Sunday 2 January 2022

গল্প (মোবাইল ভাঃ): তখত ই রুস্তম (শিশির বিশ্বাস)

 

তখত ই রুস্তম

শিশির বিশ্বাস

 ‘তখত–ই–রুস্তম’ অর্থাৎ রুস্তমের সিংহাসনের কথা প্রথম শুনেছিলাম মাজার–ই–শরিফের ট্যাক্সি ড্রাইভার ঘালিব হাবিবির কাছে। তার আগে বলি, শহরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল দিল্লি দরবার হোটেলে। জায়গাটা মাজার–ই–শরিফের বিখ্যাত নীল মসজিদ থেকে খুব দূরে নয়। হেঁটেই আসা যায়। দুপুরে সুযোগ হলেই চলে যেতাম মসজিদের কাছেই বাজারের সামনে এক পাইস হোটেলে, সেদিন দারুণ কাবুলি পোলাও দিয়ে দুপুরের ভোজ সারা হত ওখানে।’ বলতে বলতে বিনুমামার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। জিব দিয়ে ঠোঁট চাটলেন অল্প।

অল্পদিন হল বিনুমামা আফগানিস্তানের মাজার–ই–শরিফ গিয়েছিলেন এক কনস্ট্রাকশন টিমের সঙ্গে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটায় হরেক কাজ শুরু করেছে ভারত। বাড়ি–ঘর এমনকী রাস্তাও। এক টিমের হয়ে মাজার–ই–শরিফ শহরে গিয়েছিলেন তিনি। মাস কয়েক ছিলেন। হাজার হোক দেশের শাসন ব্যবস্থা পালটালেও তালিবানদের দাপট খুব যে কমেছে, এমন নয়। সেই দেশে মাস কয়েক কাটিয়ে আসা বিনুমামার ঝুলিতে যে গল্প কিছু জমে থাকবে, তাতে আশ্চর্য কী? অগত্যা কাছে পেতেই সেদিন ঘিরে ধরেছিলাম সবাই। আর তাতেই বিনুমামা মুখে তখত ই রুস্তমের কথা। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ কাবুলি পোলাওয়ের প্রসঙ্গ উঠতে একদম স্পিকটি নট।

বিনুমামার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মা বললেন,‘তা যাই বলিস বাপু। কাবুলি পোলাও কিন্তু এমন কিছু আহামরি জিনিস নয়। অন্তত আমার তো তেমন মনে হয়নি।’

‘তা ঠিকই বলেছিস দিদি। কাবুলি পোলাওয়ে ঘি–মশলার ব্যাপার তো তেমন থাকে না। সেরা মানের বড় বড় মাংসের টুকরো গোড়ায় স্রেফ নুন দিয়ে সেদ্ধ করে নেওয়া হয়। এদিকে মস্ত হাণ্ডিতে কিছু ঘি দিয়ে অল্প পেঁয়াজ আর টমেটোর কুচি ভেজে নেবার পর তাতে যোগ করা হয় সেই সেদ্ধ মাংস। এরপর সামান্য কষিয়ে নিয়ে উপরে ঢেলে দেওয়া হয় ঘণ্টা কয়েক ধরে ভিজিয়ে রাখা ভাল মানের বাসমতি চাল আর মাংসের সেদ্ধ জলটা। এরপর অনেকটা কিসমিস আর গাজরের কুচি ছড়িয়ে হাণ্ডি ঢাকনা বন্ধ করে উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয় গোটা দুই মোটা কম্বল। তারপর যথাসময়ে ডেকচির ঢাকনা খুললেই ঝরঝরে খুশবুদার কাবুলি পোলাও। আসলে সেরা মানের মাংস আর চাল ছাড়া বাকি সবটাই পাকা হাতের কাজ। তা মাজার ই শরিফের সেই হোটেলে কাবুলি পোলাওয়ের যে স্বাদ পেয়েছিলাম ভোলা যায়নি আজও। অগত্যা হোটেলটার সন্ধান পাবার পর আর ছাড়িনি। মাঝে মধ্যেই ঢুঁ মেরে যেতাম। পোলাওয়ের পরে চলে আসত আফগান চা। টেবিলে পেয়ালা রাখলেই ভুরভুর করা আসল জাফরানের গন্ধ। তো বুঝতেই পারছিস, তালিবানদের দেশে দিনগুলো মন্দ কাটাইনি।’

কাবুলি পোলাওয়ের প্রসঙ্গে ইতি টেনে বিনুমামা থামতেই মা বললেন, ‘তবে যে শুনেছিলাম, কী এক ঝামেলায় পড়েছিলি ওখানে!’

