনাথ দত্ত নিজেই বলেছেন, মহিলা তাঁর নতুন সেবাদাসী। সন্দেহ নেই, সেই কেবিনে এই মুহূর্তে একজন পুরুষও রয়েছেন। মহিলা তাঁর সঙ্গে রতিক্রিয়ায় রত। তিনি কী ধনপতিবাবু স্বয়ং? খাওয়ার সময় দুইজনে যখন কথা চলছিল, ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল তার মধ্যে যৌনতার গন্ধ ছিল যথেষ্ট! উপভোগ করছিলেন উভয়ই। ধনপতিবাবু তাহলে কী এই উদ্দেশ্যেই আজ এখানে এসেছেন? সব কিছু মেলাতে গেলে সেটাই সম্ভব। কিন্তু তবু ভাবতে মন চাইছিল না।

মিনিট কয়েক কেটে গেছে তারপর। দুই জনের কারো মুখেই কথা নেই। পাশের কেবিন থেকে কোনো আওয়াজ আর নেই তখন। হঠাৎই সেই দরজার পর্দা সরিয়ে বের হয়ে এলেন ধনপতিবাবু। অবিন্যস্ত চুল, জামাকাপড়। দ্রুত হাতে সেগুলো ঠিক করে পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াচ্ছেন, ভূতনাথ দত্ত ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘আরে, এর মধ্যে হয়ে গেল! প্রায় দুই মাস পরে এলেন! চারুমতিকে পছন্দ হয়নি?’

‘ন্‌–না দাদা।’ উত্তরে জিব কাটলেন ধনপতিবাবু, ‘দাদা নিজের খাস দাসীদের পাঠিয়ে রীতিমতো পরখ করে যাকে ঘরে এনেছেন, তার কোনো কিছু মন্দ হবার উপায় আছে! দারুণ কাটল সময়টা।’

‘তবে যে এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন? শুধু আপনার কথা ভেবেই চারুমতিকে এনেছি আজ!’ ভূতনাথ দত্তর কণ্ঠে তীব্র আপসোস তখনো।

‘তাহলে বলেই ফেলি দাদা।’ সামান্য ইতস্তত করে ধনপতিবাবু বললেন, ‘দারুণ সুখে মজে রয়েছি তখন। হঠাৎ কেমন দুলে উঠল বোট। তারপর…।’

কথা শেষ না করে ছোট এক ঢোঁক গিলে থেমে গেলেন ধনপতিবাবু।

ফের কথা শুরু করার আগেই ভূতনাথ দত্ত বললেন, ‘বুঝেছি ভাই। সে একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল তখন। ভালয় ভালয় সামাল দেওয়া গেছে।’

‘অ্যাঁ! কী হয়েছিল দাদা? কী ভয়ানক বরফের ছ্যাঁকা হঠাৎ! তবে চারুমতি অল্প সময়ের মধ্যেই সামলে নিতে পেরেছে। তাই তাল একটু কেটে গেলেও কাজ শেষ করতে পারা গেছে। বলি কী দাদা, পরের বার আবার চারুমতিকেই যদি আনেন খুব ভাল হয়।’

ভূতনাথ দত্ত না ভাঙলেও ব্যাপারটা যেন আঁচ করতে পারছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে ধনপতিবাবুর হঠাৎ বরফের ছ্যাঁকা লাগার সম্পর্ক রয়েছে কিনা বুঝে উঠতে পারলাম না।  আমার উপর অল্প চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভূতনাথ দত্ত ফের তাকালেন ধনপতিবাবুর দিকে। ‘তা বলি কী, ফের যান আবার। দু’মাস পর এলেন। আপনার জন্যই আজ চারুমতিকে নিয়ে এলাম! কোথায় রাত কাটাবেন, আর কিনা চলে এলেন ফস করে!’

