Wednesday 10 January 2018

ঐতিহাসিক গল্প (মোবাইল ভার্শন): এক খরতপ্ত দ্বিপ্রহরে (শিশির বিশ্বাস)

এক খরতপ্ত দ্বিপ্রহরে

শিশির বিশ্বাস

সে প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা খ্রি পঞ্চম শতকের অন্তিম পর্ব স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পরে গুপ্ত সাম্রাজ্য তখন টালমাটাল শক্ত হাতে হাল ধরবেন এমন কেউ নেই সিংহাসনে নরসিংহগুপ্ত নামেই সম্রাট মগধের বাইরে তেমন কোনও কর্তৃত্বই তাঁর নেই ফলে দিকে দিকে সামন্ত রাজারা মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে বিনয়গুপ্ত বাংলা শাসন করছেন মালবে ভানুগুপ্তও তাই নিজেকে তিনি পার্থ অর্থাৎ অর্জুনের সমকক্ষ বলে দাবি করেন বটে কিন্তু তাঁর নিজের রাজ্য মালবের অনেক অংশেই অরাজকতা আইনের শাসন প্রায় নেই আমাদের এই কাহিনীর শুরু সেই সময় ওই মালব দেশেই এক খরতপ্ত দ্বিপ্রহরে

মালবে ছোট এক নগর মহেন্দ্রঘাট ছোট হলেও নগরটি সমৃদ্ধশালী দেশের নানা প্রান্ত থেকে অশ্ব অশ্বতর এবং গোশকটে বণিকের দল যে মালপত্র নিয়ে আসে তার অনেকটাই খালাস হয় এখানে ফের নতুন মালপত্রে নিয়ে পাড়ি জমায় অন্য দিকে সেই কারণে বহিরাগত মানুষের ভিড় সর্বদাই সেজন্য পান্থশালাও আছে মূল সড়কের উপর তাদের একটি আকারে যথেষ্টই বড়। উঁচু প্রাচীর ঘেরা পাথরের পাকা বাড়ি একাধিক বড় ঘর ভোজন কক্ষ বিশ্রাম গৃহ গো এবং অশ্বশালা বলা বাহুল্য খরচ যথেষ্ট হবার কারণে ধনী এবং পদস্থ রাজকর্মচারীরাই এখানে আসেন মালিক পুণ্ডরীক নিজেই তদারক করেন একাধিক কর্মচারীই শুধু নয় রয়েছে নিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক প্রহরীও সেদিন সেই খরতপ্ত দুপুরে পান্থশালার বাইরে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ যখন প্রায় নিস্তব্ধ ধীর গতিতে অশ্বখুরের শব্দে প্রাঙ্গণের প্রান্তে অশ্বশালার অদূরে এক অশ্বারোহী এসে দাঁড়ালেন

পাশেই অশ্বরক্ষকদের ঘর এই খরতপ্ত দ্বিপ্রহরে সবাই প্রায় বিশ্রামরত ব্যতিক্রম এক দীর্ঘদেহী যুবক বয়স বছর কুড়ির বেশি নয় মেদহীন দেহে উপচে পড়ছে স্বাস্থ্য পরনে সামান্য কৌপীন অশ্বগৃহের পিছনে বড় এক বিচালির গাদা সেই গাদার খানিক দূরে প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে যুবকটি তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যুক্ত কাঠের লগা হাতে লক্ষ্যভেদ অভ্যাস করছিল সফল হচ্ছিল প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই বিচালির গাদার বিভিন্ন স্থানে কাঠি গুঁজে নতুন নিশানা দিয়ে উৎসাহে দূরত্বও বাড়িয়ে যাচ্ছিল প্রখর রোদে শরীর ঘর্মাক্ত। কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তবু অশ্বখুরের শব্দে এবার হঠাৎই সচকিত হয়ে উঠল হাতের লগা নামিয়ে ছুটে এল 

তরুণ যুবক পান্থশালার অশ্বরক্ষক অশ্বারোহী অতিথিদের অশ্ব দেখভাল করাই কাজ অশ্বখুরের শব্দে যুবকটি ছুটে এসেছিল যথা নিয়মেই কিন্তু সামনে অশ্বারোহী মানুষটির দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল খর্বনাসা নরুনচেরা ক্ষুদে চোখের মানুষটি ভিনদেশি আগে তেমন দেখা না গেলেও ইদানীং প্রায়ই দেখা যাচ্ছে এদের চারদিক নানা ভয়ানক কথা ভেসে বেড়ায় এই মানুষগুলোকে নিয়ে

অশ্বশালার প্রধান শাল্বদেব প্রবীণ মানুষ পুরনো দিনের নানা গল্প শুনেছে তাঁর কাছে তিনিই বলেছেন এরা নাকি হূন জাতির মানুষ দস্যুবৃত্তিই পেশা শাল্বদেবের তখন তরুণ বয়স গুপ্ত সম্রাটের পদাতিক বাহিনীর সৈনিক বহিরাগত এই হূনদল তাদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের উপরসৌভাগ্য বলতে হবে সিংহাসনে তখন স্কন্দগুপ্ত। গুপ্ত সিংহাসনে তিনিই সর্বশেষ শার্দূল। অথচ যুবরাজের মর্যাদা তিনি পাননি। কারণও ছিল। স্কন্দগুপ্তর মাতা দেবকীর রাজ মহিষীর মর্যাদা ছিল না। তাই যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও যুবরাজের মর্যাদা পেয়েছিলেন পুরুগুপ্ত। কিন্তু প্রকৃত বীরের ভাগ্য চিরকালই সুপ্রসন্ন। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি।

গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্ত ছিলেন শান্তিপ্রিয় মানুষ। দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছেন কিন্তু সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির দিকে তেমন আগ্রহ দেখাননি তারই ফলশ্রুতি রাজত্বের অন্তিম পর্বে দক্ষিণের মেলক দেশ থেকে পুষ্যমিত্র জাতির আক্রমণ সম্রাট তখন বৃদ্ধ হয়েছেন নিজে যুদ্ধে বের হবেন সেই অবস্থা নেই কিন্তু হাজার হোক সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রগুপ্তের রক্ত তাঁর দেহে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করেননি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ পুরুগুপ্ত হলেও শত্রু দমনের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন স্কন্দগুপ্তের হাতে তাই নিয়ে রাজ পরিবারে অশান্তি কম হয়নি কিন্তু সম্রাট কর্ণপাত করেননি শোনা যায় স্বয়ং রাজগুরু পর্যন্ত সম্রাটকে ব্যাপারটা ফের ভেবে দেখতে অনুরোধ করেছিলেন। এই সময় স্কন্দগুপ্তের হাতে সৈন্য বাহিনীর দায়িত্ব তুলে দিলে যুবরাজ পুরুগুপ্তর পক্ষে ভবিষ্যতে সিংহাসনে বসা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে

শোনা যায় উত্তরে সম্রাট নাকি বলেছিলেনআচার্যদেব তা হতে পারে হয়তো কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কাছে দেশের স্থায়িত্ব বিঘ্নকারী শত্রু বেশি গুরুত্বপূর্ণ যুবরাজ পুরুগুপ্ত কী এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম?’

