বুড়ির ডাবরির
ব্যাঘ্র রহস্য
শিশির
বিশ্বাস
‘সুন্দরবনে বেড়াতে গেছি বহুবার। ঘটনা কম ঘটেনি। একবার তো চামটা ব্লকের অনেক
ভিতরে ঢুকে পড়েছি। দিন তিনেক ঘোরা হয়ে গেছে‚ অথচ বাঘের দেখা নেই। অনেকেই মন খারাপ। সেদিন বিকেলের দিকে সরু
এক খালে ভটভটি ঢোকানো হয়েছে। এমন সময়...।’
বিনুমামার
গল্প মানেই‚ আমাদের নিশ্বাস প্রায় বন্ধ। সম্ভবত সেই
কারণে সামনে শ্রোতাদের কথা ভেবে মাঝেমধ্যেই থেমে পড়েন হঠাৎ। কিন্তু আমাদের কাছে
কখনও সেটা বড়ো ভয়ানক হয়ে ওঠে। প্রায় রুদ্ধশ্বাসে পুপুল বলল‚ ‘কী মামা? বাঘ?’
‘বাঘ তো বটেই। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা‚ অধিকাংশ সময় সুন্দরবনে বাঘের দেখা মেলে
মাত্র কয়েক সেকেন্ড বা বড়জোর কয়েক মিনিটের জন্য। মানুষের সাড়া পেলেই সরে পড়ে।
একবার তো বেজায় বড় এক কেঁদো বাঘ জঙ্গল থেকে বের হয়ে সবে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
সম্ভবত জল খাবে‚ নয়তো নদী পার হবার ইচ্ছে। ভটভটির বেজায় আওয়াজেও নড়েনি। কিন্তু আমাদের
একজনের চোখে পড়তে যেই সে বাঘ–বাঘ বলে চেঁচিয়ে উঠেছে‚ বেচারা পড়ি কী মরি করে পিছন ফিরে বনবাদাড়
ফুঁড়ে ভোঁ দৌড়। কিন্তু সেবারের সেই বাঘ ছিল একেবারেই অন্য রকম। ওই অবস্থায় আমাদের
ভটভটির ইঞ্জিন তখন ফুল স্পীডে। তবু নদীর
পাড়ে গাছপালার ফাঁকে মাঝে মধ্যেই তাকে দেখা যাচ্ছিল। বরাবরই একজন অভিজ্ঞ বাউলে
আমাদের সঙ্গে থাকেন। ব্যাপার দেখে তিনি মত প্রকাশ করলেন‚ বাঘটা আমাদের পিছু নিয়েছে। মতলব ভাল নয়।
এদিকে বিকেল তখন মরে আসছে। সরু খাল। বাঘ ইচ্ছে করলেই নৌকোয় লাফিয়ে পড়তে পারে। অনেক
মানুষ রয়েছে বলেই সাহস পাচ্ছে না।’
‘তারপর?’ এবার আর আমরা কেউ নই। বিনুমামা সামান্য
থামতেই রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলেন মা নিজেই।
‘সেকথা বিস্তারিত বলতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে রে। আসলে সেদিন সেই বাঘের হাত
থেকে রেহাই পেতে রীতিমতো কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। আজ থাক বরং। পরে কোনও এক দিন হবে।
শুধু জানিয়ে রাখি‚ সেবার যারা বেড়াতে গিয়েছিল‚ তাদের অনেকেই পরে আর সুন্দরবন যাবার কথা মুখেও আনেনি। সখ করে বাঘ
দেখতে এসে অমন বিপদে কে আর পড়তে চায়!’
‘বা রে!’ মুখ গোমড়া করে পুপুল বলল‚ ‘তাহলে আজকের গল্প?’