উত্তরে মাথা নাড়লেন ধনপতিবাবু। ‘না দাদা, যা হল, চারুমতি আজ থাক বরং। ইচ্ছে রাজবাড়ির দিকে যাব একবার। যদি অনুমতি করেন, বাকি রাতটা সেখানেই কাটাবার ইচ্ছে।’

‘ওদিকে যাবেন আজ?’ হঠাৎই ভুরু কুঁচকে উঠল ভূতনাথ দত্তর।

‘কেন? কিছু অসুবিধা হবে নাকি!’ ধনপতিবাবু কিছু বিস্মিত হলেন যেন।

‘না তেমন কিছু নয়।’ মুখে বললেও ভূতনাথ দত্তর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, আজ রাজবাড়ি যাবার ব্যাপারটা বাতিল করলেই ভাল হয় যেন। কিন্তু ধনপতিবাবুর মুখের উপর না করতেও পারছেন না। খানিক নীরব থাকার পরেও অন্য পক্ষের সাড়া না পেয়ে শেষে বললেন, ‘মাঝি–মাল্লাদের খবর দেই তাহলে?’

‘সেই ভাল দাদা।’ ধনপতিবাবু মুহূর্তে ঘাড় নাড়লেন। ‘আসলে সারকে নিয়ে এসেছি, আপনার রাজবাড়িটাও দেখাবার ইচ্ছে। লেখক মানুষ উনি। অনেক কিছু জানতে পারবেন। মাঝি–মাল্লাদের খবর পাঠালেই ভাল হয়।’

এতক্ষণে খেয়াল হল, এই ঘন জঙ্গলের ভিতর এত বড় একটা বোট। অথচ এই পর্যন্ত একটা মাঝি–মাল্লা নজরে পড়েনি। কোথায় তারা? কোথায়ই বা রাজবাড়ি? ভেবে কোনো কিনারাই করতে পারলাম না। বসে আকাশ পাতাল ভাবছি, হঠাৎই বাইরে ছপ–ছপ দাঁড়ের শব্দ হতে ভূতনাথ দত্তর দুই চোখ হঠাৎ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘ওই, ওই নৌকো এসে গেছে। দেরি না করে চলে যান বরং।’

ভেবেছিলাম, এই বোটেই হয়তো যাওয়া হবে রাজবাড়িতে। এবার বুঝলাম, ব্যবস্থা হয়েছে আলাদা নৌকোর। তাতে কিছু ঘাবড়েই গেলাম যেন। আজ এখানে আসার পর থেকে একের পর এক যা ঘটে চলেছে, তার অনেক কিছুই কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। শুধু ধনপতিবাবুর ব্যাপারটা ছাড়া। ভদ্রলোক নিয়মিত কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লিতে যান। কিন্তু সেই একই টানে যে এই সুন্দরবনেও আসেন জানা গেল এবার। কিন্তু ওই একটা ব্যাপার ছাড়া অন্য কিছুই বাস্তবের সঙ্গে মেলাতে পারছিলাম না। সব কেমন হেঁয়ালির মতো যেন। আরো মুশকিল, বেশি ভাবতে গেলে মাথার ভিতর কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। মগজটাও কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে যেন। কিছু অবাক হয়েই বললাম, ‘আপনি, আপনি যাবেন না দাদা?’

‘নাহ্।’ ভূতনাথ দত্ত অল্প মাথা নাড়লেন।

মুহূর্তে ধনপতিবাবুও তাঁর কথার খেই ধরে তাগাদা দিলেন, ‘না সার, দাদা আজ আর ওদিকে যাবেন না। দেরি না করে চলুন বরং।’

বড় এক ছিপ জাতীয় নৌকো দাঁড়িয়ে আছে বোটের গায়ে। জনা চারেক দাঁড়ি। বোটের উঁচু ডেক থেকে তাতে নামতে হলে লাফিয়ে নামা ছাড়া উপায় নেই। এই বয়সে তাতে বিপদ হতে পারে ভেবে দাঁড়িদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘হাতটা একটু ধরলে ভাল হয় ভাই। লাফিয়ে নামতে পারব না।’

উত্তরে দাঁড়িদের কেউ এগিয়ে আসার আগেই পাশে ধনপতিবাবু লাফিয়ে নেমে পড়েছেন নৌকোয়। তিনিই হাত ধরে নামিয়ে নিলেন আমাকে। প্রায় মুহূর্তেই ছপ–ছপ শব্দে চারটে দাঁড়ের টানে তিরবেগে ছিপ নৌকো চলতে শুরু করল। ক্রমে খালের আরও ভিতরে ঢুকে পড়তে লাগলাম। ঘন অন্ধকারে ভরা দুই পাশের সেই জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সারা শরীর হঠাৎ কেমন শিরশির করে উঠল। এই রাতে নৌকো কোথায় নিয়ে চলেছে আমাদের!

