বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার যখন বাইশ চব্বিশ বছর বয়েস তখন
নানা দেশ বেড়ানোর একটা কাজ জুটে গেল অদৃষ্টে। তখন আমি দৈব্য ঔষধের মাদুলি বিক্রি
করে বেড়াতুম। চুঁচড়োর শচীশ কবিরাজের তরফ থেকে মাইনে ও রাহাখরচ পেতুম। অল্প
বয়সের প্রথম চাকরি,
খুব উৎসাহের সঙ্গেই করতুম।
আমাকে
কাপডচোপড় পরতে হ’ত
সাধু ও সাত্বিক বামুনের মতো। ওটা ছিল ব্যবসায়ের অঙ্গ। গিরিমাটির রঙে ছোপানোর
কাপড় পরণে, পায়ে
ক্যাম্বিসের জুতো, গলায়
মালা, হাতে
থাকতো একটা ক্যাম্বিসের বাগ, তারই মধ্যে মাছলি ও অন্যান্য ওষুধ থাকতো।
বছর
তিনেক সেই চাকরি করি,
তারপর শরীরে সইলো না বলে ছেড়ে দিলুম।
একবার
যাচ্ছি বৰ্দ্ধমান জেলার মেমরি স্টেশন থেকে মাখমপুর বলে একটা গ্রামে। এট। মাদুলি
বিক্রির জন্যে নয়; মাখমপুরে
শচীশ কবিরাজের শ্বশুরের বাড়ী। সেখানকার জমিজমার ওয়ারিশান দাড়িয়েছিলেন শচীশবাবু‚ শ্বশুরের
ছেলেপুলে না থাকায়। আমাকে পাঠিয়েছিলেন পৌষ-কিস্তির সময় জমিজমার খাজনা যতটা পারি
আদায় করে আনতে।
কিন্তু
তা হ’লেও
পরণে আমার গেরুয়া কাপড়,
হাতে মাদুলি ও ওষুধভরা ক্যাম্বিসের ব্যাগ ইত্যাদি সবই ছিল, যদি পথেঘাটে
কিছু বিক্রি হয়ে যায়,
কমিশনটা তো পাব !
কখনও
ও অঞ্চলে যাইনি। মেমরি স্টেশনে নেমে বেলা দুটেfর সময়ে হাঁটচি তো হেঁটেই চলেচি, পথ আর
ফুরোয় না। এক জায়গায় একটা ছোট বাজার পড়লো, সেখানে কিছু খেয়ে নিয়ে আবার পথ
হাঁটি ।
গ্রামে
গ্রামে ওষুধ বিক্রি করে বেশ কিছু রোজগারও করা গেল। দেরিও হ’ল বিশেষ করে
সেই জন্যে । আর একটা বাজার পড়লো। সেখানে দোকানদারদের কাছে শুনলুম, আমার
গন্তব্য স্থানে পৌঁছুতে অন্তত রাত নটা বাজবে। কিন্তু সকলেই বললে, “সন্ধ্যের
পরে আগে গিয়ে আর পথ হাঁটবেন না, ঠাকুরমশায়। এই সব দেশে ফাঁসুড়ে ডাকাতের বড় ভয়, বিদেশী
দেখলে মেরেধরে যথাসৰ্ব্বস্ব কেড়ে নেয়। প্রায়ই বনের ধারে বড় বড় মাঠের মধ্যে
ঘাপটি মেরে বসে থাকে। সাবধান, একটা দীঘি পড়বে মাঠের মধ্যে ক্রোশ তিনেক দূরে, জায়গাটা
ভালো নয়---”
বড়
বড় মাঠের ওপর দিয়ে রাস্তা। সন্ধ্যা প্রায় হয়-হয়, এমন সময়
দূরে একটা তালগাছ ঘেরা দীঘি দেখা গেল। আমার বুক
টিপচিপ করে উঠলো। দীঘির ও-পাশে সঞ্জয়পুর বলে একটা গ্রাম, সেখানেই
রাত্রের জন্যে আশ্রয় নেওয়ার কথা বাজারে বলে দিয়েছিলো। কিন্তু সন্ধ্যা তো হয়ে
গেল তালদীঘির এদিকেই‚ অন্ধকার হবার দেরি নেই, কোথায় বা
সঞ্জয়পুর, কোথায়
বা কি ?
মনে
ভারি ভয় হ’ল।
কি করি এখন? সঙ্গে
মাদুলি ও ওষুধ বিক্রির দরুণ অনেক টাকা। পরক্ষণেই
ভাবলাম, কিছু
না পারি, দৌড়তে
তে পারব? না-হয়
ব্যাগটাই যাবে, —প্রাণ তো
বঁচবে ।
ভয়ে
ভয়ে দীঘির কাছাকাছি তো এলুম। বড় সেকেলে দীঘি, খুব উচু পাড়, পাড়ের দু’ধারে
বড় বড় তালগাছের সারি। তার ধার দিয়েই রাস্তা। দীঘির পাড়ে কিন্তু লোকজনের সম্পর্ক
নেই। যে ভয় করেছিলুম,
দেখলুম সবই ভূয়ো। মানুষ মিথ্যে যে কেন এ-রকম ভয় দেখায়!
প্রকাণ্ড
দীঘিটার পাড় ঘুরে যেমন তালবনের সারি ও দীঘির উচু পাড়কে পেছনে ফেলেচি, সামনেই দেখি
ফাঁকা মাঠের মধ্যে দূরে একটা গ্রাম লি-লি করছে‚ নিশ্চয়
ওটা সেই সঞ্জয়পুর।
বাঁচা
গেল বাবা! কি ভয়টাই দেখিয়েছিল লোকে! দিব্যি ফাকা মাঠ, কাছেই লোকের
বসতি, গায়ের
গরু বাছুর চরছে মাঠে‚ কেন এ সব জায়গায় বিপদ থাকবে?
আমি
এই রকম ভাবচি, এমন
সময় তালপুকুরের ওদিকের পাড়ের আড়ালে যে পথটা, সেই পথ বেয়ে একজন বৃদ্ধকে আমার দিকে
আসতে দেখলুম। বৃদ্ধ বেশ বলিষ্ঠ গড়নের, এই বয়সেও মাংসপেশী বেশ সবল, গলায়
রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে
ছোট একটা লাঠি ।
বৃদ্ধ
আমায় বললে, “ঠাকুরমশায়
কোথায় যাবেন ?”
“যাব
মাখমপুর...”
‘মাখমপুর! সে
যে এখনও তিন ক্রোশ পথ...কাদের বাড়ী যাবেন?”
“শচীশ
কবিরাজের বাড়ী।”
“ঠাকুরমশায়
কি কবিরাজমশায়ের গোমস্তা?”
“গোমস্তা নই, তবে যাচ্ছি
জমিজমার কাজে বটে।”
“এ অঞ্চলে আর
কাউকে চেনেন? "মশাইয়ের
নিজের বাড়ী কোথায়?”
“আমি এদিকে
কখনও আসিনি, কাউকে
চিনিওনে। মাখমপুরেও নতুন যাচ্ছি...”
“সেখানেও কেউ
তাহলে আপনাকে চেনে না?”
“নাঃ, কে চিনবে?”
আমার
এই কথায়, আমার
যেন মনে হ’ল
বুড়ো একটু কি ভাবলে,
তারপর আমায় বললে, “কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা বলি‚ রাত্রে
আজ দয়া করে আমার বাড়ীতে পায়ের ধুলো দিন। আমরা জাতে বারুই, জল-আচরণীয়, আপনার অসুবিধে হবে না। চণ্ডীমণ্ডপের
পাশে বাইরের ঘর আছে, সেখানে থাকবেন, রান্নাবাড়া
করে খাবেন‚ আসুন দয়া করে---”
আমি
বৃদ্ধের কথায় ভারী সন্তুষ্ট হলুম। সত্যিই তো, সেকালের লোকেরা অন্য
ধরণের শিক্ষায় মানুষ। অতিথি-অভ্যগতদের সেবা করেই এদের তৃপ্তি। বৃদ্ধ এই প্রস্তাব
না করলে রাঢ় অঞ্চলের অজানা মেঠো পথ বেয়ে এই সুমুখ-আঁধার রাতে আমায় যেতেই তো হ’ত মাখমপুরে, তিন ক্রোশ হেঁটে ।
গ্রামের
পূর্বপ্রান্তে বড় মাঠের ধারে বৃদ্ধের বাড়ী। বুদ্ধের নাম নফরচন্দ্র দাস। আমি
চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে উঠতেই একটা কুকুর ঘেউঘেউ করে উঠলো।
কুকুরের
এই ডাকটা আমার ভালো লাগলো না। এর আমি কোন কারণ দিতে পারবো না। কিন্তু
এই কুকুরের চিৎকারে যেন একটা ছন্নছাড়া অমঙ্গলজনক অর্থ আছে‚ মঙ্গলসন্ধ্যায় কোন গৃহস্থবাড়ীতে আসি নি,
যেন শ্মশানভূমিতে এসেচি…
বৃদ্ধের
বাড়ী দেখে মনে হ’ল বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। বাড়ীর উঠোনে সারি
সারি তিনটে বড় বড় ধানের গোলা। গোলার সঙ্গে প্রকাগু গোয়ালঘর, বলদ ও গাইয়ে প্রায় কুড়ি বাইশটা৷ অন্তপুরের দিকে চারখানা বড় বড়
আটচালার ঘর। বাইরের এই চণ্ডীমণ্ডপ ও তার পাশে আর একখানা কুঠরি!
আমার
কথাটা ভালো করে বুঝতে গেলে এই কুঠরিটার কথা আর একটু ভালো করে শুনতে হবে। কুঠরিটিকে
চণ্ডীমণ্ডপ সংলগ্ন একটা কামরাও বলা যায়, কারণ একটা সরু
রোয়াকের দ্বারা চণ্ডীমণ্ডপের পেছন দিকের সঙ্গে সংলগ্ন। অথচ দোর বন্ধ করে দিলে
বাইরের বাড়ীর সঙ্গে এর সম্পর্ক চলে গিয়ে এট ভেতরবাড়ীর একখানা ঘরের সামিল হয়ে
দাঁড়ায়।
আমায়
বাসা দেওয়া হ’ল এই কুঠরিতে। কুঠরির একপাশে ছোট একটা চালা।
সেখানে আমার রান্নার আয়োজন করে দিয়েচে। হাত-মুখ
ধুয়ে সুস্থ হয়ে আমি বিশ্রাম করচি।
গৃহস্বামী
এসে বললে, “ঠাকুরমশায় রান্না চাপান, আর রাত করেন
কেন?”
আমি
রান্নাচালায় বসে রান্না চড়িয়ে দিতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি একটি
বাড়ীর বৌ ভেতর থেকে একগাছা ঝাঁটা হাতে এসে আমার রান্নাচালার সামনে দিয়ে ঢুকলো ও
ঝাঁট দিতে লাগলো।
কুঠরির
দরজা খোলা। আমি যেখানে বসে সেখান থেকে কুঠরিটার ভেতর দেখা যায়। আমি দু-একবার
বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলুম বৌটি ঝাঁট দিতে দিতে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখচে। দু'তিন বার বেশ ভালো করে লক্ষ্য করে মনে হ’ল বৌটি ইচ্ছে
করেই আমার দিকে অমন করে চাইচে।
আমি
দস্তুরমত অবাক হয়ে গেলুম। ব্যাপার কি? সম্পূর্ণ অপরিচিত
মেয়ে, পল্লীর গৃহস্থবধু‚ এমন ব্যবহার তো ভালো নয়? কি হাঙ্গামায় আবার পড়ে যাবো রে বাবা। কর্তাকে কাছে বসিয়ে রাখতে রাখতে
গল্প করবো নাকি ?
এমন
সময় বৌটি বাঁট শেষ করে চলে গেল। কিন্তু বোধ হয় পাঁচ মিনিট পরেই আবার এলো। দেখে
মনে হ’ল
সে যেন খুব ব্যস্ত, উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত। এবারও
সে কুঠরির মধ্যে ঢুকে এটা ওটা সরাতে লাগলো এবং আমার দিকে চাইতে লাগলো, তারপর হঠাৎ
রান্নাচালার দরজায় এসে চকিতদৃষ্টিতে চারদিক চেয়ে কেউ নেই দেখে আমার দিকে আরও সরে
এলো এবং নিচুম্বরে বললে,
“ঠাকুরমশায়, আপনি
এখনই এখান থেকে পালান,
না হলে আপনি ভয়ানক বিপদে পড়বেন। এরা ফাঁসুড়ে ডাকাত, রাতে আপনাকে
মেরে ফেলবে।” —বলেই
চট করে বাড়ীর মধ্যে চলে গেল ।
শুনে
তো আর আমি নেই! হাতের খুন্তি হাতেই রইলো, সমস্ত শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে
গেল। সারা হাত-পা অবশ ও ঝিমঝিম করতে লাগলো। বলে কি! দিব্যি গেরস্তবাড়ী, গোলাপালা, ঘরদোর—ডাকাত কি
রকম ?
কিন্তু
পালাবোই বা কেমন করে?
এখন বেশ রাত হয়েচে। সামনের চণ্ডীমণ্ডপে বৃদ্ধ বসে লোকজনের সঙ্গে কথা কইচে।
ওখান দিয়ে যেতে গেলেই তো সন্দেহ করবে!
কাঠের
মতো আড়ষ্ট হয়ে গিয়েচি একেবারে। হাতে পায়ে
জোর নেই, কিছু
ভাববারও শক্তি লোপ পেয়েচে। মিনিট পাঁচেক
এমনি ভাবে কাটলো। এমন সময়ে দেখি সেই বৌটি আবার
কি-একটা কাজে কুঠরির মধ্যে ঢুকে খোলা দরজা দিয়ে আমার দিকে চেয়ে দাড়িয়ে রইল।
মেয়েটি
কথা বলবার পূৰ্ব্বেই আমি বললুম, “তুমি যে হও, তুমি পরম দয়াময়ী। বলে দাও কোন পথে
কি ভাবে পালাবো•••”
বৌটি
চাপা গলায় বললে, “সেই
জন্যেই এলুম। সব দেখে এলুম। পালাবার পথ নেই। ওরা ঘাটি আগলে রেখেচে...”
আমি
বললুম, “তবে
উপায় !”
মেয়েটি
বললে, “একটা
মাত্র উপায় আছে। তাও আমি ভেবে এসেচি। আমি এ-বাড়ীতে আর ব্ৰহ্মহত্যা হ’তে দেব না।
অনেক সহ্য করেচি, আর
করবো না। দাঁড়ান ঠাকুরমশায়, আর একবার বাড়ীর মধ্যে থেকে আসি, নইলে সন্দেহ
করবে।”
মিনিট
পাচেক পরে বৌটি আবার এলো,
চকিত দৃষ্টিতে চারদিকে চেয়ে বললে, “শুমুন, আমার উপায়‚ এই কথা ক’টা মনে
রাখুন। মনে যদি রাখতে পারেন, তবে বাঁচাতে পারবো। —আমার নাম বামা, আমি
এ-বাড়ীর মেজবৌ, আমার
বাপের বাড়ীর গ্রামের নাম কুসুমপুর, জেলা বৰ্দ্ধমান, থানা
রায়না। আমার বাপের নাম হরিদাস মজুমদার, জ্যাঠামশায়ের নাম পাঁচকড়ি মজুমদার, আমরা দুই
বোন, আমার
দিদির নাম ক্ষাস্তমণি,
বিয়ে হয়েচে সামন্তপুর-তেওটা, বৰ্দ্ধমান জেলা। শ্বশুরের নাম
দুর্ল্লভ দাস। সবাই জাতে বারুই। আমার বাবা, জ্যাঠামশায় সব বেঁচে আছেন, কিন্তু মা
নেই—’
আমার
তখন বুদ্ধি লোপ পেতে বসেচে। যা বলে মেয়েটি তাই করে যাই। এতে কি হবে ? বৌটি
কিন্তু এক একবার বাড়ীর মধ্যে যায়, আবার অল্প দু'মিনিটের
জন্যে ফিরে এসে আমায় তালিম দেয়‚ “মনে আছে তো ? জ্যাঠামশায়ের
নাম কি ?”
আমি
বললুম, “হরিদাস
মজুমদার••••’
“না—না, পাঁচকড়ি
মজুমদার, বাবার
নাম হরিদাস মজুমদার- আমার দিদির নাম কি ? শ্বশুরবাড়ী কোন গাঁয়ে?••••
“ক্ষান্তমণি।
শ্বশুরবাড়ী হ’ল—শ্বশুরবাড়ী--"
‘আপনি সব
মাটি করলেন দেখচি ! সামন্তপুর তেওটা, বলুন--”
“সামন্তপুর –তেওটা
–শ্বশুরের
নাম রামযদু দাস‚ দুর্লভরাম দাস---”
অবশেষে
মিনিট দশ-বারোর মধ্যে আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে এসেচে। বৌটি বললে, “রান্না-খাওয়া
করে নিন ঠাকুরমশায়,
কোন ভয় করবেন না। আমার বাপের বাড়ীর নাম-ধাম যখন জানা হয়ে গেছে, তখন আপনাকে
বাঁচাতে পেরেচি। এখন শুনুন,
খাওয়া-দাওয়ার পরেই শ্বশুরমশায়ের কাছে আমার বাপের বাড়ীর পরিচয় দিয়ে বলবেন‚ আপনি তাদের
গুরুবংশ, আমার
নাম বলে জিগ্যেস করবেন—আমার
বিয়ে হয়েচে কোথায়,
জানো নাকি ? গলা
যেন না কাঁপে, কোনরকম
সন্দেহ যেন না হয়। আমি চললুম, আবার আসবে।
আপনি শ্বশুরকে বলবার পরে কিন্তু দেরি করবেন না বেশি, বিপদ কখন হয় বলা তো যায় না।
রান্না-খাওয়া
শেষ না করলেও তো সন্দেহ করতে পারে। রান্না-খাওয়া
করতেই হ’ল। রাত্রের
অন্ধকার তখন বেশ ঘন হয়ে এসেচে, রাত আন্দাজ দশটার কম নয়, আহারাদির পর নিজের কুঠুরিতে বসেচি, আর আমার মনে
হচ্ছে এ বাড়ীর সবাই যেন খাঁড়ায়, রাম-দাতে শান দিচ্ছে, আমার গলাটি
কাটবার জন্যে।
এই
সময় গৃহস্বামী স্বয়ং আমার জন্যে পান নিয়ে এলো। বললে, “কি
ঠাকুরমশায়, আহারাদি
হ’ল? এখন দিব্যি
করে শুয়ে পড়ুন। মশারীটা টাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। রাত হয়েচে‚ আর
দেরি করবেন না •••”
আমি
বললুম, “হ্যা, একটা কথা
বলি‚ আমাদের এক মন্ত্রশিষ্য, বাড়ী কুসুমপুর, থানা রায়না, নাম
পাঁচকড়ি—ইয়ে, হরিদাস
মজুমদার, তার
একটি মেয়ের নাম বামা‚ এ দিকেই কোথায় বিয়ে হয়েচে। তারাও
জাতে তোমাদের বারুই কিনা—তাই
হয়তো চিনলেও চিনতে পারে। মেয়েটির জ্যাঠা দুর্ল্লভরাম‚ ইয়ে পাঁচকড়ি—আমায় বলে
দিয়েছিল মেয়েটির শ্বশুরবাড়ী খোঁজ করে একবার সেখানে যেতে। তা
যখন এলুমই এ দেশে••••
আমার
কথা শুনে বৃদ্ধ যেন কেমন হয়ে গেল, আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বললে, “কুসুমপুরের
হরিদাস মজুমদার? বামা? আপনি তাদের
চিনলেন কি করে?”
বামার
কথা স্মরণ করে গলা না কাঁপিয়ে দৃঢ়স্বরে বললুম, “আমি ষে তাদের গুরুবংশ– আমার বাবার
ওরা মন্ত্রশিন্য কিনা?’
বৃদ্ধ
তাড়াতাড়ি বললে, “বসুন, আমি আগচি••••
আমি
একটা কুঠরির মধ্যে বসে রইলুম, সন্দেহ ও ভয় তখনও কিছু যায় নি। আর এরা ষে গুরুদেবকেই
রেহাই দেবে তা কে বলেচে?
কিছুক্ষণ
পরে বৃদ্ধ ফিরে এল। পেছনে পেছনে সেই বধুটি, আর একজন ষণ্ডামার্ক গোছের যুবক এবং
একজন প্রৌঢ় স্ত্রীলোক। সম্ভবত বৃদ্ধের স্ত্রী।
বৃদ্ধ
বললে, “এই
যে বামা, ঠাকুরমশায়। আমারই
মেজছেলের সঙ্গে…‚ এই আমার মেজ
ছেলে শম্ভু‚ গড় করো সব, গড় করো।
মেজবৌমা, দেখ
তো, চিনতে
পারো এঁকে?
চমৎকার
অভিনেত্রী বটে বামা! অদ্ভুত অভিনয় করে গেল বটে। ঘোমটা খুলে হাসিমুখে সে আমার
পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলে গলায় আঁচল দিয়ে। জীবনদাত্রী, দয়াময়ী
বামা! আমার চোখে প্রায় জল এসে পড়লো।
তারপর
সে রাত্রি তো কেটে গেল। খাবার জল দেবার ছুতো করে এসে বামা আমায় আশ্বাস দিয়ে গেল।
বললে, “বিপদ
কেটে গিয়েছে; আমার
চোখে না পড়লে সৰ্ব্বনাশ হ’ত, ভিটেতে
ব্ৰহ্মহত্যে হ’ত।
অনেক হয়েছে
এই কুঠরিতে। এই বিছানায়, এই মেঝেতে অনেক লাশ পোঁতা…
আমার
মনের অবস্থা বলবার নয়। বললুম, “পুলিস কি গাঁয়ের লোক কিছু টের পায় না? কিছু বলে না?”
‘কে কী বলবে!
এ ফাঁসুড়ে ডাকাতের গাঁ। সবাই এ–রকম। আগে জানলে কি বাবা এখানে বিয়ে দিতেন? বিয়ের পর
সব ধরা পড়ে গেল আমার কাছে। এখন আমার একটি সন্তান হয়েছে। এ পাপ-ভিটেয় বাস করলে
তার অকল্যাণ হবে। ওকে বারণ করি, কিন্তু ও কি করবে? মাথার ওপর শ্বশুরমশায় রয়েচেন।
পুরনো ডাকাত, দাদারা
রয়েচে‚ আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন বাবাঠাকুর, আর ভয় নেই•••”
সকাল
হ’ল।
বিদায় নেবার সময় বৃদ্ধ আমায় পাঁচ টাকা গুরু-প্ৰণামী দিলে। বামাকে আড়ালে ডেকে
বললুম, “তুমি
আমার মা, আমার
জীবনদাত্রী। আশীৰ্ব্বাদ করি চিরসুখী হও মা।’
বামার
মতো বুদ্ধিমতী নারী জীবনে আর আমার চোখে পড়ে নি। কতকাল হয়ে গেল, এই বৃদ্ধ
বয়সেও সেই দয়াময়ী পল্লীবধুটির স্মৃতিতে আমার চোখে জল এসে পড়ে, শ্রদ্ধায়
মন পূর্ণ হয়ে ওঠে।
আপলোড: ১৫/১২/২০১৭
যতবার পড়ি তত বারই একই রকম ভালো লাগে। ধন্যবাদ আপনাকে।
ReplyDeleteগল্প অনুসারে বামার চরিত্র বিশ্লেষণ কর। এটা কি আপনার কাছে আছে? পাওয়া যাবে
ReplyDeleteঅসাধারণ একটি গল্প । মূল্যবোধের গল্প । কোনদিন পুরনো হয় না ।
ReplyDeleteঅনন্যসাধারণ। বারবার পড়েও আশ মেটে না।
ReplyDeletePhasure dakaand laser bole?
ReplyDelete