Sunday 2 January 2022

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোঃভাঃ): প্রেতে ও মানুষে (তুষারকান্তি ঘোষ)

প্রেতে ও মানুষে

তুষারকান্তি ঘোষ

সে আজ অনেক কালের কথা। তখন বাংলার পল্লী অঞ্চল সমৃদ্ধিশালী ছিল এবং শহর অঞ্চলের এত উন্নতি হয়নি। তখন লোকের অভাব অভিযোগ কম ছিল কারণ জিনিসপত্র ছিল খুব সস্তা। তখন বাঙালী চাকরির জন্য পাগল হয়ে শহরে ছুটে আসত না। গ্রামের নদী, পুষ্করিণী, ও শস্যক্ষেত্র গ্রামবাসীদের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করত। গ্রামের জমিদার ও অবস্থাপন্ন লোকেরা তখন গ্রামেই থাকতেন। পরিবার সকল একান্নবর্তী ছিল এবং পুরুষেরা কেউ কেউ রোজগারের জন্য বিদেশে গেলেও বাকি সকলে গ্রামেই থাকতেন। সে সময় বাংলার জনসংখ্যা অনেক কম ছিল, সেই জন্য বহু জমি পতিত ও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। গ্রামের আশপাশ নির্জন থাকাতে লোকের মন ডাকাত ও ভূত-প্রেতের ভয়ে আচ্ছন্ন ছিল। তখন গঙ্গা ময়রার মত ভূতের রোজারা বহু রোজগার করতেন। শিকড়-বাকড়ে লোকের বিশ্বাস ছিল; অবশ্য তাদের গুণও ছিল যথেষ্ট।

সেই কালে, আমাদের যশোর জেলার কোন এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ বাস করতেন। গ্রামের নাম ছিল কল্যাণপুর আর দেবেনবাবু ছিলেন সেই গ্রামের জমিদার। তার দু-মহলা চকমিলান বাড়ী ছিল। বাহিরের মহলে ছিল জমিদারবাবুর বৈঠকখানা, নায়েব গোমস্তাদের দপ্তর এবং বাইরের কোন অতিথি এলে তাদের থাকবার ঘর। বাইরের মহলের পর উঠোন, তার পরেই অন্দরবাড়ী। বাইরের উঠোনের এক থেকে অন্দর মহলে যাবার একটি গলিপথ ছিল। অর্থাৎ বাহিরের উঠোনের অন্দরের দিকে রক থেকে সেই গলিপথ দিয়ে অন্দরের উঠোনের রকে যাওয়া যেত। অন্দর-বাড়ীর মস্ত উঠোন। সেই দিকেই রান্না-বাড়ী, ভাড়া-ঘর, দাসীদের থাকবার ঘর ছিল। অন্দরের দোতলায় দেবেনবাবুর পরিবারবর্গ বাস করতেন।

কল্যাণপুরের দশ মাইল উত্তরে ঊষা গ্রামে দেবেনবাবুর জমিদারী ছিল। এই গ্রামে নায়েব তহসিলদার ছিলেন রামচন্দ্র পাল। তার একটি মাত্র ছেলে নরেন বা নরু। সে সেই বৎসর এনট্রান্স পরীক্ষা দেবে। টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে নরেন রামবাবুকে বললে, “বাবা। আমাদের বাড়ীতে মোটে দুটি ঘর। আমার পড়াশুনার বড় অসুবিধা হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি পরীক্ষার আগে এই দুটো মাস যদি আমি অন্য কোন স্থানে থেকে পড়তে পারতুম, তাহলে আমি পাস সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারতুম।”

রামবাবু কথাটা বুঝলেন কিন্তু হঠাৎ কোন উপায় স্থির করতে পারলেন না। ঊষা গ্রাম ছিল খুব ছোট। গ্রামটির তিন দিকে জঙ্গল ও এক দিকে ছিল প্রকাণ্ড মাঠ। যদিও এই গ্রামে কয়েক ঘর মধ্যবিত্ত গৃহস্থের বাস ছিল, কাহারও এমন বড় বাড়ী ছিল না যেখানে একটি খালি ঘর পাওয়া যায়। এই বিষয়ে চিন্তা করতে করতে জমিদার মশায়ের কথা রামবাবুর মনে পড়ল। দেবেনবাবু ছিলেন অত্যন্ত ভদ্রলোক ও দয়ালু। রামবাবু নিশ্চিত জানতেন যে তার ছেলেকে দু-মাসের জন্যে স্থান দিতে জমিদারবাবু কখনও আপত্তি করবেন না। তিনি তার ছেলে নরুকে বললেন, “বাবা আমি তোমার থাকবার স্থান স্থির করেছি। আমি আজই কল্যাণপুরে গিয়ে বাবু মশাইকে অনুরোধ করব তিনি যেন তোমাকে পরীক্ষার দুটো মাস তার বাড়ীতে রাখেন। কিন্তু বাবা, একটা কথা বলি। সেই বাড়ীতে বাবু মশাইয়ের পরিবারবর্গ বাস করেন। হয়ত তারা তোমার সঙ্গে মেলামেশা করবেন। তুমি তাদের সঙ্গে খুব সাবধানে কথাবার্তা বলবে। তোমার আঠার বছর বয়স হয়েছে তোমাকে বেশী কিছু বলা বাহুল্য। দেখে বাবা, কেউ যেন আমার নরুর নিন্দে না করে।”

নরু বলল, “বাবা তুমি নিশ্চিন্ত থাক। আমাদের মনিব-বাড়ীর মেয়েদের সঙ্গে কিরূপভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি জানি। তাছাড়া আমি তো দিনরাত লেখাপড়া নিয়েই থাকব। তোমার ভয় নেই, কেউ তোমার ছেলের নিন্দে করবে না”

রামবাবু যা ভেবেছিলেন, তাই হোল। জমিদারবাবু অতি আনন্দের সঙ্গে নরেনকে তার বাড়ীতে রাখতে রাজি হলেন। নরেন যে ঘরটি পেলে তার দরজার সামনেই রক, তার পরেই উঠোন এবং উঠোনের অপর দিকে অন্দরমহলে যাবার রক, সেখান থেকে অন্দরের উঠোনে যাবার শুঁড়ি পথটি আরম্ভ হয়েছে। নরেন এই ঘরে থেকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। সে অন্দরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করত এবং অতি শীঘ্রই জমিদার-গৃহিণী ও তাঁহার কন্যাদের স্নেহ আকর্ষণ করে নিল। নরেন ছিল শান্তশিষ্ট ও বিনয়ী। সেইজন্য যে সবার স্নেহ-ভালবাসা আকর্ষণ করতে পারত। জমিদার-গৃহিণী ও কন্যারা নরেনের সঙ্গে আপনজনের মত ব্যবহার করতেন। এইভাবে নরেন কল্যাণপুরে জমিদার বাড়ীতে অধিষ্ঠিত হল। নরেন তার লেখাপড়ার একটি প্রণালী স্থির করে, দিন-রাতে ক-ঘণ্টা কি বিষয়ে পাঠ করবে তা ঠিক করে নিল। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরও সে ঘণ্টা দুই লেখাপড়া করত। রাত ঠিক বারটা বাজলে লেখাপড়া বন্ধ করে তার ঘরের বাইরে রকে এসে হাত-মুখ ধুতে এবং ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ত।

