Monday 2 January 2017

ঐতিহাসিক গল্প (মোবাইল ভার্শন): প্রহরী (শিশির বিশ্বাস)

প্রহরী

শিশির বিশ্বাস

দ্ভুত গল্পটা শুনেছিলাম দিবাকরবাবুর কাছে। অফিসের দুই বন্ধু মিলে সেই প্রথম রাজগির বেড়াতে গিয়েছিলাম। শীতের মরশুমে উইক এন্ডের দিনগুলোয় রাজগিরে ভ্রমণার্থীদের ভিড় কখনও যে মাত্রাছাড়া হয়ে যায়, জানা ছিল না। গোড়ায় তাই বেশ সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। সব হোটেল ভরতি। ঠাঁই নেই কোথাও। শেষে মুশকিল আসান হল দিবাকরবাবুর সৌজন্যে। বাজারের পথে মানুষটির সঙ্গে আলাপ। কাছেই এক হোটেলের ম্যানেজার। পরিষ্কার ধুতি পাঞ্জাবি পরা সৌম্যকান্তি মাঝবয়সী মানুষটি তখন রিকশায় একরাশ বাজার চাপিয়ে রওনা হবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। পরিস্থিতি অনুধাবন করে নিজেই আর একটা রিকশা ডেকে তুলে নিলেন আমাদের। অবশ্য গোড়াতেই উনি জানিয়েছিলেন, জায়গা ওঁর হোটেলেও নেই। তবু ব্যবস্থা যে একটা হবে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

অজাতশত্রুগড়ের খুব কাছেই হোটেলটা তেমন বড় না হলেও বেশ ছিমছাম। লনে চমৎকার বাগান। পরিচর্যার ছাপ সুস্পষ্ট। রিকশা গেটের বাইরে দাঁড়াতেই দু’জন কর্মচারী ছুটে এল। বাজারের মালপত্র তাদের জিম্মায় দিয়ে উনি আমাদের নিয়ে তিনতলায় একটা ছোট ঘরে এসে বললেন, ‘এটা আমারই রাতের আস্তানা। আপাতত সঙ্গের জিনিসপত্র এখানে রেখে স্নানটা সেরে নিন। হট স্প্রিং খুব দূরে নয়। ইচ্ছে হলে সেখানেও যেতে পারেন। ততক্ষণে রান্নাটাও হয়ে যাবে। খেয়ে বের হয়ে পড়ুন। আসলে ব্যাপারটা কী জানেন, এখানে সবাই আসে উইক এন্ড ট্যুরে। তাই সময় বড় কম। অথচ কত কিছুই যে দেখার রয়েছে এই রাজগিরে! অযথা সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।’

সদ্য পরিচিত দুই ব্যক্তির সঙ্গে এক হোটেল ম্যানেজারের এই ব্যবহারে অবাক হয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সেই মুহূর্তে আরও বেশি অবাক হয়েছিলাম অন্য এক কারণে। ঘরের একপাশে ছোট একটা তক্তাপোশ। পরিপাটি করে বিছানা পাতা। পাশে দুটি বড় শেলফ ভরতি শুধু বই। বেশির ভাগই প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপর। তারই ভিতর দামি লেদারে বাঁধানো ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের ঢাউস আকৃতির গোটা কয়েক পুরনো ‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট’। একটি তো সেই ১৯০৫–১৯০৬ সালের।

ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম। সেই সূত্রে জানি, এসব বই সাধারণ পাঠকের ঘরে থাকে না। ফস করে বলে ফেললাম, ‘সার, আপনি কি কলেজে পড়াতেন?  ইতিহাস?’

মৃদু হাসলেন উনি। মাথা নেড়ে বললেন, ‘না ভাই। তা ছাড়া আমার প্রথাগত বিদ্যেও তেমন বলার মত কিছু নয়।’

‘এসব, এসব বই তাহলে আপনার নয়?’

‘তা আর বলি কী করে?’ ফের মৃদু হাসলেন মানুষটি। ‘আসলে ব্যাপার কি জানেন, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বরাবরই টানে আমাকে। বিশেষ করে এই রাজগির। এর প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে আমাদের অতীত গৌরব। সার আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম, জন মার্শাল, থিয়োডর ব্লচ, ভি এইচ জ্যাকসন–এর মত প্রথিতযশা প্রত্নতত্ত্ববিদ আর ঐতিহাসিকরা নানা সময় এখানে সেই ইতিহাসের খোঁজে অনুসন্ধান করে গেছেন। তাঁদেরই কিছু লেখা আর রিপোর্ট রয়েছে ওই বইগুলোয়। যাই হোক, আপনাদের কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে ভাই। থাকবেন তো মাত্র দু’দিন। দেরি না করে তৈরি  হয়ে নিন এবার।’ প্রসঙ্গ বদলে তাগাদা লাগালেন উনি।