ব্যাপারটা আমাদের ছোটদের কানেও সামান্য এসেছিল তখন। বিনুমামাকে কাছে পেয়ে আজ সেই ঘটনা শোনার জন্যই চেপে ধরেছিলাম সবাই। কাবুলি পোলাও সরিয়ে রেখে মায়ের তাগাদা সেই কারণেই। অগত্যা ফের মুখ খুললেন বিনুমামা, ‘সেই কথা বলতে গিয়েই তো তখন ট্যাক্সি ড্রাইভার ঘালিব হাবিবির মুখে শোনা ‘তখত ই রুস্তম’ দিয়ে শুরু করেছিলাম। মাজার ই শরীফ কিন্তু বহু পুরনো শহর। অন্তত কয়েক হাজার বছর। ব্যাক্ট্রিয় গ্রিক রাজাদের রাজধানী এই শহরের নাম তখন ব্যাকট্রা। সেই ব্যাকট্রা থেকেই বর্তমানে অঞ্চলটির নাম বালখ্। শুনলে অবাক হতে হয়, সে–সময় এই শহর থেকে আজকের পাকিস্তান তো বটেই বর্তমান ভারতেরও অনেকটা অংশ শাসিত হত। স্থলপথে তখন এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল এই মাজার ই শরিফ। দুর্ভাগ্য, সেই পুরনো দিনের সামান্য চিহ্নই এখন অবশিষ্ট রয়েছে শহরে। তাই নিয়ে একদিন কথা হচ্ছিল ঘালিব হাবিবির সঙ্গে।

 ‘আগেই বলেছি ঘালিব হাবিবি ট্যাক্সি ড্রাইভার। আলাপ কাবুলি পোলাওয়ের টানে। সেও খেতে আসত ওখানে। একেই তো আফগানরা বেজায় হাসিখুশি মজাদার মানুষ। কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। তার উপর লেখাপড়া জানা ব্যক্তি। অনেক খবর রাখে। আলাপ হতে তাই আর যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। একদিন ফস করে বলল, ‘জনাব, তাহলে একদিন তখত ই রুস্তম ঘুরে আসতে পারো।

‘তখত ই রুস্তম!

‘কিছু অবাক হয়েই বললাম। আসলে নামটা তার আগে শুনিনি। আমার কথায় ঘালিবের কাছে চমৎকার এক কাহিনি শুনেছিলাম সেদিন। ঘালিব বিস্তারিত জানালেও সংক্ষেপেই বলি এখানে। নইলে আসল গল্পে পৌঁছতে অযথা দেরি হতে পারে।’

অল্প থেমে বিনুমামা শুরু করলেন আবার, ‘রুস্তম দশম শতকের পারস্য তথা ইরানীয় মহাকাব্য ‘শাহনামার’ এক বীর যোদ্ধা। নানা উপকথা ছড়িয়ে আছে তাঁকে নিয়ে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত কাহিনিটি বড় করুণ। একবার এক অভিযানে বেরিয়ে তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়েছিল সোহরাব নামে আর এক বীর যোদ্ধার। সেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে রুস্তমের অস্ত্রাঘাতে মুমূর্ষু সোহরাব যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখনই রুস্তমের নজর পড়ল সোহরাবের হাতের দুর্মূল্য সোনার বালার দিকে। সেটি দেখেই রুস্তমের মনে পড়ল তরুণ বয়সে তিনি যখন পারস্য সম্রাটের হয়ে সামাঙ্গান জয় করতে এসেছিলেন সেই সময় সামাঙ্গানের পরাজিত রাজার কন্যাকে বিবাহ করে সেখানে ছিলেন কিছু দিন। জন্মেছিল একটি পুত্রসন্তানও। প্রথম দর্শনের সময় নিজের হাতের একটি বালা উপহার দিয়েছিলেন সদ্য জন্মানো পুত্রকে। তারপর সেই যে পারশ্যে ফিরে গিয়েছিলেন আর সামাঙ্গানে ফেরা হয়নি। তবু মুমূর্ষু প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে সেই বালা দেখে তাঁর বুঝতে বাকি থাকেনি, সোহরাব তাঁরই পুত্র।

‘অনুতপ্ত রুস্তম এরপর পুত্রকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। পারস্যরাজের কাছে খবর গিয়েছিল, সেরা রাজ–বৈদ্যকে পাঠাবার জন্য। কিন্তু পারস্যরাজ ইচ্ছে করেই তাঁর সেই আবেদনে সাড়া দেননি। কারণ সম্রাটের আশঙ্কা ছিল, রুস্তম আর সোহরাবের মতো বীর পিতাপুত্র কখনো একজোট হয়ে বিদ্রোহ করলে তাঁর সিংহাসন থেকে বিতাড়িত হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। অগত্যা সেই সম্ভাবনা তিনি অঙ্কুরেই বিনাশ করেছিলেন। রুস্তমও তাঁর পুত্রকে বাঁচাতে পারেনি। আক্ষেপ থেকেই গিয়েছিল।

‘বীর রুস্তম নেই এখন। কিন্তু পিতাপুত্রের সেই হৃদয় বিদারক কাহিনি আজও রয়েছে। আর রয়ে গেছে সামাঙ্গান রাজ্য জয় করার পর আস্ত এক পাহাড় কেটে তিনি বসার জন্য যে সিংহাসন তৈরি করেছিলেন, সেই সিংহাসন। দেখার মতোই জিনিস!