এই ভাবে দিন যায়। একদিন ঠিক বারটার সময় রকে বসে হাতে-মুখে জল দিয়ে নরেন যখন উঠে দাঁড়াল, উঠোনের অপর দিকে, অন্দরে যাবার রকের দিকে তার নজর পড়ল। নরেন দেখলে যে সেখানে উনিশ-কুড়ি বছরের একটি সুশ্রী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নরেন তাকে চিনতে পারলে না। সে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

পরদিন রাত্রে নরেন পড়ছে আর ভাবছে কে সে মেয়েটি। অত রাত্রে রকে দাঁড়িয়ে কি করছিল? আজও সে আসবে নাকি? নরেন পড়ে আর মধ্যে মধ্যে মেয়েটির কথা ভাবে। এই দোনোমনা করতে করতে রাত বারটা বাজল। নরেন বাইরে হাত-মুখ ধুতে গিয়ে প্রথমেই ওদিকে রকে দৃষ্টি নিক্ষেপ কবলে। দেখলে, ঠিক সেইখানে সে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। নরেন লজ্জা পেল, কি অদম্য কৌতূহল বশতঃ মেয়েটিব দিকে চেয়ে বইল। মেয়েটি ও নরেনকে এক দৃষ্টে দেখছিল। ক্রমে মেয়েটি আস্তে আস্তে নরেনের দিকে এগুতে লাগল যেন, নরেনকে কি বলবে। ক্রমে মেয়েটি উঠোনে নেমে ধীরে ধীরে নরেনের দিকে আসতে লাগল। কিন্তু নরেন আর অপেক্ষা করল না। তার বুক ধড়ফড় করছিল। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে।

নরেনের সে রাত্তিরে ভাল ঘুম হল না। পরদিনও সারাদিন মনটা উচাটন হয়ে রইল। “কে এ মেয়েটা? কোথাও দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। এত রাত্রে সে আমার ঘরের দিকে কেন আসছিল? গোড়ায় মনে করেছিলুম বাবুদের বাড়ীর কোন মেয়ে। কিন্তু তাও তো নয়? মেয়েটি কি ভাল মেয়ে নয়। অথচ মুখ দেখে তো সেরকম মনে হয় না। মুখে কেমন সরল ভাব, যেন আমাকে কি বলতে চায়। দেখি, আজও যদি আসে তো তার পরিচয় নেবার চেষ্টা করব।” নরেন সারাদিন এইসব কথা ভাবল, কিছুতেই মেয়েটিকে মন থেকে সরাতে পারলে না। সেদিন পড়াতে একটুও মন বসাতে পারলে না।

রাত বারটা। নরেন ঘরের বাইরে গিয়ে দেখলে যে, মেয়েটি অজ রক থেকে নেমে উঠোনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। নরেনকে দেখেই মেয়েটি তার কাছে অগ্রসর হয়ে এল। আজ আর নরেন তাকে ফেরাতে পারলে না। মেয়েটি নরেনকে অতি মিষ্টি স্বরে বললে, “তোমাকে আমার বড় ভাল লেগেছে, তাই একটু গল্প করতে এলুম। চল তোমার ঘরে গিয়ে বসি।”

মেয়েটির চোখে কি ছিল জানি না, নরেন যেন মন্ত্রমুগ্ধ কিংবা মোহগ্রস্তের মত হয়ে পড়ল। কেমন এক অবর্ণনীয় ভাব অনুভব করলে। সেটা আনন্দ, ভয়, মোহ, না সুখ! নরেনের মন এবং দেহ দুই-ই যেন আর স্ববশে রইল না। সে মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে তার ঘরে প্রবেশ করলে।

নরেন বললে, “তুমি কে?”

মেয়েটি বললে, “আমি মালতী। তুমি আমায় চেন না। আজ ক-দিন তোমায় দেখছি। তোমায় বড় ভাল লেগেছে, তাই তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এলুম। তুমি রাগ করনি তো?”

নরেন: আচ্ছা, তুমি এত রাত্রে আস কেন?

মেয়েটি: ঠিক রাত বারটার সময় আমার আসবার সুযোগ হয়। অন্য সময়ে আমি চেষ্টা করলেও আসতে পারি না। এইসব জিনিস একদিন আমি তোমাকে ভাল করে বুঝিয়ে বলব। আমি রোজ ঠিক রাত বারটার সময় আসব ও দু’টোর সময় চলে যাব। তোমার কোন ভয় নেই। আমি তোমার কোন অনিষ্ট করব না। আমার পরিচয় জানতে চেও না। আমি তোমার বন্ধু এই কি যথেষ্ট পরিচয় নয়?

নরেনের তখন স্বাভাবিক অবস্থা ছিল না। তা নইলে হয়ত সে মেয়েটির পুরো পরিচয় জানবার জন্য পীড়াপীড়ি করত। কিন্তু সে তা করলে না। সে মেয়েটির সঙ্গে গল্প করতে লাগল। তার মনে এক অনির্বচনীয় আনন্দ, যেন কেমন মোহগ্রস্ত ভাব। নরেনের একবারও মনে হল না যে, এ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। এক অপরিচিত মেয়ে ঠিক রাত বারটার সময়ে আসে, এক মিনিট আগে কি পরে আসতে পারে না, এর মানে কি? তার আত্মীয়স্বজনই বা কোথায়? এ সব কোন কথা নরেনের মনে উদয় হল না। সে কেবল তার সঙ্গে কথাবার্তার আনন্দে ডুবে রইল।

রাত দু’টো বাজতেই মেয়েটি উঠে বললে, “আজ যাই, কাল ঠিক বারোটায় আসব।” বলে মেয়েটি ঘরের বাইরে চলে গেল। নরেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাইরে গিয়ে আর মেয়েটিকে দেখতে পেলে না। সারা উঠোন খাঁ খাঁ করছে আর রকে কোন জন-মনিষ্যি নেই।