ব্যাপারটা এরপর আর এগোয়নি। চটপট স্নান-খাওয়া সেরে একটা টাঙ্গা নিয়ে বের হয়ে পড়েছিলাম দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে দেখার জন্য। ফিরতে বেশ দেরিই হয়ে গেল। শেষ বিকেলে গৃধ্রকূট পাহাড়ের চুড়োয় ভগবান বুদ্ধ আর সারিপুত্তের বাসস্থান দেখে নামতে নামতে সন্ধে হয়ে গেল। হোটেলে ফিরতে প্রায় আটটা।

দিবাকরবাবু নেই। কী কাজে বের হয়েছেন। কাউন্টারের ছেলেটি জানাল, পাশের এক লজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সারাদিনের ধকলে দু’জনেই তখন বেশ ক্লান্ত। দেরি না করে চলে গেলাম সেখানে।

খানিক বিশ্রামের পর রাতের খাওয়ার জন্য হোটেলে আসতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। ডাইনিং রুম প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। গোছগাছ শুরু হয়েছে। দিবাকরবাবুর খোঁজ নিতে শুনি উনি নিজের ঘরে রয়েছেন। চটপট খাওয়া সেরে দু’তলায় তাঁর ঘরের দিকে চললাম।

ভদ্রলোক বিছানায় বসে একমনে কী একটা বই পড়ছিলেন। আমাদের সাড়া পেয়ে সামান্য চোখ তুলে পাশে বসতে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আরে আসুন আসুন। আমারই দেখা করা উচিত ছিল। নতুন এই বইটা আজই ডাকে এসেছে। আসলে বই তো এখানে সহজ লভ্য নয়। হয় সেই পাটনা। নয়তো অর্ডার পাঠাতে হয় কলকাতায়। হাতে পেয়ে আর হুঁশ ছিল না।’

সকালের ব্যাপারটা তখনও মাথা থেকে নামেনি। বরং সারাদিন ঘোরাঘুরির পর বেড়েছে আরও। এই রাতে ভদ্রলোককে যথেষ্ট বিরক্ত করা হচ্ছে বুঝেও তক্তাপোশের একধারে বসে একটু উসকে দেবার জন্য বললাম, ‘ওই পিকনিকের মেজাজে যেটুকু দেখা হয়। গোটা কয়েক ভাঙা ইট–পাথরের ঢিপি।’

কাজ হল। মানুষটির চোখদুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো হঠাৎ। হাতের বইটা পাশে উলটে রেখে বললেন, ‘সেটাই তো স্বাভাবিক। বলি তাহলে, আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে প্রথম যেবার এখানে আসি জানতাম না কিছুই। গাইড বলতে ছিল টাঙ্গাওয়ালা বৃদ্ধ রমজান মিয়া। বন্ধুদের সাথে হইহই করে বেড়াবার ফাঁকে সেদিন তার কথা কতক শুনেছিলাম কতক শুনিনি। কিন্তু কৌতূহলের মূলে সেই মানুষটিই। ফিরে গেলাম বটে তবে ব্যাপারটা মাথা থেকে নামল না। কিন্তু সে সব বলতে গেলে যে রাত ভোর হয়ে যাবে ভাই।’

‘তা হোক না সার।’ প্রায় হাঁহাঁ করে উঠলাম। ‘শুনেছি, সারাদিন হোটেল সামলেও প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। তা একটা রাত না হয় নষ্টই করলেন আজ।’

‘না-না সে কথা নয়।’ একটু যেন বিব্রত হলেন মানুষটি। ‘আসলে এসব নীরস ইট-পাথরের কথা বড়ো একটা শুনতে চায় না কেউ। তা ছাড়া, এই রাজগিরের কতটুকুই বা আর জানা গেছে বলুন? তেমন অনুসন্ধানই বা আর হল কোথায়?’

থামলেন উনি। নীরবে বন্ধ জানালার কাচের ভিতর দিয়ে বাইরে হালকা চাঁদের আলোয় অজাতশত্রুগড়ের পিছনে উঁচু ঢিপিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিক। তারপর বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওই যে ঢিপিটা, ভগবান বুদ্ধের দেহাবশেষের উপর সম্রাট অশোক ওখানেই তৈরি করিয়েছিলেন সুবিশাল এক স্তূপ। পাশে সুদীর্ঘ এক অশোকস্তম্ভ। সেই স্তূপ আজ শুধুই মাটির ঢিপি। আর অশোকস্তম্ভ, যার শীর্ষে শোভা পেত শিল্পসুষমামন্ডিত চমৎকার এক হস্তীমূর্তি, তার কোনও চিহ্নই আজ আর নেই। সাত শতকের মাঝামাঝি হিউয়েন সাং-ও দেখে গিয়েছেন সেটা। কোথায় গেল তাহলে? অত বড় একটা স্তম্ভ সরিয়ে নেওয়া তো সহজ কথা নয়! আমার তো মনে হয় সেটির ভাঙা টুকরো কাছেই মাটির তলায় রয়েছে কোথাও। তেমন অনুসন্ধানই হয়নি। টাঙ্গায় যে পথে গেলেন, তার অনেকটাই সেই পুরানো আমলের রাজপথ। দু’ধারে বনজঙ্গলের ভিতর অবহেলায় পড়ে রয়েছে পাথরের ভিত আর ভাঙা দেওয়ালের অবশেষ। তেমন অনুসন্ধানের ফলে বের হতে পারে চমকপ্রদ কোনও তথ্য, ইতিহাস। এই অজাতশত্রুগড়, ১৯০৫-১৯০৬ সালের পর তেমন খননকাজ এখানেও আর হয়নি।’

