শিশির
বিশ্বাস
(১)
নন্দ
গো! নন্দদুলালের গল্প। শুনে তোমরা হয়তো বলবে‚ গপ্প। এসব
সত্যি হয় নাকি? কিন্তু
আমি নিরুপায়। আসলে নন্দ আমার খুব চেনা মানুষ কিনা। কতদিন দেখেছি ওকে। শ্যামলা রোগা–পটকা শরীর।
বছর ষোল বয়স। বড় ভাসা ভাসা দুটো চোখ। যেমন সহজ সাদাসিধে‚ তেমন
ফুর্তি। মুখে হাসি লেগেই আছে। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখ‚ সকাল থেকে
চাট্টি মুড়ি ছাড়া পেটে কিছুই পড়েনি।
এদিকে
শুক্রবারে হরিদেবপুর হাট। দুপুরের আগেই জমে ওঠে। কাঁধে সস্তা বিস্কুট বোঝাই একটা
টিনের বাক্স ঝুলিয়ে সেই তখন থেকে নন্দ বিরামহীন হেঁকে চলেছে‚
কলকাতার মাল‚ টাকায় ন’খান।
আজ না খেলে মিলবে না কাল।
ঘি চপচপ‚ ঘি চপচপ।
ছড়াটা
নন্দ নিজেই বেঁধেছে। সেবার তাই নিয়ে এক কাণ্ড! নন্দ গলা ছেড়ে দুপুর থেকে সুর করে
হাটের মাঝে হেঁকে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ এক বুড়োর মুখোমুখি। বুড়ো বেজায় খুঁতখুঁতে।
কুতকুতে চোখ বিস্কুটের উপর খানিক বুলিয়ে নিয়ে বলেছিল‚ ‘বিস্কুটগুলো
কলকাতার তো রে ছোঁড়া?
ঠিক বলছিস?’
উত্তরে
একগাল হেসে নন্দ বলল‚ ‘কী যে বলেন দাদু! কলকাতার মাল এই
হরিদেবপুরের হাটে কখনও টাকায় নয়টা মেলে? এই গেরামেই তৈরি। তবে ছড়াটা আমি নিজে
বেঁধেছি। ভাল হয়নি?’
বলা
বাহুল্য‚ নন্দর সেই ব্যবসা চলেনি বেশিদিন। কয়টা
মাস খুব কষ্টেই কেটেছিল তারপর। পেট তো আর একটা নয়। দেশের বাড়িতে রয়েছে বুড়ি
দিদিমা। এছাড়া ছোট দুটো ভাইবোন। কাঠা কয়েক পৈতৃক জমি আছে। শাক–সবজি করে
কোনোমতে দিন চলে। নন্দর রোজগার বন্ধ হলে তাদেরও অনেকদিন উপোষ দিতে হয়। হাতে পুঁজির
সামান্য কয়টা টাকা শেষ হয়ে যেতে তাই বড়ো বিপদেই পড়েছিল। কয়টা মাস হেন কাজ নেই‚ যা করেনি।
মুটেগিরি থেকে মাটি কাটা। তার মধ্যেই আর এক ব্যাপার।
সেবার
হাটখোলার ঘাটের অদূরে বাজারের পাশে আস্তানা নিয়েছিল এক বৃদ্ধ সাধু। সঙ্গে দু’জন সাগরেদ।
হিমালয় পাহাড়ের কোন গুহায় নাকি বাস। ভূত ভবিষ্যৎ নখদর্পণে। আপন খেয়ালে পায়ে হেঁটে
চলেছেন গঙ্গাসাগর তীর্থে। এসব অবশ্য সাধুবাবার কথা নয়। সারা দিনে একটি কথাও তিনি
কইতেন না। সবটাই তাঁর দুই শিষ্যর কথা। যাই হোক‚ ব্যাপারটা
রটে যেতে ভিড় জমতে দেরি হয়নি। সাধুর ঠেকে ভিড় লেগেই থাকত। হাটের দিন তো কথাই নেই।
নন্দ সেদিন কাজের খোঁজে গিয়েছিল হাটখোলার দিকে। আগেও
এসেছে। সাধুবাবার কথা জানত। হঠাৎ খেয়াল হতে দেখে সাধুবাবার সেই ঠেক আজ প্রায়
জনমানব শূন্য। গোড়ায় ভেবেছিল‚ বোধ হয় চলে গেছেন তিনি। কিন্তু
তারপরেই ভয়ানক ব্যাপারটা কানে এল। আগের দিন সন্ধে থেকেই সাধুবাবার হঠাৎ দাস্ত বমি।
রাতে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়তে দুই সাগরেদ টাকা–পয়সা যা ছিল‚ নিয়ে
ভেগেছে। তখন থেকে সেই ভাবেই পড়ে আছেন তিনি। ভয়ানক ভেদ কলেরা। কেউ ধারেকাছেও
মাড়ায়নি। খানিক আগে পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে‚ যদি তারা
এসে কিছু ব্যবস্থা করতে পারে।
সেই
খবর শুনে নন্দ আর স্থির থাকতে পারেনি। একাই ছুটে গিয়েছিল। চারপাশে ভয়ানক নোংরা।
মাছি ভনভন করছে। তার মাঝে নেতিয়ে পড়ে রয়েছে মানুষটা। তিনটে দিন টানা শুশ্রূষায়
নন্দ সেই সাধুবাবাকে ফের সুস্থ করে তুলেছিল। নন্দকে দেখে হাটের অনেকেই অবশ্য এগিয়ে
এসেছিল এরপর। কিছু অর্থ সাহায্যও করেছিল।
সামান্য
সুস্থ হতে সাধুবাবা অবশ্য নন্দকে আর আটকে রাখতে রাজি হয়নি। বললেন‚ ‘তোকে আর
কষ্ট দেব না বাপু। মতিভ্রম হয়েছিল। তাই গহন হিমালয়ে নিজের সাধন–ভজনের থান
ছেড়ে এদিকে এসেছিলাম। নামডাক কেনার সাধ হয়েছিল। শিষ্যও জুটিয়েছিলাম। ভগবান সইবেন
কেন। উচিত শিক্ষায় দিয়েছেন। আজই ফিরে যাব হিমালয়ের পথে।’
‘কিন্তু
বাবাঠাকুর‚ এখনো যে সম্পূর্ণ সুস্থ নয় আপনি।’ নন্দ আপত্তি
জানিয়েছিল।
‘ও নিয়ে
ভাবিসনি বাবা। যিনি বাঁচিয়েছেন‚ দেখার হলে তিনিই দেখবেন। কিন্তু তোকে
কী দেই বলতো!’
নন্দ
হাঁ–হাঁ
করে উঠছিল। কিন্তু সাধুবাবা কানে নেননি। ‘পথে দুই
শিষ্য জুটিয়েছিলাম। তাদের সেবা নিয়েছি। তার মূল্য তারা বুঝে নিয়ে গেছে। তুই বাকি
থাকবি কেন! আপত্তি করিসনি।’
কিন্তু
কী দেবেন সাধুবাবা! খানিক এদিক ওদিক তাকাতে নজরে পড়ল আধছেঁড়া ঝুলিটা। ভিতরে যা ছিল‚ যাওয়ার সময়
দুই শিষ্য খুঁটে নিয়ে গেছে। খালি ঝুলিটাই পড়ে আছে শুধু। সাধুবাবা
সেই ঝুলিটা তুলে বার কয়েক ঝাড়লেন। তাতে ছোট সাদামতো কিছু একটা বের হয়ে কোথায় ছিটকে
পড়ল। সাধুবাবা বললেন‚ ‘দেখ তো বাপু‚ পড়ল কোথায়?’
কিন্তু
অনেক খুঁজেও নন্দ তার হদিস করতে পারল না। বেজায় বিরক্ত হয়ে সাধুবাবা হাতের সেই
ছেঁড়া কাঁথার ঝুলি ছুঁড়ে দিলেন নদীর জলে। ‘নাহ্‚
তোর বোধ হয় কিছু আর জুটল না দেখছি।’ কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হনহন করে চলে
গেলেন তিনি।
কী
কাণ্ড! নন্দ অবাক হয়ে দেখল। ছুঁড়ে দেওয়া ছেঁড়া কাঁথার সেই ঝুলি হঠাৎ মেলায় দেখা
গ্যাস বেলুনের মতো ফুলে উঠল শোঁ–শোঁ শব্দে। তারপর সাঁ করে উড়ে গিয়ে পড়ল একেবারে মাঝ নদীতে।
ভুস করে ডুবে গেল। আর ঠিক সেই সময় পায়ের নীচে কিছু পড়তে নন্দ তাকিয়ে দেখে শুকনো এক
পাতার নীচে ছিটকে পড়া সেই জিনিসটা। তৎক্ষণাৎ কুড়িয়ে নিয়ে ডাকল সাধুবাবাকে। ‘বাবাঠাকুর‚ বাবাঠাকুর।’
কিন্তু কোথায় সাধুবাবা? ততক্ষণে তিনি পথের বাঁকে
হারিয়ে গেছেন। ছুটে গিয়েও নন্দ তার হদিশ করতে পারল
না।
(২)
বাদার
অঞ্চল নদীনালার দেশ। হরেক গঞ্জের ঘাট। কিন্তু মহামায়াগঞ্জের মতো কোনোটা নয়। মস্ত
বাজার। কাছেই রেল স্টেশন। সারা দিনে গোটা কয়েক লঞ্চ এসে জেটিঘাটে ভেড়ে। এছাড়া যাত্রী
নিয়ে গয়নার নৌকো তো দিনভর। সব মিলিয়ে জমজমাট। এই
মহামায়াগঞ্জে গোবিন্দ সামন্তর হোটেলের বেজায় নামডাক। স্টেশনে ট্রেন বা জেটিঘাটে
লঞ্চ এসে ভিড়লেই খদ্দেরের ভিড়। দশজন কর্মচারী হিমসিম খেয়ে যায়। মাঝ
বয়সী গোবিন্দ সামন্তর বিশাল বপু। কুচকুচে
গায়ের রং। সেই সাথে চওড়া নাকের নীচে বেড়ালের মতো ঝাঁটা গোঁফ। কাচের গুলির মতো
একজোড়া ধূর্ত চোখ।
ছোট
এক টুলে গোবিন্দ সামন্ত দিনভর ক্যাশবাক্স আগলে বসে থাকেন। ফাঁকি
দেবার জো নেই। দিন কয়েক আগে এক খদ্দের মাংস–ভাতের সঙ্গে মাছও নিয়েছিল এক প্লেট।
কাজের চাপে কর্মচারী ছোকরা খেয়াল রাখতে পারেনি। খদ্দেরটি সেই সুযোগে পয়সা মেটাবার
সময় শুধু মাংস–ভাতের
দাম দিতে যাবে‚ তেড়ে উঠে গোবিন্দ
সামন্ত তার কলার চেপে ধরেছিলেন। তারপর খদ্দেরটিকে চূড়ান্ত হেনস্তাই শুধু নয়‚ কর্মচারী
ছোকরাটিও সেই দণ্ডে ছাঁটাই হয়ে গিয়েছিল।
বছর
কুড়ি আগে গোবিন্দ সামন্ত কন্টাই থেকে প্রায় এক বস্ত্রে মহামায়াগঞ্জ এসে তেলেভাজার
দোকান দিয়েছিলেন। শাঁসে জলে বেড়ে তা এখন ‘মা তারা ব্রহ্মময়ী হোটেল’। দু’বেলা কয়েকশো
পাত পড়ে। শুধু হোটেলই নয়‚ সাদা কালো মিলিয়ে আরও গোটা কয়েক
ব্যবসা। পুলিশ‚ পার্টি-বাবু
সবাই হাতের মুঠোয়। লোকে বলে‚ গোবিন্দ
সামন্তর নাকি সম্পত্তির শেষ নেই। কন্টাই আর মেদিনীপুরে স্বনামে বেনামে গোটা কয়েক
বাড়ি। হাজার বিঘে জমি। অথচ ট্যাঁক থেকে দশটা পয়সা দান–খয়রাতী করতে
কেউ তাকে দেখেনি। গোবিন্দ সামন্ত নিজেই বলেন‚ গত তিরিশ
বছরে কাউকে তিনি ভিক্ষে দেননি।
তা আমাদের
নন্দ এসে পড়ল সেই গোবিন্দ সামন্তের হাতে। দুই মানিকজোড় বদন ব্যাপারী আর মদন
কুণ্ডুই জুটিয়ে আনল তাকে। মহামায়াগঞ্জে দুই মানিকজোড়কে চেনে
না‚ হেন মানুষ নেই। রোগা লিকলিকে
শরীর। মনে হয় ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। দুটিতে দিনভর পথেঘাটে টোটো করে বেড়ায়। দালালি
থেকে শুরু করে আইনি বেআইনি কোনো কাজেই আপত্তি নেই। শোনা যায়‚ দু’জন
গঞ্জের মহাজন মানুষের যত দু’নম্বরি কাজের মুশকিল আসান। বদনই মূল গায়েন। বুদ্ধিতেও পাকা। তুলনায়
মদন কিছু খাটো। অগত্যা বদনের শাগরেদ। তা
কাজের খোঁজে নন্দ সেদিন এসে পড়েছে মহামায়াগঞ্জে। পড়ে গেলে দুই মানিকজোড়ের নজরে।
প্রতিদিন গঞ্জের বড় পুকুরে স্নান সারেন গোবিন্দ
সামন্ত। স্নানের আগে ঘাটে বসে আয়েস করে তেল মাখেন। তা
সেদিনও তিনি তেল মাখার পর ঘাটের পৈঠেয় তেলের বাটি রেখে জলে নেমে সবে ডুব দিয়েছেন‚ হঠাৎ একটা
কাক কোত্থেকে উড়ে এসে খাবারের লোভে বসল বাটির কাছে। ব্যাপারটা চোখে পড়তেই বিশাল
বপু নিয়ে হুড়মুড় করে ধেয়ে এলেন তিনি। তাই দেখে বেজায় ঘাবড়ে বাটিটা ঠোঁটে নিয়ে
কাকটা উড়ে বসল ঘাটের পাশে মস্ত শিমূল গাছের মগডালে। দেখে
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গোবিন্দ সামন্ত থমথমে মুখে খানিক তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। তারপর দু’হাত নেড়ে
কাকের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতে শুরু করলেন।
ওদিকে
কাক বেচারার ততক্ষণে এক ডালের খাঁজে বাটি নামিয়ে ভোজ সারতে গিয়ে মালুম পেয়েছে বাটিতে
খাওয়ার কিছু নেই। অথচ নীচে তার মালিক যেভাবে তর্জন–গর্জন শুরু করেছে‚ তাতে
জায়গাটা মোটেই নিরাপদ নয়। সুতরাং বাটিটা সেখানে ফেলে রেখেই জেটি-ঘাটের দিকে হাওয়া।
তেলের
বাটির আশু বিপদের সম্ভাবনা কাটতে গোড়ায় খানিক আশ্বস্তই হয়েছিলেন গোবিন্দ সামন্ত।
কিন্তু একটু পরেই বুঝলেন‚ বাটিটা ফের হস্তগত হবার সম্ভাবনা
খুবই কম। সেটা ডালের এমন জায়গায় রয়েছে যে‚ লম্বা লগি
দিয়ে খোঁচা দিলেই টুপ করে পুকুরে পড়বে। একেবারে গভীর জলে। আর কাঁটাওয়ালা ওই
শিমুলগাছে উঠে যে বাটিটা উদ্ধার করবেন‚ সেই
সম্ভাবনাও সুদূর পরাহত। ইতিমধ্যে চিৎকার শুনে মজা দেখার জন্য জনা কয়েক জড়ো হয়েছিল।
গোবিন্দ সামন্ত এবার তাদের তোয়াজ শুরু করলেন। ‘তেলের বাটিটা পেড়ে দে বাবা।
ঠাকুদ্দার আমলের জিনিস। গরীব মানুষ।’
কিন্তু
গোবিন্দ সামন্তকে এই অঞ্চলের মানুষ বিলক্ষণ চেনে। তাই চিঁড়ে ভিজল না। একে একে সরে
পড়ল সবাই। আরো কিছুক্ষণ হয়তো অপেক্ষা করতেন। কিন্তু ওই সময় দূরে ট্রেনের হইসল কানে
আসতেই বুঝলেন‚ আটটার ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে। হোটেলের
এক ঝাঁক খদ্দের ওই ট্রেনে। ক্যাশবাক্সের কাছে না থাকলে সর্বনাশ। অগত্যা কাকের
মুণ্ডপাত করতে করতে বাটির আশা সাময়িক মুলতুবি রেখে হোটেলের দিকে ছুটেছেন‚
দুই মানিকজোড় পড়ে গেল সামনে। দুটিতে সাত
সকালেই তৈরি হয়ে ধান্দায় বেরিয়েছে। দেখা হতেই ঘাড় ঝুঁকিয়ে বিনয়ের অবতার‚ ‘জয়
মা তারা ব্রহ্মময়ী। সাত সকালে সামনে মহাজন মানুষ! কী
ভাগ্যি গো আজ!’
চিঁড়ে
অবশ্য ভিজল না। মেজাজ তিরিক্ষি হয়েই ছিল। খেঁকিয়ে উঠলেন গোবিন্দ সামন্ত। ‘তোদের তো
ভাগ্যি! এদিকে আমার যে দিনের শুরুতেই সর্বনাশ!’ কপাল চাপড়ে ব্যাপারটা সবিস্তারে
ব্যক্ত করলেন তিনি।
দুই
মানিকজোড় যেন তৈরি হয়েই ছিল। গোবিন্দ সামন্ত থামতেই বলে উঠল‚ ‘কিচ্ছুটি
ভাববেন না মহাজনকাকা। আজই পেয়ে যাবেন।’
‘তাই
দে বাবা!’ কিছুটা যেন আস্বস্ত হলেন তিনি। তারপরেই
খেঁকিয়ে উঠলেন ফের। ‘তা তোদের যে আর এক কাজ দিয়েছিলুম তার
কী হল র্যাঁ? ইদানীং দেকছি কথাই সার তোদের।’
অন্য
কাজ মানে হোটেলের জন্য নতুন একজন কাজের মানুষ। হঠাৎ
সেই কর্মচারীকে বিদেয় করে দেবার পর নতুন একজন কমর্চারী জোগাড় করে দেবার দায়িত্ব
দুই মানিকজোড়কেই দিয়েছিলেন। কিন্তু চেষ্টা করেও তেমন কাউকে এখনো জোগাড় করতে পারেনি। আসলে
গোবিন্দ সামন্তকে এদিকের সবাই বিলক্ষণ চেনে। লোক পাওয়া খুব সহজ নয়। বদন হাত কচলে
বলল‚ ‘লেগে আছি গো কাকা। সেই খোঁজেই
তো আজ সাতসকালে বের হয়েছি। একটা ভাল ছেলের খোঁজ পেয়েছি। আর
দুটো দিন সবুর করেন।’
‘তাই
দ্যাখ বাপু। আর তেলের বাটির কথাও মনে রাখিস।’ গোবিন্দ সমন্ত আর দেরি করলেন না। ফের
হুইসল দিয়ে ট্রেন তখন স্টেশনে ঢুকছে। ছুটলেন হোটেলের দিকে।
জলে
বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ তবু চলে কিন্তু মহামায়াগঞ্জে করে খেতে হল গোবিন্দ
সামন্তর সুনজরে থাকাটা বেজায় দরকার। দুই মানিকজোড় বদন আর মদন ছুটল পুকুর ঘাটের
দিকে।
গাছের
মগডালের খাঁজে তেলের বাটি তখনও যথাস্থানে। হালকা পাতলা চেহারার ছেলেছোকরা ছাড়া
পাড়া মুশকিল। বদন তেমন কাউকে খুঁজে আনার জন্য
মদনকে পাঠিয়ে দিয়ে পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল। মদন একটু
পরেই ফিরে এল অচেনা একটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। অল্প চোখ টিপে বলল‚ ‘বদনদা‚
ছোঁড়ার নাম নন্দ। এদিকে কাজের খোঁজে এয়েছে। খুব নাকি দরকার। দ্যাখো দেখি একটা
ব্যবস্থা করা যায় কিনা।’
বদন
অবশ্য ততক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে। ‘কীরে‚ কাজ খুঁজছিস বুঝি?’
‘আজ্ঞে
হ্যাঁ গো দাদা। একটা যেমন তেমন কাজ পেলেও বর্তে যাই। এই দাদা বলছিল‚
এদিকে কোন হোটেলে নাকি কাজ আছে।’
হতভাগা
মদন তাহলে আগেই সব খোলসা করে ফেলেছে! বিরক্ত হয়ে বদন বলল‚ ‘হোটেলে
কাজ করবি‚ কিছু জানিস?’
‘আজ্ঞে
তা জানি না দাদা। তবে শিখে নিতে পারব।’ নন্দ হাত কচলে জানাল।
‘অমন
অনেকেই বলে। তারপর কাজের সময় ভোঁভোঁ। বেকার বদনাম হয়ে যায় এই বদন ব্যাপারীর। তবু
বলছিস যখন দেখব। কিন্তু তার আগে দেখি কতটা কাজের মানুষ তুই। গাছের উপর থেকে ওই
তেলের বাটিটা পেড়ে আন দেখি।’
বদনের
কথায় নন্দ ঘাটের পাশে শিমূল গাছের দিকে তাকাল। বেজায় উঁচু গাছ। সারা গায়ে বড় বড়
কাঁটা। ওঠা মোটেই সহজ নয়। বদন তাই কায়দা করে কথাটা পেড়েছিল। মদন আগে থেকে উগরে না
দিলে কিছু সুবিধে হত আরও। কিন্তু বদনের ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে নন্দ বলল‚ ‘ও
হয়ে যাবে দাদা।’
‘হয়ে
যাবে!’ বদন তাড়াতাড়ি বলল‚ ‘তাহলে পেড়ে আন দেখি।’
‘ও
পেড়ে আনতে হবে না গো। যেখানে রয়েছে, বাতাসে এমনিই পড়ে যাবে।’
কী
কাণ্ড! ঘটলও তাই। মিনিট দুইও কাটেনি। হঠাৎ জোরাল
এক দমকা বাতাসে তেলের বাটিটা ঠকাস করে নীচে ছিটকে পড়ল। সামান্যই তেল ছিল। সেটাও
ছলকে পড়ল না।
(৩)
মা
তারা ব্রহ্মময়ী হোটেলে কাজটা হয়ে গেল নন্দর। মাইনে মাস গেলে আশি টাকা। আরো কিছু
বেশিই হবার কথা। কিন্ত কমিশন বাবদ বদনদের চাহিদা মিটিয়ে মাইনে ওই আশি টাকাতেই ঠেকল।
বেচারা নন্দও তাই মেনে নিয়ে সেই দিনই লেগে পড়েছিল কাজে। ভোর পাঁচটায় কলকাতার প্রথম
ট্রেন আসে। তার আগেই উনুনে আঁচ। চায়ের জল চাপিয়ে দিতে হয়। বিশ্রাম বলতে দুপুরে
ঘণ্টা দেড়েক। তারপর রাত এগারোটার শেষ ট্রেন পর্যন্ত। এরমধ্যে দম ফেলার ফুরসুত মেলা
মুশকিল। তবে নন্দর ছেলেবেলা থেকেই এসব অভ্যাস। তবু তো দু’বেলা পেট
ভরে খাবারটা মেলে। হোক না আলাদা মোটা চালের ভাত। আর কড়াইচাঁছা একটা ঘ্যাঁট। তাই
মানিয়ে নিয়েছিল। সমস্যা বলতে ইতিমধ্যে ছ’মাস হয়ে গেছে‚ মালিক এখনো
মাইনের একটি পয়সাও ছোঁয়ায়নি। তাগাদা দিলেই বলে‚ ‘হাতে পয়সা
নিয়ে কী করবি বাপু। হারিয়ে ফেলবি। বরং যখন দেশের বাড়িতে যাবি‚ একবারে সব
মাইনে নিয়ে নিস।’
কথাটা
মন্দ নয়। তবে ব্যাপার হল‚ দেশের
বাড়ির কথা তুললেই মালিকের এক কথা‚ বড্ড কাজের চাপ রে এখন। আর কটা দিন
পরে যাস বরং। নন্দ এর মধ্যে আর তাগাদা দেয়নি। কিন্তু বাড়ি এবার না গেলেই নয়। বুড়ি
দিদিমা খবর পাঠিয়েছে‚ ছোট ভাইবোন দুটো নতুন ক্লাসে উঠেছে‚ সংসারের
জন্যও কিছু টাকার দরকার। এবার তাই ও ঠিক করেই ফেলেছে। ভাইবোনদের জন্য দুটো জামা–প্যান্টও
নিয়ে যাবে। বুড়ি দিদিমার জন্য নতুন থান।
এর
মধ্যেই ঘটে গেল এক ব্যাপার। দুই মানিকজোড় বদন আর মদন প্রায়ই আসে হোটেলে। গোবিন্দ
সামন্তর সঙ্গে গুজগুজ করে খানিক সলাপরামর্শ চলে। তেমন হলে এক আধদিন দু’জনের জন্য
বিনে পয়সায় দুপুরের মিলও বরাদ্দ হয়।
এমনিতে
খাওয়ার টেবিলে খদ্দের সামলানো নন্দর কাজ নয়। কিন্তু সেদিন একজন ছুটি নেওয়ায় নন্দর
উপর সেই দায়িত্ব পড়েছিল। খানিক গুজগুজ করার পর দু’জন চার নম্বর টেবিলে এসে বসতেই
গোবিন্দ সামন্ত হাঁকলেন‚ ‘চার নম্বর টেবিলে দুটো মিল। সঙ্গে
দুটো হাফ প্লেট ইলিশের পেটি।’
হাফ
প্লেট মানে এক পিস মাছ। নন্দ তাই নিয়ে এসে টেবিলে নামিয়ে দিয়েছে‚ বদন
আড়চোখে তাকিয়ে প্রায় আকাশ থেকে পড়ল‚ ‘সে কীরে।
মাছ এক পিস যে!’
‘কেন‚ মালিক তো
হাফ প্লেটই বললেন!’
‘হতভাগা
ছেলে।’ চাপা
গলায় ধমকে উঠল বদন। সঙ্গে মদনের পোঁ‚ ‘মালিক অমন
বলে। বরাবর দু’পিস
মাছ বাঁধা আমাদের জন্য। ঠাকুরকে গিয়ে আমাদের কথা বলগে যা। আর
মাছটা ডালের বাটিতে করে আনিস। কেউ টের পাবে না। পথে পথে ঘুরছিলি‚ মালিককে
বলে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছি‚ বেইমানি করিসনি।’
ওরা
বলল বটে। কিন্তু নন্দর বিশেষ ভাবান্তর হল না। সাফ জানিয়ে দিল‚ অমন কাজ সে
মরে গেলেও পারবে না। দুই মানিকজোড় এরপর বিশেষ কিছু আর বলেনি। কটমট করে একবার
তাকিয়েছিল শুধু।
আসল
ঘটনা ঘটল এর কদিন পরে। সেদিন গোবিন্দ সামন্ত কী কাছে বাইরে বের হয়েছিল। ফিরে
এসেই নন্দকে ডেকে পাঠালেন। নন্দ কাছে আসতে তীক্ষ্ণ নজরে খানিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে
বললেন‚ ‘দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে
জানিসনি। কিন্তু বদ বুদ্ধি দেখছি মেলা!’
