Tuesday 5 January 2016

গল্প (মোবাইল ভাঃ): নিশিবস্তির ছেলে (শিশির বিশ্বাস)

নিশিবস্তির ছেলে

শিশির বিশ্বাস

সমে বাহান্ন নম্বর জাতীয় সড়কের ছইবারি মোড় থেকে ভাঙাচোরা যে রাস্তাটা গোটা কয়েক চা বাগান আর জঙ্গল ফুঁড়ে সোজা উত্তরে চলে গেছে, সেজুসা তার প্রায় শেষ প্রান্তে। সামান্য দোকানপাট, হাটবাজার ছাড়াও রয়েছে কিছু সরকারি অফিস। তার কোনোটা অরুণাচল রাজ্যের তো অন্যটা অসমের। আসলে দুটো রাজ্য জড়াজড়ি করে রয়েছে এখানে। উত্তরে পাহাড় থেকে নেমে এসে পাকুই নদী প্রায় আড়াআড়ি বয়ে চলেছে পাশ দিয়ে। ওপারে কাশবন। ঘন জঙ্গল। দূরে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের হাতছানি। সব মিলিয়ে চোখ জুড়িয়ে দেয়। প্রায় নয়শো বর্গ কিলো মিটার আয়তনের বিশাল এই জঙ্গলের নাম সরকারি খাতায় পাকুই অভয়ারণ্য। জঙ্গল বড় হলেও, পাকুই নদী বড় নয় তেমন। ছড়িয়ে থাকা অজস্র ছোট-বড় পাথরের ফাঁক–ফোকর গলে দিনভর বয়ে চলেছে কুলকুল শব্দে। মাঝে চর জেগে উঠেছে কোথাও। নুড়িপাথরের ফাঁকে কাশবন সেখানেও। বছরের অনেকটা সময় বড়-বড় কাশফুলের ফাঁকে ঢেউ খেলে বেড়ায় বাতাস। টাটকা ঘাসের লোভে ওপারের জঙ্গল থেকে হরিণ আর হাতির পাল চলে আসে। বর্ষায় পাহাড়ে জোরালো বৃষ্টি হলে এই পাকুই কিন্তু ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে কখনো। বন্যা আটকাবার জন্য সেজুসাতে ব্যারেজ আছে। ২০০৪ সালের জুন মাসের এক আচমকা বানে আস্ত থাকেনি সেটাও। জলের তোড়ে ভেঙে পড়েছিল হুড়মুড় করে। আধভাঙা সেই ব্যারেজ পড়ে আছে তেমনই।

এদিকে শুধু নিশি উপজাতির বাস। বলা যায়, জঙ্গলেই ঠাঁই ওদের। এই যে সেজুসা, সামান্য হলেও শহরের ছোঁয়া মিলবে। কিন্তু নিশিদের গ্রাম আরো উত্তরে জঙ্গলের ভিতর। চাষবাসের খেতও সেখানে। অরণ্যের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক ওদের। বাঘ হামেশাই হানা দেয় গ্রামে। গরু-ছাগল তুলে নিয়ে যায়। ফসলের মরসুমে বুনো হাতির উপদ্রব। টং-এ উঠে রাতভর পাহারা দিতে হয়। তাই শিকার ওদের রক্তে। হরিণ, মিথুন বা বুনো শুয়োর একটা মেরে আনতে পারলে আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে ভোজের আসর বসে। শিকার করে আনে ধনেশ পাখি, তিতির আর বুনো মুরগি।।

আগে নেকাম দেলোর বাসও ছিল সেখানে। কিন্তু নদীর সেই ভয়ানক বানে অনেকের মতো তারও চাষের খেত, ঘরবাড়ি তলিয়ে যেতে সর্বস্ব খুইয়ে আরো অনেকের মতো পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল সেজুসায়। সরকার থেকে ঘর তোলার জন্য নদীর ওপারে সামান্য জমি আর সাহায্যও মিলেছিল। দপ্তরের বাবুরা তার নাম দিয়েছিলেন নিশিবস্তি। আশ্রয় একটা জুটলেও জমিজমা হারিয়ে এরপর পেট চালানোই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিশিবস্তির মানুষের। একসময় নেকাম দেলো তো ভেবেই ফেলেছিল, নিশিবস্তির পাট উঠিয়ে চলে যাবে অসমের ওদিকে কোনো চাবাগানে। তা, এর মধ্যেই ঘটে গেল ব্যাপারটা।

সেজুসার বন দপ্তরের অফিসে নতুন একজন ডি.এফ.ও এলেন। কাজের মানুষ। অল্প দিনের মধ্যেই চোরা শিকার আর বেআইনি কাঠ পাচার বন্ধ করার জন্য আশপাশে গ্রামের সরপঞ্চ আর সাধারণ মানুষ ডেকে একাধিক সভা করে বোঝালেন তাদের। খবর দিতে পারলে নগদ পুরস্কারের কথাও ঘোষণা হল। অরণ্যেই বাস নিশি জাতির মানুষের। শিকার ওদের রক্তে। তবু কাজ হল কিছু। প্রধান কারণ ডি.এফ.ও সাহেব নিজেও ওই নিশি উপজাতির মানুষ। সেজুসার আশপাশে সহজ সরল মানুষগুলোর সঙ্গে তাই সহজেই মিশে যেতে পেরেছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বনের পশু-পাখি মারা যে ঠিক নয়, সামান্য হলেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কাজও হয়েছিল।

সেদিন ডি.এফ.ও সাহেব চেম্বারে বসে কিছু জরুরি কাজ সারছিলেন। হঠাৎ তাকিয়ে দেখেন দরজার বাইরে পর্দা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ছোট একটি ছেলে। রোগা ডিগডিগে শরীর। ম্যালেরিয়ায় ভুগে ফুলে উঠেছে পেট। বয়স বছর সাতেক হয়তো। কিন্তু অপুষ্টির দরুন মনে হয় আরো কম। শুকনো মুখ। দারিদ্র আর ম্যালেরিয়া বড় ভয়ানক সমস্যা এদিকে। ঘরে-ঘরে ম্যালেরিয়ার রোগী। ছেলেবেলায় তিনি নিজেও ভুগেছেন। গরিব ঘরের ছেলে ছিলেন। পেট ভরে খাওয়াও জুটত না অনেকদিন। তবু লেখাপড়াটা শিখতে পেরেছিলেন গ্রামের এক মিশনারি স্কুলের সৌজন্যে। শুরু করেছিলেন বিট অফিসার হয়ে। আজ প্রমোশন পেয়ে অনেকটা উঠে এলেও ফেলে আসা সেই দিনগুলো ভোলেননি। ইশারায় ডাকলেন ভিতরে। বিনা দ্বিধায় ছেলেটা ঢুকে পড়ল তৎক্ষণাৎ।

‘নাম কী?’ জিজ্ঞাসা করলেন উনি।

‘অঙ্গা।’ ছেলেটার সপ্রতিভ উত্তর।

‘বাড়ি কোথায়? বাবার নাম কী?’

‘নেকাম দেলো। নিশিবস্তিতে ঘর।’ ঝটপট উত্তর এল।

ছেলেটার ওই সপ্রতিভ কথা ভাল লাগল ডি.এফ.ও সাহেবের। তিনি নিজেও এমনটাই ছিলেন ছেলেবেলায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, এখন তো ভাই কাজ রয়েছে আমার। পরে গল্প করা যাবে একদিন। কেমন?’

‘আমি কিন্তু গল্প করতে আসিনি সার।’

ছেলেটার শুকনো মুখ দেখে ডি.এফ.ও সাহেবের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বেচারার আজ সকাল থেকে খাওয়া জোটেনি। কিছু ব্যবস্থার জন্য বেয়ারার খোঁজে কলিং বেলের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। থেমে গেলেন।

‘একটা খবর আছে সার।’ ছেলেটি গলা প্রায় খাদে নামিয়ে আনল।

‘কী খবর?’ দারুণ আগ্রহে ডি.এফ.ও সাহেব ততক্ষণে ঝুঁকে পড়েছেন ওর দিকে।

‘সার।’ এই প্রথম ছেলেটা সামান্য ইতস্তত করল। ‘গতকাল বিকেলে উত্তরে পাহাড়ের দিকের জঙ্গলে গিয়েছিলাম। দেখি জনাকয়েক চোরা শিকারির একটা দল ঘাঁটি গেড়েছে। সঙ্গে দুটো বন্দুক। গোটা কয়েক জাঁতি কলের ফাঁদ। দূর থেকে দেখেই পালিয়ে এসেছি। গেলে এখনো ধরা যায়।’