একটানা কথা বলে থামলেন উনি। শীতের রাত ইতিমধ্যে প্রায় নিস্তব্ধ। পথে মানুষজনের সাড়াশব্দ নেই। বুঝতে পারছিলাম মানুষটির কথা শেষ হয়নি এখনো। সম্ভবত ঝালিয়ে নিচ্ছেন ভিতরে। উসকে দেবার জন্য বললাম, ‘তা সেই আকর্ষণেই কি কাজ নিয়ে চলে এলেন এখানে?’

একটু লাজুক হাসলেন উনি। মাথা নেড়ে বললেন, ‘না ভাই, তা নয়। তবে সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। বললে বিশ্বাস করবে না কেউ। কোনও দিন বলিওনি কাউকে। শুনবেন?’

অভিজ্ঞ মানুষটির কাছ থেকে কিছু শুনব বলেই আজ এসেছিলাম। কিন্তু সেটা যে এমন দিকে বাঁক নেবে ভাবিনি। গল্পের গন্ধ পেয়ে গুছিয়ে বসে শুধু মাথা নাড়লাম। দিবাকরবাবু বলতে শুরু করলেন, ‘সেই যে প্রথমবার রাজগিরে বেড়াতে এসে বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালার দৌলতে মাথায় ভূতটা চাপল, তারপর নামেনি আর। রাজগিরের উপর লেখা কোনও বইয়ের সন্ধান পেলেই সংগ্রহ করে পড়ে ফেলি। আর ওই পড়তে পড়তেই প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপর ঝোঁকটা এল। বছর দুয়েক পর ফের এলাম এখানে । তবে একা। বাণেশ্বর প্রসাদের সঙ্গে দেখা সেই প্রথম দিনেই। প্রায় যেচে এসেই সেদিন ও আলাপ জুড়েছিল আমার সাথে। ডিসেম্বরের দুপুর। ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম মনিয়ার মঠের ধ্বংসাবশেষের ভিতর। হঠাৎ দেখি পাশে দাঁড়িয়ে পেটানো মজবুত চেহারার এক দেহাতি মানুষ। বয়স তিরিশের বেশি নয়। পরনে আধময়লা পোশাক। আমি চোখ তুলে তাকাতে লোকটা সামান্য উশখুশ করে বিনীতভাবে বলল, ‘বাবুজি, আপ রিসার্চ কর রহে হো কেয়া?’

‘লোকটার কথায় লজ্জাই পেলাম একটু। মুখের ভাবে গোপনও রইল না সেটা। তাড়াতাড়ি বললাম, না ভাই, আমি তেমন কিছু নই। সামান্য একজন টুরিস্ট মাত্র।

‘বললাম বটে, কিন্তু ফল হল উলটো। আমার ওই লাজুক ভাবটিকে লোকটি বিদ্যা জনিত বিনয় বলে ভাবল। মৃদু হেসে হিন্দিতেই বলল, আমাকে ভোলাতে পারবেন না বাবুজি। মামুলি টুরিস্ট আদমি যে আপনি নন, সেটা দেখেই বুঝেছি।

‘আরও অবাক হয়ে বললাম, কেন বলুন তো?

‘ও বলল, বাবুজি আমি আর্কিওলজিকাল বিভাগের একজন ক্যাজুয়াল কর্মী। এই মনিয়ার মঠে ডিউটি করছি গত প্রায় দেড় বছর। টুরিস্ট তো কম দেখিনি। সবাই এক রকমের। হইহই করে আসে। সিঁড়ি ভেঙে চাতালের উপর উঠে, ভিতরে এক ঝলক উঁকি দিয়ে খানিক হাসিঠাট্টা করে সময় কাটিয়ে ছোটে টাঙ্গা নয়তো বাসের দিকে। বোঝে না কিছুই। সে ধৈর্যও নেই। আর থাকবেই বা কেন? প্রাচীন রাজগৃহের রক্ষাকর্তা যক্ষ মণিনাগের এই মন্দির আজ ভাঙা ইটের এক ধ্বংসাবশেষ বই তো নয়। কেউ তাই দু-চার মিনিটের বেশি দাঁড়ায়ও না। দাঁড়াবার প্রয়োজনও বোধ করে না। কিন্তু বাবুজি, আপনাকেই আজ প্রথম ব্যতিক্রম দেখলাম। দু’ঘণ্টার উপর রয়েছেন এখানে। খুঁটিয়ে দেখছেন। লিখেও রাখছেন। মামুলি এক টুরিস্টের কাজ নয় এসব।

‘কথা শেষ করে মানুষটি এমন সহজ সরল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল যে, ওর ভ্রান্ত ধারণাটা আর ভাঙতে ইচ্ছে হল না। বললাম, আপনার নাম কী ভাই?

