Monday 9 January 2017

ছেলেবেলার ভাললাগা গল্প (মোবাইল ভার্শন): বামা (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

বামা
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
মার যখন বাইশ চব্বিশ বছর বয়েস তখন নানা দেশ বেড়ানোর একটা কাজ জুটে গেল অদৃষ্টে। তখন আমি দৈব্য ঔষধের মাদুলি বিক্রি করে বেড়াতুম। চুঁচড়োর শচীশ কবিরাজের তরফ থেকে মাইনে ও রাহাখরচ পেতুম। অল্প বয়সের প্রথম চাকরি, খুব উৎসাহের সঙ্গেই করতুম।
আমাকে কাপডচোপড় পরতে হত সাধু ও সাত্বিক বামুনের মতো। ওটা ছিল ব্যবসায়ের অঙ্গ। গিরিমাটির রঙে ছোপানোর কাপড় পরণে, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, গলায় মালা, হাতে থাকতো একটা ক্যাম্বিসের বাগ, তারই মধ্যে মাছলি ও অন্যান্য ওষুধ থাকতো।
বছর তিনেক সেই চাকরি করি, তারপর শরীরে সইলো না বলে ছেড়ে দিলুম।
একবার যাচ্ছি বৰ্দ্ধমান জেলার মেমরি স্টেশন থেকে মাখমপুর বলে একটা গ্রামে। এট। মাদুলি বিক্রির জন্যে নয়; মাখমপুরে শচীশ কবিরাজের শ্বশুরের বাড়ী। সেখানকার জমিজমার ওয়ারিশান দাড়িয়েছিলেন শচীশবাবু শ্বশুরের ছেলেপুলে না থাকায়। আমাকে পাঠিয়েছিলেন পৌষ-কিস্তির সময় জমিজমার খাজনা যতটা পারি আদায় করে আনতে।
কিন্তু তা হলেও পরণে আমার গেরুয়া কাপড়, হাতে মাদুলি ও ওষুধভরা ক্যাম্বিসের ব্যাগ ইত্যাদি সবই ছিল, যদি পথেঘাটে কিছু বিক্রি হয়ে যায়, কমিশনটা তো পাব !
কখনও ও অঞ্চলে যাইনি। মেমরি স্টেশনে নেমে বেলা দুটেfর সময়ে হাঁটচি তো হেঁটেই চলেচি, পথ আর ফুরোয় না। এক জায়গায় একটা ছোট বাজার পড়লো, সেখানে কিছু খেয়ে নিয়ে আবার পথ হাঁটি ।
গ্রামে গ্রামে ওষুধ বিক্রি করে বেশ কিছু রোজগারও করা গেল দেরিও হল বিশেষ করে সেই জন্যে । আর একটা বাজার পড়লো। সেখানে দোকানদারদের কাছে শুনলুম, আমার গন্তব্য স্থানে পৌঁছুতে অন্তত রাত নটা বাজবে। কিন্তু সকলেই বললে, “সন্ধ্যের পরে আগে গিয়ে আর পথ হাঁটবেন না, ঠাকুরমশায়। এই সব দেশে ফাঁসুড়ে ডাকাতের বড় ভয়, বিদেশী দেখলে মেরেধরে যথাসৰ্ব্বস্ব কেড়ে নেয়। প্রায়ই বনের ধারে বড় বড় মাঠের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। সাবধান, একটা দীঘি পড়বে মাঠের মধ্যে ক্রোশ তিনেক দূরে, জায়গাটা ভালো নয়---
বড় বড় মাঠের ওপর দিয়ে রাস্তা। সন্ধ্যা প্রায় হয়-হয়, এমন সময় দূরে একটা তালগাছ ঘেরা দীঘি দেখা গেলআমার বুক টিপচিপ করে উঠলো। দীঘির ও-পাশে সঞ্জয়পুর বলে একটা গ্রাম, সেখানেই রাত্রের জন্যে আশ্রয় নেওয়ার কথা বাজারে বলে দিয়েছিলো। কিন্তু সন্ধ্যা তো হয়ে গেল তালদীঘির এদিকেই অন্ধকার হবার দেরি নেই, কোথায় বা সঞ্জয়পুর, কোথায় বা কি ?
মনে ভারি ভয় হল। কি করি এখন? সঙ্গে মাদুলি ও ওষুধ বিক্রির দরুণ অনেক টাকাপরক্ষণেই ভাবলাম, কিছু না পারি, দৌড়তে তে পারব? না-হয় ব্যাগটাই যাবে, প্রাণ তো বঁচবে ।
ভয়ে ভয়ে দীঘির কাছাকাছি তো এলুম। বড় সেকেলে দীঘি, খুব উচু পাড়, পাড়ের দু’ধারে বড় বড় তালগাছের সারি। তার ধার দিয়েই রাস্তা। দীঘির পাড়ে কিন্তু লোকজনের সম্পর্ক নেই। যে ভয় করেছিলুম, দেখলুম সবই ভূয়ো। মানুষ মিথ্যে যে কেন এ-রকম ভয় দেখায়!
প্রকাণ্ড দীঘিটার পাড় ঘুরে যেমন তালবনের সারি ও দীঘির উচু পাড়কে পেছনে ফেলেচি, সামনেই দেখি ফাঁকা মাঠের মধ্যে দূরে একটা গ্রাম লি-লি করছে নিশ্চয় ওটা সেই সঞ্জয়পুর।
বাঁচা গেল বাবা! কি ভয়টাই দেখিয়েছিল লোকে! দিব্যি ফাকা মাঠ, কাছেই লোকের বসতি, গায়ের গরু বাছুর চরছে মাঠে কেন এ সব জায়গায় বিপদ থাকবে?
