Monday 3 January 2022

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোঃভাঃ): একটি ভৌতিক রেল–ট্রলি (বিমল কর)

 

একটি ভৌতিক রেল-ট্রলি

বিমল কর

গদীশের বাড়িতে প্রায় শনিবার বেলায় আমাদের এক আড্ডা বসে। আমরা এর নাম দিয়েছি ‘শনিচক্র’। তিন-চারজন বন্ধু জমায়েত হই সন্ধেবেলায়। চা, মুড়ি, তেলেভাজা খাই আর নিছক গল্প করি। সে সব গল্পের কোনও ঠিকঠিকানা থাকে না; যেদিন যাতে মেতে উঠি তাই নিয়েই গল্প চলতে থাকে। হাসির গল্প হলে রাখহরি মাতিয়ে রাখে, খুনোখুনি ডিটেকটিভ ধরনের গল্প শুরু হলে পল্লব আমাদের হাঁ করিয়ে রাখতে পারে। আর ভবিষ্যতের মানুষের চেহারা কেমন হবে, তার কোন কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কীভাবে বদলাবে---এই সব গল্প জুড়লে অনীশ একেবারে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয় আমাদের।

তা সেদিন বিজন দত্ত হঠাৎ আত্মা আছে কি নেই—তার গল্প জুড়ে দিল। তার হাতে একটা বই ছিল। ইংরেজি বই। তাতে নাকি মরণের পর কোন কোন মানুষের কী গতি হয়েছে তার সম্পর্কে কয়েকটা কাহিনী ছিল।

আত্মা থেকে প্রেতাত্মার কথা উঠল। আমরা প্রচণ্ড উৎসাহ পেলাম গল্পে, নানারকম হাসিতামাশা চলতে লাগল।

এমন সময় ছদ্মবেশী বাবু এসে হাজির। ভদ্রলোকের নাম পরিতোষ। আমরা তাকে ছদ্মবেশী বাবু বলি। বলি, কেননা ভদ্রলোকের বয়েস ষাট হয়ে গেছে, কিন্তু চেহারাটা পঞ্চাশের তলায় ধরে রেখেছেন। চমৎকার স্বাস্থ্য, দেখতেও সুপুরুষ, মানুষটিও চমৎকার। পয়লা নম্বরের গল্পবাজ।

পরিতোষবাবু আসতেই আমরা তাকে খাতির করে বসিয়ে বললাম, আজকের আসরে আমরা আত্মা, প্রেতাত্মা, ভূত নামিয়েছি। এ সম্পর্কে তিনি কী বলেন?

একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। পরিতোষবাবু বা আমাদের পরিতোষদা নানা ঘাটের জল খাওয়া মানুষ। জীবনে তিনি কত কী করেছেন, কত জায়গায় ঘুরেছেন তার ইয়ত্তা নেই। প্রচুর অভিজ্ঞতা। এমন কী, মিলিটারি জীবনেরও।

পরিতোষদা আমাদের চোখমুখ দেখলেন কয়েক পলক। তারপর বললেন, আত্মা, প্রেতাত্মা, ভূত? তোমরা তো দেখছি ক্লাস ওয়ান, ক্লাস টু, ক্লাস থ্রি করে সব সাজিয়ে ফেলেছ। তা যদি ভূতের কথা শুনতে চাও, আমি কিছু বলতে পারব না। তবে যদি অদ্ভুত কোনও ঘটনার কথা শুনতে চাও তো একটা কথা বলতে পারি। সেদিনও আমি বুঝিনি, ঘটনাটা কেমন করে ঘটল; পরে অনেক ভেবেও তার কারণ জানতে পারিনি; আজও পারি না।

আমরা বললুম, আপনি সেই ঘটনার কথাই বলুন। পরিতোষদা তার চুরুট ধরালেন ধীরেসুস্থে। তারপর গল্প বলা শুরু করলেন।

