Thursday 11 January 2018

মহাভারতের এক অজ্ঞাত অধ্যায়ের গল্প (মো ভা): রহস্য ভীষ্মপর্ব (শিশির বিশ্বাস)


রহস্য ভীষ্মপর্ব
শিশির বিশ্বাস
প্রচলিত প্রবাদ যা নেই ভারতে তা আছে মহাভারতে। অনেকেই বলবেন‚ নিছক কথার কথাতবু ওই সূত্র ধরেই আজ ভীষ্মপর্ব থেকে এক অন্য গল্প শোনাব। সেকালে বেদ ব্রাহ্মণ পুরাণ মহাকাব্য প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতারা বহু ক্ষেত্রেই রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। বেদ পরবর্তী শতপথ ব্রাহ্মণে বিদেঘ মাঠবের কাহিনি তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন সিন্ধু–সরস্বতী অতিক্রম করে বর্তমান পাঞ্জাব হরিয়ানা হয়ে বৈদিক আর্যরা কীভাবে গঙ্গা প্রভৃতি নদী বিধৌত বর্তমান বিহার পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিলেন ওই কাহিনিতে তার একটি চমৎকার বিবরণ রয়েছে। অবশ্যই রূপকের অন্তরালে  ব্যতিক্রম হয়নি ভীষ্মপর্বেও। আমি সেই রূপকের অন্তরাল থেকে প্রকৃত ঘটনা খোঁজার চেষ্টা করেছি মাত্র। রহস্য ভীষ্মপর্ব সেই গল্প।
মহাভারতের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভীষ্ম। পিতা শান্তনু তাঁকে ইচ্ছামৃত্যু বর দিয়েছিলেন। কেন দিয়েছিলেন সেই প্রসঙ্গ মহাভারতে বিস্তারিত রয়েছে। শুধু বলি পিতা শান্তনুর মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য ভীষ্ম ভীষণ দুই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। প্রথমত তিনি কোনও দিন পিতার সিংহাসন দাবি করবেন না। আর দ্বিতীয়ত জীবনে বিবাহও করবেন না। পুত্রের ব্যবহারে খুশি হয়ে শান্তনু তাঁকে ইচ্ছামৃত্যু বর দিয়েছিলেন। অর্থাৎ নিজের মৃত্যু কামনা না করলে তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই।
ভীষ্ম তাঁর পিতা শান্তনুকে যে অত্যন্ত ভক্তি করতেন তাতে সন্দেহ নেই। নইলে অমন ভয়ানক প্রতিজ্ঞা করবেন কেন? আর সেই কারণে পিতার এই বরকে তিনি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মৃত্যু না চাইলে তাঁর মরণ নেই। তাঁর এই বিশ্বাস ক্রমে অন্যদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছিল। কারণও ছিল। সেকালে তাঁর মতো বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ কুশলী যোদ্ধা সারা দেশে তেমন কেউ ছিল না। শুধু সম্মান নয় সবাই তাঁকে যথেষ্ট সমীহও করতেন
চলছিল এই ভাবেই। সমস্যাটা প্রথম দেখা দিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীষ্ম যখন কৌরবপক্ষে যোগ দিলেন। একেই তাঁর ইচ্ছামৃত্যু বর। তার উপর কৌরব শিবিরে নিযুক্ত পাণ্ডবপক্ষের গুপ্তচর ভয়ানক এক খবর নিয়ে এলেন। দুর্যোধন আসন্ন যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে আলোচনা করতে ভীষ্মর কাছে গিয়েছিলেন। তাতে ভীষ্ম পাণ্ডবপক্ষের খ্যাতনামা প্রতিটি যোদ্ধা ধরে তাঁদের কার কী ক্ষমতা হিসেব কষে যা ইঙ্গিত দিয়েছেন তা পাণ্ডবপক্ষের কাছে মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ভরসার কথা একটিই। পিতামহ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পুত্রসম পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেও তিনি তাঁদের বধ করবেন না। এছাড়া পাণ্ডব শিবিরের এক উত্তম রথী যিনি যুধিষ্ঠির নকুল আর সহদেবের চাইতেও বড় মাপের যোদ্ধা তিনি তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র পর্যন্ত ধরবেন না। সেই প্রসঙ্গ পরে বিস্তারিত আসবে। বরং আগের কথা বলি।  
খবরটা শুনে যুধিষ্ঠির ভয়ানক দমে গেলেন। একেই তাঁদের সৈন্য সংখ্যা সাত অক্ষৌহিণী মাত্র। সেখানে কৌরবপক্ষে এগারো অক্ষৌহিণী। অর্থাৎ দেড় গুণেরও বেশি। তার উপর ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী মহাপ্রতাপশালী ভীষ্মকেই দেওয়া হয়েছে কৌরব পক্ষের প্রধান সেনাপতির দায়িত্বচিন্তিত যুধিষ্ঠির তাই ছুটলেন শ্রীকৃষ্ণর কাছে।
হে জনার্দন একেই আমাদের সৈন্য সংখ্যা অনেক কম। তার উপর কৌরব পক্ষের প্রধান সেনাপতি পিতামহ সর্বশক্তিমান ভীষ্মর ইচ্ছামৃত্যু বর। তিনি একাই তো আমাদের সমস্ত সৈন্য বিনাশ করে ফেলবেন! তাই ভেবেছি আমরা পাঁচ ভাই পিতামহের কাছে আর্জি নিয়ে যাব এমন কাজ যেন তিনি না করেন। কৌরব শিবিরে যোগ দিলেও তিনি আমাদের যথেষ্টই স্নেহ করেন। মনে হয় নিরাশ করবেন না!
জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের বিচার বুদ্ধির উপর কৃষ্ণের তেমন আস্থা কোনও দিনই ছিল না। সহাস্যে বললেনজ্যেষ্ঠ-পাণ্ডব আপনি মূর্খের মতো কথা বলছেন। কে না জানে জন্ম হলে মৃত্যুও নির্দিষ্ট। ভীষ্ম যে প্রকৃতই ইচ্ছামৃত্যু ক্ষমতার অধিকারী কী করে ভাবলেন?’
যুধিষ্ঠির নিজেও জানতেন বুদ্ধিতে তেমন পাকা নন তিনি। তবু কৃষ্ণর ওই উত্তরে খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থেকে অবশেষে বললেনহে মাধব আপনার অজ্ঞাত কিছুই নেই। তবু কী  করে ভুলে গেলেন পিতা শান্তনু তাঁকে ইচ্ছামৃত্যু বর দিয়েছেন?’
যুধিষ্ঠিরের কথায় কৃষ্ণ ফের হাসলেনসে কথা বিলক্ষণ স্মরণ আছে মহারাজ। কিন্তু ভেবে দেখেছেন রাজা শান্তনু এমন কিছু মহামানব নয় সাধুসন্ন্যাসীদের মতো তপস্যাও করেননি। তাঁর দেওয়া বরের কোনও মূল্য থাকতেই পারে না। স্রেফ কথার কথা মাত্র।
হাজার হোক কৃষ্ণের কথা। যুধিষ্ঠির আর কোনও প্রশ্ন সেদিন করেননি। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হতে অল্প দিনেই টের পাওয়া গেল যুধিষ্ঠিরের আশঙ্কা একেবারে অমূলক ছিল না। এই বৃদ্ধ বয়সেও কৌরবপক্ষে ভীষ্ম একাই একশো। প্রতিদিন হাজার হাজার পাণ্ডবসেনা ছাড়াও যথেষ্ট সংখ্যায় রথী মহারথী তাঁর শরাঘাতে ধরাশায়ী হয়ে চলেছে। নবম দিন তিনি সর্বতোভদ্রনামে এক মহাব্যুহ রচনা করে পাণ্ডব বাহিনীতে প্রায় প্রলয় ঘটিয়ে ফেললেন। বিনষ্ট হল বহু সৈন্য। বেলা যত গড়াতে লাগল পাণ্ডবসেনা নিধনে ভীষ্মের উন্মত্ততা ততই বৃদ্ধি পেতে লাগল। তাঁকে ঠেকাতে এসে হার মানলেন মহাবীর অর্জুন পর্যন্ত। বৃদ্ধ ভীষ্মের সেই রণমূর্তি দেখে স্বয়ং কৃষ্ণও প্রমাদ গণলেন। সূর্যাস্ত হতে সেদিনের মতো যখন যুদ্ধ স্থগিত হল যুদ্ধক্ষেত্রে তখন শুধুই মৃতদেহের পাহাড়। প্রায় সবই পাণ্ডব-সেনার। পাণ্ডব শিবিরে তাই শুধুই হাহাকার। অন্যদিকে কৌরব শিবিরে বিজয় উল্লাস।
কৃষ্ণের সঙ্গে সেদিনের কথার পর যুধিষ্ঠির এপর্যন্ত কিছু আর বলেননি। কিন্তু অবস্থা দেখে ভাইদের নিয়ে ফের ছুটলেন কৃষ্ণর কাছে। হে মাধব আজ যা হল এভাবে আর দুচার দিন চললে আমাদের আর একটি সৈন্যও অবশিষ্ট থাকবে না।
আশঙ্কা যে মিথ্যে নয় কৃষ্ণও বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারলেন না। যুধিষ্ঠির নিজেই ফের বললেনমাধব অপেক্ষা না করে আমাদের এখনই একবার কৌরব শিবিরে পিতামহ ভীষ্মের কাছে যাওয়া দরকার। দায়বদ্ধতার কারণে তিনি কৌরব শিবিরে যোগ দিতে বাধ্য হলেও আমাদের প্রতি যথেষ্টই স্নেহশীল। মনে হয় নিরাশ করবেন না।
যুদ্ধ শুরুর আগে যুধিষ্ঠির একই কথা বলেছিলেন। কৃষ্ণ কানে নেননি। কিন্তু সামান্য কয়েক দিনে বুঝেছেন যুধিষ্ঠিরের সেদিনের কথায় যথেষ্টই সারবত্তা ছিল। তিনি তখন ভীষ্মের মিথ্যে ইচ্ছামৃত্যুর কথাই ভেবেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বৃদ্ধ মানুষটির দাপটের কথা ভাবেননি। যত দেখছেন ততই অবাক হচ্ছেন এখন। এই বয়সেও মানুষটি অস্ত্র চালনায় কী ভীষণ দক্ষ! যেভাবে একা হাতে পাণ্ডবসেনা সংহার করে চলেছেন যুধিষ্ঠিরের অনুমান একবিন্দু মিথ্যে নয়। ঢোঁক গিয়ে বললেনধর্মপুত্র অভিপ্রায় যখন করেছেন আর দেরি করা উচিত নয়।