‘রুস্তম খুব বেশি হলেও নবম–দশম শতকের মানুষ। কিন্তু মাজার–ই–শরিফে আমি যে ইতিহাসের খোঁজ করছিলাম, তা আরো পুরনো দিনের। অন্তত দু’হাজার বছর। গোড়ায় খুব একটা আগ্রহ তাই দেখাইনি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি ঘালিব হাবিবির। সামান্য চোখ নাচিয়ে বলল, তবু একবার দেখে আসতে পারেন জনাব। মনে হয় ঠকবেন না। তা ছাড়া বেশি দূরেও নয়। মাজার ই শরিফ থেকে ঘণ্টা দুয়েকের পথ মাত্র। দেখে রাতের মধ্যেই ফিরে আসা যায়। তার উপর জায়গাটা সামাঙ্গান জেলা সদর আইবক–এর লাগোয়া। রাতটা থেকেও যেতে পারেন সেখানে।

‘দূরত্বের জন্য নয়, ঘালিব হাবিবির ওই চোখ নাচানির মধ্যেই অন্য কিছুর সন্ধান পেলাম যেন। তাড়াতাড়ি বললাম, ঘালিব, মনে হচ্ছে, আরো কিছু যেন রয়েছে ওখানে। চেপে যাচ্ছ।

‘উত্তরে ঘালিব হাবিবি ফের একবার চোখ নাচাল, সে নিজের চোখেই দেখবেন জনাব। আগে তো চলুন। তবে কিছু সমস্যাও আছে। সেটা আগে থাকতে জানিয়ে রাখা ভাল।

‘কী?

‘সামাঙ্গান খুব একটা সেফ জায়গা নয়। তালিবান সমস্যা আছে। তবে যেহেতু আইবক শহরের প্রায় গায়ে, ব্যাপারটা কেউ তেমন ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। তবু জানিয়ে রাখা দরকার।

‘হাজার হোক দেশটা আফগানিস্তান। বড় শহর আর জেলা সদরগুলো ছাড়া দেশে শাসনব্যবস্থা তেমন আঁটোসাঁটো নয়। আমরা যারা বিভিন্ন ডেভেলপমেন্টের কাজে এসেছি। সবাইকে পইপই করে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। যথেষ্ট খোঁজখবর না নিয়ে হুট করে কোথাও পা বাড়ানো মানা। তবু যে রাজি হয়ে গেলাম সেই ওই রহস্যের গন্ধে। তা ছাড়া জানতাম, ঘালিব হাবিবির ইচ্ছেয় যখন যাওয়া, সমস্যা হবার কথা নয়। মুহূর্তে জানিয়ে দিলাম, ঘালিব যদি অন্য কাজ না থাকে তো আগামী কালই চলো। তোমার গাড়িতেই।

‘আফগানিস্তান পাহাড়ে ভরা দেশ। কিন্তু মাইলের পর মাইল এমন সমতলভূমিও যে রয়েছে, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। যতদূর চোখ যায় শুধু ধু–ধু করা ফাঁকা মাঠ। দিগন্তের কাছে হালকা পাহাড়ের রেখা মাত্র। হালকা ঘাস আর ঝোপে ভরা সেই জমিতে চাষবাসের চিহ্নমাত্র নেই। হয়তো তেমন সেচের ব্যবস্থা নেই, সেই কারণে। কিন্তু সুদূর অতীতে এসব স্থানে যে সোনা ফলত, প্রচুর মানুষের বাস ছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আজকের মাজার ই শরিফ তথা সেদিনের ব্যাক্ট্রিয় গ্রিক রাজাদের রাজধানী ব্যাকট্রা শহরের সমৃদ্ধির মূলে সেই উৎপন্ন ফসলও যে একটা বড় কারণ, তা বুঝতে বিরাট কিছু চিন্তাশক্তির দরকার হয় না। কালের সঙ্গে হারিয়ে গেছে সোনাভরা দিনগুলোও। বিশাল প্রান্তরের মাঝে কোথাও চরে বেড়াচ্ছে শুধু ভেড়ার পাল। গাধার পিঠে চেপে তাদের পাহারা দিয়ে চলেছে কিছু দেহাতি মানুষ। সাধারণ মানুষের উপার্জন বলতে ওই ভেড়া আর দুম্বা পালন। দিন চলে তাতেই।

‘বিশাল প্রান্তরের শেষে কোথাও পাহাড়ের সারি। উঁচু–নিচু নিরেট পাথরের টিলার উপর কোথাও সামান্য সবুজের আভাষ। কোথাও শুধুই ধুসর। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জেলা সদর আইবক। ছোট শহর। পার হতেই পথের পাশে এমনই এক টিলার মাথায় পৌঁছে ঘালিব ট্যাক্সি থামাল। টিলা হলেও উপরটা প্রায় সমতল।