বিনুমামার
দেখা বাড়িতে কালেভদ্রে মেলে। আর এলেই সেই রাতে একটা গল্প অন্তত বাঁধা। পুপুলের মুখ
গোমড়া হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু মামা নিরাশ না করে বললেন‚ ‘কী মুশকিল! গল্প বলব বলেই তো সুন্দরবনের
প্রসঙ্গ তুললাম। এটাও যে সুন্দরবনের গল্প। বুড়ির ডাবরিতে সেবার ভয়ানক এক কাণ্ড
হয়েছিল। মদন‚ মানে আমাদের নৌকোর বরাবরের রাঁধুনি সেই থেকে
আর সুন্দরবনে যায় না।’
‘বুড়ির ডাবরি সুন্দরবনে বুঝি?’ পুপুল বলল।
‘একদম। সুন্দরবনের পূব দিকে বাংলাদেশের লাগোয়া। সম্প্রতি নতুন ওয়াচ টাওয়ার
হয়েছে বনের অনেকটা গভীরে। উপরে উঠলেই রায়মঙ্গল নদীর ওপারে বাংলাদেশ। বনদপ্তরের
অফিস‚ গার্ড থাকায় নিরাপদও বটে। তবে এ গল্প যে সময়ের তখন বুড়ির ডাবরি ছিল
একেবারেই অন্যরকম। গরান কাঠের জেটির অদূরে কাঠের নড়বড়ে এক ওয়াচ টাওয়ার। পাশে
পুকুরটা অবশ্য ছিল। কিন্তু বনদপ্তরের কোনও অফিস বা নিদেন পক্ষে অ্যাকমডেশন বোট‚ কিছুই ছিল না। ওয়াচ টাওয়ারে যেতে হলে
রীতিমতো বুকের পাটার দরকার হত। তবে আমাদের সঙ্গে অভিজ্ঞ বাওয়ালি থাকত। সুন্দরবনের
নাড়ি–নক্ষত্র নখদর্পণে। মাঝিরাও অভিজ্ঞ। আর আমরা যারা তখন প্রায়
প্রতিবছর সুন্দরবনে বেড়াতে যেতাম‚ সাহস তাদেরও কিছু কম ছিল না। আসলে সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়া
আমাদের কাছে তখন এক দারুণ অ্যাডভেঞ্চার।
ভটভটি
নৌকোয় অন্তত দিন ছয়েকের ট্যুর। খাওয়ার অসুবিধা না হলেও ছিল অন্য অনেক সমস্যা। তাই
লোক নেওয়া হত বাছাই করে। তাদের বেশিরভাগই পুরোনো। তা সেবার নতুন বলতে ছিল গণেশ বোস‚
মানে আমাদের গণেশদা। নাদুসনুদুস চেহারার গণেশদা পয়সাওয়ালা মানুষ। পৈতৃক বড় ব্যবসা।
গোটা কয়েক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। সবাই খাতির করে। পৈতৃক ব্যবসা সামলাবার ফাঁকে
গণেশদার ছবি তোলার বাতিক ছিল। দামি ক্যামেরা নিয়ে যখন তখন বেরিয়ে পড়তেন। তবে
সুন্দরবনের দিকে কখনও যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেননি। সেবারই ব্যতিক্রম।
বাজারে
সবে তখন ভিডিও ক্যামেরা এসেছে। গণেশদা কিনে ফেললেন একটা। তারপরেই বায়না ধরলেন‚ আমাদের সঙ্গে সুন্দরবন বেড়াতে যাবেন।
গণেশদাকে সঙ্গে নিতে অবশ্য আপত্তি ছিল অনেকেরই। দিন সাতেকের ট্যুর। গণেশদার মতো
মানুষ অত দিন ধৈর্য রাখতে পারবেন না। শেষে হয়তো
ট্যুর কাটছাঁট করে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু উনি নাছোড়। আর মোটা ডোনেশন দেবেন শুনে
