শিশির বিশ্বাস
বৈরাট নগরের পথ সেদিন জনশূন্য। অথচ বসন্ত উৎসবের দিন। প্রতি বছর এই দিনে নগরের পথে মানুষের ঢল নামে। নানা রঙের কেতনে সাজানো হয় বাড়ি আর তোরণদ্বার। প্রতিটি সরণী। অগুরু আর অঙ্গরাগে
সজ্জিত হয়ে নারী–পুরুষ পথে নেমে আসে। মেতে ওঠে রঙের খেলায়। আর যে চক্রস্বামী মন্দির সাধারণ দিনেও পূণ্যার্থীর ভিড়ে সরগরম
থাকে‚ সেই মন্দির প্রাঙ্গণও আজ নিস্তব্ধ। ব্যতিক্রম বলতে অদূরে রাজপথে যাত্রীর অপেক্ষায় এক অশ্বশকট মাত্র।
অশ্বশকটের চালক সুভদ্র সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ
যুবক। ওর বাবা কুবয়ও রাজপথে অশ্বশকট চালাতেন। তবে ইচ্ছে ছিল পুত্রকে সারথির কাজ নয়‚ অস্ত্রবিদ্যা শেখাবেন। খ্যাতনামা অস্ত্রগুরু আচার্য সারঙ্গদেবের আশ্রমেও পাঠিয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যে সুভদ্র অনেকটাই উন্নতি করেছিল। ভল্ল এবং ধনুর্বাণ নিক্ষেপে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন স্বয়ং
আচার্যও। কিন্তু হঠাৎই সেই
পর্বের ইতি ঘটে গেছে।
সে বছর কয়েক আগের কথা। নগর প্রশাসক বিশ্বদেব তাঁর রথের জন্য কয়েকজন উপযুক্ত সারথির
সন্ধানে ছিলেন। ডেকে পাঠিয়েছিলেন
কুবয়কে। সম্রাটের নির্দেশে
যুদ্ধে বের হবেন তিনি। কুবয় সাড়া দিতে
দ্বিধা করেননি। বিশ্বদেবের রথের
সারথি হয়ে চলে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই
যুদ্ধে সম্রাটের বাহিনী জয়লাভ করলেও নিহত হয়েছিলেন সারথি কুবয় সহ বিশ্বদেব। পিতার সেই মৃত্যু সুভদ্রর জীবনটাই পালটে দিয়েছে। অস্ত্রশিক্ষা স্থগিত করে ফিরে আসতে হয়েছে গৃহে মায়ের কাছে। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য পৈতৃক জীবিকাই এখন সম্বল।
আজ এই দিনে যাত্রী মেলার সম্ভাবনা তেমন
নেই। মাও আপত্তি করেছিলেন। তবু ও যে শকট নিয়ে বের হয়েছে‚ তা অন্য কারণে। আজ বৈরাট নগরের এই অবস্থা হঠাৎ নয়। কিছুদিন ধরেই খবর পাওয়া যাচ্ছিল‚ হূন
নামে এক বর্বর জাতি পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসছে। সুভদ্র আশ্রমের অস্ত্রগুরুর কাছেই শুনেছে‚ হাঁটতে শেখার আগেই নাকি হূন শিশু অশ্ব চালনায় রপ্ত হয়। তাই অশ্বযুদ্ধে তাদের সমকক্ষ মেলা ভার। অশ্বপৃষ্ঠে ঝড়ের বেগে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। তারপর শুধু হত্যালীলা আর লুঠতরাজ। ঘরে ঘরে মানুষের আর্তনাদ। সীমান্তে একের পর এক নগর‚ জনপদ
ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে তাদের হাতে।
আজই হঠাৎ খবর এসেছে‚ তাদের একটা দল নগরের খুব কাছে পৌঁছে গেছে। অথচ ভয়ানক ব্যাপার হল‚ নগর
রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী নেই। হানাদারের দল এগিয়ে
আসার খবর পেয়ে দিন কয়েক আগে নগরের নতুন প্রশাসক শক্রদেব তার বাহিনী নিয়ে বাধা দিতে
এগিয়ে গিয়েছেন। উদ্দেশ্য ছিল‚ হূন হানাদারেরা নগরে ঢোকার আগেই তাদের সম্মুখীন হবেন। নগরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও সেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন কেউ ভাবতেও পারেনি শক্রদেবের বাহিনী পাশ কাটিয়ে তারা অন্যদিক
থেকে অরক্ষিত নগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
সেই খবর কানে আসার পর থেকে বৈরাট নগরের
প্রতিটি মানুষ আতঙ্কে কাঠ হয়ে রয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে নানা
গুজব। যে গুটি কয়েক রক্ষী নগর রক্ষায় মজুত রয়েছে‚ তা প্রয়োজনের তুলনায়
যৎসামান্য। অথচ সামান্য হলেও
অস্ত্র চালনার কিছু কৌশল সুভদ্রর রপ্ত করার সুযোগ হয়েছে। আর সারথি পুত্র হবার সুবাদে অশ্বের সঙ্গে তারও পরিচয় হাঁটতে
শেখার আগেই। তাই আজ নিজেই পরখ
করে নিতে চায়‚
কত বড় অশ্বারোহী যোদ্ধা ওরা। নগরের প্রতিটি গলিঘুঁজিও তার নখদর্পণে। আত্মরক্ষা করতে পারবে‚ সেই
বিশ্বাসও আছে। তাই সঙ্গে নিয়েছে
দুটো ভল্ল আর ধনুর্বাণ সহ তূণীর। মাকে এসব কথা অবশ্য
ঘুণাক্ষরেও জানায়নি ও।
সুভদ্রর কথায় আমরা পরে আবার আসব। তার আগে কিছু অন্য প্রসঙ্গ। কারণ এই গল্প আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগের। মূল কাহিনীতে যাবার আগে সেই সময়ের অবস্থা তাই সামান্য বলা দরকার।
এদেশের ইতিহাসে সে এক সংকটময় সময়। গৌরব–উজ্জ্বল গুপ্ত সাম্রাজ্যের আকাশে হঠাৎই কালো মেঘের ছায়া ঘনীভূত
হতে শুরু করেছে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ
তিন গুপ্ত সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্ত‚ সমুদ্রগুপ্ত
এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তর পরে যিনি সিংহাসনে বসেছিলেন সেই কুমারগুপ্ত ছিলেন কিছু ভিন্ন
প্রকৃতির। দীর্ঘদিন রাজত্ব
করেছেন। কিন্তু সাম্রাজ্যের
স্থায়িত্ব রক্ষা বা বৃদ্ধির জন্য তেমন যত্নবান ছিলেন না। তারই ফলশ্রুতি তাঁর রাজত্বের অন্তিম পর্বে দক্ষিণের মেলক দেশ
থেকে পুষ্যমিত্র জাতির আক্রমণ। সম্রাট তখন বৃদ্ধ
হয়েছেন। নিজে যুদ্ধে বের
হবেন‚ সেই অবস্থা নেই। তবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি।
জ্যেষ্ঠপুত্র স্কন্দগুপ্ত যোগ্য হওয়া স্বত্বেও
যুবরাজের মর্যাদা পাননি। কারণ তাঁর মায়ের
রাজমহিষীর মর্যাদা ছিল না। তাই যুবরাজপদে অধিষ্ঠিত
হয়েছিলেন কনিষ্ঠ পুত্র পুরুগুপ্ত। পিতার মৃত্যুর পরে
তিনিই সিংহাসনে বসবেন। অথচ এই বিপদে গুপ্ত
সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা যে জ্যেষ্ঠ স্কন্দগুপ্তর পক্ষেই সম্ভব‚ বৃদ্ধ সম্রাট কুমারগুপ্ত জানতেন।
বাধা এসেছিল। শুধু মন্ত্রীপরিষদ এবং রাজ পুরোহিতের কাছ থেকে নয়। রাজঅন্তঃপুর থেকেও। কারণ
এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর দায়িত্ব যদি স্কন্দগুপ্তের হাতে ন্যস্ত হয়‚ যুবরাজ পুরুগুপ্তের পক্ষে সিংহাসনে বসা কঠিন। কিন্তু বৃদ্ধ সম্রাট তাতে কর্ণপাত করেননি। আদেশ জারি করে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন স্কন্দগুপ্তের
হাতে।
স্কন্দগুপ্ত প্রকৃতই যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীকে হাতের তালুর মতো চিনতেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে বেছে নিয়েছিলেন যোগ্য
ব্যক্তিদের। বৈরাট নগরের বিশ্বদেব
তাঁর সেই ডাক পেয়েই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। স্কন্দগুপ্তের সুনিপুণ
পরিচালনায় মেলকরাজের পুষ্যমিত্র বাহিনী অচিরেই পর্যুদস্ত হল। কিন্তু সেই সংবাদ শোনার জন্য বৃদ্ধ সম্রাট তখন আর বেঁচে নেই। মৃত্যু হয়েছে তাঁর। সেনাবাহিনীর
পূর্ণ দায়িত্ব স্কন্দগুপ্তের হাতে ন্যস্ত করার পর তাঁর উপর নানা দিক থেকে প্রতিনিয়তই
চাপ আসছিল। বৃদ্ধ মানুষটি সেই
চাপ সামলাতে পারেননি। সম্রাটের শেষ দিনগুলি
তাই একেবারেই সুখের ছিল না।
মেলকরাজের পুষ্যমিত্র বাহিনীকে চূর্ণ করে
স্কন্দগুপ্ত তাই আর দেরি করেননি। ছুটেছিলেন পাটলিপুত্রের
দিকে। যদিও ইতিমধ্যে পুরুগুপ্ত সিংহাসনে আসীন হয়েছেন‚ তবু গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হওয়া তাঁর কাছে তখন সময়ের অপেক্ষা
মাত্র। হাতে সময় কম। তবু তার মধ্যেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন। তার একটি এই বৈরাট নগরের জন্য। নগর প্রশাসক বিশ্বদেব নিহত। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই নগরের জন্য এক যোগ্য প্রশাসকের প্রয়োজন
ছিল। বয়সে নবীন হলেও তিনি সেই পদে বসিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বদেবের
পুত্র শক্রদেবকে।
নগরের অনেকেই তখন এই পদের দাবিদার। তারা নিরাশ হয়েছিলেন নিশ্চয়। বয়সে নিতান্তই নবীন শক্রদেব এই কাজে কতটা উপযুক্ত‚ তা নিয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু দূরদর্শী মানুষটির নির্বাচনে যে কিছুমাত্র ভুল ছিল না‚ তা বোঝা গিয়েছিল অল্প দিনের মধ্যেই।
পুষ্যমিত্রদের সঙ্গে যুদ্ধে বিশ্বদেবের
মৃত্যুই শুধু নয়‚
বৈরাট নগরের সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল
প্রচুর। তার উপর অল্প দিনের
মধ্যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উপর নেমে এসেছে নতুন বিপদ‚ হূন
আক্রমণ। চর মারফৎ যে খবর
এসে পৌঁছেছে‚
তাতে শক্রদেবের বুঝতে বাকি থাকেনি‚ বহিরাগত নতুন এই শত্রু পুষ্যমিত্র আক্রমণ থেকেও অনেক বেশি বিপজ্জনক। হূনদের মূল বাহিনী সেনাপতি এটিলার নেতৃত্বে সুদূর প্রতীচ্য দেশগুলি
ইতিমধ্যেই নাকি তছনছ করে ফেলেছে। সেসব দেশে তাঁর
নামই হয়ে গিয়েছে ‘রক্তপিশাচ
এটিলা’। তবে আশার কথা‚ এটিলার মৃত্যুর পরে হূনরা বর্তমানে নানা দলে বিভক্ত। কিছু দুর্বল। তাদেরই কয়েকটি দল
এবার হানা দিয়েছে এদেশে। দ্রুত ব্যবস্থা
নিতে না পারলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করার জন্য
তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু অর্থের অভাবটাই
ছিল বড় বাধা। সেই সমস্যার সমাধানে
এই সময়ে তিনি এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেটা অবশ্য জানা গেছে মাত্রই কয়েক দিন আগে।
স্কন্দগুপ্ত ইতিমধ্যে সিংহাসনে আসীন হলেও
তখনো সম্পূর্ণ গুছিয়ে উঠতে পারেননি। পুরুগুপ্ত বন্দি
হলেও তাঁর অনুগামীরা তখনো সক্রিয়। এই অবস্থায় দ্রুত
রাজধানী থেকে কোনো অর্থসাহায্য আসার সম্ভাবনা নেই। ওই সময় শক্রদেব একদিন দেখা করেছিলেন চক্রস্বামী মন্দিরের প্রধান
আচার্য অগ্নিভট্টর সঙ্গে। কারণ ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের স্থপতি মহারাজাধিরাজ চন্দ্রগুপ্তর সময় থেকেই
চক্রস্বামী মন্দিরের খ্যাতি। এই মন্দিরে পূজা
নিবেদন করে তিনি প্রতিবার দিগ্বিজয়ে বের হতেন। কখনো ব্যর্থ হননি। প্রবাদ‚ বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত চক্রস্বামীর আশীর্বাদেই তিনি স্থাপনা
করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে অন্য
সম্রাটরাও এখানে এসেছেন। চক্রস্বামীর জন্য
নিয়মিত প্রণামী পাঠিয়েছেন টঙ্কশালায় নির্মিত প্রতি প্রথম দফার কয়েকটি করে স্বর্ণমুদ্রা
তথা দীনার। প্রবাদ‚ এভাবে নাকি মন্দিরের কোষাগারে জমা হয়ে রয়েছে প্রচুর সংখ্যক মুদ্রা। শক্রদেবের আর্জি ছিল‚ সেই
স্বর্ণমুদ্রার কিছু পাওয়া গেলে নগরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তথা প্রয়োজনীয় সেনা বাহিনী
তিনি গড়ে তুলতে পারেন।
বলা বাহুল্য‚ কাজ তো হয়ইনি। বরং নবীন নগর প্রশাসকের
ধৃষ্টতায় অগ্নিভট্ট ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। হুঁশিয়ারি
দিয়েছিলেন‚
সম্রাটের কাছে নালিশ জানিয়ে যথোপযুক্ত
ব্যবস্থা নেবেন তিনি। ব্যাপারটা তখন নগরের
কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়া কেউ জানতে পারেনি। তারাও তখন একবাক্যে শক্রদেবের নিন্দাই করেছিলেন। আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তাঁদের মুখেই এখন উলটো সুর শোনা
যাচ্ছে। গোপন ব্যাপারটা
সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে তাঁদের কাছ থেকেই। সেদিন আচার্য অগ্নিভট্ট
কিছু বাস্তববোধের পরিচয় দিলে আজ নগরবাসীদের এমন সংকটে পড়তে হত না।
যাই হোক‚ সম্রাটের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য এরপর এসে পৌঁছল বটে‚ কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। গুপ্তচর মারফত নিয়মিত খবর আসছিল। সীমান্তের একের পর এক অঞ্চল লুঠেরা হূন বাহিনী ইতিমধ্যে প্রায়
তছনছ করে ফেলেছে। দিকে দিকে শুধু
হাহাকার। তারপর একদিন খবর
এল‚ তাদের বড় একটা দল ধাওয়া করেছে বৈরাট নগরের দিকে।
শক্রদেব অবশ্য পরোয়া করেননি। সমস্যা ছিল একটাই। প্রয়োজনীয়
সেনাবাহিনী তখনো গড়ে তোলা যায়নি। অথচ হানাদারদের
বাধা দিতে হবে তারা নগরে পৌঁছোবার আগেই। অগত্যা
নগর প্রায় অরক্ষিত রেখেই তিনি বাহিনী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। নগরের মানুষ সেদিন দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল তাঁকে। চক্রস্বামী মন্দিরের প্রধান আচার্য অগ্নিভট্ট বিশেষ যজ্ঞ করে
তাঁর কপালে পবিত্র জয়টিকা পরিয়ে দিয়েছিলেন। আশ্বাস
দিয়েছিলেন‚
চক্রস্বামীর কৃপায় যুদ্ধ জয় করে ফিরবেন
তিনি। নগরের মানুষ বড় ভরসা পেয়েছিল সেদিন। কেউ ভাবতেও পারেনি বড় সর্বনাশটা হয়ে গিয়েছিল তখনই।
হূন জাতির যুদ্ধ পদ্ধতি কিছু ভিন্ন গোত্রের। বিভিন্ন সর্দারের অধীনে ওরা ছড়িয়ে থাকে ছোট–বড় দলে। রাজ্য বিস্তারের
থেকে লুঠতরাজেই আগ্রহ বেশি। তাই অধিকাংশ সময়
সামনাসামনি যুদ্ধ এড়িয়ে চলে। শক্রদেব তাঁর বাহিনী
নিয়ে রওনা হবার দু’দিন
পরেই আক্রমণকারীদের মূল বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে অন্য এক দল যে ঘুরপথে নগরের দিকে অগ্রসর হতে
শুরু করেছে‚
বুঝতে পারেননি। যখন সেটা টের পেলেন‚ তখন
তাঁর দু’দিকেই শত্রুসৈন্য। তাদের পরাভূত না করে নগরের দিকে এগোনো সম্ভব নয়।
ভয়ানক এই সংবাদ বৈরাট নগরে মাত্র গতকালই
এসে পৌঁছেছে। অথচ নগর সম্পূর্ণ
অরক্ষিত! এই ভয়ানক অবস্থায় কে সাহস করে ঘরের বাইরে বের হবে! বসন্ত উৎসবের এই বিশেষ
দিনেও তাই চক্রস্বামী মন্দিরে কোনো পূণ্যার্থীর দেখা নেই। শোনা যাচ্ছে‚ মন্দিরে আচার্য
অগ্নিভট্ট এবং তার পুত্র দেবভট্ট ছাড়া আজ অন্য কেউ নেই। আচার্যর কাছে সাময়িক বিরতি নিয়ে অন্য কর্মীরা সবাই গৃহে ফিরে
গেছেন। সুনসান মন্দির প্রাঙ্গণে
শুধু দু’একটা পাখির ডাক‚ নয়তো ঝরা পাতার মৃদু শব্দ।
দুপুর পার হয়ে বিকেল যখন ঘন হতে শুরু করেছে‚ সুভদ্র গৃহের পথ ধরবে কিনা ভাবছে‚ হঠাৎ খট করে মন্দিরের ভারি সদর দরজা সামান্য ফাঁক হল। সেই ফাঁক দিয়ে গৌরবর্ণ একটা হাত বের হয়ে ইশারায় ডাকল ওকে।
মানুষটি আচার্য অগ্নিভট্টর পুত্র দেবভট্ট। কিছু অবাক হয়েই সুভদ্র গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে দ্রুত এগিয়ে গেল
সেই দিকে। সুভদ্র মন্দিরের
দরজার কাছে পৌঁছোতেই দেবভট্ট চাপা কণ্ঠে বললেন‚ ‘বৎস
সূতপুত্র‚
দ্বারদেশে শকট নিয়ে এসো। জরুরী প্রয়োজন।’
আদেশ পেয়ে সুভদ্র তার অশ্বশকট মন্দিরের
দরজার সামনে এনে দাঁড় করাতেই দেবভট্ট ওকে মন্দিরের ভিতরে আসতে আদেশ করলেন। মন্দিরের ভিতরে আগেও এসেছে সুভদ্র। অল্প দূর অন্তর বাতির আলোয় ঝলমল করে। আজ এই উৎসবের দিনেও প্রায় অন্ধকার। প্রতিটি দরজা বন্ধ থাকায় কারুকাজ করা বিশাল স্তম্ভগুলো অন্ধকারে
অবলোকন করা মুশকিল। কোথাও একটি মানুষ
নেই। ও পায়ে পায়ে দেবভট্টর পিছনে এগিয়ে চলল গর্ভগৃহের দিকে।
মূল গর্ভগৃহের ভিতর দেবমূর্তির সামনে গোটা
কয়েক বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় ভিতরটা
কিছু পরিষ্কার। সুভদ্র দেখল‚ পূজার আসনে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন অগ্নিভট্ট। সামনে লম্বা নল লাগানো বড় একটা তামার কলস। বিশেষ বিশেষ দিনে এই কলস পবিত্র যমুনা–বারিতে পূর্ণ করে চক্রস্বামীর মূর্তিকে স্নান করানো হয়। স্নানের আগে সেই জল বৈদিক মন্ত্রে পবিত্র করা হয়। গোড়ায় সুভদ্র তেমন কিছুই ভেবেছিল। ঢাকনা দেওয়া কলসির মুখে কয়েকটি ফুলও রয়েছে। ও কাছে আসতে ধ্যান ভঙ্গ করে অগ্নিভট্ট ওর দিকে তাকালেন। স্থির কণ্ঠে বললেন‚ ‘বৎস
সূতপুত্র‚
অতি পুণ্যবান তুমি। স্বয়ং চক্রস্বামী আজ তোমাকে নির্বাচন করে পাঠিয়েছেন।’
অগ্নিভট্টর ওই কথায় তৎক্ষণাৎ সুভদ্রর মুখে
উত্তর যোগাল না। অন্যপক্ষ অবশ্য
সেজন্য অপেক্ষা করলেন না। দ্রুত ওর কপালে
যজ্ঞ-টিপ পরিয়ে দিয়ে ইঙ্গিতে সামনের সেই কলস তুলতে নির্দেশ করলেন। সামান্য জলের কলসি। সুভদ্র
মুখের কানা ধরে তুলতে গিয়ে বুঝল সেটি অসম্ভব ভারি। একার পক্ষে তুলতে হলে যথেষ্ট মেহনতের প্রয়োজন। ততক্ষণে পাশ থেকে দেবভট্ট এগিয়ে এসেছেন। হাত লাগিয়েছেন স্বয়ং অগ্নিভট্টও।
তিনজনের মিলিত চেষ্টায় একসময় সেই কলসি
এসে পৌঁছল মন্দিরের মূল দ্বারপ্রান্তে। সন্তর্পণে তোলা
হল অশ্বশকটে। সেই কলস পাশে নিয়ে
অগ্নিভট্ট স্বয়ং ভিতরে বসলেন। ইঙ্গিতে নির্দেশ
দিলেন শকট চালনার। দেবভট্ট মন্দিরের
দ্বার বন্ধ করে ইতিমধ্যে ভিতরে অন্তর্হিত হয়েছেন।
জনশূন্য পথ অতিক্রম করে শকট কিছু পরে এসে
পৌঁছোল নগরের মূল তোরণদ্বারের সামনে। আজ সকাল থেকেই তোরণদ্বার
রুদ্ধ। কিন্তু শকটের যবনিকার
ভিতর থেকে অগ্নিভট্ট হাত তুলে ইঙ্গিত করতেই প্রহরীরা সসম্ভ্রমে দ্বার খুলে দিলেন। কেউ প্রশ্ন মাত্র প্রশ্ন করল না।
তোরণদ্বার পার হয়ে অনেকটা পথ অতিক্রম করে
ওরা একসময় এসে পৌঁছল বিক্ষিপ্ত পাহাড় ঘেরা এক নির্জন অরণ্যের ভিতর প্রাচীন এক জলাভূমির
কাছে। দিনান্তের আলো ইতিমধ্যে মরে এসেছে। কাছেই উঁচু এক শিরীষ গাছের অদূরে ঝোপঝাড়ে ভরা সামান্য উঁচু এক
টুকরো জমি। অগ্নিভট্টর নির্দেশে
সুভদ্র সেখানেই শকট থামাল।
শকট থামতেই অগ্নিভট্ট দ্রুত নেমে এসে সেই
উঁচু জমির এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে কমণ্ডলু থেকে কিছু জল
ছিটিয়ে দিলেন। তারপর বললেন‚ ‘বৎস‚
তোমার শকটে যে ভল্ল রয়েছে‚ সেটি দিয়ে এখানে দ্রুত একটা গহ্বর তৈরি কর।’
জলাভূমির কাছে হবার কারণে মাটি তেমন কঠিন
নয়। সুভদ্র যথাসম্ভব দ্রুত বড় আকারের এক গভীর গর্ত সেখানে
খুঁড়ে ফেলল। দু’জন এরপর ধরাধরি করে শকট থেকে সেই কলসি এনে নামিয়ে দিল
সেই গর্তের ভিতর। অগ্নিভট্ট ফের বৈদিক
মন্ত্র উচ্চারণ করে তিনবার সেই কলসিতে অঞ্জলি দিলেন। তারপর কমণ্ডলু থেকে জল ছিটিয়ে সুভদ্রকে মাটি ফেলে গহ্বরটি ভাল
করে বন্ধ করতে আদেশ করলেন। নির্দেশ পালন হতে
উপরে ঘাসের চাপড়া বসিয়ে জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হল। সমস্ত কাজ শেষ হবার পরে ফের শকটে উঠে আচার্য অগ্নিভট্ট সুভদ্রকে
ফিরে যেতে আদেশ করলেন।
অরণ্য পার হয়ে সুভদ্রর অশ্বশকট তখন নগরের
নিকটবর্তী। সন্ধ্যার অন্ধকার
ইতিমধ্যে ঘন হয়ে উঠলেও পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারপাশ বেশ পরিষ্কার। সামান্য গলা ঝেড়ে নিয়ে অগ্নিভট্ট বললেন‚ ‘বৎস‚
যে পথে আমরা এসেছি সেই পথে নয়। একটু ঘুরে যেতে হবে। কাঁটাপাহাড়ের
পথ দিয়ে।’
চক্রস্বামী মন্দির থেকে রওনা হবার পর সুভদ্র
এ পর্যন্ত একটি কথাও বলেনি। নিঃশব্দে প্রতিটি
নির্দেশ পালন করে গেছে। এই প্রথম ব্যতিক্রম
হল। কাঁটাপাহাড়ের পথেই পড়ে মশান। ও পিছনে অগ্নিভট্টর দিকে ফিরে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল। অন্ধকারে জ্বলে উঠল চোখ। ‘আচার্যদেব‚ আপনার
এই নির্দেশ পালন করা সম্ভব নয়। ক্ষমা করবেন।’
‘ক–কেন?’ বলতে গিয়ে আচার্য অগ্নিভট্ট সামান্য থতিয়ে গেলেন।
‘কারণ আপনার উদ্দেশ্য
এই মুহূর্তে মহৎ নয়।’
হিমশীতল কণ্ঠে সুভদ্রর উত্তর‚ ‘অন্তত আমার জন্য।’
‘সূতপুত্র‚ এ আমার আদেশ।’
ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন অগ্নিভট্ট। কণ্ঠস্বরে যথেষ্টই উষ্মা। ‘মনে রেখ‚ স্বয়ং
সম্রাটও আমার নির্দেশ অমান্য করেন না। তোমার এই স্পর্ধায়
আমি বিস্মিত।’ দারুণ ক্রোধে অগ্নিভট্টের মুখ তখন রক্তিম বর্ণ।’
সুভদ্র অবশ্য বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। ধীর কণ্ঠে বলল‚ ‘জানি
আচার্যদেব। তবে ভুলে যাবেন
না‚ সূতপুত্র হলেও পিতা আমার অস্ত্রশিক্ষার কিছু ব্যবস্থা
করেছিলেন। তাছাড়া নিঃসহায়
বিধবা মায়ের জন্যও আমার বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে। তাই তেমন বুঝলে আপনাকে হত্যা করতে আমার বুক একটুও কাঁপবে না।’ বলতে
বলতে সুভদ্র হাতে ভল্ল তুলে নিল।
সেদিকে তাকিয়ে অগ্নিদেব মুহূর্তে গুটিয়ে
গেলেন। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন‚ ‘বৎস‚ তুমি বুদ্ধিমান। ঠিকই অনুমান করেছ‚ কলসিতে রয়েছে মন্দিরে সঞ্চিত স্বর্ণমুদ্রা। ওগুলির নিরাপত্তার কথা ভেবে গত কাল থেকে বড়ই চিন্তিত ছিলাম। মন্দিরে অন্যদের বিদায় দিয়েছিলাম ওই জন্যই। চক্রস্বামীর কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলাম‚ উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবার জন্য। তাঁরই তো সম্পদ এগুলি। তিনিই পাঠিয়েছেন তোমাকে। এরপর তোমাকে বাঁচিয়ে রাখলে ভগবান চক্রস্বামী আমাকে ক্ষমা করবেন
না। আমি তাঁর কাছে দায়বদ্ধ।’
‘তা ঠিক আচার্যদেব।’ স্থির
কণ্ঠে সুভদ্র বলল‚
‘আর তাই আমি ভগবান চক্রস্বামীর নামে শপথ
করছি‚ তাঁর এই ধনসম্পদ বোঝাই কলসের সন্ধান আমার কাছ থেকে দ্বিতীয়
কোনো ব্যক্তি জানতে পারবে না। আমি নিজেও কখনো
স্পর্শ করব না । আজ এই পূণ্যদিনের
সন্ধ্যায় শপথের সাক্ষী রইলেন স্বয়ং আকাশের পূর্ণচন্দ্র।’ কথা
শেষ করে সুভদ্র আকাশে পূর্ণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে দু’হাত জোড় করল।’
যে আশঙ্কা নগরের প্রতিটি মানুষকে উৎকণ্ঠিত
করে রেখেছিল‚
তা শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল পরের দিন। ভোর সকালে ঘোড়ার খুরে ধুলোর ঝড় তুলে হূন হানাদারের দল ঝাঁপিয়ে
পড়ল বৈরাট নগরের উপর। নগর রক্ষায় সামান্য
যে রক্ষীবাহিনী মজুত ছিল‚
তারা সেই আক্রমণ রোধ করতে পারেনি। তবে সৌভাগ্য‚ হানাদারেরা
নগরে বেশিক্ষণ অবস্থান করেনি। কারণ তারা সংখ্যায়
বেশি ছিল না। তার উপর পিছনে ধাওয়া
করে আসছিল শক্রদেবের সেনাদল। তবু সর্বনাশ কিছু
কম হয়নি। মৃত্যুর সংখ্যা
বেশি না হলেও লুঠ হয়েছে অধিকাংশ ধনী ব্যক্তির গৃহ। গবাদি পশু।
তবে সব ছাপিয়ে দাবানলের মতো যে সংবাদ সারা
নগরে ছড়িয়ে পড়ল তা হল‚
লুণ্ঠিত হয়েছে চক্রস্বামী মন্দিরও। নিহত হয়েছেন মন্দিরের আচার্য অগ্নিভট্ট এবং তাঁর পুত্র দেবভট্ট।
সেই বিকেলেই শক্রদেব তাঁর বাহিনী নিয়ে
নগরে ফিরে এলেন। সব শুনে থম হয়ে
রইলেন খানিক। বিচলিত হবার মতোই
সংবাদ। সপুত্র অগ্নিভট্টর
মৃত্যুই শুধু নয়। লুণ্ঠিত হয়েছে চক্রস্বামী
মন্দির। প্রথম গুপ্ত সম্রাট
স্বয়ং চন্দ্রগুপ্তর সময় থেকে এই মন্দিরে সম্রাটের তরফ থেকে নিয়মিত প্রণামী পড়ে আসছে। সর্বশেষ প্রণামী এসেছেন স্বয়ং সম্রাট স্কন্দগুপ্তর কাছ থেকে। মাত্র কয়েক দিন আগে। এছাড়া‚ বিভিন্ন সময়ে প্রণামী
এসেছে ধনী শ্রেষ্ঠীদের কাছ থেকেও।
শক্রদেবের সেনাবাহিনীর অবস্থা তখন ভাল
নয়। একের পর এক যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি প্রচুর। ভেবেছিলেন‚
কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিয়ে কিছু গুছিয়ে নেবেন। সৈন্য চেয়ে পাঠাবেন সম্রাটের কাছেও। আরও অর্থ। কারণ কয়েক দিনের
অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন‚
নতুন এই আক্রমণকারীদের সহজে দমন করা যাবে
না। কিন্তু নগরে ফিরে যা শুনলেন‚ তাতে আর অপেক্ষা করা সম্ভব হল না। লুঠ হওয়া মন্দিরের সম্পদ উদ্ধার করতে হলে আর এক মুহূর্তও সময়
নষ্ট করা যায় না। পরের দিন ভোর হতেই
নগর পাহারায় কিছু সৈন্য রেখে শক্রদেব ছুটলেন সেই হূন দলের খোঁজে।
দু’দিন পরেই খবর পাওয়া গেল‚ আক্রমণকারী সেই হূন দল শক্রদেবের হাতে পর্যুদস্ত হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি পালটা আক্রমণ হতে পারে ভাবতেই পারেনি তারা। রাতে এক পাহাড়ের আড়ালে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল‚ চন্দ্রালোকে শক্রদেবের বাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের
উপর। বন্দি হয়েছে হূন সেনাপতি হেরান। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হল‚ লুঠের অন্য সব উদ্ধার হলেও চক্রস্বামী মন্দিরের মূল স্বর্ণমুদ্রাগুলির
কিছুই তাদের কাছে পাওয়া যায়নি। হূন সর্দার হেরান
জানিয়েছে‚
তেমন কিছুই তারা মন্দিরে পায়নি।
বন্দিদের নিয়ে শক্রদেব পরের দিনই নগরে
ফিরে এলেন। বলা বাহুল্য‚ হূন সর্দারের কথা
বিশ্বাস করেনি তিনি। নগরে ফিরে পরামর্শের
জন্য ডেকে পাঠালেন বিশিষ্ট অমাত্যদের। দিন কয়েক ধরে হেরানকে
জেরা করা হল। কিন্তু নতুন কিছুই
তার কাছ থেকে প্রকাশ পেল না। শেষে দণ্ডনায়ক
(বিচারক) হূন সর্দার হেরানের প্রাণদণ্ডের বিধান দিলেন।
দণ্ডনায়ক যেদিন তাঁর রায় ঘোষণা করলেন ঘটনা
ঘটল তার পরের দিন। শক্রদেব সেদিন বড়ই
ব্যস্ত। নতুন অস্ত্র সংগ্রহের
জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন কর্মশালার অভিজ্ঞ লৌহকারদের। তাঁদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। ওই সময় সংবাদ বাহক এসে খবর দিল‚ বাইরে দাঁড়িয়ে এক আগন্তুক তাঁর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চায়। শক্রদেব তখন যথেষ্টই ব্যস্ত। তবু আগন্তুক সারথি কুবয়পুত্র শুনে ডেকে পাঠালেন।
একটু পরেই সুভদ্র তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। নতমুখে বলল‚ ‘দেব
আমি দণ্ডনায়কের কাছেই গিয়েছিলাম। এই সময়ে আপনাকে
ব্যস্ত করতে চাইনি। কিন্তু দেখা না
হওয়ায় আসতেই হল আপনার কাছে।’
‘সেজন্য চিন্তা করো
না সুভদ্র। তোমাকে সম্ভবত আগে
দেখিনি আমি। তবে তোমার পিতাকে
চিনি। এবার বল কী উদ্দেশ্যে এসেছ?’
‘দেব‚ হূন সর্দার হেরান চক্রস্বামী মন্দিরের স্বর্ণমুদ্রা অপহরণ করেনি। মিথ্যা অপবাদে তাঁর প্রাণদণ্ড হওয়া উচিত নয়।’
‘তুমি‚ তুমি কী করে জানলে।’
‘আমি জানি দেব। স্বয়ং আচার্য অগ্নিভট্ট সেদিন আমার শকটেই মন্দিরের স্বর্ণমুদ্রাগুলি
চক্রস্বামীর স্নানের কলসে ভরে অন্য এক গোপন স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
‘সেই কলস এখন কোথায়?’ প্রায় রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলেন শক্রদেব।
‘আচার্যদেব যেখানে
রেখেছেন‚
সেখানেই।’
‘তাহলে এখনই সেই
স্থানের সন্ধান জানাও। চক্রস্বামীর মন্দিরে
স্বয়ং সম্রাটের নিবেদন করা প্রণামীর স্বর্ণমুদ্রা ফের যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া আমাদের
কর্তব্য।’
‘তা যে সম্ভব নয়
দেব।’ দৃঢ়
কণ্ঠে সুভদ্র বলল‚
‘আচার্যদেবের কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দ্বিতীয় কাউকে সেই স্থানের সন্ধান জানাতে পারি না। এমনকী নিজেরও তা স্পর্শ করার উপায় নেই। তাই দ্বিতীয়বার ওই অনুরোধ করবেন না।’
সুভদ্রর সেই কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে শক্রদেব
প্রমাদ গণলেন। খানিক মৌন থাকার
পরে নরম গলায় বললেন‚
‘কিন্তু ভেবে দেখ‚ স্বয়ং সম্রাটের নিবেদন করা চক্রস্বামী মন্দিরের প্রণামী কী মন্দিরে
থাকাই শ্রেয় নয়? সেজন্য
যদি প্রতিজ্ঞা–ভঙ্গ
হয়‚ চক্রস্বামী নিশ্চয় তোমাকে ক্ষমা করবেন।’
‘দেব।’ অল্প
মাথা নাড়ল সুভদ্র। ‘সেদিন
আচার্যদেব আমার সামনে পবিত্র বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে সেই কলস ভগবান চক্রস্বামীর উদ্দেশ্যে
ওই স্থানে গচ্ছিত রেখে গেছেন। তাই স্বয়ং চক্রস্বামীর
জিম্মাতেই রয়েছে সেগুলি। মন্দিরে ফিরিয়ে
আনার কী প্রয়োজন? যাঁর
সম্পদ‚
তিনি ইচ্ছা করলে নিজেই সন্ধান দেবেন। আর সেই সম্পদ যখন অন্য প্রয়োজনে কারো ব্যয় করার অধিকার নেই‚ তখন যেমন রয়েছে তেমন থাকাই ভাল। নয় কী?’
সেই কথায় শক্রদেবের মুখ হঠাৎ রক্তিম হয়ে
উঠল। সুভদ্রর কথায় কিছুমাত্র ভুল নেই। একদিন আচার্য অগ্নিভট্টর কাছে এই অর্থের কিছু অংশ তিনি সেনা
সংগ্রহের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। সেদিন তিনি সম্মত
হলে যথাসময়ে উপযুক্ত সংখ্যায় সেনাবাহিনী প্রস্তুত করতে পারতেন। হয়তো নগরের আজ এই দুর্দশা হত না। পুত্র সহ তাঁর নিজের প্রাণটাও বাঁচত। মৃদু মাথা নেড়ে সুভদ্রর কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। ‘সুভদ্র‚ তোমার
পিতার কাছে শুনেছি‚
আচার্য সারঙ্গদেবের কাছে তুমি অস্ত্রশিক্ষা
করেছ। কিন্তু তার থেকেও বড় পরিচয় তুমি নিজের কাজেই ব্যক্ত করেছ
আজ। বর্বর হূন আক্রমণ বিনাশ করতে হলে উপযুক্ত এক সেনাবাহিনী
আমাদের গড়ে তুলতে হবে। তোমার মতো যোদ্ধার
বড় দরকার।’
উত্তরে সুভদ্র মাথা ঝাঁকিয়ে বলল‚ ‘দেব‚ এ আমার পরম সৌভাগ্য।’
এই কাহিনী এখানেই শেষ নয় অবশ্য। তবে সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে জানিয়ে রাখি‚ সেদিন
এদেশের উপর নেমে আসা হূন আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করেছিলেন গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্ত। পরবর্তী প্রায় পঞ্চাশ বছর হূন বাহিনী এদেশে আর হানা দিতে সাহস
পায়নি। স্কন্দগুপ্তর সেই
কৃতিত্ব ইতিহাসে স্বর্ণ অক্ষরে লেখা আছে। লেখা
নেই‚ শক্রদেব আর তাঁর তরুণ সেনাপতি সুভদ্রর কথা। মূলত যাঁদের কৃতিত্বে সম্রাট স্কন্দগুপ্ত এই কঠিন কাজে উত্তীর্ণ
হতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে সুভদ্র
উজ্জয়িনী নগরের প্রধান সেনাপতির পদেও নিয়োজিত হয়েছিলেন। সেদিন বসন্ত উৎসবের সন্ধ্যায় পূর্ণচন্দ্রকে সাক্ষী রেখে যে শপথ
তিনি করেছিলেন‚ তা কোনোদিনই ভঙ্গ করেননি। সেই স্বর্ণভাণ্ডারের সন্ধানও মেলেনি।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলি দিন। প্রায় দেড় হাজার বছর। এই
সেদিনের কথা‚ ১৯৪৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলেও তার রেশ তখনো যায়নি। যুদ্ধের সময় জারি হওয়া ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে দেশিয় রাজারা
নিজেদের সেনাবাহিনী তৈরি রাখার জন্য নিয়মিত কুচকাওয়াজ‚ চাঁদমারি চালু রেখেছেন। বর্তমান উত্তর প্রদেশে তৎকালীন ভরতপুর স্টেটের মহারাজা স্যার
বরেন্দ্র সিংজীর সৈন্যদের জন্য এমনই এক চাঁদমারির আয়োজন হয়েছিল বায়না জংশন স্টেশনের
কাছে হুল্লানপুর গ্রামের অদূরে অনুচ্চ পাহাড় ঘেরা একটি পতিত জলাভূমিতে।
চাঁদমারি শেষ করে সৈন্যদল চলে যাবার কয়েকদিন
পরে পোড়া কার্তুজের খোঁজে কাছেই এক গ্রামের তিনটি ছেলে হাজির হয়েছিল সেখানে। পোড়া কার্তুজের পেতলের খোল কালোয়ারদের কাছে বিক্রি হয়। খুঁজতে খুঁজতে ওরা এসে পৌঁছল ঝোপঝাড়ে পূর্ণ অনুচ্চ এক মাটির
বাঁধের কাছে। হাতের লাঠি দিয়ে
ঝোপের ভিতর খোঁচাখুঁচি শুরু করতেই লাঠির ডগা নরম মাটির সামান্য নীচে শক্ত কিছুতে গিয়ে
ঠেকল। কৌতূহলী হয়ে সেই মাটি সামান্য খুঁড়তেই বের হয়ে পড়ল একদিকে
লম্বা নল লাগানো বড় এক তামার কলসি। শক্ত করে আঁটা মুখের
ঢাকনা সরাতে দেখা গেল ভিতরে একরাশ ঝকঝকে নিরেট সোনার চাকতি। প্রাচীন কালের স্বর্ণমুদ্রা।
সৌভাগ্য‚ লোকমুখে
কয়েক দিনের মধ্যেই সেই সংবাদ এসে পৌঁছল ভরতপুরের মহারাজার কাছে। রক্ষীবাহিনী পাঠিয়ে দ্রুত দখল নেওয়া হল সেই কলসির। ততদিনে বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা গলিয়ে ফেলা হয়েছে। তবু যা পাওয়া গেল‚ তার সংখ্যাও কম
নয়। মোট ২১০৬টি। প্রতিটি
দেড় হাজার বছর আগে গুপ্তযুগের। সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্ত
থেকে শুরু করে স্কন্দগুপ্তর আমল পর্যন্ত। দেখেই
বোঝা যায়‚
তাদের বেশির ভাগই আনকোরা নতুন। মিন্ট থেকে বের হয়ে সাধারণের হাতে পড়ার আগেই জমা হয়েছে এখানে। তাই বহু ব্যবহারে জীর্ণ নয়। এযাবতকাল সারা দেশে গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রা যথেষ্টই পাওয়া গেছে। কিন্তু এমন নিখুঁত ঝকঝকে অবস্থায় অন্য কোথাও মেলেনি।
মহারাজা স্যার বরেন্দ্র সিংজী বিদ্যোৎসাহী
মানুষ ছিলেন। তাঁর অনুরোধে তৎকালীন
খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ড. সদাশিব আলটেকার মুদ্রাগুলির উপর ব্যাপক গবেষণা করে প্রকাশ করেছিলেন
গুপ্ত যুগের অনেক অজানা নতুন তথ্য। তাঁর সেই গবেষণালব্ধ
গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। সেই সংকটময় সন্ধ্যায়
সুভদ্র যে শপথ নিয়েছিল‚ তার চূড়ান্ত ফসল।
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
১২/৫/২০১৭
Anoboddo......asadharon..
ReplyDeleteDarun
ReplyDeleteVery informative story.
ReplyDeleteVery informative story
ReplyDeleteDarun... Onek kichu jante parlam..
ReplyDeleteঅসাধারণ একটি গল্প পড়লাম। ধন্যবাদ শিশিরদা।
ReplyDeleteKhub bhalo laglo pore.
ReplyDelete