‘ক–কেন মালিক!’ প্রায় আকাশ
থেকে পড়ল নন্দ।
‘কাল দুপুরে জেটিঘাটের
দিকে গিয়েছিলি?’
দুপুরে
যখন কাজ থাকে না। গঞ্জের জেটিঘাটে একটু বেড়িয়ে আসে নন্দ। ওই সময় ওদের গ্রামের দিক
থেকে একটা লঞ্চ আসে। চেনা কেউ থাকলে তাদের কাছে বাড়ির খবর পাওয়া যায়। গত কালও
গিয়েছিল। সেই কথাই বলল।
‘হোটেল থেকে
চুরি করে এক বুড়োকে মাছ–ভাত খাইয়েছিস?’
ব্যস‚ নন্দর মুখে
আর কথা নেই। থম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গোবিন্দ
সামন্ত অবশ্য থামলেন না। চারদিক গুছিয়েই তিনি নন্দকে ধরেছেন। একটু পরেই দু’জন ষণ্ডা
মতো লোক এক বৃদ্ধ মানুষকে হিড়হিড় করে টেনে এনে গোবিন্দ সামন্তর সামনে দাঁড় করাল। বেজায়
ঘাবড়ে গিয়ে বৃদ্ধ তখন রীতিমতো কাঁপছে।
‘কাল আমার
হোটেলের এই ছোকরা তোমাকে ভাত–মাছ খাইয়েছিল? সত্যি কথা বলবে। নইলে হাড়মাস আলাদা
করে ফেলব। আমি গোবিন্দ সামন্ত। এই গঞ্জে আমার কথায় বাঘে–গরুতে এক ঘাটে জল খায়।’ প্রায়
হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন তিনি।
‘আজ্ঞে হ্যাঁ
কত্তা। মিথ্যে কথা বলবুনি।’
ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বৃদ্ধ বলল‚ ‘দু’দিন কিছু
খাওয়া হয়নি। ওনার কাছে খাবার চাইলুম। সব শুনে উনি ছুটে চলে গেলেন। একটু পরেই
কলাপাতায় করে ভাত এনে দিলেন।’
‘শুধু ভাত?’ ফের হুঙ্কার।
‘আজ্ঞে না
কত্তা। সঙ্গে সোনামুগের ডাল। আলুপোস্ত। ইলিশের মুড়ো দিয়ে কচুর শাক। আর দুটো চিতল
মাছের পেটি দিয়ে ঝোল।’
বৃদ্ধের
খাওয়ার ফিরিস্তি শুনে গোবিন্দ সামন্তর মুখ তখন থমথম করছে। সব কয়টা আইটেমই গত কাল
তাঁর হোটেলের মেনুতে ছিল। বৃদ্ধকে বিদায় করে দিয়ে আর বেশি কথা খরচ করলেন না।
নন্দকে সেই দণ্ডেই কাজ থেকে বিদেয় করে দিলেন।
নন্দ
অবশ্য সেজন্য অবাক হয়নি। হোটেলের কাজটা যে এবার যাবে‚ বুঝে
ফেলেছিল। শুধু বলেছিল‚ ‘তাহলে আমার
ছয় মাসের মাইনের টাকাটা মিটিয়ে দেন বাবু।’
শুনে
গোবিন্দ সামন্ত শুধু মারতে বাকি রেখেছিল। মুখে মুখে হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন‚ আশি টাকা
করে নন্দর ছয় মাসের মাইনে হয় চারশো আশি টাকা। আর মাত্র গত কালই ও যে মাল হোটেল
থেকে সরিয়েছে তার দাম তিরিশ টাকা। সেই হিসেব গত এক মাসে নয় নয় করেও অন্তত হাজার
দেড়েক টাকার মাল সরিয়েছে। এরপর আবার মাইনে!
অগত্যা
শুধু হোটেলের কাজ নয়‚ নন্দর ছয় মাসের মাইনেও গেল। গোড়ায়
ভেবেছিল‚ হোটেলের কাজটা যখন কিছু শিখেছে‚ অন্য কোথাও
একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু কদিন ঘোরাঘুরিই সার। ইতিমধ্যে খবরটা রাষ্ট্র হয়ে
গেছে চারদিকে। চোর কর্মচারীকে কেউ কাজ দিতে রাজি নয়। দিন কয়েকের মধ্যেই নন্দ বুঝে
ফেলল‚ মহামায়াগঞ্জে তার ঠাঁই হওয়া মুশকিল। অন্য
কোথাও পাড়ি দিতে হবে। এর মধ্যে একদিন হঠাৎই পথে দেখা বদন আর মদনের সঙ্গে। ও পাশ
কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু দু’জন পথ আগলে দাঁড়াল।
‘কী চাঁদু‚ সেদিন একপিস
মাছ বেশি দিতে বলেছিলুম‚ গ্রাহ্য করলিনি। আর এদিকে একেবারে
পুকুর চুরি! তা কীভাবে নিত্যিদিন মাল সরাতি রে? মালিক টেরটিও পেলনি!’
‘আমি হোটেল
থেকে কিছু চুরি করিনি গো দাদা। মালিক
মিথ্যে অপবাদ করলেন। ছয় মাসের মাইনেও দিলেন না। ভেবেছিলাম‚ টাকাটা পেলে
দেশের বাড়ি যাব। তা আর হল না।’ নন্দর চোখ ছলছল হয়ে উঠল।
বদন
আড় চোখে পাশে মদনের উপর বুলিয়ে নিয়ে বলল‚
‘আমাদেরও সেই কথা রে?
তোর মতো ভাল মানুষ এমন কাজ করবে বিশ্বাস হতে চায় না। তা হ্যাঁরে…।’
‘আমার সময়
নেই দাদা।’ কথার মাঝেই নন্দ হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল। ‘গয়নার
নৌকো ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। সাতখালির দিকে যাব। চৈত্র
সংক্রান্তির গাজনের মেলা লেগেছে। দেখি যদি একটা কাজ মেলে।’ কথা শেষ করে
নন্দ পাশ কাটাতে যাবে। বদন ব্যস্ত হয়ে উঠল। ‘আরে আমরাও তো ওইদিকে যাব বলেই
বেরিয়েছি! তাহলে চল‚ একসাথেই
যাই।’
কদিন
পরেই চৈত্র সংক্রান্তি। সেই উপলক্ষে সাতখালিতে মস্ত মেলা বসে। চলে দিন পনেরো। গ্রাম–গঞ্জের
প্রচুর মানুষ আসে। কেউ পুজো দিতে। কেউ স্রেফ কেনাকাটা। সঙ্গে কাঁচা পয়সা। বদন আর মদন
আগে প্রতিবছরই হাজিরা দিত। এমন জায়গায় লোক ঠকানো কারবার ভালই জমে। রোজগার
মন্দ হয় না। কিন্তু বছর কয়েক হল মহামায়াগঞ্জেই
দিব্যি জমিয়ে নিয়েছে। গোবিন্দ সামন্তর মতো লোকেদের নানা হুকুম তামিল করে ভালই
রোজগার। ইদানীং তাই আর ওদিকে যায় না। এবারেও ইচ্ছে ছিল না। তবু যে আজ নন্দর সঙ্গে
ভিড়ে পড়েছে‚ তা অন্য কারণে।
ভিতরের
খবর হল‚ বুড়ো মানুষটিকে নন্দর মাছ–ভাত
খাওয়ানোর খবরটা ওরাই গোবিন্দ সামন্তের কানে তুলেছিল। গতকাল সেই কারণেই তার হোটেলে
গিয়েছিল। এত বড় একটা খবরের দাম তো আছেই। তার উপর খবর‚ নন্দর ছ’মাসের
মাইনের টাকাও কাটা গেছে। সেই দৌলতে একটা জম্পেশ খাওয়া তো
পাওনা হয়েই রয়েছে। প্রসঙ্গটা তুলে বদন শুধু বলেছে‚ ‘কাকা‚ এত বড় একটা খবর দিলুম‚ আজ এক প্লেট
চিতলমাছের পেটি খাইও কিন্তু। প্যানতা পোনা মাছ খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেল।’
‘বাজে কথা
বলিসনি বদন। শুধু পোনামাছ খাওয়াই আমি! কেন সেদিন
ইলিশের পেটি দিইনি?’
প্রায় ফুঁসে উঠলেন গোবিন্দ সামন্ত।
‘সে দিয়েছিলে
কাকা‚ আধ প্লেট। মোটে এক
পিস মাছ! এবার কতবড় খবরটা দিয়েছি বলো তো! আমাদের হাফ প্লেট ইলিশের পেটি দিতে তোমার
দম ফাটে। আর ওদিকে ছোঁড়াটা কত পিস চিতলপেটি হাতসাফাই করে খেয়েছে ঠিক কী!’
কথা
শেষ করে বদন সবে কপাল চাপড়াতে যাবে‚ গোবিন্দ
সামন্ত মুচকি হেসে বললেন‚ ‘ঘোড়ার ডিমের খবর এনেছিলি।’
‘ম–মানে!’ দুই
মানিকজোড়ের মুখে কথা নেই।
‘আমি হলুম গে
গোবিন্দ সামন্ত।’ ফের
মুচকি হাসলেন তিনি। ‘আমার
হোটেল থেকে এক প্লেট চিতলের পেটি হাপিশ হবে‚ আর
আমি টের পাবনি! এই বুদ্ধি নিয়ে তোদের হামবড়া? তা যাকগে‚ ছোকরার ছয়
মাসের মাইনে তোদের দৌলতেই বেঁচেছে‚ সেটা ঠিক।
তাই চিতলের পেটিই তোদের খাওয়াব আজ। সঙ্গে একটা কাজের দায়িত্বও দেব।’
‘কী‚ কী গো কাকা?’ দুই
মানিকজোড় প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
‘নন্দ
ছোঁড়াকে দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। কিন্তু আস্ত ঘোড়েল জিনিস। অনেক
রহস্য আছে ভিতরে। তোদের এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচে দিতে পারে।’
গোবিন্দ
সামন্তর ওই কথায় বদন হঠাৎ গুম হয়ে গেল। মনে পড়ল‚ সেদিন পুকুরে চানের ঘাটের ব্যাপারটা। নন্দর মুখের কথা খসতে
না খসতেই তেলের বাটি গাছের উপর থেকে নীচে খসে পড়েছিল বটে! এক ফোঁটা তেলও ছলকে
পড়েনি। একেবারেই গুরুত্ব দেয়নি তখন। হাঁ করে খানিক তাকিয়ে থেকে ঝুঁকে পড়ল গোবিন্দ
সামন্তর দিকে। ‘কী নজর গো তোমার কাকা! পায়ের ধুলো
দাও। তা আরও কিছু দেখেছ নাকি?’
‘দেখিনি
মানে!’ চোখ নাচাল গোবিন্দ সামন্ত। ‘প্রমাণ আরও পেয়েছি রে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও
রহস্যের হদিশ পাইনি। ছোঁড়া গভীর জলের মাছ। লেগে পড় দেখি।’
এত কিছুর
পরেও সেদিন চিতলের পেটি অবশ্য হাফ প্লেটের বেশি জোটেনি। তবু
গোবিন্দ সামন্তর হুকুম। দুই মানিকজোড় সেই থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে নন্দকে। আজ দেখা যখন
মিলেছে‚ হাতছাড়া করা যায় না। বদনের
ইশারায় মদন ইতিমধ্যে লেগে পড়েছে তার পিছনে।
সাতখালির গয়নার নৌকোয় যাত্রী কম হয়নি। কিন্তু এই
মেলার সময় দুনো যাত্রী হবার কথা। ছাড়ার সময় পেরিয়ে গেলেও দুই মাঝি গড়িমসি করছে। তাই
নিয়ে কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে তুমুল তর্ক। গয়নার নৌকো।
টাইম যখন হয়ে গেছে‚ ছাড়তেই হবে। নইলে চৌকিতে খবর দেবে
তারা। সেই শাসানিতে দুই মাঝি কিছু ঘাবড়েই গিয়েছিল। হঠাৎ চোখ পড়ল‚ বদন আর মদনের
দিকে। দুই মাণিকজোড়কে মাঝিরা ভালই চেনে। একজন কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে বলল‚ ‘দাদা গো‚ কিছু একটা
বিহিত করা যায় না? বোঝেন তো‚ এই মেলার সময়তেই চারটি পয়সা আমাদের।’
তা
দুই মানিকজোড় নিরাশ করেনি ওদের। গলা নামিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে খানিক কী কথা হল।
দেখা গেল‚ তারপরেই নোঙর তুলে বদর বদর বলে দুই
মাঝি ছেড়ে দিয়েছে নৌকো।
গঞ্জের
ছোট নদী ছাড়িয়ে নৌকো তখন বড়গাঙের কাছে। জায়গাটার বেজায় বদনাম। স্থানে স্থানে চোরা
ঘূর্ণি। নৌকো হুঁশিয়ার হয়ে না বাইলেই ঘূর্ণিতে পড়ার সম্ভাবনা। তেমন জোরাল ঘূর্ণিতে
পড়ে নৌকো ডুবেও গেছে অনেক। তা কপাল
খারাপ। গয়নার নৌকোও আজ হঠাৎ সেই চোরা ঘূর্ণিতে গিয়ে পড়ল। মুহূর্তে চক্কর খেয়ে নৌকো
টালমাটাল হয়ে ডুবুডুবু। মাঝিদের সামাল সামাল রব। আতঙ্কে যাত্রীদের বাঁচাও বাঁচাও
আর্তনাদ। সে এক ভয়ানক অবস্থা। অবস্থা দেখে বদন হাঁক পাড়ল‚ ‘হেই মাঝির
পো। নৌকো সামলাও। এতগুলো মানুষ।’
‘সে তো হক
কথা কত্তা’ এক
মাঝির জবাব। ‘তা মোদের দিকটাও একটু দেখেন। কিছু বকশিস।’
‘তা কত
চাইছিস বাবা?’
‘এজ্ঞে
যাত্রী পিছু এক শিকি (২৫ পয়সা)।’ বদনের কথায় মাঝির উত্তর।
নৌকোর
অনেকেরই তখন মাঝিদের শয়তানি বুঝতে বাকি নেই। কায়দা করে নৌকো ঘূর্ণিতে ফেলে কিছু
অতিরিক্ত আদায়ের চেষ্টা। সন্দেহ নেই‚ দুই
মানিকজোড়ের হাতও রয়েছে। নৌকো ছাড়ার আগে তাই নিয়ে দুই পক্ষের গুজগুজ চলছিল। কিন্তু
বুঝলেও ওই অবস্থায় কী করবে তারা? ওদিকে ভীত সন্ত্রস্ত যাত্রীদের অনেকেই তখন রাজি
হয়ে হাত তুলে দিয়েছে। হঠাৎ এক ব্যাপার ঘটল। নন্দ ছিল একধারে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে
বিড়বিড় করে বকতে শুরু করল।
বনবাদাড় আর পথঘাট‚
আঁধার রাতে চাঁদের হাট।
হিড়িং পিড়িং হিং টিং ছট‚
মুশকিল আসান ফটাফট।
টালমাটাল
নৌকো দেখতে দেখতে স্থির। ঘূর্ণির ছিটেফোঁটাও নেই। যাত্রীদের
মুখে মুহূর্তে মা গঙ্গার জয়গান। রক্ষা করেছেন তিনি। এদিকে দুই মাঝির তো মাথায় হাত।
যাত্রীদের ভড়কি দেবার জন্য দুই নদীর স্রোত বুঝে ওরাই নৌকো ছোটমতো এক ঘূর্ণিতে এনে
ফেলেছে। তেমন বিপদের নয়। কিন্তু
যাত্রীদের ঘাবড়ে দিতে তাই যথেষ্ট। দুই
মানিকজোড় বাবুও কথা দিয়েছে‚ অতিরিক্ত কিছু পয়সা আদায় করে দেবে। সেটা
সারা হলেই তারা নৌকো ফের ঘূর্ণি থেকে বের করে আনবে। কিন্তু কোথায় কী!
দুই
মাঝির মুখ কালো হয়ে গেলেও ওদিকে মদনের হাসি তখন গাল ছাড়িয়ে কান পর্যন্ত পৌঁছে
গেছে। খুশিতে লাফিয়ে উঠেছে তিড়িং করে। ভাগ্যিস‚
বদনের পরামর্শে
সেই থেকে নন্দর গায়ে লেপটে ছিল! বিড়বিড় করে চাপা গলায় মন্ত্র পড়লেও শুনতে ভুল
হয়নি। ভিড় ঠেলে মদনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল‚ ‘মেরে দিয়েছি
বদনদা। কেল্লা ফতে।’
ওই
ব্যাপার দেখে বদন নিজেও কিছু নিরাশ হয়ে পড়েছিল। মাঝিদের ভুজুংয়ে কিছু আদায় হলে
পকেটে কিছু আসত। হঠাৎ বদনের কথায় চমকে উঠল‚ ‘কী রে?’
‘ছোঁড়া
মন্ত্র জানে গো বদনদা। বিড়বিড় করে পড়ছিল তখন। আর তাতেই বিপদভঞ্জন।’
‘অ্যাঁ‚ বলিস কী রে!
ছোঁড়া ভেলকিবাজি জানে! গোবিন্দ সামন্তের অনুমানে তাহলে ভুল নেই!’
‘আলবত।’ তুড়ি মেরে মদন
বলল‚ ‘তোমার
কথায় সেই থেকে ছোঁড়ার সঙ্গে লেগে ছিলাম তো। নিজের কানে শুনেছি।’
‘সব শুনেছিস!’ খুশিতে বদনের
দু’পাটি
দাঁত গাল ছাড়িয়ে কান পর্যন্ত পৌঁছল। ‘মনে করে রেখেছিস তো?’
‘এই সেরেছে!’ বদনের কথায়
হঠাৎ যেন খাবি খেল মদন। ‘দাঁড়াও ভেবে বলছি।
বনবাদাড়
আর পথঘাট‚
আঁধার
রাতে চাঁদের হাট।
হিড়িং
কিড়িং…। এই
রে আর তো মনে নেই!’
অনেক
ভেবে চাঁদিতে টোকার পর টোকা মেরেও মদন আর কিছু মনে করতে পারল না। মস্ত এক জিব বের
করে দাঁড়িয়ে রইল।
(৪)
সাতখালির
গাজন-মেলা এদিকে বিখ্যাত। বেজায় নামডাক। দূর দূর থেকে মানুষ আসে। বিরাট গাজনের মাঠ
কয়েক দিন গমগম করে। নানা জায়গা থেকে ব্যাপারীরা আসে পশরা নিয়ে। ভটভটি লাগানো বড়
নাগরদোলা। বাঘ–সিঙ্গি
নিয়ে সার্কাস পার্টি। তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা। সাধুসন্ন্যাসীও কম নয়। আস্তানা গেড়ে আসর
জমায় তারাও। ভাগ্য ফেরাবার আসায় তাদের ঠেকেও ভিড় কম হয় না। গাজনের মাঠে এই কয়েকটা
দিন তাই তিল ধারণের স্থান থাকে না। নন্দ এর আগে এদিকে আসেনি। ঘাটে নেমে সেই ভিড়
দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে‚ দুই মানিকজোড় দু’পাশে এসে দাঁড়াল। ‘এই ভিড়ে
কোথায় যাবি বাপু। অচেনা জায়গা। তারচেয়ে আমাদের সঙ্গে চল‚ ভাবতে হবে না।’
সন্ধে
নামতে দেরি নেই। গ্রামের মেলা। সন্ধের পরেই
ফাঁকা হতে শুরু করবে। রাতে কোথায় ঠাঁই নেবে ঠিক নেই। নন্দ
রাজি হয়ে গেল।
এদিকে
বদন আর মদনও রাতের জন্য জুতমতো একটা ঠাঁই নিয়ে চিন্তায় ছিল। ছোঁড়ার কাছ থেকে
মন্ত্র আদায় করতে হলে তোয়াজ কিছু করতেই হবে। এক দোকানে গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে। বদন
বলল‚ ‘আমাদের
কিন্তু বেজায় খিদে পেয়েছে রে। তোর পায়নি?’
খিদেয়
নন্দও তখন কাহিল হবার জোগাড়। সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি। কিন্তু জবাব না দিয়ে থম
হয়ে রইল। মদন চাপা গলায় বদনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল‚ ‘গুরু‚ যে ছোঁড়া
চিতলের জোড়া পেটি দিয়ে জলযোগ সারে‚ তাকে জিলিপি
দেখাচ্ছ! ওতে হবে না। মেলায় গজু ঘোষও দোকান লাগিয়েছে দেখছি। বরং ওখানেই নিয়ে চলো।’
মহামায়াগঞ্জে
গজু ঘোষের মিষ্টি বিখ্যাত। রাজভোগ আর রাবড়ির জবাব নেই। বদনের পরামর্শে মাথা নেড়ে বদন
সেদিকে পা বাড়িয়েছে‚ নন্দ বলল‚ তোমরা খাও
দাদা। আমি যাই বরং।’
কেন
যে নন্দ সরে পড়তে চাইছে‚ তখন দুই মানিকজোড়ের বুঝতে বাকি নেই।
প্রায় হাউমাউ করে উঠল। ‘যাবি
মানে! একসাথে মেলায় এলুম। তোকে ফেলে খাব‚ এমন পাষণ্ড
নই রে। কদিন একসাথে খাব‚ একসাথে থাকব
সবাই।’
নন্দ
আর কিছু বলতে পারল না। প্রথমে আলুর দম দিয়ে ঘিয়ে ভাজা গোটা কয়েক করে গরম কচুরি। তারপর
চারটে করে ঢাউস রাজভোগ আর রাবড়ি। খাওয়ার ফাঁকে দু’জন আড়চোখে ঘনঘন তাকাচ্ছিল নন্দর
দিকে। কী জানি‚ গজু ঘোষের মেঠাইও পছন্দ হবে কিনা
ছোঁড়ার। কিন্তু চেটেপুটেই খেল নন্দ। হাঁফ ছাড়ল ওরাও। যতক্ষণ না মন্ত্র উদ্ধার করা
যাচ্ছে‚ ছোঁড়াকে এভাবেই তোয়াজ করে যেতে হবে।
তিনজন
যখন খেয়ে উঠল‚ পেট ঢাউস। ইতিমধ্যে অন্ধকার ঘন হতে
শুরু করেছে। দাম মেটাতে গিয়ে বদনের শরীর চিড়বিড় করছিল। কিন্তু কাজ হাসিল করতে হলে
অন্য উপায় নেই। তাই গ্রাহ্য করল না। দোকান থেকে বের হয়ে ওরা চলতে শুরু করেছে। ছোঁড়ার
পছন্দসই ঘরের জন্য এরপর কত গুনাগার দিতে হবে নিচু গলায় তাই নিয়ে দু’জনের ফিসফাস
চলছে। পাশেই সাধুদের আখড়ায় ভিড়ের ভিতর থেকে ‘বোম শঙ্কর’ আওয়াজ। মদন
চমকে উঠে চাপা গলায় বলল বদনদা‚ এ আমাদের বোমবাবা মনে হয় যেন!’
গেঁজেল
বোমবাবা মহামায়াগঞ্জের কাছে এক শিবমন্দিরের পুরোহিত। আসল নাম একটা ছিল। কিন্তু
দিনরাত গাঁজায় দম আর থেকে থেকেই বিকট ‘বোম শঙ্কর’ হুঙ্কারের
জন্য সবার কাছে ‘বোমবাবা’ নামেই
পরিচিত। দুই মানিকজোড়ের সঙ্গে ভালই খাতির। সন্দেহ হতে দু’জন এগিয়ে গিয়ে
দেখে অনুমানে ভুল নেই। এক চালার নীচে বেড়ে আসর জমিয়ে ফেলেছে। সামনে ধুনি। চারপাশে
কৃপা প্রার্থীও কম নয়। ঘন ঘন গাঁজায় দম দেওয়ার ফাঁকে কারো চোখ উলটে‚ কারো কপালে দুটো
টোকা মেরে ভবিষ্যৎ বাতলে দিচ্ছেন। কাউকে এক
খাবলা ধুনীর ছাই। প্রণামীও পড়ছে। মানুষটা
এবার যে সাতখালির গাজনের মেলায় এসেছে জানা ছিল না ওদের। ছুটে গিয়ে দু’জন পায়ের
কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ‘কী
ভাগ্যি ঠাকুর! সেই কতদিন পরে দেখা পেলাম গো!’
‘কে রে?’ কলকে থেকে
মুখ সরিয়ে বোমবাবা আড়চোখে তাকালেন। ‘অ‚ সেই পৈরাগের
(প্রয়াগ) ঘাটে তোদের দেকেছিলুম না? পাঁচ বছর আগে।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ
ঠাকুর।’ দুই
মানিকজোড় প্রায় পঞ্চমুখ‚ ‘চান সেরে উঠতেই সামনে উদয় হলেন! একটু
আশীর্বাদ চাইতে গেছি‚ নিমেষে চোখের সামনে উধাও। সেই দিনই
বুঝেছি ঠাকুর সাক্ষাত মহাদেব। আজ ফের দেখা যখন পেয়েচি‚ আর ছাড়ছিনে।
পায়ের তলায় ঠাঁই একটু দিতেই হবে।’
গেঁজেল
হলেও বোমবাবার জ্ঞান টনটনে। আড় চোখে ততক্ষণে দেখে নিয়েছেন উপস্থিত
কৃপা-প্রার্থীদের। ভক্তিতে সবার চোখ প্রায় গদগদ। কদিনে জমিয়েছেন ভালই। তবে গ্রামের
মেলা। চাষাভুষো মানুষ। প্রণামী বিশেষ যুতসই নয়। দুই মানিকজোড়কে সাগরেদ পেলে সেটা
পুষিয়ে নেওয়া যাবে। হাতের কলকেয় বড় একটা টান দিয়ে অল্প মাথা নাড়লেন।
বদন
আর মদনের দৌলতে বোমবাবার আখড়া ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেরি হয়নি। দুনো ভিড় এখন। সাধু
সন্ন্যাসীদের উপর বেজায় ভক্তি নন্দরও। এসেছিল একটা
কাজের খোঁজে। কিন্তু সব ভুলে আখড়ায় সাধুর সেবায় ভিড়ে পড়েছে সেও। দেখে দুই মানিকজোড়
তো বেজায় খুশি। প্রায় বিনে খরচে আস্তানা। তবে নন্দকে তোয়াজ করতে ত্রুটি রাখেনি। দু’বেলা মাছ
ভাত‚ পাঁঠার
মাংস‚ ভালমন্দ
খ্যাঁটের দিকে নজর রাখতেই হয়েছে। তাতে নন্দ একদিন মদনকে বলেই ফেলেছিল‚ ‘এসব খাওয়া
আমার অভ্যেস নেই গো দাদা।’
তাতে
বেজায় ঘাবড়ে মদন ছুটেছে বদনের কাছে। ‘সেরেছে গো বদনদা! ছোঁড়াটা বেগড়বাই
করতে লেগেছে। ফের একদিন গজু ঘোষের রাজভোগ আর রাবড়ি দিয়ে ঠাণ্ডা না করলে কোন ফাঁকে
সটকে না পড়ে। এতবড় মেলা!’