অতঃপর বর্ম অস্ত্র প্রভৃতি ত্যাগ করে পঞ্চপাণ্ডব এবং কৃষ্ণ কৌরব শিবিরে ভীষ্মর কাছে হাজির হলেন। যুধিষ্ঠির নতমস্তকে বললেনপিতামহ চিরকাল আপনি আমাদের হিত কামনা করেছেন। দুঃসময়ে আজ তাই আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছি। কীভাবে জয়ী হয়ে রাজ্য লাভ করতে পারি  সেই পরামর্শের আশায়।
ভীষ্ম বলেনবৎস আমি জীবিত থাকতে তোমাদের যুদ্ধ জয়ের কোনও আশা নেই। একমাত্র আমাকে নিহত করলেই তোমরা অক্লেশে কৌরব সৈন্য বিনাশ করতে পারবে।
উপস্থিত পঞ্চপাণ্ডব ও কৃষ্ণ নীরব। ভীষ্ম বললেনপাণ্ডুপুত্র তুমি নিশ্চয় অবগত আছো যুদ্ধক্ষেত্রে নিরস্ত্র যোদ্ধার বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধরি না। তেমনই অস্ত্র ধরি না স্ত্রী জাতির বিরুদ্ধেও। এমনকী তিনি যদি সশস্ত্র হয় তবুও। তোমার সেনাদলে দ্রুপদ পুত্র শিখণ্ডী আছেন। পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন কাশীরাজের কন্যা অম্বা। এমনকী এই জন্মেও তিনি রাজা দ্রুপদের কন্যা সন্তান হয়েই জন্মেছিলেন। পুরুষ হয়েছেন অনেক পরে। শিখণ্ডী আমার কাছে তাই স্ত্রী বলেই গণ্য। তার বিরুদ্ধেও আমি অস্ত্র ধরব না। কিন্তু উত্তম রথী হলেও আমার বর্ম ভেদ করার সাধ্য শিখণ্ডীর নেই। তাই শিখণ্ডীকে সামনে রেখে একমাত্র অর্জুন যদি শরনিক্ষেপ করে তাহলেই আমাকে পরাজিত করা সম্ভব।
যদিও মহাভারতে বিস্তারিত রয়েছে তবু গল্পের প্রয়োজনে অম্বা ও শিখণ্ডীর সেই কৌতূহলোদ্দীপক উপাখ্যানের কিছু উল্লেখ করা দরকার। 
ভীষ্ম তাঁর অনুজ বিচিত্রবীর্যর বিবাহের জন্য স্বয়ংবর সভা থেকে অম্বা নামে এই কাশীরাজ কন্যাকে তার অন্য দুই বোন অম্বিকা ও অম্বালিকা সহ হরণ করে এনেছিলেন। স্বয়ংবর সভায় তখন উপস্থিত পাণিপ্রার্থী কম ছিলেন না। কিন্তু যুদ্ধে কেউই তাঁর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেননি। বয়সে পৌঢ় হলেও ভীষ্মর যুদ্ধ–নৈপূণ্য দেখে সম্ভবত তিন রাজকন্যাও মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই তাঁরাও আপত্তি করেননি। কিন্তু পরে যখন জানতে পারলেন‚ ভীষ্ম নিজের জন্য নয়‚ তাঁদের হরণ করে এনেছেন রুগ্ন বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্যর সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য‚ তিন রাজকন্যার কেউই মেনে নিতে পারেননি। 
অন্য দুই বোন মুখ ফুটে বলতে না পারলেও অম্বা কিন্তু সাফ জানিয়ে দিলেন‚ ইতিপূর্বে পিতার অগোচরে তিনি শাল্বরাজকে পতিরূপে বরণ করছেন। স্বয়ংবর সভায় তাঁকেই মালা দিতেন। সুতরাং এই বিবাহে তিনি রাজি নয়।
অম্বার কথায় ভীষ্ম অনতিবিলম্বে তাঁকে শাল্বর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু স্বয়ংবর সভায় ভাবী স্ত্রীর সামনে ভীষ্মর হাতে নিদারুণ পরাজয়ের গ্লানি তিনি ভুলতে পারেননি। ক্ষোভে জর্জরিত। অম্বাকে তিনি গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। অপমানিত অম্বার যাবতীয় ক্ষোভ গিয়ে পড়ল ভীষ্মর উপর। সর্বনাশের মূলে ওই মানুষটা! প্রতিশোধ চাই। অম্বা গেলেন পরশুরামের কাছে। তিনি রাজিও হলেন। কিন্তু তখন তাঁর বয়স হয়েছে। যুদ্ধে তিনিও ভীষ্মর কাছে হার মানলেন। অম্বা এরপর শুরু করলেন দেবাদিদেব মহাদেবের তপস্যা। তুষ্ট হয়ে মহাদেব বর দিলেন তুমি আগামী জন্মে অন্য দেহে পুরুষত্ব পেয়ে ভীষ্মকে বধ করতে পারবে। নবজন্ম কামনায় এরপর অম্বার দেহত্যাগ।