‘আমার কথায় লোকটা প্রায় কৃতার্থ হয়ে গেল, খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখ দুটো। বলল, ‘জি বাণেশ্বর প্রসাদ বাবুজি। নালন্দায় বাড়ি। পুরনো এসব ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পরিচয় তাই ছেলেবেলা থেকেই। কেন জানি না, এসব জিনিস তখন থেকেই ভীষণ আকর্ষণ করে আমাকে। আগে বুঝতাম না কিছুই। এখন সামান্য বুঝি হয়তো। কিন্তু তাতে হয়েছে আরো মুশকিল। গরিব ঘরের ছেলে। লেখাপড়া তেমন শিখতে পারিনি। হিন্দিটা কোনো রকমে আসে। এত কম বিদ্যে নিয়ে এসব কি আর হয় বাবুজি?

‘ততক্ষণে মানুষটাকে কিছু ভাল লেগে গেছে। বললাম, এসব ধ্বংসাবশেষের ইতিহাস খুব জানতে ইচ্ছে করে বুঝি?

‘আমার কথায় একটু যেন লজ্জা পেল মানুষটি। রোদে পোড়া ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠল। আমতা আমতা করে বলল, তা, তা ঠিক বাবুজি। তবে আসল ব্যাপারটা হল রাজগিরের এই ধ্বংসাবশেষের ভিতর এসে নিরিবিলিতে খানিক দাঁড়ালে, আমি নিজেই যেন কোথাও হারিয়ে যাই। কী যেন একটা ঘটে যায় ভিতরে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আবছা এক জনপদের ছবি। রাজপথ, অশ্বশকট আর গোশকটের ব্যস্ততা, বড় বড় অট্টালিকা, বিপণি, মানুষের ভিড়। যক্ষ মনিনাগের মন্দিরে পুণ্যার্থী। আর আশ্চর্য বাবুজি, সেই ভিড়ে বক্ষত্রাণ পরিহিত অশ্বারূঢ় একটি মানুষকেও দেখতে পাই কখনও! কোমরবন্ধে তরবারি। মাথায় শিরস্ত্রাণ। হাতে সুদীর্ঘ ভল্ল। পরনে উজ্জ্বল নীল-সাদা পোশাক। তারপরে হঠাৎই হারিয়ে যায় ছবিটা।

‘মানুষটির ভিতরে যে চমৎকার একটি ইতিহাস সচেতন, কল্পনাপ্রবণ মন লুকিয়ে রয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি এরপর। বললাম, ‘আপনি ভাগ্যবান বাণেশ্বরবাবু। প্রায় তিন হাজার বছর আগে এই নগরীর যে ছবি আপনি মানসনেত্রে দেখেছেন, তা অনেক বিশেষজ্ঞেরও ক্ষমতার বাইরে। আপনি লিখে ফেলুন না সেসব কথা। দারুণ ব্যাপার হবে।

‘সত্যি বলছেন বাবুজি? উজ্জ্বল হয়ে উঠল বাণেশ্বর প্রসাদের চোখদুটো।

‘নীরবে মাথা নাড়লাম। ও বলল, সত্যি কথা বলি বাবুজি। কিছু-কিছু লিখেও ফেলেছি। কিন্তু কোনও কিছুই যে বেশিক্ষণ দেখা যায় না! সব গোলমাল করে দেয় ওই নীল-সাদা পোশাক পরা অশ্বারোহী মানুষটি। এসে পড়লেই মুহূর্তে মিলিয়ে যায় সব। বাবুজি লোকটার নাম বীরবাহু। নগরের প্রহরী। এই তো দিনকয়েক আগে এক দুপুরে একা বসে আছি। চোখের সামনে হঠাৎ দেখি এক রাজপ্রাসাদ। পশ্চিম দিকে ওই যে পোড়া জমিটা, ওইখানে। সিংহদ্বারের সামনে মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা। শাণিত অস্ত্র হাতে প্রহরীবৃন্দ। পাঁচ ঘোড়ার এক রথ এসে দাঁড়াল সেখানে। উজ্জ্বল পোশাক-পরা পেশিবহুল একটি মানুষ নামলেন। কাড়ানাকাড়া বেজে উঠল। রাজা শ্রেণীক-এর নামে জয়ধ্বনি করে উঠল সবাই। হাত তুলে অভিনন্দন গ্রহণ করলেন তিনি। ঠিক সেই সময় নীল-সাদা পোশাকের সেই অশ্বারোহীটি ঘোড়ার খুরের শব্দে হাজির হল কোথা থেকে। ব্যাস, হারিয়ে গেল সব।

‘কথায়-কথায় বেলা পড়ে আসছে। আজই সোনভান্ডার আর রণভূমির দিকটাও ঘুরে দেখব ঠিক করে রেখেছি। প্রসঙ্গ পালটে সেই কথাই জানালাম।