আমি এই রকম ভাবচি, এমন সময় তালপুকুরের ওদিকের পাড়ের আড়ালে যে পথটা, সেই পথ বেয়ে একজন বৃদ্ধকে আমার দিকে আসতে দেখলুম। বৃদ্ধ বেশ বলিষ্ঠ গড়নের, এই বয়সেও মাংসপেশী বেশ সবল, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ছোট একটা লাঠি ।
বৃদ্ধ আমায় বললে, “ঠাকুরমশায় কোথায় যাবেন ?”
যাব মাখমপুর...
মাখমপুর! সে যে এখনও তিন ক্রোশ পথ...কাদের বাড়ী যাবেন?”
শচীশ কবিরাজের বাড়ী।
ঠাকুরমশায় কি কবিরাজমশায়ের গোমস্তা?”
গোমস্তা নই, তবে যাচ্ছি জমিজমার কাজে বটে।
এ অঞ্চলে আর কাউকে চেনেন? "মশাইয়ের নিজের বাড়ী কোথায়?”
আমি এদিকে কখনও আসিনি, কাউকে চিনিওনে। মাখমপুরেও নতুন যাচ্ছি...
সেখানেও কেউ তাহলে আপনাকে চেনে না?”
নাঃ, কে চিনবে?”
আমার এই কথায়, আমার যেন মনে হল বুড়ো একটু কি ভাবলে, তারপর আমায় বললে, কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা বলি রাত্রে আজ দয়া করে আমার বাড়ীতে পায়ের ধুলো দিন। আমরা জাতে বারুই, জল-আচরণীয়, আপনার অসুবিধে হবে না। চণ্ডীমণ্ডপের পাশে বাইরের ঘর আছে, সেখানে থাকবেন, রান্নাবাড়া করে খাবেন আসুন দয়া করে---
আমি বৃদ্ধের কথায় ভারী সন্তুষ্ট হলুম। সত্যিই তো, সেকালের লোকেরা অন্য ধরণের শিক্ষায় মানুষ। অতিথি-অভ্যগতদের সেবা করেই এদের তৃপ্তি। বৃদ্ধ এই প্রস্তাব না করলে রাঢ় অঞ্চলের অজানা মেঠো পথ বেয়ে এই সুমুখ-আঁধার রাতে আমায় যেতেই তো হত মাখমপুরে, তিন ক্রোশ হেঁটে ।
গ্রামের পূর্বপ্রান্তে বড় মাঠের ধারে বৃদ্ধের বাড়ী। বুদ্ধের নাম নফরচন্দ্র দাস। আমি চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে উঠতেই একটা কুকুর ঘেউঘেউ করে উঠলো।
কুকুরের এই ডাকটা আমার ভালো লাগলো না। এর আমি কোন কারণ দিতে পারবো না কিন্তু এই কুকুরের চিৎকারে যেন একটা ছন্নছাড়া অমঙ্গলজনক অর্থ আছে মঙ্গলসন্ধ্যায় কোন গৃহস্থবাড়ীতে আসি নি, যেন শ্মশানভূমিতে এসেচি
বৃদ্ধের বাড়ী দেখে মনে হল বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। বাড়ীর উঠোনে সারি সারি তিনটে বড় বড় ধানের গোলা। গোলার সঙ্গে প্রকাগু গোয়ালঘর, বলদ ও গাইয়ে প্রায় কুড়ি বাইশটা৷ অন্তপুরের দিকে চারখানা বড় বড় আটচালার ঘর। বাইরের এই চণ্ডীমণ্ডপ ও তার পাশে আর একখানা কুঠরি!
আমার কথাটা ভালো করে বুঝতে গেলে এই কুঠরিটার কথা আর একটু ভালো করে শুনতে হবে। কুঠরিটিকে চণ্ডীমণ্ডপ সংলগ্ন একটা কামরাও বলা যায়, কারণ একটা সরু রোয়াকের দ্বারা চণ্ডীমণ্ডপের পেছন দিকের সঙ্গে সংলগ্ন। অথচ দোর বন্ধ করে দিলে বাইরের বাড়ীর সঙ্গে এর সম্পর্ক চলে গিয়ে এট ভেতরবাড়ীর একখানা ঘরের সামিল হয়ে দাঁড়ায়।
আমায় বাসা দেওয়া হল এই কুঠরিতে। কুঠরির একপাশে ছোট একটা চালা। সেখানে আমার রান্নার আয়োজন করে দিয়েচেহাত-মুখ ধুয়ে সুস্থ হয়ে আমি বিশ্রাম করচি।
গৃহস্বামী এসে বললে, “ঠাকুরমশায় রান্না চাপান, আর রাত করেন কেন?”
আমি রান্নাচালায় বসে রান্না চড়িয়ে দিতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি একটি বাড়ীর বৌ ভেতর থেকে একগাছা ঝাঁটা হাতে এসে আমার রান্নাচালার সামনে দিয়ে ঢুকলো ও ঝাঁট দিতে লাগলো।
কুঠরির দরজা খোলা। আমি যেখানে বসে সেখান থেকে কুঠরিটার ভেতর দেখা যায়। আমি দু-একবার বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলুম বৌটি ঝাঁট দিতে দিতে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখচেদু'তিন বার বেশ ভালো করে লক্ষ্য করে মনে হল বৌটি ইচ্ছে করেই আমার দিকে অমন করে চাইচে
আমি দস্তুরমত অবাক হয়ে গেলুম। ব্যাপার কি? সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়ে, পল্লীর গৃহস্থবধু এমন ব্যবহার তো ভালো নয়? কি হাঙ্গামায় আবার পড়ে যাবো রে বাবা। কর্তাকে কাছে বসিয়ে রাখতে রাখতে গল্প করবো নাকি ?
