মাঝরাতের ফোন
শিশির বিশ্বাস
অফিসে ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার বসন্ত কে. ঘোষ বরাবরই কিছু অন্য গোত্রের অফিসার।
এ সেই নব্বুয়ের দশকের কথা। কলকাতায় টেলিফোন অফিস মানেই হইহই ব্যাপার। দিনভর মানুষের
আনাগোনা। হরেক অভিযোগ নিয়ে সাবসক্রাইবার আর নানা ধান্দার মানুষ। কাস্টমার সেলে অনবরত
ভিড়। হরেক সমস্যা। তখন এক্সর্টারনাল ইউনিটে কম্পিউটার চালু হয়েছে। প্রতিদিন সকালে সেকশন
প্রতি কয়েক পাতা করে অভিযোগ। সামাল দেওয়া সহজ নয়। অফিসারেরা হিমসিম খেয়ে যেতেন। ঘন
ঘন বদলি। দু–তিন বছরের বেশি কেউই টিকতে পারতেন না। ব্যতিক্রম ছিলেন ঘোষসাহেব। টেকনিকাল
কাজের খুঁটিনাটি যেমন বুঝতেন, অধস্তন কর্মী দিয়ে করিয়েও নিতে পারতেন। সাবসক্রাইবারও
পছন্দ করতেন। সমীহ করতেন অধস্তন কর্মীরাও।
এ গল্প অবশ্য ঘোষসাহেবকে নিয়ে নয়। সেকশনের অধস্তন লাইন স্টাফ অতনু পালের। তবু
গোড়াতেই যে ঘোষসাহেবকে দিয়ে শুরু করতে হল, তার কারণ গল্পের তিনিই সূত্রধর। নইলে এই
গল্পের সূচনাই হত না।
সেদিন কিছু তাড়াতাড়িই হাতের কাজ শেষ হয়ে গেছে। অতনু পাল অফিসে ফিরে রেস্টরুমের
আড্ডায়। হঠাৎই ঘরে ঢুকল ঘোষ সাহেবের খাস বেয়ারা জগন্নাথ। ভিতরের মানুষগুলোর উপর এক
পলক দৃষ্টি বুলিয়ে বলে উঠল, ‘অতনুদা, সাহেব ডাকছেন। আর্জেন্ট ফল্ট।’
এই অসময়ে অতনুর অফিসে থাকার কথা নয়। আজ হঠাৎই চলে এসেছে। খবরটা পৌঁছে গেছে সাহেবের
কাছে। অতনু ভিতরে কিছুটা উদ্বেগ নিয়েই ছুটল তাঁর ঘরের দিকে। এই অবেলায়, হয়তো এমন কাজ
দেবেন শেষ করতে রাত হয়ে যাবে। সাহেবের ঘরে ঢুকে কিন্তু অনেকটাই নিশ্চিত বোধ করল। সাহেবের
সামনে মামুলি শাড়ি পরিহিতা মাঝবয়সী যে মহিলা উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছেন, তিনি উদয়পুর
পার্কের মিসেস রমা চক্রবর্তী। টেলিফোন অফিসে অনেকেরই পরিচিত। এদিকের পস এরিয়া উদয়পুর
পার্কে মস্ত দুতলা বাড়ি মহিলার। কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই, অত বড় বাড়ির মালিক। স্বামী
মারা গেছেন অনেক দিন। একমাত্র ছেলে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় বড় চাকুরে। মাকে অনেকবার
নিয়ে যেতে চেয়েছে, কিন্তু রাজি হননি। বাড়ি আগলে একাই পড়ে আছেন। একটি কাজের মানুষও নেই।
মাসে বড় জোর দু’এক দিন সেন্টার থেকে কাজের মানুষ আনা হয়।
উদয়পুর পার্কে ভদ্রমহিলাদের ব্লকের দায়িত্ব অতনুর নয়। কখনো যায়ওনি ওনার বাড়িতে।