সেদিন সম্রাটের প্রশ্নের কোনও জবাব রাজগুরু দিতে পারেননি আরামপ্রিয় যুবরাজ পুরুগুপ্তর পক্ষে এই কঠিন কাজ সত্যিই সম্ভব ছিল না

পুরনো সেই কথা বলতে বসলে আজও চকচক করে ওঠে শাল্বদেবের চোখ সম্রাটের দূরদৃষ্টির কারণে গুপ্ত সাম্রাজ্য রক্ষা পেয়েছিল সেবার দায়িত্ব পেয়েই বিশাল বাহিনী নিয়ে স্কন্দগুপ্ত শত্রু দমনে বের হয়ে পড়েছিলেন স্কন্দগুপ্তের সুনিপুণ পরিচালনায় মেলকরাজের পুষ্যমিত্র বাহিনী অচিরেই পর্যুদস্ত হয়েছিল গুপ্ত সাম্রজ্যের অঙ্গহানি আর হয়নি। কিন্তু সেই সংবাদ শোনার জন্য বৃদ্ধ সম্রাট তখন আর বেঁচে নেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর সেনাবাহিনীর পূর্ণ দায়িত্ব স্কন্দগুপ্তের হাতে ন্যস্ত করার পর তাঁর উপর নানা দিক থেকে প্রতিনিয়তই চাপ আসছিল বৃদ্ধ মানুষটি সেই চাপ সামলাতে পারেননি সম্রাটের শেষ দিনগুলি তাই একেবারেই সুখের ছিল না

কুমারগুপ্তর মৃত্যুর পর পুরুগুপ্ত ইতিমধ্যে সিংহাসনে আসীন হলেও গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হওয়া স্কন্দগুপ্তর কাছে তখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র

 সেবার সেই যুদ্ধে গুপ্ত বাহিনীতে সামিল হয়েছিলেন শাল্বদেবও নিজে চোখেই দেখেছিলেন স্কন্দগুপ্তর সৈন্য পরিচালনার দক্ষতা তাই সিংহাসনে বসার অতি অল্প দিনের মধ্যে হূন আক্রমণের কারণে গুপ্ত সাম্রাজ্যে যখন নতুন বিপদ দেখা দিল ব্যবস্থা নিতে কিছুমাত্র দেরি করেননি যে হূন দস্যুরা তখন পর্যন্ত প্রায় অপরাজেয় স্কন্দগুপ্তের সামনে প্রায় কুটোর মতোই ভেসে গিয়েছিল তারা একের পর এক যুদ্ধে হেরে শেষে আশ্রয় নিয়েছিল পঞ্চনদীর (সিন্ধু) ওপারে শাল্বদেবই বলেন গুপ্তসাম্রাজ্যের সেই ভাগ্যলক্ষ্মী সম্রাট স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পরে অন্তর্হিত হয়েছেন পঞ্চনদী পার হয়ে হূন দস্যুর দল ফের এদেশে ঢুকতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ তাই ভয়ানক ভয় করে এদের সহজে ঘাঁটায় না এদেশের ভাষাও এরা তেমন জানে না অধিকাংশ সময়ে আকার ইঙ্গিতে কাজ সারে

ভাষা নিয়ে অশ্বরক্ষক যুবকের অবশ্য সমস্যা ছিল না কারণ তার কাজ স্বল্প সময়ের জন্য আগন্তুকের অশ্বের পরিচর্যা খাদ্যর ব্যবস্থা করা অন্য কেউ হলে ঘাড় ঝুঁকিয়ে অতিথিকে যথোপযুক্ত সম্মান জানিয়ে এগিয়ে যেত কিন্তু আগন্তুক হূন বলেই যুবকটির ঘাড় সামান্যতম নত হল না স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল

যুবকটি যেমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অশ্বপৃষ্ঠে অন্যপক্ষও তখন স্থির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন তরুণ যুবকটির গলায় লোহার বেড়ির দিকে 

গলায় আঁটা ওই বেড়ির দিকে তাকিয়ে যে কেউ বলে দিতে পারেন যুবকটি কৃতদাস আগন্তুক অশ্বারোহীরও বুঝতে ভুল হয়নি কারণ ভিনদেশী হূন হলেও এদেশে তিনি নবাগত নয় প্রায় চল্লিশ বছর আগে যে হূন দস্যুর দল ভারতে প্রবেশ করেছিল অশ্বারোহীর এদেশে আগমন সেই সময় যদিও তখন তার বয়স মাত্রই তিন বছর সেই সময়ই সে অশ্ব চালনায় অভ্যস্ত আসলে হূন যোদ্ধাদের মধ্যেই প্রবাদ আছে তাদের জন্ম এবং মৃত্যু উভয়ই অশ্বপৃষ্ঠে সেই কিশোর বয়সে ‘নেপি’ অবশ্য যোদ্ধা নয় এদেশে এসেছিল তার বাবার সঙ্গে হাতেকলমে শেখাবার জন্য হূন যোদ্ধারা এমন হামেলাই করত এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি ব্যতিক্রম হয়েছে তার পরের ঘটনাবলী

গুপ্ত সেনার তাড়া খেয়ে হূন বাহিনী পশ্চাৎপসারণ করলেও সবাই ফিরে যায়নি নানা কারণে অল্প কিছু হূন থেকেও গিয়েছিল এই দেশে রণকুশলী এই যোদ্ধাদের সম্রাট স্কন্দগুপ্তও বিব্রত করেননি কিছু ব্যক্তিকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগও করেছিলেন কিন্তু সেসব অনেক দিন অতীত হয়ে গেছে নেপি আজ পঞ্চাশ উত্তীর্ণ এক পোড় খাওয়া হূন এদেশের কিছুই অজ্ঞাত নয় তবু যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে অশ্বপালকটির দিকে তাকিয়েছিলেন তা অন্য কারণে

সামান্য পর্যবেক্ষণের পরে নেপি অশ্ব থেকে লাফিয়ে নামতেই অবশ্য অন্যপক্ষ সচকিত হয়ে উঠল অভ্যাস মতো সামান্য মাথা নিচু করে অভিবাদন জানাল এই অবস্থায় অধিকাংশ অশ্বারোহী অশ্বের লাগাম এগিয়ে দেয় সঙ্গে প্রাণীটির যথোপযুক্ত যত্নের জন্য কিছু নির্দেশ কিন্তু ভিনদেশী আগন্তুকের দিক থেকে তেমন কিছুই হল না তবে একটু পরেই নীরবতা ভঙ্গ করে বললেনঅশ্বপালক কী নাম তোমার?’

তরুণ অশ্বপালক এই প্রথম যেন কিছু সংকুচিত হয়ে উঠল। দুটো কারণে প্রথমত ভিনদেশি আগন্তুকের মুখে এমন পরিষ্কার দেশীয় ভাষা একেবারেই আশা করেনি আর দ্বিতীয়ত বাবা বা মা কারো কথাই আজ আর মনে নেই তার পৈতৃক নামও তাই জানা নেই মনিবও পালটেছে বার কয়েক প্রায় পশুর মতোই ছিল সেই জীবন। এই পান্থশালায় যে কিছু ব্যাতিক্রম তা ওই শাল্বদেবের কারণে আজ পর্যন্ত কিছু স্নেহমমতা ওই মানুষটির কাছেই পেয়েছে এই যে অবসর সময়ে ভল্ল নিক্ষেপের চর্চা সে ওই শাল্বদেবের জন্যই। নইলে একজন ক্রীতদাসের এসব অধিকার নেই। পিছনে এক ঘটনাও রয়েছে অবশ্য। বছর কয়েক আগে একদল দুর্বৃত্ত আচমকা হানা দিয়েছিল পান্থশালায়। অশ্বশালার অশ্বগুলি লুঠ করাই ছিল উদ্দেশ্য। তখন গভীর রাত। প্রহরীরাও তেমন সতর্ক ছিল না। তবু তাদের উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হতে পারেনি সেজন্য অনেকটা কৃতিত্বই তার

সেদিনের পরে শাল্বদেবই মালিক পুণ্ডরীককে সম্মত করে ওর অস্ত্র চর্চার এই সামান্য সুযোগ করে দিয়েছেন। আশা দিয়েছেন লক্ষ্যভেদে উন্নতি করতে পারলে মালবরাজের পদাতিক বাহিনীতে স্থান করে দেবার চেষ্টা করবেন দুঃসহ এই ক্রীতদাসের জীবন থেকেও হয়তো মুক্তি মিলবে বেচারা সেই আশাতেই দিন গোনে এখন। অস্ত্র চর্চায় সামান্যমাত্রও ফাঁকি দেয় না। ভিতরে অন্য একটা ইচ্ছেও অবশ্য রয়েছে। শাল্বদেবের কাছেই শুনেছে মালবদেশে প্রকৃত বীর এখন একজনই তিনি ধর্মদেব মালবরাজের সেনা বাহিনীতেই ছিলেন একসময় তারপর বিতাড়িত এখন নিজেই সেনাদল গড়তে শুরু করেছেন মালবরাজের সৈন্য প্রায় হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁকে কিন্তু শাল্বদেবই বলেন ধর্মদেবকে ধরা সহজ নয় তিনি হূন বাহিনীর মতোই আসেন ঝড়ের গতিতে তারপর মিলিয়েও যান সেইভাবে মালবে ইদানীং যে দস্যু তস্করের দৌরাত্ম কিছু কমের দিকে তা ওই মানুষটির কারণেই