অগত্যা
সেই দিন বিকেলেই ফের গজু ঘোষের মেঠাই। ট্যাঁকে ফের ধস নামলেও বদন পরোয়া করেনি। মদন
আরো হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। মন্ত্রের বাকি অংশ শিখে না নেওয়া পর্যন্ত ছোঁড়াটাকে
কিছুতেই চোখের আড়াল করা চলবে না।
দিন
কয়েক তোয়াজের পর সেদিন দুপুরে মেলা তখনো জমে ওঠেনি। ভিড় কম। বদন আর মদন নন্দকে
নিয়ে হাজির হল মেলার এক কোনে নিরিবিলিতে। কাজটা বোমবাবার আখড়াতেও সারা যেত। কিন্তু
তাতে ব্যাপারটা পাঁচকান হবার সম্ভাবনা। গেঁজেল বোমবাবাকে ভালই চেনে দু’জন। একবার
আসল ব্যাপারের হদিস পেলে মুশকিল। দু’জন নানা ফন্দিফিকির খাটিয়ে বোমবাবা
রোজগার ভালই বাড়িয়েছে। অথচ বখরা নিয়ে মোটেই উচ্চবাচ্য নেই। নন্দকে
নিরিবিলিতে ডেকে আনতে হয়েছে সেই কারণে। আসার পথে ফের গজু ঘোষের রাজভোগ খাইয়ে
এনেছে। ইলিক চিলিক গল্পের ফাঁকে বদন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল‚ ‘তুই নাকি
মন্ত্রতন্ত্র জানিস!’
‘কী মন্ত্র
গো দাদা?’ নন্দ
আকাশ থেকে পড়ল।
‘সেদিন নদীর
ঘূর্ণিতে পড়ে নৌকো যখন বেসামাল‚ বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছিলি নাকি। আর
তাতেই…।’
‘সে মন্ত্র
নয়গো দাদা।’ বদনের
কথার মাঝেই নন্দ বলল‚ ‘আমার তৈরি ছড়া। আমি
না ছড়া বাঁধতেও পারি। শুনবে:
বনবাদাড় আর পথঘাট‚
আঁধার রাতে চাঁদের হাট।
হিড়িং পিড়িং হিং টিং ছট‚
মুশকিল আসান ফটাফট।’
দুই
মানিকজোড় আলগোছে পরস্পরের দিকে তাকাল। ‘এই ছড়াটাই পড়েছিলি তখন? ঠিক বলছিস?’
‘হ্যাঁ গো
দাদা। ভাল হয়নি?’
নন্দ
খুশিতে ফুরফুরে হয়ে উঠলেও মদনের ভুরু কুঁচকে উঠল। ‘কী বললি? হিড়িং কিড়িং
হিং টিং ছট। মুশকিল আসান…।’
‘না গো ভুল
হল দাদা। হবে হিড়িং পিড়িং।’ নন্দ ফের ঝালিয়ে দিল ছড়াটা। মনে মনে বদন
আর মদনও ঝালিয়ে নিল বার কয়েক। তারপর চারদিকে সন্তর্পণে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল‚ ‘নন্দ এবার
তুই বোমবাবার আখড়ায় যা। উনি খুঁজছেন হয়তো। আমরা একটু পরে
আসছি।’
নন্দ
চলে যেতেই বদন বলল‚ ‘মদনা‚ এবার তাহলে
মন্ত্র পরখ করে নেওয়া যাক।’
‘খেপেছ বদনদা।’ আঁতকে উঠল মদন‚ ‘চারপাশে
লোকজন। কারো চোখে পড়লে নিস্তার আছে! বাপরে বাপ!’
‘কেন?’ মদনের কথায়
অবাক হল বদন।
‘সেই
বায়স্কোপ দেখনি? আমাদের
মতোই দুই মাণিকজোড় গুপী আর বাঘা এমনই এক মন্ত্র পেয়েছিল। তারপর মন্ত্র পড়ে খাবার
চাইতেই উড়ে এল হাঁড়ি ভরতি পোলাও কালিয়া। দই–মিষ্টি। এই মেলায় ভিড়ে ওসব ব্যাপার
হলে উপায় আচে! খাবে কী? তার আগেই মেলাসুদ্ধ মানুষ হামলে এসে ছিঁড়ে খাবে দু’জনকে।’
যুক্তিটা
মানতেই হল বদনকে। মন্ত্রের গুন পরখ করতে হলে এখনই সরে পড়তে হবে। জেটিঘাটের দিকে
তাকিয়ে চোখে পড়ল মহামায়াগঞ্জের গয়নার নৌকো ছাড়ব ছাড়ব করছে। দেরি না করে উঠে পড়ল দু’জন।
দুই
মানিকজোড় এরপর হাঁফ ছাড়ল সেই রাত্তিরে মহামায়াগঞ্জ পৌঁছে। এর মধ্যে উত্তেজনায় ভাল
করে নিঃশ্বাসটুকুও ফেলতে পারেনি কেউ। মদনের বাসা জেটিঘাটের কাছেই। একাই থাকে। বরং বদনই
থাকে কিছু দূরে। দু’জনের
কারোই তখন তর সইছে না। মদন বলল‚ ‘বদনদা‚ আজ আমার
ঠেকেই চলো বরং। বড্ড খিদেও পেয়েছে। রাতের খাওয়া আজ গোবিন্দ সামন্তর জোড়া চিতলপেটি
দিয়ে দেরাদুন–ভাত আর গজু ঘোষের রাবড়ি দিয়ে হয়ে যাক।’ বলতে বলতে উলস্ করে জিবের জল টানল।
‘তা মন্দ
বলিসনি। সেদিন অত করে বললুম‚ হতচ্ছাড়া গোবিন্দ সামন্ত তবু দু’পিস
চিতলপেটি দিলে না! বেড়ে স্বাদ ছিল রে। তার সঙ্গে গজু ঘোষের রাবড়ি! বেশ বলেছিস!’ বলতে গিয়ে
সুড়ুত করে জিবের জল টানল বদনও।
ছুটে ঘরে পৌঁছে মদন আগে দরজা বন্ধ করল। তারপর
হাঁফাতে হাঁফাতে মনের ইচ্ছে নিবেদন করে মন্ত্র। কিন্তু কোথায় কী! হাঁ করে অপেক্ষা
করাই সার। কিছুই এল না। মিনিট পাঁচেক পার হবার পর বদন বলল‚ ‘কী হল রে? মন্ত্র ঠিক
পড়েছিস তো?’
‘একদম ঠিক…।’ বলতে বলতে
হঠাৎ থেমে গিয়েছিল মদন। তারপরেই লাফিয়ে উঠল। ‘হ্যাঁ মনে
পড়েছে গো। ছোঁড়াটাকে মন্ত্র পড়ার পর জোরে কবার হাততালি দিতে দেখেছিলুম।’
‘হতচ্ছাড়া‚ এই বুদ্ধি
নিয়ে আমার সাগরেদি কচ্ছিস! ক’বার দিয়েছিল হাততালি?’ খেঁকিয়ে উঠল বদন।
‘সে বার কয়েক
গো বদনদা।’ মদন
ফের মন্ত্র পড়ে হাততালি দিল। এবারেও সেই এক ব্যাপার।
‘তোর মন্ত্র
ঠিক হচ্ছে না বোধহয়। দাঁড়া আমি পড়ছি।’ মদনকে থামিয়ে এবার বদন শুরু করল।
কিন্তু সব আগের মতোই ভোঁ–ভোঁ।
খাবারের দেখা নেই।
মদন
বলল‚ ‘বদনদা
হাততালিতে ভুল হচ্ছে না তো?’
‘আমারও তাই
মনে হচ্ছে রে।’ ঘাড়
নাড়ল বদন। অগত্যা দু’জনের শুরু
হল হাততালির কম্পিটিশন। তাতে কিছু তো মিললই না। বরং এক ভয়ানক ব্যাপার ঘটে গেল। রাত
দুপুরে বিকট হাততালির শব্দে কাঁচা ঘুম ভাঙতে বাড়িওয়ালা ঘটৎকচ হালদার খেপে কাঁই।
নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লোকটার যেমন চেহারা‚ মেজাজটাও
সেই রকম। বেজায় বদরাগী। তার উপর মদনের তিন মাসের ভাড়া বাকি। অথচ
ধরাই যাচ্ছে না। দেখা হলেই চ্যাং মাছের মতো পিছলে যাচ্ছে। মেজাজ তাই খাপ্পা হয়েই
ছিল। দরজা খুলে বের হয়ে সোজা বদনের ঘরের সামনে হামলে পড়লেন।
‘অরে
হারামজাদা। তিন মাসের ভাড়া বাকি ফালাইছস! অখন আর একটারে জুটাইয়া রাত দুপরে তামসা!
আইজ তো তরে খাইছি। আমারে চিনস নাই! দরজাটা খোল দেহি?’ বলতে বলতে ধাঁই করে দরজায় এক রদ্দা।
বেজায় আঘাতে পলকা দরজা প্রায় মড়মড় করে উঠল।
কাঠ
বাঙাল ঘটৎকচ হালদারকে ভালই চেনে দুই মানিকজোড়। এখন দরজা খুললে যে যমের বাড়ির দরজা
দেখতে হবে তাতে সন্দেহ নেই। অগত্যা কাঁথা মুড়ি দিয়ে এক লাফে বিছানায়। মদন
কাঁপতে কাঁপতে কাঁথার ভিতর থেকে কোঁ–কোঁ করে বলল‚ ‘মাইরি গো
দাদা‚ আমরা
কেউ ঘরে নেই।’
তাতে
ঘটৎকচ হালদার তো আরো খেপে কাঁই। ‘অ্যাঁ‚ আমার লগে তামসা করস! কাইল সকালে তগো
একদিন কী আমার একদিন।’
দরজা খোলার আশু সম্ভাবনা নেই বুঝে রাগে গরগর করতে করতে মুঠি পাকিয়ে দরজায় ফের
এক রদ্দা কশাতে গিয়েও অতি কষ্টে সামলে নিলেন। ফের রদ্দা হাঁকালে দরজার কিছু আর
অবশিষ্ট থাকবে না। হাজার হোক নিজের বাড়ি। নইলে
দরজা ভেঙেই আজ কাজ সেরে ফেলতেন। অগত্যা দাঁত কড়মড় করতে করতে ফিরেই গেলেন নিজের ঘরের
দিকে।
পেটের
খিদে পেটে চেপে দুই মানিকজোড় এরপর সারারাত মড়ার মতো বিছানায়। সেই শেষ রাতে যখন দু’একটা করে
পাখি ডাকতে শুরু করেছে‚ মদন কাঁথা উলটে উঠে বসল। বেশ জানে‚ এই শেষ রাতে
ঘটৎকচ হালদারের ঘুম কুম্ভকর্ণকেও হার মানায়। চাপা গলায় বলল‚ ‘বদনদাগো‚ আর দেরি নয়।
চলো ভেগে পড়ি এইবেলা। ঘটা হালদার টেরও পাবে না। উঠে দেখবে পাখি ফুড়ুৎ।’
‘একে এভাবে
বেইজ্জত! তারপর ঘটৎকচ হালদারের হামলা‚ বদন একটু
ঘাবড়েই গিয়েছিল। মদনের কথায় চাঙা হয়ে বলল‚ ‘তাহলে দেরি
না করে গাজনের মেলার দিকেই চল আবার। নন্দ ছোঁড়াকে ফের ধরতেই হবে আজ। ব্যাটা বেজায়
ভোগা দিয়ে গেছে!’
পরামর্শ
করে দুই মানিকজোড় এরপর নিঃশব্দে ঘটৎকচ হালদারের বাড়ির চৌহদ্দি পার হয়ে পথে। তারপর
পড়ি কী মরি করে গঞ্জের ঘাটের দিকে। ভোর সকালে সাতখালির দিকে একটা লঞ্চ ছাড়ে। ধরতে
পারলে শুধু ঘটৎকচের হাত থেকে নয়‚ ধরা যাবে নন্দকেও। ব্যাটা ভিজে
বেড়াল!
কিন্তু
জেটিঘাটে পৌঁছবার আগেই আর এক ব্যাপার। গতকাল সংক্রান্তি গেছে। আজ যে পয়লা বৈশাখ
হুঁশই ছিল না ওদের। হালখাতার দিন। কাকভোরে গণেশ মন্ত্র জপতে জপতে গোবিন্দ সামন্ত
চানে বের হয়ে পড়েছেন। চান সেরে গণেশ পুজো। তারপর নতুন খাতায় সিঁদুরের ফোঁটা আর
কাঁচা টাকার ছাপ মেরে বউনি। অনেক কাজ। তা দুই মানিকজোড় পড়ে গেল তার সামনে।
ভেবেছিল
আধো অন্ধকারে পাশ কাটিয়ে ভেগে পড়বে। কিন্তু গোবিন্দ সামন্তর চোখ শকুনকেও হার
মানায়। দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন‚ ‘কী হল রে তোদের? চুরি করে
পালাচ্ছিস নাকি? শুনতে
পাই‚ ঘটা
হালদারের কাছে মদনের তিন মাসের ভাড়া বাকি। এবার আমাকেও ফাঁকি দেবার মতলব!’
