Monday 3 January 2022

ভাললাগা অলৌকিক গল্প (মোঃভাঃ): ভূতের প্রেম (বনফুল)

 

ভূতের প্রেম

বনফুল

‘এই দেখ ইন্দুর ডায়েরী আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, তুমি পড়ে দেখ দিকি, কিছু মানে বার করতে পার কিনা।’

বলিষ্টকায় ভুজঙ্গধর মরক্কো-চামড়া দিয়া বাঁধানো সুদৃশ্য খাতাখানি আমার দিকে আগাইয়া দিল

উনত্রিশ তারিখে যেটা লিখেছে সেইটে পড় আরও পাতা উলটে যা, হ্যাঁ, ওই মাস থেকে পড়

পড়িতে লাগিলাম ভুজঙ্গধর ভ্রূ-কুঞ্চিত করিয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল ভুজঙ্গধর আমার বাল্যবন্ধু এবং ইন্দুমতীর স্বামী

ইন্দুমতী লিখিয়াছেন, ‘কাল রাত্রে যে অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটেছে তা এতই অসম্ভব যে বললে কেউ বিশ্বাস করবে না আমি কাউকে বলিওনি, এমন কি মাণিককেও না মাণিককে বলতে খুবই লোভ হচ্ছে, কিন্তু ভয় হচ্ছে পাছে সে আমাকে ভীতু বলে ঠাট্টা করে তার চক্ষে নিজেকে ভীতু প্রতিপন্ন করবার ইচ্ছে নেই সত্যি সত্যি ভীতু আমি নইও ভীতু হলে জনমানব বর্জিত এই পোড়ো বাড়িতে এসে থাকতে রাজি হতাম নাকি? ঘটনাটা তবু লিখে রাখছি লিখে রাখবার মতো ঘটনা কটাই বা ঘটে জীবনে ভবিষ্যতে, কোনও পাঠক বা পাঠিকা হয়তো এটা পড়ে পাগল ভাববেন আমাকে; কিংবা হয়তো কোনও উৎসাহী মনস্তাত্ত্বিক এর থেকে কোনও তথ্য উদ্ধার করে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করবেন আমার স্বামীকে সত্যই অদ্ভুত ঘটনাটা

‘কাল রাত দশটার সময় মাণিক হঠাৎ বলল, ওহে, একটা বড় ভুল হয়েছে, পেট্রোলটা কেনা হয়নি চল কিনে আনি গিয়ে দশ মাইল যেতে আসতে আর কতক্ষণ লাগবে

‘আমার শরীরটা তেমন ভাল ছিল না, কোমর ব্যথা করছিল সন্ধ্যে থেকেই তাছাড়া আগাথা ক্রিষ্টির একখানা বই এমন পেয়ে বসেছিল আমাকে যে কোথাও নড়তে ইচ্ছে করছিল না

‘বললাম, আমি আর যাব না, থাক না কাল কিনলেই হবে মাণিক বললে, ওটা হল স্ত্রী-বুদ্ধি আমরা যেরকম অবস্থায় আছি তাতে মোটরে সদাসর্বদা পুরো পেট্রোল থাকা চাই

তাহলে তুমিই গিয়ে নিয়ে এস

তুমি থাকতে পারবে একা ? ভয় করবে না তো?

আমি যদি ভীতু হতাম তাহলে যা করছি তা করতে পারতাম নাকি!

‘মাণিক হঠাৎ ঝুঁকে আমার গালে চপাৎ করে চুম খেল একটা, এমন দুষ্টু, আর অসভ্য হয়েছে আজকাল!