প্রায় মিনিট তিরিশ পার হয়ে গেছে তারপর, অথচ সেই খাল বা জঙ্গল শেষ হবার লক্ষণ নেই। বরং খালটা ক্রমেই যেন সরু হয়ে আসছে। সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচয় কম দিনের নয়। এখানে প্রতিদিনের জীবন জোয়ার–ভাটা হিসেব করে। সামান্য ভুল হলেই বিপদ। মনে আছে, একবার এমনই এক খালে ঢুকেছিল আমাদের বোট। তখন শেষ বিকেল। জল দ্রুত নেমে চলেছে। তবু অভিজ্ঞ গাইডের ধারণা ছিল জল বেশি কমার আগেই বোট খাল পার হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু হিসেব মেলেনি। খালের মাঝে ইতিমধ্যে যে চড়া পড়েছে জানা ছিল না তাঁর। অগত্যা চড়ায় আটকে নৌকো সেই সরু খালের মধ্যে আটকে গিয়েছিল সেদিন। তাড়াতাড়ি বোট ঘোরাতে গিয়ে আরো বিপদ। বড় বোটের দুই মাথা ছুঁয়ে ফেলল খালের দুই দিকের ঘন হেঁতাল জঙ্গল। বিপদের চূড়ান্ত। ওই অবস্থায় জনা কুড়ি মানুষ নিয়ে বোট পড়ে ছিল ঘণ্টা কয়েক। ছাড়া মিলেছিল রাত আটটা নাগাদ ফের জোয়ারের জল বাড়তে। সেদিন অন্ধকার রাতে কয়েকটা ঘণ্টা কেটেছিল প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে।

সেই ঘটনা মনে পড়তেই আশঙ্কা হল, তেমন কিছুই ঘটতে যাচ্ছে না তো? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ইতিমধ্যে জোয়ার শেষ হয়ে ভাটা শুরু হয়ে গেছে। খালের যা অবস্থা, মনে হচ্ছিল ইতিমধ্যে বড় নদীতে না পড়লে বিপদ হতে পারে। চার দাঁড়ি কারো মুখেই অবশ্য কথা নেই। এ পর্যন্ত একটি কথাও কারো মুখে শুনিনি। ঘাড় নামিয়ে প্রায় যন্ত্রের মতো দাঁড় টেনে চলেছে। পাশে ধনপতিবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনিও হঠাৎ কেমন গুম হয়ে গেছেন। রীতিমতো থমথমে মুখ। তাড়াতাড়ি বললাম, ‘রাজবাড়ি আর কতদূর দাদা? এদিকে খাল তো ক্রমে শুকিয়ে আসছে মনে হচ্ছে। চড়ায় আটকে সারা রাত পড়ে থাকতে হবে না তো?’

উত্তরে সামান্য গলা ঝাড়লেন ধনপতিবাবু। ‘তাই তো দেখছি সার! বুঝতে পারছি না কিছুই। এতটা সময়ও লাগার কথা নয়! আজ সবকিছুই কেমন অন্য রকম…’

কথা শেষ না করেই হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে গলা নামিয়ে বললেন, ‘আপনি তো বুঝতেই পেরেছেন সার, সিগারেট খাওয়ার নামে আসলে তখন পাশের কেবিনে ভৈরবদাদার সেবাদাসী চারুমতির সঙ্গে ছিলাম। ওই সময় আপনাদের কেবিনে কিছু ঘটেছিল? দেখেছিলেন কিছু?’

