পয়েন্টসম্যান
শিশির বিশ্বাস
‘আগের স্টেশন মাস্টার অম্বিকা বর্মণ বাক্স–প্যাঁটরা গুছিয়ে তৈরি
হয়েই ছিলেন। প্রথম দিন কাজে জয়েন করতেই চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে বললেন‚ আমি মশাই দুপুরের ডাউন ট্রেন ধরব।
‘শুনে থতমত খেয়ে বললাম‚ আজই চলে
যাবেন! নতুন মানুষ আমি। বিদেশ–বিভূঁই। দু—একটা দিন থেকে গেলে খুব ভাল হয়। কাজটা কিছু
বুঝে নিতে পারতাম।
‘উনি অবশ্য পাত্তাই দিলেন না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন‚ কিচ্ছু অসুবিধা নেই মশাই। পয়েন্টসম্যান কেদার নাথ‚ গ্যাংম্যান বিপিন কলিতা আছে। পুরনো মানুষ। ট্রেনের খবর এলে টিকিট
বিক্রি আর পয়সাকড়ির হিসেব রাখা ছাড়া কিছুই করতে হবে না। তাও বলছেন যখন‚ দুটো দিন থেকে যেতাম হয়তো। কিন্তু বুঝলেন না‚ মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে সাতদিন পরে। দেরি করার উপায় নেই।
‘অগত্যা আর কথা বাড়াইনি। শুধু বলেছিলাম‚ গ্যাংম্যান বিপিনকে তো দেখলাম‚ কথাও হয়েছে।
কিন্তু পয়েন্টসম্যান কেদারবাবুকে তো দেখতে পেলাম না! আজ নেই নাকি?
‘উত্তরে একটু যেন থমকে গেলেন ভদ্রলোক। অল্প ঘাড় চুলকে বললেন‚ থাকবে না কেন? খানিক আগেও তো ছিল। ওরে বিপিন…
‘বিপিন কলিতা কাছেই ছিল। ছুটে এসে জানাল‚ আগের ট্রেন ক্লিয়ার করে কেদারদা সম্ভবত গেছে কোথাও। চলে আসবে।
‘সিঙ্গেল লাইনের উপর ছোট রিমোট স্টেশন হলেও ডবল প্ল্যাটফর্ম। অর্থাৎ
ঝামেলা বিস্তর। উলটো দিক থেকে ট্রেন থাকলে এখানেই ক্রসিং হয়। দুই নং প্ল্যাটফর্মে আগের
ট্রেন থামিয়ে রেখে অপেক্ষা করা হয় উলটো দিক থেকে অন্য ট্রেনের জন্য। সেটা পাস করে গেলেই
আগের ট্রেনের ছাড়ার পালা। অর্থাৎ আপ–ডাউন দু’দিকের শান্টিং পয়েন্টে ট্রাক চেঞ্জ করতে
হয় কয়েক দফায়। সামলাবার পুরো দায়িত্ব পয়েন্টসম্যানের। ওই সময় তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত
চলবে না। আবার এমনই কপাল যে‚পরের ট্রেনেই রয়েছে সেই ঝামেলা।
হঠাৎ যে পয়েন্টসম্যানের কথা তুলেছিলাম‚ তা ওই
কারণে।
‘বিপিনের কথা শেষ হতেই উনি বললেন‚ শুনলেন
তো। চলে আসবে ঠিক সময়। আসলে ছোট স্টেশন তো। কাজ কম। ঠায় কতক্ষণ আর পড়ে থাকবে এখানে?
‘আমার আশঙ্কা প্রায় হেসে উড়িয়ে দিলেন উনি।’
একটানা কথা বলে দম নেবার জন্য মধুসূদন ভট্টাচার্য থামলেন। এক বৃষ্টিভেজা
সন্ধেয় গল্পটা তাঁর কাছেই শুনেছিলাম আসামের এক শহরে তাঁর ঘরে বসে। চাকরির তাগিদে বছর
তিনেক থাকতে হয়েছিল ওখানে। তখনই আলাপ। ভদ্রলোক চাকরি করতেন রেল দপ্তরে। অল্পদিন হল
রিটায়ার করেছেন। ছোট শহর। আলাপ হতে দেরি হয়নি।
সেদিন কী কাজে ডিসি অফিসে গেছি‚ ফেরার
পথে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। কোথাও না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। খেয়াল হল‚ কাছেই মধুসূদনবাবুর বাড়ি। দেখা হলেই ভদ্রলোক তাঁর বাড়িতে যাবার
জন্য বলেন। সুযোগটা তাই আর ছাড়িনি।
যত্নের ত্রুটি করেননি ওনারা। ভদ্রলোকের স্ত্রী অতি অল্প সময়ের মধ্যেই
বড় প্লেট ভরতি গরম লুচি আর আলুভাজা নিয়ে এলেন। সঙ্গে ওমলেট। শেষ হতেই চায়ের কাপ হাজির
করে বললেন‚ আপনার কথা ওনার কাছে শুনে পর্যন্ত হাঁ করে
আছি‚ কবে আসবেন। জানেন‚ আমি আপনার
লেখার ভক্ত। কলকাতা থেকে প্রতি মাসে দু’তিনটে পত্রিকা আসে। তাতে আপনার লেখা থাকলে আগে
পড়ে ফেলি।
প্রশংসা শুনতে তেমন অভ্যস্ত নই। তাড়াতাড়ি বললাম‚ ‘দিদি‚ সেই দরের লেখক আমি নই কিন্তু। যে পত্রিকাগুলির
কথা বললেন‚ তাতে সারা বছরে আমার কয়টি লেখাই বা ছাপা হয়!