অভিজ্ঞ ডি.এফ.ও সাহেব আর দেরি করেননি। লোকজন নিয়ে তৎক্ষণাৎ বের হয়ে পড়েছিলেন নিজেই। ফলও পেয়েছিলে। দু’জন চোরা শিকারিকে পাকড়াও করেছিলেন একেবারে হাতেনাতে। সঙ্গে দুটো দেশি বন্দুক। বেআইনি চোরা শিকারের বিরুদ্ধে নতুন ডি.এফ.ও সাহেবের সফল অভিযান সেই প্রথম।

তারপর কেটে গেছে প্রায় একটা বছর। ধরা পড়েছে আরো অনেকে। বাজেয়াপ্ত হয়েছে গোটা চল্লিশেক বেআইনি বন্দুক, হাজার-হাজার কুইন্টাল চোরাই কাঠ। সেজুসায় কারও এখন জানতে বাকি নেই, জঙ্গলে চোরা শিকার, বেআইনি কাজের খবর পৌঁছে দেবার জন্য খুব গোপন একটা টিম আছে তাঁর। ফাঁকি দেবার উপায় নেই। চোরা শিকার এখন তাই বন্ধ হয়েছে অনেকটাই। অঙ্গা ছেলেটার কথা অবশ্য ভোলেননি ডি.এফ.ও সাহেব। ওর বাবা নেকাম দেলোকে বন দপ্তরে ছোটখাটো একটা চাকরি দিয়েছেন। হঠাৎ সাহেবের এই অনুগ্রহের কারণ জানতে পারেনি সে-ও। অঙ্গাও বলেনি। সাহেব অবশ্য একদিন কাজের ফাঁকে নেকাম দেলোর কাছে জানতে চেয়েছিলেন ছেলের খবর। স্কুলে ভরতি বা চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে কিনা। নেকাম ঘাড় নাড়ালেও ব্যাপার হল তেমন কিছুই করে উঠতে পারেনি সে। সামান্য মাইনে যা মেলে, সংসার চালাতেই শেষ হয়ে যায়। তার উপর বাড়িতেও থাকা হয় না তেমন। দূরে এক ক্যাম্পে জঙ্গল পাহারার কাজ। হাতির পিঠে সেখানে পৌঁছোতেই লেগে যায় আধ বেলা। ঘরের দিকে নজর দেবে, সময় কোথায়? তবে সাহেবের কথায় ছেলেকে কাছেই এক মিশন স্কুলে ভরতি করে দিয়েছে। কিন্তু স্কুলে অঙ্গার তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না। মাসের বেশিরভাগ দিনই ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়ে থাকতে হয় ঘরে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বরটা হঠাৎ যখন আসে বেহুঁশ একেবারে। আর ভাল থাকলে নিশিবস্তির ছেলে অঙ্গার দিন কাটে জঙ্গলে-জঙ্গলে।

পাকুইয়ের এই বিশাল জঙ্গল কেমন ঘোরের মতো টানে ওকে। ভিতরে পাহাড়ের পর পাহাড়। রকমারি ঝরনা, নদী-নালা। বৃষ্টির পরে কেমন পালটে যায় সব। অন্য এক রূপ তখন। আর কত দিনের পুরনো সব গাছ! গায়ে জমাট পুরু শ্যাওলা। হরেক জাতের পরগাছা, অর্কিডের মেলা। সারা বছর সেগুলো মিইয়ে থাকে। আগাছার বেশি ভাবা যায় না। কিন্তু সময় হলেই অপরূপ ফুলে ছেয়ে যায়। নানা রঙের ছোঁয়ায় তখন ঝলমল করে ওঠে। চোখ ফেরানো যায় না। কোন অর্কিডে কখন ফুল ধরবে, এখন দেখেই বলে দিতে পারে ও। সেই কবে বাবাই একদিন জঙ্গলে নিয়ে এসেছিল। দেখার শুরু সেই থেকে। জ্বরটা ঝামেলা না করলে অঙ্গা তাই সারা দিন বনে বনেই ঘুরে বেড়ায়। কোথা দিয়ে পার হয়ে যায় সময়। ডি.এফ.ও সাহেবের কাছে অবশ্য তারপর আর যাওয়া হয়নি। বাবার কাছেই শুনেছে, সাহেব নাকি একদিন ওর খোঁজ করেছিলেন। জিজ্ঞাসা করেছিলেন স্কুলের খবর। শুনেই সিটিয়ে গিয়েছিল বেচারা। ওদিকে পা বাড়াতে ভরসা হয়নি আর। তবু যেতেই হল একদিন।