ঘটনাটা ঘটেছিল বছর ত্রিশ আগে। আমি তখন ‘কারবো গ্রিয়ারস'-এর একজন রিপ্রেজেনটেটিভ। আমাদের কোম্পানি সে সময় বেবি বয়লার আর কোল-ফায়ার বয়লারের কাজ করে। নামী কোম্পানি। তা আমাকে অফিস থেকে এক জায়গায় পাঠাচ্ছিল, নাগপুর থেকে সোয়া দুশো মাইল হবে। একটা কারখানা চালু হবে। তাদের কোল-ফায়ার্ড বয়লার দরকার। কাগজপত্র, ড্রয়িং, আমাদের কাছে যা মজুত আছে তার ক্যাটালগ, দামের ফিরিস্তি ইত্যাদি নিয়ে আমার যাওয়ার কথা। গোছগাছ করে বেরিয়ে যাব, এমন সময় ছোটসাহেব ডেকে পাঠালেন। তাঁর ঘরে গিয়ে দেখা করতেই দু-দশটা কাজের কথার পর হঠাৎ বললেন, ‘মুখার্জি, তুমি যদি পারো একটা বাড়তি কাজ সেরে এলে ভাল হয়।'

বললাম, কী কাজ?

সাহেব বললেন, 'তুমি যেখানে যাচ্ছ তার কাছাকাছি হাতরাস বলে একটা জায়গা আছে। লাস্ট ওয়ারের সময় ওখানে ব্রিটিশদের একটা লুকোন এয়ার-বেস ছিল। আমি শুনেছি, বেসটায় এখনও অনেক স্ক্র্যাপ পড়ে আছে। ডিসপোজালে সামান্যই বিক্রি হয়েছিল। এখন জায়গাটা জঙ্গল। ওই স্ক্র্যাপ আমরা কিনতে পারি খুবই সস্তায়। তুমি একবার খোঁজ নিয়ে আসবে।’

আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজ নিয়ে কী লাভ! বললাম, আমি চেষ্টা করব, সার। যদিও বুঝলাম, প্লেনের স্ক্র্যাপ মেটিরিয়াল স্টাফদের কোন কাজে লাগতে পারে!

তা একদিন, কোম্পানির কাজ সেরে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এক স্টেশনে এসে নামলুম। স্টেশনটা খুবই ছোট। আমাদের রোড সাইড স্টেশন যেমন হয়, তেমনই। অবাক ব্যাপার, ওই স্টেশনই আবার জংশন। দেখলাম, ওই স্টেশন থেকে ন্যারো গেজ, মানে ছোট লাইনের গাড়ি ধরতে হবে হাতরাস যাওয়ার জন্য। তোমরা যদি একটু ঘোরাফেরা শুরু করা, দেখবে---এইরকম জংশন স্টেশন আমাদের দেশে গণ্ডায়-গণ্ডায় রয়েছে।

যে স্টেশনে আমি নেমেছিলুম তার নাম, চিচৌকি। চিচৌকি জংশন। নেমেছিলাম সন্ধে নাগাদ। তখন মে মাস। প্রচণ্ড গরম চলছে। রেলগাড়িতে আমি সেদ্ধ হয়ে গিয়েছি অর্ধেক। গা যত পুড়ছে পড়ুক, কিন্তু দেখি গরমে এবং স্নানের অভাবে আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে মাঝে-মাঝে। চোখ জবাফুল।

শুনলাম, ছোট লাইনের গাড়ি ছাড়বে কাল সকালে। তার মানে এই স্টেশনেই আমায় রাত কাটাতে হবে। কাছে পিঠে ওঠার মতন জায়গা তো নেই, এমনকী, একটা ধর্মশালাও নয়।

স্টেশন ওয়েটিংরুম বলে কিছু নেই। একটা খুপরিঘর রয়েছে। সেটাই মুসাফিরখানা। ওই ঘরে একটিমাত্র বেঞ্চি আর পা-ভাঙা এক চেয়ার পড়ে আছে। দেড় হাতের এক কলঘর। তাতে না ল, না বালতি।

স্টেশনমাস্টার বললেন, সামনেই একটা ইঁদারা আছে। জল ভাল। ওখানে গিয়েই স্নান করে নিন। আর ওই দোকানে যান---পুরি, ভাজি পেয়ে যাবেন। বলে একটা আটচালা দেখিয়ে দিলেন। আটচালা থেকে গজ পঞ্চাশ দূরে একটা টিনের শেড। সেখানে শেডের তলায় খেলনা গাড়ির মতো দু-তিনটে কামরা দাঁড়িয়ে। একটা ইঞ্জিন। ছোট বহরের।