‘শুনে ব্যস্ত হয়ে উঠল বাণেশ্বর প্রসাদ, ছি ছি, অযথা সময় নষ্ট করছি আপনার! দাঁড়ান বাবুজি একটা রিকশা ডেকে দিই। আরামে ঘুরে আসতে পারবেন।

‘হেসে বললাম, রিকশার দরকার নেই ভাই। নিশ্চিন্তে দেখার কাজটা তেমন হয় না ওতে। হেঁটেই যাব।

আমার কথায় ভুরু কুঁচকে উঠল বাণেশ্বর প্রসাদের। একটু পরে বলল, তা ঠিক বাবুজি। কিন্তু এই বিকেলে এদিকের পথঘাট তেমন নিরাপদ নয়। বিশেষ করে ওই রণভূমির দিকটা। খুবই নির্জন। দূরত্বও কম নয়। 

‘তা আর কী করা যাবে। তেমন কিছু হলে একা রিকশাওয়ালাও কি কিছু করতে পারবে? এই মনিয়ার মঠেও তো হেঁটেই এলাম।

‘হেসে উড়িয়ে দিলাম আমি।

‘আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বাণেশ্বর প্রসাদ আর বলল না কিছু। দেরি না করে আমিও বের হয়ে পড়লাম।’

এই পর্যন্ত বলে দিবাকরবাবু থামলেন হঠাৎ। সামনে দুই শ্রোতার উপর নিঃশব্দে চোখ বুলিয়ে নিলেন। বাইরে রাত ইতিমধ্যে গভীর হয়েছে আরও। নীচে পথ দিয়ে দ্রুত একটা টাঙ্গা চলেছে বাজারের দিকে। এই নিস্তব্ধ রাতে আওয়াজটা কেমন গা ছমছমিয়ে দেয়। পাশে দেবু বলল, ‘রণভূমির ওদিকে কিন্তু আমাদেরও যাওয়া হয়নি।’

ঘোড়ার ঘুরের খটখট শব্দ ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে দূরে। দিবাকরবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ রণভূমি, যেখানে জরাসন্ধের মল্লযুদ্ধের আখড়া ছিল বলে বিশ্বাস, সেদিকে টাঙ্গা বা রিকশাওয়ালারাও এখনও বড় একটা যেতে যেতে চায় না। সেই তিরিশ বছর আগেও ব্যতিক্রম ছিল না। তবু বাণেশ্বর প্রসাদের কথায় কর্ণপাত করিনি। আসলে বয়সটাও তো কম ছিল। তার উপর ভিতরের তাগিদ। শুনেছিলাম, ওদিকে ঝোপ জঙ্গলের ভিতর কিছু ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে এখনো। কিন্তু পরে মনে হয়েছিল, একা ওদিকে না গেলেই ভাল হত বোধহয়।

‘সোনভাণ্ডার ঘুরে যখন রণভূমির পথ ধরলাম বিকেল ঘন হতে শুরু করেছে। নির্জন পথের দু’ধারে হালকা জঙ্গল, ঝোপঝাড়। জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। একদিন এই পথের দু’ধারে ছিল সুসজ্জিত অট্টালিকা শ্রেণী, বাসগৃহ। বিপণীগুলিতে মানুষের ভিড়। সারাদিন গমগম করত। সন্ধ্যায় জ্বলে উঠতো আলো। আজ সব শূন্য। চিহ্নমাত্র নেই।

‘ভাবতে-ভাবতে এগিয়ে চলেছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে ঘোড়ার খুরের খটখট আওয়াজ কানে এল। গোড়ায় ভেবেছিলাম কোনও টাঙ্গা বোধহয়। দর্শনার্থী নিয়ে চলেছে রণভূমির দিকে। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরি হল না। টাঙ্গা নয়। তেজি ঘোড়ায় চড়ে এদিকে আসছে কেউ। কৌতূহলী হয়ে ঘাড় ফিরিয়েছিলাম। অবাক কাণ্ড! কিচ্ছু নেই কোথাও। আওয়াজটাও মিলিয়ে গেছে হঠাৎ। নির্জন বনভূমিতে শুধু মর্মরধ্বনি। পুরো ব্যাপারটাকে মনে ভুল বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু খানিক বাদে সেই একই ব্যাপার ঘটল আবার। রণভূমির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি তখন। পিছনে ফের সেই ঘোড়ার খুরের শব্দ। তাকিয়ে সেবারও দেখতে পেলাম না কিছু। আওয়াজটাও আগের মতই মিলিয়ে গেল।

‘ভয়ডর কোনও কালেই তেমন ছিল না। থাকলে এই অপরিচিত স্থানে বাণেশ্বর প্রসাদের ওই সতর্কতার পরে একা পা বাড়াতাম না। তবু পড়ন্ত বিকেলের সেই জনমানবহীন নির্জন বনপথে এরপর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। রণভূমিতে বিশেষ আর দেরি করিনি। ফিরে এসেছিলাম।’

‘পথে আর কিছু হয়নি?’ দিবাকরবাবু সামান্য থামতেই প্রায় রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলাম।