এমন সময় বৌটি বাঁট শেষ করে চলে গেল। কিন্তু বোধ হয় পাঁচ মিনিট পরেই আবার এলো। দেখে মনে হল সে যেন খুব ব্যস্ত, উদ্বিগ্ন, উত্তেজিতএবারও সে কুঠরির মধ্যে ঢুকে এটা ওটা সরাতে লাগলো এবং আমার দিকে চাইতে লাগলো, তারপর হঠাৎ রান্নাচালার দরজায় এসে চকিতদৃষ্টিতে চারদিক চেয়ে কেউ নেই দেখে আমার দিকে আরও সরে এলো এবং নিচুম্বরে বললে, “ঠাকুরমশায়, আপনি এখনই এখান থেকে পালান, না হলে আপনি ভয়ানক বিপদে পড়বেন। এরা ফাঁসুড়ে ডাকাত, রাতে আপনাকে মেরে ফেলবে।” —বলেই চট করে বাড়ীর মধ্যে চলে গেল ।
শুনে তো আর আমি নেই! হাতের খুন্তি হাতেই রইলো, সমস্ত শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সারা হাত-পা অবশ ও ঝিমঝিম করতে লাগলো। বলে কি! দিব্যি গেরস্তবাড়ী, গোলাপালা, ঘরদোরডাকাত কি রকম ?
কিন্তু পালাবোই বা কেমন করে? এখন বেশ রাত হয়েচে। সামনের চণ্ডীমণ্ডপে বৃদ্ধ বসে লোকজনের সঙ্গে কথা কইচে। ওখান দিয়ে যেতে গেলেই তো সন্দেহ করবে!
কাঠের মতো আড়ষ্ট হয়ে গিয়েচি একেবারেহাতে পায়ে জোর নেই, কিছু ভাববারও শক্তি লোপ পেয়েচেমিনিট পাঁচেক এমনি ভাবে কাটলোএমন সময়ে দেখি সেই বৌটি আবার কি-একটা কাজে কুঠরির মধ্যে ঢুকে খোলা দরজা দিয়ে আমার দিকে চেয়ে দাড়িয়ে রইল।
মেয়েটি কথা বলবার পূৰ্ব্বেই আমি বললুম, “তুমি যে হও, তুমি পরম দয়াময়ী। বলে দাও কোন পথে কি ভাবে পালাবো•••
বৌটি চাপা গলায় বললে, “সেই জন্যেই এলুম। সব দেখে এলুম। পালাবার পথ নেই। ওরা ঘাটি আগলে রেখেচে...
আমি বললুম, “তবে উপায় !
মেয়েটি বললে, “একটা মাত্র উপায় আছে। তাও আমি ভেবে এসেচি। আমি এ-বাড়ীতে আর ব্ৰহ্মহত্যা হতে দেব না। অনেক সহ্য করেচি, আর করবো না। দাঁড়ান ঠাকুরমশায়, আর একবার বাড়ীর মধ্যে থেকে আসি, নইলে সন্দেহ করবে।
মিনিট পাচেক পরে বৌটি আবার এলো, চকিত দৃষ্টিতে চারদিকে চেয়ে বললে, “শুমুন, আমার উপায় এই কথা কটা মনে রাখুন। মনে যদি রাখতে পারেন, তবে বাঁচাতে পারবো। আমার নাম বামা, আমি এ-বাড়ীর মেজবৌ, আমার বাপের বাড়ীর গ্রামের নাম কুসুমপুর, জেলা বৰ্দ্ধমান, থানা রায়না। আমার বাপের নাম হরিদাস মজুমদার, জ্যাঠামশায়ের নাম পাঁচকড়ি মজুমদার, আমরা দুই বোন, আমার দিদির নাম ক্ষাস্তমণি, বিয়ে হয়েচে সামন্তপুর-তেওটা, বৰ্দ্ধমান জেলা। শ্বশুরের নাম দুর্ল্লভ দাস। সবাই জাতে বারুই। আমার বাবা, জ্যাঠামশায় সব বেঁচে আছেন, কিন্তু মা নেই
আমার তখন বুদ্ধি লোপ পেতে বসেচে। যা বলে মেয়েটি তাই করে যাই। এতে কি হবে ? বৌটি কিন্তু এক একবার বাড়ীর মধ্যে যায়, আবার অল্প দু'মিনিটের জন্যে ফিরে এসে আমায় তালিম দেয়মনে আছে তো ? জ্যাঠামশায়ের নাম কি ?”
আমি বললুম, “হরিদাস মজুমদার••••
নানা, পাঁচকড়ি মজুমদার, বাবার নাম হরিদাস মজুমদার- আমার দিদির নাম কি ? শ্বশুরবাড়ী কোন গাঁয়ে?••••
ক্ষান্তমণি। শ্বশুরবাড়ী হশ্বশুরবাড়ী--"
আপনি সব মাটি করলেন দেখচি ! সামন্তপুর তেওটা, বলুন--
সামন্তপুর –তেওটা শ্বশুরের নাম রামযদু দাস দুর্লভরাম দাস---
অবশেষে মিনিট দশ-বারোর মধ্যে আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে এসেচে। বৌটি বললে, “রান্না-খাওয়া করে নিন ঠাকুরমশায়, কোন ভয় করবেন না। আমার বাপের বাড়ীর নাম-ধাম যখন জানা হয়ে গেছে, তখন আপনাকে বাঁচাতে পেরেচি। এখন শুনুন, খাওয়া-দাওয়ার পরেই শ্বশুরমশায়ের কাছে আমার বাপের বাড়ীর পরিচয় দিয়ে বলবেন আপনি তাদের গুরুবংশ, আমার নাম বলে জিগ্যেস করবেনআমার বিয়ে হয়েচে কোথায়, জানো নাকি ? গলা যেন না কাঁপে, কোনরকম সন্দেহ যেন না হয়আমি চললুম, আবার আসবে। আপনি শ্বশুরকে বলবার পরে কিন্তু দেরি করবেন না বেশি, বিপদ কখন হয় বলা তো যায় না
রান্না-খাওয়া শেষ না করলেও তো সন্দেহ করতে পারেরান্না-খাওয়া করতেই হরাত্রের অন্ধকার তখন বেশ ঘন হয়ে এসেচে, রাত আন্দাজ দশটার কম নয়, আহারাদির পর নিজের কুঠুরিতে বসেচি, আর আমার মনে হচ্ছে এ বাড়ীর সবাই যেন খাঁড়ায়, রাম-দাতে শান দিচ্ছে, আমার গলাটি কাটবার জন্যে।
এই সময় গৃহস্বামী স্বয়ং আমার জন্যে পান নিয়ে এলোবললে, “কি ঠাকুরমশায়, আহারাদি হ? এখন দিব্যি করে শুয়ে পড়ুন। মশারীটা টাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। রাত হয়েচে আর দেরি করবেন না •••
আমি বললুম, “হ্যা, একটা কথা বলি আমাদের এক মন্ত্রশিষ্য, বাড়ী কুসুমপুর, থানা রায়না, নাম পাঁচকড়িইয়ে, হরিদাস মজুমদার, তার একটি মেয়ের নাম বামা এ দিকেই কোথায় বিয়ে হয়েচেতারাও জাতে তোমাদের বারুই কিনাতাই হয়তো চিনলেও চিনতে পারে। মেয়েটির জ্যাঠা দুর্ল্লভরাম ইয়ে পাঁচকড়িআমায় বলে দিয়েছিল মেয়েটির শ্বশুরবাড়ী খোঁজ করে একবার সেখানে যেতেতা যখন এলুমই এ দেশে••••
আমার কথা শুনে বৃদ্ধ যেন কেমন হয়ে গেল, আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বললে, “কুসুমপুরের হরিদাস মজুমদার? বামা? আপনি তাদের চিনলেন কি করে?”
বামার কথা স্মরণ করে গলা না কাঁপিয়ে দৃঢ়স্বরে বললুম, “আমি ষে তাদের গুরুবংশআমার বাবার ওরা মন্ত্রশিন্য কিনা?
বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি বললে, “বসুন, আমি আগচি••••
আমি একটা কুঠরির মধ্যে বসে রইলুম, সন্দেহ ও ভয় তখনও কিছু যায় নি। আর এরা ষে গুরুদেবকেই রেহাই দেবে তা কে বলেচে?
কিছুক্ষণ পরে বৃদ্ধ ফিরে এল। পেছনে পেছনে সেই বধুটি, আর একজন ষণ্ডামার্ক গোছের যুবক এবং একজন প্রৌঢ় স্ত্রীলোকসম্ভবত বৃদ্ধের স্ত্রী।
বৃদ্ধ বললে, “এই যে বামা, ঠাকুরমশায়আমারই মেজছেলের সঙ্গে এই আমার মেজ ছেলে শম্ভু গড় করো সব, গড় করো। মেজবৌমা, দেখ তো, চিনতে পারো এঁকে?
চমৎকার অভিনেত্রী বটে বামা! অদ্ভুত অভিনয় করে গেল বটে। ঘোমটা খুলে হাসিমুখে সে আমার পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলে গলায় আঁচল দিয়ে। জীবনদাত্রী, দয়াময়ী বামা! আমার চোখে প্রায় জল এসে পড়লো।
তারপর সে রাত্রি তো কেটে গেল। খাবার জল দেবার ছুতো করে এসে বামা আমায় আশ্বাস দিয়ে গেল। বললে, “বিপদ কেটে গিয়েছে; আমার চোখে না পড়লে সৰ্ব্বনাশ হ, ভিটেতে ব্ৰহ্মহত্যে হত। অনেক হয়েছে এই কুঠরিতে এই বিছানায়, এই মেঝেতে অনেক লাশ পোঁতা
আমার মনের অবস্থা বলবার নয়। বললুম, “পুলিস কি গাঁয়ের লোক কিছু টের পায় না? কিছু বলে না?”
কে কী বলবে! এ ফাঁসুড়ে ডাকাতের গাঁ। সবাই এরকম। আগে জানলে কি বাবা এখানে বিয়ে দিতেন? বিয়ের পর সব ধরা পড়ে গেল আমার কাছে। এখন আমার একটি সন্তান হয়েছে। এ পাপ-ভিটেয় বাস করলে তার অকল্যাণ হবে। ওকে বারণ করি, কিন্তু ও কি করবে? মাথার ওপর শ্বশুরমশায় রয়েচেন। পুরনো ডাকাত, দাদারা রয়েচে আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন বাবাঠাকুর, আর ভয় নেই•••
সকাল হল। বিদায় নেবার সময় বৃদ্ধ আমায় পাঁচ টাকা গুরু-প্ৰণামী দিলে। বামাকে আড়ালে ডেকে বললুম, “তুমি আমার মা, আমার জীবনদাত্রী। আশীৰ্ব্বাদ করি চিরসুখী হও মা।

বামার মতো বুদ্ধিমতী নারী জীবনে আর আমার চোখে পড়ে নি। কতকাল হয়ে গেল, এই বৃদ্ধ বয়সেও সেই দয়াময়ী পল্লীবধুটির স্মৃতিতে আমার চোখে জল এসে পড়ে, শ্রদ্ধায় মন পূর্ণ হয়ে ওঠে।
আপলোড: ১৫/১২/২০১৭

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভার্শন): পাঁচ মুন্ডির আসর (হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়)