তবু জেনে ভাল লাগল‚ এই দূর শহরে একজন হলেও অনুরাগী পাঠক আছেন
আমার।’
ভদ্রমহিলা বললেন‚ ‘জানেন
তো‚ আমার কত্তা রেল দপ্তরে চাকরি করতেন। এই আসামেই বিভিন্ন স্টেশনে
কাজ করেছেন। দারুণ সব অভিজ্ঞতা। কত বলি‚ লিখে ফেলার
জন্য। কিন্তু তাতেই আপত্তি।’
এই এতক্ষণ নড়ে উঠলাম আমি। সত্যি কথা বলতে কী‚ আমাদের সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুলি বিরাট কিছু নয়। অগত্যা লিখতে
বসলে মনগড়া কথাই বেরিয়ে আসে কলমের ডগায়। অনেক সময় নিজেরই পছন্দ হয় না। বরং অন্যের
কাছে শোনা গল্পের জোর ঢের বেশি। পাঠকও পছন্দ করেন। তাড়াতাড়ি বললাম‚ ‘তাহলে দু’একটা গল্প বলুন না দাদা। বৃষ্টিভেজা সন্ধেটা মন্দ কাটবে
না।’
‘তাহলে বলো না গো সেই প্রথম পোস্টিংয়ের গল্পটা।’ আমি থামতেই মহিলা
প্রায় হইহই করে উঠলেন‚ ‘জানেন‚ তখনো বিয়ে
হয়নি আমাদের। ওনার প্রথম পোস্টিং ডিমাপুরের ওদিকে ছোট এক স্টেশনে। ভয়ানক এক ব্যাপার
ঘটেছিল সেখানে। ভাবলে আমার নিজের বুকই কেঁপে ওঠে!’
অগত্যা আমার অনুরোধে মধুসূদনবাবু শুরু করেছিলেন তাঁর গল্প। আর জমিয়ে
গল্প বলতে তিনি যে যথেষ্টই ওস্তাদ‚ স্ত্রী
যে কিছুমাত্র বাড়িয়ে বলেননি‚ তা টের পেয়ে গিয়েছিলাম শুরুতেই।
উনি হঠাৎ থামতে তাই তাড়াতাড়ি বললাম‚ ‘পয়েন্টসম্যান
কেদার নাথ তারপর আসেনি আর?’
‘এসেছিল।’ মধুসূদনবাবু মাথা নাড়লেন‚ ‘দক্ষ হাতে কাজও সামলেছিল। পয়েন্টসম্যানের কাজ কিন্তু খুব সামান্য
নয়। বিশেষ করে রিমোট স্টেশন‚ যেখানে পয়েন্টসম্যান আবার একজনের
বেশি নয়। সামলাতে হয় একা হাতে। অন্য দিনের মতো সেদিন আপ লোকালই আগে এসেছিল। তার আগে
ডাউন শান্টিং পয়েন্টে ট্রাক চেঞ্জ করে তাকে দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
তারপর ট্রাক ফের নরমাল করেই চলো স্টেশনের অন্য প্রান্তে আপ শান্টিং পয়েন্টে। একটুও
দেরি করার উপায় নেই। সেখানে পৌঁছে পয়েন্টসম্যান ডাউন লোকালের জন্য সবুজ সিগন্যাল দিলেই
সেটা এক নং প্ল্যাটফর্মে ঢুকবে। তারপর সিগন্যাল পেয়ে স্টেশন ছেড়ে গেলেই পয়েন্টসম্যান
আপ শান্টিং পয়েন্টে ট্রাক চেঞ্জ করে দুই নং প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো আপ লোকালের জন্য সবুজ
সিগন্যাল দেবে। ট্রেন এরপর আপ শান্টিং পয়েন্ট পার হয়ে গেলে ফের ট্রাক নরমাল করে লিভার
লক করার পর তার সেই দফার কাজ শেষ।
‘বলা বাহুল্য‚ পয়েন্টসম্যানের কাজ তাই ভীষণ
গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য ভুলে ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। অনেক স্টেশনে এজন্য একাধিক
পয়েন্টসম্যান থাকে। এখানে একা কেদার নাথই ভরসা।
‘যাই হোক‚ সদ্য চার্জ বুঝিয়ে দেওয়া অম্বিকা
বর্মণ ইতিমধ্যে ডাউন লোকালে চেপে বিদায় নিয়েছেন। ট্রেন ছাড়তে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাতে
ভোলেননি অবশ্য। এরপর আপ লোকাল ক্লিয়ার করে লম্বা প্ল্যাটফর্মে সামান্য রাউন্ড দিয়ে
ঘরে ঢুকেছি‚ দেখি কেদার নাথ হাতের ফ্ল্যাগ দুটো টেবিলের
উপর নামিয়ে মুখের ঘাম মুছছে। হাঁফাচ্ছে অল্প।
‘চাকরিতে প্রথম পোস্টিং। একেবারেই নতুন। তবু কেদার নাথের সার্ভিস
দেখে কিছুটা ভরসা পেয়েছি তখন। এসব রিমোট স্টেশন‚ যেখানে
শান্টিংয়ের কাজ দিন–রাতে বার কয়েক‚ সেখানে
পয়েন্টসম্যান কাজের মানুষ হলে স্টেশন মাস্টার অনেকটাই নিশ্চিন্ত হতে পারেন। ছেলেটাকে
সেজন্য থ্যাঙ্কস দিতে যাচ্ছিলাম‚ কিন্তু তার আগেই সে বোঁ করে আমার
দিকে ঘুরে বলল‚ ‘সার‚ গ্যাংম্যান
বিপিন এখানে পুরোনো মানুষ। আমি আসার আগে শান্টিংয়ের কাজ ওই করত। রাতে ডাউন এক্সপ্রেস
শান্টিংয়ের কাজটা আপনি ওকে দিয়ে করিয়ে নিলে ভাল হয়। দিনের বাকি কাজ আমি একাই সামলে
দেব। ভাবতে হবে না।
‘চাকরিতে নতুন হলেও এসব ব্যাপার একেবারেই বরদাস্ত নয়। যথেষ্ট কড়া
গলায় বললাম‚ কেন?