‘না ভাই, সেদিন আর কিছু ঘটেনি। তবে এর দু’দিন পরে অশোকস্তূপের কাছে যে ব্যাপারটা ঘটেছিল, তার কোনও ব্যাখ্যা আজও আমার কাছে নেই।’

কথা শেষ করে দিবাকরবাবু ফের জানালা দিয়ে অজাতশত্রুগড়ের পিছনে উঁচু ঢিপিটার দিকে কয়েক মুহূর্ত নীরবে তাকিয়ে থেকে শুরু করলেন আবার, ‘অশোকস্তূপের ওই যে ঢিপি, ওদিকে আজও বড় একটা যায় না কেউ। তেমন রাস্তাও নেই। পাশে ক্ষীণ এক জলধারা। এখন প্রায় মজে এলেও একসময় ওটাই ছিল সরস্বতী নদী। পাশেই শ্মশান। এই শ্মশানের উল্লেখ হিউয়েন সাংয়ের লেখাতেও রয়েছে। মজা নালার ধারে বহু পুরনো ভাঙাচোরা একটা ঘাটের ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে এখনো।

‘মনে রাখা দরকার, সম্রাট অশোক যখন এখানে আসেন রাজগিরের গৌরব তখন অনেকটাই ম্লান। মগধের রাজধানী সরে গেছে পাটলিপুত্রে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই চলে গেছেন সেখানে। নগরের মূল অংশের হতশ্রী অবস্থা। যেটুকু তখনো বজায় রয়েছে, তার সবটাই প্রায় অজাতশত্রুর আমলে তৈরি এই নতুন গড়কে কেন্দ্র করে। ভগবান বুদ্ধের পূতাস্থির ওপর স্তূপ তৈরির জন্য এই স্থানটি তাই অনেক চিন্তাভাবনা করেই নির্বাচন করা হয়েছিল। যাই হোক, সেবার রাজগিরে সেটাই আমার শেষ দিন। পরের দিন ভোরেই ফেরবার বাস ধরব। মোটামুটি সব ঘোরা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বাকি শুধু ওই অশোকস্তূপের দিকটা। খুব কাছে হলেও ওদিকে তখনও আমার যাওয়া হয় নি। সেদিন তাই বিকেলেই বের হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ওদিকে যাওয়ার যে তেমন রাস্তা নেই, জানতাম না। ভেবেছিলাম গড়ের দক্ষিণ পাশ ধরে সহজেই পৌঁছে যেতে পারব। কিন্তু পথে নেমে বুঝলাম ব্যাপারটা সহজ নয় অত। অনেকটা ঘুরে যখন কাছে এসে পৌঁছুলাম, সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াল জলকাদায় ভরা সরস্বতী নদীর মজা খাত। পাশেই একখণ্ড পোড়ো জমিতে সেই শ্মশান। খানিক দূরে ঝোপঝাড়ের ভিতর পুরনো দিনের সেই ভাঙ্গাচোরা ঘাট পড়ে রয়েছে নিতান্ত অবহেলায়। এই পড়ন্ত বিকেলে জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। নির্জন খাঁখাঁ করছে।

‘ওপরেই অশোকস্তূপের উঁচু ঢিপিটা। কিন্তু অনেক খুঁজেও যাওয়ার পথ পেলাম না। মজা খাত হলেও সামান্য জল রয়েছে। কাদা আরও বেশি। বুঝতে বাকি রইল না, সম্পূর্ণ ভুল পথে এসে পড়েছি। ঢিপিটায় যাবার রাস্তা এদিক দিয়ে নয়। খোঁজখবর নিয়ে বের হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তখন আর সময় নেই। বেলা পড়ে আসছে। দিনশেষে এক ঝাঁক পাখি কলরব করে উড়ে গেল বেণুবনের দিকে। আর একটু চেষ্টা করে দেখব কিনা ভাবছি, হঠাৎ পিছনে সেই পরিচিত ঘোড়ার খুরের খটখট আওয়াজ। সেই প্রথম দিনের পরে ব্যাপারটা ঘটেনি আর। চমকে ঘাড় ফেরালাম। নাহ্, কিচ্ছু নেই কোথাও। আওয়াজটাও থেমে গেছে। এক ঝলক দমকা হিমেল বাতাস শুধু ছুটে এল গড়ের দিক থেকে। শিরশির করে উঠল সারা শরীর। ক্যাঁ-ক্যাঁ শব্দে অচেনা একটা পাখি ডেকে উঠল কোথাও। জায়গাটা জনবসতি থেকে এমন কিছু দূরে নয়। বেলা পড়তে শুরু করলেও তাই চিন্তা তেমন হয় নি। তবু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আর দেরি করা উপযুক্ত বোধ হল না। অশোকস্তূপ দেখা মুলতুবি রেখেই ফেরবার পথ ধরলাম।