যুবকের মনোগত বাসনা তাই অকারণে নয় মুখ ফুটে একদিন সেকথা শাল্বদেবকে বলেও ফেলেছিল আতঙ্কিত শাল্বদেব থামিয়ে দিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ এমন ভয়ানক ইচ্ছের কথা মালবরাজের কানে গেলে সমূহ বিপদ তাতে অবশ্য দমেনি ও বরং ভিতরে জেদটা আরও বেড়েছে পান্থশালায় এই দুপুরের দিকেই কিছু সময় পাওয়া যায় সবাই একটু জিরিয়ে নেয় কিন্তু এই সময়টুকু নষ্ট করে না ও নীরবে ভল্ল নিক্ষেপ অভ্যাস করে

অশ্বারোহী আগন্তুকের প্রশ্নে যুবকটি তাই কিছু সংকুচিত হয়ে পড়লেও সামলে নিয়ে বললআজ্ঞে বৃষল

বৃষল!’ নেপির হালকা ভুরু মুহূর্তের জন্য কুঁচকে উঠলবাহ্ বেশ নাম তো!’

তরুণ অশ্বপালক এই প্রথম সামান্য হাসল ম্লান হাসি। কোনও জবাব দিল না। ভিনদেশি মানুষটির জানার কথা নয় নামটি এদেশে মোটেই গৌরবের নয়

ওকে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নেপি বললকী চুপ করে রইলে যে?’

নয়তো কী!’ ধীর কণ্ঠে যুবক উত্তর দিল এবারসামান্য এক ক্রীতদাস অশ্বপালকের এদেশে মত প্রকাশের অধিকার নেই যে

উত্তরে নেপি তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের মানুষটিকে আরও একবার জরিপ করে নিয়ে বললেনতাই নাকি! তবে একটা কথা বলে রাখি বৃষল দূর থেকে তোমার ভল্ল নিক্ষেপ দেখেছি এদেশের অনেক তাবড় ক্ষত্রিয় যোদ্ধার কাছেও তুমি ঈর্ষার পাত্র তাই খুব বেশিদিন তোমাকে আর ক্রীতদাস থাকতে হবে না উপযুক্ত কারও নজরে পড়ে যাবে অবশ্যই তা ছাড়া অতি অল্প দিনের মধ্যেই এদেশের পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তোমার মতো কুশলী যোদ্ধার গুরুত্বও বাড়বে তখন শুধু বৃষল নয় তখন নিজের পরিচয় দিও বৃষলদেব নামেবলতে বলতে অশ্বপালকের কাঁধে হাতে রাখলেন তিনি

আগন্তুকের ওই কথায় চকিতে বৃষলের একটা কথা মনে পড়ে গেল শাল্বদেবের কাছেই শুনেছে ধর্মদেব তাঁর বাহিনীতে পুরনো দিনের কিছু হূন যোদ্ধাকেও ঠাঁই দিয়েছেন দূরদর্শী মানুষটির বুঝতে ভুল হয়নি আগামী দিনে লড়াইটা যখন হূন হানাদারদের বিরুদ্ধে তখন বাহিনীতে পুরনো দিনের কিছু হূন যোদ্ধা থাকলে অনেক সুবিধে হূনদের তড়িৎ গতিতে আক্রমণ অতর্কিতে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নানা পদ্ধতি জানা থাকা একান্তই প্রয়োজন ব্যাপারটা মনে পড়তেই বৃষলের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল সতর্ক চোখে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বললভদ্দ আমার কিন্তু বীর ধর্মদেবের সেনাদলে যোগ দেবার ইচ্ছা

 বৃষল আগ্রহ নিয়ে বললেও নেপির তরফে তেমন সাড়া পাওয়া গেল না তার হাত অবশ্য তখনও বৃষলের কাঁধে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে বললেনছেলে এবার একটু অন্য কথা বলি অনেক দূর থেকে আসছি ভয়ানক ক্ষুধার্ত এখানে ভোজনের ব্যবস্থা আছে?’

পান্থশালায় খাবার সর্বদাই মেলে দধি ও শর্করা সহযোগে যব ও মুগচূর্ণ। শুকনো ফল অথবা পিষ্টক (রুটি)কখনো গোধূমের তপ্ত পিষ্টকের সাথে ঘৃতপক্ব ব্যঞ্জন বৃষল সেই কথাই জানাল

আগন্তুক অবশ্য তেমন খুশি হল না ভুরু কুঁচকে বললসে কী! মাংস মাংস পাওয়া যায় না?’

ঘৃতপক্ব ব্যঞ্জনের কথা বলতে গিয়ে বৃষলের দুই চোখ হঠাৎই চকচক করে উঠেছিল পান্থশালায় লঙ–এলাচ আর উত্তম ঘৃত সহযোগে মশলা দিয়ে রান্না চণকের সুনাম আছে অনেকের মুখেই প্রশংসা শুনেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত খাবার সৌভাগ্য হয়নি হবে এমন সম্ভাবনাও কম আগন্তুকের কথায় মুহূর্তে বাস্তবে ফিরে এল

 মশলা মাখানে শূলপক্ব মৃগ বা অজমাংস পান্থশালায় পাওয়া গেলেও সবদিন নয় তবে আজ নাকি কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির আসার কথা তেমনই খবর এসেছে মালিক পুণ্ডরীক তাই সকাল থেকেই কিছু ব্যস্ত নির্দেশ পেয়ে সকালে শাল্বদেব তাই ওকে নিয়ে শিকারে বের হয়েছিলেন কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও একটির বেশি হরিণ শিকার করা যায়নি তাও আকারে তেমন বড় নয় সেটি মালিক পুণ্ডরীক একেবারেই খুশি হয়নি প্রবীণ মানুষ শাল্বদেবকেও গালমন্দ হজম করতে হয়েছে বেশ জানে সেই মাংস অন্যদের জন্য নয় তাই চুপ করে ছিল কিন্তু আগন্তুক থামল না ওর মুখের উপর খানিক চোখ বুলিয়ে হঠাৎ বললসে কী হে! এমন দারুণ লক্ষ্য ভেদের ক্ষমতা তোমার! অথচ মাংস পাওয়া যায় না!’

আগন্তুকের ওই কথায় বৃষল আর নীরব থাকতে পারেনি সঙ্গে শাল্বদেব থাকলেও ভল্ল নিক্ষেপ করে আজকের হরিণটি তারই শিকার করা ফস করে বলে ফেলল সেই কথা

বাহ্উত্তেজিত গলায় কিছু বলতে গিয়েও নেপি থামল হঠাৎ সামান্য বিরতি দিয়ে বললতাহলে সেদিকেই যাচ্ছি তুমি ততক্ষণে আমার অশ্বর দেখভালটা ঠিকমতো সেরে ফেল সারাদিন বেচারার পেটে দানাপানি পড়েনিকথা শেষ করে কোমরবন্ধে বাঁধা ক্ষুদ্র চর্মপেটিকা থেকে একটা চকচকেপুরাণবের করে ওর হাতে গুঁজে দিলেনএটা তোমার কাজের জন্য

পুরাণঅর্থাৎ রৌপ্যমুদ্রা অশ্বর পরিচর্যার কারণে অতিথিদের কাছ থেকে এসব কখনও মেলে বটে তবে তা একআধ মাষার বেশি নয় গোটা এক পুরাণ হাতে পেয়ে বৃষল বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল আগন্তুক বললেনঅবাক হয়ো না বাপু ওটা শুধু অশ্বর পরিচর্যার কারণে নয় তোমার লক্ষ্যভেদের পুরস্কারও বটে বিদেশী হলেও এদেশে রয়েছি সেই বালক বয়স থেকে লক্ষ্যভেদে এমন পারদর্শী খুব বেশি দেখিনি তুমি অনেক দূর পৌঁছবে হে