উদ্যোক্তারাও আর ঘাঁটায়নি।
এখানে
বলে রাখি‚ আমাদের কাছে হরেক গল্প শুনে গণেশদার তখন ধারণা হয়ে গেছে‚ সুন্দরবনে গেলেই বাঘের জম্পেশ ভিডিও তুলে
আনতে পারবেন। ক্লাবের সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবেন।
যাই
হোক‚ গণেশদা কিন্তু
মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছিলেন। নানা অসুবিধা স্বত্বেও কখনও উষ্মা প্রকাশ করেননি। তবে
অন্য এক ব্যাপারে কিছু সমস্যা হয়েছিল। আমাদের
ভটভটির ছাদে সারেংয়ের খোপের পিছনেই ছিমছাম ছোট এক কেবিন ছিল। জনা তিনেক শোওয়া যায়।
স্বভাবতই এই কেবিনের দিকে সবার লোভ থাকত। তাই পালা করে শোবার ব্যবস্থা হত। সেবার
ঠিক হয়েছিল‚ গনেশদাই শোবেন ওই কেবিনে। সঙ্গে প্রতি রাতে পালা করে অন্য কেউ। কিন্তু দুই
রাত কাটতে না কাটতেই দেখা গেল কেউ আর কেবিনে গণেশদার সঙ্গে রাতে শুতে চাইছে না।
বরাবর যে কেবিনে শোবার জন্য রীতিমতো মনকষাকষি হয়ে যায়‚ সেখানে এবার শোবার লোক নেই! তাতে শোয়ার
ব্যাপারে আমাদের বেজায় সমস্যা হলেও গণেশদার সুবিধেই হয়েছিল। ভটভটি নৌকোয় সুন্দরবন
বেড়াতে এসে সবচাইতে বড় যে সমস্যা‚ তাতে পড়তে হয়নি তাঁকে। কয়টা দিন বেশ ফুরফুরে মেজাজেই
কাটিয়েছেন। শুধু দিন ফুরিয়ে আসতে থাকায় তাঁর উৎকণ্ঠা বাড়ছিল। এ
পর্যন্ত যথেষ্ট সংখ্যায় হরিণ‚ গোটা দুই কুমির‚ এমন কী প্রায় জলহস্তীর মতো এক জাঁদরেল শূকর নজরে এলেও তখনও বাঘের দেখা
মেলেনি। তাতে কয়েকজনের কাছে দরবারও করে গেছেন‚ ট্যুরের সময়সীমা আরও দু’এক দিন বাড়িয়ে দেওয়া যায় কিনা। এই সময় ব্যাপারটা ঘটল।
সেটা
ফেরার আগের রাত। ঠিক ছিল এই রাতটা বুড়ির ডাবড়ির ওয়াচ টাওয়ারে কাটানো হবে। এর আগে
নেতিধোপানীর টাওয়ারেও রাত কাটিয়েছি। কিন্তু বুড়িরডাবড়িতে সেই প্রথম। আগেই বলেছি‚ বুড়ির ডাবড়ির ওয়াচ টাওয়ারে ব্যবস্থা বলতে
তখন কিছুই ছিল না। নীচে সিঁড়ির মুখে কাঠের পলকা একটা গেট। এছাড়া
নিরাপত্তা বলতে তেমন কিছুই নেই। অথচ পুকুরে চারপাশে বাঘের পাগ-মার্ক অর্থাৎ পায়ের
দাগ প্রচুর। তার কতক একদম টাটকা। বুঝতে অসুবিধা হয় না‚ বাঘ নিয়মিতই আসে জল খেতে। তবে পূর্ণিমার
লাগোয়া চাঁদনি রাত‚ আর অভিজ্ঞতায় বেশ জানতাম‚ টাওয়ারে এতগুলো লোক যখন রয়েছি‚ বাঘ এলেও জল খেয়েই বিদায় নেবে। অন্য মতলব
করতে সাহস পাবে না।
যাই
হোক গণেশদার মতো সৌখিন মানুষও যে টাওয়ারে রাত কাটাতে রাজি হবে ভাবিনি। কিন্তু