‘আসার সময় ঘুরতে হয়েছে অনেকটা। সময়ও লেগেছিল। আগেই তাই ভেবে রেখেছিলাম, ফেরবার সময় পশ্চিম দিকের মাটির দেওয়াল টপকে, গড়ের ভিতর দিয়ে কোনাকুনি পাড়ি দেব। তাড়াতাড়ি হবে। পায়ে চলা কোনও পথও পাওয়া যাবে হয়তো।

‘বাইরে পাথরের ওই ভগ্ন প্রাচীরটুকু ছাড়া অজাতশত্রু-গড়ের ভিতর দেখার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আজ। উঁচুনিচু, অসমান বিশাল এক প্রান্তর। তারই মাঝে ইতস্তত বেড়ে উঠেছে বড়-বড় ঘাস আর ঝোপঝাড়, মাটির ঢিপি। আড়াই হাজার বছর আগে এই দুর্গনগরী তৈরি হয়েছিল অজাতশত্রুর আমলে। নাম অজাতশত্রু হলেও মানুষটির শত্রু ছিল অনেক। একেই তো পিতা বিম্বিসারকে কারাবন্দী করে তিনি সিংহাসনে বসেছিলেন। সেই কারণে বুদ্ধদেবের অনুগামী, নগরের সাধারণ মানুষ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ যে তাঁকে মোটেই ভাল চোখে দেখতেন না, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং দূরদর্শী মানুষটি সেটা ভাল করেই জানতেন। তার উপর তিনি তখন প্রতিবেশী কোশল, লিচ্ছবি, বৈশালী, কাশী প্রভৃতি রাজ্যগুলি জয় করার স্বপ্ন দেখছেন। প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। নগরের পুরানো রাজপ্রাসাদ তাই তখন মোটেই নিরাপদ ছিল না তাঁর কাছে। আর সেই কারণেই তৈরি করেছিলেন এই দুর্গ। ভিতরে বিশাল রাজপ্রাসাদ। বিশ্বস্ত ব্যক্তি এবং অমাত্যবৃন্দের বাসস্থান। সেনানিবাস। সব নিয়ে একদিন গমগম করত এই গড়। আজ শুধুই এক পরিত্যক্ত প্রান্তর। জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই।

‘পুরনো সেই দিনের কথা ভাবতে-ভাবতে মাঠ ভেঙে দ্রুত এগিয়ে চলেছি, হঠাৎ দেখি লাল টালির একটা ছাউনি। অমন পাতলা চৌকোনা টালি আগে দেখিনি। ঘরটাও নজরে পড়েনি এতক্ষণ। সম্ভবত দ্রুত চলার তাগিদে খেয়াল হয়নি। কৌতূহলী হয়ে পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলাম। তিনদিক খোলা ছাউনিটার নীচে পড়ে রয়েছে ঝকমকে সুদীর্ঘ এক পাথরের স্তম্ভ। স্তম্ভের গায়ে এক জায়গায় অপরিচিত অক্ষরে লেখা রয়েছে কিছু। সেদিকে তাকিয়ে মুহূর্তে সারা শরীর প্রায় কাঁটা দিয়ে উঠল। এই জিনিসের ভাঙা কয়েকটা টুকরো, সারনাথের ধ্বংসাবশেষের ভিতর দেখেছি। সন্দেহ নেই, এটা পুরান রাজগৃহের সেই হারিয়ে যাওয়া অশোকস্তম্ভ। স্তম্ভ-শীর্ষের হস্তী-মূর্তিটিও পাশে রয়েছে। বড়-বড় গোটা কয়েক জালায় নানা জাতীয় আরক আর রাসায়নিক পদার্থ। ছোট বড় নানা আকারের বুরুশ। শানপাথরের টুকরো। বোঝা যায় পালিশের কাজ শেষ হয়নি এখনো। আশেপাশে জনমানুষ কাউকেই দেখতে পেলাম না।

‘অবাক হয়ে দেখছি। ভয়ানক ব্যাপারটা ঘটে গেল ওই সময়। হঠাৎ অদূরে একটা ঢিপির আড়াল থেকে রে-রে করে ছুটে এল দুটি মানুষ। অবিন্যস্ত জামাপ্যান্ট-পরা শক্তপোক্ত শরীর। কশ বেয়ে গড়াচ্ছে পানের রস। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। ঘটনার আকস্মিকতায় গোড়ায় প্রায় বিমূঢ় হয়ে গেলেও মুহূর্তে সামলে নিয়ে লোকটাকে লক্ষ করে সজোরে হাত চালালাম। একটু আধটু শরীরচর্চা করতাম তখন। কাজ হল। ঘুরে পড়ে গেল লোকটা। দেখে থমকে গেল পিছনের মানুষটা। তারপরেই জামার নীচে কোমর থেকে মস্ত এক ছোরা বের করে এগিয়ে এল আমার দিকে। ততক্ষণে আগের লোকটাও উঠে দাঁড়িয়েছে। হাতে তারও একটা লম্বা ছোরা। হিংস্র গলায় চেঁচিয়ে উঠল, খতম কর দো, খতম কর দো। বহোত মারা।