স্টেশনের নাম লোচনপুর। সেখান থেকে আবার দু ক্রোশ পথ। যানবাহন বলতে কিচ্ছু নেই। গরমে আর শীতে যাও-বা গরুর গাড়ি চলে কিন্তু বর্ষায় তা আর সম্ভব নয়। মাঝখানে দু-দুটো খাল। অন্য সময়ে বালির স্তুপ হয়ে থাকে কিন্তু বর্ষায় ফুলেফেঁপে একেবারে অন্য চেহারা। তখন খেয়া নৌকো ছাড়া যাতায়াত একেবারেই অসম্ভব।
কিন্তু আমার না গিয়ে উপায় নেই। কোর্টের কাজ। এই চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে পুবাই গাঁয়ের সর্বেশ্বর জানা'কে ধরতে হবে। ধরা মানে, কোর্টের ভাষায় সমন ধরিয়ে দেওয়া। এই কাজ না করতে পারলে চাকরি থাকবে না।
হয়তো গিয়ে দেখব আগে থাকতে খবর পেয়ে সর্বেশ্বর জানা ডুব মেরেছে। কোথাও পাওয়া যাবে না তাকে। তাই যদি হয়, তাহলে তার বাড়ির দরজায় নোটিশ সেঁটে দিয়ে আসতে হবে। মোট কথা, যেতে আমাকে হবেই।
যাত্রা শুরু করলাম। কাঁচা মাটির পথ কিছুটা গিয়েই শেষ হয়ে গেল। তারপর আল। হাতখানেক চওড়া। সার্কাসে সরু দড়ির ওপর দিয়ে যেভাবে লোকে ব্যালেন্স রেখে হাঁটে, তেমনিই সাবধানে ব্যালেন্স রেখে আলের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটু এদিকওদিক হলেই কাদাগোলা জলে নাকানিচোবানি খেতে হবে। একমাত্র ভরসা, এখনও যথেষ্ট দিনের আলো রয়েছে, চারদিক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হাতের লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে চললাম। 
যা শুনেছিলাম, তা ভুল। খাল দুটো নয়, একটা। খেয়া নৌকোর ব্যবস্থা নেই। সরু খালের ওপর বাঁশের একটা সেতু আছে। দু'হাতে বাঁশ আঁকড়ে ধরে খাল পার হলাম।
তারপর একটা সরু পায়ে চলা পথ। দু'পাশে ঘোড়া নিম আর আশশ্যাওড়ার গাছ। জায়গাটা বেশ অন্ধকার।
মাইলকখানেক পথ পার হয়ে এসে পুবাই গাঁয়ে এসে হাজির হলাম।
ছোট্ট গ্রাম। একটা দোকান আর গোটা দশেক চালাঘর এই গ্রামের সীমানায়।
বরাত ভালই বলতে হবে। সর্বেশ্বরকে একেবারে বাড়ির দাওয়াতেই পেয়ে গেলাম। বসে বসে গাবের আটা দিয়ে জাল মাজছিল।
তার কাছে খোঁজ করতেই বাজখাঁই গলায় বলল, "আমিই সর্বেশ্বর জানা। বাবার নাম ঈশ্বর পতিতপাবন জানা। মশাইয়ের প্রয়োজন? "
প্রয়োজনের কথাটা তাকে শোনাতেই চমকে উঠল সর্বেশ্বর। এমন জানলে হয়তো জাঁক করে নিজের পরিচয়ই দিত না।
কাজ শেষ করে কোঁচার খুঁটে গাল, কপাল মুছে নিয়ে বললাম, "একটু জল খাওয়াতে পারেন?"
সর্বেশ্বর একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল। সে দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছে।
তারপর বলল, "লোচনপুর থেকে আসবার সময় একটা খাল পার হয়ে এসেছেন না?"
ঘাড় নেড়ে বললাম, "হ্যাঁ"।
সর্বেশ্বর বলল, "অনেক জল পাবেন সেই খালে। পেট ভরে চুমুক দিতে পারবেন।’’
অবস্থা দেখে আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। দাঁড়াতে সাহস হলো না। কিছু বলা যায় না, দলবল ডেকে এনে যদি লাঠির ঘায়ে এখানেই খতম করে মাটিতে পুঁতে দেয়, তাহলেও কেউ জানতে পারবে না।
কোর্টের পেয়াদার ভাগ্যে মারধোর হামেশাই জোটে। লোকজন ক্ষেপে উঠে আধমরা করে দেয়। একবারও ভাবে না, আমরা কর্মচারী মাত্র। আদেশ পালন করছি। শুধু নির্দেশ জারি করাই আমাদের কাজ।
বুঝতে পারলাম, এ গাঁয়ে ঠাঁই হবে না। ভেবেছিলাম, রাতটা কোথাও বিশ্রাম নিয়ে ভোর ভোর রওনা হব, কিন্তু তা হবার নয়।
একেবারে গাঁয়ে প্রবেশের মুখে যে দোকানটা দেখেছিলাম, সেখানে এসে দাঁড়ালাম।
দোকানী দোকানেই ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, "খাবার জিনিস কিছু পাওয়া যাবে?"
দোকানী নড়েচড়ে বসে বলল, "কি চাই বলুন কত্তা?"
চেয়ে দেখলাম, দুটো মুড়ির ধামা পাশাপাশি সাজানো। আরও গোটা কয়েক জার আছে, সবকটিই খালি।
দোকানীই আবার বলল, "মুড়ি আছে, পাটালিগুড় আছে"।
"আর কিছু? দুধ কিংবা কলা?"
"আজ্ঞে না, ওসব পাবেন না।"
নিরুপায়। মুড়ি আর পাটালিগুড় নিয়েই কাঠের বেঞ্চের ওপর বসে পড়লাম। দু এক গাল মুখে দিয়েই বুঝতে পারলাম, মুড়িগুলো অন্তত এক সপ্তাহের বাসি আর পাটালিগুড় যে এত তেতো হয় কি করে, ভেবে কুলকিনারা পেলাম না।
খাওয়া শেষ করে, জল খেয়ে পয়সা দেবার মুখে জিজ্ঞেস করলাম, "এখানে রাতটা কাটাবার জায়গা হবে? এই দোকানঘরের একপাশে একটু জায়গা পেলেই রাতটা কাটিয়ে দিতে পারব।"
কোনও উত্তর নেই দেখে মুখটা তুলেই শঙ্কিত হলাম।
দোকানী একদৃষ্টে আমার বুকের ওপর আটকানো পেতলের চাকতিটার দিকে দেখছে। যেটার ওপর কোর্টের নাম খোদাই করা আছে।
তাড়াতাড়ি আমার হাত থেকে পয়সা কটা কেড়ে নিয়ে দোকানী হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, "না মশাই, থাকার জায়গা টায়গা হবে না। ছেলেপুলে নিয়ে থাকি, এখানে আপনি শোবেন কোথা?"