‘দেখেছিলাম তো। ভূতনাথ দত্ত হঠাৎই একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যেন।’

‘সে কী! তারপর?’ হঠাৎই যেন ধনপতিবাবু রীতিমতো উদ্বিগ্ন।

‘সে তো জানিনা। তবে…’

‘তবে, তবে কী?’ অন্ধকারে উনি উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।

ব্যাপারটা বলা ঠিক হবে কিনা, ভাবতে কিছু সময় লাগল। কৌতূহলে কেবিনের কুলুঙ্গিতে রাখা ভৈরবের উপর সামান্য আঙুল ছোঁয়াতেই প্রায় ছ্যাঁকা লাগার জোগাড় হয়েছিল তখন। কী ভয়ানক গরম! কিন্তু পরে মনে হয়েছিল, মনের ভুল। এমন হয় নাকি! পরে ভুলেও গিয়েছিলাম প্রায়। ধনপতিবাবুর কথায় মনে পড়ল হঠাৎ। সামান্য ইতস্তত করে বললাম, ‘হঠাৎই কেবিনের কুলুঙ্গিতে রাখা সেই ভৈরবের উপর সামান্য হাত দিয়ে…’

‘কী! কী বললেন!’ কথা শেষ করার আগেই প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন উনি। ‘ক্–কিছু হয়নি তো!’

‘ন্–না!’ থতমত খেয়ে বললাম, ‘এমন কিছু নয়। তবে মূর্তিটা ভীষণ গরম ছিল তখন। হাতে প্রায় ছ্যাঁকা লাগার জোগাড়। আশ্চর্য ব্যাপার, ঠিক ওই সময় ভূতনাথবাবুও কেমন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন হঠাৎ।’

‘হায় হায়! একথা তখন যদি বলতেন, তাহলে আর আসতাম না এদিকে। উনি সেই জন্যই মানা করেছিলেন তখন।’ কথা শেষ করে খানিক থম হয়ে রইলেন উনি। তারপর নিজেই বললেন, ‘তবে, তবে উনি নিজে যখন পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন, সব দিক ভেবেই করেছেন। ভাববেন না সার।’ বলতে বলতে বার কয়েক কপালে হাত ছোঁয়ালেন উনি।

বলা বাহুল্য ভদ্রলোকের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে কথাও বলিনি আর। অন্ধকার ফুঁড়ে নৌকো তখন তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে।

সেই রাতে ওই ভাবে নৌকো ছুটেছিল আরো অনেকটা সময়। থম হয়ে ঠায় বসে আছি তখন। হঠাৎই অন্ধকারের ভিতর হালকা কাঁসর–ঘণ্টার আওয়াজ কানে এল। আওয়াজটা কানে আসতেই হঠাৎ যেন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ধনপতিবাবু। ‘আর ভাবনা নেই সার। রাজবাড়ি এসে গেছে। ওই আওয়াজ শুনতে পারছেন না?’

‘ও তো কাঁসরঘণ্টার আওয়াজ!’ কিছু অবাকই হলাম বলা যায়। ‘এই রাত দুপুরে রাজবাড়িতে কাঁসর–ঘণ্টার আওয়াজ!’

‘আরে রাজবাড়ির কাছেই যে মনসা দেবীর মস্ত মন্দির। দিন কয়েক আগে মনসা পুজো গেছে। পক্ষকাল ধরে প্রতিদিনই এখন অষ্টপ্রহর উৎসব। তার উপর আজ একাদশীর রাত! চিন্তা নেই আর।’

ততক্ষণে অন্ধকার ফুঁড়ে নৌকো এসে পড়েছে বড় নদীতে। শুক্লাপক্ষের এই একাদশীর রাতেও দিগন্ত বিস্তৃত নদীর জলে ছড়িয়ে পড়া চাঁদের আলোয় চারপাশ প্রায় ঝকঝকে। ঘাটের বাঁধানো সোপানে নৌকো ভিড়তেই দাঁড়িদের একজন বিকট গলায় চিৎকার করে উঠল, ‘রাজাবাবা অতিথি পাঠিয়েছেন গো–ও–ও–ও…, নতুন অতিথি–ই–ই–ই।’

চার দাঁড়ির মুখে এ পর্যন্ত একটা কথাও শুনিনি। হঠাৎ এমন বিকট গলায় কে চিৎকার করে উঠল ঘাড় ফিরিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি। তার আগেই চার মাল্লা লাফিয়ে নেমে পড়েছে বাঁধানো ঘাটের সোপানে। ওদিকে সেই কাঁসর–ঘণ্টার আওয়াজ ক্রমশ এগিয়ে আসতে শুরু করেছে ঘাটের দিকে। কাঁসর–ঘণ্টার সঙ্গে শঙ্খও বাজতে শুরু করেছে। মাল্লার দল নেমে গেলেও ধনপতিবাবু বসে আছে সেইভাবেই। অগত্যা উঠবার উপায় ছিল না আমারও।

অল্প সময়ের মধ্যেই সেই আওয়াজ ঘাটে এসে পৌঁছল। নয় নয় করেও প্রায় বিশ–তিরিশজন মানুষ। সংখ্যায় মেয়েরাই বেশি। নীবিবন্ধে সোনার কাজ করা রেশমের সূক্ষ্ম বস্ত্র। ঊর্ধ্বাঙ্গেও তাই। সর্বাঙ্গে গহনার ঝলক। এমন মহার্ঘ পোশাক, এমন অলংকার পরিহিতা মহিলা সিনেমা–টিভির পর্দা ছাড়া দেখা যায় না। অল্প আগে বোটে চারুমতিকে দেখলেও এদের পোশাক, অলঙ্কার আরো যেন জমকালো। সামনে কয়েকজনের হাতে বরণডালায় মঙ্গল দীপ, আনুষঙ্গিক নানা দ্রব্য। শঙ্খ–ঘণ্টা তো আগে থেকেই ছিল, এবার মুহুর্মুহু উলুধ্বনি। 


ততক্ষণে ধনপতিবাবুর চোখ উৎসাহে ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। এগোতে গিয়েও ভদ্রতার খাতিরেই বললেন, ‘আপনি আগে চলুন সার।’

অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, ‘আগে যাব?’

‘হ্যাঁ সার। ওরা বরণ করে নিয়ে যেতে এসেছে। আপনি নতুন মানুষ। আপনিই আগে চলুন।’

উঠে দাঁড়িয়েছিলাম আগেই। অগত্যা এগিয়ে গেলাম। ছোট ছিপ নৌকো। বড় নদীর দামাল ঢেউয়ে দুলছিল সমানে। সামাল দিতে চার মাল্লা ঘাটের সোপানে দাঁড়িয়ে দুই হাতে যথাসম্ভব টেনে ধরে রেখেছে নৌকোর মাথা। তবু গোলমাল হয়ে গেল। পা বাড়িয়ে সোপানের উপর নামতে যাব, হঠাৎ ঢেউয়ের তোড়ে কেমন দুলে উঠল নৌকো। সামলাতে না পেরে ঝুঁকে চেপে ধরলাম সামনে এক মাল্লার হাত।

মুহূর্তে সারা শরীর কেঁপে উঠল। লোকটার হাত বরফের মতো ঠাণ্ডাই শুধু নয়, লোহার মতো শক্ত। বহু কালের পুরোনো হিমশীতল মৃত মানুষের হাত! মুহূর্তে হাত টেনে নিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম, ‘আঁ–আঁ–আঁ–আঁ…’

আমার মুখে সেই আর্তনাদের রেশ ধরে চারপাশ থেকে কারা যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, হাঃ–হাঃ–হাঃ, হাঃ–হাঃ–হাঃ, হাঃ–হাঃ–হাঃ—

সেই ভয়ানক হাসির তোড়ে ঘাটের সোপানে চার মাল্লাই শুধু নয়, বরণডালা হাতে মহিলার দল, পিছনে অন্য সবাই কেমন ঢেউয়ের মতো দুলতে শুরু করল। দেখতে দেখতে খান–খান হয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে লাগল। সেই দৃশ্য দেখে মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। কিছুই মনে নেই আর।

সেই জ্ঞান যখন ফিরল, দেখি রাত কেটে ভোর হয়েছে ইতিমধ্যে। ভোরের বাতাসে দু’একটা পাখির ডাক। পাশে ধনপতিবাবু উদ্বিগ্ন মুখে ঠেলছেন আমাকে।

‘সার, সার!’

ভদ্রলোকের সেই ডাকে মুহূর্তে উঠে বসলাম। ‘ক–কোথায়? কোথায় আমি?’

‘ভাববেন না সার। আমরা নেতিধোপানি ওয়াচ টাওয়ারে ঘরে।’

‘অ্যাঁ! কীভাবে এলাম এখানে?’