জায়গাটা পাহাড়ি। জঙ্গলে ঘেরা। সারাদিনের উষ্ণতা সন্ধের পর থেকেই কমতে শুরু করল ধীরে ধীরে। কুয়োতলায় গিয়ে স্নান করলাম। জল সত্যিই ভাল। স্নান করে শরীর জুড়োল। তারপর দোকানে গিয়ে পুরি আর আলুর ঘ্যাঁট খেলাম। মায় লাড্ডু। এক গ্লাস চা।

একটু রাত হল। স্টেশনের সেই মুসাফিরখানার বাইরে বসে রইলাম চুপ করে। একটা ভাঙা ওজন-যন্ত্র পড়ে ছিল, তার ওপরে।

ধীরে ধীরে রাত হয়ে আসতে লাগল। গরমটাও পালাল। তার বদলে জঙ্গলের ঠাণ্ডা বাতাসে আর পাহাড়ি জায়গার ঠাণ্ডায় ক্রমেই কেমন ঘুম পেতে লাগল। নিজের জিনিসপত্র আগলে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন কত রাত তা আমি খেয়াল করিনি প্রথমটায়। মনে হল, মাঝরাত। এবার বেশ শীত করছিল। বাতাস ঠাণ্ডা। চারদিক ঘুট ঘুটে অন্ধকার। স্টেশন মাস্টারের ঘরেও কেউ আছে কি না কে জানে!

আমার ঘুম ভেঙেছিল শব্দ শুনে। মুসাফিরখানার সেই ছোট্ট ঘরে কেমন একটা শব্দ হচ্ছিল। কিসের শব্দ! আমি যত দূর জানি, ওই ঘরে কেউ নেই, থাকার কথাও নয়। কেননা এখানে থাকা যায় না। আলো নেই, পাখা নেই; একটা জানলা আছে—সেটাও খোলে না। শুধু দরজাটাই যা কোনওরকমে খোলাবন্ধ করা যায়। তা ছাড়া ওই ঘরের লাগোয়া দেড়-দু'হাতের কলঘরের যা গন্ধ, তাতে কোনও মানুষ কাছাকাছি থাকতে পারে না। তা হলে?

কান পেতে শব্দটা শুনলাম। কুকুর নয়তো? জংশনের প্ল্যাটফর্মে একজোড়া কুকুর দেখেছি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। প্ল্যাটফর্মটাই তাদের যেন থাকার জায়গা। হতে পারে কুকুর ঢুকে বসে আছে।

এদিকে আমার শীত শীত করছিল। শিরশির করা যাকে বলে। মাথাটাও কেমন ধরা ধরা লাগল। ট্রেনের ধকল, ওই চামড়া ঝলসানো গরম, তারপর সন্ধেবেলায় কুয়োর জলে স্নান, এসবের জন্য হতে পারে। তা ছাড়া এখন যেরা বাতাস দিচ্ছে বাঙ্গালর তাতে একটু শীত করতেই পারে। নতুন জলে স্নানের জন্য মাথা ভার হওয়া অসম্ভব নয়।

মুসাফিরখানার ছোট্ট ঘর থেকে নানারকম শব্দ আসতে লাগল। মনে হল, কে যেন চেয়ার উলটে ফেলে দিল, বেঞ্চি সরাল, কলঘরে বালতি, মগ টানাটানি করতে লাগল।

বড় অদ্ভুত ব্যাপার তো! কলঘরে বালতি বা মগ কিছুই ছিল না। জলও নয়। তা হলে বালতি, মগ এলে কোথা থেকে, আর কেই-বা সেগুলো টানাটানি করবে।

শব্দ হতে হতে একসময় সব থেমে গেল। একেবারে চুপচাপ। মনে হল, কোনও কুকুরই ঢুকে পড়েছিল, বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনদিক দিয়ে গেল? আমার তো চোখে পড়ল না!