পরদিন আবার ঠিক রাত বারটার সময় মালতীর আগমন হল, পড়া সেরে ঘরের বাইরে যেতেই দরজার কাছে মালতীকে সে দেখতে পেলে। তার পরে তারা দু'জনে ঘরের ভিতরে এসে গল্পগুজব আরম্ভ করলে।

এইভাবে দিন কাটছে, নরেনের লেখাপড়া চুলোয় গেছে। নরেন সর্বক্ষণ মেয়েটির কথা ভাবে, এমনই তার আকর্ষণ যে সারাদিন উদগ্রীব হয়ে থাকে, কখন রাত বারটা বাজবে। মেয়েটির সঙ্গ উন্মদার এবং রাত বারটা থেকে দুটো পর্যন্ত এই দু-ঘণ্টা সুখ-স্বপ্নের মত কেটে যায়। কখনো কখনো নরেন ভাবে যে, কে এই মেয়েটি, কোথায় থাকে, কার মেয়ে, কেন রাত্রি বারটার সময় আসে, কেন দু’টোর পরেই চলে যায়, কিছুই বুঝতে পারে না। তাকে জিজ্ঞাসা করলে মালতী কেবল হাসে, বলে, “আমার পরিচয় নিয়ে কি হবে? কেন, আমাকে কি পছন্দ কর না। তুমি প্রায়ই জিজ্ঞাসা কর, কেনই বা আমি বারটার সময় আসি ও দু’টোর সময় চলে যাই। তার কারণটা আজ আমি তোমায় বলি। রাত বারটা থেকে দু’টো পর্যন্ত যে ক্ষণ, কেবল সেই সময়টাই আমি তোমার কাছে আসতে পারি। আমার এমন ক্ষমতা নেই যে, বারটার আগে আসি কিংবা দু’টোর পরেও থাকি।”

নরেন এইসব কথা শোনে আর তার মনে কেমন একটা সন্দেহের উদয় হয়। এক একবার একথাও তার মনের মধ্যে উঁকি-ঝুঁকি মারে যে, এ কি মানুষ নয়। আরও একটা জিনিস সে লক্ষ্য করলে যে, মালতী চলে যাওয়ার পর তার দেহমনে একটি গভীর অবসাদ আসে। সে মড়ার মত ঘুমিয়ে পড়ে ও পরদিন উঠতে অনেক বেলা হয়ে যায়। সে আরও লক্ষ্য করলে যে তার শরীর দিনের পর দিন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে একথা তার মনে বদ্ধমূল হল যে, মালতীর সঙ্গ তার পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। কিন্তু কি করা যায়? কি করে এর হাত থেকে উদ্ধার পাব? নরেন বেশ বুঝতে পেরেছে যে তার পাস হওয়া অসম্ভব এবং এভাবে আর দিন কতক চললে তার শরীর একেবারে ভেঙে পড়বে। নরেন উপায় ঠাওরাতে লাগল যে কি করে মালতীর আসা বন্ধ করা যায়। সে ভাবলে যে, ‘মালতী যখন বলেছে যে রাত বারটা থেকে দু’টো পর্যন্ত তার আসবার সময়, আমি কেন সেই সময়টা দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতর শুয়ে থাকি না। সে দরজা বন্ধ দেখে বুঝতে পারবে যে আমি হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছি।” নরেন প্রতিজ্ঞা করলে যে সেই রাত্রেই সে ঐরূপ করবে।

সেইদিন রাত্রে রাত এগারটার সময় নরেন দরজা বন্ধ করে তার বিছানায় শুয়ে পড়ল। সে ঘুমনোর চেষ্টা করলে কিন্তু ঘুম কিছুতেই এল না। যখন জমিদার বাড়ীর ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারটা বাজছে

তখন ঘরের মধ্যে খস খস করে কেমন একটা শব্দ হল। নরেন এতক্ষণ চোখ বুঁজে পড়েছিল। খস খস শব্দ শুনে নরেন চোখ মেলে দেখলে যে, মালতী ঘরের ভেতর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও এই ব্যাপারে নরেন হতভম্ব হয়ে গেল, কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, সে মালতীকে দেখে আবার মোহাবিষ্ট হল এবং তাড়াতাড়ি উঠে বসে তাকে সাদর সম্ভাষণ জানালে। মালতী হাসিমুখে বললে, “আজ যে বড় দরজা বন্ধ কবে বেখেছ? ঘুমিয়ে পড়েছিলে বুঝি?”

নরেন বললে, “না না, শরীরটা খারাপ বোধ হওয়াতে বিছানায় শুয়েছিলুম, মতলব ছিল বারটা বাজলেই বাইরে যাব। কিন্তু তুমি ঘরের ভেতরে এলে কি করে?”

মালতী হাসতে হাসতে বললে, “আমি এক ম্যাজিক জানি, দরজা বন্ধ থাকলেও কি করে ঘরের ভেতর আসতে পারা যায়, সেকথা তোমাকে একদিন আমি বুঝিয়ে দেবে।”

সে রাত্রে মালতী চলে গেলে নরেন এক লহমাও ঘুমোতে পারলে না। সে কেবলই ভাবে যে মালতী কি করে ঘরের দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ভিতরে আসতে পারলে। যেটা এতদিন তার মনে উকি-ঝুঁকি মারছিল এখন সেই ধারণা তার বদ্ধমূল হল। মালতী যে মানুষ নয়, কোন মৃত স্ত্রীলোক এই ধারণা তার মনের উপর চেপে বসল। কিন্তু আত্মা তো অশরীরী, সে দেহ ধারণ করে কি করে। ক্রমে নরেনের মনে পড়ল যে, মালতী বার বার বলেছে যে, কেবল রাত বারটা থেকে দুটো পর্যন্ত সে নরেনের কাছে আসতে পারে। নরেন ভাবলে, হয়ত কেবল এই সময়টুকুর জন্যই সে স্কুল দেহ ধারণ করতে পারে। নরেনের এ সম্বন্ধে কোন জ্ঞান ছিল না এবং কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলে না। তবে এটা সে স্থির বুঝলে যে এইভাবে আর কিছুদিন চললে পাস করা দূরে থাকুক তার প্রাণ সংশয় হবে।

এর দু’চার দিনের ভিতরেই নরেন কঙ্কালসার হয়ে পড়ল। ভয় ও প্রেতসঙ্গ তার শরীর আর মনকে দগ্ধ করে দিলে। দিন-রাত তার খাওয়া নেই, ঘুম নেই, কেবল রাত্রে ঐ দু-ঘণ্টা সে ভুলে থাকে, এমনি মালতীর আকর্ষণ আর এমনি নরেনের মোহ।