 

যবন হূন জাতির অশ্ব বরাবরই উন্নত মানের এই অশ্বটিও ব্যতিক্রম নয় দেখেই বোঝা যায় কম্বোজ দেশের সারাদিনের পরিশ্রমেও তেমন কাতর হয়ে পড়েনি তবে যথেষ্টই ক্ষুধার্ত অশ্বর জন্য ভেজানো দানা অশ্বশালায় মজুত থাকে অনেকটা পরিমাণে সেই দানা আর কিছু টাটকা ঘাসজল দিয়ে ও অশ্বর অঙ্গমর্দন শুরু করল কাজটা ভালই শিখেছে পরিশ্রান্ত অশ্বকেও অতি অল্প সময়ে কিভাবে চাঙা করে ফেলা যায় ভালই জানে

নিবিষ্ট মনে ও তখন কাজ করে চলেছে সেই থেকে খুশিতে ভরে রয়েছে ভিতরটা কাছের মানুষ একমাত্র শাল্বদেব ছাড়া এমন প্রশংসা আগে কারও কাছে শোনেনি তাও একজন হূন জাতির মানুষের কাছ থেকে এদের কথা অনেকের কাছেই শুনেছে ও এমন দুর্দান্ত যোদ্ধা খুব বেশি দেখা যায় না তাদেরই একজনের মুখে এমন প্রশংসা জুটবে ভাবতেও পারেনি নির্জননিস্তব্ধ দুপুরে সেই কথা ভাবতে ভাবতে ঘোড়ার পরিচর্যা করছিল ওই সময় অদূরে ভোজন কক্ষের দিক থেকে ভয়ানক এক চিৎকার ভেসে এল আগন্তুক নেপির কণ্ঠস্বর

পান্থশালার ভোজনকক্ষে ও যায়নি কখনও নিষেধও আছে অতিথিদের অশ্ব প্রভৃতির জন্য কিছু খরচ হয়েছে কিনা কর্মচারীদের একজন এসে খবর নিয়ে যায় মালিক পুণ্ডরীক সেই বাবদ মূল্য ধার্য করেন কিন্তু আজ হঠাৎই ভিনদেশী মানুষটির সঙ্গে সামান্য কথার পর ভিতরে কিছু অন্য রকম বোধ হচ্ছিল অশ্বর পরিচর্যা করে এপর্যন্ত সামান্য যা পারিতোষিক মিলেছে তিল তিল করে জমিয়ে রেখেছে অবশ্য সব মিলিয়ে এখনও এক পুরাণের সমান হয়নি ইচ্ছে আছে আরও কিছু অর্থ জমলে একদিন দূরে কোনও কর্মকারের গৃহে চলে যাবে তারপর নাহ্ এরপর আর ভাবতে পারেনি বেচারা আতঙ্কে সারা শরীর কেঁপে গিয়েছে এসব বৃষলের মতো সামান্য এক ক্রীতদাসের ভাবাও অপরাধ প্রকাশ হয়ে পড়লে কঠিন শাস্তি কিন্তু আজ এই প্রথম নিজেকে যেন কিছু অন্যরকম মনে হচ্ছিল তারপর বখশিশ নগদ একটা পুরাণ!

 ভোজন কক্ষে তেমন চিৎকার আর না হলেও উত্তেজিত গলায় বাদপ্রতিবাদ তখনো চলছে ও পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেই দিকে গবাক্ষ দিয়ে ভিতরে তাকাল

 স্থূলাকার পাথরের দেয়াল যুক্ত গৃহ এই খরতপ্ত দুপুরেও বেশ ঠাণ্ডা শরীর জুড়িয়ে দেয় উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে কক্ষে যথেষ্টই আলো বৃষল দেখল ভিনদেশী নেপি কক্ষের এক কোনে ছোট এক তক্তপোষে বসে আছেন সামনে থালিতে সদ্য সেঁকা উৎকৃষ্ট ঘৃত মাখানো গোধূমের পিষ্টক বাটিতে ধোঁয়া ওঠা ঘন চণক সদ্য গরম করা হয়েছে দূর থেকেও তার লোভনীয় গন্ধ বৃষলের নাকে আসছিল পাশেই পানপাত্রে উৎকৃষ্ট মদিরা। কিন্তু আগন্তুক নেপি সেসব স্পর্শমাত্র না করে সমানে চিৎকার করে চলেছে লক্ষ্য পান্থশালার মালিক পুণ্ডরীকওহে তুমি কালা নাকি? মৃগমাংস দিতে বলেছিলাম! সেটা কোথায়?’

পান্থশালার মালিক পুণ্ডরীক শুধু ধনী নয় এ অঞ্চলে যথেষ্টই প্রতিপত্তিশালী মালবের রাজদরবারেও খাতির আছে এত বড় পান্থশালা কাজের মানুষ কম নয় তবু কখনও নিজেই উপস্থিত থেকে তদারক করেন পিছনে অন্য কিছু কারণও আছে দূর দেশ থেকে বণিকের দল আসে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন তেমন বুঝলে বা সস্তায় পাওয়া গেলে অনেক সময় কিছু মালপত্র কিনেও রাখেন আজ সম্ভবত তেমন কারও আসার কথা রয়েছে মৃগ মাংসের ব্যবস্থা সেই কারণে এই দুপুরে নিজেই তাই ভোজন কক্ষে উপস্থিত মধ্যম বয়স হলেও যথেষ্ট শক্ত সমর্থ মানুষ বিচক্ষণও বটে নেপির চিৎকার তেমন ধর্তব্যের মধ্যে নেননি বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে বললেনআপনাকে বললাম তো আজ মৃগমাংস নেই

মিথ্যে কথানেপি ফের চেঁচিয়ে উঠলেন

মিথ্যে! আমি মিথ্যে বলছি!’ হঠাৎ যেন খেপে উঠলেন পুণ্ডরীকমৃগমাংস আছে কে বলেছে? ওই শয়তান ছোঁড়া? শুনলাম অনেকক্ষণ নাকি গুজগুজ চলছিল!’ দুপাটি দাঁত কড়মড় করে উঠল তাঁর

ফালতু কথা রাখ হে অযথা আমি কিন্তু আর সময় নষ্ট করতে রাজি নইকিছুমাত্র না দমে নেপি প্রায় হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন

ফালতু আমি ফালতু কথা বলছি!’ পুণ্ডরীক পালটা হুঙ্কার দিলেন এবার

তারপরেই এক ব্যাপার ঘটল নেপি হঠাৎ সামনে রাখা চণকের বাটি তুলে ছুঁড়ে মারল পুণ্ডরীকর দিকে এমন হবে উপস্থিত কেউ ভাবতেও পারেনি ভোজন কক্ষে অন্য অতিথি না থাকলেও জনা কয়েক কর্মচারী উপস্থিত নানা প্রয়োজনে তাদের হামেশা পেশিশক্তি প্রয়োগ করতে হয় মালিকের দিক থেকে তেমন কোনও নির্দেশ না আশায় অনেক্ষা করছিল এতক্ষণ এবার এগিয়ে গেল। কিন্তু ততক্ষণে নেপি তক্তপোষ থেকে লাফিয়ে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন কোমরবন্ধের কোষ থেকে অসি বের করে সাঁইসাঁই শব্দে বার কয়েক ঘুরিয়ে ফের কঠিন গলায় হাঁকলেনমাংসটা আসবে কি এবার?’