অম্বার প্রতিজ্ঞাই শুধু নয় তাঁর ভয়নক জেদও ভীষ্মকে বিস্মিত করেছিল। বিচক্ষণ মানুষটি তাই উপযুক্ত সংখ্যক গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেনতারাই তাঁকে নিয়মিত অম্বার সংবাদ জানিয়ে গেছে। মহাদেবের বরলাভ। দেহত্যাগ। এর অল্পকাল পরেই রাজা দ্রুপদের ঘরে এক পুত্র সন্তানের জন্ম। আসলে পুত্র নয় জন্মেছিল কন্যা। কিন্তু পুত্রহীন রাজা দ্রুপদ তখন পুত্র কামনায় অধীর। ভয়ে দ্রুপদমহিষী তাই পুত্রসন্তান জন্মের কথা প্রচার করেছিলেন। গুপ্তচর মারফত ভীষ্মর কাছে কিন্তু প্রকৃত সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। তারপর যক্ষ স্থূণাকর্ণর চেষ্টায় সেই কন্যার কীভাবে পুরুষে রূপান্তর ঘটল‚ তা কল্পকথা নয় বিজ্ঞানের গল্প। বিচক্ষণ ভীষ্ম কিন্তু তাঁর নিয়তি বুঝে ফেলেছিলেন এরপর
যাই হোক আগের কথায় ফিরে আসি আবার। মহামতি ভীষ্ম সেই রাতে এভাবে নিজের মৃত্যুবাণ নিজেই তুলে দিয়েছিলেন পাণ্ডবদের হাতে। তবু পরের দিন অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের দশম দিনের যুদ্ধে ভীষ্মকে পরাজিত করা সহজ হয়নি। গোড়ায় শুরু করেছিলেন শিখণ্ডী একাই। কিন্তু তার দিকে বিন্দুমাত্র দৃকপাত না করে ভীষ্ম যেভাবে পাণ্ডবসেনা সংহার শুরু করলেন ছুটে আসতেই হল অর্জুনকে। শিখণ্ডীর আড়ালে থেকে মুহুর্মুহু ভীষ্মের প্রতি শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। সেই তীক্ষ্ণ শরে ভীষ্মের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিদীর্ণ হতে লাগল। বর্ম ভেদ করে বুকেপিঠে আঘাত করল। কিন্তু ভীষ্ম সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃকপাত না করে আগের মতোই পাণ্ডবসেনা বিনষ্ট করতে লাগলেন। এভাবেই চলল সারা দিন। শেষে সূর্য যখন প্রায় অস্তাচলে। সামান্য পরেই যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা হবে শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে গেলেন। অর্জুনের নিক্ষিপ্ত শর তাঁর সুকঠিন বর্ম ভেদ করতে পারলেও দেহ বিদীর্ণ করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু ক্ষতস্থান থেকে দিনভর অবিরাম রক্তক্ষরণে প্রায় শেষ অবস্থা।
মৃত্যুপথযাত্রী ভীষ্মকে সবাই তখন ঘিরে ধরেছেন। নিস্তেজ মৃতপ্রায় মানুষটির দিকে তাকিয়ে অভিজ্ঞ কৃষ্ণ তো বটেই যুধিষ্ঠির অর্জুনেরও বুঝতে বাকি নেই অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন তিনি। সম্ভবত সূর্যাস্তের আগেই। এই যখন অবস্থা তখন হঠাৎই পট পরিবর্তন।
মুমূর্ষু মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটিকে ঘিরে তখন উভয় পক্ষের একাধিক ব্যক্তি। সবাই বিলাপ করে চলেছেন। এই সময় মৃতপ্রায় মানুষটি ক্ষীণ কণ্ঠে জল খেতে চাইলেন। দুর্যোধন স্বর্ণপাত্রে জল নিয়ে এলেন। পিতামহের জন্য জল এনেছিলেন পাণ্ডবেরাও। ভীষ্ম কিন্তু জল খেলেন অর্জুনের হাতে। অতঃপর সবাই যখন তাঁর মৃত্যুক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছেন ক্ষীণ কণ্ঠে ভীষ্ম বললেনতোমরা অযথা বিলাপ করো না। এখন সূর্যের এই দক্ষিণায়ন কালে আমার মৃত্যুর ইচ্ছা নেই। যেদিন উত্তরায়ণ শুরু হবে সেই দিনই আমি মৃত্যু বরণ করব।
ভীষ্মের সেই কথায় উপস্থিত অনেকেই সাধু সাধু করে উঠলেন। কিন্তু প্রমাদ গণলেন অর্জুন। কৃষ্ণকে একান্তে ডেকে বললেনমধুসূদন এ কী সম্ভব? পিতামহের দেহে আর সামান্যই তেজরক্ত অবশিষ্ট। আর কতক্ষণ তাঁর দেহে প্রাণ থাকবে? অথচ উত্তরায়ণ শুরু হতে এখনও যে কয়েক মাস সময় বাকি!
কৃষ্ণ বললেনধনঞ্জয় আশা আমিও দেখছি না। ভীষ্মর আয়ু বড়ো জোড় আর এক বা দুই দণ্ডকাল (১ দণ্ড বর্তমান ২৪ মিনিটের মতো)।
ততক্ষণে যুধিষ্ঠির সহ অন্য পাণ্ডবেরাও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। সন্দেহ তাঁদের ভিতরেও। যুধিষ্ঠির ব্যাকুল হয়ে বললেনহে গোবিন্দ পিতামহ আজ আমাদের জন্যই এই শরশয্যা বরণ করেছেন। তাঁর কথা মিথ্যে হয়ে যাক আমাদের কাম্য হতে পারে না। কিছু একটা করতেই হবে। আপনি আমাদের প্রধান। উপায় করুন?’
আগেই বলেছি যুধিষ্ঠিরের বিচার বুদ্ধির উপর কৃষ্ণর কোনও দিনই তেমন আস্থা ছিল না। কিন্তু পরে মানতেই হয়েছে যুদ্ধের আগে যুধিষ্ঠিরের কথায় সহমত হলে অযথা পাণ্ডব পক্ষের এত সৈন্যক্ষয় ঘটত না। অনেক আগেই ভীষ্মের পতন ঘটানো সম্ভব হতো। তাঁরই ভুল। তিনি ভ্রান্ত ইচ্ছামৃত্যু কথাই ভেবেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বৃদ্ধ মানুষটির দক্ষতার সামান্য আঁচও করতে পারেননি।  গত রাতে পাণ্ডবদের সঙ্গে তিনিও ভীষ্মর কাছে গিয়েছিলেন। দায়িত্ব তাঁরও কিছু কম নয়। ব্যাপারটা নিয়ে তিনিও সেই থেকে ভাবছিলেন। কিন্তু উপায় কী ভেবে পাচ্ছিলেন না। ওই সময় হঠাৎ যুধিষ্ঠিরের ওই শরশয্যাকথায় যেন আলোর দিশা পেলেন। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে বললেনউপায় বোধ হয় আছে ধর্মপুত্র। কিন্তু হাতে সময় খুব কম। আশঙ্কা সেটাই।
যুদ্ধে শুধু সৈন্য বা অস্ত্র নয় প্রয়োজন উপযুক্ত সংখ্যায় বৈদ্য তথা চিকিৎসকেরও। কুরুক্ষেত্র মহাযুদ্ধের আগে উভয় পক্ষই প্রচুর সংখ্যক বৈদ্য নিযুক্ত করেছেন। সৈন্য শিবিরের কাছেই তাঁদের সাময়িক আরোগ্যশালা। অশ্বপৃষ্ঠে কৃষ্ণ আর অর্জুন প্রায় ঝড়ের বেগে সেখানে পৌঁছুলেন। আরোগ্যশালার প্রধান তাঁর সহকারীদের নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। সারা দিনই তাঁদের কাজ। কিন্তু দিন শেষে কাজ আরও বাড়ে। আহত যাদের দেহে প্রাণ আছে খুঁজে বের করে তাঁদের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা। কৃষ্ণ তাঁর কাছে পৌঁছে প্রয়োজন ব্যক্ত করলেন কৌরব শিবিরের হলেও ভীষ্মর চিকিৎসার ব্যবস্থা তাঁকেই করতে হবে। শুধু তাই নয় মানুষটিকে আগামী উত্তরায়ণ শুরুর দিন পর্যন্ত বাঁচিয়েও রাখতে হবে।
বৈদ্যাচার্য প্রায় থমকে গেলেন সেই কথায়। ইতিমধ্যেই ভীষ্মর সব খবরই তাঁর কানে এসেছে। কোনও উত্তর না দিয়ে থম হয়ে রইলেন। কৃষ্ণ এমনটাই আশা করেছিলেন। এক মুহূর্ত দেরি না করে বললেনআচার্য খবর পেয়েছি অল্পদিন হল তক্ষশিলা থেকে বৈদ্যাচার্য সুভদ্রশর্মা এসেছেন। তাঁর কোনও সংবাদ জানেন? তিনি কোথায় এখন?’
ঘটনা হল মহাযুদ্ধ শুরুর আগে উভয় পক্ষই নিজ নিজ শিবিরে প্রচুর সংখ্যক চিকিৎসক তথা বৈদ্য নিয়োগ করেছেন। উপার্জনের তাগিদে নিজেদের উদ্যোগেও এসেছেন অনেকে। কৃষ্ণর কাছে খবর ছিল দিন কয়েক হল তক্ষশীলা থেকে বৈদ্যাচার্য সুভদ্রশর্মাও এসেছেন। তিনি কণ্টক চিকিৎসায় অত্যন্ত দক্ষ। ভীষ্মর শেষ অবস্থা অনুমান করে তিনি যখন দিশা পাচ্ছিলেন না তখন যুধিষ্ঠির হঠাৎ ভীষ্মর শরশয্যার কথা বলতে চকিতেই তাঁর মাথায় কণ্টক চিকিৎসার কথা মনে পড়ে যায়। কণ্টক চিকিৎসায় কোনও ওষুধ নয় রোগীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে শুধু কাঁটা বিঁধিয়ে দেওয়া হয়। প্রয়োজনমতও সেই বিদ্ধ কাঁটা দুই আঙুলে মৃদু ঘোরানো হয়। এভাবে রোগীর দেহের বিভিন্ন স্নায়ুতন্ত্র কৃত্রিম উপায়ে অতি সক্রিয় বা সাময়ীক নিষ্ক্রিয় করে সুস্থ করে তোলা হয়। তবে চিকিৎসাটি অত্যন্ত ঝুঁকি সাপেক্ষ। ভুল চিকিৎসায় ক্ষতি হবারও সম্ভাবনা। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় অন্য উপায় না থাকায় কৃষ্ণ মনস্থির করতে দেরি করেননি। বিশেষ করে এ ব্যাপারে বৈদ্যাচার্য সুভদ্রশর্মার যখন যথেষ্টই খ্যাতি রয়েছে।
সমস্যা ছিল এই ডামাডোলের ভিতর তাঁকে খুঁজে বের করা। কিন্তু পাণ্ডব শিবিরের বৈদ্যাচার্যের সহায়তায় খুব সহজেই সেটা সম্ভব হল।   
সুভদ্রশর্মা প্রবীণ মানুষ। মাত্র দুদিন হল সহকারীদের নিয়ে তক্ষশিলা থেকে এসেছেন। হাতে তেমন কাজ এখনও মেলেনি।  তার উপর পৌঁছেই খবর পেয়েছেন যুদ্ধ নাকি প্রায় শেষ হবার মুখে। পাণ্ডবদের হার আর দুএক দিনের ব্যাপার মাত্র। প্রবীণ মানুষটি সেই সংবাদে কিছু মুষড়েই পড়েছিলেন। কৃষ্ণের কথায় গোড়ায় কিছু উৎসাহী হয়ে উঠলেও পরে নিরাশ হয়ে বললেনহে কেশব আমি বৈদ্য। রোগ নিরাময় করতে পারি। কিন্তু মৃত মানুষ বাঁচাতে পারি না। রোগী না দেখে তাই কিছুই বলা সম্ভব নয়। আগে যথাস্থানে পৌঁছনো দরকার।
অশ্ব প্রস্তুতই ছিল। কালক্ষেপ না করে সহকারীকে নিয়ে সুভদ্রশর্মা রওনা হয়ে পড়লেন।
ইতিমধ্যে ভীষ্মকে রণক্ষেত্র থেকে শিবিরে সরিয়ে আনা হয়েছে। বৈদ্য সুভদ্রশর্মাকে নিয়ে কৃষ্ণ যখন সেখানে পৌছলেন তখন শিবিরের অন্য বৈদ্যরা তাঁর বর্ম খুলে ক্ষতস্থান যথাসম্ভব পরিষ্কার করে দিয়েছেন। রক্তপাতও যথাসাধ্য বন্ধ করা হয়েছে। তবে কেউই আশার কথা শোনাতে পারেননি। মুমূর্ষু মানুষটার দেহে প্রাণ আছে বটে তবে নাড়ির গতি এতই ক্ষীণ যে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। বৈদ্য সুভদ্রশর্মা অবশ্য তাঁদের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করলেন না। মুহূর্তে ঝুঁকে পড়ে নাড়ী দেখতে বসে গেলেন।
থম হয়ে অনেকটা সময় ধরে নাড়ী দেখলেন তিনি। তারপর মুখ তুলে কৃষ্ণকে বললেনদেহে অতি ক্ষীণ হলেও প্রাণ আছে তবু চিকিৎসায় কতটা সাড়া পাওয়া যাবে তা না দেখে বলা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় সম্মতি দিলেই চিকিৎসা হাতে নেব।
চিন্তা করার সময় নেই। অন্য উপায়ও নেই। কৃষ্ণ অন্যদের সঙ্গে দুএক কথার পর সম্মতির কথা জানিয়ে দিলেন। সহকারীর দল ইতিমধ্যে সঙ্গের পেটিকা খুলে স্বর্ণ এবং রৌপ্য নির্মিত এক গুচ্ছ নানা মাপের  সুঁচ বের করে আকার অনুসারে সজিয়ে ফেলেছেন। তৈল পক্ব বেলের কাঁটাও কিছু রয়েছেসুভদ্রশর্মা একটি একটি করে সুচ ভীষ্মের নিথর দেহের বিভিন্ন স্থানে ফুঁড়তে শুরু করলেন। দেহের প্রায় সর্বত্রই ক্ষতবিক্ষত। তাই কাজ করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল। তবু বেশ কয়েকটি সুঁচ ফোঁড়ার পর কাজটা সহকারীদের উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি ফের রোগীর কবজি হাতে নিয়ে নাড়ি দেখতে শুরু করলেন।
বৈদ্য সুভদ্রশর্মা ভীষ্মের হাতের কবজি তারপর আর নামাননি। শুধু ইঙ্গিতে সহকারীদের নির্দেশ দিয়ে গেছেন। সহকারীর দল নীরবে সেই নির্দেশ অনুসারে বিদ্ধ সুঁচ বা কাঁটা তুলে নিয়েছেন। নয়তো অন্য স্থানে নতুন কাঁটা স্থাপন করে গেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বিদ্ধ শরগুলি ভীষ্মর দেহ থেকে তুলে নেওয়া হলেও তাঁর শায়িত দেহ তখন কণ্টকপূর্ণ। সেও যেন এক অন্য রকম শরশয্যা।
রাত গভীর হল ক্রমে। দুই শিবির প্রায় নিস্তব্ধ গভীর নিদ্রায় মগ্ন। নিস্তব্ধতা ভেদ করে কখনও আহত মানুষের অস্ফুট আর্তনাদ। শৃগাল কুকুরের চিৎকার। ইতিমধ্যে খবর এসেছে কৌরব পক্ষের সেনাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং দ্রোণাচার্য। নতুন সেনাপতি। মোকাবিলার জন্য নতুন প্রস্তুতি নতুন সলাপরামর্শর প্রয়োজন। কিন্তু পঞ্চপাণ্ডব এবং কৃষ্ণের তখনও সেই সময় মেলেনি। দুচোখের পাতা এক করতেও পারেনি কেউ। ভীষ্মর শিয়রের পাশে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে বসে। তাকিয়ে আছেন বৈদ্য সুভদ্রশর্মার দিকে। এখনও মুখ খোলেননি তিনি। রোগীর কবজিতে হাতের চার আঙুল রেখে একই ভাবে স্থির হয়ে বসে রয়েছেনঅন্য হাতে কিছু সময় অন্তর বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা কাঁটায় দুই আঙুলে মৃদু পাক দিয়ে চলেছেন। তারই মধ্যে ইঙ্গিতে সহকারীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ। ওদের সবার কাছে সেটাই আশার আলো। অর্থাৎ মুমূর্ষু মানুষটির দেহে প্রাণ রয়েছে এখনও। প্রহর পার হয়ে এই গভীর রাতেও।
বৈদ্য সুভদ্রশর্মা কিছু না বললেও কৃষ্ণ কিছুটা যেন অনুমান করতে পারছিলেন। কণ্টক চিকিৎসা তক্ষশিলার কয়েকজন বৈদ্য করে থাকেন। দেহের বিভিন্ন স্নায়ুকে এই চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণ করা যায় এই টুকুই শুনেছিলেন তিনি। নিজের বুদ্ধিতে মনে হয়েছিল মৃতপ্রায় মানুষটির বিভিন্ন স্নায়ু সাময়িক উত্তেজিত করে হয়তো তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলেও হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে তাঁর সেই ভাবনা বোধ হয় সঠিক হতেও পারে।
এভাবে চলল প্রায় সারা রাত। শেষে ভোরের পাখির কলরব যখন শুরু হয়েছে পূর্ব দিকের আকাশে আলোর আভাষ ভীষ্মের ঠোঁট সামান্য ফাঁক হল। অস্ফুট স্বরে জল খেতে চাইলেন। বৈদ্য সুভদ্রশর্মা ধীরে ভীষ্মর হাত নামিয়ে রাখলেন এবার। বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উপস্থিত মানুষগুলির দিকে সামান্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে মুখ খুললেনআপনাদের কিছু বলিনি তার কারণ যখন এসে পৌঁছেছিলাম তখন নাড়ির যা অবস্থা একেবারেই ভরসা পাইনি। কিন্তু এই বয়সেও বৃদ্ধের অসাধারণ প্রাণশক্তি। চিকিৎসায় এভাবে সাড়া দেবেন ভাবিনি। আর চিন্তা নেই।
রহস্য ভীষ্মপর্ব শেষ হতে আর সামান্যই বাকি। সামান্য হলেও অংশটি বর্তমান পাঠকের কাছে তো নয়ই বৈদ্য সুভদ্রশর্মার কাছেও খুব তৃপ্তিদায়ক ছিল না। এরপর ভীষ্মর চিকিৎসায় নিয়োজিত হয়েছিলেন তিনি। যথেষ্ট পারিশ্রমিকও পেয়েছিলেন। তবু যতই উত্তরায়ণ শুরুর দিন এগিয়ে আসছিল ততই মনের ভিতরে অন্য এক অবস্থা টের পাচ্ছিলেন। বৃদ্ধ ভীষ্ম ততদিনে প্রায় সেরে ওঠার দিকে। দেহের অধিকাংশ ক্ষত নিরাময় হয়ে গেছে। অনেকটাই সুস্থ। একদিন যুধিষ্ঠির আর কৃষ্ণকে একান্তে পেয়ে জানিয়েও দিলেন রোগী এখন প্রায় সুস্থ। নাড়ীর যা গতিপ্রকৃতি অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারেন।
শুনে কৃষ্ণ প্রায় হাঁ হাঁ করে উঠলেন। সে কী বলছেন বৈদ্যাচার্য! উনি যে উত্তরায়ণ শুরু হবার দিন নিজের মৃত্যুকথা শেষ করতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকালেন। মহারাজ আপনার কী অভিমত?’
যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ কোনও উত্তর দিলেন না। খানিক থম হয়ে রইলেন। তাঁর মাথায় তখন যুদ্ধের প্রথম দশ দিনের দুঃস্বপ্ন। ওই দশ দিনে পাণ্ডব পক্ষের বারো আনা সৈন্য এই বৃদ্ধের হাতেই ধ্বংস হয়েছে। দুর্যোধনদের কেউ আর বেঁচে নেই ঠিকই। সিংহাসন তাঁরই দখলে। তবু ফের যদি কখনও যুদ্ধ হয় পিতামহ হয়তো পাণ্ডবদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধারণ করবেন। ভাবতে গিয়ে প্রায় শিউরে উঠলেন তিনি। তিক্ত কণ্ঠে বললেনবৈদ্যাচার্য পিতামহের ইচ্ছা তবে কী পূর্ণ হবার নয়?’
উত্তরে সুভদ্রশর্মা অল্প হাসলেনমহারাজ কেন হবার নয়? তবে আমি বৈদ্য যে কাজ এখন করতে বলছেন তা আমার পক্ষে অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
উত্তরে যুধিষ্ঠির কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ বললেনআচার্য মহারাজ জানতে চাইছেন কাজটা ওই কণ্টক চিকিৎসাতেই সম্ভব কিনা?’
অবশ্যই। সেভাবে ওনাকে সারিয়ে তোলা হয়েছে সেই ভাবেই নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়েই সেটা সম্ভব হবে। আর যেহেতু ওনার কণ্টক চিকিৎসা এখনও চলছে রহস্য প্রকাশ হবার আশঙ্কা নেই। ভাববেন না।
গল্প শেষ হলেও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা: যে কণ্টক চিকিৎসার কথা গল্পে বলা হয়েছে তা কিন্তু কিছুমাত্র কাল্পনিক নয়। অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই জানেন চিকিৎসাটি আজও বর্তমান। তবে ভারত থেকে অনেক দিন আগেই বিলুপ্ত। দুর্ভাগ্য ক্রমাগত বৈদেশিক আক্রমণ লুণ্ঠণ আর ধ্বংসলীলার কারণে এমন অনেক কিছুই চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে এদেশ থেকে।*
 *মহাভারতের কাহিনি রাজশেখর বসু রচিত মহাভারতগ্রন্থ অনুসারে।
ছবি: প্রদীপ গোস্বামী (সৌজন্য: ছোটদের কলরব)
আপলোড: ২৯/৩/২০১৮

14 comments:

  1. আমাদের দেশ থেকে অনেক সম্পদ বিলুপ্ত হয়েছে। তার মধ্যে মেধা অন্যতম। অনেকাংশেই অব্যবহারে। কণ্টক চিকিৎসা তারই একটি। - দারুণ লেখা

    ReplyDelete
  2. Sir, শুভদ্র শর্মার এই ভীষ্মের চিকিৎসার ব্যাপার টা রাজশেখর বসু এর মহাভারতের কোন পর্বে উল্লেখ আছে, বলতে পারবেন please.?

    ReplyDelete
  3. Ei kontok chikitsai akhn acupuncture name porichiti ja chin o Japan er ayurveda te use kora hoy

    ReplyDelete
  4. এই কন্টক চিকিৎসাই কি আকুপাংচার ?

    আমার তো ব্যাখ্যান অনুযায়ী তাই বোধ হলো |

    ReplyDelete
  5. Ekta prosno theke gelo amar, sir!!
    Uttarayane jodi bhisma Mara jete chailen, ta to juddho cholakalin diner theke onek mas por ... Tahle to 18 diner juddho sesh hoyei geche, pandab rao jite geche, tahle abar voi peye bhisma ke bhul treatment Kore mere fela holo keno!!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার প্রশ্নের জবাব তো গল্পেই দেওয়া আছে!

      Delete
    2. ভাল লাগছে কাহীনিটা

      Delete
    3. Vobisyote kono joddho hole jate pitamoho vismo pandob der birudhe punoray na jete paren.

      Delete
  6. খুব ভালো হয়েছে।

    ReplyDelete