শুনে
দু’কান
মলে দু’জন প্রায় হাউমাউ করে উঠল‚ ‘কী যে বলেন কাকা! আপনার ভরসাতেই তো
বেঁচে আছি।’
‘তাই বল।’ গোবিন্দ
সামন্ত চোখ নাচালেন। ‘তা
তোদের ভরসা আর কোথায় পাচ্ছি? একটা কাজ দিয়েছিলুম। তার কী করলি।’
‘সেই খোঁজেই
তো লেগে আছি গো।’
হাঁফ ছাড়ল বদন। ‘নন্দর
খোঁজেই তো সাত সকালে ধাওয়া করেছি। খোঁজ পেয়েছি ছোঁড়া সাতখালির গাজন মেলায় গেছে।’
‘দূর হতভাগা।’ সপাটে হাত
নেড়ে গোবিন্দ সামন্ত মাছি তাড়ালেন যেন। ‘নন্দর খোঁজ পরে করিস। তার আগে অন্য
এক কাজের কথা বলেছিলুম‚ ভুলে গেছিস?’
‘সেরেছে!’ মনে পড়তে বদন
ততক্ষণে প্রমাদ গণেছে। গোবিন্দ সামন্ত দিন কয়েক আগে একটা কাজের কথা বলেছিল বটে।
বাজারে মা তারা ব্রহ্মময়ী হোটেলের রমরমা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আয়তনে না বাড়ালে
চলছে না। হোটেলের লাগোয়া বুড়ি দয়াময়ী দাসীর বাড়ি। তিনকুলে কেউ নেই। কিন্তু তেজ
এখনো ষোল আনা। কাউকে গ্রাহ্য করে না। গোবিন্দ সামন্ত অনেক দিন থেকে লেগে আছে
পিছনে। দয়াময়ী দাসীর বাড়িটা পেলে সোনায় সোহাগা হয়। এক লপ্তে বাড়িয়ে ফেলতে পারেন
হোটেল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বুড়িকে রাজি করানো যাচ্ছে না। অগত্যা অন্য ফন্দি।
সেজন্য
লাগানো হয়েছে গঞ্জের সেরা উকিল। দয়াময়ী দাসীর সম্পত্তির অন্য এক দাবিদার খাড়া করে
কেস ঠোকার তোড়জোড় চলছে। কিন্তু তার জন্য বুড়ির দলিলটা আগে হাতানো দরকার। ওটা হাতে
পেলে উকিল সাহেব কথা দিয়েছেন‚
দয়াময়ী দাসীর থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেবেন। দিন কয়েক
আগে দুই মানিকজোড়কে গোবিন্দ সামন্ত সেই কাজের কথাই বলেছিলেন। বুড়ি
রাতকানা মানুষ। আর বদন–মদনের
চেনা জানা সিঁদেল মহামায়াগঞ্জে কিছু কম নেই। তাদের কাউকে লাগিয়ে দিলে সহজেই হাসিল
করা যায়। কাজটা কঠিন নয় এমন। কিন্তু নানা কাজে খেয়াল ছিল না ওদের। বদন মস্ত জিব
বের করে বলল‚ ‘ভুল হয়ে গেছে গো কাকা। তবে
চিন্তা নেই‚ এই হপ্তাতেই সেরে দেব।’
‘উঁহু‚ সেটি হচ্ছে
না।’
গোবিন্দ সামন্ত ঘাড় ঝাঁকালেন। ‘আজ রাতের মধ্যেই চাই।’
‘আজ!’ বদন মাথা
চুলকাল। গতকাল গাজন মেলায় নন্দকে বিদেয় করে দিলেও ফের আজ ছুটেছে তার খোঁজে। মরে
গেলেও সে–সব কথা বলার উপায় নেই।
‘হ্যাঁ রে।
আজ। খবর পেয়েছি‚ বুড়ি গতকাল মেলায় গাজনের থানে পুজো
দিতে গেছে। বাড়িতে কেউ নেই। আজ পয়লা বৈশাখের দিনটাও ওখানে পার করে আসবে। এই সুযোগ
বারে বারে আসবে না রে। তোদের হাতে সিঁদেলের তো অভাব নেই। আজ রাতে লাগিয়ে দে একটাকে। ওফ!
বুড়ির ওই বাড়ির উপর আমার লোভ কী আর আজকের রে! বাবা গণেশ বুঝি এতদিনে মুখ তুলে
চেয়েছেন। দে বাপু‚ বুড়ির দলিলটা এনে দে।’
গোবিন্দ
সামন্তর মর্জি। রাজি না হয়ে উপায় নেই। অগত্যা মাথা
নাড়তেই হল বদনকে। গোবিন্দ সামন্তও ফের গণেশ মন্ত্র জপতে জপতে চানের ঘাটে চললেন।
খানিক দূরে যেতেই মদন ফুঁসে উঠে বলল‚ ‘এটা কেমন হল
বদনদা! একটা কাজে যাচ্ছি। এর মধ্যে এই সব উটকো ঝামেলায় রাজি হওয়া কী ঠিক হল? ওদিকে
নন্দছোঁড়া ফসকে গেলে হাতপা কামড়াতে হবে‚ খেয়াল আছে।
হায় হায়!’
একেবারে
মনের কথাই বলেছে মদন। হাড় কৃপণ গোবিন্দ সামন্তের ফয়দার
জন্য নন্দকে হাতছাড়া করা যায় না। ঠোঁট উলটে বলল‚ ‘তুইও যেমন।
বলতে হয়‚ তাই বেলেছি। সেদিন অত করে বললুম‚ কঞ্জুসটা
তবু দু’পিস
চেতলপেটি খাওয়ায়নি। সেকথা মনে নেই ভেবেছিস। চল–চল‚ সকালের লঞ্চ
ফেল হয়ে গেলে মুশকিল।’
(৫)
সাতখালির
গাজন মেলায় বোমবাবার ঠেকে পৌঁছে দু’জনের তো মাথায় হাত। হায় হায়। একী
কাণ্ড হয়ে রয়েছে এদিকে। পাখি যে হাতছাড়া! দু’জন প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল বোমবাবার
পায়ে। ‘ও
ঠাকুর‚ নন্দছোঁড়া গেল কোথায়? সেই সাত সকালে
বের হয়ে ছুটে এলুম!’
‘সে আমি কী
জানি?’ বোমবাবা
প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন‚ ‘তোরা
ওইভাবে না বলে–কয়ে
ভেগে পড়লি! ছোঁড়াকে রেখে কী করব? দিয়েছি খেদিয়ে। নিজে করে খেগে যা।’
‘সর্বনাশ
করেছ ঠাকুর!’ আর
চেপে রাখার উপায় নেই। একে একে সব কথাই খুলে বলল ওরা।
‘বলিস কী রে!’ বোমবাবার
দুই চোখ জুলজুল করে উঠল। তারপর খেঁকিয়ে উঠে বললেন‚ ‘এত ব্যাপার‚ আর একবারও
বলিসনি! সব নিজেরা খাবার মতলব? যা‚ ছাই খেগে এবার।’
‘ওঠাই বড্ড
ভুল হয়ে গেছে গো ঠাকুর। মুখ্যু মানুষ।’ বোমবাবার পায়ে দু’জন মাথা
ঠুকতে লাগল।
তাতে
কিছুটা যেন নরম হলেন তিনি। ‘মুখ্যু বলে মুখ্যু! ডাহা মুখ্যু
তোরা। শুধু মন্ত্র নয় রে। ছোঁড়ার কাছে আরো কিছু রয়েছে। ভাল করে খুঁজে দেখেছিলি?’
‘সে আর
খুঁজিনি ঠাকুর।’ মদন
ঠোঁট ওলটাল‚ ‘ছোঁড়ার পুঁটলি হাতড়ে দেখেছি।
কানাকড়িও নেই। ছেঁড়া গুটি কয়েক জামাকাপড় মাত্র।’
‘চোখের মাতা
খেইছিস!’ খেঁকিয়ে
উঠলেন বোমবাবা। ‘আমি
গেঁজেল বামুন। তাও নিজের চোখে দেখিছি ছোঁড়ার গলায় ঝুলছে দিব্যি
এক কানাকড়ি। আর বলছিস‚ কানাকড়ি নেই। এই চোখ নিয়ে ঠগের ব্যবসা
করতিস!’
‘হে–হে সে তো
কথার কথা ঠাকুর! আমার গলাতেও তো অমন এক ফুটো কড়ি রয়েছে। ছেলেবেলায় পেঁচোয় ধরেছিল
কিনা। শুকিয়ে আমসি হয়ে যাচ্ছিলুম। তাই গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল। এই দ্যাকো।’ বলতে বলতে
জামার তলা থেকে তেলচিটে সুতোয় ঝোলানো এক ফুটো কড়ি বের করল মদন।
বোমবাবা
তখন গাঁজায় দম দিতে ব্যস্ত। উত্তর এল না। কিন্তু বদনের মাথা ততক্ষণে খুলে গিয়েছে।
চট করে বোমবাবার পায়ের ধুলো মাথায় ঠেকিয়ে বলল‚ ‘ঠাকুর এই না
হলে গুরু মেনেছি তোমায়? ওফ‚ যা ভোগা খেয়েছি গতকাল! চল রে মদনা।’ বলে মুহূর্ত
মাত্র দেরি না করে ছুটল।
পিছনে
বোমবাবার হাঁক‚ ‘কাজ উদ্ধার হলে আমার ভাগটা মনে রাখিস কিন্তু।’
পয়লা
বৈশাখের দিন। মেলায় আজ বাড়াবাড়ি ভিড়। তিল ধারণের স্থান নেই। তার মধ্যে কাউকে খুঁজে
বের করা কী চাট্টিখানি কাজ? কিন্তু দুই মানিকজোড়ের অসাধ্য কিছু নেই। ঘণ্টা দুয়েকের
চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত নন্দর খোঁজ পাওয়া গেল। আর কপাল বলে একেই! নন্দর খোঁজ পাওয়া
গেল খোদ বুড়ি দয়াময়ী দাসীর কাছে। যাকে বলে কিনা‚ মেঘ না চাইতেই জল। এক ঢিলে দুই পাখি!
বুড়ি
দয়াময়ী দাসী যে মেলায় তীর্থ করতে এসেছে‚ সেই খবর
সকালে গোবিন্দ সামন্তই জানিয়েছিলেন। সেই বুড়ির
সঙ্গে এভাবে দেখা হবে‚ ভাবতেই পারেনি। গত কাল থেকে বুড়ি
ভিড়ে নাজেহাল অবস্থা। পুজো দেওয়া দূরের কথা‚ ভিড়ের চোটে
মন্দিরের কাছেও ঘেঁসতে পারেনি। হতাশ হয়ে আজ ফিরে যাবে কিনা ভাবছিলেন। হঠাৎ নন্দর
সঙ্গে দেখা। গোবিন্দ সামন্তর মা তারা ব্রহ্মময়ী হোটেলের পাশেই বুড়ির বাড়ি। সেই
দৌলতে পরিচয়। দেখা হতেই জড়িয়ে ধরে বলেছে‚ বাবা নন্দ‚ বুড়ি মানুষ‚ একা মেলায় এসে নাজেহাল হয়ে গেছি। বেজায় ভিড়ে
এখনো পুজোটাও দিতে পেলুমনি।
দয়াময়ী
দাসীকে এর বেশি কিছু আর বলতে হয়নি। নন্দ লেগে পড়েছে কাজে। দৌড়ঝাঁপ করে মন্দিরের এক
সেবায়েত ধরে কাছেই এক ঘরে বুড়িকে নিয়ে তুলেছে। পুজোর ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। বুড়ি
বেজায় খুশি। পুজো যখন হয়েই গেছে আজই ফিরে যাবার ইচ্ছা। বুড়ির সেই কথায় বদনের তো
মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়। ‘সে
কী বুড়িমা! আজ বছরের পয়লা দিন। এই বচ্ছরকার দিনে তীর্থস্থান ছেড়ে যাওয়া কী ভাল
কথা!’
‘তা ঠিক
বাপু।’ বুড়ি
মাথা নড়লেন‚ ‘নন্দরও সেই কথা। বলে‚ তীর্থে এলে
তিন রাত্তির থাকতে হয়। কিন্তু ওদিকে ফাঁকা ঘর রেখে এইছি। মন পড়ে রয়েছে।’
ইতিমধ্যে
বুড়ি ওদের ঘরে এনে বসিয়েছে। ভিতরে ঢুকে ওরা তো থ হবার জোগাড়। থরে থরে সাজানো গোটা
বিশেক মিষ্টির বাক্স আর হাঁড়ি। সব ‘মিরচিরাম’ আর ‘নবীন ময়রা’র দোকানের। বদন ঠোঁট
চেটে বলল‚ ‘এ যে কলকাতার মিষ্টি গো বুড়িমা!
এখানে পেলেন কোথায়?’
‘সে আর বলিনি
বাপু।’ একগাল
হেসে বুড়ি বললেন‚ ‘বিধবা মানুষ। কাল থেকে উপোস। নন্দকে
বলেছিলুম‚ চাট্টি দই–চিঁড়ের
ব্যবস্থা করতে। তা পাগল ছেলে এইসব নিয়ে এসেছে। তোরাই বল‚ এই বয়সে এত
খেতে পারি? ওদিকে
নন্দ মুখেও দেবে না। শুধু এক কথা‚ তোমার জন্য এনেছি বুড়িমা। খাই কী করে। তাই
পড়েই রয়েছে। তা ভালই হয়েছে বাবা। দেখা যখন হয়েছে‚ কিছু খেয়ে
যাও তোমরা। তবু কিছু কমবে।’
কলকাতার
এসব দোকানের মিষ্টির নামই শুনেছে ওরা। চেখে দেখার ভাগ্য হয়নি। তবু অতি কষ্টে জিব
সামলাতেই হল। হাতে সময় নেই। আগে নন্দর খোঁজ দরকার। বদন বলল‚ ‘সে হবে
বুড়িমা। মেলা সময় আছে। আজ বচ্ছরকার দিন। আমরাও পুজোটা দেব কিনা। তা
নন্দকে দেখছি না যে! সে কোথায়?’
‘আর বলিসনি
বাবা। পাগল ছেলে আমার। একবার শুধু বলেছিলাম‚ অবেলায় খেয়ে
কেমন অম্বলমতো হয়েছে। ব্যস‚
ছেলে ছুটেছে ডাক্তারের খোঁজে।’
‘আমরা তাহলে
পুজোর কাজটা সেরেই আসছি বুড়িমা। শুধু নন্দ কেন‚ আমরা কী
তোমার ছেলে নই? ঠাকুর দয়া করলে এই বচ্ছরকার দিনে মেঠাই আমরাও খাওয়াব তোমাকে।’ কথা শেষ করে
দু’জন
হন্তদন্ত হয়ে ছুটল।
নন্দকে
খুঁজে বের করতে দেরি হল না। মেলায় সরকারি চিকিৎসার ঠেক কোন দিকে জানা ছিল। সেই
দিকে ধাওয়া করতেই দেখা তার সঙ্গে। হাতে গোটা দুই ওষুধের শিশি আর পুরিয়া। ওরা
ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। ‘ভাইরে‚ কোথায় ছিলি তুই। সেই থেকে খুঁজে
খুঁজে হয়রান।’ কোঁচার
খুঁটে চোখ মুছল বদন।
‘আর বলো না
দাদা। ঠাকুরমশাই আজ সকালে হঠাৎ বিদেয় করে দিলেন যে। ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখা
বুড়িমা দয়াময়ী ঠাকরুনের সঙ্গে। চেন তো ওনাকে?’
‘খুব চিনি।’ বদন বলল‚ ‘আর বুড়িমার
সঙ্গে দেখাও হয়েছে। তাঁর কাছেই তো তোর খোঁজ পেলুম। তা হ্যাঁরে নন্দ‚ তোর গলার ওই
কড়িটা কী জন্য রে? সেই
থেকে দেখছি। ভাবি জিগ্যেস করব‚ তা মনেই থাকে না।’
‘গলার এই
কানাকড়ি!’ নন্দ
হেসে বলল‚ ‘সে এক কাণ্ড হয়েছিল গো দাদা। এক
সাধুবাবার ঝুলি থেকে পড়েছিল। তখন খুঁজে পাইনি অবশ্য। উনিও খোঁজ করেছিলেন। তারপর
যখন পেলাম‚ তিনি চলে গেছেন। সেই
থেকে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি। ওনার দেখা পেলেই ফিরিয়ে দেব।’
নন্দ
থামল। ততক্ষণে ইশারায় দুই মানিকজোড়ের শলাপরামর্শ সারা হয়ে গেছে। একটু পরে তিনজন
কথা বলতে বলতে বুড়ির আস্তানার দিকে রওনা হয়েছে। ভিড়ের ভিতর নন্দর গলার সেই কানাকড়ি
হঠাৎ কিসের খোঁচায় বেঁধে ছিঁড়ে পড়ল। মদন তৈরি হয়েই ছিল। তৎক্ষণাৎ হুমড়ি খেয়ে
কুড়িয়ে নিল সেটা। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে দিল নন্দর দিকে। ‘এই নে নন্দ‚ তোর গলার কানাকড়ি হঠাৎ ছিঁড়ে পড়েছিল।’ অবশ্য
ইতিমধ্যে যে আসল কাজ‚ অর্থাৎ নিজের
গলার কানাকড়ির সঙ্গে সেটা বদল হয়ে গেছে‚ টের পায়
সাধ্য কার।
গলার
কানাকড়ি ছিঁড়ে পড়েছে বুঝে নন্দ হাত বাড়িয়ে
সেটা নিয়ে ফের গলায় বাঁধছে‚ বদন বলল‚ ‘বুড়িমার
ওষুধ নিয়ে তুই এগো রে নন্দ। আমরা মন্দিরে পুজোটা দিয়েই আসছি।’
নন্দ
আপত্তি করল না। দুই মানিকজোড় দেরি না করে ছুটল মেলার এক কোনে খানিক নিরিবিলির
দিকে। কিন্তু পয়লা বৈশাখের দিনে সাতখালির গাজন মেলায় তেমন জায়গা খুঁজে বের করা কী
চাট্টিখানি কথা। চারদিক মানুষে ছয়লাপ। একবার ভেবেছিল গয়নার নৌকোয় ফিরে যায়
মহামায়াগঞ্জ। কিন্তু আগের দিনের কথা ভেবে ভরসা হল না। শেষে অনেক খুঁজে গোটা কয়েক
গাছের আড়ালে নিরিবিলি জায়গা একটু পাওয়া গেল। আড়ালে গিয়েই বদন সেই কানাকড়ি কপালে
ঠেকিয়ে বলল‚ ‘জয়গুরু‚ হাঁড়ি ভরতি
গজু ময়রার রাজভোগ আর রাবড়ি দাও গো কানাকড়িবাবা। বুড়ি দয়াময়ী দাসীকে খাওয়াব বলে কথা
দিয়ে এইচি।’
বদনের
মুখের কথা পড়তে পেল না। ঠকাস করে বাঘা সাইজের রাজভোগ আর সরেস রাবড়ি ভরতি দুটো হাঁড়ি
কোত্থেকে উড়ে এসে সামনে পড়ল।’
মার
দিয়া কেল্লা! যুদ্ধ জয়ের আনন্দে দুই মানিকজোড় তখন আত্মহারা। হাঁড়ি নিয়ে ছুটল বুড়ি
দয়াময়ী দাসীর উদ্দেশ্যে। দেখে বুড়ি তো হাঁ–হাঁ করে উঠলেন। ‘এ কী করেছিস
বাবারা! আগের মিষ্টিই যে এখনো খালি হয়নি!’
‘তাতে কী
বুড়িমা! আমরা গরীব মানুষ। তাই কলকাতার মিষ্টি আর আনতে পারলাম কোথায়? তবে জানই তো‚ আমাদের গজু ঘোষের মিষ্টিও কিছু খারাপ নয়।’
‘বেঁচে থাক
বাবারা।’ মদনের
কথায় আঁচলে চোখ মুছল বুড়ি। ‘তা থিতু হয়ে বোস দেখি। কিছু
খেয়ে যা। নন্দ তুইও খা। ওরা ভালবেসে এনেছে।’
‘খেপেছ
বুড়িমা।’ চোখ
কপালে তুলে দুই মানিকজোড় বলল‚ ‘হাতে সময় নেই একদম। মেলা কাজ। আর একদিন
হবে। বরং নন্দকে দাও। ছেলেমানুষ।’
নন্দ
ঘরেই ছিল। হাঁ করে দেখছিল সব। বলল‚ ‘তাহলে দাও
গো বুড়িমা। গজু ঘোষের মিষ্টি বদন আর মদনদা এই মেলায় আগেও খাইয়েছে। আহা‚ কী যে
আস্বাদ!’
গজু
ঘোষের সেই রাজভোগ আর রাবড়ির হাঁড়ি দেখতে দেখতে প্রায় অর্ধেক সাফ করে ফেলল নন্দ।
কিন্তু সেই দৃশ্য দেখার জন্য বদন আর মদন তখন সেখানে নেই। দৌড় লাগিয়েছে জেটিঘাটের
দিকে। লঞ্চ ধরে আজই পাড়ি দেবে মহামায়াগঞ্জ। ভাবনা নেই
আর।
মহামায়াগঞ্জে
পৌঁছোতে আজও বেশ রাত হয়ে গেল। বদন বলল‚ ‘চল‚ তোর ঠেকেই যাই আজ। রাত
হয়েছে। খিদেও পেয়েছে বেজায়।’
শুনে
মদন তো প্রায় আঁতকে উঠল‚ ‘খেপেছ বদনদা! ঘটা হালদার ওদিকে যে
গুলি পাকিয়ে বসে আছে‚ ভুলে গেলে!’
‘থাম দেখি।’ প্রায় তুড়ি
মেরে উড়িয়ে দিল বদন। ‘যে অস্ত্র এখন হাতে রয়েছে‚ ওসব ঘটৎকচ‚ কুম্ভকর্ণদের
কাত করতে দু’সেকেন্ডও
লাগবে না।’
যুক্তি
ফেলনা নয়। মদন তাই আর আপত্তি করল না। ঘরে ঢুকে মেঝেয় গ্যাঁট হয়ে বসে বদন বলল‚ ‘কী খাবি বল?’
মদন
মাথা চুলকে বলল‚ ‘কলকাতার ‘দ্বারিক ময়রা’র বরফি রাবড়ির
নামই শুনেছি বদনদা। কোনোদিন দেখার ভাগ্যি হয়নি। আজ রাতের
ভোজটা সেই রাবড়ি দিয়েই হয়ে যাক।’
বদন
কানাকড়ি হাতে নিয়ে সেই প্রার্থনাই জানল। মুখের কথা সরতে না সরতেই দু’হাড়ি রাবড়ি
উড়ে এসে পড়ল ওদের সামনে।
টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোয় সেই রাবড়ির দিকে
তাকিয়ে ওদের চোখ তো ঠিকরে পড়ার জোগাড়। কী তার রূপ!
কী গন্ধ! মুহূর্তমাত্র দেরি না করে যে যার হাঁড়িতে কবজি ডুবিয়ে এক খাবলা তুলে চালান
করে দিল মুখের ভিতর। আর তারপরেই প্রায় বজ্রাঘাত।
‘ওয়াক’ করে বেজায়
এক হেঁচকি তুলে বদন ব্যাপারী এক তুড়ুক লাফে উঠে গেল হাত কয়েক উঁচুতে। তারপর
ধপাস করে নীচে পড়েই হাইমাই চিৎকার‚ ‘বাবাগো! কী
তেতো! কী তেতো! ওয়াক্–থুঃ—থুঃ।
স্রেফ কুইনিন আর চিরতা রে! মদন‚ জল
আন শিগগির। মরে গেলুম।’
কিন্তু মদন জল আনবে কী। সে ততক্ষণে ‘দাদা গো! কী
ঝাল! কী ঝাল! জ্বলে গেল সব! জ্বলে গেল! জল—জল।’ বলে কানে হাত দিয়ে হাত কয়েক দূরে
ঠিকরে পড়েই হাহাকার জুড়ে দিয়েছে। তারপর মস্ত জিব বের করে সমানে ‘হুস–হাস’ শব্দ। রাবড়ি
তো নয়‚ যেন হাঁড়ি ভরতি কেজি কয়েক ধানিলঙ্কা
বাটা।
সেই
ভয়ানক কাণ্ড বদন আর মদনের মতো দুই ঝানু ওস্তাদেরও পক্ষেও সামলে ওঠা সহজ হল না।
দু’জন তখনো হাঁড়ির সামনে থম হয়ে বসে আছে‚ দরজা ঠেলে
ভিতরে ঢুকলেন ঘটৎকচ হালদার।
‘বাহ্‚ তোরা আইয়া গেছস দেহি! তা ভাবস না‚ আমিও রেডি হইয়া…।’ বলতে বলতে থেমে গেলেন তিনি। চোখ দুটো
জুলজুল করে উঠল। হাতের আস্তিন গোটাতে গিয়েও ফের নামিয়ে দিলেন‚ ‘হাঁড়িতে কী আনছস
রে? অ্যাঁ‚ কলিকাতার
মেঠাই!’
তাড়াতাড়িতে
দরজার খিল দেওয়া হয়নি। কিন্তু চোখের সামনে ঘটৎকচ হালদারকে ঘরে ঢুকতে দেখেও দুই
মানিকজোড়ের শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে রইল ফ্যাল ফ্যাল
করে। ওদিকে ঘটৎকচ হালদার ততক্ষণে এগিয়ে এসে রাবড়ির হাঁড়ির উপর হামলে পড়েছেন। ওদের
চোখের সামনেই দুই মিনিটে দুটো হাঁড়ি সাফ হয়ে গেল। তারপর
বেজায় খুশি হয়ে একগাল হেসে বললেন‚ ‘আজ বেড়ে খাওয়াইলি রে! জয়জয়কার হোউক
তগো। এমন মাঝেমধ্যে যদি খাওয়াস‚ বকেয়া ভাড়া
আর দিতে লাগব না।’
হাঁ
করে দেখছিল মদন। হাত চাটতে চাটতে ঘটৎকচ হালদার বিদায়
নিতে ঢোঁক গিলে চিঁচিঁ করে বলল‚ ‘এটা কেমন হল বদনদা? মাথায় যে
কিছুই ঢুকছে না গো!’
উঠে
গিয়ে কলসি থেকে অনেকটা জল ঢেলে কুলি করল বদন। মুখটা কিছু সাফ হতে ক্রমে মাথাটাও
যেন সাফ হয়ে আসছিল। বার কয়েক ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলল‚ ‘আমারই কী
কিছু ঢুকছিল রে। তবে ধন্দটা এখন যেন কিছুটা সাফ হচ্ছে।’
‘কী বদনদা?’
‘কানাকড়ির
গুন আছে বটে‚ কিন্তু তাতে মালিকের ফয়দা নেই রে।
নন্দ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খেটে খেত কী আর অমনি? কদিন স্রেফ আহাম্মুকের মত দৌড়দৌড়ি হল।’
‘তাহলে ওই
কানাকড়ি ভোগে লাগবে না! হায় হায়!’ হতাশায় কপাল চাপড়াল মদন।
‘হবে রে বাপু‚ হবে।’ বদন ভরসা দিল। ‘বোকা নন্দটা
বিনে পয়সায় ভোজ দিয়ে বদনাম কুড়িয়েছে। আমরা তা
করতে যাব কোন দুঃখে?