‘জানি না সার। অল্প আগে জ্ঞান ফিরেছে আমারও। উঠে দেখি ওয়াচ টাওয়ারের এই ঘরে পড়ে আছি দু’জন। আপনি, আপনি সার ওই সময় ভয় পেয়ে চিৎকার করে না উঠলে…’

‘কী বলছেন দাদা!’ ধনপতিবাবুর কথা মাঝেই বলে উঠলাম, ‘লোকটার হাত বরফের মতো ঠাণ্ডাই শুধু নয়, লোহার মতো শক্তও। কোনো জীবিত মানুষের হাত অমন হতে পারে না। কী ভয়ানক!’

উনি অবশ্য আমার কথা তেমন গ্রাহ্য করলেন না। অল্প মাথা নেড়ে বললেন, ‘আপনি কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবেন এখানে। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখে আসতাম, জেটি ঘাটে কাছে অ্যাকমডেশন বোট পাওয়া যায় কিনা। সবে ভোর এখন। ওয়াচ টাওয়ারে মানুষের আনাগোনা শুরু হতে দেরি আছে। অ্যাকমডেশন বোটের দেখা পেলে ওদের ধরে একটা নৌকোর ব্যবস্থা হয় কিনা দেখি।’

রাতের কথা ভেবে মনের ভিতর তখন হরেক প্রশ্ন ঘুরতে শুরু করেছে। ঘাড় ফিরিয়ে অদূরে গাছপালার ফাঁকে পুরনো দিনের ভাঙা ইটের মন্দিরটার দিকে একবার তাকিয়ে সভয়ে বললাম, ‘এখানে একা পড়ে থাকার থেকে আমিও সঙ্গে যাই বরং।’

ওয়াচ টাওয়ার থেকে জেটি ঘাট জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অনেকটা পথ হলেও পুরো পথটা তখনও তারের নেট দিয়ে ঘেরা। গত রাতে ওই ব্যাপারের পর এই জঙ্গলের ভিতর পড়ে থাকার থেকে সেটা অনেক ভাল।

অগত্যা ওয়াচ টাওয়ারের ঘর থেকে সিঁড়ি ভেঙে পায়ে পায়ে নামতে শুরু করলাম।

 

এরপর অ্যাকমডেশন বোটের গার্ড ধরে কীভাবে নৌকো জোগাড় করে প্রথমে পাখিরালা, তারপর ভ্যানরিক্সা ধরে গোসাবা, সোনাখালি হয়ে কলকাতা পৌঁছে হাঁফ ছেড়েছিলাম, এই কাহিনির জন্য সেসব তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমন সদুত্তর পাইনি তারও।

অনেক ভেবেও তেমন জোরাল ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারিনি। কখনো মনে হয়েছে, সবটাই বুঝি নেতিধোপানি ওয়াচ টাওয়ারে শুয়ে ঘুমের ঘোরে দেখা অলীক স্বপ্ন! কিন্তু তাই যদি হবে, নেতিধোপানির ওয়াচ টাওয়ারে গেলাম কখন? সেই বিকেলে আমরা তো নেতিধোপানিতে অ্যাকমডেশন বোট না পেয়ে চলে গিয়েছিলাম পাশের খাল ধরে ভিতরে! সেখানেই দেখা ভূতনাথ দত্তর ময়ূরপঙ্খী বোটের। সন্দেহ মেটাতে পরে যোগাযোগ করেছিলাম সোনাখালির সেই বরফের নৌকোর দুই মাঝির সঙ্গেও। তারাও একই কথা বলেছিল।