বাঘের ছবি তোলার জন্য তিনি তখন মরিয়া। এদিকে নড়বড়ে টাওয়ার। গণেশদার মতো মানুষ
টাওয়ারে উঠলে জনা ছয়েকের বেশি জায়গা হবে না। ভেবেছিলাম‚ টাওয়ারে থাকার জন্য লোক বাছতে বেশ বেগ পেতে
হবে। কিন্তু অবাক কাণ্ড‚ গনেশদা টাওয়ারে থাকবেন শুনে একে একে অনেকেই জানিয়ে দিল‚ তারা রাতে নৌকোতেই থাকবে। ঝামেলা তাই সহজেই
মিটে গিয়েছিল। সন্ধেয় প্রায় ভুরিভোজের ব্যবস্থা। গণেশদার খরচে এক জেলেনৌকো থেকে
সদ্য ধরা বড় এক ভেটকি আর বাঘা সাইজের চাপড়া চিংড়ি নেওয়া হয়েছিল। রাধুনি
মদন রান্নাও করেছিল চমৎকার।
খাওয়াদাওয়া
শেষ করে আমরা জনা ছয়েক মানুষ উঠে পড়লাম টাওয়ারে। সঙ্গী বাউলে উঠিয়ে দিতে
এসেছিল। ঠিক ছিল তিনিও থাকবেন। কিন্তু
নড়বড়ে টাওয়ার সামান্য নড়াচড়াতেই যেভাবে মচমচ করছিল‚ ভার কমাতে তিনি খানিক পরে নৌকোয় চলে গেলেন। ভরসা দিয়ে গেলেন‚ ভটভটি কাছেই‚ সবাই যখন জেগেই
থাকবে‚ চিন্তার কিছু নেই।
টাওয়ার
জেটি থেকে মাত্র মিনিট খানেকের পথ। কাছেই নৌকো নোঙর করা। সামনে গোটা কয়েক চারা
গরান গাছের আড়াল থাকায় দেখা না গেলেও কথাবার্তা সবই শোনা যায়। তাই তেমন চিন্তার
কারণ নেই বুঝে আমরাও আপত্তি করলাম না। কিন্তু অন্য এক ব্যাপার হয়ে গেল। বাউলে চলে
যাবার পরে আমরা সবাই টাওয়ারে ভিতর ছোট খুপরি ঘরে নিঃশব্দে বসে রয়েছি। ইতিমধ্যে
অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। কৃষ্ণ
পক্ষের ত্রয়োদশী। অল্প পরেই বড় চাঁদ উঠবে। চারপাশটা তখন পরিষ্কার হয়ে যাবে। গণেশদা
ক্যামেরা হাতে নিয়ে বসে আছেন। বাঘ এলে যেন মিস না হয়। হঠাৎ নীচে টাওয়ারের সিঁড়ির
গেটে খুট করে শব্দ। চমকে তাকিয়েছি। অন্ধকারে এক গাল দাঁত বের করে হাজির হল মদন। আগেই
বলেছি‚ মদন আমাদের নৌকোর রাঁধুনি। ক্যানিংয়ের ওদিকে বাড়ি। চমৎকার
রান্নার হাত। তাই বরাবর নেওয়া হয়। সেই কারণে
সুন্দরবন সম্বন্ধে বেশ ওয়াকিবহাল। গর্বও আছে
সেজন্য। তার উপর খানিকটা বেপরোয়া গোছের মানুষ।
মদনকে
ওই অবস্থায় দেখে সবাই যখন হাঁ–হাঁ করে উঠেছি‚ সে একগাল হেসে বলল‚ ‘আমার মন বলতেচে‚ আজ রাতে বাঘের দেখা মিলবেই। তাই বাউলে নৌকোয় ফিরে যেতেই এক
ফাঁকে নেমে এইচি।’
জেটি
থেকে পথ বেশি নয় ঠিকই। কিন্তু এই অন্ধকারে কাউকে না জানিয়ে এভাবে একা চলে আসা যে
ভয়ানক ঝুঁকির কাজ হয়েছে‚ তাতে সন্দেহ নেই। সেকথা বলতে মদন পাত্তাই দিল না। ঘাড় ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিল‚ ‘থামেন দেখি। এতদিন সুন্দরবনে আসতিচি‚ আমারে বাঘের ভয় দেখাচ্ছেন!’