বললাম, "সন্ধে তো হয়ে গেল। তাহলে এখন যাই কোথা?"
দোকানী বলল, "এইবেলা স্টেশনের দিকে রওনা হয়ে পড়ুন। কতটা আর পথ। কলকাতা যাবার শেষ গাড়ি দশটা বত্রিশে। অনায়াসেই পেয়ে যাবেন।"
আমাকে আর কিছু বলার অবসর না দিয়ে দোকানী ঝাঁপ বন্ধ করতে শুরু করল। যাতে দোকানের সামনে থেকে অন্তত সরে যেতে বাধ্য হই।
বুঝতে পারলাম, এ গাঁয়ে আশ্রয়ের কোনও আশা নেই। বুকে কোর্টের নামাঙ্কিত চাকতিটাই আমার কাল। কোর্টের পেয়াদাকে এরা সমনের শামিল বলে মনে করে।
ঠিক করলাম, স্টেশনেই চলে যাব। সত্যিই তো, আর কতটাই বা পথ। যেতে ঘন্টা দুই বা তিন লাগলেও হাতে অনেক সময় থাকবে।
অগত্যা লাঠিটা বাগিয়ে ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। কোর্টের নামাঙ্কিত চাকতিটা খুলে নিয়ে পকেটের মধ্যে রেখে দিলাম।
চারদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। গাছপালার জন্য আরও ঝুপসি ঠেকছে। যাবার সময় দিনের আলোয় যে পথ মসৃণ, সরল মনে হয়েছিল, আধো অন্ধকারে সেই পথেই বারবার হোঁচট খেতে লাগলাম। 
একটু পরে অন্ধকার ঘন হলো। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। চাঁদের দেখা নেই। তারাও নেই। ঝোপের ফাঁক থেকে শেয়াল ডেকে উঠল। হুক্কা হুয়া...হুক্কা হুয়া.....হুয়া....হুয়া.....।
শক্ত হাতে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। শেয়ালকে ভয় নেই। শেয়াল জ্যান্ত মানুষের কাছে ঘেঁষে না। কিন্তু এই জঙ্গলে আর কোনও হিংস্র জন্তু নেই তো? কোনও ভয়ানক জংলি জানোয়ার?
প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর খেয়াল হলো এতক্ষণে খালের পারে পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল। বাঁশের সেতুর কাছ বরাবর। দুটো হাত আড়াআড়িভাবে চোখের ওপর রেখে চারদিক নিরীক্ষণ করলাম। এখনও অন্ধকার সূচিভেদ্য হয়ে ওঠেনি। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে আবছা আবছা দেখা যায়। চারদিকে গাছের জটলা। অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাসে গাছের পাতাগুলো শিরশির করে কাঁপছে।
আর কোনও সন্দেহ নেই। নিশ্চয় পথ হারিয়েছি। সম্ভবত জঙ্গলের মধ্যে একাধিক পায়ে চলা পথ আছে। অন্ধকারে ঠাহর হয়নি। একটা পথের বদলে আরেকটা পথ ধরে হাঁটতে আরম্ভ করেছি।
এখন উপায়?
লাঠিটা ঠুকে চিৎকার করে বললাম, "কে আছ? আমি পথ হারিয়েছি। আমায় সাহায্য করো।"
একবার, দু'বার, তিনবার। চিৎকারে কোনও ফল হলো না। শুধু গাছের ডালে বিশ্রামরত কাকের দল কা-কা করে ঝটপট শব্দে উড়ে গেল।
কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। যেভাবেই হোক, এই জঙ্গল থেকে বেরোতেই হবে। নইলে রাত বাড়বে, আর এই জায়গাটাকে দেখে মোটেও নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
সোজা রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম। গাছপালার যেন আর শেষ নেই। যত এগোই, জঙ্গল যেন ততই দুর্ভেদ্য হয়ে আসে।
পায়ের পাশ দিয়ে সরসর করে সরীসৃপগতিতে যেসব প্রাণী চলাফেরা করছে, সেগুলোর কথা ভেবে গলা কাঠ হয়ে এল আমার।
বেশ কিছুক্ষণ চলাফেরার পর মনে হলো, জঙ্গল যেন একটু ফিকে হয়ে এসেছে। চারদিকে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। অন্ধকারে জোড়া জোড়া জ্বলন্ত চোখ ঘোরাফেরা করছে। বুঝলাম, সে চোখের মালিক শেয়ালের দল।
জঙ্গল পার হয়ে এসে মনে একটু সাহস ফিরে এল আমার। ভাল করে চেয়ে দেখলাম, কোথাও এতটুকু যদি আলোর বিন্দু চোখে পড়ে। গ্রামের নিশানা। 
হঠাৎ পেছন থেকে একটা বিকট শব্দ এল।
"বলো হরি, হরিবোল......বলো হরি, হরিবোল.....বলো হরি......"