‘সবে জয়েন করেছি‚ তায় নতুন
চাকরি। সেই মানুষের মুখে এমন কড়া জবাব সম্ভবত কেদার একেবারেই আশা করেনি। থতমত খেয়ে
বলল‚ ন–না‚ তেমন কিছু নয় সার। তবে রাতের কাজটা ওকে দিয়ে
করালে কিছু সুবিধা হয় আমার। পুরনো মানুষ ও। শান্টিংয়ের কাজ ভাল জানে। তারপর স্থানীয়।
আর রাতে ওই একটাই তো শান্টিং। আপনি বললে না করতে পারবে না।
‘বিপিন গ্যাংম্যান। শান্টিংয়ের কাজ তার নয়। তবে ঘটনা হল‚ এসব রিমোট স্টেশনে নিয়ম তেমন মানা হয় না। অনেক স্টেশনে পয়েন্টসম্যানই
নেই অথবা ছুটিতে গেছে‚ সেখানে গ্যাংম্যান দিয়ে চালিয়ে নেওয়া হয়।
কিন্তু স্টেশন মাস্টার হিসেবে প্রথম দিন কিছু কড়া হতে পারলে পরের অনেক ঝামেলা সহজ হয়ে
যায়। তাই গম্ভীর হয়ে বললাম‚ বলছেন যখন‚ ভেবে দেখব।
আজ আপনিই করবেন।
‘আমার কথায় প্রতিবাদ না করলেও দেখলাম মানুষটার মুখ ভয়ানক থমথমে হয়ে
উঠেছে। তবে কথা বাড়ায়নি।
‘নতুন চাকরি শুধু নয়‚ অপরিচিত
এক স্টেশনে প্রথম দিন। হরেক রেজিস্টার‚ কাগজপত্র
দেখতে দেখতে দিন পার হয়ে গেল। কিছুটা ফুরসত যখন মিলল‚ সন্ধে পার হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বিপিন কলিতার সঙ্গে কথা বলার সময়
পাইনি। খানিক আগের কথা মনে পড়তে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি বারান্দার কোনায় আধো অন্ধকারে
ওজন যন্ত্রের পাশে একা বসে আছে সে। ডাকতেই যেভাবে ছুটে এল‚ তাতে মনে হল‚ মানুষটি আমার ডাকের জন্যই অপেক্ষা
করছিল। আগ্রহে বলল‚ কিছু বলছেন সার?
‘চাকরি জীবনে ছোট–বড় অনেক স্টেশনে পোস্টিং হয়েছে। কিন্তু পদমর্যাদা
যথাসম্ভব বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। পয়েন্টসম্যান কেদার নাথের তুলনায় বিপিনকে যথেষ্ট
অনুগত মনে হল। এসব ছোট স্টেশনে অনেকেই গ্যাংম্যান বা কুলিদের দিয়ে নানা ফাইফরমাশ খাটিয়ে
নেয়। ওরাও চেষ্টা করে সাহেবদের খুশি রাখার। দুপুরের খাওয়া কাছেই ছোট এক পাইস হোটেলে
সেরেছি। বলে এসেছি রাতের খাবারটা পাঠিয়ে দিতে। যদি না পাঠায় ফের যেতে হবে। ব্যবস্থা
কিছু একটা না হওয়া পর্যন্ত এই ভাবেই চালাতে হবে হয়তো। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে
বললাম‚ বিপিন রাতে ডাউন এক্সপ্রেস শান্টিং তুমিই
করো নাকি?
‘সে কখনো করতে হয় সার‚ বিপিন
সামান্য ঘাড় চুলকাল‚ আগের সাহেবও বলতেন। না বলি কী করে। তবে একা
যেতাম না। সঙ্গে থাকত কেউ।
‘বিপিনের উত্তরটা পরিষ্কার নয়। কিন্তু এই প্রথম দিন তা নিয়ে তেমন
মাথা না ঘামিয়ে বললাম‚ আজ তাহলে কেদারের সঙ্গে থেকো বরং।
‘তা কেন সার!
‘বিপিন কলিতার গলার স্বর হঠাৎই পালটে গেল কেমন। অল্প থেমে বলল‚ কেদারদা যখন আপনার কথায় আপত্তি করেনি তখন আর আমাকে সঙ্গে দিতে চাইছেন
কেন?
‘শান্টিংয়ের কাজ দিনে বার দুয়েক করতে হলেও রাতে একবারই মাত্র। রাত
দশটা নাগাদ ডাউন এক্সপ্রেসই সাধারণ আগে আসে। তার আগে আপ শান্টিং পয়েন্টে ট্রাক চেঞ্জ
করে তাকে দুই নং প্ল্যাটফর্মে পাঠাতে হয়। ট্রেন শান্টিং পয়েন্ট পার হয়ে গেলে ট্রাক
নরমাল করতে হয় ফের। অর্থাৎ দাঁড়াতে হয় অনেকটা সময়। বিপিন কলিতার কথায় সেই প্রথম টের
পেলাম এই আপ শান্টিং পয়েন্টেই কেদার বা বিপিনের রাতে কাজ করতে যত আপত্তি। দুপুরে কেদারের সঙ্গে আমার কথা বিপিন জেনেছে মানেই
দু’জনের মধ্যে ইতিমধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে কথা হয়েছে। শুধু বললাম‚ কেদার তোমাকে আজ সঙ্গে থাকতে বলেছিল?
‘বলেছিল সার। আমি রাজি হইনি। সাফ বলে দিয়েছি‚ দিনের কাজ দরকার হলে পুরোটাই আমি সামলে দিতে পারব। শুধু রাতের শান্টিং
যেন ও করে দেয়।
‘উত্তরে কী বললেন উনি?
‘তেমন কিছু তো বলল না সার। অল্প মাথা নাড়ল শুধু।
‘বিপিনের সেই কথায় কিছুটা বিচলিত হয়ে বললাম‚ সন্ধে থেকে দেখছি না ওকে! গেছে কোথায়?
‘ও ওই রকম সার। বিয়েথা করেনি। বাউণ্ডুলে গোছের। কোয়ার্টারও নেয়নি।
এদিকে অনেক ঠেক আছে ওর। দিনভর সেখানে পড়ে থাকে। তবে কাজে ফাঁকি নেই। চলে আসবে।
‘বিপিন সহজভাবে বললেও আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। তাড়াতাড়ি
বললাম‚ শান্টিংয়ের আগে আসবে তো?
‘মনে তো হয়। আপনি ভাববেন না সার। আর তেমন হলে আমি তো আছি। শুধু…
‘কথা শেষ না করে হঠাৎই থেমে গেল বিপিন। করুণ চোখে তাকিয়ে রইল।
‘ওর সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে বাকি রইল না‚ কী বলতে চাইছে বেচারা। কিন্তু সেটা নিয়ে এই রাতে অযথা উচ্চবাচ্য
না করে বললাম‚ ঠিক আছে। দশটার ক্রসিংয়ের আগে কেদারের দেখা
না পেলে জানিও।
‘বিপিন ঘাড় নেড়ে চলে গেল। আমিও আগের কাজে মন দিলাম।
‘রাত ন’টার আগেই আমার রাতের খাবার এসে গিয়েছিল। সমস্যা হয়নি। কিন্তু
রাত সাড়ে নয়টা বাজতে চলল‚ কেদারের দেখা নেই তখনো। উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে
আছি‚ বিপিন ঘরে ঢুকল।
‘কী খবর বিপিন? কেদার এসেছে?
‘আজ্ঞে না সার‚ আসেনি এখনো। তবে হাতে সময় আছে।
খেয়ালি মানুষ তো‚ এমনও হয়েছে‚ স্টেশনে না এসে সোজা শান্টিং পয়েন্টে চলে গেছে।
‘শান্টিং পয়েন্টে চলে গেছে মানে! সিগন্যাল বাতি?
‘অতিরিক্ত একটা বাতি সেজন্য সন্ধের আগে আপ শান্টিং পয়েন্টের কাছে
মজুত রাখা হয় সার। আজও রয়েছে।
‘ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হল না। রাতে এমনিতেই যার আপ শান্টিং পয়েন্টে
কাজ করতে আপত্তি‚ সে এমন করতে পারে‚ বিশ্বাস হওয়া শক্ত।
‘বুঝতে পারছিলাম‚ গোড়াতেই
ব্যাপারটাকে হালকা ভাবে নিয়ে ভুল করেছি আমি। উচিত ছিল ওদের দু’জনের সঙ্গে ব্যাপারটা
নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা। ভাল করে জেনে নেওয়া। কিন্তু এই রাতে সেটা আর সম্ভব নয়। আগামী
কালই দু’জনকে নিয়ে বসতে হবে। কিন্তু সে তো পরের কথা। তাড়াতাড়ি বললাম‚ কিন্তু যদি না আসে‚ তখন? কিছু
একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। দরকার হলে আমিই না হয় তোমার সঙ্গে যাব।
‘এই কথাটাই তখন বিপিন বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল। ওর মুখ দেখেই বুঝেছিলাম
কেদার রাতের ট্রেন শান্টিং করতে না এলে আগের স্টেশন মাস্টার বিপিনকে নিয়ে নিজেই চলে
যেতেন আপ শান্টিং পয়েন্টে। মুখের উপর সেটা বলতে সাহস পায়নি বেচারা।
‘আমার কথায় বিপিনের চোখ কিছু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি বলল‚ ডাউন এক্সপ্রেস যদি আগে আসে তো এখনই অত ভাবার দরকার নেই। ট্রেনের
খবর পেয়েছেন সার?
‘বলা বাহুল্য‚ এত আগে সেই খবর পাওয়া সম্ভব নয়।
বললাম‚ ডাউন এক্সপ্রেস আগে এলে কী সুবিধা হবে বিপিন?
‘সার‚ ডাউন এক্সপ্রেস আপ শান্টিং পয়েন্ট দিয়েই তো
স্টেশনে ঢুকবে। যদি শান্টিং পয়েন্টে ট্রাক চেঞ্জ না হয়‚ বড় জোর ট্রেন দুই নম্বরের বদলে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকবে। এমন
কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আগেও হয়েছে। তখন আপ লোকাল ডাউন শান্টিং পয়েন্টের আগে থামিয়ে
ট্রাক চেঞ্জ করে ঢোকানো হয় দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে। আর যদি দেখা যায় ডাউন এক্সপ্রেস
দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মেই ঢুকছে‚ তাহলে আর ভাবনা নেই‚ আপ শান্টিং পয়েন্টে হাজির রয়েছে কেদারদা।
‘অতি বাস্তব কথা। বিপিন কলিতার কথায় বলা বাহুল্য কিছু নিশ্চিন্ত
হওয়া গিয়েছিল।
‘একটু একটু করে সময় পার হয়ে গেলেও বিপিন কলিতা কিন্তু স্টেশনে হাজির
হয়নি আর। রেল লাইন আপের দিকে কিছু বেঁকে থাকার কারণে স্টেশন থেকে আপ শান্টিং পয়েন্ট
ভাল দেখা যায় না। তবু ডাউন এক্সপ্রেস আগে আসছে জেনেও আশঙ্কা একটু ছিলই। কিন্তু সেটা
অহেতুক প্রমাণ করে ডাউন এক্সপ্রেস যথাসময়ে দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মেই এসে দাঁড়াল। হাঁফ
ছেড়ে বাঁচলাম যেন।
‘একগাল হেসে বিপিন বলল‚ বলেছিলাম
না সার‚ কেদারদা ঠিক পৌঁছে যাবে। আমি তাহলে সিগন্যাল
বাতি নিয়ে ডাউন শান্টিং পয়েন্টের দিকে যাচ্ছি।
‘কেন‚ তুমি যাবে কেন আবার?
‘অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে বিপিন বলল‚ ডাউন শান্টিং
পয়েন্ট নিয়ে ঝামেলা নেই সার। খেয়ালি মানুষ কেদারদা অনেক সময় রাতের আপ শান্টিংয়ের কাজ
সেরে এদিকে আর আসে না। ডাউন শান্টিং পয়েন্টের কাজ আমিই সামলাই তখন।
‘ব্যাপার যে যথেষ্টই গোলমেলে‚ বিপিন
কলিতার সেই কথার পর বুঝতে বাকি থাকেনি। কিন্তু তা নিয়ে একটি কথাও বলিনি তখন। ভালয় ভালয়
রাতের কাজটা মিটে যাক। কেদারের ব্যাপার আগামী কাল দেখা যাবে।
‘সেই রাতের ক্রসিংয়ের কাজ ঠিক মতোই মিটে গিয়েছিল তারপর। কিন্তু অন্য
ব্যাপারটাই আর হয়নি। কেদার আপ শান্টিংয়ের কাজ সেরে সেই রাতে তো বটেই পরের দিনও ডিউটিতে
আসেনি। কাজের ফাঁকেই বিপিনকে পাঠিয়েছিলাম তার খোঁজে। সেও সন্ধান পায়নি। তল্লাটে যেসব
ঠেকে কেদার নাথকে সাধারণত দেখা যায়‚ তার কোথাও
সে নেই।
‘এসব রিমোট স্টেশন মাস্টারের কাজ যে কী ঝক্কির‚ মালুম পেয়ে গিয়েছিলাম সেই এক দিনেই। সারাদিন আমি আর বিপিন মিলেই
কাজ সামলালাম। দিনে দুটো ক্রসিং‚ খেলা কথা নয়। বেচারা বিপিন দিনভর
শান্টিং সামলানোই নয়‚ কেদার নাথের খোঁজে ছুটোছুটিও করল। খাটুনির
চূড়ান্ত। তারই ফাঁকে বিপিনের মুখে জানা গেল আপ শান্টিং পয়েন্টের আসল সমস্যার কথা। সত্যি
কথা বলতে কী‚ সব শুনে আমার নিজের বুকই তখন হিম হবার জোগাড়!’
একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে মধুসূদনবাবু থামলেন। আমি তাড়াতাড়ি বললাম‚ ‘কী সমস্যা?’
উত্তরে খানিক থম হয়ে থেকে উনি বললেন‚ ‘সমস্যা বলে সমস্যা সার? স্টেশনটা বেশি দিনের নয়। মাত্র বছর তিনেক
হল ওপেন হয়েছে। আমার আগের স্টেশন মাস্টারই এখানে প্রথম। বেচারা তারপর বদলির জন্য সমানে
চেষ্টা করে শেষটা আমার দৌলতে ছাড়পত্র পেয়েছেন। একটা দিন অপেক্ষা না করেই তিনি যে চার্জ
বুঝিয়ে দিয়ে সরে পড়েছেন তা কী অমনি?
‘বুঝলেন সার‚ শহর–গঞ্জে বসে অনেক কিছুই হয়তো
সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায়‚ কিন্তু আসামের মতো পাহাড়–জঙ্গলের দেশে রিমোট
এক স্টেশনে সেটা সহজ নয়। বিপিন কলিতা স্থানীয় মানুষ। সহজ ছিল না তার কাছেও। বলতেই চাইছিল
না। অনেক খুঁচিয়ে যেটুকু জানতে পারা গেল‚ তা এককথায়
ভয়ানক।
‘স্টেশন হওয়ার আগে জায়গাটা ছিল ফাঁকা মাঠ। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের
সময় তখন। কাছেই ছিল আর্মির ক্যাম্প‚ হাসপাতাল।
যুদ্ধের ডামাডোলে হাসপাতাল তখন আহত মানুষে ভরতি। মারা যেত প্রতিদিনই। তাদের কবর দেওয়া
হত ওখানে। লোকমুখে তাই জায়গাটার নাম হয়ে গিয়েছিল লাসপোতা মাঠ। হরেক গুজবও চালু ছিল।
কেউ আসত না এদিকে। চাষবাসও হত না। চাষবাস এখনো তেমন হয় না। তবে স্টেশনের কারণে নতুন
বসতি শুরু হয়েছে এই মাত্র। তবু দিনের বেলায় একরকম কেটে গেলেও সমস্যা হয় রাতে। বিশেষ
করে আপ শান্টিং পয়েন্টে।
‘শুরুতে যে পয়েন্টসম্যান ছিল‚ সে তো
প্রথম রাতে শান্টিং সেরে ফিরে এসেছিল প্রায় কাঁপতে কাঁপতে। তারপরেই ধুম জ্বরে এমন অবস্থা
যে‚ হাসপাতালে পাঠাতে হল। সেখান থেকে গৌহাটি। বেচারা আর ফেরেনি তারপর।
সেই রাতে সে যখন আপ শান্টিং পয়েন্টে লিভার টেনে ট্রাক চেঞ্জ করার পর পয়েন্ট ব্লেড লক
করে সবুজ বাতির সিগন্যাল দিচ্ছে‚ হঠাৎ পিছন থেকে কেউ তাকে ঠেলতে
শুরু করল। লাইনের উপর ফেলে দেবার মতলব। ওদিকে ডাউন এক্সপ্রেস তখন আপ শান্টিং পয়েন্টের
কাছে। চমকে উঠে পিছন দিকে তাকিয়ে কিন্তু কাউকেই দেখতে পায়নি। তাতেই ঘাবড়ে গিয়েছিল আরো।
তবে ঘাড় ফেরাতে ঠেলাও থেমে গিয়েছিল। কোনোমতে তাই পিছিয়ে যেতে পেরেছিল। প্রাণটা খোয়াতে
হয়নি। তারপর ট্রেন পাস হতে ট্রাক নরমাল করেই ছুটে এসেছে স্টেশন ঘরে।
‘পয়েন্টসম্যান তো হাসপাতালে ভরতি হয়ে রেহাই পেয়ে গেল। কিন্তু রাতের
ট্রেন তো শান্টিং করাতেই হবে। পরের রাতে অন্য উপায় না দেখে স্টেশন মাস্টার অম্বিকা
বর্মণ নিজেই বিপিন কলিতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে হাজির হয়েছিলেন আপ শান্টিং
পয়েন্টে। এই দফায় তেমন ব্যাপার হয়নি। কেউ পিছন থেকে ধাক্কাও দেয়নি। কিন্তু সারাটা সময়
দুই জনেরই মনে হয়েছে‚ কাছে কেউ যেন রয়েছে। নজর রাখছে ওদের উপর।
শুধু তাই নয়‚ বিড়বিড় করে কিছু বলছেও যেন। গোড়ায় মনে হয়েছিল
মনের ভুল। কিন্তু কয়েক রাত কেটে যাবার পরেও সেই একই ব্যাপার।
এখন আর স্টেশনে কারো বুঝতে বাকি নেই‚ আপ শান্টিং পয়েন্টে রাতের বেলা কোনো এক অশরীরী আত্মা ঘুরে বেড়ায়।
কেউ একা শান্টিংয়ের কাজে গেলেই তাকে ট্রেনের সামনে ফেলে দেবার চেষ্টা করে। সঙ্গে অন্য
কেউ থাকলে তেমন হয় না ঠিকই‚ কিন্তু সেই অশরীরী আত্মার উপস্থিতি বেশ টের
পাওয়া যায়। দেখা না গেলেও খুব কাছেই রয়েছে সে। নিঃশব্দে লক্ষ রাখছে উপস্থিত মানুষগুলোর
উপর। অসাবধানে তার সঙ্গে ধাক্কাও লেগেছে একাধিকবার। অথচ দেখা যায়নি কাউকে।
‘বলা বাহুল্য‚ এই অবস্থায় রাতের বেলায় কে আর
একলা যেতে চাইবে ওই শান্টিং পয়েন্টের কাজে। স্টেশন মাস্টার অম্বিকা বর্মণ তাই নিজেই
বিপিন কলিতাকে নিয়ে আপ শান্টিং পয়েন্টে যেতেন। তারপর নতুন পয়েন্টসম্যান কেদার নাথ জয়েন
করতে বিপিন কলিতাকে সঙ্গে পাঠাতেন। কিন্তু আমি জয়েন করার পরেই নতুন মানুষ পেয়ে কেদার
নাথ চেয়েছিল রাতের কাজটা বিপিনের উপর চাপাবে। কিন্তু হয়ে গিয়েছিল হিতে বিপরীত।
‘ভিতরের ব্যাপারটা না জানার কারণে সব গোলমাল করে দিয়েছি আমি নিজেই।
কিন্তু সেজন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকার উপায় নেই। সারা দিন যখন কেদারের খোঁজ মিলল না‚ ঠিক করে ফেললাম রাতের ট্রেন শান্টিংয়ের কাজে আমিও বিপিনের সঙ্গে
যাব। সেই মতো কথাও সেরে রাখলাম।
‘কিন্তু সব হিসেব পালটে গেল সন্ধের পরেই। রাত তখন আটটার মতো। হঠাৎ
কেদার নাথের উদয়। প্রশ্ন করতেই মাথা চুলকে জানাল‚ গত রাতে
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাছেই এক পরিচিতর কাছে ছিল। সন্ধের পর শরীরটা কিছু ভাল মনে হতে
চলে এসেছে।
‘কেদার মিথ্যে বলছে‚ ওর মুখের
দিকে তাকিয়ে কিন্তু মনে হল না। এক দিনের মধ্যেই বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। গাল ভাঙা। চোখ
বসে গেছে। উষ্কখুষ্ক চুল। খানিক তাকিয়ে থেকে বললাম‚ ডিউটি
করতে পারবে?
‘পারব সার। তবে…
‘তবে কী?
‘আমি সার শুধু আপ শান্টিং পয়েন্টের কাজ করে চলে যাব। বাকিটা বিপিনকে
দিয়ে সামলে নেবেন। মনে হয় আপত্তি করবে না।
‘ইতিমধ্যে বিপিন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি কথা বলার আগেই সে লুফে
নিয়ে বলল‚ তাই করে দাও কেদারদা। বাকিটা আমি সামলে নেব।
‘বিপিনের খুশির কারণ বোঝা যায়। বেচারা কাজের মানুষ। বাড়ি এদিকে হলেও
কোয়ার্টারে বউ–বাচ্ছা নিয়ে থাকে। দিনের বেশিরভাগ সময় স্টেশনেই কাটিয়ে দেয়। কোনো কাজেই
আপত্তি নেই। সমস্যা মাত্র ওই একটা ব্যাপারে। সেই কাজটা কেদার করে দিতে চাইছে‚ খুশি হবারই কথা। আমি তাই আর কথা বাড়ালাম না। ওরাও বের হয়ে গেল।
‘মনের ভিতর সামান্য সন্দেহ থাকলেও কেদার যে তার কথা রেখেছে‚বোঝা গিয়েছিল রাতের ডাউন এক্সপ্রেস যখন দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মেই
ঢুকল। অগত্যা পরের কাজগুলো নিয়ে কোনো সমস্যা সেই রাতে আর হয়নি। বিপিন একাই সামলে দিয়েছিল।
রাতে এরপর আর ট্রেন নেই। আমিও হাঁফ ছেড়ে স্টেশন মাস্টারের অফিসঘরে ছোট তক্তপোষের বিছানায়
শুয়ে পড়েছিলাম।
‘পরের দিন সকাল থেকে ফের শুরু হল দুশ্চিন্তা। কেদার আসবে তো আজ?
একটু বেলার দিকে অফিসঘরে বসে খাতাপত্র দেখছি। বিপিন কলিতা ঘরে ঢুকে সামান্য ঘাড় চুলকে
বলল‚ সার গতরাতে কেদারদার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। আপনি আপত্তি করবেন না
যেন।
‘কী কথা?
‘অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে বিপিন ফের একটু ঘাড় চুলকে বলল‚ সার‚ কেদারদা বলে গেছে আমি যদি দিনের অন্য সব কাজ
সামলে দেই ও এরপর থেকে রাতে আপ শান্টিং পয়েন্টের কাজ যথাসময়ে এসে করে দিয়ে যাবে। আমি
তখনি রাজি হয়ে গেছি। রাতের ওই কাজটা ও যদি করে দিয়ে যায়‚ দিনের বাকি কাজ আমি একাই সামলে দেব। আপনি আপত্তি করবেন না।
‘বেচারা বিপিন কলিতার আগ্রহের কারণ বোঝা যায়। কিন্তু স্টেশনের ইনচার্জ
হিসেবে ব্যাপারটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল। যদিও আমার কাছেও এর চাইতে ভাল কিছু
আর হয় না। তবু বললাম‚ বিপিন‚ তুমি যে
হঠাৎ রাজি হয়ে গেলে‚ ভাল করে ভেবে দেখেছ তো? স্টেশনের অন্য কাজও
কিন্তু কম নয়। তার উপর দিনেও দুটো ক্রসিং রয়েছে। পারবে?
‘পারব সার‚ ঘাড় ঝুঁকিয়ে বিপিন বলল‚ দিনভর কাজের চাপ থাকবে জানি। কিন্তু প্রতি রাতে ওই ভয়ানক অবস্থা
থেকে তো রেহাই মিলবে। কী বলব সার‚ প্রতি রাতে আপ শান্টিং পয়েন্টের
কাজে কেদারদার সঙ্গে আমিই তো যেতাম। ভয়ে সারাটা সময় কাঠ হয়ে থাকতাম। বেশ বুঝতে পারতাম‚ দেখা না গেলেও খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে সে। বার কয়েক অসাবধানে ধাক্কাও
লেগেছে। শক্তসমর্থ দশাসই চেহারার একটা মানুষ। অথচ দেখতে পাওয়া যায় না। এক এক দিন দাঁত
কড়মড় করে কী এক ভাষায় গরগর করে উঠত‚ ‘ডিটেইকে
ডিটেইকে। কোকো কারা ডিটেইকে।’
‘কী বলত?
‘বিপিন কলিতার কথায় চোখ কুঁচকে উঠল আমার।
‘হ্যাঁ সার‚ কোনো বিদেশি ভাষা। শুনে শুনে
মুখস্থ হয়ে গেছে‚ ‘ডিটেইকে ডিটেইকে। কোকো কারা ডিটেইকে।’
‘বলা বাহুল্য‚ অদ্ভুত ওই কথার অর্থ আমিও বুঝতে
পারিনি। বিপিনকে তখনকার মতো বিদায় করে দিলেও ব্যাপারটা অবশ্য মাথা থেকে নামেনি পরেও।
তবে রাতের ট্রেন শান্টিং নিয়ে আমাকে আর ভাবতে না হলেও কেদার নাথের দেখাও পাইনি এরপর।
একদিন তাই বিপিন কলিতাকে ডেকে বললাম‚ প্রায়
দুই সপ্তাহ হয়ে গেল কেদারবাবুকে দেখিনি। তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
‘উত্তরে এক গাল হেসে বিপিন বলল‚ হয়নি সার।
তবে সেজন্য মাথাও ঘামাইনি। রাতের শান্টিং যখন ঠিকমতো করে দিয়ে যাচ্ছে‚ অযথা ভাবার দরকারটা কী?
‘অগত্যা কেদারকে নিয়ে নিশ্চিন্তই ছিলাম। কিন্তু প্রথম খটকা লাগল‚ যখন মাসের শেষে তার মাইনে এল না। এ পর্যন্ত কেদার নাথের ব্যাপারে
দপ্তরের হেড অফিসে কিছুই জানাইনি। কিন্তু আর চুপ থাকা যায় না। সেই দিনই একটা চিঠি লিখে
পাঠালাম। কিন্তু সেই চিঠির জবাব আসার আগেই হেড অফিস থেকে একটা চিঠি এল‚ কেদার নাথ হঠাৎই অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। অর্ধ উন্মাদ অবস্থা।
মেন্টাল হাসপাতালে ভরতি এখন।
‘বলা বাহুল্য সেই চিঠি পাওয়ার পর মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠতে দেরি হয়নি।
মুহূর্তে অফিসঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে ডাকলাম বিপিন কলিতাকে। সে ছুটে আসতেই বললাম‚ কেদারের সঙ্গে এরমধ্যে আর দেখা হয়েছিল?
‘উত্তরে বিপিন বলল‚ হয়নি সার।
তবে রাতের ট্রেন প্রতি রাতে শান্টিং করে যাচ্ছে দেখে আমিও গরজ করিনি। আজ খোঁজ নেব সার?
‘ন–না‚ দরকার নেই‚ প্রায়
হাঁ–হাঁ করে উঠলাম।
‘বিপিন কলিতা খানিক হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গিয়েছিল তারপর।
কেদার নাথকে নিয়ে এরপর আর একটা কথাও বলিনি ওকে।’
কথা শেষ করে মধুসূদন ভট্টাচার্য থামলেন। বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে
ইতিমধ্যে। বেরিয়ে পড়া যায়। কিন্তু সে চেষ্টা না করে ব্যস্ত হয়ে বললাম‚ ‘বলেন কী দাদা! তাহলে যে প্রতি রাতে আপ শান্টিং পয়েন্টে কাজ করত‚ সে কে?’
