Tuesday 3 January 2017

ভৌতিক রহস্য গল্প (মোবাইল ভার্শন): অন্ধকার গলির সেই বাড়ি (শিশির বিশ্বাস)


অন্ধকার গলির সেই বাড়ি

শিশির বিশ্বাস
পুরো দুটো দিন অপেক্ষা করার পরে সুযোগটা হঠাৎই পাওয়া গেলরাত তখন দশটার মতোএমন বেশি নয়। কিন্তু এর মধ্যেই ছোট রালডিং শহর প্রায় নিঝুম। সদর রাস্তার বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বললেও ছোট এই গলি একেবারেই অন্ধকার। কালো প্যান্ট আর আঁটো জামা গায়ে একটা মূর্তি পা টিপে এগিয়ে চলেছে গলির ৯ নম্বর বাড়িটার দিকে। অন্ধকারে এত সন্তর্পণে যে নজরে পড়ার কথা নয়। কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। একে তো ৯ নম্বরের লাগোয়া বাড়িতেই আমার আস্তানা। পাশের একটা জানলা তো প্রায় মুখোমুখি। পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরেও নজর করা যায়। তা ছাড়া গলির দিকের জানলা দিয়ে দেখা যায় সদর দরজাও। তার উপর গত দুটো দিন এমন একটা সুযোগের জন্যই তো অপেক্ষা করে রয়েছি
অল্প দিন আগেও বাড়িটা ফাঁকাই ছিল। সারাদিন ঝিম হয়ে পড়ে থাকত। সদর দরজার হাতলে ধুলো–ময়লার আস্তরতারপরে হঠাৎই এক দুপুরে লোকজনের সাড়া। এসব ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ নেই আমারতবু প্রতিবেশী বলেই নিতান্ত কৌতূহলে জানলা দিয়ে তাকিয়েছিলাম। সদর দরজা খোলা। জনাকয়েক কুলিমজুর ধরাধরি করে নানা মাপের আসবাবপত্র ঢোকাচ্ছে। চেয়ার টেবিল মস্ত আরাম কেদারা খাট। প্রতিটিই বেশ দামি। এছাড়া গোটা দশেক বড় আকারের মজবুত স্টিলের ট্রাঙ্ক। ডালা বন্ধ থাকলেও কুলিগুলো যেভাবে সেগুলো নিয়ে আসছিল বোঝা যায় একেবারেই খালি। মালপত্র নেই। এতগুলো খালি ট্রাঙ্কের কী দরকার বুঝে উঠতে পারলাম না। ইতিমধ্যে হইহই করে সারা বাড়িতে শুরু হয়ে গেছে ঝাড়পোঁছসেও জনা কয়েক মিস্ত্রিমজুর।
কৌতূহল হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তত্ত্বতালাশ করেও খুব বেশি হদিশ পাইনিকাজের তদারক যিনি করছিলেন তিনি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির লোক। বিশেষ কিছু জানেন না। কলকাতা থেকে এক মহিলা নাকি আসছেন। কিছুদিন থাকবেন। তার আগে মালপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। সব যথাস্থানে সাজিয়ে ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করে দিতে হবে। সেই রকমই নির্দেশ