ঘুমভাঙা লোকের যেমন হয়, আমার লম্বা লম্বা হাই উঠছিল। ছলছল করছিল চোখ। একটা সিগারেট ধরালাম। তখন আমি চুরুটের অভ্যেস করিনি, সিগারেটই খেতাম। ঘড়ি দেখলাম হাতের, সাড়ে তিনটে। মানে আর দু'ঘণ্টা কাটাতে পারলেই ভোর, গ্রীষ্মের সকাল।

সিগারেট ধরিয়ে আড়মোড়া ভাঙছি, হঠাৎ চোখে পড়ল, সামান্য তফাতে ছোট লাইনের ওপর এক ট্রলি দাঁড়িয়ে। তোমরা নিশ্চয় ট্রলি দেখেছ। রেললাইনের তদারকির কাজে লাগে। বড় লাইনের ট্রলি বড়। ছোট লাইনের ট্রলি এত ছোট যে, বোঝানো মুশকিল। ধরো, দুজন বসার বাসের সিট যতটুকু চওড়া হয়, প্রায় ততটাই।

ট্রলি দেখছিলাম, চোখে পড়ল এক সাহেব। পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে হাফশার্ট, জুতা-মোজা, মাথায় শোলার হাট। বড় অবাক লাগল। এই রাত সাড়ে তিনটের সময় মাথায় টুপি পরে কোন পাগল ট্রলির কাছে দাঁড়িয়ে আছে?

আমার কী মনে হল, উঠে পড়ে গজ পঞ্চাশ এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি ছোট লাইনের নিচু প্ল্যাটফর্মে ট্রলি আর এক সাহেব দাঁড়িয়ে আছে।

সাহেব আমাকে দেখল। আমি তাকে।

মামুলি চেহারা সাহেবের। মাথায় বেঁটে। গলায় রুমাল বাঁধা বলে থুতনি দেখা যাচ্ছিল না। আর টুপির জন্য কপাল ঢাকা পড়েছে।

আমি কিছু বলার আগেই সাহেব হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব আমি? আমি বললাম, হাতরাস। গাড়ির জন্য বসে আছি।

সাহেব জানাল, গাড়ি হয়তো সারাদিনই পাব না। লাইন ভেঙে গিয়েছে সামনে। খবর পেয়ে দেখতে বেরিয়েছে সাহেব। বলে নিজেই বলল আবার, তুমি যদি আমার সঙ্গে ট্রলিতে আসতে চাও, আমি তোমাকে খানিকটা পৌঁছে দিতে পারব। সেখান থেকে ট্রেকার পাবে হাতরাস যাওয়ার।

রাজি হব কি হব না করে শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম। ছোট লাইনের গাড়ি যদি নাই পাই তা হলে অকারণ এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে কী লাভ! তার চেয়ে এমন কোনও জায়গায় যদি যেতে পারি যেখান থেকে ট্রেকার, টেম্পো পাওয়া যায় হাতরাস যাওয়ার—আমার পক্ষে তো সেটাই ভাল।

সুটকেস আর ছেটি হোল্ডলটা টেনে এনে ট্রলিতে রাখলাম। সাহেবকে বললাম, তোমার পোর্টার কই, ট্রলি-কুলি, কারা ট্রলি ঠেলবে?'

সাহেব আমাকে একটা জিনিস দেখল, মোটর। ছোট ট্রলির একপাশে লাগানো আছে। বুঝলাম, এই ট্রলিটা মোটরে চলে, কুলির দরকার পড়ে না। আগে পা-কুলিরা ট্রলি ঠেলত, এখন অনেক ভটভটি ট্রলি হয়ে গেছে। ইঞ্জিনে চলে।

সাহেব আর আমি পাশাপাশি বসে। ঠাসাঠাসি করেই। পায়ের কাছে আমার হোল্ডল আর সুটকেস

সাহেব স্টার্ট দিল ইঞ্জিনে। ভটভট শব্দ হতে লাগল। ট্রলির মুখের সামনে আলো ছিল, মোটর গাড়ির লাইটের মতন। তবে একটা মাত্র আলোই জ্বলে দেখলাম। পেছনে একরত্তি লাল আলো।