কিন্তু এত কথা জানার কারণ, টেলিফোন খারপ হলে মহিলা প্রায় পাগল হয়ে যান। একটা দিন দূর
অস্ত, একটা ঘণ্টাও তর সয় না। যে করেই হোক ঠিক হওয়া চাই। ওইদিকটা লাইন স্টাফ রমেশের দায়িত্বে। টেলিফোন খারাপ
হলে তাগাদার পর তাগাদায় প্রায় পাগল করে দেন তাকে। রমেশও যথাসাধ্য করে দেয়। এসব তার
কাছেই শোনা। এই বিকেলে ভদ্রমহিলার অফিসে হানা দেবার কারণটাও তাই অজানা নয়। রাস্তায়
নতুন পাওয়ার কেবল বসাতে গিয়ে ইলেকট্রিক কোম্পানির ঠিকেদার গত রাতে ওই ব্লকের আন্ডার
গ্রাউন্ড কেবল ড্যামেজ করেছে। বহু টেলিফোন বিকল। বিষয়টা নজরে আসতে কেবল জয়েন্টার মেরামতির
কাজ সকাল থেকে শুরু করলেও শেষ হতে আরো একটা দিন অন্তত লাগবে। আর কেবল মেরামতির ওই কাজ
শেষ না হওয়া পর্যন্ত মহিলার ফোন ঠিক হওয়ার আশা নেই। বলা বাহুল্য বেচারা রমেশ তাই কিছুই
করতে পারেনি। হাত তুলে দিয়েছে। সন্দেহ নেই, নাছোড়বান্দা মহিলা এরপরেই ধাওয়া করেছেন
অফিসে। পেয়েও গেছেন ঘোষসাহেবকে।
অন্য কেউ হলে ভদ্রমহিলার টেলিফোনের ব্যাপারে অতনু একেবারেই আশাবাদী হত না। কিন্তু
ঘোষসাহেব বলেই চট করে তেমন ভাবতে পারল না। সাহেব তখন ফোনে কারো সঙ্গে নীচু গলায় কথা
বলছেন। ও তাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। কথা শেষ হতে টেলিফোন নামিয়ে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে
বললেন, ‘বাড়ি চেনো ওনার?’
‘চিনি স্যর। কেবল ব্রেকডাউনের কারণে ওনার ব্লকের অনেক টেলিফোনই খারাপ হয়ে রয়েছে।’
‘তা ঠিক।’ মৃদু কণ্ঠে ঘোষসাহেব বললেন, ‘কিন্তু ওনার টেলিফোনটা যে ঠিক করে দিতে
হবে। বাড়িতে একলাই থাকেন। রাত বারোটায় ছেলে ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রতি রাতে ফোন…’
ঘোষসাহেবের কথা শেষ হতে পেল না, উলটো দিকে বসা রমাদেবী অতনুর দিকে তাকিয়ে প্রায়
হাউমাউ করে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বাবা বাড়িতে একা মানুষ আমি। একটা কাজের মানুষ রাখতেও
ভরসা পাই না। সারাদিন হাঁ করে থাকি ওই ফোনটার জন্য। রাতে ওই ফোনটা এলে ভরসা পাই কিছু।
মনে হয় কেউ আছে আমার। বেঁচে আছি। রমেশবাবু সব জানেন। যথাসাধ্য করেও দেয়। কিন্তু এই
দফায় আর পারেননি। দাও না বাবা, আমার টেলিফোনটা ঠিক করে। বুকে বল পাই। গতরাতে কথা বলতে
পারিনি। কীভাবে যে রাতটা কেটেছে, আমিই জানি। আজও কথা বলতে পারব না, ভাবতেই মাথা ঘুরছে।’
অতনু সহকর্মী রমেশের কাছেই শুনেছে বাড়ির টেলিফোন খারাপ হয়ে গেলে মহিলার মাথা
ঠিক রাখতে পারেন না। অথচ কলকাতার নামী স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। স্বামীও ছিলেন বড়
সরকারী অফিসার। এক ছেলে আগে থেকেই বিদেশে। রিটায়ার করার পর স্বামী–স্ত্রী বাড়িতেই থাকতেন।
মাঝেমধ্যে ছেলের কাছে গিয়ে এক–আধ মাস কাটিয়ে আসতেন দু’জন। তারপর ভদ্রলোক হঠাৎ মারা
যেতেই ভদ্রমহিলার মাথা আগের মতো স্বাভাবিক নেই। প্রতি রাতে আমেরিকায় ছেলের সঙ্গে কথা
বলা চাইই চাই। টেলিফোন খারাপ হলে প্রায় পাগল হয়ে যান। অতনু তাড়াতাড়ি বলল, ‘ভাববেন না
ম্যাম। সাহেব কিছু করবেন নিশ্চয়।’
‘তোমার মুখে ফুল–চন্দন পড়ুক বাবা।’ বলতে বলতে দুই চোখের পাতা ভিজে উঠল মহিলার।
ঘোষসাহেব নীরবে শুনছিলেন। মানুষটা এমনই। ভদ্রমহিলা থামতে অতনুর দিকে চোখ ফিরিয়ে
বললেন, ‘পন্ড ডিপি থেকে ওনার বাড়ি কত দূর বলতে পারবে?’
সাহেবের কথায় এতক্ষণে যেন দিশা পেল অতনু। সাহেব তাহলে ইতিমধ্যে অনেকটাই এগিয়ে
গিয়েছেন! ভদ্রমহিলার বাড়ির কাছেই বড় এক পুকুর। পুকুরের অন্য পারের লাইন চলে ভিন্ন কেবলে।
পুকুরের কোনে একটা ডিপি অর্থাৎ ডিসট্রিবিউশন পোস্ট আছে। লাইনস্টাফদের কাছে তার নাম
‘পন্ড ডিপি’। সাহেব তাহলে ওই ডিপিতে জয়েন্টারকে নতুন কেবল পেয়ার তুলে দিতে নির্দেশ
দিয়েছেন। দরকার এখন ওই ডিপি থেকে ভদ্রমহিলার বাড়ি পর্যন্ত ওভারহেড লাইন টানার ব্যবস্থা
করা। তার ডাক পড়েছে সেই কারণে। সামান্য হিসেব করে অতনু বলল, ‘একশো কুড়ি মিটারের মতো
স্যর। ডিপিতে পেয়ার কী দেওয়া হয়ে গেছে?’
‘হয়নি এখনো।’ ঘোষসাহেব বললেন, ‘তবে ‘ই.টি’ অ্যালট হয়ে গেছে। এম.ডি.এফ–এ নতুন
জাম্পার হচ্ছে। তুমি এস.ডি.ও.পির কাছ থেকে রিকুইজিশন স্লিপ করে স্টোর থেকে তারটা নিয়ে
নাও। আমি বলে দিচ্ছি।’
মনে মনে সাহেবের তারিফ না করে পারল না অতনু। ভদ্রমহিলার টেলিফোন কী উপায়ে ঠিক
হবে একটু আগেও ভেবে পাচ্ছিল না। অথচ মাত্র কয়েক মিনিটে বড়সাহেব কী চমৎকার সমাধানই না
করে ফেলেছেন! ব্যবস্থা যা হয়েছে ওনার টেলিফোন ঠিক হতে বড় জোর আর ঘণ্টা দেড়েক। ও মাথা
নেড়ে চলে যাচ্ছে, ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি আসছি বাবা। বাইরে ট্যাক্সিও দাঁড় করিয়ে রেখেছি,
তোমাকে নিয়েই বের হব।’
কথা না বাড়িয়ে অল্প ঘাড় নেড়ে বের হয়ে গেল অতনু।
মিনিট কুড়ি পর অতনু যখন স্টোর থেকে ওভারহেড তার নিয়ে বের হল, তার মধ্যেই খবর