দিন কয়েক থাকবেন। অথচ এত মালপত্র! পেল্লায় আকারের এতগুলো খালি ট্রাঙ্ক! সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আসলে দেশের পূর্বপ্রান্তে ছোট এই শহরটার বিশেষ সুনাম নেই। স্মাগলিং উগ্রপন্থীদের উৎপাত লেগেই আছে। খুনজখম প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক। বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের ঢালাও কারবার। এর উপর কিছুদিন হল শুরু হয়েছে অন্য এক আপদ। গোদের উপর বিষফোঁড়া বলা যায়। প্রায় নিয়ম করে সপ্তাহে দুদিন শনি আর মঙ্গলবার রাতে রহস্যজনক ভাবে একের পর এক খুন। নিহত মানুষটির দেহে আঘাতের চিহ্ন বলতে গলায় তীক্ষ্ণ কিছু বেঁধার দাগ। এছাড়া শরীর শুকিয়ে প্রায় কাঠ হয়ে রয়েছে। সমস্ত রক্ত চুষে বের করে নেওয়া হয়েছে। কেউ বলছে ভ্যাম্পায়ার। শহরে ভ্যাম্পায়ার হানা দিয়েছে। এ তারই কাজতবে যুক্তিবাদীরা মানতে রাজি নয়। তাদের সন্দেহ এ কাজ রক্তের চোরাকারবারিদের। রাতের অন্ধকারে শিকার পেলেই তারা কাবু করে গলায় সূচ ফুটিয়ে শরীরের সমস্ত রক্ত বের করে নিচ্ছে। সে রক্ত চলে যাচ্ছে সীমান্ত পার হয়ে।
অন্য কোথাও এমন ঘটলে এতদিনে তোলপাড় হয়ে যেত। কিন্তু রালডিং নিতান্তই এক উপদ্রুত সীমান্ত শহর। পুলিশ আছে বটে। কিন্তু তাদের যে কী কাজ তারা নিজেরাই হয়তো জানে না। শহরে আধা সামরিক তথা প্যারামিলিটারি ফোর্সেরই রমরমা। তবে তাদের কাজ উগ্রপন্থী আর সীমান্ত সামলানো। এসব নিয়ে ভাবার সময় কমরহস্য তাই রহস্যই রয়ে গেছে। পুলিশ কোনও কিনারা করতে পারেনি। অগত্যা রাত নামলেই এখন শহর জুড়ে আতঙ্ক। খুব দরকার ছাড়া কেউ তেমন বের হয় না।
এমন এক জায়গায় কলকাতা থেকে কেউ মাস কয়েকের জন্য বেড়াতে আসছেন ব্যাপারটা সন্দেহজনক বইকী। বিশেষ করে এত আসবাবপত্র নিয়ে। অন্য কোনও ব্যাপার নয়তো? কিন্তু এসব দেখার কাজ পুলিশের। আমার নয়। তাই সেই প্রথম দিনের পর ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই মত বদলাল
এরমধ্যে নতুন প্রতিবেশীর ব্যাপারে আর খোঁজ নিইনি। কোনও সাড়াশব্দও পাইনি বাড়িটা থেকে। ভেবেছিলাম মহিলা বোধ হয় এখনও আসেননি। সেদিন গলির দিকের জানলা খোলাই ছিল। হঠাৎ ৯ নং বাড়ির সদর দরজা খোলার শব্দে বুঝলাম নতুন বাসিন্দা ইতিমধ্যে এসে গেছেন। নিতান্ত কৌতূহলে জানলা দিয়ে চোখ বাড়িয়েছিলাম। মধ্য চল্লিশ মহিলার পোশাক এমন কিছু আহামরি নয়। পরনে ফেডেড জিনস আর কটনের টপ। পায়ে স্নিকার। নিতান্তই সাদামাটা। তবু চোখ ফেরাতে পারিনিশুধু সুন্দরী বললে কমই বলা হয়। এমন হ্যান্ডসাম ফিগার অনেক দিন চোখে পড়েনি। যেন মুম্বাইয়ের কোনও ছবির পর্দা থেকে উঠে আসা হিরোইনএমন একজন মহিলা প্রতিবেশী হলে আগ্রহ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম ছিলাম না আমিও।