দিন কয়েক আগে ডি.এফ.ও সাহেবের কাছে হঠাৎ খবর এসেছিল দূরের গ্রামের একজন জঙ্গল থেকে একটা ভালুকছানা ধরে এনেছে। বড়জোর মাস খানেক বয়স। পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল জঙ্গলের পথে। দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। চা–বাগানের ওদিকে ভালুকের বাচ্চা কিনতে মাঝেমধ্যে লোক আসে। দাম পাওয়া যায়। বাচ্চাটাকে তুলে এনে গোপনে আটকে রেখেছিল ঘরে। খদ্দেরের খোঁজে ছিল। কিন্তু ফাঁকি দিতে পারেনি ডি.এফ.ও সাহেবকে। খবরটা যথা সময়েই পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর কাছে। লোক পাঠিয়ে বাচ্চাটাকে তখনই নিয়ে এসেছিলেন তিনি। খুব ছোট বাচ্চা। বনে ছেড়ে দিলে মা ছাড়া না-ও বাঁচতে পারে। তাই সেটাকে কদিন রেখে দেওয়াই ঠিক হল। নদীর ওপারে জঙ্গলের ভিতর সেজুসার বন-বাংলো। ব্যারেজ ভেঙে পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন প্রায় পরিত্যক্ত। পাহারার জন্য চৌকিদার রয়েছে। অনেক ভেবে সেখানেই রাখা হল বাচ্চাটাকে। ঠিক হল, খানিক বড় হলে ছেড়ে আসা হবে জঙ্গলে।

দিন কয়েক জ্বরটা বেশ ভোগাচ্ছে অঙ্গাকে। একবার কাঁপুনি দিয়ে এলে সহজে আর ছাড়তে চায় না। বড় দুর্বল শরীরটা। অন্ধকার খুপরি ঘরের এক কোণে নড়বড়ে বাঁশের মাচায় ছেঁড়া এক চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকে সারা দিন। কদিন তাই আর বের হতে পারেনি। বাবা জঙ্গলের ক্যাম্পে। মার কাছেই প্রথম শুনতে পেল ব্যাপারটা। শুয়ে ছিল বিছানায়। দারুণ চমকে ধড়মড়িয়ে উঠে বলল, ‘বাচ্চাটাকে জঙ্গলের কোথায় পাওয়া গেছে। মা?’

মার জানা ছিল না। বলতেও পারেনি। কিন্তু অঙ্গার উপায় ছিল না। ভাগ্য ভাল। জ্বরটা সেদিন কম। দেরি না করে ছুটেছিল জঙ্গলের দিকে। বিকেল পড়ে আসতে শুরু করেছে তখন। থমথমে বাতাস। দিন শেষে সেই ঝিম ধরা বাতাসে আওয়াজ তুলে ফিরছে ধনেশ পাখির দল। বিকেলের মরা আলোয় ঝিমঝিম করছে। পাকুইয়ের জঙ্গল। তবে অঙ্গার চিন্তা নেই তেমন। এমন কত বিকেল এই জঙ্গলে চষে বেড়িয়েছে। বেশ জানে, জঙ্গল শত্রু নয় ওর। কতদিন বাঘ, বুনো শুয়োর নয়তো হাতির পালের মুখোমুখি পড়ে গেছে। কেউ ঘাঁটায়নি কাউকে। নীরবে যে যার পথে চলে গেছে। জঙ্গলে পা দিলেই এখন বুঝতে পারে আশপাশে ওদের কেউ রয়েছে কিনা। এড়িয়ে যায় সেদিক। তবু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল একবার। দিচু পাহাড়ের কাছে ঘটেছিল সেই ব্যাপারটা। জঙ্গলের ভিতর ওখানে লেটকুর বন। বড়-বড় গাছগুলো মরসুমে ভরে থাকে ফলে। অন্য পাখিদের সঙ্গে বড় ধনেশ পাখিও উড়ে আসে পাকা ফলের লোভে। চলে আসে অঙ্গাও। দিন কয়েক টকমিষ্টি লেটকু খেয়ে পেট ভরায়। পাশে ঝরনার ধারে চমৎকার গুহাও আছে একটা। কতদিন বৃষ্টিতে ছুটে ওই গুহায় ঢুকে মাথা বাঁচিয়েছে।