‘সেটাই তো রহস্য সার। বছর চারেক সেই স্টেশনে বহাল তবিয়তেই কাটিয়ে
দিয়েছিলাম তারপর। বলা বাহুল্য‚ কেদার নাথ আর আসেনি। আসেনি নতুন
কোনো পয়েন্টসম্যানও। আমিও চেয়ে পাঠাইনি। রাতের শান্টিং নিয়ে কখনো সমস্যা হয়নি যে। বিপিনের
কাছেও কেদার নাথের কথা পাড়িনি কখনো। সেও বলেনি কিছু। শুধু ট্রান্সফার হবার সময় নতুন
স্টেশন মাস্টারকে জনান্তিকে বলে এসেছিলাম‚ স্টেশনে
কোনো পয়েন্টসম্যান নেই। দরকারও পড়বে না। বরং পয়েন্টসম্যান চেয়ে পাঠালে অযথা ঝামেলাই
বাড়বে। তারচেয়ে যেমন চলছে চলতে দেওয়াই ভাল। অবশ্য তিনি তারপর কী করেছিলেন খোঁজ নেইনি।
তবে আমার স্ত্রীর দৌলতে রহস্যের কিছু সমাধান বোধ হয় পরে করা গিয়েছিল।’
‘কী সমাধান?’
আমার প্রশ্নের উত্তরে মধুসূদনবাবু পাশে তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকাতে
তিনি অল্প হেসে বললেন‚ ‘সমাধান নয় সার। বড় জোর একটা ব্যাখ্যা বলতে
পারেন। রাতের বেলা আপ শান্টিং পয়েন্টে বিদেশি ভাষায় ওই যে শোনা যেত‚ ‘ডিটেইকে ডিটেইকে। কোকো কারা ডিটেইকে।’ ওটা জাপানি ভাষা। ওনার কাছ
থেকে সব শোনার পরে জাপানি ভাষা জানেন‚ এমন এক
পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনিই জানিয়েছিলেন‚ জাপানি ভাষায় কথার অর্থ হল‚ ভাগো‚ ভাগো। ভাগো এখান থেকে।’
‘বলা যায় পরে এই সূত্র ধরেই গৌহাটির ডিসট্রিক্ট লাইব্রেরী থেকে পুরনো
নিউজ পেপার ঘাঁটতে গিয়ে একটা খবর চোখে পড়েছিল। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় যখন আসামের
অবস্থা টালমাটাল। ইম্ফল শহর জাপানি আর আজাদ হিন্দ ফৌজ ঘিরে রেখেছে‚ সেই সময় ওই স্টেশন না থাকলেও রেললাইন ছিল। আর ছিল কাছেই আমেরিকান
সৈন্যের বড় এক ক্যাম্প। লাগোয়া মিলিটারি হসপিটাল। সেই সময় একদিন ক্যাম্পের টহলদার বাহিনীর
নজরে পড়ে জনা কয়েক স্থানীয় মানুষের সঙ্গে এক চিনা লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সে
সময় ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে চিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আসামের অনেক স্থানেই দেখা যেত তাদের।
তবু কৌতূহলী হয়ে টহলদার বাহিনী আটক করেছিল তাঁকে। তারপর জিজ্ঞাসাবাদে প্রকাশ পেয়েছিল‚ লোকটা আদৌ চিনা নয়‚ জাপানি।
সেদেশের রেল দপ্তরের কর্মী। আসামে বেড়াতে এসেছে।
‘বলা বাহুল্য‚ লোকটার সেই কথা বিশ্বাস করেনি
তারা। বরং সন্দেহ করেছিল‚ লোকটা জাপান আর্মির গুপ্তচর বিভাগের কেউ।
আসাম রেলের খোঁজ খবর নিতেই এদিকে আসা। অগত্যা খবর গিয়েছিল ডিমাপুরে। দিন কয়েকের মধ্যেই
বন্দিকে নিয়ে যাবে তারা। জেরা করার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে কলকাতায়। কিন্তু সেই ব্যবস্থা
নেবার আগেই ঘটে গিয়েছিল এক ঘটনা। হাত–পা বাঁধা বন্দি লোকটাকে সেদিন খাবার দেবার জন্য
দু’জন গার্ড তার ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু হাতকড়া খুলতেই সে মুহূর্তে একজনের রাইফেল ছিনিয়ে
নিয়ে তার বেয়নেট সটান ঢুকিয়ে দিয়েছিল নিজের বুকে। হার্ট এফোঁড়–ওফোঁড় হয়ে মুহূর্তে মৃত্যু।
সন্দেহ নেই‚ কাছেই লাসপোতার মাঠে কবর দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।’
ভদ্রমহিলা থামলেন। আমি মধুসূদনবাবুর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বললাম‚ ‘তাহলে তো বলতে হয় সেই মানুষটির আত্মাই পয়েন্টসম্যান কেদার নাথের
পরিবর্তে বছরের পর বছর রাতের ট্রেন শান্টিং করে গেছে। তাও কী সম্ভব!’
‘কী জানি‚’ অল্প ঠোঁট ওলটালেন উনি‚ ‘বললাম না‚ সেই অদ্ভুত ঘটনার একটা ব্যাখ্যা
মাত্র। আর পুরো চার বছর ধরে সেই ঘটনার সাক্ষী তো আমি নিজেই।’
‘উনি সেই কাজ আজও করে যাচ্ছেন কী?’
‘খোঁজ নেইনি সার। নিতে চাইও না।’
আপলোড: ৩/৩/২০২১
খোঁজ নেইনি এবং খোঁজ নেইনি স্যার দুটো ভুল আছে। দুটোতেই নিইনি হবে
ReplyDeleteদারুণ!❤️
ReplyDeleteদাদা, নমস্কার | আপনার ইমেইল এ একটু যোগাযোগ করার দরকার ছিল, করা সম্ভব হবে কি? কিছু জানানোর ছিল কিন্তু ব্যক্তিগত মেইল এ বলতে চাই | যদি যোগাযোগ এর সূত্র টি দেন খুব খুশি হবো |
ReplyDeleteআপনি ফেসবুকে আমার Messenger বক্সে জানতে পারেন। ওখানে অনেকেই লেখেন।
Deleteআসামের দিকের বাঙালি বা ওখানে অনেকদিন থাকা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি রাও একটু আলাদা উচ্চারণ করে.. নিইনি কে নেয়নি বলা তারই একটা উদাহরন
DeleteExcellent dada....👍
ReplyDeleteদারুন লাগল।
ReplyDeleteদারুণ লাগল
ReplyDeleteঅভূতপূর্ব
ReplyDelete