বাড়ীর সকলে দেখলে যে নরেন শুকিয়ে যাচ্ছে। একদিন গৃহিণী অনুযোগ করলেন যে, সে যেন রাত জেগে বেশী পড়াশুনা না করে। তার পুষ্টিকর খাবারেরও বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু কোন ফল হল না। তখন গৃহিণী একদিন জমিদারবাবুকে নরেনের শারীরিক অবস্থার কথা জানালেন।

দেবেনবাবু নরেনকে ডেকে পাঠালেন ও তাকে বহু প্রশ্ন করলেন। নরেন প্রথমটা লুকোতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে শেষটা নরেন সেই মেয়েটির কথা বলে ফেললে। একটি ভদ্রলোকের মেয়ে রাত্রে তার ঘরে আছে শুনে জমিদারবাবু চমকে উঠলেন ও বার বার সে মেয়েটির পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। নরেন বললে, “আমি অনেক জিজ্ঞাসা করেছি, সে কোন পরিচয় দেয় না।”

জমিদার: তুমি তাকে ঘরে ডেকে আন কেন?

নরেন: আমি ডাকি না, সে আপনি আসে।

জমিদার: তুমি দরজা বন্ধ করে থাক না কেন? তুমি তো বলছ যে, সে রাত বারোটার আগে আসতে পারে না। তুমি তার আগেই দরজায় খিল দিয়ে শুয়ে পড় না কেন?

নরে: আমি দরজা বন্ধ করে দেখেছি। দরজা বন্ধ থাকলেও সে ঘরে আসে।

জমিদারবাবু অবিশ্বাসের হাসি হেসে বললেন, “তুমি কি গাঁজাখুরি কথা বলছ? দরজা বন্ধ থাকলে সে আসিবে কেমন করে?”

নরেন: তা জানি না। বোধ হয় তার কোন অমানুষিক ক্ষমতা আছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম। সে খালি হাসে আর বলে, একদিন বুঝতে পারবে।

নরেনের কথা শুনে দেবেনবাবু বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন না ওর রহস্যটা কি। তিনি নরেনকে ভালভাবে জানতেন যে সে সত্যবাদী ও সৎ। বিশেষতঃ তার সামনে সে কখনই মিথ্যা কথা বলবে না। তিনি নরেনকে বললেন, “তুমি আমাকে এই ব্যাপারটা দেখাতে পার?”

নরেন: নিশ্চয় পারি। আপনি রাত বারটার কিছু আগে থাকতে আমায় পাশের ঘরটায় লুকিয়ে থাকবেন, তাহলে সবই দেখতে শুনতে পাবেন।

দেবেনবাবু তখনই নরেনের ঘরে গেলেন ও দরজা, জানলা সব তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করে বুঝলেন যে, দরজা বন্ধ থাকলে বাইরে থেকে সে ঘরে আসা একেবারে অসম্ভব। এই ঘরের পাশেই একটি ছোট ঘর ছিল এবং এই দুই ঘরের মধ্যে একটি ছোট জানলা ছিল। দেবেনবাবু ভেবে দেখলেন যে, ঐ জানলাটা খুলে যদি কেউ আলো নিবিয়ে ঐ ছোট ঘরটায় লুকিয়ে থাকে তাহলে নরেনের ঘরের সব ব্যাপারই সে লক্ষ্য করতে পারবে। দেবেনবাবু মনে মনে এই প্ল্যান স্থির করে রাত্রির জন্য অপেক্ষা করলেন।

রাত বারটার কিছু আগে দেবেনবাবু সেই ছোট ঘরটায় গিয়ে ছোট জানলাটার আড়ালে লুকিয়ে রইলেন, কিন্তু নরেনের ঘরে | ভিতর খর দৃষ্টি রাখলেন। নরেন দরজা বন্ধ করে শুলে তিনি দরজাটির দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন যাতে তার দৃষ্টি এড়িয়ে মেয়েটি ঘরের ভিতর না আসতে পাবে।

দেবেনবাবু এইভাবে চেয়ে আছেন আর নরেনের ঘরে আলো জ্বলছে। ঠিক বারটার সময় তাঁর চোখে কেমন ধাঁধা লাগল। তিনি মুহূর্তের জন্য চোখ বুঁজলেন। তখনই চোখ চেয়ে দেখলেন যে, একটি সুন্দরী মেয়ে নরেনের ঘরের ভিতর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কিসে কি হল তিনি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলেন না। তারপর মালতী ও নরেন যখন কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করলে দেবেনবাবু চুপিসারে সে ঘর থেকে চলে গেলেন। মালতী যে প্রেতিনী সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহ রইল না।

পরদিন প্রত্যুষেই দেবেনবাবু নরেনের বাবাকে এক জরুরী পত্র লিখে ঘোড়সওয়ার দিয়ে ঊষা গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। সেই পত্রে তিনি লিখলেন, “তুমি এখনই এসে নরুকে তোমার গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, নইলে তার প্রাণ সংশয়।”

নরেনকেও ডেকে বললেন যে, তার বাবাকে আনতে লোক গিয়েছে। তিনি এলেই যেন তার সঙ্গে নরেন গ্রামে ফিরে যায়। নরেন খুব রাজী, কারণ রাত্রের ঐ দু-ঘণ্টা ছাড়া নরেন স্ববশে সাধারণ মানুষের মতই থাকত। সে বুঝলে এর হাত থেকে বাঁচতে গেলে তার পালানই মঙ্গল।

সেই দিনই নরেনের বাবা এলেন। নরেনের শরীরের অবস্থা দেখে এবং সব কথা শুনে ভয়ে দুঃখে তিনি পাগলের মত হয়ে পড়লেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে জমিদারবাবুকে বললেন যে, তিনি সেই দিনই নরুকে নিয়ে যাচ্ছেন। দেবেনবাবু বললেন, ‘শুধু নিয়ে গেলে হবে না। একজন ভাল রোজাকে দিয়ে নরুকে দেখাও। ওকে পেতনীটা যেভাবে পেয়েছে তাতে ছাড়ান সহজ নয়।”রামবাবু বললেন, তিনি তাই করবেন।

সেই দিনই তারা ঊষা গ্রামে ফিরে গেলেন।

নরেনের মা সব কথা শুনে কেঁদে সারা। তিনি বললেন, “পরীক্ষা মাথায় থাকুক, ছেলের প্রাণ বাঁচান আগে দরকার।”

নরেনও এত দূরে চলে এসে আর বাবা মাকে নিকটে পেয়ে মনে অনেকটা বল পেলে। সে ভাবলে পেতনীটাকে আর এত দূর আসতে হবে না! সে সকাল সকাল খেয়েদেয়ে তার ঘরে শুতে গেল।

কিন্তু ঘুম আর আসে না। ক্রমেই রাত হচ্ছে আর নরেন ভাবছে সে কি এখানেও আসবে নাকি। এই ভাবে রাত বারটা বাজল আর সঙ্গে সঙ্গে নরেন দেখলে যে, মালতী ঘরের ভিতর দাড়িয়ে আছে। নরেন ভয় পেলে, কিন্তু সেই অদম্য মোহ। সে উঠে মালতীকে সম্ভাষণ করলে।

মালতী: তুমি যে এখানে চলে এলে? তুমি কি ভাবছ ?