মাস কয়েক আগে সেই গুহায় হঠাৎই আস্তানা পেতেছিল মস্ত এক ভালুক। অত বড় ভালুক আগে কখনো দেখেনি। গোড়ায় কিছুদিন তাই এড়িয়ে চলত জায়গাটা। কিন্তু পাকা লেটকু ফলের জন্য পারেনি বেশিদিন। ভালুকটা আশেপাশে নেই বুঝলেই চলে আসত। তারই মধ্যে ভালুকটার ফুটফুটে একটা বাচ্চা হল। একদিন লেটকু ফলের খোঁজে গেছে, বাচ্চাটার কুঁই-কুঁই আওয়াজ শুনে এগিয়ে দেখে ভয়ানক ব্যাপার। মা-ভালুকটা নেই, এক ঝাঁক লাল পিঁপড়ে ছেঁকে ধরেছে বাচ্চাটাকে। দেখে ছুটে গিয়ে তুলতুলে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। একটা-একটা করে খুঁটে ফেলেছিল পিঁপড়েগুলো। হুঁশ ছিল না কোনো দিকে। হঠাৎ খেয়াল হতে জঙ্গলে সেই প্রথম বুকটা কেঁপে উঠেছিল অঙ্গার। বিশাল মা–ভালুকটা কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেও পারেনি। বনের এই মা-ভালুক বড় ভয়ংকর। কিন্তু প্রাণীটার চোখে হিংস্রতার লেশমাত্রও ছিল না তখন। তাই সামলে নিতেও সময় লাগেনি। আলতো করে নামিয়ে দিয়েছিল বাচ্চাটাকে। ভালুকটাও নিশ্চিন্তে দুধ খাওয়াতে বসে গিয়েছিল বাচ্চাকে। ফিরেও তাকায়নি ওর দিকে। কে শত্রু আর কে মিত্র, তা কী বোঝে ওরা? হয়তো। তবে তা নিয়ে অঙ্গা মাথা ঘামায়নি আর।

অঙ্গা লেটুকু বনে যখন পৌঁছলো অন্ধকার তখন নামতে শুরু করেছে। চারপাশে ঝিঁঝির কোরাস তীব্র হয়েছে আরো। মানুষের পায়ের আওয়াজে জঙ্গল ফুঁড়ে চাপা গর্জনে হঠাৎ ছুটে এল ভালুকটা। তারপর ওকে দেখেই বসে পড়ল ধুপ করে। কুঁই-কুঁই শব্দে ডাকতে লাগল করুণ সুরে। বিশাল আকারের প্রাণীটার চোখের কোলে কদিনের শুকিয়ে থাকা জলের ধারা দেখে কিছু আর বুঝতে বাকি থাকেনি ওর।

অঙ্গার জ্বরটা রাতে কাঁপুনি দিয়ে বাড়ল আবার। ভোরের দিকে সামান্য কমলেও মায়ের চোখ এড়িয়ে বের হওয়া গেল না। খানিক বেলার দিকে কী কাজে বেরিয়েছে মা, সেই সুযোগে চুপি-চুপি ও বের হয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। নদী পার হয়ে সোজা ডি.এফ.ও অফিসে। ভালুকের বাচ্চাটাকে ছেড়ে দেবার জন্য যে করে হোক রাজি করাতেই হবে সাহেবকে। সেদিন যখন হয়নি, সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আজও অসুবিধা হবে না নিশ্চয়। সব বুঝবেন তিনি।

কিন্তু সব কিছু কী আর হিসেব মতো হয়? জ্বর গায়ে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ও ডি.এফ.ও অফিসে এসে পৌঁছল, শোনে, অল্প আগে জরুরি কাজে ইটানগরে রওনা হয়ে গেছেন সাহেব। দিন তিনেকের আগে ফেরার সম্ভাবনা কম। শুনে মুষড়ে পড়লেও অঙ্গা হতাশ হয়নি একেবারে। দিন তিনেক অপেক্ষা না করে উপায় নেই। কিন্তু তার পরেই যা শুনতে পেল, তাতে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল ও। বাবা কাজ করে বন দপ্তরে। সেই সুবাদে অনেকেই এখন চেনে ওকে। তাদের কাছেই শুনল ব্যাপারটা। খোদ মন্ত্রী ডেকে পাঠিয়েছেন সাহেবকে। দু’এক মাসের মধ্যে সেজুসায় আসতে চান তিনি। সাহেব তাই ঠিক করেছেন, যতদিন মন্ত্রী না আসছেন। ভালুকের বাচ্চাটাকে রেখে দেবেন। মন্ত্রী এলে, তাঁর হাত দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে জঙ্গলে। গুয়াহাটি, কলকাতা, এমনকী দিল্লি থেকেও জনা কয়েক রিপোর্টার আনা হবে। কাগজে ফলাও করে ছাপা হবে সেই ছবি। এই মাস দুয়েক বাচ্চাটার যাতে অযত্ন না হয়, তা দেখার জন্য রেঞ্জার সাহেবের উপর দায়িত্ব পড়েছে। বরাদ্দ হয়েছে আলাদা খরচ।

নিশিবস্তির ঘর থেকে পুরনো বন-বাংলোটা দূরে নয়। মিনিট পাঁচেকের মতো পথ। কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া হাতার ভিতর অযত্নে বেড়ে ওঠা বড়-বড় ঘাস। শুকনো ঝরাপাতার স্তূপ। এক পাশে বড় একটা আঙুরের ঝাড়। ওই আঙুরের লোভে আগে প্রায়ই আসত এদিকে। অযত্নে গাছটা শুকিয়ে গেছে এখন। তাই আর আসা হয় না তেমন। অনেক দিন পরে অঙ্গা আজ হাজির হল সেই বন-বাংলোয়।

বাড়িটা ঝিম মেরে পড়ে থাকত সারা দিন। চৌকিদার ছিল একজন। কিন্তু বিশেষ দেখা যেত না তাকে। আজ ব্যাপার দেখে একটু মুষড়েই পড়ল। হঠাৎ পালটে গেছে সব। পরিষ্কার করা হয়েছে চারপাশ। চৌকিদার তো আছেই, সঙ্গে নতুন একজন গার্ড। লোকটা পরিচিত নয়। ঢুকতেই তেড়ে এল হইহই করে। ভাগ্যিস, পুরনো চৌকিদারও ছিল। তাই গলাধাক্কাটা খেতে হল

সাহেবের কড়া হুকুম, ভিতরে উটকো কারও ঢোকা চলবে না। ভালুকের বাচ্চাটার ক্ষতি হতে পারে তাতে। আরো দু’জন গার্ড আসছে আগামী কাল থেকে। দু’বেলা টাটকা দুধ আর ফলের রস আনা হচ্ছে বাচ্চাটার জন্য। নিয়ম করে একজন ডাক্তারও আসছেন। চমৎকার সুযোগটা ডি.এফ.ও সাহেব হাতছাড়া করতে চান না।

গেটের বাইরে থেকেই তাই ফিরে আসতে হল অঙ্গাকে। তবে নিরাশ হল না। এ বাড়ির প্রতিটি ইট-কাঠ, প্রতিটি কোণ ওর পরিচিত। চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে জ্বরটাও বুঝি বাড়তে শুরু করেছে আবার। শীত-শীত করছে। ঘরে ফিরে চাদরটা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তে পারলে বেশ হত। কিন্তু ভাবতে গিয়ে প্রায় আঁতকে উঠল ও। মা নিশ্চয় ফিরে এসেছে এতক্ষণে। দেখলেই চ্যাঁচামেচি জুড়ে দেবে। আর বের হতে পারা যাবে না। যে করেই হোক কাজটা সারতে হবে আজই। আগামী কালই নাকি দু’জন নতুন গার্ড আসবে। কাজটা তখন আরো কঠিন হয়ে উঠবে।

টয়লেট সাফ করার জন্য বাংলোর পিছনে ছোট এক দরজা আছে। বাইরে থেকে তালাবন্ধ থাকে। অনেক দিন ব্যবহার হয় না বাংলোটা। তালাটা খোলা থাকাও সম্ভব। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অনেকটা ঘুরে ও একসময় কাঁটা তারের বেড়া টপকে নিঃশব্দে হাজির হল সেখানে। যা ভেবেছে তাই। শিকল তোলা থাকলেও তালাটা নেই। ভিতরে ঢুকতে অসুবিধা নেই আর। ওদের মিশন স্কুলের মহারাজ মাঝে-মধ্যে ক্লাস নিতে আসেন। এক আধ দিন ও যে স্কুলে যায়, সে ওই মানুষটার টানেই। বড় ভাল লাগে মানুষটার কথা। প্রায়ই বলেন, ইচ্ছে আর জেদ থাকলে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। পথ একটা ঠিক বের হয়ে যায়। ওই জেদটাই হল আসল। অঙ্গা ওর এই সামান্য বয়সেই বুঝেছে, অমন খাঁটি কথা হয় না আর। আজ তালাটা যদি লাগানও থাকত, অন্য কোনো পথ বের হয়ে যেত ঠিক।