আগন্তুকের সেই রুদ্র মূর্তি দেখে চারজন কর্মচারী থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেও অস্ত্র হাতে জনা কয়েক প্রহরী ইতিমধ্যে হাজির হয়েছে দরজার সামনে অন্য কেউ হলে এতক্ষণ ঝাঁপিয়ে পড়ত কিন্তু লোকটা হূন যোদ্ধা লড়াইটা জানে আর দেহে প্রাণ থাকতে থামতেও জানে না অগত্যা লড়াই মানেই ভোজন কক্ষের ভিতর একাধিক প্রাণহানি সবাই তাই মালিকের নির্দেশের অপেক্ষায়

ইতিমধ্যে একজন কর্মচারীর সাহায্যে পুণ্ডরীক কিছু পরিষ্কার হয়েছেন গরম চণকের ঝোলে শরীরের অনেক স্থান সামান্য পুড়েও গেছে জ্বালাও শুরু হয়েছে হয়তো ফোসকাও পড়বে কিন্তু সেদিকে কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে অদূরে অসি হাতে নেপিকে উদ্দেশ্য করে বললেনসামান্য অপেক্ষা করুন ভদ্দ মশলা দেওয়া মৃগ মাংস কিছু আছে যত শীঘ্র সম্ভব শূলপক্ব করে আনা হচ্ছে

মাংস অল্পই যখন আছে সবটাই নিয়ে এস বাপু অযথা ঝামেলায় খিদেটা আরও বেড়ে গেল যেননেপি হাতের অসি সামনে তক্তপোষের উপর নামিয়ে রাখলেন এরপর

  শিকার করে আনা হরিণ খুব বড় না হলেও একেবারে ছোটও নয় ধীরে সুস্থে নেপি তার পুরোটাই উদরে চালান করে ফেললেন খাওয়া সেরে যখন উঠলেন শুধু ঘরের ভিতরে নয় দরজার বাইরেও অনেকগুলি প্রাণী প্রায় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে কারও চোখেই কোনও প্রতিক্রিয়া নেই সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নেপি আর সময় নষ্ট করলেন না কোমরের চর্মপেটিকা থেকে একটা পুরাণ তক্তপোষের উপর নামিয়ে রেখে আরামে একটা ঢেঁকুর তুলে বের হয়ে পড়লেন

খরতপ্ত দ্বিপ্রহরের সূর্য আকাশে আগের মতোই আগুন ছড়াচ্ছে তখনও দমকা বাতাসেও আগুনের হলকা ভোজন কক্ষ থেকে বের হয়ে নেপি প্রাঙ্গণের অন্য প্রান্তে অশ্বশালায় এসে পৌঁছলেন বৃষলকে দেখতে না পেলেও তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামালেন না অশ্বশালায় অশ্বটা যথাস্থানে রয়েছে প্রভুকে দেখেই নড়ে উঠল সে দড়ি খুলে নেপি এক লাফে উঠে বসলেন পিঠে দ্রুত বের হয়ে পড়লেন তারপর অশ্বখুরের একটানা খটখট শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল একসময়

ভোজন কক্ষে পুণ্ডরীক থম হয়ে বসে ছিলেন এতক্ষণ চাপা ক্রোধে ফুঁসছিলেন অশ্বখুরের শব্দ মিলিয়ে যেতেই মুহূর্তে চাঙ্গা হয়ে বৃষলকে ধরে আনতে নির্দেশ দিলেন এমন হেনস্থা এপর্যন্ত কখনও হতে হয়নি তাঁকে সবকিছুর মূলে যে ওই ছেলেটা তখন বুঝতে বাকি নেই তার দেশের অবস্থা ভাল নয় এত বড় একটা পান্থশালা চালাতে গেলে অনেক দিকে নজর রাখতে হয় সেজন্য উপযুক্ত লোকও রেখেছেন শয়তান ছেলেটাকে কী শাস্তি দিলে ক্ষোভ কমবে অতঃপর তাই ভাবছিলেন তিনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষোভের নিবৃত্তি কিছুই আর হল না একে একে ফিরে এল সবাই বৃষলের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না পান্থশালায় নেই সরে পড়েছে ইতিমধ্যে

 

ভোজন কক্ষে ওই ঘটনার পর পালানো ছাড়া অন্য পথ যে আর নেই তা বুঝতে ভুল হয়নি বৃষলের তাই এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেনি ছুটে পান্থশালার চৌহদ্দি ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে সেই দণ্ডেই ভোজন কক্ষে সবাই তখন নেপিকে নিয়ে ব্যস্ত টের পায়নি কেউ 

এদেশে ক্রীতদাসের পালিয়ে যাওয়ার শাস্তি বড় ভয়ানক হতে পারে প্রাণদণ্ড পর্যন্ত অথচ হাতে সময় বড় কম তার উপর পদব্রজে পথ চলা গলায় আঁটা ক্রীতদাসের পরিচয় লোহার বেড়ি অতি সাধারণ মানুষের নজরে পড়লেও উপায় নেই পড়তে হতে পারে নানা প্রশ্নের মুখে এ ব্যাপারে সাধারণের জন্য কড়া নির্দেশও রয়েছে সন্দেহ হলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খবরটা পৌঁছে দিতে হবে স্থানীয় আরক্ষী গৃহে আর ব্যাপারটা জানা থাকলে তো ধরা পড়ে যাবে সেই দণ্ডেই বৃষল তাই পরিচিত পথ ছেড়ে কিছু নির্জন পথ ধরেছিল তবু পথে দুএকজনের দেখা পাওয়া গেছে ভয়ানক এই খরতপ্ত দুপুরে কেউই অবশ্য সেভাবে লক্ষ করেনি তাই রেহাই পাওয়া গেছে সারাদিন অশ্বশালাতেই সময় কাটে এসব অঞ্চল তাই তেমন পরিচিত নয় শাল্বদেবের কাছে সামান্য শুনেছে মাত্র বের হবার সময় মানুষটির সঙ্গে দেখা করাও যায়নি

ভাবতে গিয়ে নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছিল বৃষলের কিন্তু ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হল ইতিমধ্যে চারপাশের প্রকৃতি পালটে যেতে শুরু করেছে গাছপালার সংখ্যা কমে এসেছে অনেক দূরে পাহাড়ের সারি এখন অনেক স্পষ্ট একটাই ভরসার কথা আলো ইতিমধ্যে কমে এসেছে কিছু পড়ন্ত বিকেল বলা যায় আর কিছুটা সময় নিরাপদে কাটাতে পারলেই রাত নেমে আসবে তখন ধীর স্থির মাথায় পরবর্তী কর্মপন্থা গুছিয়ে নিতে পারবে ওটাই এখন সবচেয়ে জরুরি ভাবতে গিয়ে যখন কিছু স্বস্তি বোধ করছে তখনই পিছনে অনেক দূরে অশ্ব খুরের শব্দটা কানে এল

অশ্বপৃষ্ঠে কেউ পিছনে আসছে তবে কি কেউ অনুসরণ করেছে ওকে? সম্ভাবনার কথা মাথায় আসতেই বৃষলের শরীর আতঙ্কে প্রায় হিম হয়ে গেল কিন্তু ভাবনাটা মাথা থেকে নামিয়ে দিল মুহূর্তেই ভয় পেলে অযথা বিপদ আরও বাড়বে ও যা আশঙ্কা করছে হয়তো তেমন নাও হতে পারে অশ্বারোহী হয়তো ওর খোঁজে আসেনি অন্য কেউ সামান্য চিন্তা করে বৃষল তবু পথ পালটে ভিন্ন পথ ধরল কিন্তু খানিক বাদেই বুঝতে পারল পিছনে অশ্বারোহীও পথ পালটে ফেলেছে সেই আগের মতোই ওকে অনুসরণ করে আসছে খুরের আওয়াজেই বোঝা যাচ্ছে সুশিক্ষিত যুদ্ধের অশ্ব সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য নয় অশ্বশালায় কাজ করে এখন এসব ভালই বুঝতে পারে ও তবে কী ইতিমধ্যে আরক্ষ কেন্দ্রে (থানা) খবর গেছে অশ্বারোহী আরক্ষীর দল খুঁজতে বের হয়ে পড়েছে?