চল গোবিন্দ সামন্তকে আগে একটু তোয়াজ করে আসি। দলিল চুরির কাজে আজ আর সিঁদেল
লাগানো গেল না। জানতে পারলে অনর্থ করবে।’
(৬)
মা
তারা ব্রহ্মময়ী হোটেল রাত দুপুর পর্যন্ত খোলা থাকে। দু’জন যখন
পৌঁছল ঘরদোর সাফ করে কর্মচারীরা শুয়ে পড়লেও গোবিন্দ সামন্ত যথাস্থানে বসে নতুন
খাতার হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। ওদের দেখেই একগাল হেসে বলল‚ ‘কীরে সিঁদেল
এনে লাগিয়ে দিয়েছিস তো?
দলিল কিন্তু আজই চাই। খোঁজ নিয়েছি‚
বুড়ি আজও ফেরেনি।’
‘সে হবে এখন মহাজনকাকা। বুড়িকে
নিয়ে চিন্তা নেই। সাতখালির গাজন মেলায় তার ব্যবস্থা করে এসেছি। হাজার হোক তীর্থস্থান বলে কথা।
তেরাত্তির না গেলে বুড়ি এদিকে পা মাড়াচ্ছে না। সবে তো আজ দু’রাত্তির।’
‘এই রাত
দুপুরে সেই খবর দিতে এলি!’
ব্যাজার হয়ে গোবিন্দ সামন্ত বললেন।
‘না গো কাকা। আরো
বড় খবর রয়েছে। তাই বলতেই তো এই রাতে ছুটে এলাম।’
‘কী খবর রে?’ মদনের কথায়
চোখ জুলজুল করে উঠল গোবিন্দ সামন্তর।
‘নন্দকে নিয়ে
সেই ধন্দ এতদিনে খোলসা করা গেছে। সে দারুণ
জিনিস কাকা। যা চাইবে শুধু বললেই হল। আকাশ ফুঁড়ে
সামনে এসে পড়বে।’ বলতে
বলতে মদনের গলা থেকে সুতো বাঁধা ফুটো কড়ি খুলে হাতে নিল বদন। দু’চার কথায় সব
ব্যক্ত করে হাতের মুঠোয় সেই কানাকড়ি নিয়ে বলল‚ ‘এবার কী চাও
বল। শুধু মুখের কথা সরার অপেক্ষা। বচ্ছরকার
দিন। কলকাতার ‘মিরচিরাম’–এর সেরা জাফরান লাড্ডু খাও বরং। চাইলেই হাঁড়ি ভরতি হয়ে
উড়ে আসবে’
‘থাম দেখি
বাপু।’ খেঁকিয়ে
উঠলেন গোবিন্দ সামন্ত‚ ‘লাড্ডু পরে হবে। আগে
বুড়ির দলিলটা বাগিয়ে আন দেখি। বচ্ছরকার পয়লা দিন। একটু শান্তিতে ঘুমোই।’
ধমক
খেয়ে বদন একটু দমে গেল। তারপর কানাকড়ি কপালে ঠেকিয়ে বলল‚ ‘জয়গুরু‚ বুড়ি দয়াময়ী
দাসীর জমির দলিলটা এনে দাও গো কানাকড়িবাবা। মহাজনকাকার বেজায় দরকার।’
বদনের
মুখের কথা সবে খসেছে। জুলজুল চোখে তাকিয়ে ছিল গোবিন্দ সামন্ত। ‘বাপরে’ বলে লাফিয়ে
উঠে দু’হাতে
সারা শরীর চুলকোতে শুরু করলেন। ব্যাপারটা
কী হল বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল মদন। হঠাৎ
লাফিয়ে উঠল সেও। কাতরাতে কাতরাতে বলল‚ ‘ও বদনদা‚ এত জলবিছুটি
কোথা থেকে এল! মরে গেলাম যে।’
কিন্তু
জবাব দেবে কে? ততক্ষণে বদনের সারা গায়েও ভয়ানক চুলকুনি শুরু হয়ে গেছে। আর ওদিকে
গোবিন্দ সামন্ত তো সারা হোটেলঘর জুড়ে চেয়ার টেবিল উলটে দাপাদাপি জুড়ে দিয়েছেন। সাথে
পরিত্রাহি চিৎকার‚ ‘জলবিছুটিতে মরে গেলাম গো। বাঁচাও‚ কে আছো।’
রাত
দুপুরে গোবিন্দ সামন্তর হোটেলঘরে তারপর সে এক ভয়ানক অবস্থা। দারুণ চুলকুনির চোটে
শুধু গোবিন্দ সামন্তই নয়‚ লাফালাফি জুড়েছে বদন আর মদনও। যাকে
বলে দক্ষযজ্ঞ। বদন আর মদনের চুলকুনি তবু কিছু কম।
কিন্তু হোটেলের জনা দশেক কর্মচারীও তাদের মালিককে সামলাতে পারছে না।
রাত
ভোর হল ওই ভাবে। গোবিন্দ সামন্ত পয়সাওয়ালা মানুষ। সকালের
ট্রেনেই বাড়ির লোক তাকে নিয়ে ছুটল কলকাতার দিকে। বড়
ডাক্তার দেখানো হবে। বদন আর মদনের সেই উপায় নেই। দু’জন অগত্যা ছুটল
সেই গাজনের মেলার দিকে। নন্দর খোঁজ যখন পেল‚ সে তখন
ফুরফুরে হয়ে দয়াময়ী দাসীকে নিয়ে সার্কাস দেখে ফিরছে। বুড়ির হঠাৎ বাঘ–সিঙ্গির
সার্কাস দেখার শখ হয়েছিল। ওরা ছুটে গিয়ে তার পায়ের কাছে হুমড়ি
খেয়ে পড়ল। ‘নন্দভাই
বাঁচাও। চুলকুনির চোটে মরে গেলাম যে!’
ওদের
ওই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল নন্দও। উসকো খুসকো চুল। সারা গায়ে চুলকুনির দাগ।
বিধ্বস্ত অবস্থা। ভয়ে ভয়ে বলল‚ ‘কী হয়েছে গো দাদা?’
‘আর বলিসনি
ভাই।’
দু’জন
প্রায় হাহাকার করে উঠল‚ ‘তোর সেই কানাকড়ি আমাদের কানাকড়ি
কাজেও লাগেনি রে! মতিভ্রম হয়েছিল। তাই ফের ছুটে এলাম তোর কাছে। ক্ষমা করে দে ভাই।
রাগ করিসনি।’
গতকাল
ভিড়ের ভিতর মদন যখন ওর গলার কানাকড়ি হাতসাফাই করে নেয়‚ তখন নন্দ টের পায়নি এমন নয়। কিন্তু গ্রাহ্য করেনি। এবার
বলল‚ ‘দাদাগো‚ ওই
কানাকড়ির বেজায় গুন ঠিকই। কিন্তু নিজের কানাকড়ি কাজেও লাগাবার উপায় নেই। কিন্তু তাই
বলে এমন তো হবার কথা নয়! কারো অনিষ্ট করতে চাওনি তো?’
দু’জনের মুখে আর
কথা নেই। তাকিয়ে রইল হাঁ করে। নন্দ বলল‚ ‘ওই জন্যই এই
শাস্তি।’
দুই
মানিকজোড় ককিয়ে উঠল এরপর‚ ‘আমরা নিজের ইচ্ছেয় চাইনি রে। ওই
শয়তান গোবিন্দ সামন্ত। সে তো চিকিৎসা করাতে কলকাতা চলে
গেল। আমাদের কী হবে রে? তোর কানাকড়ি ফিরিয়ে নে নন্দ। রক্ষে
দে এবার।’
‘তা হয় না গো
দাদা।’ নন্দ
বলল‚ ‘নিয়েছ যখন‚ ও কানাকড়ি এখন তোমাদের সম্পত্তি। রাখতে
না চাও‚ বোমশঙ্কর ঠাকুরকে দিয়ে দিও বরং। খানিক
আগে উনিও কানাকড়ির খোঁজ করতে এসেছিলেন। সব শুনে বেজায় খেপে গেছেন তোমাদের উপর।
হাজার হোক সাধু মানুষ। ওই কানাকড়ি ওনাদের কাছে থাকাই ভাল। আমাদের কাছে রাখা খুব
সহজ ব্যাপার নয়।’
সহজ
যে নয়‚ সেটা ইতিমধ্যে হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে দুই
মানিকজোড়। কোনো কথা না বলে তাকিয়ে রইল হাঁ করে। নন্দ বলল‚ ‘স্বয়ং সেই সাধুবাবাকেও দেখেছিলাম ঢাউস ঝুলি নদীতে ছুঁড়ে
ফেলে দিতে। ছেঁড়া কাঁথার ঝুলি! তবু কী ভয়ানক তেজ
গো তার! সেই ঝুলি থেকেই তো পড়েছিল ওই কানাকড়ি। তেজ টের পেয়েছিলাম কয়েক দিনের
মধ্যেই।’
নন্দকে নিয়ে ধন্দ মিটতে এরপর বাকি থাকেনি দুই মানিকজোড়ের।
ওর গলা জড়িয়ে ধরে দু’জন কেঁদে উঠেছিল ভেউভেউ করে। ‘তাই হবে রে নন্দ। কানাকড়ি
আজই বোমবাবার হাতে তুলে দিয়ে যাব। কিন্তু এই
চুলকুনির কী হবে রে? মরে গেলুম যে! পয়সাও নেই যে‚ কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যাব। হায় হায়!’
‘সারবে দাদা।
নিজের ইচ্ছায় যখন অনিষ্ট করতে চাওনি‚ তখন নিশ্চয়
ভাল হয়ে উঠবে। আর মনটাও বড় ভাল গো তোমাদের। গজু
ঘোষের মেঠাই চোখে তো কম দেখিনি। তোমরাই প্রথম খাওয়ালে সেদিন। ঠাকুর
দয়া করবেন নিশ্চয়।’ নন্দর দু’চোখ ছলছল
করে উঠল।
নন্দর
গল্প খুব বেশি আর বাকি নেই। সংক্ষেপেই বলি। মহামায়াগঞ্জ ফিরে এরপর ওর ঠাঁই হয়েছিল
বুড়িমা দয়াময়ী দাসীর কাছে। নিজের ছেলের মতোই। শুধু
তাই নয়‚ এর পর ঘটে গেছে আরও অনেক ব্যাপার।
নন্দর কথামতো
বদন আর মদনের চুলকুনি কিছুদিনের মধ্যে সেরে গেলেও গোবিন্দ সামন্তর তেমন উন্নতি
আর হয়নি। পয়সাওয়ালা মানুষ। চিকিৎসা কম হয়নি। কিন্তু উপকার মেলেনি। এরপর
আর এক বিপদ। চুলকুনির সঙ্গে সারা গায়ে ঘা আর পাঁচড়া। এমন মানুষের হোটেলে কে খেতে
আসে? শেষে জলের দরে হোটেল বেচে দিয়ে দেশে ফিরে গেছেন। সেই
হোটেল কিনেছেন বুড়ি দয়াময়ী দাসী। বলতে গেলে‚ মা
তারা ব্রহ্মময়ী হোটেলের মালিক এখন নন্দ। তবে বদলায়নি একটুও। সেই আগের মতোই
সাদাসিধে সহজ মানুষ। দেশের বাড়ি থেকে সবাইকে নিজের কাছে
নিয়ে এসেছে। ভাই–বোন দুটি ভরতি হয়েছে স্কুলে। এখন দুই বুড়িকে নিয়ে কদিন পরে পরেই
তীর্থে বের হয়ে পড়ে। বেশ আছে ও। দয়াময়ী দাসী ঠিক করেছেন‚ আর কদিন গেলে ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন।
ওদিকে
মা তারা ব্রহ্মময়ী হোটেলের দায়িত্ব এখন বদন আর মদনের উপর। গাজনের মেলায় সেই যে ওরা
দয়াময়ী দাসীকে হাঁড়ি ভরতি মিষ্টি দিয়ে গিয়েছিল‚ তাতে বেজায় খুশি হয়েছিলেন তিনি। তারপর
নন্দ যখন প্রস্তাবটা দেয়‚ বুড়ি এক
কথায় রাজি। এমন সৌভাগ্য হবে‚ দু’জন স্বপ্নেও ভাবেনি। দুই
মানিকজোড় মন দিয়ে হোটেল চালাচ্ছে এখন। নাক–কান মলে শপথ নিয়েছে‚ অসৎ পথ আর মাড়াবে না কেউ।
কথামতো
সেই কানাকড়ি গাজনের মেলাতেই ওরা বোমবাবার হাতে তুলে দিয়েছিল। বেজায় খুশি হয়েছিলেন
তিনিও। কিন্তু ফল নাকি মোটেই ভাল হয়নি। মন্দিরে পুরোহিতের কাজটা গেছে। এখন বদ্ধ
উন্মাদ। সেই কানাকড়িরও খোঁজ নেই।
ছবি:
প্রকাশ গুপ্ত
Words: 8870
বাহ, খুব ই সুন্দর
ReplyDeletedarun
ReplyDeleteei uponyas ta boi akare Prakash r kotha bhabte paren,amar prothombar poreo besh bhalo legechilo
ReplyDeleteDarun...darun...
ReplyDeletedurdanto!
ReplyDeletechhobir moto lekha!
ReplyDeleteঅপূর্ব
ReplyDeleteদারুণ।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো
ReplyDelete