‘প্রমাদ গুনলাম এবার। সম্ভবত ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যেই এসেছিল লোক দুটো। দামি ক্যামেরা, ঘড়ি রয়েছে সঙ্গে। কিছু টাকা পয়সাও আছে। মার খেয়ে হিংস্র হয়ে উঠেছে এবার। দু’জনের মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম, নিতান্ত অপ্রয়োজনেও এরা খুন করতে অভ্যস্ত। এই নির্জন প্রান্তরের মাঝে আর একটা খুন করতে কিছুমাত্র হাত কাঁপবে না। উপায় না দেখে ঝোপঝাড় ভেঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করলাম। অপরিচিত পথ। হোঁচট খেলাম বার কয়েক। পিছনে আততায়ী দুজন ততক্ষণে তাড়া করে প্রায় ধরে ফেলেছে আমাকে। বুঝতে পারছি বাঁচার সব আশাই প্রায় শেষ। এমন সময় ঘটল সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা। হঠাৎ পিছনে থেকে কানে এল ঘোড়ার খুরের সেই খটখট আওয়াজ। অনেক দ্রুত। ঘোড়ায় চড়ে তীব্র বেগে এদিকে ছুটে আসছে কেউ। তারপরই এক আততায়ীর অন্তিম আর্তনাদ ভেসে এল পিছন থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, তেজি ঘোড়ার পিঠে এক বর্মধারী অশ্বারোহী। পরনে উজ্জ্বল নীল-সাদা পোশাক। কোমরবন্ধে তরবারি। মাথায় শিরস্ত্রাণ। হাতের সুদীর্ঘ বর্শা বিঁধিয়ে দিয়েছেন এক আততায়ীর পিঠে। লোকটা পড়ে যেতেই অশ্বারোহী ফের তাঁর অস্ত্র চালালেন দ্বিতীয় আততায়ীকে লক্ষ করে। নিমেষে পড়ে গেল সে-ও।

‘প্রায় চোখের পলকে ঘটে গেল ব্যাপারটা। তারপরই উন্মুক্ত অস্ত্র হাতে অশ্ব ঘোরালেন তিনি। আর সেই সময়েই এক ঝলকের জন্য দেখতে পেলাম তাঁর মুখটি। কদিন আগে দেখা মনিয়ার মঠের সেই বাণেশ্বর প্রসাদ। দেখতে-দেখতে সেই অশ্বারোহী দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে মিলিয়ে গেলেন অদূরে গাছপালার আড়ালে অন্ধকারে। মিলিয়ে গেল ঘোড়ার ঘুরের আওয়াজও। চারপাশে তাকিয়ে সেই দীর্ঘ খোলা ছাউনিটিও আর দেখতে পেলাম না । শুধু অদূরে পড়ে রয়েছে নিহত দুই আততায়ীর রক্তাক্ত দেহ।’

থামলেন দিবাকরবাবু। প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে গল্প গিলছিলাম এতক্ষণ । কোনও মতে একটা ঢোঁক গিলে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘তারপর?’

‘তারপর বলার মতো তেমন কিছু আর নেই ভাই।’ অল্প হাসলেন ভদ্রলোক। ‘পরের দিন সকালে বাস। বের হয়ে শুনলাম, ভোরে অজাতশত্রুগড়ের ভিতর দুটো লাশ পাওয়া গেছে। কাছেই এক গ্রামে বাড়ি। নানা অপরাধে ধরা পড়ে জেলও খেটেছে বার কয়েক।’

‘আর বাণেশ্বর প্রসাদ?’ প্রশ্ন করল দেবু।

‘সে-ও এক রহস্য বলতে পারেন।’ সামান্য মলিন হাসলেন উনি। ‘পরের বছর রাজগিরে এসেই খোঁজ করেছিলাম তাঁর। এমনকি যেখানে ওর বাড়ি বলেছিল সেই নালন্দাতেও। পাইনি কোথাও। তারপর তো হোটেলের এই কাজ নিয়ে চলে এলাম এখানে। কিন্তু খোঁজ পাইনি আর। অদ্ভুত সেই ব্যাপারটা রহস্যই রয়ে গেছে।’

ছবি: প্রদীপ গোস্বামী

4 comments:

  1. দারুণ রোমাঞ্চকর গল্প। ভারতের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় লেখা গল্পটি পাঠ করতে করতে যেন পৌঁছে গেলাম প্রাচীন রাজগৃহ নগরীতে। লেখকে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ, অসাধারণ লাগল। শিশিরদার গল্পের অন্ধ ভক্ত আমি। পেলেই গোগ্রাসে পড়ি। ভালো থাকবেন শিশিরদা। আরও এমন গল্প পড়ে তৃপ্ত হতে চাই।

    — দেবাশিস তেওয়ারী,চাপড়া, নদিয়া ২৭/০৮/২০২১

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা রইল দাদা। ভাল থাকবেন।

      Delete
  3. আবার পড়লাম, আমার প্রিয় এই ঐতিহাসিক গল্পটি। যতবার পড়ি ততবার হারিয়ে যাই রাজগিরে।

    ReplyDelete