নরেন: আমি ভাবছি তুমি কি করে এখানে এলে? আমার শরীর খারাপ হয়েছে বলে বাবা আমাকে নিয়ে এসেছেন।

মালতী: তুমি সত্যি বলছ? তোমাকে আমার কাছ থেকে ছাড়াবার চেষ্টা হচ্ছে না তো? সে কিন্তু কেউ পারবে না, তা যত চেষ্টাই না কর। তুমি কি এতদিনেও বুঝতে পারনি যে আমি কে? তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে। আমি কখনও তোমার অনিষ্ট করব না। কিন্তু তুমি যেখানে যাবে আমিও যাব। তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে এইভাবে আমি আসব। তোমার মৃত্যুর পর আমরা চিরকাল একসঙ্গে থাকব।

মালতীর কথা শুনে নরেনের বুক কেঁপে উঠল, যদিও সে আগেই বুঝেছিল যে মালতী মানুষ নয়, কিন্তু এমন খোলাখুলিভাবে কথা এর আগে কোনদিন হয়নি। যখন মালতী বলে যে, ‘কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে ছাড়াতে পারবে না।”তখন ভয়ে নরেনের সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে এল। সে যদিও অন্যদিনের মত হাসিখুশির ভান করলে, কিন্তু তার মুখ শুকিয়ে উঠতে লাগল।

দু’টোর সময় মালতী চলে গেলেই নরেন পাগলের মত ছুটে গিয়ে তার বাবা-মার শোবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। তাঁরা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে এসে সব কথা শুনলেন ও হাহাকার করে কাঁদতে লাগলেন। সে রাত্রে আর কেউ ঘুমোতে গেলেন না।

পরদিন সকালেই রামবাবু প্রতিবেশীদের ডেকে এনে সব কথা বললেন। তারা বললেন, যত শীঘ্র পারা যায় একজন ভাল রোজাকে ডাকান হোক। আর যতদিন না রোজা আসে ততদিন নরু তার বাবা-মার মধ্যিখানে শোবে। একজন এ সংবাদ দিলেন যে, সাত ক্রোশ দূরে একজন সত্যিকার ভাল রোজা থাকে। তার ভূতপ্রেত সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান, আর সে অনেক দরকারি শিকড়-বাকড়েরও সন্ধান রাখে। সেইদিনই সেই রোজাকে আনতে লোক পাঠানো হল, আর তাকে বলে দেওয়া হল, যাতে তার পরদিনই সে রোজাকে নিয়ে আসে। রোজা যা চাইবে তাই তাকে দেওয়া হবে, একথাও তাকে বলে দেওয়া হল।

সেদিন রাত্রে নরেন বাবা-মার সঙ্গে একঘরে শুল। দু-পাশে বাবা-মা, আর নরেন শুয়েছে মধ্যে, একই বিছানায়। তিন জনই জেগে আছেন, আতঙ্কে ও দুশ্চিন্তায় কেউই ঘুমোতে পারছেন না। এইভাবে রাত বারটা বাজল।

নরেন চোখ বুজে শুয়েছিল। হঠাৎ নরেন অনুভব করলে কে যেন তাকে ঠেলছে। নরেন চমকে চোখ মেলে দেখলে যে মালতী মাথার কাছে বসে আছে। নরেন চুপি চুপি বললে, “তুমি কি করছ, বাবা-মা জানতে পারবেন যে।”

মালতী স্বাভাবিক সুরে বললে, “তোমার সে ভয় নেই, ওঁরা কিছুই জানতে পারবেন না।” নরেন উঠে দেখলে যে তার বাবা-মা মড়ার মত পড়ে আছেন। তারা তখন পাশের ঘরে গেল। একথা বলাই বাহুল্য যে, মালতীই রামবাবু ও তাঁর স্ত্রীকে অজ্ঞান করে রেখেছিল।

পরদিন সব কথা শুনে নরেনের বাবা-মা পাগলের মত বুক চাপড়াতে লাগলেন। নরেনও বুঝলে যে আর তার নিস্তার নেই। আতঙ্কে ও দুশ্চিন্তায় তার শরীরের আর কিছু নেই। দেহ কঙ্কালসার, সব সময় বুক ধড়ফড় করে, মাথা ঘোরে। বহুকষ্টে হাঁটে, এমন কি বসে থাকতেও কষ্ট হয়, সব সময় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সে ভাবছে এ অবস্থার চেয়ে মরে যাওয়াও ভাল। গ্রামের লোকেরাও দুঃখিত। সকলের শেষ আশা সেই রোজা। যদি সে কিছু করতে পারে।

সেদিন বিকেলে রোজার আগমন হল। সে ধীরভাবে আগাগোড়া সব কথা শুনলে আর নরেনের শরীরের অবস্থাও দেখলে। রোজা বললে যে, সে একবার সমস্ত ব্যাপারটা নির্জনে ভেবে দেখবে যে এর কোন উপায় আছে কি না। সে স্পষ্টই বলে যে মেয়েটা যেভাবে নরেনকে গ্রাস করে বসে আছে তাতে তাকে ছাড়া খুব শক্ত। এই বলে রোজা এক নির্জন গাছতলায় গিয়ে বসল। ঘণ্টা দুই বাদে রোজা ফিরে এসে বললে যে সে একটা উপায় বার করেছে, সেটা কিন্তু খুব বিপজ্জনক উপায়। সে রামবাবুকে তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং প্রবীণ প্রতিবেশীদের ডেকে আনতে বললে। রোজা তাদের সামনে তার কথা বলবে এবং যদি সকলের মত হয় তাহলে সে নরেনের ব্যাপারের ভার নেবে। রোজার কথামত তখনই আত্মীয়স্বজনদের এবং প্রতিবেশীদের ডাকা হল। তাঁরা সকলেই রামবাবুর হিতৈষী এবং নরুর মিষ্ট স্বভাবের জন্য তাকে ভালবাসেন। তারা সকলেই রোজাকে বিশেষ অনুরোধ জানালেন যে, যে উপায়েই হোক নরুকে যেন এই ভীষণ বিপদ থেকে রক্ষা করা হয়।