‘গোড়ায় তেমন বোঝা যায়নি। ঘালিব হাবিবিও বলেনি কিছু। কিন্তু সেজন্য সমস্যা হয়নি। পায়ে পায়ে টিলার প্রান্তে পৌঁছোতেই তখত–ই–রুস্তম তথা বীর যোদ্ধা রুস্তমের সিংহাসনের দেখা মিলল। প্রথম দেখায় প্রায় চমকে উঠেছিলাম বলা যায়। ঘালিব ভেঙে না বললেও রুস্তমের সিংহাসনে কিছু অন্য রহস্য যে আছে তা বুঝেছিলাম। ছুটে আসা সেই কারণে। কিন্তু এতটা ভাবিনি! নিরেট পাহাড় কেটে তৈরি আসলে এক বৌদ্ধ স্তূপ। অন্তত চার তলা সমান উঁচু। ঠিক যেভাবে আস্ত পাহাড় কেটে ইলোরায় কৈলাস মন্দির তৈরি, সেই একইভাবে তৈরি এই বৌদ্ধ স্তূপ। পার্থক্য বলতে আরো ধ্যানগম্ভীর। কৈলাস মন্দিরের সামনের দিক পাহাড় কেটে অনেকটাই উন্মুক্ত। এখানে তেমন নয়। চারদিকেই পাহাড়ের দেয়াল। তার কারণ, মন্দির দর্শনার্থী আর পূজার্থীদের জন্য। আর স্তূপ একান্তভাবেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাধনক্ষেত্র। সন্দেহ নেই, এই কীর্তির প্রাচীনত্বও অনেক অনেক বেশি। আফগানিস্তানে বৌদ্ধ ধর্মের পূর্ণ বিস্তৃতি কুশান শাসনকালে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে। এই বিশাল কীর্তিও সেই সময়ের।

‘বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটতে তাই সময় লাগল। ঘালিবির দিকে ফিরে বললাম, এ রুস্তমের সিংহাসন নয় ঘালিব। তারও অনেক অনেক আগের বৌদ্ধ স্তূপ।

‘আফগান ট্যাক্সি ড্রাইভার ঘালিব হাবিবি যে কিছু আলাদা রকমের মানুষ, বুঝেছিলাম আগেই। কিন্তু সবটা নয়। আমার কথায় মানুষটি হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ জনাব, থ্যাঙ্ক ইউ। একদম তাই।  কালের প্রবাহে প্রেম আর অহিংসার বৌদ্ধধর্ম বিলীন হয়ে গেছে এদেশ থেকে। ভগবান বুদ্ধের কথা ভুলে গেছে সবাই। ভুলে গেছে দুই হাজার বছর আগে বৌদ্ধ শ্রমণদের পৃষ্ঠপোষকতায় সামাঙ্গানে নিরেট পাহাড় কেটে তৈরি এই বিশাল বৌদ্ধ স্তূপের কথাও।  কিন্তু আইবক শহরের পাশে বিশাল কীর্তি তো ভুলে যাওয়ার উপায় নেই। চোখের সামনেই বর্তমান! বিশাল সেই স্তূপের দিকে তারা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু। ভগবান বুদ্ধের কথা ভুলে গেলেও ততদিনে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে সামাঙ্গান বিজয়ী কীর্তিমান যোদ্ধা রুস্তমের বীরত্বের কথা। গ্রাম–গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে ফেরে। হাটে–বাজারে কথকদের মুখে গীত হয়। অগত্যা স্তূপের সঙ্গে একদিন জুড়ে গেল যোদ্ধা রুস্তমের নাম। রুস্তমের সিংহাসন। তখত–ই–রুস্তম। সামাঙ্গান জয়ের কীর্তি স্বরূপ তিনিই নিজের বসার জন্য এই সিংহাসন তৈরি করেছিলেন।