এদিকে গাছপালা সামান্যই কঠিন রুক্ষ প্রান্তর তারই মাঝে দুএকটা হালকা ঝোপঝাড় প্রয়োজনে তাদের কোনও একটার আড়াল লুকোনো যাবে এমন সম্ভাবনা কম ভাবতে ভাবতে  বৃষল দ্রুত পথ চলেছিল হঠাৎই বুঝতে পারল পিছনে অশ্বখুরের শব্দটা ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে একসময় বিলীনও হয়ে গেল

খানিক অপেক্ষার পর বৃষলের বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেমে এল এবার অকারণেই আশঙ্কা করছিল ও আশঙ্কা সত্যি নয় নিশ্চিন্ত হয়ে ফের পথ চলতে শুরু করেছিল। ওই সময় পিছনে অনেক দূরে ফের অশ্বখুরের শব্দ শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়াল গোড়ায় মনে হয়েছিল একই অশ্বারোহী ফিরে আসছে আবার কিন্তু অল্প সময় কান পেতে বুঝল শব্দটা অন্য কোনও অশ্বের অন্য কোনও অশ্বারোহী খানিক বাদে আওয়াজটা আরও স্পষ্ট হতে সারা শরীর আতঙ্কে ফের হিম হয়ে গেল ওর

ও পালিয়ে আসার পর পুণ্ডরীক অবশ্যই হাতপা গুটিয়ে বসে থাকবে না আরক্ষ বা চৌকিতে খবর পাঠাবে কিন্তু এক্ষেত্রে তাগিদ যে আরও বেশি একেবারেই ভাবেনি অথচ ওর অপরাধ বলতে মুখ ফসকে হরিণ শিকারের কথা ভিনদেশী নেপির কাছে বলে ফেলেছে মাত্র তবু মানুষটার ক্ষোভ তার উপরেই শাস্তি তাকেই পেতে হবে অথচ নেপির সব কিছুই মাফ ভাবতে গিয়ে বৃষলের সারা শরীরে প্রায় যেন আগুন জ্বলে উঠল

পান্থশালার অশ্বশালায় ভাল অশ্ব আছে গোটা কয়েক তারই একটার নাম চনক চমৎকার অশ্বটা পুণ্ডরীক নিজেও ব্যবহার করেন কখনও খুরের আওয়াজে বৃষলের তখন বুঝতে বাকি নেই সেই চণকের পিঠেই আসছে কেউ ক্ষুব্ধ পুণ্ডরীক শুধু আরক্ষ কেন্দ্রে খবর দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি পান্থশালার সেরা অশ্ব চণকের পিঠে কাউকে খুঁজতে পাঠিয়েছেন তবে কী মালিক নিজেই ওর খোঁজে বেরিয়েছেন?

এদিকের প্রান্তর আরও রুক্ষ প্রকৃতির সামান্য ঝোপঝাড়ও নেই শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে উটের কুজের মতো কিছু ক্ষয়িষ্ণু ফাটল ধরা পাথর দ্রুত মনস্থির করে ও তারই একটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল পালাবার সময় সঙ্গে কিছুই প্রায় নিতে পারেনি সেই সময়ও ছিল না তবু লক্ষ্যভেদ অভ্যাসের জন্য নিজের তৈরি তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যুক্ত সুদীর্ঘ একটা কাষ্ঠদণ্ড সঙ্গে নিয়েছিল আত্মরক্ষায় প্রয়োজন হতে পারে ভেবেই অস্ত্রটা হাতে নিয়ে ও নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না কিছুক্ষণের মধ্যেই অশ্বারোহীর অবয়ব পরিষ্কার হয়ে যেতে অজান্তেই বুক থেকে কিছুটা হলেও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নেমে এল অশ্বারোহী পান্থশালার প্রহরীপ্রধান শবর যেমন দানবের মতো শরীর তেমনই নিষ্ঠুর প্রকৃতির কারণে অকারণে লোকটার হাতে অনেক লাঞ্ছনা ওকে সহ্য করতে হয়েছে যমের মতো ভয় পায় সবাই ও নিজেও ব্যতিক্রম নয় কিন্তু আজ অশ্বপৃষ্ঠে সেই শবরকে দেখে কিছু অন্য রকম বোধ করল ও সমস্যা শুধু একটাই শবরের শরীরে বৃষচর্মের সুকঠিন বক্ষত্রাণ বৃষলের ভল্ল নিক্ষেপের নিপুণতা জানা আছে। তাই কিছুমাত্র ঝুঁকি নেয়নি অথচ ওর হাতে অস্ত্র বলতে এক কাষ্ঠদণ্ড মাত্র ভল্লের মতো তীক্ষ্ণ শীর্ষ। আর কাঠও সেরা মানের এই যা এই সামান্য অস্ত্রে ওই বর্ম কি ভেদ করা সম্ভব?

ভাবনাটা অবশ্য মাথা থেকে মুহূর্তেই নামিয়ে দিল বৃষল দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল

পান্থশালার প্রহরী প্রধান শবর অশ্বপৃষ্ঠে নিশ্চিন্তেই পথ চলছিল অনেক দিন পরে একটা কাজের মত কাজ পাওয়া গেছে শয়তান ছোঁড়াটাকে ধরে আনতে পারলে মালিক বেজায় খুশি হবেন অথচ তেমন কিছু কঠিন কাজ নয় গলায় কৃতদাসের বেড়ি দেখলেই চিনতে পারবে সবাই খোঁজ পেতে সমস্যা হবার কথা নয় ঘটনা হল ইতিমধ্যে কিছু সূত্রও মিলেছে দুই পথিকের কাছে খোঁজ পেয়েছে শয়তান ছোঁড়াটা এই পথেই গেছে সুতরাং কতক্ষণ আর ঘাপটি মেরে থাকবে? কিছু সূত্র যখন পেয়েছে সন্ধের আগেই পাকড়াও করে ফেলতে পারবে তারপর কীভাবে শাস্তি দিতে হবে ভালই জানে চলতে চলতে সেই কথাই ভাবছিল শবর হঠাৎ খুব কাছে কেউ হুঙ্কার দিয়ে উঠল: হে

বৃক্ষহীন রুক্ষ ফাঁকা প্রান্তর সেই কারণে দ্রুত পথ চলছিল শবর চারপাশে সেভাবে নজর রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি সামনে খানিক গেলেই বড় এক গ্রাম বেলা পড়ে আসছ গ্রামের পথে লোকজন পাওয়া যাবে সহজেই কিছু খবর মেলার সম্ভাবনা হয়তো গ্রামের মানুষের হাতে ছোঁড়া এতক্ষণে ধরাও পড়ে গেছে তাড়া ছিল সেই কারণেও আচমকা শব্দটা কানে আসতেই চমকে উঠে মুহূর্তে লাগাম টেনে পাশ ফিরল হাতের তীক্ষ্ণ ভল্ল নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেও সময় মিলল না ততক্ষণে অদূরে উটের কুজের মতো মস্ত পাথরের আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যুক্ত দীর্ঘ এক কাষ্ঠদণ্ড তীব্র বেগে উড়ে এসে তাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলেছে পোড় খাওয়া অত বড় শরীর তবু অশ্বপৃষ্ঠ থেকে শবর ছিটকে পড়েছিল সেই মুহূর্তেই প্রাণবায়ু বের হয়ে যেতেও সময় লাগেনি তবু আততায়ীকে চিনতে ভুল হয়নি তার শেষ মুহূর্তেও অপার বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল শুধু 

আর মানুষটার সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বৃষলের বুকের ভিতরটা কিছু অন্য রকম করে উঠলেও সামলে নিতে সময় লাগেনি। বরং ভিতরে আত্মবিশ্বাসটা আরও তীব্র হয়েছিল পারবে পারবে সে ভিনদেশী নেপির ওই কথার পরেও মনের ভিতর সামান্য যে দুর্বলতা অবশিষ্ট ছিল এতক্ষণে দূর হয়ে গেছে। যদি বাঁচতে হয় বাঁচার মতোই বাঁচবে এরপর