বাকি থাকে শুধু ভৈরব মন্ত্রর ব্যাপারটা। একেবারে তাই উড়িয়ে দেওয়া যায়নি। সেই সন্ধেয় ভূতনাথ দত্তর বোটে ওঠার পর মাথাটা ঠিকমতো কাজ করছিল না। তাই নজর এড়িয়ে গিয়েছিল অনেক কিছুই। পরে ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছে, কুলুঙ্গিতে সযত্নে রাখা ভৈরবের সেই মূর্তির মুখের সঙ্গে অদ্ভুত মিল ছিল ভূতনাথ দত্তর। দুই চোখের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মস্ত গাল। বিস্তৃত পুরু ওষ্ঠ। সব হুবহু এক! মিল ছিল নামেও। ভৈরব যেমন মহাদেবের অন্য নাম, ভূতনাথও তাই! সেই প্রলয় রাতের ঝড়ের যে বর্ণনা উনি দিয়েছিলেন, তা প্রত্যক্ষদর্শীর পক্ষেই সম্ভব। তাহলে মানুষটি কি ভুতনাথ দত্ত স্বয়ং? ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর প্রাসাদ ধ্বংস হবার সময় ভৈরবমূর্তির সঙ্গে তিনিও চাপা পড়েছিলেন? ভাঙা ইটের ধ্বংসস্তূপের ভিতর সেই মউলের দেখা কঙ্কালটি তাঁরই? ভৈরবমূর্তি ফের উদ্ধার হতে তিনিও ফিরে এসেছেন আবার! কিছু বিশেষ দিনে ভৈরব মন্ত্রের প্রভাবে বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া নিজের রাজপাট নিয়ে ফিরে আসেন। সেই রাজপ্রাসাদ, দাসদাসী, প্রমোদ ভ্রমণের জন্য ময়ূরপঙ্খী বজরা, হাজির হয়ে যায় সবকিছু! ধনপতি লশকর জানেন সেটা। তাই নির্দিষ্ট দিন এলেই ছুটে যান। সেদিন কৌতূহলবশত কুলুঙ্গির মূর্তি ছুঁয়ে ফেলে আমিই সব গোলমাল করে দিয়েছি হয়তো!

পাশের কেবিনে চারুমতির সঙ্গে রতিক্রিয়ারত ধনপতি লশকরের গায়ে বরফের ছ্যাঁকা সেই সময়েই। মুহূর্তে হিমশীতল হয়ে গিয়েছিল চারুমতির সারা শরীর। তখনকার মতো সামলে নেওয়া গেলেও ভূতনাথ দত্ত আশঙ্কা করেছিলেন, ফের হয়তো সমস্যা হতে পারে। তাই রাজবাড়ির দিকে যেতে মানা করেছিলেন। তাঁর সেই আশঙ্কা ভুল ছিল না। রাজবাড়ির ঘাটে নৌকোর মাল্লার হাত ধরতে গিয়ে হিমশীতল বরফের ছ্যাঁকা লেগেছিল আমারও। তারপর দারুণ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল ভৈরব মন্ত্রের প্রভাবে সৃষ্ট ভুতনাথ দত্তর মায়ারাজ্য, রাজপাট।

অনেকবার তাই মনে হয়েছে, সেই রাতে ঘটনার ব্যাখ্যা একমাত্র ধনপতিবাবুই দিতে পারবেন। অনেকবার ভেবেওছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, শেষ পর্যন্ত ভরসা করে উঠতে পারিনি। এতদিনের পরিচয়! তবু সেই এক রাতেই মানুষটি হঠাৎ কেমন রহস্যময় হয়ে গেছেন। যে মানুষ সব জেনেও এমন আচরণ করতে পারেন, তার সঙ্গে মেলামেশা খুব সহজ নয়। তাই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। উনিও যোগাযোগ করেননি। পরে শুনেছি, বারুইপুরে আগের বাসাও ছেড়ে দিয়েছেন। ছেড়ে দিয়েছেন কোর্টের কাজও। সাতজেলিয়ার বাড়িতেও নাকি যাননি অনেক দিন।

আপলোড: ৩/২/২০২১

8 comments:

  1. অসামান্য লাগল, তবে বার বার ভূতনাথ দত্ত কে ভৈরব দত্ত বলা হল কেন বুঝলাম না, একবার ভৈরব দত্ত , একবার ভূতনাথ দত্ত! ধনপতি বাবু একবার ধপতি হয়ে গেছে।এগুলি ঠিক করে নিলে আরো ভাল লাগবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

      Delete
  2. শিশির-বাবু, সুন্দরবন বিষয়ক আপনার লেখা গল্পগুলি সত্যিই রোমাঞ্চকর

    ReplyDelete
  3. অভূতপূর্ব লিখেছেন।

    ReplyDelete
  4. উফফ অসাধারণ

    ReplyDelete