পেয়েছে পন্ড ডিপিতে পেয়ার অ্যালটই শুধু নয়, এম.ডি.এফ–এ নতুন জাম্পারের কাজও হয়ে গেছে।
ঘোষসাহেব তাঁর কাজে ফাঁক রাখেননি। অর্থাৎ অতনু এবার ডিপি–র নির্দিষ্ট ট্যাগ থেকে বাড়ি
পর্যন্ত তার টেনে দিলেই টেলিফোন চালু হয়ে যাবে।
বাইরে থেকে হরদম নজরে পড়লেও ভদ্রমহিলার বাড়িতে আগে ঢোকেনি অতনু। দরকারও পড়েনি।
হেলপার ছেলেটাকে আজ আগেই ছেড়ে দিয়েছে। একা পুকুরের উপর দিয়ে লাইন টানতে কিছু দেরিই
হয়ে গেল। বাইরের কাজ সেরে যখন বাড়ির ভিতর ঢুকল, তখন সন্ধে নেমে এসেছে। ভদ্রমহিলা ওর
অপেক্ষায় বাড়ির নিচে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন। দরজা খুলে দিলেন। ভিতরে ঢুকে কিছু অবাকই হল
অতনু।
বাইরে থেকে এমন দারুণ একটা বাড়ির ভিতরে এমন অগোছাল অবস্থা, না দেখলে বিশ্বাস
করা শক্ত। রমেশের কাছে শুনেছিল বটে, কিন্তু তা যে এতটা ভাবতেও পারেনি। নিচতলায় বড় ড্রইং
রুম। দামি ফার্ণিচারে সাজানো। কিন্তু কখনো ঝাড়পোঁছ হয়েছে মনে হয় না। শুধু মেঝে নয়,
প্রতিটি ফার্ণিচারের উপরেও ধুলোর আস্তর। এমনকী ঘরের বাতিও যথেষ্ট কম ওয়াটের। এই সন্ধেয়
অন্ধকার দূর হয়েছে সামান্যই। তারই মধ্যে ঘরের দক্ষিণ দিকে টেবিলের উপর এক প্রৌঢ় মানুষের
বাঁধানো বড় ছবি। ঘরের ভিতর ব্যতিক্রম একমাত্র এই ছবিটিই। ঝকঝকে পরিষ্কার। একবিন্দু
ধুলো নেই। টাটকা রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে।
বাড়িতে মানুষ মাত্র একজন। ভদ্রমহিলা নীচে বড় একটা আসেন না হয়তো। অতনু তাই আশা
করেছিল, দু’তলার ঘরের অবস্থা নিশ্চয় এমন নয়। কিন্তু উপরতলায় উঠেও খুব একটা ব্যতিক্রম
চোখে পড়ল না। যে ঘরে টেলিফোন, তার যাবতীয় আসবাবপত্রে ধুলোর পরিমান সামান্য কম, এই মাত্র।
বিছানার পাশে বড় টেবিলে রাখা নীচের ঘরে দেখা সেই প্রৌঢ় মানুষটির বাঁধানো ছবিটা অবশ্য
নিয়মিত ঝাড়পোঁছ হয়। পরিষ্কার ছবিতে সেই একই রকম টাটকা রজনীগন্ধার মালা।
টেবিলেরই একপাশে রাখা টেলিফোনের সঙ্গে সদ্য টানা তার জোড়ার জন্য অতনু টেবিলের
নীচে কানেকটিং বক্স খুলেছে, ভিতরে শুধু ধুলো নয়, ঝুল কালিতে ভরতি। ও ব্রাস দিয়ে সাফ
করছে, মহিলা কিছু সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, ‘কিছু মনে করো না বাবা, রমেশবাবু জানেন, স্বামী
মারা যাওয়ার পর থেকে বাড়ির একটি জিনিসও আমি স্থানচ্যুত করিনি। বেঁচে থাকতে যেমন উনি
দেখে গেছেন, ঠিক তেমনটাই রেখেছি। ওই কারণে তেমন ঝাড়পোঁছ করা যায় না, যদি সামান্য অদল–বদল
হয়ে যায় সেই ভয়ে। তাতে কিছু সুবিধাই হয়েছে বরং। এত বড় বাড়িতে একা মানুষ। কাজের মানুষ
রাখতে সাহস পাই না। ওই সেন্টার থেকে মাসে দু’দিন কাজের লোক আসে। তাদের দিয়ে বাড়ির চারপাশ
পরিস্কার আর ঘরের দেয়ালের ঝুল–কালির সঙ্গে মেঝেও সামান্য সাফ করা হয় মাত্র।’
অতনু বলল, ‘কিন্তু এমন ধুলো ভরতি ঘরে অসুস্থ হয়ে পড়বেন যে। একা মানুষ।’
‘সে হলে হবে। কদিনই বা আর বাঁচব। কয়টা দিন এভাবেই পার করে দিতে চাই।’
ইতিমধ্যে অতনুর কাজ শেষ করে টেলিফোনের হ্যান্ডসেটে হাত দিয়েছে। ভুরু কুঁচকে
উঠল তারপরেই। টেলিফোন সেই আগের মতোই। কানেকশন আসেনি। সর্বনাশ! গোলমাল শুধু কেবল–এ নয়,
মহিলার টেলিফোন ইন্সট্রুমেন্টেও! কিছুটা ধন্দে পড়ে গেল ও। ইতিমধ্যে অফিসের স্টোর বন্ধ
হয়ে গেছে। কিন্তু স্বয়ং ঘোষসাহেবের দেওয়া কাজ, ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। ঠিক করল অফিস
থেকে একটা টেলিফোন খুলে এনে লাগিয়ে দেবে। ও সেই কথাই বলল।
উত্তরে মহিলা কেমন ঘাবড়ে গেলেন হঠাৎ। দুই চোখ করুণ হয়ে উঠল। থতমত খেয়ে বললেন,
‘সেই টেলিফোন ঠিক এই রকম তো বাবা?’
ভদ্রমহিলার টেলিফোন পুরোনো প্রিয়দর্শীনী মডেলের। বহুদিন হল অবসোলেট। অতনু বলল,
‘এই মডেলের টেলিফোন এখন অফিসে নেই ম্যাম। পাওয়া যায় না।’
‘কিন্তু আমার যে এই টেলিফোনই চাই বাবা।’ বলতে বলতে মহিলা করুণ দুই চোখ বেয়ে
কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘এই মডেল আমার স্বামীর পছন্দের জিনিস
বাবা। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এই টেলিফোন যখন প্রথম আসে উনি সখ করে নিয়েছিলেন। পরে টেলিফোন
অফিসে যখন এই মডেল আর পাওয়া যেত না, উনি চাঁদনিচকের এক দোকান থেকে আনিয়ে নিতেন। সেইভাবেই
চলছে তারপর। আমি সেই দোকান চিনি। তুমি আমার সঙ্গে চলো বাবা। ট্যাক্সিতে বেশি সময় লাগবে
না। প্লিজ।’
অতনু জানে, চাঁদনিচকের কিছু দোকান এসব জিনিস রাখে এখনো। পুরোনো টেলিফোন থেকে
পার্টস জোগাড় করে অ্যাসেম্বল করে নেয়। সেকালের যথেষ্ট মান সম্পন্ন টেলিফোন এই প্রিয়দর্শীনী।
পুরোনো হলেও চলে যায় অনেক দিন। দামও বেশি। তবে সখের কাস্টমার তাতে পিছুপা হয় না। কিন্ত
এখন চাঁদনীচক যাওয়া মানে ঘণ্টা দুয়েকের ধাক্কা! অন্য সময় হলে অতনু হয়তো রাজি হত না।
কিন্তু একে ঘোষসাহেবের দেওয়া কাজ আর মহিলার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারল না।
সন্ধের অফিস টাইম। ট্যাক্সি নিলেও ফিরতে প্রায় সাড়ে আটটা হয়ে গেল। সময় নষ্ট
না করে অতনু নতুন টেলিফোন দ্রুত জুড়ে দিয়ে হ্যান্ডসেট তুলতে যাবে, তার আগেই প্রিয়দর্শীনী
টেলিফোনের জোরাল বেল ঝন্ঝন্ শব্দে বেজে উঠল। কেউ ফোন করেছে।
অফিসের সঙ্গে ইতিমধ্যে আর যোগাযোগ হয়নি। কন্ট্রোল রুম থেকে ফোন এসেছে ভেবে অতনুই
হ্যান্ডসেট তুলল।
‘হ্যালো।’
‘রমা, গত রাতে অনেকবার ফোন করেও তোমাকে পাইনি। কী যে চিন্তায় রয়েছি। অনেক চেষ্টায়
এইমাত্র…’
ওপ্রান্তের ভারী কণ্ঠস্বর কন্ট্রোল রুমের কারো নয়। অতনু থতমত খেয়ে বলল, ‘আমি টেলিফোনের লোক সার। ধরুন দিচ্ছি ওনাকে।’
মহিলা পাশেই ছিলেন। অতনু হ্যানডসেট তাঁর হাতে ধরিয়ে দিতেই উনি প্রায় হুমড়ি খেয়ে
পড়লেন তার উপর।
‘হ্যালো, তুমি! হ্যাঁ–হ্যাঁ কাল রাত থেকে ফোন খারাপ। টেলিফোন অফিসের
ওনারা খুব চেষ্টা করেছেন আজ। তারপর টেলিফোন ইন্সট্রুমেন্টটাও খারাপ। যেতে হল সেই…,
কী, কী হল! লাইন কেটে গেল নাকি? হ্যালো, হ্যালো…’
আরও কয়েক সেকেন্ড হ্যালো হ্যালো করে মহিলা নামিয়ে রাখলেন হ্যান্ডসেট। হাঁ করে
তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল অতনু। সবটাই তখন তার কাছে প্রায় হেঁয়ালির মতো। টেলিফোনের
ওপ্রান্তে যিনি কথা বললেন, তিনি মহিলার ছেলে হতে পারেন না। তাহলে?
ওর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন, ‘তুমি, তুমি আজ যা করলে, তোমাকে মিথ্যে
বলতে পারব না বাবা। ছেলে ফিলাডেলফিয়া থাকলেও প্রতি রাতে মায়ের খবর নেবে, এত সময় নেই
তার।’
‘তাহলে? তাহলে কে ফোন করেছিলেন?’ থতমত খেয়ে অতনু বলল।
‘আমার স্বামী। প্রতিদিন মাঝরাতে ফোন করে খবর নেন। টেলিফোন খারাপ থাকায় গত রাতে
ফোন করতে পারেননি। আমার মতোই খুব উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। সেই থেকে সমানে চেষ্টা করে
যাচ্ছিলেন নিশ্চয়। তাই টেলিফোন ঠিক হতেই ফোনটা চলে এসেছিল। অসময় হবার কারণে বেশিক্ষণ
কথা বলতে পারলেন না। লাইন কেটে গেল। মাঝরাতে ফোন করবেন আবার।’
‘উ–উনি কে?’ খানিকটা অনুমান করতে পারলেও সামনে টেবিলে মালা দেওয়া ছবির দিকে
তাকিয়ে অতনু কাঁপা গলায় বলেই ফেলল শেষ পর্যন্ত।
‘উনি, উনিই আমার স্বামী দেবীশঙ্কর চক্রবর্তী। মারা গেছেন আজ আট বছর তিন মাস
একুশ দিন হল।’
ছবি: অগ্নিভ সেন (সৌজন্য: শারদীয়া ১৪২৭ কিশোর ভারতী)
আপলোড: ১৪/৩/২০২১
Bah
ReplyDeleteDARUN/
ReplyDeleteআপনার লেখার আমি বড়ো ভক্ত।
ReplyDelete