ট্রলি চলতে শুরু করল। আমার হাতঘড়িতে তখন চারটি বাজে। ঘন্টাখানেক এই অন্ধকার থাকবে। তারপর ধীরে ধীরে আঁধার কাটতে শুরু করবে। গরমের দিন। ফরসা হাতে হাতে বড়জোর সোয়া পাঁচ।

ট্রলি চলতে শুরু করার পর আমি সাহেবের সঙ্গে গল্প জমাবার চেষ্টা করছিলাম। সাহেব কথাই বলছিল না। দু-চারবার হুঁ-হাঁ করার পর সাহেব আমাকে লাইনের দিকে দেখিয়ে ইশারায় জানাল, কথা বোলে না, আমি এখন লাইন দেখছি।

রাত্রে যে কেমন করে লাইন দেখা যায়-আমি বুঝলাম না। খানিক পরে মনে হল, চোখের চেয়েও কানটাই যেন আসল। সাহেব লাইনের শব্দ শুনেই যেন অনুমান করার চেষ্টা করছে কোথাও গোলমাল আছে কিনা!

বাধ্য হয়েই আমি চুপ করে থাকলাম। ছোট লাইনের ওপর দিয়ে ট্রলি চলতে লাগল। লাইনের শব্দের সঙ্গে মোটরের ফটফট ভটভট শব্দ হচ্ছিল।

ধীরে ধীরে ট্রলি জোর হচ্ছিল। শব্দ বাড়ছিল। আশপাশের জঙ্গলও বুঝি ঘন হয়ে আসছিল, কখনও পাতলা হয়ে যাচ্ছিল। মাঠের পর মাঠ, গাছের পর গাছ, অন্ধকার, কোথাও জোনাকি উড়ছে, কোনও মাঠে আলেয়ার আলো, কোথাও বা ছোট ছোট পাহাড়।

শেষরাতে বাতাস বাড়তে লাগল। দেখতে দেখতে ড়ের মতন হল। আকাশভরা তারা। হু–হু বাতাসের সঙ্গে শীতও যেন ছুটে আসছিল। আমার কাঁপুনি উঠছিল।

সাহেব চুপচাপ। ট্রলির চাকার শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল, যতটা সম্ভব জোরে ট্রলি ছুটছে। চাকাগুলো যেন লাইনের ওপর থরথর করে কাঁপছে। কাছেও বুঝি। আর আমাদের চারপাশ থেকে মাঠ, গাছপালা, জঙ্গল, সরু শুকনো নদী~-যা আছে চতুর্দিকে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে।

আমার ভয় করতে শুরু করেছিল। এ আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সাহেব, বুঝতে পারছিলাম না। অদ্ভুত লোক তো, মুখে একটাও কথা নেই, সামনে তাকিয়ে বসে আছে, ভয়ডর বলে কিছু কি নেই মানুষটার? সাহেবের বাঁ হাতের দিকে একটা লোহার লম্বা হাতল, মানে লিভার; ওটাই গাড়ি থামবার যন্ত্র, ব্রেক। আমি সাহেবের ডান পাশে বসে। আমার পক্ষে ওই হাতল ধরা সম্ভব নয়।

শেষ পর্যন্ত আর আমার সহ্য হল না। ভয়ে চিৎকার করে বললুম, গাড়ি থামান। দয়া করে থামান গাড়ি। এখনই একটা অ্যাকসিডেন্ট হবে। প্লিজ, গাড়ি থামান।'

সেই ঝোড়ো বাতাসে আমার গলার স্বর যেন ফুটল না। সাহেবও শুনতে পেল কিনা কে জানে! ট্রলি বুঝি আরও জোর হল। আর কিছু দেখা যাচ্ছে না! শুধু অন্ধকার, আর রেল লাইনের উপর দিয়ে ট্রলি ছুটে যাওয়ার ভীষণ শব্দ কানে আসছিল।