রোজা তাদের বললে, “আপনারা নরেনবাবুর অবস্থা তো দেখছেন। এইভাবে চললে একমাসের মধ্যে তার মৃত্যু নিশ্চিত। কেবল একটি মাত্র উপায় আছে যাতে একে বাঁচান যায় কিন্তু সেই উপায়ের আর একটি দিক আছে, সেটাও আপনারা ভেবে দেখুন। আমার মতলব যদি সফল হয় তাহলে চিরকালের জন্য নরেনবাবু প্রেতিনীর হাত থেকে উদ্ধার পাবেন। কিন্তু যদি অকৃতকার্য হন তাহলে এখনি ওঁর প্রাণ যাবে। এখন আপনাদের ভেবে দেখতে হবে যে আপনারা একমাসের মধ্যে নরেনবাবুর নিশ্চিত মৃত্যু চান অথবা তাকে চিরতরে বিপদমুক্ত করতে চান, যদিও এতে আজই ওঁর প্রাণ যেতে পারে। আপনারা বেশ করে ভেবে জবাব দিন।”

রামবাবুর স্ত্রী দরজার আড়ালে বসে সব শুনছিলেন, তিনি কেঁদে উঠলেন ও অস্ফুট স্বরে বলল, “বাপ রে, যাতে আজই আমার ছেলের প্রাণ যেতে পারে তাতে আমি কখনই মত দেব না।” রামবাবুও দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছেন, কিন্তু তিনি পুরুষ মানুষ, তিনি রোজার কথাটি ভাল করে বিবেচনা করে দেখতে লাগলেন। একজন বৃদ্ধ প্রতিবেশী রোজাকে অনুরোধ করলেন, সে যাতে তার সমস্ত মতলবটা ভেঙে বলে। রোজা বললে, “আমি বলব না, আমি কাউকে কিছু জানতে দেব না, আমি শুধু নরেনবাবুকে যা যা করতে হবে বুঝিয়ে দেব তবে এ সম্বন্ধে আনুষঙ্গিক ব্যাপারও কিছু আছে তা কিন্তু আপনাদের করে দিতে হবে।”

এরূপ জীবন-মরণের কথায় বাপ-মার মতি স্থির করা খুব শক্ত। তাঁরা একবার এ-দিক ভাবেন একবার ও-দিক ভাবেন। প্রতিবেশীরা তখন তাদের বোঝতে লাগলেন। “তোমরা কি চাও না যে নরেন সুস্থ শরীরে সুস্থ মনে স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকে? দিন কতকের মধ্যে ওর প্রাণ তো যাবেই, এরূপে জীবন্মৃত অবস্থায় দিন কতক বেশী বেঁচে থেকে লাভ কি? আমাদের মত হচ্ছে, রোজার কথামত চলা। যখন আর কোন উপায় নেই তখন এই উপায়ই নিতে হবে।”

যদিও কথাটা তারা বুঝলেন তবুও মা-বাপের মন, রামবাবু ও তার স্ত্রী দোনোমনা করতে লাগলেন। যে কাজে আজই ছেলের মৃত্যু হতে পারে কেমন করে তারা তাতে মন দেন। কিন্তু নরেনই এ সমস্যার সমাধান করে দিলে। নরেন বললে, যে তার বর্তমান অবস্থায় সে একদিনও বেঁচে থাকতে চায় না। সে রোজাকে পরিষ্কার বললে, “আপনি আমাকে বাঁচাতে পারেন ভাল নয়তো আজই আমার জীবন শেষ করে দিন, আমি এ নরকযন্ত্রণা আর একটা দিনও সহ্য করতে পাচ্ছি না।”

নরেনের বাবা-মা কাঁদতে লাগলেন আর আত্মীয়স্বজনরা বোঝাতে লাগলেন। শেষে, সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হল যে, রোজার উপরে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া হোক। রোজা বললে, “আজ সন্ধ্যে হয়ে গেছে আজ আর কিছু হবে না, আর একটা রাত্রি নরেনবাবু এইভাবেই থাকুন, কাল আমি এ ব্যাপারে হেস্তনেস্ত করব। তবে এখানে হৰে না। যেখানে নরেনবাবুর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল সেখানে যেতে হবে।” শেষকালে স্থির হল যে, রোজা ও নরেন রামবাবুর সঙ্গে পরদিন সকালে কল্যাণপুরে জমিদার বাড়ীতে যাবে।

সে রাত্রে মালতী নরেনকে বললে, “তোমায় আগেও বলেছি এখনও বলছি যে, কেউ তোমাকে আমার হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবে না, আমি কখনও তোমার কোন অনিষ্ট করব না, তুমি আগে যেখানে ছিলে সেখানে ফিরে যাও, আমার এখানে আসতে কিছু কষ্ট হয়।” নরেন তাকে বললে, “তাই হবে। কালই আমি কল্যাণপুরে ফিরে যাব।’’

পরদিন কল্যাণপুরের জমিদার বাড়ীতে রামবাবু, নরেন ও রোজা উপস্থিত হল। রোজা দেবেনবাবুকে বিষয়টা বুঝিয়ে দিলে এবং বললে, “আপনাকে কিছু সাহায্য করতে হবে।”

দেবেনবাবু খুব আগ্রহের সঙ্গে সব কথা শুনলেন আর বললেন, “তুমি যা চাও করব। নরু আমার ছেলের বাড়া। তাছাড়া মনুষ্যত্বের দিক দিয়েও এই পৈশাচিক ব্যাপারে যাতে অবসান হয় তাতে আমি সর্বপ্রকার সাহায্য করতে বাধ্য।”

রোজা: আপনাকে বেশী কিছু করতে হবে না, আপনি শুধু নরেনবাবুর ঘরটি খুব ভাল করে সাজিয়ে দিন। ঘরটি ঝেড়ে মুছে তক্তপোশ সরিয়ে সেখানে একটি খাট পেতে দিন। আর ঘরটি আর বিছানাটি নানা রকম ফুল ও মালায় সজ্জিত করুন, সব বন্দোবস্ত সন্ধ্যের মধ্যে শেষ করতে হবে।

জমিদার: এতে আর কষ্টটা কি, সন্ধ্যের মধ্যেই সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।

রাত দশটার সময় রোজা নরেনকে নিয়ে সেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে। সেখানে রোজা নরেনকে তার মতলবটা ভেঙে বললে আর খুব ভাল করে নরেনকে বুঝিয়ে দিলে, তাকে কি করতে হবে আর কি বলতে হবে। শেষকালে রোজা বললে, “আপনার জীবন এখন আপনার হাতে, ভূতনাথ মহাদেবের কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি আপনার বুকে বল দিন।”

রাত্রি বারটার কিছু আগে রোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ঠিক রাত বারটায় মালতীর আগমন হল, নরেন খুব আগ্রহের সঙ্গে তাকে আহবান করলে এবং সাজান খাটে বসতে বলে।

মালতী: আজ একি ব্যাপার? এমন খাট এত ফুলের মালা এ কার জন্যে?