এরপর খোঁজ নিতে আগ্রহ কিছু বাড়ল আরও। মহিলা একাই থাকেন। এমন কী একটা কাজের মানুষও নেই। সারাদিন কোনও সাড়াও পাওয়া যায় না। খালি বাড়িটা আগে যেমন নিঝুম হয়ে থাকত এখনও প্রায় তেমনব্যতিক্রম বলতে গভীর রাতে কখনও চাপা একটা ঘড়ঘড় আওয়াজএক রাতে ওই শব্দ শুনে জানলায় কান পেতেছিলাম। বুঝতে অসুবিধা হয়নি মহিলা যথেষ্ট ভারি কিছু মেঝের উপর দিয়ে টেনে আনছেন। ট্রাঙ্কের ঢাকনা খোলার চাপা একটা শব্দ এরপর শুনতে পেয়েছিলাম শুধুব্যস তারপর সব আবার নিস্তব্ধ।
ব্যতিক্রম বলতে শুধু ওই বিকেলের দিকে। তাও নিয়মিত নয়। হঠাৎ কখনওআচমকাই সেদিন খুলে যায় ভারি কাঠের সদর দরজা। বেরিয়ে পড়েন মহিলা। সেই একই পোশাক। ফেডেড জিনস আর কটনের টপ। এছাড়া রোদচশমা। দরজায় তালা লাগিয়ে স্নিকারের হালকা শব্দে দ্রুত গলি পার হয়ে যান। এ শহরে এখনো ঘোড়ায় টানা টমটম রয়েছে। রিক্সা এমন কী অটো চালু হলেও সাধারণ মানুষ টমটমই ব্যবহার করে বেশি। গলির মুখে তাদের একটা ঠেক। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত দুএকটা থাকেই। গলির মোড়ে পৌঁছে মহিলা অন্য গাড়ির জন্য দেরি করেন না। তারই একটায় উঠে পড়েন। তবে গাড়িতে বেশি দূর যান না। শহরেই কোনও নিরিবিলি স্থানে পৌঁছে ছেড়ে দেন। বাকিটা হেঁটেই চলে যান তারপরকখন ফেরেন সেই হদিস পেতে অবশ্য সময় লাগেনি
সেদিনই রাত তখন আটটার মতোবড় রাস্তায় টিমটিমে বাতি জ্বললেও সরু গলিটা একেবারেই অন্ধকার। শুধু দুদিকের বাড়ির জানলা দিয়ে পড়া সামান্য আলো। তা বর্তমানে শহরের যা অবস্থা সন্ধের পর কেউ আর দরজাজানলা বিশেষ খোলা রাখে না। তাই ঘন অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই দেখতে পেলাম স্নিকারের হালকা শব্দে মহিলা ঘরে ফিরছেন। সঙ্গে একজন পুরুষ। লম্বাচওড়া চেহারা দেখেই বোঝা যায় স্থানীয় নয়। সম্ভবত প্যারামিলিটারিদের কেউলোকটা এক হাতে মহিলার গলা জড়িয়ে যেভাবে পা ফেলছিল বোঝা যায় অতিরিক্ত নেশার প্রভাবে যথেষ্টই বেসামাল। সঙ্গীকে নিয়ে মহিলা এরপর সন্তর্পণে দরজার তালা খুলে ঢুকে পড়েছিল ভিতরে।
রহস্যময় মহিলাটি কী চরিত্রের মানুষ এরপর বুঝতে বাকি থাকেনি। সেই প্রথম দিন থেকে ভিতরে যে ইচ্ছেটা ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে তা যে পূর্ণ হতে পারে বুঝে ফেলেছিলাম দিন কয়েকের মধ্যেই মিলে গেল সুযোগটা। সেদিন বিকেলে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে আর দেরি করিনি। যখন বের হলাম মহিলা ততক্ষণে গলির শেষ মাথায় পৌঁছে গেছেনসেজন্য অবশ্য ব্যস্ত হইনি। মহিলা এবার কী করবে জানা আছে। ধীরেসুস্থে যখন গলির মোড়ে পৌঁছলাম মহিলা ততক্ষণে টমটমে চেপে রওনা হয়ে পড়েছে। স্ট্যান্ডে দ্বিতীয় কোনও টমটম নেই দেখে যখন হাতপা কামড়াচ্ছি হঠাৎই একটা চলতি রিক্সা পেয়ে গেলাম।
বেশিদূর যেতে হল না। ছোট শহরএকপ্রান্তে বাগান ঘেরা ছোট এক লেক। পাশেই পাহাড় থেকে গোটা কয়েক ঝরনা নেমেছে। একটায় প্রায় সারা বছর জল থাকে। উঁচু বাঁধ দিয়ে সেই জল ধরেই লেকটা তৈরিচারপাশে নানা জাতের ফুল আর ফলের বাগান। শুনেছি আগে বিকেল হলে এখানে বহু মানুষের সমাগম হত। এখন প্রায় ফাঁকা। যারা এসেছিলেন বিকেল পড়তেই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। গেটের সামনে তাদের হালকা জটলা। দূর থেকেই দেখলাম মহিলা সেই লেকের সদর ফটকের কাছে এসে টমটম ছেড়ে দিলেনঅগত্যা খানিক আগেই নেমে পড়তে হল।
বাকি পথটুকু হেঁটে আসতে সময় লাগল। তবে সেজন্য উদ্বিগ্ন হইনি। পার্কের সদর ফটকের গায়েই চারদিক খোলা ছোট এক রেস্তরাঁসুদৃশ্য গোটা কয়েক চেয়ারটেবিল। ভিতরে ঢোকার আগে অথবা বের হবার পর অনেকেই এখানে চাকফি পান করতে আসেন। ইতিমধ্যে দেখে নিয়েছি মহিলা প্রায় ফাঁকা সেই রেস্তরাঁয় একটা টেবিলের সামনে বসে পড়েছেন।
কাছে গিয়ে শ্রাগ করে বললামওহ্‌ ম্যাম! ইউ!
মহিলা নীরবে কিছু ভাবছিলেন বোধ হয়। ইতিমধ্যে টেবিলে ধূমায়িত চা এসে গেছে। হাত দেওয়া হয়নি। আমার কথায় মুখ তুলে তাকালেন। ভুরু সামান্য কুঁচকে উঠল। তারপর ইংরেজিতেই বললেনআপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না!
আপনি নতুন মানুষ ম্যাম। তাই চেনার কথা নয়। আমি আপনার প্রতিবেশী। গলিতে দুএকবার দেখেছি। আলাপ হয়নি। আজ এই দিকেই কাজে এসেছিলাম। আপনার দেখা পাব ভাবিনি। হাজার হোক প্রতিবেশী মানুষ।
আমার কথায় মহিলা খুশি হলেন কিনা বোঝা গেল না। তবে বসতে ইঙ্গিত করে বললেনচা চলে তো? নাকি কফি?’
এক যাত্রায় আলাদা রকম ঠিক নয়।টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসে ফের কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসলাম। তারপর বয় ছেলেটাকে আর একটা চায়ের কথা জানিয়ে বললামদামটা কিন্তু আজ আমিই দেব।
ভেবেছিলাম মহিলা আপত্তি করবেন। কিন্তু কোনও কথাই বললেন নাআগের মতোই থম হয়ে রইলেন। কীভাবে শুরু করা যায় ভাবছি মহিলা ফস করে বললেনআপনি তো দেখছি আমার মতোই বাইরের মানুষ। চাকরির খাতিরে এসেছেন? একাই থাকেন?’
মহিলার কাছ থেকে এমন প্রশ্নের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। একটু থতমত খেয়ে গেলেও মুহূর্তে সামলে নিয়ে বললামঠিকই ধরেছেন ম্যাম। তবে চাকরিবাকরির জন্য নয়। আসলে
আমিও তাই।আমার কথা শেষ হবার আগেই মুক্তোর মতো দাঁতে উনি মিষ্টি হাসলেনআমি মিসেস নিশা রাও। বিবাহিতা হলেও আপাতত সেপারেশন চলছে। হাতে টাকাপয়সা আছে উড়ে বেড়াচ্ছি। আপনি?’
আমি মি. রমাকান্ত বাসু।মহিলার হাসিতে কিছু সাহস পেয়ে বললামকলকাতার মানুষ। মাস ছয়েক হল এসেছি। ভেবেছিলাম এই মাসেই ফিরে যাব। কিন্তু আজ আপনার সঙ্গে পরিচয়ের পরে মনে হচ্ছে দিন কয়েক থাকা যায় আরও। লাগোয়া বাড়ি। যদি অনুমতি করেন একদিন যেতেও পারি। খানিক গল্প করে আসব। অথবা যদি একদিন সময় করে গরিবের বাসায় আসেন।
আপনি তাহলে পাশের ৯ এ বাড়িটায় থাকেন!একটু যেন অবাক হলেন উনি। আমি তো ভেবেছিলাম বাড়িটা খালি। কেউ থাকে না।
আসলে একা মানুষ তো। দিনের অনেকটা সময় বাইরেই কাটে। 
কিছু মনে করবেন না মি. বাসু। আমি কিন্তু কারও বাড়িতে বড়ো একটা যাইবলতে বলতে হঠাৎই থেমে গেলেন উনি। হাঁ করে আমার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। সামান্য কুঁচকে উঠল ভুরু। আপনার আপনার বাঁ দিকের দাঁতটা নেই দেখছি!
সবে পরিচয়। হঠাৎ এমন কথায় বিব্রত হওয়া স্বাভাবিক। বাঁ দিকের ক্যানাইন দাঁতটা অনেক দিন আগে এক দুর্ঘটনায় পড়ে গেছে। বাঁধিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে সুবিধার থেকে অসুবিধাই বেশি। তাই আর ব্যবহার করা হয় না। সেই কথাই বললাম। মহিলা কিন্তু বিশেষ খুশি হলেন বলে মনে হল না। ঠোঁট বাঁকিয়ে সামান্য ঘাড় নাড়লেন শুধু। তারপর মুখ তুলে সন্তর্পণে চারপাশে চোখ ঘোরাতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন দূরে রাস্তার দিকে।
উপদ্রুত অঞ্চল। দিনভর পথে প্যারামিলিটারিদের টহল চলে। উর্দ্দিপরা তাদের কয়েকজন এদিকেই আসছে। কাঁধে রাইফেল। তাকিয়ে আছি রেস্তরাঁর মালিক সন্ত্রস্থ হয়ে টেবিলের পাশে এসে হাত কচলে বললেনরেস্তোরাঁ এবার বন্ধ করতে হবে স্যার।’
‘কেন? সন্ধে হতে তো দেরি আছে এখনও।’ একটু অবাক হয়েই বললাম
‘আর বলবেন না স্যার’ হাত কচলে ভদ্রলোক বললেন ‘ইদানীং সন্ধের পরে শহর থেকে কয়েকজন নাকি উধাও হয়ে গেছে। কোনও খোঁজ নেই তাদের। তাই দিন কয়েক হল সন্ধের আগেই রেস্তোরাঁ বন্ধ করার হুকুম হয়েছে। ওরা ওই জন্যই আসছে। আর দেরি করা যাবে না।
ইতিমধ্যে দ্রুত গোটা কয়েক চুমুক দিয়ে মহিলা আধখাওয়া চায়ের কাপ নামিয়ে রেখেছেন। আমি কিছু বলার আগেই উঠে দাঁড়ালেন। আজ এমনিতেও হাতে একদম সময় নেই মি. বাসু। উঠি বরং।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি হনহন করে বের হয়ে গেলেন। অল্প দূরে পথের উপর বড় এক হাউসিংপাশাপাশি গোটা কয়েক বাড়ি। হারিয়ে গেলেন তার ওধারে। দাম মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমিও।
সেদিন কাজটা যে বোকার মতো হয়ে গিয়েছিল পরে বুঝতে বাকি থাকেনি। মহিলা অর্থাৎ মিসেস নিশা রাও সেদিন রাত গোটা সাতেকের আগেই ফিরে এসেছিলেন। সঙ্গে নতুন একজন পুরুষ। দেখে হাতপা কামড়াতে বাকি রেখেছি। ওভাবে চলে না এসে মহিলার সঙ্গে থাকলে সুযোগটা আজই নেওয়া যেত। আহাম্মক মতো কাজ হয়ে গেছে।
আগেই বলেছি মহিলার ৯ নম্বর বাড়ির জানলার সোজা আমার ঘরেও একটা জানলা আছে। দুটো জানলাই সাধারণত বন্ধ থাকে। পরের দিন কী কারণে আমার জানলাটা খুলেছি দেখি ওদিকের জানলাও হাট করে খোলা। ঝোলানো হালকা পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরটা বেশ দেখা যাচ্ছেমহিলা ঘরে নেই অবশ্য। জানলাটা ফের ভেজিয়ে দিলেও কৌশলে সামান্য ফাঁক রেখে দিয়েছিলাম
কান দুটো তাই সতর্ক ছিল। দুপুরে ওদিক থেকে দরজা খোলার হালকা আওয়াজে জানলার ফাঁক দিয়ে তাকাতে যা নজরে পড়ল তাতে ভিতরে প্রায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেলঅনেক দিন শরীরের ভিতর এমন উত্তেজনা টের পাইনি। স্নান সেরে মিসেস রাও অ্যাটাচ বাথ থেকে বের হয়েছেন। সিক্ত উন্মুক্ত শরীর বেয়ে অল্প জল গড়াচ্ছে। উন্মুক্ত জঘন বক্ষদেশএকটা তোয়ালে নিয়ে মহিলা এরপর অনেকটা সময় ধরে শিক্ত দেহ মুছলেন। ওয়ারড্রব থেকে একটা নাইটি বের করে পরতে গিয়েও হঠাৎ ছুঁড়ে দিলেন মেঝেতে। তারপর সিলিং ফ্যানটা ফুল স্পীডে চালিয়ে দিয়ে ঘরের মাঝে মস্ত আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়লেন
তারপর কতক্ষণ ওইভাবে তাকিয়ে ছিলাম হুঁশ নেই। যখন সাড় ফিরে পেলাম সারা শরীর দরদর করে ঘামছে। কপালের দুপাশের শিরা দুটো সমানে দপদপ করে লাফিয়ে চলেছে
সেদিন বিকেলে মহিলা যখন বাড়ি থেকে বের হলেন না। সামান্য অন্ধকার নামতেই হানা দিয়েছিলাম। কিন্তু হতাশ হতে হয়েছে। মহিলা দরজা খোলেননি।
এ ঘটনা দু’দিন আগেরমহিলা এর মধ্যে আর বের হয়নি। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না। আর তারপরে আজ প্রায় অযাচিত ভাবে এই সুযোগ। উপদ্রুত সীমান্ত শহর। সন্ধের পরেই একেবারেই নিরাপদ নয়। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বড়ো একটা বের হয় না। তার উপর সাম্প্রতিক কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার কথা তো আগেই বলেছি। রাতে চোরের উপদ্রব ইদানীং তাই প্রায় শোনা যায় না। গলির অন্ধকারে মানুষটিকে তাই গোড়ায় সন্দেহ হয়নি। কিন্তু সামান্য লক্ষ্য করতেই ভুল ভাঙল। পা টিপে টিপে লোকটি যেভাবে সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে তা সাধারণ মানুষের মতো নয়নিশিকুটুম হাতে ছোট এক থলি। সন্দেহ নেই ভিতরে তালা খোলা দেয়াল বেয়ে ওঠার সরঞ্জাম।
গলির দিকের জানালার ফাঁক দিয়ে সন্তর্পণে তাকিয়ে ছিলাম। যা ভেবেছি তাই। ঘর ভরতি অত মালপত্র নিয়ে মহিলা একলা থাকে সেটা শহরের চৌর্য মহলে চাউর হতে সময় লাগেনি। তাদেরই কেউ রাতের অন্ধকারে হানা দিয়েছে। লোকটা পা টিপে সন্তর্পণে একসময় ৯ নং বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়াল। থলি থেকে কী একটা যন্ত্র বের করে সামান্য চেষ্টায় খুলে ফেলল দরজা। আমিও তৈরি হয়ে নিলাম।
ছোট দুতলা বাড়ি। উপর তলায় দুটি মাত্র ঘর। মহিলা আজও সেই আরাম কেদারায় শুয়ে রয়েছেন। শরীরে জড়ানো হালকা নাইটি। ভেবেছিলাম ঘুমচ্ছেন। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই নড়ে উঠলেন উনি। আসুন আসুন মি. বাসু। আমি কিন্তু আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।একরাশ খুশি ঝরে পড়ল মহিলার কণ্ঠস্বরে।
আমি আমি কিন্তু একদিন এসেছিলাম। অনেকক্ষণ দরজায় নক করে ফিরে যেতে হল!সামান্য হলেও উষ্মা আমার গলায়
আমি আমি দরজা খুলে দেব কী করে ভাবলে? একেই তো দাঁতটা ভেঙেছবাবুর দৌড় কত দূর দেখব না!খিলখিল করে হেসে উঠলেন নিশা রাওঅর্ধ উন্মুক্ত নাইটির ফাঁকে বুকে ঢেউ খেলে গেলউন্মুক্ত হাত দুটো বাড়িয়ে দিলেন‘তুমি তুমি কিন্তু পাশ হয়ে গেছ।’
উন্মুক্ত বাহুমূলে মদির আহ্বান। তবু সাড়া দিতে গিয়েও থমকে গেলাম। মুক্তোর মতো দুসার দাঁতে রিনরিন করে হাসছে নিশা রাও। দুপাশের তীক্ষ্ণ ক্যানাইন দাঁত দুটো ঠিকরে বের হয়ে এসেছে। লম্বা হচ্ছে ক্রমশ
আহা রে পুরুষ আমার! দেখি একবার।বলতে বলতে নিশা রাও উন্মুক্ত দুই হাতে বুকের মাঝে টেনে নিল আমাকে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপর আবেগঘন কণ্ঠবাহ্‌ শুধু হ্যান্ডসামই নয় ম্যান তোমার শরীর তো দেখছি সাংঘাতিক! নিশা রাওয়ের খিদে মিটবে বোধ হয়। অনেক দিন উপোষী কিন্তু
এসময় অযথা সময় নষ্টর অর্থ হয় না। পাশেই বেডরুম। কিন্তু বাধা দিয়ে নিশা রাও উঠে দাঁড়াল হঠাৎ ‘দাঁড়াও বাপু। আমার রাতের খাওয়া হয়নি এখনও। আগে পেটে কিছু দিয়ে নিইতারপর সারা রাত তো পড়েই রয়েছে। তোমার খিদে পায়নি?’
এ হে! আমি যে একটু আগেই খেয়ে এসেছি ডার্লিং!’ জিব কেটে বললাম ‘তোমার কথা একেবারেই খেয়াল হয়নি। মাই গডএখন বের হবে আবার!
‘সে কী আর জানি না!’ নিশা রাওয়ের কণ্ঠে একরাশ অভিমান। অধর ফুলে উঠল সামান্য। তবে সামলাতেও সময় লাগল না। অল্প হেসে মুখ খুলল আবার ভেব না বাপু রাতের খাবার ঘরেই মজুত রাখি আমি চট করে সেরে আসছি

পরের দিন ভয়ানক এক খবরে ছোট রালডিং শহর প্রায় তোলপাড় হয়ে গেলসকালে গলির ৯ নং বাড়ির দরজা খোলা ভিতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই দেখে স্থানীয় মানুষ থানায় খবর দিয়েছিলপুলিশ ভিতরে ঢুকে যা দেখতে পায় তা ভয়ানক বললেও কম বলা হয়। ঘর যিনি ভাড়া নিয়েছিলেন সেই মিসেস নিশা রাও নিরুদ্দেশ। তবে জিনিসপত্র তেমনই আছে। ডালা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে বড় চারটে ট্রাঙ্ক। প্রতিটি ট্রাঙ্কে একটি করে মৃত মানুষ। দেহ শুকিয়ে প্রায় কাঠ হয়ে রয়েছে। গলায় তীক্ষ্ণ ফলার একাধিক ক্ষতচিহ্ন। তার কতক শুকিয়ে গেলেও দুটি করে ক্ষতচিহ্ন বেশ টাটকা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগের। কয়েক দিন শহর থেকে যারা নিরুদ্দেশ হয়েছে দেহগুলি তাদের। একটি আবার এক প্যারামিলিটারি অফিসারেরনিরুদ্দেশ মাত্র দিন কয়েক আগে।  
এরপর পোস্ট মর্টেমে জানা গিয়েছিল প্রতিটি মৃত্যুই মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। গলার ক্ষত দিয়ে রক্ত আগেও বের করে নেওয়া হয়েছে। তবে তারা বেঁচেই ছিল তখনশেষ রক্তবিন্দু টেনে নিয়ে মাত্র গতকালই তাদের মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। এছাড়া বাড়ির একতলায় সিঁড়ির পাশে পড়েছিল আরও একটি দেহ। সেটিও শুকিয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে। তবে তার গলায় ক্ষতচিহ্ন একটি। একদম টাটকা। এই দেহটিকেও সনাক্ত করা হয়েছেএই শহরেই বাস। চুরির দায়ে বার কয়েক জেল খেটেছে। লোকটা যে বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল বোঝা যায় তার যন্ত্রপাতি বোঝাই থলে পাশে পড়ে থাকতে দেখে।
রালডিং ছোট শহর। ভয়ানক ব্যাপারটা যথেষ্ট আলোড়ন ফেললেও শহরের বাইরে তেমন প্রচার হয়নিযাতে আতঙ্ক না ছড়ায় সেজন্য স্থানীয় প্রশাসনের চেষ্টাও একটা কারণ। তাই রালডিংয়ের বাইরে তেমন জানতে পারেনি কেউ
নিরুদ্দেশ নিশা রাওয়ের খোঁজে এরপর শহর জুড়ে চিরুনি তল্লাশি হয়েছিল। তাতে নিশা রাওয়ের খোঁজ মেলেনি। কিন্তু জানা গেছে অন্য এক অদ্ভুত ব্যাপার। নিশা রাওয়ের ৯ নং বাসার লাগোয়া ৯ এ বাড়ি মাস ছয়েক আগে ভাড়া নিয়েছিলেন মি. রমাকান্ত বাসু নামে এক ভদ্রলোক। দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরেই থাকতেন। নিরুদ্দেশ তিনিও। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার যে বাড়িতে তিনি থাকতেন তার কোনও ঘরেই বসবাসের চিহ্ন নেই। চারদিকে ঝুল আর পুরু ধুলো ময়লা। মাস কয়েকের মধ্যে সেখানে কেউ বাস করেনিঅথচ দিন কয়েক আগেও তাঁকে গলির পথে দেখা গেছে।
শুধু পুলিশ নয় ব্যাপারটার তদন্ত হয়েছিল প্যারামিলিটারি ফোর্সের দপ্তর থেকেও। কোনও সমাধান হয়নি।
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত

13/6/2017
প্রথম প্রকাশ: ‘নবকল্লোল’ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ ভৌতিক সংখ্যা।

9 comments: