অবসরের দিন
শিশির বিশ্বাস
৩১শে ডিসেম্বর, বছরের শেষ দিন আজ। ভরদ্বাজ চৌধুরীরও চাকরি জীবনের শেষ দিন। অবসর
নেবেন আজ। দপ্তরে ঢুকেছিলেন সেই সাঁইত্রিশ বছর আগে। সেদিন থানায় জয়েন করার পর ও.সি
মুখার্জী সাহেব ওর দিকে অল্প তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘বয়স বেজায় কম দেখছি বাপু! কোথায় বন্ধুদের
সঙ্গে আড্ডা দেবে, ঢুকে পড়লে পুলিশ দপ্তরে! এখানে ছুটি নেই হে! ডিউটি বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি
দিন।’
‘জানি সার।’ অল্প ঘাড় নেড়েছিল ভরদ্বাজ চৌধুরী।
রাশভারী মুখার্জী সাহেব কিছু বলেননি আর। থানার সিনিয়র এস.আই চক্রবর্তী সাহেবকে
ডেকে বলেছিলেন, আমাদের নতুন এস.আই। শিখিয়ে–পড়িয়ে নাও।’
সেই মুখার্জী সাহেব তার মাস কয়েক পরে চেম্বারে ডেকে পাঠিয়ে অবাক হয়ে বলেছিলেন,
‘কী ব্যাপার হে! গত সাত মাসে একটা দিন ছুটি নাওনি!’
‘দরকার হয়নি সার।’
‘সামনের পুজোতেও তো সবচেয়ে টার্ফ ডিউটিগুলো তোমাকেই দেওয়া হয়েছে দেখছি!’
‘সেজন্য অসুবিধা নেই সার।’
শুধু ছুটি নয়, মুখার্জী সাহেব ততদিনে আরো অনেক কিছুই জেনে ফেলেছেন থানার এই
নতুন এস.আই–এর ব্যাপারে। বাবা হঠাৎ মারা যাবার পর মা, ছোট তিনটি বোনের দায় সামলাতে
ল পড়তে পড়তেই ছুটতে হয়েছে চাকরির খোঁজে। খানিক নীরব থেকে নরম গলায় বলেছিলেন, ‘ভরদ্বাজ,
এ দপ্তরে কোনো ভবিষ্যৎ নেই তোমার। অথচ যোগ্যতা রয়েছে। আইনের ডিগ্রিও হয়তো পেয়ে যাবে।
চেষ্টা করলে আরো ভাল চাকরি জুটিয়ে নিতে পারবে।’
‘চেষ্টা করব সার।’
মুখার্জী সাহেব অন্তর্যামী ছিলেন বোধহয়! এই সাঁইত্রিশ বছরে তারপর একটি প্রমোশনও
হয়নি ভরদ্বাজ চৌধুরীর। ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষায় দু–দুবার পাশ করেও পোস্টিং মেলেনি কনফিডেনসিয়াল–রিপোর্ট
বেজায় খারাপ হবার কারণে। সেটার শুরু অবশ্য সেই প্রথম বছরেই। বিদেশ থেকে সোনা পাচারের
একটা কেস লিখতে বসেই টের পেয়েছিলেন, পার্টির টিকি অনেক উপর মহলে বাঁধা। কিন্তু পরোয়া
করেননি। ইংরেজিটা গুছিয়ে লিখতে জানতেন। আইনও পড়া। কেস ডায়রিতে ফাঁক রাখেননি কোথাও।
তবু বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছিল পার্টি। ওদিকে মুখার্জী সাহেবকে কথা দিলেও অন্য কোথাও
সেভাবে চেষ্টা করার সুযোগ হয়নি। বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন যে মানুষটার অফিসে কামাই নেই।
কাজের চাপে দম ফেলার ফুরসুত মেলে না, অন্য কোথাও যে চেষ্টা করবে, সেই সময় কোথায়? তারপর
ভাল পাত্র দেখে একে একে তিনটে বোনের বিয়ে। কম মেহনত করতে হয়নি সেজন্য।
বোনেদের বিয়ের কাজ শেষ হবার পর মা অবশ্য ভেবেছিলেন, ছেলের বিয়ে দেবেন এবার।
বয়স হয়েছে। এতদিন মেয়েরা ছিল। এখন বাড়ি একেবারে ফাঁকা। একজন মানুষ তো দরকার। কিন্তু
ততদিনে ছেলের মনের ভিতরেও যে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, সেই খোঁজ রাখেননি তিনি। আসলে
ভরদ্বাজ বরাবরই কিছু অন্তর্মুখী। বাড়িতে বাবা বা মায়ের কথা অমান্য করেনি কখনো। সেই
মানসিকতাও ছিল না। বাবা হঠাৎ মারা যাবার পর চাকরিটাও খুব দরকার ছিল। প্রায় হন্যে হয়ে
পড়েছিল একটা চাকরির জন্য। সত্যি একটা চাকরি না পেলে উপায় ছিল না তখন। তারপর পুলিশে
চাকরিটা যখন হল, শুধু মা নয়, নিজেও খুশি হয়েছিল কম নয়। একটা কনস্টবলের চাকরি পেলেও
যখন সংসারটা রক্ষা পায়, তখন একেবারে এস.আই, আনন্দ হবারই কথা। সেই প্রথম দিন মুখার্জী
সাহেব যখন কথাগুলো বলেছিলেন, স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর বেরিয়ে এসেছিল একেবারে অন্তর থেকে।
তবে মনের সব কথা সেদিন বলতে না পারলেও চেষ্টায় খামতি রাখেনি। তারপর কবে যে অফিসের সঙ্গে
নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছে টেরও পায়নি। মা বিয়ের কথা বলতে শুধু বলেছিল, ‘দেখতেই তো পারছ
মা, পুলিশের চাকরি! সারাদিন অফিসে পড়ে থাকি। বিয়ে করলে তাঁকেও তো সময় দিতে হবে!’
ছেলের কথায় সেই প্রথম ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন মা, ‘বাজে কথা বলিসনি। পুলিশে কেউ যেন
চাকরি করে না! কে তোর মতো সারাদিন অফিস নিয়ে থাকে! কত কাজ সেখানে? তারা বিয়ে–থা করে
না? তাদের ঘর–সংসার নেই!’
ভরদ্বাজ বরাবরই কিছু ভিন্ন গোত্রের মানুষ। ছেলেকে নিয়ে তাই কোনোদিনই ভাবনা ছিল
না বাবা–মায়ের। জানতেন, ক্লাসে ফার্স্ট–সেকেন্ড হতে না পারলেও পাশ ঠিকই করে যাবে। বরং
যত ভাবনা ছিল মেয়েদের নিয়ে। বাড়িতে মাস্টারও রাখা হয়েছিল তাদের জন্য। ভরদ্বাজের তখন
ল কলেজে শেষ বছর। বাবা হঠাৎই মারা গেলেন। প্রায় দিশেহারা মা সেই প্রথম ছেলের কাছে কেঁদে
পড়েছিলেন, ‘বাবা, পড়াশুনা বাদ দে এবার। একটা চাকরিতে না ঢুকলে আর যে বাঁচার উপায় নেই!
সবই তো জানিস, তোর বাবা সামান্য চাকরি করতেন। কিছুই রেখে যেতে পারেননি। নেই পেনশন।
এতগুলো মানুষের পেট, তিনটে বোনের লেখাপড়ার খরচ, ওদের বিয়েও তো দিতে হবে।’
ইচ্ছে ছিল ল পাশ করে ডবলিউ.বি.সি.এস পরীক্ষায় বসবে। চেষ্টা করবে আই.এ.এস পরীক্ষা
দেবার। বইপত্র জোগাড় করে ক্লাসের পড়ার ফাঁকে শুরুও করে দিয়েছিল। কিন্তু সেসব হয়নি আর।
মায়ের কথায় মাথা নেড়েছিল শুধু। একটি কথাও ভুল বলেননি মা। তিন বোন বয়সে অনেকটাই ছোট
ওর থেকে। ছোট নিরু মাত্রই দশে পড়েছে এবার।
মেধাবী বলতে যা বোঝায়, ভরদ্বাজ চৌধুরী কোনোদিনই তা ছিল না। শুধু জানত, চেষ্টা
আর অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। বাড়িতে মাস্টারও ছিল না কোনোদিন। থাকলে রেজাল্ট ভাল করতে
পারত আরো। কিন্তু বাবাকে বলতে পারেনি সেকথা। ওরাও জানতেন, বছর গেলে ছেলের পাশ আটকাবে
না। কিন্তু সেজন্য যে কী ভয়ানক মেহনত তাকে করতে হয়েছে জানতে পারেনি কেউ। ব্যতিক্রম
হয়নি চাকরির ক্ষেত্রেও। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে একের পর এক চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করে গেছে।
সেজন্য শুধু খরচই নয়, হ্যাপাও অনেক। মার কাছে চাওয়ার উপায় ছিল না। কলেজে পড়ার ফাঁকে
গোটা দুয়েক টিউশনি করে খরচ জুটিয়ে নিয়েছে। তবু শিকে ছেঁড়েনি। ক্রমে বুঝেছে চাকরি আর
ক্লাসের পরীক্ষায় পাশ, এক ব্যাপার নয়। এখানে খুঁটির জোরটাও দরকার। কিন্তু সেজন্য দমে
না গিয়ে বাকি ব্যাপার, যেটা নিজের হাতে রয়েছে সেটাকেই আঁকড়ে ধরেছিল আরো।
যেমন তেমন একটা চাকরীর জন্য প্রায় মরণপণ লড়াই। যত ব্যর্থ হয়েছে জেদ বেড়েছে আরো।
আরো বেশি করে তৈরি করেছে নিজেকে। যে করেই হোক চাকরি একটা পেতেই হবে। প্রতি বছর ক্লাসের
পরীক্ষার মতো ভরদ্বাজের সেই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়নি। কলকাতা পুলিশে চাকরির
চিঠি যেদিন বাড়িতে এল, মা বলেছিলেন, অফিসে মন দিয়ে কাজ করিস বাবা।
বিয়ের প্রসঙ্গে সেই মায়ের মুখে অন্য রকম শুনেও ভরদ্বাজ বরাবরের মতো সেদিনও সামান্য
প্রতিবাদ করেনি ঠিকই। তবে সম্মতিও দেয়নি। আসলে অফিসের কাজে ডুবে জীবনের ধারা ততদিনে
বদলে গেছে আমূল। ঝড়ঝাপটা তো কম সইতে হয়নি এযাবৎ। বাড়িতে জানতেও পারেনি কেউ।
প্রথম কয়েক বছর তো প্রায় ঝড় বয়ে গেছে। যতদিন মুখার্জী সাহেব ছিলেন তেমন বুঝতে
দেননি। কিন্তু অবস্থাটা বদলাল তারপরেই। হঠাৎই একদিন ডাক পড়ল নতুন ও.সি সাহেবের ঘরে।
ঘরে ঢুকতেই খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি, ‘কী ব্যাপার হে ছোকরা, দিন পিছু এক দিস্তে করে এফ.আই.আর!
কেউ এফ.আই.আর করতে এলেই নিয়ে নিতে হবে!’
গোড়ায় ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হয়নি ভরদ্বাজের। থতমত খেয়ে বলেছিল, ‘বরাবর তাই
তো করি সার! সমস্যায় পড়েই তো ওনারা থানায় ছুটে আসেন।’
‘তারপর এসব ফালতু হ্যাপা সামলায় কে?’
‘কেন সার, আমি! অন্য কারো সময় না হলে আমি নিজেই ইনভেস্টিগেশনে যাই।’
‘সময় পাও?’
‘সে করে নিতে হয় সার। রাত দশটার পরেও গেছি কত দিন।’
চাকরির প্রথম বছরে সেই ঘটনাটার কথা ভরদ্বাজ চৌধুরীর মনে পড়ে গিয়েছিল ওই মুহূর্তে।
সেদিনও থানার বড়বাবু মুখার্জী সাহেব ঘরে ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘আরে ছেলে রোজ এতগুলো
করে এফ.আই.আর নিলে অন্য কাজ সামলাবে কী করে?’
‘সে সামলে নেব সার। একটু বেশি দৌড়ঝাঁপ করতে হবে হয়তো। তবে ওসব অভ্যাস আছে আমার।’
‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু এত এফ.আই.আর নিলে কোর্ট ইন্সপেক্টরেরও তো কাজ বাড়ে। থানারও
বদনাম।’
মাত্র মাস কয়েক চাকরি হলেও এসব তখন জানতে বাকি নেই ভরদ্বাজ চৌধুরীর। মাস গেলেই
কমিশনার সাহেবের অফিসে মিটিং। থানায় নতুন আর পুরনো কেসের হিসেব নিয়ে হাজির থাকতে হয়
থানার বড়বাবুদের। নতুন কেসের সংখ্যা অতিরিক্ত হলেই থানার বদনাম। দিতে হয় হাজারো কৈফিয়ত।
আসলে কোন থানার কী পারফরমেন্স, উপরওয়ালাদের কাছে তার বিচার হয় থানায় করা এফ.আই.আরের
সংখ্যা দিয়ে। থানায় এফ.আই.আরের সংখ্যা যত বেশি, পারফরমেন্স তত খারাপ বলে গণ্য হয়। কনফিসেডনসিয়াল
ফাইলে এন্ট্রিও হয়ে যায় কখনো। প্রমোশনের দফারফা। অগত্যা মুখার্জী সাহেবের সমস্যা বুঝতে
অসুবিধা হয়নি। উত্তরে মাথা নিচু করে অল্প ঘাড় নেড়েছিল ভরদ্বাজ চৌধুরী, তা ঠিক সার।
তবে সমস্যায় পড়ে থানায় কেউ এফ.আই.আর করতে এলে না নিয়ে কী করি বলুন?
মুখার্জী সাহেব থানার নতুন এই এস.আই.কে চিনে ফেলেছিলেন। অল্প মাথা নেড়েছিলেন
শুধু। কিন্তু নতুন বড়বাবু তো আর মুখার্জী সাহেব নন। ভরদ্বাজ চৌধুরীর উত্তরে প্রায় খেঁকিয়ে
উঠেছিলেন এরপর। ‘ব্যস, ব্যস। এখন থেকে আর চলবে না ওসব। আন্ডারস্ট্যান্ড?’ অশ্লীল একটা
গালিও জুড়ে দিয়েছিলেন সঙ্গে। থানায় এসব গালি অবশ্য অতি সাধারণ ব্যাপার। কিছু মনে করে
না কেউ। গায়ে মাখেনি ভরদ্বাজ চৌধুরীও। নতুন বড়বাবুর ক্ষোভের কারণ যখন অকারণ নয়।
আসলে আগের মুখার্জী সাহেব কিছু অন্য রকম মানুষ ছিলেন। কমিশনার সাহেবকে হয়তো
বোঝাতে পেরেছিলেন, এফ.আই.আরের সংখ্যা বেশি হলেও কেস পেনডিং থাকে না। প্রপার ইনভেস্টিগেশন
করে কোর্টে রেফার করে দেওয়া হয়। কিন্তু সবাই তো তেমন মাপের নয়। নতুন ও.সিকে তাই দোষ
দিতে পারেনি।
দুর্ভাগ্য, নতুন ও.সির ওই নির্দেশের পর চেষ্টা করেও ভরদ্বাজ চৌধুরী এফ.আই.আরের
সংখ্যা তেমন কমাতে পারেননি। অগত্যা বড়বাবুর ঘরে ডাক পড়েছিল ফের। ভরদ্বাজ চৌধুরী সেদিন
অবশ্য ভনিতা না করে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তার অক্ষমতার কথা।