নরেন: কেন তোমর জন্যে আর তার পুরস্কারও তো পেলুম।

মালতী: কি পুরস্কার পেলে?

নরেন: কেন কখনও যা করনি তা আজ করেছ। এর আগে তো কখনও তুমি দু-বার আসনি।

মালতী: দু-বার মানে কি? আমি আবার কখন এলুম?

নরেন: তুমি এর মধ্যে ভুলে গেলে? তুমি রাত সাড়ে দশটার সময় এলে আর বলল যে, তুমি ফুল দিয়ে সাজান ঘর দেখে আজ আগেই এসেছ। আমার সঙ্গে ফুল নিয়ে মালা নিয়ে কত কাড়াকাড়ি করলে, এই দেখ বিছানাতে ছেঁড়া মালা ছেঁড়া ফুল পড়ে রয়েছে। এইতো মাত্র পনেরো মিনিট হল তুমি গিয়েছ, এর মধ্যে সব ভুলে গেলে! নাকি আমার সঙ্গে তামাশা করছ?

নরেনের কথা শুনতে শুনতে মালতীর হাসি মিলিয়ে গেল, মুখ হল অসম্ভব গম্ভীর আর চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোতে লাগল।

মালতী: তুমি তো আমার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করছ না? তুমি আমার গা ছুঁয়ে বল যে, আমি আজ রাত্রে আবার এসেছিলুম?

নরেন তখনই তাই করলে। মালতী আর কোন কথা না বলে এক মনে ভাবতে লাগল। মালতীর মুখের সৌন্দর্য গেছে মিলিয়ে, মুখ রাগে কালো হয়ে গেছে আর থমথম করছে। কিছুক্ষণ পরে মালতী নরেনকে বললে যে, এর আগে সে আসেনি আর কেউ তার মত সেজে এসেছিল।

নরেন যেন কত দুঃখ আর ভয় পেয়েছে এইভাবে বললে, “যদি তাই হয়ে থাকে তবে তুমি তার হাত থেকে আমাকে বাঁচাও, আমার তোমাকেই ভাল লাগে আর তোমারই বন্ধুত্ব কামনা করি। যদি আর কেউ এভাবে আসে তাহলে আমি আর বাঁচব না। যে করে হোক তুমি আমাকে এই ঘোর বিপদ থেকে বাঁচাও।”

মালতী কিছুক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করে বলল, “এর এক উপায় মাছে কিন্তু তা কি তুমি পারবে। আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে শবে কি? আমি কে তা জান, এই গভীর রাত্রে আমার সঙ্গে তুমি এক জায়গায় যেতে পারবে?”

নরেন বুঝলে যে এতক্ষণে তার জীবনের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে, তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল এবং বুকের মধ্যে কেমন করতে লাগলো। সে কষ্টে হেসে বললে, “তোমার সঙ্গে যাব তাতে ভয়টা কি ? কিন্তু তুমি কি করতে চাও আমাকে বুঝিয়ে বল।”

মালতী: এখান থেকে দু-মাইল দূরে উত্তর দিকে যে জঙ্গল আছে সেখানে তোমায় নিয়ে যাব। সেখানে এক জায়গায় এক রকমের লতা আছে সেই লতার শিকড় তোমাকে আনতে হবে।

নরেন: তা তুমি কেন নিজেই নিয়ে এস না, তুমি তো সব জায়গায় যেতে পার, বাইরে কী ভীষণ মেঘ করেছে দেখ, তুমি তো জান, আমার হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়।

মালতী: আমি যদি আনতে পারতুম তাহলে কি তোমাকে কষ্ট দি। আমি সে লতা গাছের কাছেও যেতে পারি না। তোমাকেই সে শিকড় আনতে হবে। সেই শিকড় দিনরাত তোমার হাত বেঁধে রাখতে হবে। ঠিক রাত বারটার সময় সেই শিকড় খুলে অন্য ঘরে তফাত করে রেখে আসবে, আর রাত দু’টোর সময় আমি চলে গেলে আবার পরে থাকবে, তাহলে কেউ আর তোমার কাছে আসতে পারবে না।

নরেন আর কিছু বললে না এবং তারা দু’জন ঘর থেকে উঠোনে নামল, ক্রমে উঠোনের বাইরে এসে গ্রামের উত্তর দিকে যেতে লাগল। আকাশ গভীর মেঘাচ্ছন্ন, মধ্যে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, পল্লী পথ জনহীন, নরেনের সঙ্গী কেবল মালতী। সে মানুষ নয়, নরেন জানে। শুধু তাই নয় নরেন দুর্বল বলে মালতী তার হাত ধরে আছে। মালতী তাকে বললে, “এখন তুমি বেশী পরিশ্রম করো না, তুমি আমার কাঁধে ভর দিয়ে চল, মনে রেখ আসবার সময় আমি তোমার কাছে থাকতে পারব না, তোমাকে নিজেই আসতে হবে।”

এইভাবে তারা দু'জনে যাচ্ছে, গ্রাম্য পথ ছেড়ে তারা ধান ক্ষেতের দিকে গেল এবং সরু আলের উপর দিয়ে যেতে লাগল, গভীর অন্ধকারে মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের আলোতে নরেন পথ দেখতে পাচ্ছে, অন্য সময়ে সম্পূর্ণ মালতীর উপর নির্ভর। ক্রমে তারা নদীর ধারে পৌঁছল। সামনেই শ্মশান, যার নাম কালাপেড়ের দেয়াড়। একটি তেঁতুল গাছ দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে, কি নির্জন স্থান, নরেনের বুক সবলে স্পন্দিত হতে লাগল, কিন্তু রোজার কথা তখন তার কানে বাজছে, “নরেনবাবু আপনার জীবন আপনার হাতে, ভূতনাথকে স্মরণ করবেন কোন ভয় নেই।”