ব্যাপার
দেখে আমরা আর তাকে ঘাঁটাইনি। ভিতরে জায়গা কম দেখে মদন অবশ্য বাইরে সিঁড়িতেই বসতে
চেয়েছিল‚ কিন্তু আমরা সরে ভিতরে জায়গা করে দিলাম।
কী
বলব! সারা রাত ঠায় বসে থাকাই সার হল। বাঘ তো ছার‚ একটা হরিণের দেখাও পাওয়া গেল না। এভাবেই সকাল হল এক সময়। বেজায়
বিরক্ত গণেশদা হাতের ক্যামেরা ব্যাগে ভরে বললেন‚ ‘তোদের কথায় নেচে আজ রাতে ভালই ভোগান্তি হল!
নৌকোয় থাকলে তবু একটু ঘুমোনো যেত।’
আমাদের
কারো মুখেই কথা নেই। এর আগে নেতিধোপানীর টাওয়ারে রাত কাটিয়েছি। কখনও এমন ফাঁকা
যায়নি। অন্তত হরিণ বা শূকর দেখা গেছে। সবাই চুপ করে আছি‚ গণেশদা বললেন‚ ‘শরীরটা আর দিচ্ছে না রে। একটু গড়িয়ে নেই
বরং।’
সবে
সামান্য আলো ফুটেছে। নৌকোর দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। সবাই ঘুমোচ্ছে। নিরাপত্তার
কারণে নৌকো জেটি থেকে অল্প সরিয়ে নোঙর করা। তাই ইচ্ছে থাকলেও নৌকোয় ফিরে যাওয়া
মুশকিল। আমরা তাই আর কিছু বললাম না। গণেশদাও দেরি না করে মেঝেতে চিৎপাত হয়ে শুয়ে
পড়লেন। দেখে মদনও উঠে দাঁড়িয়ে বলল‚ ‘তাহলে আমিও এই ফাঁকে একটু গড়িয়ে নেই।’
গণেশদা
শুয়ে পড়তে টাওয়ারের খুপরি ঘরের মেঝেতে আর চিলতে জায়গাও নেই। একজন অবাক হয়ে বলল‚ ‘এখানে শুবি কী রে! জায়গা কোথায়?’
‘কেন! সিঁড়ির নীচে।’ মদন মেদ্দা সুন্দরবনে তো আর নতুন
মানুষ নয়।’ বলতে বলতে মদন গটমট করে সিঁড়ির মুখে সেই পলকা গেটের পাশে চিলতে চাতালের
উপর শুয়ে পড়ল।
আমরা
কয়েকজন নিঃশব্দে বসে আছি ভটভটির দিকে থেকে কারো গলার শব্দ শোনা যায় কিনা সেই
অপেক্ষায়। তেমন হলেই নৌকো জেটিতে লাগাতে বলে নেমে যাব। ঠিক সেই সময় কাছেই এক ঝোপের
আড়াল থেকে জেল্লা দেওয়া লাল রঙের বড় একটা মোরগ বেরিয়ে এসে পুকুর পাড়ে খুঁটে খেতে
লাগল। সারা রাতে এই প্রথম কিছু একটা তবু দেখা গেল। যদিও জানি‚ ওটা বনবিবির নামে ছেড়ে দেওয়া মানতের মোরগ।
বছরের পর বছর জঙ্গলে থেকে এখন অবশ্য বুনোই হয়ে গেছে। তাই নিয়ে চাপা গলায় কথা চলছে।
‘তবু যদি একটা হরিণ দেখা যেত!’ আপসোস একজনের গলায়।
পরিতোষ
চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ বলল‚ ‘তোরা যাই বলিস‚ আমার কিন্তু অন্য রকম মনে হচ্ছে।’
আমাদের
মধ্যে পরিতোষ সুন্দরবনের ব্যাপারে সবচেয়ে অভিজ্ঞ। অনেকবার এসেছে। সবাই বলল‚ ‘কী সন্দেহ।’
এই
যে সারা রাত একটা হরিণ বা শূকর কিছুই জল খেতে এল না‚ তার একটাই মানে দাঁড়ায়‚ বাঘ কাছেই ওত পেতে রয়েছে। আমরা দেখতে না পেলেও বনের অন্য পশুরা
ঠিক টের পেয়ে গেছে। তাই মনে হয়‚ আর একটু অপেক্ষা করলে হয়তো বাঘ দেখার আশা পূর্ণ হতেও পারে।
সারা রাত অপেক্ষার পর নিরাশ হয়ে এবার হয়তো জল খেতে বের…।’
পরিতোষের
কথা তখনও শেষ হয়নি‚ হঠাৎ খুব কাছেই ‘ঘড়াম’ করে আচমকা রক্ত জল করা আওয়াজ। অদূরে মোরগটা মুহূর্তে ‘কঁক’ করে চাপা আর্তনাদে নিমেষে ডানা ঝাপটে হাওয়া। আর
আমরা? বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে ততক্ষণে লাফিয়ে উঠেছি সবাই‚ ‘বা–বা–বাঘ।’
ওদিকে
সিঁড়ির নীচে মদনের চোখে তখন বোধ হয় সামান্য ঘুমের ঘোর লেগেছে। মুহূর্তে উঠে বসে
পরিত্রাহি চিৎকার‚ ‘বাঘ–বাঘ! খেয়ে ফেল দেলে।’
আমাদের
সেই চিৎকারে ততক্ষণে অদূরে নৌকোয় সাড়া পড়ে গেছে। শুরু হয়েছে চিৎকার‚ ‘বাঘ! কোথায়?’
ওই
সময় আর এক কাণ্ড। নৌকোয় বাউলে হঠাৎ হাউমাউ করে উঠল‚ ‘গেছে‚ মদনকে নিয়ে গেছে! হেই মাঝির পো‚ শিগগির গেরাপী (নোঙ্গর) তুলে ভটভটি চালু করো। ছেলেটাকে নিয়ে
সুমুন্দি কোনদিক গেল‚ দ্যাখো। হায় হায়!’
এদিকে
মদন তখনও সিঁড়ির নীচে পরিত্রাহি চিৎকার করে চলেছে। আমরাই চেঁচিয়ে জানিয়ে দিলাম‚ ‘মদন আমাদের এখানে বাউলেদা।’
ইতিমধ্যে
মদনের সেই চেল্লানি বাউলেও বোধহয় চিনতে পেরেছে। আশ্বস্ত হয়ে বলল‚ ‘কাণ্ড দ্যাখো। বোটে নেই দেখে ভাবলুম বুঝি
বাঘে নিয়েছে। তা ওদিকে সব ঠিক আছে তো?’
‘একদম‚ একদম ঠিক আছে গো বাউলে। কোথায় বাঘ! যত সব ছেলেমানুষের কাণ্ড।’
তাকিয়ে
দেখি ইতিমধ্যে উঠে বসেছেন গনেশদা। আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন কটমট করে। উত্তরটা
তাঁরই। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আমাদের কারো মুখেই আর কথা সরল না। সত্যি কথা!
ইতিমধ্যে চারপাশে আতিপাতি করে খুঁজে বাঘের টিকির দেখাও পাওয়া যায়নি। ভয়ানক
সেই গর্জনও দ্বিতীয়বার শোনা যায়নি। নীচে মদন অবশ্য তখনও চিৎকার করে চলেছে। দেখে
গণেশদাই তাকে ধমক দিয়ে থামালেন‚ ‘সেই থেকে ষাঁড়ের মতো চেল্লাচ্ছিস! কোথায় বাঘ? দেখেছিস?’
‘না দেখিনি গো। কিন্তু কানের কাছে যা ডাক ছাড়লে‚ প্রাণটা ধড় ছেড়ে বেইরে যায়নি‚ সেই ঢের।’ গণেশদার ধমকে
চেল্লানি থামলেও করুণ গলায় ব্যক্ত করে মদন‚ ‘হেই দাদা। আমারে আজই কেনিং পাইঠে দাও গো। সুন্দরবনে এতবার বাঘ
দেখিচি‚ কোনও দিন এমন ডাক শুনিনি গো! ঢের হয়েছে‚ আর এদিকে আসবুনি। মেরে ফেল্লেও না।’
‘ঠিক আছে বাপু। আসিসনি।’ প্রায় ধমকে উঠলেন গণেশদা।
তারপর উঁচু গলায় নৌকোয় বাউলেদার উদ্দেশে বললেন‚ ‘বাউলে‚ এবার এখান থেকে উদ্ধার করো দেখি। আর এই
বেলাই নৌকো ছেড়ে দাও। এসব ছেলেছোকরাদের সঙ্গে আর সুন্দরবন দেখার ইচ্ছে নেই। খুব
হয়েছে।’
সুন্দরবনে
শেষ দিনেও কিছুক্ষণ ঘোরা হয়। কিন্তু গণেশদার তাগাদায় সেই সকালেই ক্যানিংয়ের
উদ্দেশে ছেড়ে দেওয়া হল ভটভটি।’
থামলেন
বিনুমামা। আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম‚ ‘কিন্তু সেই বাঘ! তার হদিশ মেলেনি?’
‘বাঘ! বাঘ কোথায়?’ বিনুমামা প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন।
‘বা রে! তাহলে সেই গর্জন!’ এবার আকাশ থেকে পড়ার পালা
আমাদের।
‘গর্জন কী শুধু বাঘেরই হয় রে? সেদিন সেই ব্যাঘ্র
গর্জনের রহস্য ফাঁস হতে কিন্তু সময় লাগেনি। বাঘ নয়‚ সামান্য ঘুম আসতে আচমকাই ডেকে উঠেছিল
গণেশদার নাক। আর সে তো মামুলি নাকডাকা নয়‚ হার মানে ব্যাঘ্র গর্জনও! সাধে কী গত কয়েক দিন কেউ কেবিনে
গণেশদার পাশে শুতে চায়নি! তাতে অবশ্য গণেশদার সুবিধাই হয়েছিল। কেবিনে দিব্যি একাই
রাত কাটিয়েছেন। কিন্তু সেদিন টাওয়ারে ওই ঘটনায় আমাদের উপর যে বেজায় খেপে গিয়েছিলেন‚ তা বলাই বাহুল্য। তাগাদা লাগিয়ে ফেরার পথ
ধরেছিলেন সেই সকালেই। সম্মানীয় মানুষ‚ তাই আমরাও আর উচ্চবাচ্য করিনি। বেচারা মদন শুয়ে ছিল বাইরে
সিঁড়ির প্রান্তে। তাই রহস্যটা ধরতে পারেনি। আমরাও ভাঙিনি। বুড়িরডাবড়ির সেই অঘটন ওর
কাছে ভয়ানক ব্যাঘ্র গর্জন হয়েই রয়ে গেছে। কখনও আর সুন্দরবনমুখো হয়নি।’
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
২/২/২০১৭
দুর্দান্ত
ReplyDelete