হিন্দুদের শবযাত্রা চলেছে কোথাও। সেই শব্দে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল আমার।তবু এই ভেবে মনে আশ্বাস পেলাম যে, এই নির্জন জঙ্গলে আমি একলা নই। আরও লোক আছে। এই শবযাত্রীদের জিজ্ঞাসা করলেই সঠিক পথের হদিশ পাব।
হরিধ্বনি আরও কাছে আসতেই আমি পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। সেটাই নিয়ম। অনন্তপথের যাত্রীকে প্রথমে পথ দেওয়া উচিত।
লাঠিতে ভর দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অন্ধকারের বুক চিরে একটা মশাল এগিয়ে আসছে। একটু পরেই শববাহীদের দেখা গেল। সামনেপিছনে শুধু চারজন একটা খাটিয়াকে বহন করে নিয়ে চলেছে। সামনের ডান দিকের লোকটার হাতে মশাল। আর কারোর হাতে আলো নেই।
"শুনুন!" 
কাতর কন্ঠে অনুরোধ জানালাম।
শববাহকরা থামল না, শুধু চলার গতি একটু মৃদু করল আর চারজনেই আমার দিকে দৃষ্টি ফেরাল।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল। আমি ভীতু, এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না, কিন্তু আমার মনে হল, আমার হাতের মুঠিটা আলগা হয়ে লাঠিটা বোধহয় পড়েই যাবে মাটিতে, সমস্ত শরীর অজানা একটা কিছুর আতঙ্কে কেঁপে উঠল।
চারজন লোকেরই ঠিক একরকম চেহারা। একইরকম দেখতে। মাথায় অবিন্যস্ত চুল, রক্তিম চোখ, এমনকি মুখে বসন্তের দাগ পর্যন্ত - অবিকল একরকম।
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শববাহকরা আবার ' বলো হরি, হরিবোল' বলতে বলতে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
ক্রমে ওরা আমায় ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে গেল।
আর গোটা ব্যাপারটা নিয়ে আমার ভেতর উথালপাতাল হয়ে যেতে লাগল। দুজনের চেহারায় এইরকম সাদৃশ্য থাকলে অস্বাভাবিক কিছু মনে হতো না আমার। ভাবতাম, তারা যমজ ভাই। কিন্তু চারজনের মুখ এবং চেহারা হুবহু একরকম হয় কি করে।
মনের মধ্যে অলৌকিক যে প্রসঙ্গ উঁকি দিচ্ছিল, নিজেকে ধমক দিয়ে অনেক কষ্টে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমারই চোখের ভুল এসব। মনের মধ্যে একটা অলৌকিক ভয় বাসা বেঁধে ছিল, মশালের আলোয় ক্ষণিকের দেখায় আমার দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছিল।
নিজেকে সাহস দেবার জন্য চিৎকার করে গান গাইতে শুরু করলাম। বেসুরো, বেতালা। কিন্তু পরমূহুর্তেই আবার সেই 'বল হরি, হরিবোল' বিকট ধ্বনিতে চমকে থেমে গেলাম।
মনে হলো, এবার শব্দটা যেন আমার পাশ থেকে উঠছে। অথচ শববাহকের দল ততক্ষণে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। তাদের চিৎকার এত কাছ থেকে শ্রুতিগোচর হবার তো কথা নয়!
মনের মধ্যে আবার একটু অস্বস্তি শুরু হলো। কিন্তু এভাবে চুপচাপ পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। তাই জোরে জোরে পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
লক্ষ্য করিনি, এরইমধ্যে কখন যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। ছুরির ফলার মতো বিদ্যুতের শানিত স্ফুরণ। দমকা ঝড় উঠল। সেই ঝড়ের এমন বেগ যে পথচলাই দুষ্কর হয়ে পড়ল।
ঝড়ে বনের গাছগুলোর মর্মর ধ্বনি কানে এসে বাজতে লাগল আর আমার বুকের রক্ত সেই শব্দে যেন তুহিন শীতল হয়ে যেতে লাগল।
হঠাৎ ঝড়ের মাতন আর গাছপালার মর্মরধ্বনি ছাপিয়ে আবার সেই চিৎকার। এবারে যেন একেবারে আমার কানের সামনে। 'বল হরি, হরিবোল....বল হরি, হরিবোল.....'
কিন্তু চমকে পাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। শবযাত্রীদের দল সামনে কতদূর এগিয়ে গেছে, কে জানে! কিন্তু কানের পাশে এখনো তাদের সেই ধ্বনি চলছে!
বুঝলাম, চিন্তা করে লাভ নেই। চিন্তা করে এর জট ছাড়ানো যাবে না। রহস্য যাই হোক, যেভাবেই হোক আমায় প্রাণে বাঁচতে হবে। কোনওরকমে একটা লোকালয়ে গিয়ে পৌঁছতেই হবে আমায়।
বড় বড় বৃষ্টির ফলা সারা গায়ে যেন হুল ফোটাতে লাগল। ছুটতে আরম্ভ করলাম। লাঠিটা প্রাণপনে বগলে চেপে।
জানি না বোধহয় আধ মাইলেরও বেশী একটানা দৌড়েছি। হিসেব রাখিনি। হঠাৎ আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাতেই দেখলাম, পথের পাশে যেন একটা চালাঘর।
মনে মনে ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছুটে চালাঘরে আশ্রয় নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, অন্তত প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। এমনও হতে পারে, চালাঘরে আরও কোনও লোকের সাক্ষাৎ মিলবে।
অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে দেখলাম, এটা চালাঘর নয়, শুধু চালা। তিনদিক আচ্ছাদিত, একদিক খোলা। বোধহয় রোদের তাপ বা বৃষ্টির ছাঁট থেকে পথচারীকে বাঁচাতেই এটা তৈরি হয়েছিল।
আস্তে আস্তে এগোতে গিয়ে থেমে গেলাম।
আকাশে আঁকাবাঁকা হয়ে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল আর সেইসঙ্গে কড়কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল। কিন্তু সেই বিদ্যুতের আলোয় এবার আরও পরিষ্কার দেখলাম। আরও কাছ থেকে দেখলাম।
শবের খাটিয়াটা রেখে সেই চারজন শববাহক দাঁড়িয়ে আছে। সারি দিয়ে। হুবহু এক চেহারা। একইরকম দেখতে। সেই অবিন্যস্ত দাড়িগোঁফের জঙ্গল, রক্তাভ দুটি চোখ, মাথার চুল উস্কোখুস্ক।
আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সেই চারজন একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল। শিকারকে যেন কুক্ষিগত করে ফেলেছে, এমন একটা উৎকট পৈশাচিক উল্লাসে। লাঠিটা বজ্রমুষ্টিতে ধরে পাষাণের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম এক জায়গায়। নিঃসন্দেহ হলাম, এই হাসি মোটেও স্বাভাবিক নয়। রক্তমাংসের কোনও মানুষ এভাবে হাসতে পারে না। অশরীরী আত্মার বীভৎস হাসি।
আমাকে আবার আতঙ্কিত হতে দেখে সেই চারজনের একজন খনখনে গলায় বলল, "আপনি এইহানে একটু লাশের কাছে থাইকেন। আমরা যাচ্ছি জঙ্গল থেইক্যা কাঠ কাইটতে।"
কোনওরকমে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস রোধ করে বললাম, "আপনারা সবাই যাবেন?"