পাগলের মতন, কিছু না বুঝেই আমি সাহেবের গায়ের ওপর দিয়ে ব্রেকের হাতলটা ধরতে গেলাম। পারলাম না। তারপর দেখি, সাহেবের মাথার টুপি কখন হাওয়ায় উড়ে গিয়েছে। একমাথা সাদা চুল। অন্ধকারেও সেটা বোঝা যাচ্ছিল। সাহেবের মুখও সাদা। যেন হাড়ের মতো সাদা।

ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করব কি, আমার যেন গলায় স্বর ফুটল না। বুকের মধ্যে কেমন যেন করছিল। মনে হল, আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে। আর ওই অবস্থায় দেখলাম, সাহেবের মাথা, মুখ কিছুই আর নজরে পড়ছে না। গায়ের পোশাকগুলোও যেন কোথায় উড়ে গিয়েছে। মানুষটাই আর নেই। শুধু আমি একা; আর সেই ছুটন্ত ট্রলি, অন্ধকার মাঠঘাট, জঙ্গল।

নিজেকে বাঁচাবার জন্য ট্রলির সেই হাতল ধরে প্রাণপণে টানলাম। তখন আমার খেয়াল হয়নি অত জোরে যে-ট্রলি ছুটছে—সেটা থামাতে হলে ধীরে ধীরে থামাতে হবে। ব্রেক ধরানো চাই আস্তে আস্তে। আচমকা থামাতে গেলেই গাড়ি ছিটকে যাবে, উলটে যাবে—কোথায় গিয়ে পড়বে কেউ জানে না।

হলও তাই। টুলি কোথায় গেল জানি না, আমিও ছিটকে গিয়ে কোথায় পড়লাম কে জানে।

যখন আমার জ্ঞান এল—দেখি হাত, পা, কপালে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছি রেলের হাসপাতালে। দিন তিনেক পরে আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল শুনেছি।

তা মাথাটা সে যাত্রায় বেঁচে গেল। হাত, পা, কোমরে চোট পেয়েছিলাম। আমার বাঁ হাত ভাঙা, ডান পায়ের হাঁটু অকেজো, আর কোমর-পিঠ কোনওরকমে জখমটা সামলে নিয়েছে।

হ্যাঁ, একটা কথা বলা দরকার। পরে আমি খোজ নিয়ে জেনেছিলাম, আমার যখন দুর্ঘটনা ঘটে তার ঘণ্টা দুই পরে ছোট লাইনের এক ট্রলি সাহেব ভোরবেলায় লাইন দেখতে বেরিয়েছিলেন। তিনিই আমাকে পড়ে থাকতে দেখতে পান। নিজেই তুলে আনেন আমাকে।...তোমরা হয়তো জিজ্ঞেস করবে, আগের ট্রলি গেল কোথায়? সেই প্রথম সাহেবই বা কোথায় গেল? সত্যি বলতে কি, আমি নিজেই এই ব্যাপার নিয়ে অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, মাথা ঘামিয়েছি। কোনও সদুত্তর পাইনি। শুধু জানতে পেরেছিলাম—ছোট লাইনে একটা ট্রলি আগে থেকেই দাঁড় করানো ছিল। সেটাকে আর লাইনে পাওয়া যায়নি।

ঠিক যে কী হয়েছিল, আমি বলতে পারব না। কেউ আমায় হাতছানি দিয়ে ডেকে ওই ট্রলির ওপর তুলে নিয়েছিল, না কি আমি বেহুঁশ হয়ে নিজেই টুলিতে গিয়ে বসেছিলাম, জানি না।

আর যদি বসেও থাকি, ট্রলি চালাতে আমি পারতাম না। কেমন করে সেটা চলল, কে চালাল তার কোনও জবাব আমার জানা নেই। তবে বিশ্বাস করো, সাহেবের চেহারাটা আমার এখনও খুব আবছাভাবে মনে পড়ে।

পরিতোষদার গল্প শেষ হবার পর অনীশ বলল, আমি হলে ট্রলি থামাতাম না, দেখতাম সেটা নিজে নিজেই থামে কি না!

রাখহরি বলল, থামত না। আর থামলেও যেখানে গিয়ে থামত, সেখান থেকে পরিতোষদাকে ফিরিয়ে আনা যেত না।

আপলোড: ৩০/৮/২০২২

No comments:

Post a Comment