আমি পেট্রোলটা নিয়ে আসি তাহলে যাব আর আসব

‘মাণিক চলে গেল আমরা যে বাড়িটাতে এসে ছিলাম সেটা কোন এক মৈথিল জমিদারের বাগান বাড়ি যদিও এখন পোড় বাড়ির মতো হয়ে গেছে, কিন্তু একদিন যে এর মহিমা ছিল তা এক নজরেই বোঝা যায় জমিদারের বংশধর জীমূতবাহন সিংয়ের সঙ্গে মাণিকের বন্ধুত্ব আছে বলেই বাড়িটা পাওয়া সম্ভব হয়েছে বাড়ির চাবিটা মাণিককে দিয়ে জীমূতবাহন লণ্ডনে পাড়ি দিয়েছেন সম্প্রতি প্রকাণ্ড বাড়ি, প্রকাণ্ড হাতা আমরা দোতলার যে ঘরখানা নিয়ে আছি, তার ঠিক সামনেই গাড়িবারান্দা, গাড়িবারান্দায় বেরিয়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে সুবিস্তৃত বাগানটা বাড়ির সামনেই বাগান এখন অবশ্য বাগানের পূর্বশ্রী নেই ফাঁকা মাঠের মতো খানিকটা জমি পড়ে আছে খালি বাগানের ওপারে গেট গেটেরও ভগ্নদশা কপাট নেই, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড থাম দুটো দাড়িয়ে আছে কেবল সেদিন জ্যোৎস্না উঠেছিল খুব ফিনকি ফুটছিল যেন চতুর্দিকে! ইজিচেয়ারটায় শুয়ে শুয়েই আমি টের পেলাম মাণিক মোটর নিয়ে বেরিয়ে গেল তারপর কতক্ষণ কেটেছিল, আমার মনে নেই ঠিক আমি তন্ময় হয়ে বই পড়ছিলাম হঠাৎ শুনতে পেলাম কিসের যেন একটা শব্দ হচ্ছে মনে হল ঘোড়ার পায়ের শব্দ, অনেকগুলো ঘোড়া যেন টগবগ করে ছুটে আসছে মনে হল অনেক দূর থেকে আসছে, কেন জানি না হঠাৎ মনে হল অনেকদিন ধরে আসছে! শব্দটা প্রথমে ক্ষীণ ছিল, তারপর স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল খট খট খট খট, ক্রমশই যেন এগিয়ে আসছে আমি বইটার দিকে চেয়ে বসেছিলাম কিন্তু পড়ছিলাম না আমি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলাম কার বা কিসের, তা জানি না, কিন্তু অপেক্ষা করছিলাম মনে হচ্ছিল, চরাচরও যেন অপেক্ষা করছে রুদ্ধশ্বাসে কি হয় তা দেখার জন্য সবাই উৎসুক ছুটন্ত ঘোড়াগুলোর প্রতিটি পদক্ষেপ ধ্বনি সবাই যেন শুনছে উৎকর্ণ হয়ে এগিয়ে আসছিল শব্দটা কাছে, আরও কাছেগেট দিয়ে ঢুকল তারপরই আমি ধড়মড় করে দাঁড়িয়ে উঠলাম! মনে হল, ঘোড়াগুলো বুঝি হুড়মুড় করে আমার ঘাড়েই লাফিয়ে পড়ল আমি দাঁড়িয়ে ওঠামাত্র শব্দটা কিন্তু থেমে গেল হঠাৎ হলের দরজাটা খোলা ছিল, ঘাড় ফিরিয়ে দেখি সেখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড লম্বা লোক

আমি তোমাকে নিতে এসেছি ইন্দুমতী

এক সুপুরুষ ব্যক্তি ঘরের ভিতর ঢুকল এসে শালপ্রাংশু মহাভুজ চেহারা মাথায় স্বর্ণ-মুকুট, অঙ্গে কারুকার্য খচিত অঙ্গচ্ছদ, কর্ণে মণিকুণ্ডল, বাহুতে কেয়ূর চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে কুচকুচে কালো গোঁফ, কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো এক মাথা চুল আমি তো অবাক

কে আপনি?

অয়ি মানস-সরোবর-বিহারিণী রাজহংসী, তুমি কি সত্যিই চিনতে পারছ না আমাকে!

আমি নীচের ঠোঁটটা ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ঈষৎ কুঞ্চিত করে ভাবতে চেষ্টা করলাম, কোথাও একে দেখেছি কি না সে বলতে লাগল, একটু ভেবে দেখ মনে পড়বে নারদের বীণাচ্যুত মালার আঘাতে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল কিন্তু আমি তোমাকে তো একদিনের জন্যও ভুলিনি বারবার এসেছি তোমার কাছে নানারূপে এসেছি তুমিও তো আমাকে প্রত্যাখ্যান করনি, অয়ি রম্ভোরু, অয়ি অনবদ্যা ভোজনন্দিনি, ভুলে গেছ কি সব? অর্জুনরূপে এসেছিলাম সুভদ্রার কাছে, পৃথ্বীরাজরূপে এসেছিলাম সংযুক্তার কাছে আমাকে তো তুমি প্রতিবারই চিনেছ

‘আমি তখন আত্মস্থ হয়েছি

‘বললাম, ওসব বাজে কথা ছেড়ে দিন স্পষ্ট করে বলুন আপনি কে?

আমি অজ

অজ? সে আবার কে!