সন্তর্পণে দেয়ালে কান রাখল ও। ভিতরে চাপা কুঁই-কুঁই স্বরে দরজায় ঢু মারছে ছোট্ট প্রাণীটা। বের হতে চাইছে। অঙ্গার মনে হল, এখুনি ঢুকে পড়ে ভিতরে। কিন্তু ইচ্ছেটাকে দমন করল ও। বোকার মতো কাজ হয়ে যাবে তাহলে। গার্ড আর চৌকিদার দু’জনেই এখন রয়েছে। আর খানিক পরেই স্নান-খাওয়ার সময় হবে। হাতার এক কোণে ওদের থাকার ঘর। চলে যাবে সেই দিকে। সুযোগটা তখনই নিতে হবে।

যা ভয় করেছিল তাই হল শেষ পর্যন্ত। জ্বরটা বাড়তেই লাগল ক্রমশ। মাথাটা ছিঁড়ে পড়ছে যন্ত্রণায়। পুড়ে যাচ্ছে গা। ঘাসের উপর একটু শুয়ে পড়লে বেশ হয়। কিন্তু হার মানলে চলবে না যে। দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশব্দে এক ঝোপের আড়ালে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ও। তারপর যখন বুঝল গার্ড আর চৌকিদার নেই ওদিকে, দরজার শিকল নামিয়ে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল ঘরের ভিতর। ভয় ছিল, ভালুকের বাচ্চাটা আবার চ্যাঁচামেচি জুড়ে না দেয়। কিন্তু তেমন হল না কিছু। বরং পরম নিশ্চিন্তে গুটিসুটি হয়ে জড়িয়ে রইল ওর কোলের ভিতর। পা টিপে এরপর বাইরে বের হয়ে এল অঙ্গা। বন-জঙ্গল ভেঙে ছুটল হাওয়ার বেগে।

দুপুর গড়িয়ে দিচু পাহাড়ে বিকেল নামতে শুরু করেছে তখন। ভরপেটে বুলবুলির ঝাঁক গান জুড়েছে গাছে-গাছে। খুশিতে গাছ থেকে গাছে ছুটোছুটি করছে কাঠবেড়ালির দল। কলরব তুলে উড়ে গেল এক ঝাঁক পাহাড়ি ময়না। খুশিতে প্রায় উড়ে চলেছে অঙ্গও। ফিরছে ঘরের দিকে। একটু আগেই ও ভালুকের বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে লেটকু গুহায় মায়ের কাছে। এত আনন্দ, এত খুশি ওর জীবনে আর আসেনি কখনো। খানিক আগের সেই ভয়ানক জ্বরটাও সেরে গেছে যেন। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। স্কুলের মহারাজ সন্ন্যাসী মানুষ। তার কথা কি আর মিথ্যে হতে পারে? চলতে চলতেই ঠিক করে ফেলে, এবার থেকে স্কুলে আর কামাই করবে না। বাবা পাহারার কাজে সারা মাস পড়ে থাকে জঙ্গলের ক্যাম্পে। বাড়ির খোঁজ নেবার সময় পান সামান্যই। আগামী কালই মাকে রাজি করিয়ে চা-বাগানে ওদিকে ভাল কোনো ডাক্তারের কাছে যাবে। অসুখটা সারিয়ে ফেলতেই হবে এবার। লেখাপড়া শিখে সাহেবের মতো একদিন ডি.এফ.ও হতেই হবে ওকে। এই সেজুসাতেই।

খুশিতে দ্বিগুণ বেগে ও চলতে থাকে জঙ্গলের পথে।

ছবি: সৌরীশ মিত্র (সৌজন্য: আনন্দমেলা)

1 comment:

  1. অপূর্ব!! মা এর কাছে তার শিশু কে ফিরিয়ে দেওয়ার চেয়ে পূণ্য কাজ আর কিছু আছে? বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মায়ের কোলে, সে যে প্রাণীর শিশু ই হোক।

    ReplyDelete