‘বলা বাহুল্য, অযথা সময় নষ্ট করিনি তারপর। টিলা থেকে নেমে সামান্য ঘুরে মস্ত এক টানেলের মুখ। স্তূপের পাদদেশে যাওয়ার প্রবেশ পথ। প্রশস্ত টানেলের দুই দিকে  ছোট–বড় একাধিক গৃহ আকৃতির গুহা তথা কেভ। ভেঙেচুরে করুণ অবস্থা। তারই ভিতর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে কয়েকজন স্থানীয় পুরুষ। তাদের বেশিরভাগই ভেড়া বা দুম্বার পাল চরাতে আসা মানুষ। দুপুরের রোদে খানিক বিশ্রামের তাগিদে আগমন। ভিড়টা এখানেই বেশি। গোড়ায় ভেবেছিলাম, যেহেতু ভিতরে বসেই নজর রাখা যায় ভেড়ার পালের উপর, সেই কারণে। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরি হল না। টানেলের সামনেই নিরেট পাথর কেটে তৈরি বড় এক চৌবাচ্চা। বড় জোর হাত খানেক লম্বা–চওড়া তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই নিরেট পাথর কেটে তৈরি চৌবাচ্চা কতটা বড় আর গভীর। সেই দু’হাজার বছর আগে ভিক্ষুদের ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়েছিল চৌবাচ্চাগুলি। পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে আসা বৃষ্টির জল জমা হত। সারা বছর সেই জল ব্যবহার করত সাধক ভিক্ষুরা। সময় বদলেছে। পালটে গেছে মানুষের ধর্ম। বৌদ্ধ থেকে ইসলাম। ডিটোনেটর ব্যবহার করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বামিহানের বুদ্ধমূর্তি। সেই চেষ্টা এই সামাঙ্গানেও কম হয়নি। টানেলের দু’ধারে পাহাড় কেটে তৈরি গৃহগুলির করুণ অবস্থা শুধু সুদীর্ঘ সময়ের কারণে নয়, যত্রতত্র অসংখ্য বুলেট আর গোলার চিহ্ন। নীচে মেঝেতেও ছড়িয়ে অসংখ্য ফোটা কার্তুজ। অত্যাধুনিক পোড়া বুলেটের টুকরো। তবে জলের চৌবাচ্চাগুলি প্রায় অটুট। ভেড়া–ছাগল চরাতে আসা মানুষগুলো এখানে যে বিশ্রাম করতে আসে। এই চৌবাচ্চার ঠাণ্ডা জলেই দুপুরের তৃষ্ণা মেটে তাদের। সেই সঙ্গে গুহার ছায়ায় বিশ্রাম। আড্ডার আসর। এক গাল শুভ্র দাড়ি টাকমাথা এক বৃদ্ধকেও দেখলাম সেই চৌবাচ্চার কাছে দাঁড়িয়ে বালতিতে জল তুলে হাতমুখ ধুচ্ছেন। সম্ভবত নমাজের প্রস্তুতি। পাথর কেটে এমন একাধিক জলের চৌবাচ্চা মুম্বাইয়ের কাছে কানহেরি বৌদ্ধ গুহাতেও দেখেছি। বৌদ্ধ গুহাগুলি বহুদিন পরিত্যক্ত। কিন্তু জলের চৌবাচ্চাগুলি আজও স্থানীয় মানুষ ব্যবহার করে চলেছে। পানীয় জলের সহজ উৎস। বালতি–কলসি ভরে দিনভর মেয়েদের জল নিয়ে যেতে দেখেছি। এখানেই বা ব্যতিক্রম হবে কেন। বৌদ্ধস্তূপ দেখার তাগিদে এরপর বেশি সময় নষ্ট করিনি। টানেল পার হয়ে চলে এসেছি স্তূপের পাদদেশে।

পাহাড়ের মাঝ বরাবর শীর্ষদেশ থেকে কেটে নামানো নিখুঁত গড়নের বৌদ্ধ স্তূপ ঘিরে পাহাড়ের বেষ্টনী। সেই বেষ্টনী কেটে তৈরি একাধিক গুহাঘর। সাধক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বাসস্থান। তারই একটি গম্বুজাকৃতি। ভিতরে পা রাখলেই বোঝা যায় গুহাঘরটির আকৃতি অর্ধস্ফুট পদ্মের মতো। দেয়াল আর গম্বুজাকৃতি ছাদ জুড়ে পদ্মের পাপড়ির মতো নক্সা। একসময় দেয়ালে রঙের কাজ ছিল। কালের প্রভাবে বিলীন হয়ে গেছে। সেই গুহা–দেওয়ালেই শুধু নয়, স্তূপেও অসংখ্য বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। স্তূপের চারদিকে প্রশস্ত পরিক্রমা–পথের উপর পোড়া কার্তুজ, অত্যাধুনিক বুলেটের টুকরো সংখ্যায় আরো বেশি।

ঘালিব হাবিবি সামান্য এগিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ নিচু হয়ে কিছু কুড়িয়ে নিয়ে চিন্তিত মুখে ফিরে এল আমার কাছে। চোখের সামনে একটা কার্তুজের পোড়া খোল তুলে ধরে বলল, জনাব দেখেছেন?

জঙ্গিবাহিনীর তাণ্ডব তখত ই রুস্তমের তথা বৌদ্ধ স্তূপের সর্বত্র। তাই খুব একটা অবাক হলাম না। হাঁ করে তাকিয়ে আছি, ঘালিব বলল, একদম টাটকা কার্তুজের খোল জনাব।

‘টাটকা! তার মানে?

‘দু’এক দিনের মধ্যে তালিবান জঙ্গিরা হানা দিয়েছিল এখানে। একে–৪৭ মকশো করে গেছে।

‘তালিবান জঙ্গিদের পদচিহ্ন যে এখানে হরদম পড়ে, তা স্তূপের চারপাশের অবস্থা দেখেই বোঝা গেছে। গোড়ায় তাই খুব একটা মাথা ঘামাইনি। কিন্তু সেই মুহূর্তে ঘালিবের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রমাদ গণতেই হল। ঘালিবের মতো মানুষের কপালে একাধিক ভাঁজ মানে ব্যাপারটা খুব সাধারণ নয়। বললাম, তাহলে কি ফিরে যাওয়া হবে? সবে এসেছি। দেখা হয়নি কিছুই। অথচ খুবই ইন্টারেস্টিং।

‘সে তো ঠিকই, ঘালিব মাথা নাড়ল, তাহলে খানিক দেখেই নিন বরং। আমি ততক্ষণে টানেলের ওদিকে কিছু খোঁজখবর পাওয়া যায় কিনা দেখি।

‘কথা শেষ করে ঘালিব দ্রুত পদক্ষেপে সেদিকে পা বাড়িয়ে দিল। স্তূপের পাদদেশে প্রশস্ত প্রদক্ষিণ পথে তখনো চোখের আড়াল হয়নি, হঠাৎ বাঁশির আওয়াজ ভেসে এল। পুস্তু গানের সুর তুলছে কেউ। টানেলের দুইপাশে ছোট গুহা–ঘরগুলোয় যারা আড্ডা দিচ্ছে  তাদের কারো কাছে বাঁশি ছিল হয়তো। বাজাতে শুরু করেছে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বাঁশি বেজে উঠতেই দেখলাম ঘালিব হঠাৎই চলার গতি বাড়িয়ে দ্রুত পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘সত্যি কথা বলতে কী, ঘালিবের সঙ্গে আসার কারণে তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত আমি। আফগান মানুষটাকে গত মাস কয়েক ধরে দেখছি। সেই ঘালিব যখন নিজের ইচ্ছায় নিয়ে এসেছে, বেশ জানি, বিপদে পড়লে উদ্ধারের দায়ও তার। আর সেটা ও করতেও পারবে। অযথা চিন্তা করে লাভ নেই। চোখের সামনে এত বড় একটা পুরাকীর্তি দেখতে এসে অযথা সময় নষ্ট করার মানে হয় না। অগত্যা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তাই নিয়ে। 

বেশ অনেকটা সময় কেটে গেছে তারপর। প্রায় মিনিট কুড়ির মতো। স্তূপের চারপাশে এক পাক ঘোরাও হয়ে গেছে। চক্রাকার পথে ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি সেই আগের জায়গায়। তাকিয়ে দেখি সেই অর্ধ প্রস্ফুটিত পদ্মাকৃতি গুহার ভিতর এক বৃদ্ধ হাঁটু গেড়ে বসে দুপুরের নামাজ পড়ছেন। মাথাজোড়া টাক। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল, দুই হাজার বছর আগের সামাঙ্গানের মানুষ তাঁদের সদ্ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের স্মরণ নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু মনের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি বোধ হয়। সেদিন যে বৌদ্ধ ভিক্ষু এই গুহাঘরে স্তূপের দিকে মুখ করে বুদ্ধের আরাধনা করতেন, সেই একই ঘরে বসে আজ এই বৃদ্ধ দুপুরের নামাজ পড়ছেন। সামনে সেই পবিত্র স্তূপ। কী অদ্ভুত মিল!

হাঁ করে তাকিয়েছিলাম মানুষটির মুখের দিকে। হঠাৎ খেয়াল হল খানিক আগে এই বৃদ্ধকেই তো দেখেছিলাম টানেলের প্রবেশপথে চৌবাচ্চার কাছে। সেই একই মুখ যেন। সেই করুণাঘন চোখ। ভাবতে গিয়ে মুহূর্তে থমকে গেলাম অবশ্য। দূর তা কেন! মাথাজোড়া টাক থাকলেও সেই মানুষটির পরনে ছিল আফগান কুর্তা-পাজামা। গাল ভরতি সাদা দাড়ি। আর এই মানুষটির গাল নিপাট কামানো। দাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। তাছাড়া পরনে পেঁচিয়ে পরা সাদা এক টুকরো কাপড়। খালি গা।

মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে গিয়েও কেমন থতমত খেয়ে গেলাম। কিন্তু দুটি মানুষের ভিতর এতটা মিল কী করেই বা সম্ভব। হুবহু সেই চোখের দৃষ্টিই শুধু নয়, নাকের পাশে গভীর কাটা দাগটি পর্যন্ত হুবহু এক রকম। 

‘অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। প্রায় ছুটতে ছুটতে হাজির হল ঘালিব হাবিবি।

‘আরে জনাব, আপনি এখানে! এদিকে আপনার খোঁজে তখত ই রুস্তম পুরো এক পাক ঘুরে ফেললাম।

‘ক–কেন?

‘ডাকাবুকো মানুষ ঘালিব হাবিবির সেই উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে তখন বুঝতে বাকি নেই পরিস্থিতি একেবারেই ভাল নয়। তবু প্রশ্ন করলাম।

‘খবর ভাল নয় জনাব, ঘালিব যথাসম্ভব চাপা গলায় বলল, যা সন্দেহ করেছিলাম, খবর তার থেকেও ভয়ানক। তালিবান জঙ্গিদের একটা দল আজ সকালের দিকেই এখানে এসেছিল। চলেও গিয়েছিল তারপর। তেমন সমস্যা হত না। কিন্তু ওদের কয়েকজন ইনফর্মার এখানে ছিল। তাদেরই একজন তোমাকে দেখেই বুঝে ফেলেছে বাইরের মানুষ। তারপরেই বাঁশি বাজিয়ে জানান দিয়েছে তালিবান দলকে। যদি সেই আওয়াজ ওদের কানে যায় সমূহ বিপদ। দুর্ভাগ্য, দেরি হয়ে গেল আমার। সামান্য আগে ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ব্যাপারটা সামাল দেওয়া যেত হয়তো। ওখানে দু’একজনের সঙ্গে মুখচেনা আছে। বলেছি তাদের, কিন্তু বাঁশির আওয়াজ যদি তালিবানদের কানে যায় কিছু করার নেই ওদের। এই মুহূর্তে এখান থেকে সরে পড়া ছাড়া অন্য উপায় নেই।

‘বাঁশির আওয়াজ আমার কানেও এসেছিল। সে প্রায় মিনিট কুড়ি আগের কথা। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। আর এক মুহূর্তও দেরি করা ঠিক হবে না। কথা না বলে দ্রুত পা চালালাম ঘালিবের সঙ্গে।

‘আমাদের গাড়ি সড়কের কাছে সেই টিলার উপরে। অনেকটাই নেমে এসেছি। অগত্যা পৌঁছতে সময় লাগল। দু’জন গাড়িতে উঠতে যাব তখন। হঠাৎই পথের উপর উঠে এল জনা দশেকের একটা দল। মানুষগুলো যে তালিবান জঙ্গি, বুঝতে বাকি নেই তখন। প্রত্যেকের হাতে একে–৪৭। কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা। সামনে দু’জনের হাতের অস্ত্র আমাদের দিকে তাক করা।’

একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে থামলেন বিনুমামা। গল্পের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ তখন। কারো মুখে শব্দ নেই। সামান্য গলা ঝেড়ে নিয়ে শেষে মা বললেন, ‘সে কীরে! একদম তালিবানদের হাতে!’

‘হ্যাঁ রে দিদি।’ সামান্য দম নিয়ে বিনুমামা বললেন, ‘একদম তালিবান জঙ্গিদের হাতে। সারা জীবন পাহাড়–জঙ্গলে কাজ করেছি, এমন বিপদে কমই পড়েছি। বুঝতেই পারছিস, দু’জনের আর গাড়িতে ওঠা হয়নি। গলা শুকিয়ে কাঠ। তালিবান জঙ্গিদের হাতে পড়া মানে, প্রাণে যদি নাও মারে, পণ বন্দি করে আটকে রাখবে কোথাও। তারপর এক কথায় পশুর মতো জীবন। কবে ছাড়া মিলবে, বা আদৌ মিলবে কিনা ঠিক নেই। হায় ভগবান!

‘হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছি। তারই মধ্যে অস্ত্র হাতে লোকগুলো সামনে এসে দাঁড়াল। ঘালিব হাবিবি তার বিশাল শরীর দিয়ে আমাকে যথাসম্ভব আড়াল করে দেহাতি ভাষায় কিছু বলল ওদের। বিন্দুবিসর্গও বুঝতে না পারলেও মানুষটা যে যথাসাধ্য জঙ্গিদের বোঝাবার চেষ্টা করছে, বুঝতে পারছিলাম সেটা।

‘অন্য পক্ষ যে মানতে রাজি নয়, সেটা ওদের কথার ঝাঁঝেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। তবে ঘালিবও হার মানার পাত্র নয়। তর্ক বাড়তেই লাগল ক্রমশ।

‘হাজার হোক ঘালিব হাবিবিও আফগান। দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে জীবনের পরোয়া করে না। তার উপর আজ সেই নিয়ে এসেছে এখানে। সহজে যে হার মানবে না, জানতাম। বুঝিয়ে বললে হয়তো ছাড় মিলতেও পারে। কিন্তু যেভাবে অন্য পক্ষের কথার ঝাঁঝ ক্রমশ বাড়ছে, সেটা একেবারেই ভাল মনে হচ্ছিল না। আমি বিদেশি। পণবন্দি করলেই লাভ। তাই হয়তো প্রাণে মারবে না। কিন্তু ঘালিব যেভাবে তর্কের ঝাঁঝ বাড়াচ্ছে, তাতে হয়তো তাকে প্রাণটাই দিতে হতে পারে। সামনে জঙ্গি তো দু’একজন নয়। পুরো দশজন। সবার মেজাজও এক নয়। এদিকে নাছোড়বান্দা ঘালিব তর্কের ঝাঁঝ বাড়িয়েই চলেছে, উত্তেজনার কেউ হাতের একে–৪৭ চালিয়ে দিতেই পারে। দু’জনের কেউই বাঁচব না তখন। মুহূর্তে মৃত্যু।