শবরের তীক্ষ্ণ ভল্লটা সেই ভাবেই হাতে ধরা ছিল নিচু হয়ে বৃষল সেটা তুলে নিলো দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে একবার তুলে ধরল আকাশে তারপর শবরের পিঠে বাঁধা তূনীর সহ ধনু্‌ক খুলে নিয়ে এক লাফে উঠে পড়ল অশ্বপৃষ্ঠে অতি পরিচিত অশ্ব চনক হাতে লাগাম ধরে ইঙ্গিত করতেই চলতে শুরু করল

চনক অতি উন্নত মানের অশ্ব দুরন্ত বেগেই চলা সম্ভব কিন্তু এসব অঞ্চল বৃষলের তেমন পরিচিত নয় তাই স্বাভাবিক কারণেই অশ্বের গতি তেমন বৃদ্ধি করেনি পড়ন্ত বিকেলে শবরকে নিশ্চিন্তে অশ্ব চালনা করতে দেখে মনে হয়েছিল সামনে হয়তো লোকালয় আছে এই অবেলায় তার সন্ধানে লোকটা সেই দিকেই যাচ্ছিল সেই অনুমানেই বৃষল কিছু সতর্ক হয়ে অশ্ব চালনা করেছিল ইতিমধ্যে প্রকৃতির রূপ অনেকটাই পালটে গেছে তেমন রুক্ষ নয় আর চারপাশে গাছপালা ঝোপঝাড় ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে কিছু ভাঙাচোরা বসতির চিহ্নও নজরে পড়ছিল ওই সময় দূরে গাছপালার ফাঁকে পাথরের উঁচু এক স্তম্ভের দিকে চোখ পড়তে হঠাৎ পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল গোড়ায় কিছু সন্দেহ ছিল অবশ্য কিন্তু ভাল করে খানিক পর্যবেক্ষণের পর শেষে নিশ্চিন্ত হল বৃষল

বছর কয়েক আগে একদিন শাল্বদেবের সঙ্গে হরিণ শিকারে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এদিকে এসে পড়েছিল ওরা সেদিন শাল্বদেবের কাছেই শুনেছিল স্তম্ভটা একসময় মালবরাজ ভানুগুপ্তই এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তখন অবশ্য এখানে এক বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল অদূরে নদী অনেক অবস্থাপন্ন শ্রেষ্ঠীও বাস করতেন ভানুগুপ্ত তখন অবশ্য স্বাধীন নয় গুপ্ত সম্রাটের অধীন ক্ষত্রপ মাত্র তবু নিজেকে তৃতীয় পাণ্ডব মহাবীর পার্থ তথা অর্জুনের সমকক্ষ দাবী করে ওই স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সামান্য এক ক্ষত্রপের এমন অধিকার নেই কিন্তু স্কন্দগুপ্তের পরে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সেই আগের জৌলুস তখন অস্তাচলে। তায় ভানুগুপ্ত গুপ্তবংশেরই মানুষ সম্রাট কোনও ব্যবস্থাই নেননি

সেই থেকে মালবে ভানুগুপ্তর আচরণ প্রায় স্বাধীন রাজার মতই তাও যদি তিনি পার্থের মতো বাহুবল দেখাতে পারতেন! দেশের মানুষকে সামান্য নিরাপত্তা দিতে পারতেন! বজায় রাখতে পারতেন শান্তি শৃঙ্খলা! অল্প দিনের মধ্যে হূন আক্রমণে বর্ধিষ্ণু নগরটি প্রায় জনশূণ্য হয়ে যায় দস্যুরা নগরে ব্যাপক হত্যালীলা আর লুণ্ঠন করেই ক্ষান্ত হয়নি যাবার আগে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যায় জনাকীর্ণ নগরটি সেই থেকে পরিত্যক্ত জনশূন্য শ্মশান শুধু স্তম্ভটিই যথাস্থানে দাঁড়িয়ে অপদার্থ ভানুগুপ্তের জয়ধ্বনি করে চলেছে

ভাবতে গিয়ে মনটা কিছু খারাপ হয়ে গেলেও অন্য কথা মনে পড়তে বৃষল ফের চাঙা হয়ে উঠল সেদিন শাল্বদেবের কাছেই শুনেছিল এই স্তম্ভের কিছু দক্ষিণেই রয়েছে ছোট এক গ্রাম দ্রুত অশ্ব চালনা করলে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যেতে পারবে দেরি না করে ফের ঘোড়া ছোটাল ও

 সন্ধ্যার অল্প আগেই বৃষল গ্রামের কাছে পৌঁছে গেল এই অবেলায় পথে অবশ্য মানুষ নেই বাড়িঘরও দেখা যাচ্ছ না তবে গ্রাম যে বেশি দূরে নয় দুপাশে জোয়ারি আর বাজরার সবুজ খেত দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেই খেত বরাবর ঘোড় ছুটিয়ে একসময় পৌঁছে গেল গ্রামের প্রান্তে গাছপালার আড়ালে প্রথম বাড়িটায় চোখ পড়তেই বৃষল সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এবার সেই দুপুর থেকে পথ চলা ভয়ানক খিদে পেয়েছে জমানো মুদ্রা কয়টি সঙ্গেই রয়েছে কোনও চটিতে গেলেই আখের গুড় দিয়ে খোলায় ভাজা বাজরার ছাতু আর মোষের দুধের দই চমৎকার ভোজ গ্রামের চটিতে এক মাষা মূল্য ফেললেই মেলে তবু শেষ কবে খেয়েছে মনে করতে পারল না সেসব নিয়ে ভাবার সময় বৃষলের অবশ্য ছিল না তখন বরং অন্য ব্যাপারটাই ভাবাচ্ছিল বেশি চনক সাধারণ অশ্ব নয় গ্রামে ঢুকলে সহজেই নজরে পড়ার সম্ভাবনা তবে কী অশ্ব গ্রামের বাইরে কোথাও রেখে যাবে? তাতে বিপদ আরও বাড়বে না তো?

অশ্ব থামিয়ে বৃষল সেই কথাই ভাবছিল হঠাৎই অদূরে হাতুড়ির ঠংঠং আওয়াজ নির্জন নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় সামান্য ওই শব্দ নিমেষে বৃষলের মনে যেন মুক্তির মন্ত্র বয়ে আনল কাছেই কামারশালা গ্রামের প্রান্তেই এক মুহূর্ত দেরি না করে ও অশ্ব ছুটিয়ে এগিয়ে গেল সেই দিকে

অনুমান অভ্রান্ত গ্রামের প্রান্তে ছোট এক কামারশালা সন্ধ্যার অল্প আলোয় কর্মকার নিবিষ্টমনে কাজ করে চলেছে কুড়ুলের ফলায় ইস্পাত আনার কাজ বোধ হয় আগামী কাল সকালের মধ্যেই জোগান দিতে হবে অদূরে ঘোড়া থামিয়ে বৃষল এগিয়ে গেল সেই দিকে

অশ্বখুরের আওয়াজে কর্মকার আগেই মুখ তুলে তাকিয়েছিল নিছক কৌতূহলেই কিন্তু মুহূর্তেই তার মুখের ভাব পালটে গেল আধো অন্ধকারেও অশ্বারোহী আগন্তুকের গলার লোহার বেড়ি তার নজর এড়াল না

কমর্কারের সেই মুখের দিক তাকিয়ে বৃষল মুহূর্তমাত্র দেরি করল না ছুটে গিয়ে ভল্লর তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ কর্মকারের বুকের উপর রেখে নিজের ঠোঁটের উপর আলতো করে তর্জনী রেখে চাপা গলায় বললউঁহু শব্দ করা চলবে না বাপু চ্যাঁচামেচিও নয় প্রাণে বাঁচতে চাইলে চটপট গলার বেড়িটা কেটে দাও এক পুরাণ পারিশ্রমিক মিলবে

 গ্রামের সামান্য কর্মকার প্রাণপাত খেটেও সারা মাসে এক পুরাণ উপায় হয় না তবু তার মুখে উত্তর যোগাল না ফ্যাল ফ্যাল করে আগের মতোই শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আগন্তুক মানুষটার কী প্রয়োজনে আগমন সেই প্রথম দর্শনেই বুঝতে বাকি নেই তার তাই এখন কাজর কথা শুনেও মুখের ভাবে বিশেষ পরিবর্তন হল না কাজটায় তেমন মেহনত নেই ঠিকই কিন্তু খবরটা কোনও ক্রমে যদি চৌকিতে পৌঁছোয় প্রাণদণ্ড অবধারিত

অযথা নষ্ট করার মতো সময় তখন নেই কর্মকারকে ওই অবস্থায় দেখে বৃষল হাতের ভল্লে সামান্য চাপ দিয়ে কড়া গলায় দাবড়ে উঠলকী হল? কানে ঢুকল কথা? নাকি অন্য কোথাও যেতে হবে?’

বুকে তীক্ষ্ণ ভল্লের খোঁচায় কর্মকার ততক্ষণে বাস্তবে ফিরে এসেছে গ্রামে কামারশালা আরও আছে রাজি না হলে তাদের কারও কাছে যাবার আগে লোকটা যে তার প্রাণটা নিংড়ে নিয়ে যাবে বুঝতে বাকি নেই কম্পিত গলায় বললকিন্তু মালিক এই কম আলোয় কাজটা

কর্মকার তার কথা শেষ না করে থেমে গেল হঠাৎ কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করে কম্পিত গলায় বললমালিক অশ্বপৃষ্ঠে কেউ আসছে এদিকে! বোধ হয়

লোকটা এবারেও তার কথা শেষ করতে পারল না প্রাণভয়ে তার গলা শুকিয়ে প্রায় কাঠ হয়ে গেছে তখন

অশ্বখুরের শব্দ ইতিমধ্যে বৃষল নিজেও শুনতে পেয়েছে একজন নয় সুশিক্ষিত অশ্বপৃষ্ঠে দুই অশ্বারোহী তীব্র গতিতে ছুটে আসছে এদিকে উদ্বেগের বিষয় অবশ্যই তবু এবার আর তেমন বোধ করল না ও দুই অশ্বের একটির আওয়াজ যেন কিছু পরিচিত সম্ভবত এই অশ্বারোহীই খানিক আগে ওকে অনুসরণ করে আসছিল তারপর শবর আসার আগে চলে গিয়েছিল অন্য দিকে ফের আবার আসছে

হাতে সময় কম বৃষল কঠিন গলায় বললসে বাপু আমি বুঝে নিতে পারব আর এটুকু বলতে পারি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই তোমারও তবে হ্যাঁ হাতুড়িটা যেন আবার মাথায় বসিয়ে দেবার মতলব করো না মনে রেখ তাহলে তোমার প্রাণটাও যাবেবলতে বলতে কামারশালার নেহাইয়ের পাশে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল বৃষল হাতে তীক্ষ্ণ ভল্লের অগ্রভাগ তখন একই ভাবে কর্মকারের বুকে ঠেকে রয়েছে

কর্মকার প্রাণের আশা ছেড়েই দিয়েছে তখন তবু কুশলী হাতেই কাজটা সম্পূর্ণ করল ওই সামান্য আলোতেও ছেনিহাতুড়ি দিয়ে অতি সন্তর্পণে অল্প সময়ের মধ্যেই বৃষলের গলার বেড়ি দুই টুকরো করে কেটে ফেলল তারপর হাতের ছেনি হাতুড়ি নামিয়ে বললএবার উঠে পড়ুন মালিক

গলার বেড়ি কাটার কাজ যে সম্পূর্ণ হয়েছে বুঝতে পারছিল বৃষল নিজেও তবু কর্মকারের কথার পরেও নেহাইয়ের পাশে কয়েক মুহূর্ত একইভাবে পড়ে রইল বাইরে দ্রুত গতিতে ছুটে আসা দুই অশ্বের আওয়াজ ততক্ষণে আরও জোরাল তবু এমন নিশ্চিন্ত এত আনন্দ জীবনে কখনও বোধ করেনি ও মনে হচ্ছিল যেন নবজন্ম হল আজ নতুন এক জীবন নেহাইয়ের উপর ফের একবার মাথা ঠেকিয়ে মানুষটা উঠে বসল এরপর কর্মকারের দিকে তাকাল

দারুণ আতঙ্কে মানুষটা প্রায় কাঠ হয়ে রয়েছে তখন পিঠে হাত রেখে বৃষল ফের আশ্বস্ত করল তাকে কোমরে গোঁজা ক্ষুদ্র পেটিকা থেকে নেপির দেওয়া সেই পুরাণটা বের করে এগিয়ে দিলনাও তোমার পারিশ্রমিক

সভয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে কর্মকার বললপারিশ্রমিক চাই না মালিক আমার প্রাণটা রক্ষা পেলেই যথেষ্ট কথা রাখুন

কর্মকার মিথ্যে ভয় পাচ্ছ তুমিপ্রায় জোর করেই বৃষল তার হাতে পুরাণটা গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়াল এবার হাতের ভল্ল উঁচিয়ে ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বললভয় পেও না বাপু মনে রেখ ওই ভয়ই আজ আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু আমি বৃষল বৃষলদেব কথা যখন দিয়েছি শুধু আজ নয় যদি ভবিষ্যতেও কখনও প্রয়োজন পড়ে আর যদি খোঁজ পাও আমার নিঃসঙ্কোচে চলে এস

বৃষলের সেই মুখের দিকে তাকিয়ে কর্মকার কিছুটা যেন ভরসা পাচ্ছিল সেই কথাই বলতে যাবে প্রায় ঝড়ের গতিতে দুই অশ্বারোহী কামারশালার সামনে এসে দাঁড়াল ভল্ল হাতে বৃষল প্রস্তুত হয়েই ছিল কিন্তু কিছুই করতে হল না দুই অশ্বারোহীর একজন নেপি অন্যজনকে চিনতে পারল না খড়্গীচর্মের দৃঢ় বক্ষত্রাণ পরিহিত বিশাল চেহারার এক পুরুষ কোমরবন্ধে দীর্ঘ অসি পিঠে ধনু আর তূণীর মাথায় উষ্ণীষ

বৃষল তাকিয়ে ছিল মানুষটির দিকে নেপি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ওই সময় তার আগেই অন্যজন অশ্ব থেকে লাফিয়ে নামলেন এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন ওকেবৃষল তোমার লক্ষ্যভেদের কথা আজ শুনেছি আমি শুধু তাই নয় তোমার হাতের শক্তির নমুনাও আজ নিজের চোখেই দেখে এলাম যেভাবে ছুঁচোল কাঠের তৈরি সামান্য ভল্ল দিয়ে বৃষচর্মের বক্ষত্রাণ ভেদ করে শত্রুকে বিদ্ধ করেছ তা এক কথায় অসাধারণ অসাধারণ তোমার ক্ষমতা

শবরকে নিহত করার কথাই যে মানুষটি বলছেন বুঝতে পারছিল বৃষল খুশি হবার বদলে সে তখন অবাক চোখে তাকিয়ে সামনে মানুষটির দিকে। খানিক পরে শুধু বলতে পারলঅজ্জ আপনি ধর্মদেব! আমার যে অনেক দিনের স্বপ্ন

বৃষলদেব আমারও স্বপ্ন তোমার মতো শত শত কুশলী নির্ভীক যোদ্ধায় আমার সেনা বাহিনী ভরে উঠুক একমাত্র তা হলেই আমি আমার স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারব

কথা শেষ করে অশ্বপৃষ্ঠে ফের লাফিয়ে উঠলেন তিনি মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা না করে বৃষলও লাফিয়ে উঠল চণকের পিঠে ঘোড়া ছুটিয়ে ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেল তিন যোদ্ধা পিছনে কর্মকার তখনও বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে*

_________

*ধর্মদেব পরবর্তীকালে যশোধর্মদেব নামে খ্যাত হয়েছিলেন গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্তর পরে এদেশে যাঁরা হূন দস্যু দমনে সফল হয়েছিলেন তিনি তাঁদের মধ্যে প্রধান। 

2 comments:

  1. Historical story amer sob somoy valo lage ,khoob valo laglo

    ReplyDelete
  2. Asadharan khub e valo laglo

    ReplyDelete