এইবার জঙ্গল আরম্ভ হল, এখন আর পথ নেই, প্রেতিনী যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ সেদিকে যাচ্ছে। একটু পরে ডানদিকে একটি বড় অশ্বত্থ গাছ দেখা গেল। মালতী নরেনকে ছেড়ে দিয়ে বললে, “ঐ গাছটার ওপারে আগাছার জঙ্গল আছে। সেখানে গোটাকতক লতানে গাছ আছে, তারই একটা শিকড় সুদ্ধ তুলে নিয়ে এস, তোমাকে একলাই যেতে হবে।”

প্রেতিনীর নির্দেশমতো নরেন অগ্রসর হয়ে গেল এবং সেখানে কয়েকটি লতানে গাছ দেখতে পেলে। মূলসুদ্ধ একটি লতানে গাছ তুলে এনে নরেন পূর্বস্থানে ফিরে এল কিন্তু মালতীকে সে স্থানে দেখতে পেলে না। সে ভয় কম্পিত স্বরে ডাকলে, “মালতী•••।”

প্রায় পঞ্চাশ হাত দূর থেকে মালতী জবাব দিলে, “আমি এখানে আছি। এখন তো মেঘ খানিকটা কেটে গেছে এবং অল্প চাঁদের আলো ফুটেছে আমার সাদা কাপড় তো তুমি দেখতে পাচ্ছ, আমি এগিয়ে যাচ্ছি তুমি পেছনে পেছনে এস।”

নরেন দ্রুতপদে মালতীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললে, “আগে তুমি শিকড়টি দেখ তো, ঠিক জিনিসটি এনেছি কি না।”

মালতী সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতে যেতে বললে, ‘‘হাঁ হাঁ, ঠিক জিনিসই এনেছ, তুমি আমার অত কাছে এস না।”

মালতী এগিয়ে যাচ্ছে আর পঞ্চাশ হাত পিছু পিছু নরেন আসছে। আবার সেই নদীর ধার, সেই কালপেড়ের দেয়াড়। সেই ধান ক্ষেত, আর সরু আলের রাস্তা। আবছা আলোতে নরেন মালতীকে দেখতে পাচ্ছে। ক্রমে গ্রাম্য পথে এসে পৌঁছলে এবং অবশেষে বাড়ী। মালতী চেঁচিয়ে বললে “তুমি শিকড়টা অন্য ঘরে রেখে এস, এখনও দু’টো বাজতে আধ ঘণ্টা দেরী আছে।”

নরেনের রোজার কথা মনে হল। পরিত্রাণের উপায় পেলে তা এক এক মুহূর্তের জন্য ত্যাগ করবে না, তাই নরেন মালতীকে বললে, “আজ আমি বড় ক্লান্ত, আজ তুমি যাও, কাল তুমি এস।”

মালতী বললে, “বেশ তাই হোক এখনই শিকড়টি হাতে বেঁধে ফেল, কাল রাত বারটার সময় আবার খুলে রেখ।”

নরেন বাড়ীতে পোঁছেই জমিদারবাবুর বৈঠকখানা ঘরে গেল। সেখানে রোজা, দেবেনবাবু ও তার বাবা গভীর দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে বসেছিলেন। নরেনকে দেখতে পেয়ে তারা আনন্দে কলরব করে উঠলেন। রোজা জিজ্ঞাসা করলে ওষুধ পেয়েছেন? কি জিনিস পেলেন দেখি?”

নরেন শিকড় সুদ্ধ লতাটি রোজাকে দিলে আর মালতী তাকে যা যা বলে দিয়েছিল তাও বললে। রোজা বললে “আর ভয় নেই, জয় ভগবান।”

সেই রাত্রেই এক বালার ভিতর সেই শিকড় রেখে নরেনের বাহুতে মোক্ষম করে বেঁধে দেওয়া হল। সে এমন বস্ত্র বাঁধন যে নরেন নিজে হাজার চেষ্টা করলেও অপরের সাহায্য ব্যতিরেকে সে বালা খুলতে পারবে না। এ বালা রোজাই সঙ্গে এনেছিল এবং এর গঠনও একটু বিশেষ রকমের। নরেনকে বালা পরিয়ে দিয়ে রোজা বললে, “এখন দিন কতক রাত্রে ও রোজ আসবে এবং অনুনয় বিনয়, এমন কি ভয় প্রদর্শনও করবে। কিন্তু এই বালাই আপনার ‘ইষ্ট কবচ। সে যাই বলুক আর যাই করুক আপনি প্রাণান্তেও এই বালা খোলবার চেষ্টা করবেন না।”

রোজা যা বলেছিল তাই হল। নরেন পরদিন রাত্রে দরজা বন্ধ করে ঘরে শুয়েছে আর মালতী ঘরের বাইরে থেকে শিকড়টি খুলে ফেলবার জন্য অনুনয় বিনয় করছে, আজ আর সে বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে ঘরে আসতে পারলে না। নরেন মালতীর কথার কোন জবাব দিলে না। প্রথম দু-তিন রাত্রি অনুনয়-বিনয় ও পরে ভয় প্রদর্শন, “আমার কথা না শুনলে, আমি তোমার প্রাণ নেব, কেউ তোমায় বাঁচাতে পারবে না।”

কিন্তু নরেন নিরুত্তর। এই উপদ্রব আট-দশ দিন চলেছিল, তারপরে আর মালতী আসেনি। নরেন তার বাবার সঙ্গে গ্রামে ফিরে গেল এবং মা-বাবার আদর-যত্নে অতি শীঘ্রই তার পূর্ব স্বাস্থ্য ও মনের বল ফিরে পেল। নরেনের আনন্দ, মা-বাবার আনন্দ, আত্মীয়স্বজনের আনন্দ, প্রতিবেশীদের আনন্দ, জমিদারবাবু ও তার পরিবারবর্গের আনন্দ, আর সবচেয়ে বড় আনন্দ হচ্ছে রোজার। শুধু সে যে একটি অমূল্য জীবন রক্ষা করেছে তাই নয়, সকলের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছে শুধু তাও নয়, জমিদারবাবু তার কোঁচড় টাকায় ভরে দিয়েছিলেন।*

* এই গল্পটি আমি খুব ছোটবেলায় শুনেছিলাম। —লেখক

ছবি: কালীকিঙ্কর ঘোষ দস্তিদার (সৌজন্য: আরো বিচিত্র কাহিনি)

আপলোড: ৩০/৭/২০২২

No comments:

Post a Comment