‘আর সময় নষ্ট করা যায় না। আমার যা হয় হোক, ঘালিবের অযথা তর্ক করার দরকার নেই। সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ল খানিক আগে স্তূপের গুহাঘরে নমাজ পড়তে দেখা সেই বৃদ্ধ মানুষটাকে। সেই নিপাট মাথাজোড়া টাক, কামানো দাড়ি, খালি গা। পরনে পেঁচিয়ে পরা সাদা কাপড়। মানুষটা কখন যে তালিবান জঙ্গিদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে একেবারেই খেয়াল করিনি।

‘কিছু অবাক হয়েই তাকিয়ে আছি, সৌম্য চেহারার মানুষটা চমৎকার ব্যক্তিত্বপূর্ণ কণ্ঠে কিছু বললেন। সেই কণ্ঠস্বরে মুহূর্তে তর্ক থাকিয়ে তালিবান জঙ্গিদের প্রত্যেকে ঘাড় ফেরাল তাঁর দিকে। উনি একই রকম ব্যক্তিত্বপূর্ণ কণ্ঠে কিছু বললেন আবার। প্রত্যুত্তরে জঙ্গিদের প্রধান আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ম্যান, ইউ ইন্দিয়ান?

‘জঙ্গি মানুষটার গলার স্বর অনেক শান্ত এখন। উত্তেজনার লেশমাত্র নেই। আমি তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম, হ্যাঁ সার। আমি ইন্ডিয়ান। ভারত থেকে এসেছি।

‘সরি, আই সরি সার। ইউ মে গো। ডোন্ত মাইন্দ।

‘শুধু মুখের কথাই নয়। ঝুঁকে পড়ে ক্ষমাও চেয়ে নিল। এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে তুলে দিল আমাদের। গাড়িতে উঠে জানলা দিয়ে তাকিয়ে জঙ্গি দলটার দিকে হাত নাড়তে যাব, প্রায় চমকে উঠলাম, দশ জঙ্গি তালিবানের পিছনে সৌম্য চেহারার সেই বৃদ্ধ নেই এখন। তাড়াতাড়ি চারপাশে চোখ ঘোরালাম। দেখতে পেলাম না কোথাও। অথচ গাড়ি যে টিলার উপর তার চারপাশ একদম ফাঁকা। এত তাড়াতাড়ি কোথায় গেলেন মানুষটা, ভেবে কিনারা করতে পারলাম না।

‘ততক্ষণে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে কাঁচা পথ পার হয়ে ঘালিব তার গাড়ি নিয়ে সড়কে এসে পড়েছে। মুখ দেখেই বোঝা যায়, হঠাৎ এই পট পরিবর্তনে বেচারা নিজেও হতভম্ব। হঠাৎ পরিস্থিতি এমন পালটে যাবে ভাবতেও পারেনি। ঘালিব স্টিয়ারিং হাতে থম হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে তখন। আমি বললাম, ঘালিব,তালিবান জঙ্গিদের ভিতর টাকমাথা কামানো গাল, খালি–গা বৃদ্ধ মানুষটি কোথায় গেলেন হঠাৎ?

‘জঙ্গিদের ভিতর টাকমাথা, কামানো গাল, খালি–গা বৃদ্ধ মানুষ!

‘প্রায় আকাশ থেকে পড়ল ঘালিব হাবিবি, কোথায়? আমি দেখিনি তো!

‘হ্যাঁ, ওই মানুষটাই তো তখত ই রুস্তমের সামনে সেই গুহাঘরে বসে নমাজ পড়ছিলেন তখন। সেই যখন তুমি খুঁজতে এসে দেখতে পেলে আমাকে। মনে নেই?

‘আমার কথায় আরো অবাক হয়ে ঘালিব সশব্দে ব্রেক কষে তাকাল আমার দিকে, কী বলছ জনাব! ওই লোটাস কেভ তখন তো একদম ফাঁকা! কেউ ছিল না তো!

‘উত্তরে কিছু আর বলতে পারলাম না। থম হয়ে রইলাম। আমার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ঘালিবও আর প্রশ্ন করল না। স্টিয়ারিংয়ের দিকে ফিরে ব্রেক রিলিজ করতে গাড়ি ফের চলতে শুরু করল।’

ছবি: পার্থ দাশ (সৌজন্য: সন্দেশ)

প্রথম প্রকাশিত: শারদীয়া সন্দেশ ১৪২৭

1 comment:

  1. অসাধারণ অলৌকিক গল্প | শ্রদ্ধেয় লেখককে অনেক ধন্যবাদ গল্পটি এখানে upload করে পাঠকদের পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য |

    ReplyDelete