অগত্যা থানাতেই বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর পানিসমেন্ট ট্রান্সফার। তারপর একে
একে অনেক কিছুই ঘটে গেছে ভরদ্বাজ চৌধুরীর কর্ম জীবনে। একাধিকবার সেনশার, শোকজ ছাড়াও
বসিয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশ লাইনে। ক্লোজ করা হয়েছে বার কয়েক। কিন্তু কোনো কিছুতেই পরিবর্তন
হয়নি মানুষটির। পরে অবশ্য সেই থানাতেই ফিরিয়ে আনা হয়েছে আবার। কারণ আর কিছু নয়, ইতিমধ্যে
গোটা দপ্তরে রাষ্ট্র হয়ে গেছে, এস.আই ভরদ্বাজ চৌধুরী যে থানায় পোস্টিং হয়েছে সেখানেই
চাউর হয়ে গেছে, অন্যায় করে রেহাই পাওয়া যাবে না। অগত্যা উটকো ঝামেলা কমে গেছে অনেক।
একবার তো এক থানা থেকে ট্রান্সফার হবার পরে ব্যাপারটা চাউর হতেই প্রায় হাজার খানেক
মানুষ এসে থানা ঘেরাও করে ফেলেছিল। শেষ পর্যন্ত যে ভয়ানক কিছু ঘটেনি, তার মূলেও ওই
ভরদ্বাজ চৌধুরী। খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। থানার গেটে দাঁড়িয়ে প্রায়
ধমকে বিক্ষুব্ধ মানুষগুলোকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সেই মানুষকে অস্বীকার করার উপায় কী? অগত্যা প্রমোশন না হলেও বিভিন্ন থানাতেই
কেটে গেছে ভরদ্বাজ চৌধুরীর গোটা চাকরি জীবন। শুধু কাজ আর কাজ। বিয়ে, ঘরসংসার এসবের
জায়গা ছিল না একেবারেই। খোঁজ রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি বাড়িতে মা আর বোনেরাও।
বিয়ের ব্যাপারে মা অপারগ হতে এরপর আসরে নেমেছিল বোনেরা। চেষ্টা তারাও কম করেনি।
হোক না সামান্য এস.আই। একটা প্রমোশনও হয়নি। তবু তো থানার অফিসার। মেয়ের অভাব কী! কয়েটি
ভাল খোঁজও এনেছিল তারা। তারপর দাদার ভাবগতিক দেখে এ বাড়িতে আসাই ছেড়ে দিয়েছিল পরে।
কোনো সম্পর্কও রাখেনি। দাদার জন্য তাদের নাকি সম্মানের হানি হয়েছে। এক জায়গায় কথা দিয়েও
রাখতে পারা যায়নি। এ ব্যাপারে মা নিজেও মেয়েদের পক্ষ নিয়েছিলেন। সেই জল তারপর গড়িয়েছিল
অনেক দূর পর্যন্ত। ছেলের উপর রাগ করে মা–ও চলে গিয়েছিলেন মেয়েদের কাছে। ইন্ধন ছিল তাদেরও।
তার উপর এক জামাই খবর এনেছিল, ভরদ্বাজদার নাকি খারাপ পাড়ায় যাওয়া–আসা আছে। তাই বিয়ের
গরজ নেই।
মা তিন মেয়ের কাছে পালা করে থাকতেন তারপর। সেই মার যখন ক্যান্সার ধরা পড়ল, মেয়েরাই
মাকে ফের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাদের ঘর–সংসার আছে। এই অবস্থায় মায়ের দেখভাল, চিকিৎসার
খরচ সামলানো সম্ভব নয়। দাদা যখন ঝাড়া হাত–পা, সরকারী চাকরি, তিনিই ভাল পারবেন।
ততদিনে অফিস তথা থানার হরেক কাজে আরো বেশি করে সঁপে দিয়েছেন ভরদ্বাজ চৌধুরী।
সারাদিন প্রায় অফিসেই কেটে যায়। বাড়িতে খুব সামান্য সময়। অগত্যা মায়ের জন্য সর্বক্ষণের
এক কাজের মেয়ে রাখতে হয়েছিল। পাশের বস্তির রহিমা বিবি। স্বামীকে খুনের দায়ে কুড়ি বছরের
জেল হয়েছিল। সেই কেস ফাইল করেছিলেন ভরদ্বাজ চৌধুরীই। আর শুধু থানা কেন, আসামিকুলও ততদিনে
জেনে ফেলেছিল এস.আই ভরদ্বাজ চৌধুরীর কেস ফাইল মানে উকিলের বাপ–ঠাকুরদার ক্ষমতা নেই,
আসামীকে বাঁচাতে পারে। শাস্তি হয়ে গিয়েছিল রহিমা বিবিরও। কিন্তু জেলে ভাল রেকর্ডের
দরুন তেরো বছরের বেশি থাকতে হয়নি। ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। জেল থেকে বের হয়ে সেই রহিমা একদিন
কেঁদে পড়েছিল ভরদ্বাজ চৌধুরীর কাছেই, আগে বাড়ি বাড়ি কাজ করে দিন চলত। এখন জেল ফেরত
কয়েদি, কেউ তাকে কাজে রাখতে ভরসা পায় না। সাহেব যদি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারেন।
বাড়িতে অসুস্থ মা। সারাদিন তাকে বাইরেই থাকতে হয়। কোনোক্রমে ঠেকা দিয়ে চালাতে
হচ্ছিল। ভরদ্বাজ চৌধুরী এরপর আর দ্বিতীয়বার ভাবেননি। এক কথায় রহিমা বিবিকে বাড়িতে বহাল
করে দিয়েছিলেন। একেবারে সর্বক্ষণের জন্য। রহিমা বিবির মতো একজনকে সর্বক্ষণের জন্য বাড়িতে
বহাল করার পর আপত্তি উঠেছিল অনেক জায়গা থেকেই। শুধু অফিস নয়, খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল
বোনেরা পর্যন্ত। কাজটা একেবারেই ঠিক করেনি দাদা। একবার যে খুনের দায়ে অভিযুক্ত, সেই
মানুষ আবার যে কিছু করে ফেলবে না, তার নিশ্চয়তা কী! তার উপর অসুস্থ মা ছাড়া বাড়িতে
অন্য কেউ থাকে না।
ভরদ্বাজ চৌধুরী অবশ্য কান দেননি সেসব কথায়।
মা তারপর ওই অবস্থায় ভুগেছেন অনেক দিন। প্রায় বছর চারেক। রহিমা বিবির দরুন মাকে
নিয়ে একেবারেই সমস্যায় পড়তে হয়নি। ব্যাঘাত ঘটেনি অফিসের কাজেও। তারপর অবশ্য ঝাড়া হাতপা।
ভেবেছিলেন রহিমাকেও ছাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু রহিমা বিবিই ছাড়েনি। ঠিকে কাজের মানুষ হিসেবে
বহাল রয়েছে তারপর থেকে। ভোর সকালে এসে সব কাজ, রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। তারপর রাতে
আসে আবার। ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি দেওয়া আছে। রাতের রান্না করে দিয়ে যায়। রহিমা বিবির
দৌলতে ভরদ্বাজ চৌধুরী এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। রাতের খাওয়া নিয়ে ভাবতে হয় না। সব পরিপাটি
করে ঢাকা দেওয়া থাকে। মাইক্রো ওভেনে গরম করে নিলেই হল। তবে নতুন এক উপসর্গ জুটে গেছে।
ই.সি.জি রিপোর্টে অনেক গোলমাল। তবে তা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাননি। কেউ সাবধান করতে
এলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছেন, ‘আর তো মাত্র কয়েকটা মাস ভাই।’
তা সেই কয়টা মাসও শেষ হয়ে গেল আজ। চাকরির শেষ দিন। বের হয়ে পড়তে পারতেন আগেই।
কিন্তু পেনডিং কিছু পেপার ওয়ার্ক সারতে সময় লাগল। প্রায় দশটা। অন্যদিন থানার গাড়ি বাড়ি
পৌঁছে দিয়ে আসে। আজ নিজেই মানা করেছেন। রিটায়ার করেছেন যখন, দপ্তরের গাড়ি আর নেবেন
না। বের হবার আগে ইউনিফর্মও খুলে ফেলেছেন। তবু সবে পথে নেমেছেন, এক ভ্যান ড্রাইভার
দেখতে পেয়েই পাশে গাড়ি থামাল। ‘পার্ক সার্কাসের দিকেই যাচ্ছি সার। মোড়ে নামিয়ে দিতে
পারব।’
ভ্যান ড্রাইভার রহমানকে ভালই চেনেন ভরদ্বাজ চৌধুরী। মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে
না করতে পারলেন না। পার্ক সার্কাস মোড় থেকে বাড়ি বেশি দূরে নয়। উঠেই বসলেন।
রহমান গাড়িতে ফের স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘সার শুনলাম আপনি আজ রিটায়ার করেছেন?’
‘করেছি তো। তুমি কী করে জানলে?’
‘আপনি রিটায়ার করছেন, আর জানব না? অনেকেরই মন খারাপ। বলছিল, অমন অফিসার আর হবে
না। আপত্তি করবেন না সার। আজ আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেব।’
‘একদম নয় ভাই। তাছাড়া মোড়ে সামান্য কেনাকাটার ব্যাপারও আছে। একটু দোকানে যেতে
হবে।’
বেচারা রহমান কথা বাড়াতে সাহস পায়নি তারপর। পার্ক সার্কাস মোড়ের কাছে গাড়ি থামাতে
নেমে পড়েছে ভরদ্বাজ চৌধুরীও। অল্পই এগিয়েছেন তারপর, হঠাৎই রাস্তার উলটো দিকে চিৎকার–চ্যাঁচামেচির
শব্দ, চোর চোর, ছিনতাই। ধরুন–ধরুন।
বছরের শেষ দিন। এই শীতের রাতেও পথে মানুষ কম নয়। চওড়া সি.আই.টি রোডের উলটো দিকে
এক মহিলা তারস্বরে চিৎকার করে চলেছেন, তাঁর গলার সোনার চেন ছিঁড়ে নিয়ে দৌড় লাগিয়েছে
একজন।
লোকটা ততক্ষণে পাশের গলিতে ঢুকে পড়ার মুখে। এদিকে ছিনতাইবাজ সবাই তাঁর চেনা।
অল্প আলোতেও পিছন থেকে লোকটার দৌড় দেখে চিনতে পারলেন, আলতাফ। এমন অবস্থায় ভরদ্বাজ চৌধুরীকে
কেউ নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখেনি। আজও ব্যতিক্রম হল না। ছুটলেন পিছনে। লোকটা ততক্ষণে সরু
গলির অনেকটাই ভিতরে। ধরে ফেলতে বেগ পেতে হত না। এমন ছিনতাইবাজ জীবনে নেহাত কম ধরেননি।
কিন্তু আজ বছরের শেষ দিনে এই রাতেও সি.আই.টি রোডে গাড়ির সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। পার হতে
সময় লাগল। যখন গলির মুখে পৌঁছলেন, লোকটা অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়েছে। সেজন্য পরোয়া করলেন
না অবশ্য। এ–গলির অনেকেই তাঁর পরিচিত। তার উপর নতুন থানায় জয়েন করলে অল্প দিনের মধ্যেই
মানুষ জেনে যায়, এস.আই ভরদ্বাজ চৌধুরীর জেদ বড় ভয়ানক। একবার মনস্থির করলে ছাড় নেই আর।
কিন্তু বুকের ব্যথাটা হঠাৎই টের পাচ্ছিলেন যেন। কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাসেও। তবে সেজন্য
পরোয়া না করে গতি বাড়িয়ে দিলেন আরো। তারপরেই হঠাৎ কিছুতে পা আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু সামলে নিতে পারলেন শেষ পর্যন্ত। ওকে ছুটতে দেখে পিছনে দৌড়ে আসছিল আরো কয়েকজন।
তাঁদের হইচই হঠাৎই বাড়ল। কিন্তু হাতে সময় নেই। ছোটার গতি বাড়িয়ে ভরদ্বাজ চৌধুরী লোকটাকে
ধরতে পারলেন এবার। আলতাফ তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রায় আঁতকে উঠল যেন।
‘স–সার!’
লোকটা অবশ্য এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেনি তারপর। হাতের সোনার চেন ফেলে দিয়ে এক
ঝটকায় ভরদ্বাজ চৌধুরীর হাতের মুঠো গলে ছুট লাগাল আবার।
ব্যাপারটায় কিছু অবাকই হলেন ভরদ্বাজ চৌধুরী। তার মুঠো গলে এভাবে আজ পর্যন্ত
কোনো দুষ্কৃতি পালাতে পারেনি। তবে তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালেন না। লোকটাকে চেনা গেছে
যখন ব্যবস্থা পরেও করতে পারবেন। অতঃপর পায়ের কাছে ফেলে যাওয়া চেনটা তুলতে যাচ্ছিলেন,
কেমন থতমত খেয়ে গেলেন। চেনটা গলে গেল আঙুলের ফাঁক দিয়ে। সোনার চেনটা যথেষ্ট সরু যদিও,
তাহলেও সামান্য কাজটা কেন পারছেন না বুঝতে পারলেন না। ততক্ষণে সেই মহিলা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ছিনতাইবাজ লোকটা পিছনের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘাবড়ে গিয়ে যে চেনটা ফেলে পালিয়েছে, সেটা
নজরে পড়েছে তাঁর। পথের উপর জিনিসটা দেখে দ্রুত তুলে নিলেন।
এতক্ষণে কিছুটা যেন টের পেলেন ভরদ্বাজ চৌধুরী। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন, অনেক মানুষ
রাস্তার উপর থেকে কাউকে তুলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে অদূরে হাসপাতালের দিকে। পিছনে উদ্বিগ্ন
কিছু মানুষ। কপাল চাপড়ে বিলাপ করছে দুই মহিলা। ভাল করে তাকাতেই চিনতে পারলেন তাদের।
কাছেই বস্তিতে থাকে। রহিমাবিবির মতোই কারো বাড়ির কাজ সেরে এই রাতে বাড়ি ফিরছিল হয়তো।
হঠাৎই বুকটা ভীষণ হালকা হয়ে গেল ভরদ্বাজ চৌধুরীর। সেই প্রথম দিন ও.সি মুখার্জী
সাহেবের কথা শুনে যা বলতে গিয়েও বলতে পারেননি, শেষ পর্যন্ত তা সম্পূর্ণ করতে পেরেছেন!
আপলোড: ২১/৭/২০২১
অসাধারণ
ReplyDeleteKhub bhalo laglo..Thank you
ReplyDeleteদুর্দান্ত
ReplyDelete