আবার সেই রক্তজল করা হাসি।
উত্তর এল, "আমরা যেইহানে যাই, একসঙ্গেই যাই।"
যাবার আগে লোকগুলো মশালটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে তখনও শুধু বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন।
আড়চোখে একবার খাটিয়ায় শোয়ান মড়াটার দিকে চাইলাম আমি। সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা। মশালের আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
আচমকা দমকা হাওয়ায় শবের মুখের আবরণ সরে গেল। আমি একবার সেদিকে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠলাম।
সেই একইরকম মুখ। চুল, গোঁফদাড়ি, মুখ, চেহারা - কোথাও এতটুকু প্রভেদ নেই। এমনকি মুখে বসন্তের দাগটা পর্যন্ত আছে।
দুহাতে চোখ রগড়ে নিলাম। এ'ও কি সম্ভব? সেই চারজন শববাহক আর খাটিয়ায় শোয়ানো এই মড়ার মধ্যে এতটুকু প্রভেদ নেই! সবার এক চেহারা!
বুকের স্পন্দন দ্রুততর হলো। লাঠিটা যে হাতে শক্ত করে ধরব, সেই ক্ষমতাটুকুও রইল না আমার। এরপর যা ঘটল, তা অবর্ণনীয়।
চোখ মেলে তাকাল শব। রক্তিম দুটো চোখ। প্রথমে তার ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল তিরতির করে, তারপর খনখনে গলা ভেসে এল তার। শোয়া অবস্থা থেকে একটু উঠে বসার মতো করে উঠে সে বলতে লাগল :
"ঠিকই ভেবেছ। আমরা পাঁচজন একই লোক। কোনও তফাত নেই। বসন্ত রোগে মারা গিয়েছিলাম বলে প্রতিবেশীরা কেউ ভয়ে পোড়াতে এলো না। তাই বলে কি আমার সৎকার হবে না? তাই নিজের দেহ থেকেই চারজন বাহক সৃষ্টি করলাম। তারাই বয়ে নিয়ে এলো শ্মশানে। কেমন বুদ্ধি বের করলাম, বলো দেখি?" 
বলেই খনখনে গলায় হেসে উঠল সেই জ্যান্ত মড়া।
তারপর আর আমার জ্ঞান ছিল না।
যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি সকাল হয়ে গেছে। পথের একপাশে আমি কর্দমাক্ত দেহে পড়ে আছি। পরনের পোশাক ছিন্নভিন্ন। জেলেরা আমার মুখেচোখে জল দিচ্ছে, বাতাস করছে।
একটু সুস্থ বোধ করে ধীরেধীরে উঠে বসলাম। চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখলাম। চালাঘরটা আছে কিন্তু এখন শূন্য। রাতের বিভীষিকা কোথাও নেই।
আস্তে আস্তে জেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করলাম, "লোচনপুর স্টেশন এখান থেকে কতদূর?"
তাদের একজন বলল, "লোচনপুর? সে তো এখান থেকে পাক্কা দশ মাইল। একেবারে উল্টোপথ।"
জিজ্ঞেস করলাম, "এ জায়গাটার নাম কি?"
"এ জায়গাটাকে বলে পাঁচ মুন্ডীর আসর।"
পাঁচ মুন্ডীর আসর? চমকে উঠলাম।
"হ্যাঁ গো কত্তা। এক রকমের পাঁচজন তেনাদের দেখা যায়। পথ ভুলিয়ে মানুষকে এখানে নিয়ে আসে। তারপর সাবাড় করে দেয়। কত লোক যে সন্ধের মুখে জঙ্গলে পথ হারিয়ে একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেছে , আর তাদের কোনওদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি, তার ঠিক নেই। তুমি দেখছি বামুন মানুষ, তাই বোধহয় বেঁচে গেলে।"
ছেঁড়া জামার ফাঁক দিয়ে আমার গলার পৈতেটা দেখা যাচ্ছিল। শক্ত করে পৈতেটাকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরলাম। রোজ গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করি, তারই জোরে গত রাতে...নইলে বোধহয় আর রক্ষা ছিল না।

এ কাহিনী অনেককে বলেছি, কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। কিন্তু যারা বিশ্বাস করেনি, তারাও এমনকি রাতের বেলা পুবাই গাঁ থেকে পশ্চিমমুখো রাস্তা ধরে পাঁচ মুন্ডীর আসরের দিকে আসতে কোনওদিন রাজি হয়নি। আমাকে যদি কেউ এক থলি আকবরী মোহর দেয়, তবু আমি ওপথে আর জীবনে যাব না।
১১/১২/২০১৭