মহারাজ রঘুর পুত্র শ্রীরামচন্দ্রের পিতামহ।

কি চান আপনি?

তোমাকে চাই তুমি আমার স্বয়ংবর সভায় মলরাজের যে ঐশ্বর্য তোমাকে ক্ষণিকের জন্যও বিচলিত করেছিল তা আমি আহরণ করেছি ইন্দুমতী অয়ি মত্ত-চকোর-লোচনে, নিতম্ব-গুবি, আমিও তোমার জন্য তাম্বুললতা পরিবৃত, পূগতরুশোচিত, এলালতালিঙ্গিত, চন্দনবৃক্ষ সুরভিত, তমালমালাআকীর্ণ মনোরম কানন নির্মাণ করে রেখেছি নিষ্কলুষ মানসলোকের উত্তঙ্গ মলয়-শিখরে চল সখি সেখানে আমি রথ এনেছি তোমার জন্যে চল

লোকটা ঘরে ঢুকে গাড়ি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল আমিও মন্ত্রমুগ্ধবৎ তার অনুসরণ করলাম গিয়ে দেখি সত্যিই চতুরশ্ববাহিত বিরাট এক রথ দাড়িয়ে রয়েছে নীচে ও রকম বলিষ্ঠ ঘোড়া আমি আর দেখিনি এর আগে যেন মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি!

আর বিলম্ব কোরো না চল

‘লোকটা আমার হাত ধরতে যাচ্ছিল আমি চীৎকার করে উঠলাম মাণিকের কথা মনে পড়ল আমার!

ভয় পেয়ো না, আমি ভদ্রবংশজাত, আমি বলাৎকার করব না যাবে না তুমি আমার সঙ্গে?

না

কেন?

আমি মাণিককে ভালবাসি

মানিক? সে কে!

আমাদের মোটর ড্রাইভার ছিল কিছুদিন আগে কিন্তু এখন সে-ই আমার সব

আচ্ছা আমি অপেক্ষা করব একটা কথা শুধু বলে যাচ্ছি, আমার কাছে তোমাকে আসতেই হবে আবার আসৰ আমি

পরমুহূর্তেই সৰ অন্তর্হিত হয়ে গেল

এই খানেই ডায়েরি সমাপ্ত হইয়াছে মুখ তুলিয়া দেখিলাম, ভুজঙ্গধর তখনও ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া রহিয়াছে জিজ্ঞাসা করিলাম, ইন্দুকে তুমি ফিরিয়ে এনেছ?’

‘হ্যাঁ, চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে ফিরিয়ে এনেছি।’

আর মাণিক?’

তাকে গুলি করে ওই খানকার একটা ইঁদারায় ফেলে দিয়েছি

কি সর্বনাশ!’

আবেগ কম্পিত কণ্ঠে ভুজঙ্গধর বলিল, ‘ইন্দুকে সত্যিই আমি ভালবাসি ভাই ওর জন্য ফাঁসি যেতেও আমার আপত্তি নেই

এত রাত্রে তুমি আমার কাছে এসেছ কেন বল তো?’

‘পরামর্শ করতে ইন্দুকে কি লুম্বিনী পার্কে পাঠাব ? ডায়েরিটা পড়ে মনে হচ্ছে হয়তো পাগল হয়ে গেছে

ঘড়িতে টং টং করিয়া বারোটা বাজিল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করিল ভুজঙ্গধরের চাকর ঘনাই বোঝা গেল ঘনাই উৰ্দ্ধশ্বাসে আসিয়াছে

হাঁপাইতে হাঁপাইতে সে বলিল, ‘বাবু মাঠান আবার বেরিয়ে গেলেন—’

‘সে কি রে!’

‘হা বাবু প্রকাণ্ড একটা চার ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে, কি বড় বড় ধবধবে সাদা ঘোড়াগুলো গাড়ির ভিতর থেকে চৌগোঁপ্পা একটা লোক মুখ বার করে বললে, ইন্দুমতী, এস মা ঠাকরুণ ছুটে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চেপে বসলেন, আর টগবগ করে গাড়িটা বেরিয়ে গেল ঝড়ের বেগে!’

তাই নাকি?’

আমরা যথাসম্ভব দ্রুতবেগে অকুস্থলে গিয়া উপস্থিত হইলাম কেহ কোথাও নাই' চতুর্দিক নিস্তব্ধ ইন্দুমতী আর ফেরে নাই

আপলোড: ৫/৯/২০২২

1 comment: