শিশির বিশ্বাস
ভ্যাম্পায়ারের গল্প। তবে সেই গল্প
শুরুর আগে প্রাসঙ্গিক কিছু অন্য কথা। ভ্যাম্পায়ার কাহিনি সারা পৃথিবীতেই আজ সাহিত্যের
এক অতি জনপ্রিয় শাখা। সিনেমাতেও অতি পছন্দের বিষয়। সিনেমায় ভ্যাম্পায়ার কাহিনি মানেই
হট কেক। অগত্যা পিছিয়ে নেই টিভিও। হয়েছে একাধিক সিরিয়াল। এছাড়া ভ্যাম্পায়ার কাহিনির
জনপ্রিয়তা হাতিয়ার করে বাজারে চলে এসেছে ভ্যাম্পায়ার ব্যান্ড স্টাইল‚ ইন্টারনেট ফোরাম, হরেক খেলনা আর পত্র–পত্রিকা। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও ভ্যাম্পায়ার কাহিনি যে অতি
জনপ্রিয়‚ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অথচ এই সেদিনও ভ্যাম্পায়ার কাহিনি
মূলত ছিল পূর্ব ইউরোপের স্লাভ অঞ্চল অর্থাৎ আজকের রাশিয়া‚ বুলগেরিয়া‚ স্লোভাকিয়া‚ সার্বিয়া প্রভৃতি দেশে গ্রামাঞ্চলের
লোককথার বিষয়বস্তু। শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায় বিষয়টি নিয়ে ছিলেন একেবারেই উন্নাসিক।
মৃত্যুর পরে আত্মা‚ প্রেত তথা ভৌতিক কাহিনি অনেকের কাছে
অলীক কল্পনা হলেও মানুষের কাছে ভূত তথা ভৌতিক কল্পকথার মান্যতা সেই গুহা যুগ থেকে।
হ্যাঁ‚ গুহা যুগেও মানুষ ভৌতিক আত্মায় যে বিশ্বাসী ছিল‚ এমন প্রমাণ যথেষ্টই পাওয়া গেছে। আন্দামানে
ওঙ্গি জাতির মানুষ‚ যারা একসময় প্রায় বন্য জীবন যাপন করত‚ তারাও মৃত্যুর পরে ভূত-প্রেতে বিশ্বাসী
ছিল। গোষ্ঠীর কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির প্রেতাত্মার সংস্পর্শ এড়াতে তারা সেই অঞ্চল
ছেড়ে দূরে অন্য কোথাও ডেরা বাঁধত। তবু ভ্যাম্পায়ার একেবারেই যেন উদ্ভট কল্পনা। গ্রাম্য
অশিক্ষিত মানুষের ভ্রান্ত ধারণার বস্তু।
নয়তো কী! ভূত বা প্রেত দেহধারী নয়‚ দেহহীন। সেখানে ভ্যাম্পায়ার দেহধারী।
মৃত্যুর পর তাদের দেহ নষ্ট হয় না। কবরের ভিতর অটুট থাকে। জেগে ওঠে রাতে। তারপর কবর
থেকে উঠে শিকারের সন্ধানে বের হয়ে পড়ে। একাকী মানুষের দেখা পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার
উপর। ঘাড়ের উপর দাঁত বসিয়ে শিকারের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত চুষে খায়। তারপর ফের ঢুকে
পড়ে কফিনের ভিতর।
ভ্যাম্পায়ার নিয়ে কল্পকথা এরপরেও শেষ
হয় না। ভ্যাম্পায়ারের শিকার হয়ে যে মানুষটির মৃত্যু হল‚ অল্প দিনের মধ্যে কফিনের ভিতর সেও
ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়। তারপর একদিন কফিন থেকে বের হয়ে পড়ে শিকারের সন্ধানে। জন্ম হয়
আর একটি নতুন ভ্যাম্পায়ারের। গ্রামাঞ্চলের স্বল্প শিক্ষিত মানুষের এসব অলীক কল্পনা
অন্যদের কাছে তাই ছিল হাসিঠাট্টার বস্তু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা তেমন আর রইল
না। ভ্যাম্পায়ার কাহিনি হঠাৎই জাতে উঠে পড়ল। সেই ঘটনার কথাই বলি এবার।
অবস্থাটা বদলাল উনবিংশ শতকের গোড়ার
দিকে। হঠাৎই এক ঘটনায় জোয়ার এলো ভ্যাম্পায়ার সাহিত্যে। ইংরেজি সাহিত্যের বিশ্বখ্যাত
কবি লর্ড বায়রন এক রাতে মজলিস বসিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের এক বাগানবাড়িতে।
বয়স মাত্র আটাশ বছর হলেও তখনই খ্যাতনামা কবি। বিখ্যাত ব্যক্তি। লর্ড পরিবারের সন্তান‚ অভাব নেই পয়সা–কড়িরও। সুইজারল্যান্ডের
লেক জেনিভায় চমৎকার এক ভিলা ভাড়া নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তখন। আমন্ত্রণ পেয়ে দেখা করতে
এলেন সস্ত্রীক কয়েকজন বন্ধু আর কাছের মানুষ।
সেই রাতে জমে উঠেছে আসর। আসরে হাজির
সস্ত্রীক ইংরেজি সাহিত্যের আর এক দিকপাল কবি পার্সি বিশি শেলি। শেলি অবশ্য তখন বায়রনের
মত অত বিখ্যাত হতে পারেননি। বয়স মাত্রই চব্বিশ। স্ত্রী মেরি শেলির বয়স আঠারো। এ ছাড়া
সৎ বোন ক্লায়ার ক্ল্যারমন্ট (Claire
Clairmont) আর বায়রনের অতি কাছের এক বন্ধু‚ চিকিৎসক জন উইলিয়াম পলিডরি (John
William Polidori)। তাঁর বয়সও মাত্রই একুশ।
বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়–বৃষ্টি। বায়রন
হঠাৎ প্রস্তাব করলেন‚ এই রাতে কবিতা নয়‚ হরর গল্পই ভাল জমবে। খুঁজে বের করা
হল জার্মান হরর গল্পের একটি কালেকশন। বায়রন বললেন উপস্থিত সবাই একটি করে গল্প পড়বে।
বাকিরা শ্রোতা। পর পর পড়া হয়ে গেল গোটা কয়েক গল্প। এবার বায়রনের পালা। কিন্তু ততক্ষণে
একের পর এক হরর গল্প শুনে রোমান্টিক কবি বায়রনের মতলব বদলে গেছে। তিনি বললেন‚ ‘আর বই থেকে নয়। এবার মন থেকে ভেবে
নতুন গল্প।’
‘কী‚ কী গল্প?’ এক সাথে সবাই হইহই করে
উঠলেন।
‘হরর গল্পই।’ বায়রন বললেন‚ ‘তবে চলবে কিছু অন্য রকম ভাবে। শুরুটা
করব আমি। বাকিটা অন্যরা যে যার মতো করে শেষ করবে। প্রতিটি গল্প একদম নতুন হওয়া চাই।’
সবাই সম্মতি জানাতে বায়রন তাঁর গল্প
শুরু করলেন। সংক্ষেপে এই রকম: দুই ইংরেজ বন্ধু গ্রিসে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পথিমধ্যে হঠাৎই
একজন মারা গেলেন। রীতিমতো রহস্যজনক মৃত্যু। অন্যজন এরপর লণ্ডনে ফিরে এলেন। এরপর একদিন
তিনি সমাহিত করা বন্ধুর কবর দেখতে গিয়ে হঠাৎই আবিষ্কার করলেন‚ মৃতদেহটি আসলে ভ্যাম্পায়ার।
সেই রাতের আসরে বায়রন তাঁর গল্পে ভ্যাম্পায়ার
আমদানি করেছিলেন একেবারে শেষ পর্বে এসে। ব্যাপারটা বন্ধু জন উইলিয়াম পলিডরিকে ভীষণ
রকম প্রভাবিত করেছিল। সে কথায় পরে আসছি। তার আগে বলি‚ গল্পে গল্পে রাত ভোর হয়ে গিয়েছিল
সেদিন। আসরের শেষে ঠিক হল‚ বাড়ি ফিরে যে যার গল্প লিখে ফেলবেন।
অগত্যা লণ্ডনে ফিরে শেলি লিখে ফেললেন
তাঁর গল্প ‘ফ্রাগমেন্ট অফ এ ঘোস্ট স্টোরি’। পরে আরো কয়েকটি। গল্পগুলি প্রকাশিত হয়েছিল
তাঁর মৃত্যুর পরে। স্ত্রী মেরিও লণ্ডনে ফিরে লিখে ফেললেন তাঁর গল্প। তবে অনেক গুছিয়ে।
সময়ও নিলেন। শোনা যায়‚ বয়সে একেবারেই ছেলেমানুষ মেরির লেখার পিছনে স্বয়ং শেলিরও উৎসাহ
ছিল যথেষ্ট। নানা পরামর্শ দিয়ে স্ত্রীকে সাহায্যও করেছিলেন। ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নামে
মেরির এই কাহিনি পরে যখন প্রকাশিত হয়‚ সাড়া পড়ে গিয়েছিল পাঠক মহলে। হরর
গল্প‚ কিন্তু
সম্পূর্ণ অন্য মেজাজের। সেরা মানের এক কল্পবিজ্ঞান কাহিনি বলা যায় বরং। বইটি জনপ্রিয়তায়
আজো প্রথম সারিতে।
এ তো গেল শেলি দম্পতির কথা। কথা রাখতে
উদ্যোক্তা বায়রনও লিখে ফেলেছিলেন তাঁর গল্প ‘এ ফ্রাগমেন্ট’। তবে ঘটনা হল‚ সেই বর্ষণের রাতে নিছক হুজুগের বসে
যে প্রসঙ্গ তিনি উত্থাপন করেছিলেন‚ পরে তা একেবারেই মনপূত হয়নি। বন্ধুদের
একবার পড়ে শুনিয়ে গুঁজে দিয়েছিলেন বাজে কাগজের গাদায়।
সবশেষে বায়রনের ডাক্তার বন্ধু জন উইলিয়াম
পলিডরি। আগেই বলেছি‚ সেই রাতে ভ্যাম্পায়ারের বিষয়টি তাঁকে ভীষণভাবেই আকৃষ্ট করেছিল।
প্রচলিত ভ্যাম্পায়ারের কিছু লোককথা তিনিও শুনেছেন। সেভাবে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ
করেননি। কিন্তু বায়রনের মতো ব্যক্তির মুখে ভ্যাম্পায়ারের গল্প শুনে কিছু যে প্রভাবিত
হয়েছিলেন‚ তা বলাই বাহুল্য। সেদিন রাতের আসরে তিনিও একটি গল্প শুনিয়েছিলেন।
ফিরে এসে সেই গল্পের সঙ্গে বায়রনের
লেখা কাহিনি মিশেল দিয়ে লিখে ফেললেন ‘দি ভ্যাম্পায়ার’ নামে এক গল্প। ইচ্ছে হল পত্রিকায়
ছাপার জন্য পাঠাবেন। ব্যাপারটা মনে হতেই অবশ্য কুঁকড়ে গেলেন তারপর। একে বিষয়বস্তু এদেশের
বটতলা গোছের সাহিত্য‚ ভ্যাম্পায়ার। তার উপর আগে কখনো লেখালেখি করেননি। লেখক হিসেবে
পরিচিতিও নেই। কে তাঁর গল্প ছাপাবে! অগত্যা সেই গল্প তিনি খোদ বায়রনের নামে এক পত্রিকার
দপ্তরে পাঠিয়ে দিলেন। বায়রনের অনুমতি ছাড়াই। বিখ্যাত ‘নিউ মান্থলি ম্যাগাজিন’–এর এপ্রিল
১৮১৯ সংখ্যায় গল্পটি ছাপাও হয়ে গেল।
এক লহমায় সাড়া পড়ে গেল পাঠক মহলে।
খ্যাতনামা রোমান্টিক কবি খোদ লর্ড বায়রন ভ্যাম্পায়ার নিয়ে গল্প লিখেছেন‚ চোখ না দিয়ে উপায় কী! খবরটি বায়রনের
কানে আসতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধই হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে পাঠক মহলে ভ্যাম্পায়ার নিয়ে
যে ক্রেজ শুরু হয়ে গেছে‚ তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই মাতামাতির আজো বিরাম নেই।
বরং খোদ ইউরোপ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বাড়ছে আরো।
বায়রন অবশ্য ‘দি ভ্যাম্পায়ার’ গল্পটি
যে তাঁর লেখা নয়‚ বন্ধু উইলিয়াম পলিডরির‚ সেটা পরিষ্কার করার জন্য বাজে কাগজের
গাদা থেকে খুঁজে বের করে নিজের লেখা ‘এ ফ্রাগমেন্ট’ গল্পটি দিন কয়েকের মধ্যেই পাঠিয়ে
দিয়েছিলেন পত্রিকার অফিসে। ছাপা হল সেই বছরেই। আগের গল্পটি যে প্রকৃত পক্ষে জন উইলিয়াম
পলিডরি লেখা জানতে পেরেছিলেন পাঠকবৃন্দ। সেই হিসেবে আধুনিক ভ্যাম্পায়ার সাহিত্যে প্রথম
স্বীকৃত লেখক জন উইলিয়াম পলিডরিই।
হঠাৎ হাজির ভ্যাম্পায়ার সাহিত্যে এরপর
জোয়ার আসতে সময় লাগেনি। কলম ধরতে শুরু করলেন একের পর এক লেখক। পাঠকও হামলে পড়তে লাগল।
আসলে সারা পৃথিবীতেই ভৌতিক কাহিনির জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। সুতরাং কিছু নতুন রকমের ভৌতিক
কাহিনি ভ্যাম্পায়ার যে পাঠকের মন কেড়ে নেবে‚ তাতে আশ্চর্য কী। ১৮২৮ সালে ভ্যাম্পায়ার
সাহিত্যে সাড়া জাগিয়ে অবতীর্ণ হলেন প্রথম মহিলা লেখিকা এলিজাবেথ ক্যারোলিন গ্রে। ১৮৪৭–এ
জেমস ম্যালকম রাইমার নিয়ে এলেন তাঁর সাড়া জাগানো ভ্যাম্পায়ার কাহিনি ‘ভার্নে দ্য ভ্যাম্পায়ার’।
চলছিল এইভাবেই। নতুন নতুন লেখক আর
তাঁদের নতুন নতুন বই। তবে মাস্টার স্ট্রোকটা এলো ১৮৯৭ সালে। ভ্যাম্পায়ার সাহিত্যে প্রায়
ঝড় তুলে হাজির হলেন ব্রাম স্টোকার। তাঁর কাউন্ট ড্রাকুলা পাঠক মহলে হইহই ফেলে দিল।
ভ্যাম্পায়ার সাহিত্যে এক লহমায় যুক্ত হল এক নতুন মাত্রা। এ পর্যন্ত যাঁরা ভ্যাম্পায়ারের
গল্প লিখেছেন‚ তেমন হোম ওয়ার্ক তাঁদের ছিল না। ব্রাম স্টোকার প্রথম ব্যতিক্রম।
ভ্যাম্পায়ার নিয়ে কলম ধরার আগে তিনি তাঁর পূর্বসূরিদের বিভিন্ন ভাল ভাল লেখাই শুধু
নয়‚ দিনের পর
দিন পূর্ব ইউরোপ তথা স্লাভ অঞ্চলের ইতিহাস‚ পরিবেশ ভৌগলিক খুঁটিনাটি আর প্রচলিত
বিভিন্ন লোককথা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ফলে কাউন্ট ড্রাকুলার বিশ্বাসযোগ্য পটভূমি সহজেই
বেছে নিতে পেরেছিলেন।
পূর্ব ইউরোপের অনেকটা অংশই সেই সময়
তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও স্থানীয় শাসনভার ছিল বড় মাপের জমিদার তথা কাউন্টদের
হাতে। কর আদায়ের জন্য তারা সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য নির্যাতন করতেন। বর্তমান রুমানিয়ার
কার্পেথিয়ান পর্বতমালার কোলে ট্রানসেলভেনিয়ার দক্ষিণে ওয়ালাশিয়া রাজ্যের শাসন ছিল এমনই
এক কাউন্ট ‘ভ্লাদ’ পরিবারের হাতে। সাধারণ মানুষের উপর তাঁদের নির্যাতন প্রায় মাত্রা
ছাড়া হয়ে গিয়েছিল। এই বংশের চতুর্থ পুরুষ ‘ভ্লাদ’ এ ব্যাপারে ছিলেন সবার উপরে। গরিব
প্রজাদের উপর নিপীড়নে জুড়ি ছিল না তাঁর। তাই লোকমুখে তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ভ্লাদ
ড্রাকুলা’ অর্থাৎ রক্তপিপাসু ভ্লাদ। ব্রাম স্টোকার তাঁর ভ্যাম্পায়ার চরিত্রের জন্য
বেছে নিলেই এই মানুষটিকেই। ভ্লাদের শাসনক্ষেত্র ছিল ওয়ালসিয়া অঞ্চল। কিন্তু ওয়ালসিয়া
নয়‚ ব্রাম স্টোকারের
পছন্দ হল পাশেই ট্রানসেলভেনিয়া। মাইলের পর মাইল ঢেউ খেলানো পাহাড় জঙ্গল আর বিস্তৃত
জনমানবহীন উপত্যকা। মানুষ বলতে বেশির ভাগই নিরক্ষর চাষাভুষো শ্রেণীর। এ ছাড়া জিপসি
যাযাবরের দল। প্রসঙ্গত বলা যায়‚ ইউরোপ হলেও রুমানিয়ার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খুব বেশি
পরিবর্তন আজও হয়নি। পড়ে আছে সেই মধ্য যুগের অন্ধকারে।
বলা বাহুল্য ব্রাম স্টোকার তাঁর গল্পের
জন্য যে কাউন্ট ড্রাকুলার চরিত্র‚ যে পরিবেশ বেছে নিয়েছিলেন‚ তা ভ্যাম্পায়ার কাহিনির জন্য এক কথায়
আদর্শ। ব্যাপারটা যে মাস্টার স্ট্রোক ছিল‚ সে তো আগেই বলেছি। শুধু বইয়ের পাতায়
নয়‚ বিংশ শতকের
গোড়ায় এই ড্রাকুলার হাত ধরেই সিনেমায় এসে পড়ল ভ্যাম্পায়ারের গল্প।
ভ্যাম্পায়ারের গল্প লিখতে বসে এতক্ষণ
শিবের গীত হল বোধ হয়। তাই কালক্ষেপ না করে গল্পই শুরু করা যাক বরং। এ–গল্পের পটভূমিও
ওই ট্রানসেলভেনিয়ার প্রান্তর। আর ট্রানসেলভেনিয়া প্রান্তরের গল্প যখন‚ পড়তে বসে পাঠক পুরনো ভ্যাম্পায়ার
গল্পের ছায়া খুঁজে পাবেন হয়তো। খুঁজে পাবেন এ–দেশের রূপকথার কিছু আদল। সঙ্গে নতুন কিছুও।
যাই হোক এবার সেই গল্প।
ট্রানসেলভেনিয়া প্রান্তরে সে এক পড়ন্ত
বিকেল। কাছেপিঠে জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। নির্জন কাঁচা পথ ধরে আনমনে হেঁটে চলেছে
এক দীর্ঘ চেহারার মানুষ। হালকা-পাতলা চেহারা হলেও মুখে আভিজাত্যের ছাপ। অভিজাত পরিবারের
কেউ বলেই মনে হয়। বেলা শেষে উত্তর–পশ্চিম থেকে জোরাল হিমেল বাতাস বইতে শুরু করেছে।
মানুষটির তাতে হুঁশ নেই অবশ্য। পাথুরে পথে ভারি জুতোর খট–খট শব্দে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছেন।
পায়ে চলা সরু পথটা শেষ হয়েছে কাছেই
এক প্রাচীন কবরখানায় গিয়ে। আসলে সরু পথটা সেই কবরখানার দিকে যাবার জন্যই তৈরি। মানুষটি
এদিকে নবাগত। তাই গোড়ায় খেয়াল করেননি। অনেকটা চলে আসার পর যখন টের পেলেন‚ দাঁড়িয়ে পিছন ফিরতে যাবেন‚ দূর থেকে থেকে কে ডেকে উঠল‚ ‘সার‚ একটু দাঁড়ান‚ একটু দাঁড়িয়ে যান সার।’
আগন্তুক ঘাড় তুলে দেখলেন কবরস্থানের
অদূরে ছোট এক খুপরি গোছের আধভাঙা ঘর। বিবর্ণ পাথরের দেয়ালের কতক অংশ ধ্বসে পড়েছে। উপরে
পাথরের চালেরও সেই অবস্থা। লোকটা সেই ঘরের দিকে থেকেই ছুটে আসছে। অগত্যা দাঁড়িয়ে পড়লেন
তিনি।
অল্প সময়ের মধ্যে লোকটা কাছে এসে প্রায়
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল‚ ‘কিছু মনে করবেন না সার। আমি এই কবরখানা দেখভাল করি। অনেকক্ষণ
ধরেই দেখছি আপনাকে। মনে হয় এদিকে নতুন। এই অবেলায় পথ হারিয়ে ফেলেননি তো?’
‘না‚’ আগন্তুক অল্প ঘাড় নাড়লেন‚ ‘তেমন কিছু নয়। ঘোড়ায় করেই যাচ্ছিলাম।
অনেকক্ষণ ছুটে বেচারা কিছু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই বিশ্রাম দিয়ে সামান্য পায়চারি।’
‘তাহলে একটা কথা বলি সার।’ লোকটার
চোখ দুটো হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘আমি ড্রাগুটিন পালমেন। এই কবরস্থান দেখাশোনা করি।
তা দেশের যা অবস্থা‚ মাইনে কবে যে মিলবে‚ কিছু ঠিক নেই। ওই কবর দিতে এলে গর্ত
খোঁড়া বাবদ কিছু রোজগার। তা সেও কালেভদ্রে। এই বিজন দেশে মানুষই বা কোথায়? তাই আপনাদের
মতো নতুন কাউকে দেখলে ছুটে আসি।’
ড্রাগুটিন পালমেন থামল। আগন্তুক কোনো
কথা না বলে সামান্য মাথা নড়ল শুধু। তাই দেখে ড্রাগুটিন কিছু ভরসা পেল যেন। হাত কচলে
বলল‚ ‘সার‚ এই কবরস্থান বহু দিনের পুরনো। অনেক
ইতিহাস। রোমাঞ্চকর ঘটনার সাক্ষী। নতুন মানুষ যারা সেসব গল্প জানেন না‚ তাঁদের কেউ শুনতে চাইলেও কিছু উপায়
হয়। তাই নতুন কাউকে দেখলেই ছুটে আসি।’
কথা শেষ করে ড্রাগুটিন পালমেন হাত
কচলাল আবার। আগ্রহে তাকিয়ে রইল আগন্তুকের মুখের দিকে। মানুষটির মুখ ভরতি খোঁচা দাড়ি‚ শীর্ণ শরীর‚ ছেঁড়া জীর্ণ পোশাকের দিকে তাকিয়ে
আগন্তুক মানুষটির বুঝতে বাকি রইল না‚ অনেক আশা নিয়ে লোকটা ছুটে এসেছে।
এদিকে হাতে সময় কিছু রয়েছে। অল্প মাথা নেড়ে বলল‚ ‘তা শোনাও হে বাপু। শোনাও একটা গল্প।
সময়টা কাটবে তবু বেচারা ঘোড়াটাও কিছু বিশ্রাম পাবে।’
‘তাহলে চলুন সার‚ কাউন্ট রাডোভানের সমাধির কাছে নিয়ে
যাই আপনাকে। এক সময় এই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন ওরা। ডাকসাইটে কাউন্ট। তাঁদের নামে বাঘে
গরুতে এক ঘাটে জল খেত‚ এতটাই দাপট। এই বংশেরই শেষ পুরুষ কাউন্ট রাডোভান কিন্তু ছিলেন
একেবারেই ব্যতিক্রম। অমন বড় মনের মানুষ বংশে আগে জন্মায়নি। প্রজাদের সুখ–দুঃখের খবর
রাখতেন। জমিতে ফসল ভাল না হলে সেই বছর খাজনা মকুব করে দিতেন। প্রজারাও বেজায় ভালবাসত
তাঁকে।’
বলতে বলতে ড্রাগুটিন পালমেন সমাধিক্ষেত্রের
মাঝে এক ভাঙাচোরা সমাধির কাছে এসে থামল। আগন্তুক দেখলেন‚ পুরনো সমাধির পাথর কিছুই প্রায় যথাস্থানে
নেই। ভেঙে ছড়িয়ে রয়েছে। করুন অবস্থা। সেদিকে অল্প তাকিয়ে আগন্তুক বললেন‚ ‘এই তাহলে কাউন্ট রাডোভানের সমাধি?’
‘একদম সার।’ মথা নাড়ল ড্রাগুটিন পালমেন।
‘ভেঙে পড়েছে কবেই‚ আর মেরামত হয়নি। দুনিয়ায় ভাল মানুষদের এই দশাই হয়। তা শুনুন
সার। বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী কাউন্ট রাডোভান তখন প্রজাদের নিয়েই ব্যস্ত। নয়তো শিকার
আর ছবি আঁকা। বিয়ে করার কথা ভেবে উঠতে পারেননি। এমন সময় একদিন তিনি জনা কয়েক বন্ধু
নিয়ে শিকারে বের হয়েছিলেন। রোদ ঝলমল দিন। কিন্তু কপালের ফের‚ বেলা পড়তেই আকাশে হঠাৎ মেঘ ঘনিয়ে
এলো। দেখতে দেখতে শুরু হল প্রবল ঝড়বৃষ্টি। দিনের বেলায় নেমে এলো অন্ধকার। সেই দুর্যোগের
ভিতর কে যে কোথায় ছিটকে পড়ল হদিস করা গেল না। সন্ধের আগেই ঝড়বৃষ্টি কিছু কমতে আকাশে
মেঘ কেটে সামান্য হলেও আলো ফুটল। সন্ধে প্রায় নেমে এসেছে তখন। কিন্তু অনেক খুঁজেও কাউন্ট
তাঁর সঙ্গীদের খোঁজ পেলেন না। অগত্যা একাই ফেরার পথ ধরলেন। চলতে চলতে এসে পড়লেন এই
সমাধিক্ষেত্রের কাছে। তারপর হঠাৎই দেখেন অল্প এক বয়সী মহিলা নতমুখে পথের পাশে বসে আছেন।
‘এই বিজন প্রান্তরের মাঝে মহিলাকে
দেখে গোড়ায় অবাক হলেও পরে তাঁর মনে হল‚ মহিলা নিশ্চয় ঝড়জলে পড়ে তাঁরই মতো
অবস্থা হয়েছে। সঙ্গীদের হারিয়ে ভয়ানক বিপদে পড়েছেন। তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন মহিলার
কাছে। প্রশ্ন করতেই মহিলা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। খানিক পরে কিছু শান্ত হতে বললেন‚ আমাকে‚ আমাকে বাঁচান সার। ভয়ানক বিপদে পড়েছি।
‘কে আপনি? এখানে কীভাবে এলেন? কাউন্ট
বললেন।
‘সার আমি এলিনা। যাচ্ছিলাম আত্মীয়র
বাড়িতে। পথে ভয়ানক ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পড়ে দলের সবাই বিচ্ছিন্ন। অন্ধকারে আমার গাড়ির কোচোয়ান
পথ বুঝতে পারেনি। হঠাৎ উলটে পড়েছে পাশের খানায়। প্রবল ঝাঁকুনিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
তারপর জ্ঞান ফিরতে দেখি পথের পাশে গভীর খানায় পড়ে আছে গাড়ি। কোচোয়ান বা ঘোড়ার চিহ্ন
নেই। প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে নিশ্চয়। ঈশ্বরের করুণায় প্রায় কিছুই হয়নি আমার। খানা থেকে
কোনোমতে উঠে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আর পারছি না। ক্লান্ত শরীর বইছে না আর। এদিকে
সন্ধেও হয়ে আসছে। পথও চিনি না। কোথায় যাব‚ কিছুই বুঝতে পারছি না।
‘বলতে বলতে রুদ্ধ হয়ে এলো মহিলার কণ্ঠস্বর।
চোখ দিয়ে সমানে জল পড়তে লাগল।
‘মহিলার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে কাউন্ট
রাডোভানের বুকের ভিতরে ততক্ষণে এক অন্য শিহরণের ছোঁয়া লেগেছে। বয়স হয়েছে তাঁর। কিন্তু
বিয়ে করার কথা একবারও মনে আসেনি। অনেকেরই সেজন্য অনুযোগ। কিন্তু তেমন গা করেননি। হঠাৎ মনে হল‚ মহিলা যদি রাজি থাকেন‚ একেই বিয়ে করবেন তিনি। কিন্তু প্রথমেই
সে কথা না ভেঙে বললেন‚ আমি কাউন্ট রাডোভান। এই অঞ্চলের ভূস্বামী। শিকারে বের হয়ে
হঠাৎ দুর্যোগের কারণে আপনার মতোই অবস্থা। ঘরের দিকে ফিরছি এখন। আপত্তি না থাকলে আমার
সঙ্গে আসতে পারেন। আমার প্রাসাদ–বাড়ি খুব দূরেও নয়।
এলিনাকে নিয়ে নিজের প্রাসাদ–দুর্গে
ফিরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই কাউন্ট রাডোভান বিয়ের কথা পাড়লেন। এলিনা রাজিও হয়ে গেল।
সেই সংবাদ প্রচার হতে চারদিকে শুরু হল আনন্দের ধূম। এতদিন পরে কাউন্ট বিয়ে করতে চলেছেন‚ এ কী কম আনন্দের কথা! বিয়ের দিনও
ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরেই এক ভয়ানক ঘটনায় সব ওলটপালট হয়ে গেল। কাউন্ট রাডোভানের
জমিদারি স্টেটে হঠাৎই মড়ক লাগল যেন। একের পর এক মৃত্যু। আগের রাতেও যে মানুষটা সুস্থ
ছিল সকালে তার নিথর দেহ মরে পড়ে আছে। শুধু তাই নয়‚ এক রাতেই শুকিয়ে প্রায় কাঠ।
প্রজা অন্তপ্রাণ কাউন্ট রাডোভান চেষ্টা
করলেন অনেক। কিন্তু রহস্যের কোনো কিনারাই করতে পারলেন না। এদিকে প্রাণের ভয়ে সবাই ঘরবাড়ি
ফেলে পালাতে শুরু করেছে। জমিদার যত ভালই হোক‚ এমন জায়গায় কে আর থাকতে চায়! একদিন
কাউন্ট রাডোভান একা ঘরে বসে ভাবছিলেন। হেস্তনেস্ত কিছু একটা না করে উপায় নেই। তাঁর
নিজের প্রাসাদ বাড়ির কয়েকজন চাকর–বাকরও কাজ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এদিকে দিন কয়েক সমানে
ছুটোছুটির কারণে শরীরটাও তেমন ভাল যাচ্ছে না। গভীরভাবে চিন্তা করতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর
গত রাতের কথা মনে পড়ল। রাতে প্রাসাদের দু’তলার বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছেন
এলিনার সঙ্গে। হঠাৎ এই ঘটনায় বেচারি খুব ঘাবড়ে গেছে। অনেকটা সময় ধরে বুঝিয়েছেন তাকে।
সাহস দিয়েছেন। ভাবতে গিয়ে হঠাৎই তাঁর খেয়াল হল‚ এত বড় ঘটনায় ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক‚ কিন্তু এলিনাকে দেখে তেমন তো মনে
হয়নি! বরং যে অবস্থায় তাকে নিয়ে এসেছিলেন‚ তার থেকে অনেক স্বাস্থ্যবতী। রূপ
ফেটে পড়ছে আরো! দুই গালে লাল আভা স্পষ্ট!
মুহূর্তে ঘণ্টা বাজিয়ে প্রধান পরিচারককে
ডাকলেন তিনি।
‘পরিচারক হাজির হতেই বললেন‚ লেডি এলিনাকে ডাকো একবার।
‘আজ্ঞে তিনি তো ঘরে নেই হুজুর। ঢোঁক
গিয়ে পরিচারকের উত্তর।
‘কোথায়?
‘আজ্ঞে তিনি ভোর হতেই ঘোড়া নিয়ে বের
হয়ে গিয়েছেন।
‘বের হয়ে গিয়েছেন?
‘হ্যাঁ হুজুর। রোজ সকালেই এমন বের
হয়ে যান উনি। ফেরেন সেই সন্ধের পর। ঘরের কোনো খাবারও কোনো দিন খাননি। সে কথা বললেই
উলটে আমাদের ধমক দেন। বলেন তা নিয়ে কারো মাথা ঘামাতে হবে না। কাউন্ট সব জানেন।
‘কোথায় যান তিনি? বলতে বলতে শক্ত হয়ে
উঠল কাউন্টের চোয়াল।
‘সে তো জানি না হুজুর‚ মাথা চুলকে পরিচারক বলল‚ তবে সবাই দেখেছে পশ্চিম দিকের সরু
পথ ধরেই তিনি ঘোড়া ছোটান।
‘উত্তর শুনে কাউন্ট গুম হয়ে ভাবছিলেন।
পরিচারক হাত কচলে বলল‚ অপরাধ নেবেন না হুজুর‚ প্রাসাদের অনেকেই বলে…
‘বলতে গিয়েও থমকে গেল পরিচারক। কাউন্ট
বললেন‚ কী বলে সবাই?
‘বলে‚ উনি মানুষ নয় ভ্যাম্পায়ার‚ পিশাচী। কিন্তু ভয়ে বলতে পারেনি আপনাকে।
‘কাউন্ট রাডোভান আর প্রশ্ন করলেন না।
পরিচারককে বিদায় করে শিকারের পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে নিলেন। কোমরে পিস্তল। এছাড়া সূচলো
মাথা লম্বা একটা লোহার লাঠি। প্রাসাদের পরিচারকদের সন্দেহ যে অমূলক নয়‚ তখন বুঝতে বাকি নেই তাঁর। সন্দেহ
নেই‚ সেদিন যে
সমাধিক্ষেত্রের কাছে তিনি এলিনাকে দেখেছিলেন‚ ওর কবর ওই সমাধিক্ষেত্রেই। প্রাসাদ–বাড়ি
থেকে পশ্চিম দিকের পথটা ওই কবরের দিকেই গেছে। রাতের মানুষের রূপ ধরে থাকলেও দিনের আলো
পরিষ্কার হয়ে উঠতেই ভ্যাম্পায়ার এলিনা ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ে তার কফিনের ভিতর। ফের জেগে
ওঠে অন্ধকার নামার পর। কী ভয়ানক! ব্যাপারটা এতদিনেও টের পাননি তিনি! আর পরিচারকরা বুঝতে
পারলেও তাঁকে জানাতে সাহস পায়নি। আর দেরি করা যায় না।’
ড্রাগুটিন পালমেন অল্প থামল। তারপর
চোখ তুলে বলল‚ ‘শুনছেন তো সার?’
‘শুনছি তো।’ মাথা নাড়লেন আগন্তুক।
‘কাউন্ট রাডোভান নিজেও বাঁচতে পারেননি বোধ হয়?’
‘গল্পের বেশি আর বাকিও নেই সার। শুনুন
আগে। দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে কাউন্ট একসময় পৌঁছে গেলেন এই সমাধিক্ষেত্রে। দিনের আলো কমে
এলেও কিছু রয়েছে তখনো। খানিক খোঁজাখুঁজির পর এক ঝোপের পাশে নির্দিষ্ট কবরটি খুঁজে পেলেন
তিনি। সমাধির উপর আলগা এক পাথর। সামান্য টানতেই সরে গেল সেটা। বের হয়ে পড়ল বড় এক ফোকর।
দিনের আলো কমে এলেও সেই ফোকর দিয়ে কাউন্ট পরিষ্কার দেখতে পেলেন ডালা খোলা কফিনের ভিতর
এলিনা শুয়ে ঘুমোচ্ছে। অন্ধকার ঘন হলেই জেগে উঠবে এই মেয়ে। ফিরে যাবে তাঁর প্রাসাদ–গৃহে।
তারপর?
‘কাউন্ট আর ভাবতে পারলেন না। অ–মৃত
ভ্যাম্পায়ারের মৃত্যু ঘটাবার একটাই উপায়। লোহার একটা তীক্ষ্ণ শলাকা আমূল বিঁধিয়ে দিতে
হবে ঘুমন্ত ভ্যাম্পায়ারের হৃৎপিণ্ড বরাবর। একমাত্র তাহলেই মৃত্যু হবে তার। আর কোনোদিন
সে জেগে উঠবে না। সেই ভাবে প্রস্তুত হয়েই আজ বের হয়েছেন তিনি। সঙ্গে এনেছেন লোহার তীক্ষ্ণ
শলাকা। দ্রুত সেটা বের করে ঘুমন্ত পিশাচীর বুকে বিঁধিয়ে দিতে যাবেন‚ উদ্যত হাত থেমে গেল হঠাৎ। এলিনার
রূপের সত্যিই তুলনা নেই। কফিনের অন্ধকারেও নিদ্রিত এলিনার রূপ যেন ফেটে পড়ছে! অগত্যা
লোহার কাঁটা বুকে বিঁধিয়ে দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। একটু পরেই টের পেলেন তাঁর নিজের শরীরের
ভিতরেও কিছু একটা শুরু হয়ে গেছে যেন। কেমন এক বিশ্রী হাসি ফুটে উঠল মুখে। গালের দুই
পাশ কেমন নিসপিস করে উঠল।’
বলতে বলতে ড্রাগুটিন পালমেন থামল হঠাৎ।
মুখ তুলে সামনে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল‚ ‘কী সার অবাক হয়ে গেলেন নাকি?’
‘নাহ্‚’ আগন্তুক বললেন‚ ‘অবাক হবার কী আছে। ভ্যাম্পায়ার এলিনা
শুধু অন্যদের রক্ত নয়‚ সুযোগ মিলতে চুষে খেয়েছে কাউন্ট রাডোভানের রক্তও। ফারাক শুধু
অন্য শিকারের শেষ বিন্দু রক্ত যখন আকণ্ঠ পান করেছে‚ তখন নিজের স্বার্থেই কাউন্টকে প্রাণে
মারেনি। কাউন্ট রাডোভান তাই নিজেও তখন বোধ হয় সম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন না।’
‘একদম ঠিক বলেছেন সার। আসলে কাউন্টের
সঙ্গ পাবার জন্য পিশাচী এলিনা ইচ্ছে করেই তার পুরো রক্ত না খেয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তবে
বেঁচে থাকলেও ইতিমধ্যে কাউন্টের ভিতরে ভ্যাম্পায়ারের অনেক লক্ষণই দেখা দিতে শুরু করেছে।
তাই ভ্যাম্পায়ার এলিনার অপরূপ মুখের দিকে তাকিয়ে আর মারতে পারেননি তাঁকে। হাতে লোহার
শিক নিয়ে সেই ভাবেই বসে ছিলেন। তারপর যা হবার তাই হয়েছিল। পরের দিন সকালে কাউন্টের
মৃতদেহটা সমাধিক্ষেত্রের কাছে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। সেই থেকে রাত নামলেই একটা বাদুড়
সমাধিক্ষেত্রের উপর রাতভর পাক খেয়ে বেড়ায়। সবাই বলে‚ বাদুড়টা আসলে সেই কাউন্ট…’
কথা শেষ না করেই ড্রাগুটিন পালমেন
অল্প থামল। তারপর উপর দিকে সামান্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল‚ ‘ওই দেখুন সার‚ আজও সন্ধে নামতে চলে এসেছে বাদুড়টা।
রাত নামলে কেউ আর তাই আসে না এদিকে। মানুষ দেখলেই নিঃশব্দে ঘাড়ের উপর নেমে আসে। শিকার
টেরও পায় না।’
থামল ড্রাগুটিন পালমেন। চোখ দুটো হঠাৎ
কেমন চকচক করে উঠল। জিব দিয়ে বার কয়েক ঠোঁট চাটল। ‘তা এবার আমার দক্ষিণাটা চাই যে সার।
বলেছিলাম না‚ গল্প শোনাতে কিছু দক্ষিণা নেই আমি।’
‘তা বলেছিলে বটে।’ আগন্তুক সামান্য
নড়ে উঠলেন হঠাৎ। ঠোঁটের কোনে অল্প হাসলেন। ‘কিন্তু গল্প যে এখনো শেষ হয়নি বাপু। যে
কবর দেখিয়ে গল্প শুরু করলে‚ সেটা কাউন্ট রাডোভানের কবর নয়।’
‘কী যে বলেন সার! এদিকে সবাই কিন্তু
তাই বলে।’ ড্রাগুটিন পালমেন প্রবল ঘাড় নাড়াল।
‘সে বলতেই পারে। আসলে তিনশো বছর আগের
কথা তো। মুরেস নদী দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেছে তারপর! ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। তবে এই কবরের
কাছেই ছিল এলিনার কবর। সেটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তারপর। কফিন খুঁজে বের করার
পর প্রাসাদ–দুর্গের ফাদার যথারীতি মারণ–মন্ত্র পড়ে তার বুকের হৃৎপিণ্ড ভেদে করে ঢুকিয়ে
দিয়েছিল লোহার শিক। ভ্যাম্পায়ার এলিনার মৃত্যু হয়েছিল বটে‚ কিন্তু বিলীন হয়নি। বাদুড় হয়ে রাডোভানকে
খুঁজে বেড়ায় আজও। ওই সেই বাদুড়। ভাল করে দেখ একবার‚ পুরুষ নয়‚ স্ত্রী বাদুড় ওটা।’
‘বলছেন কী সার!’ প্রায় যেন চমকে উঠল
ড্রাগুটিন পালমেন।
‘হ্যাঁ বাপু। তুমি নিজেও জানো হয়তো।
বেচারা এখন আর ভ্যাম্পায়ার নয়। মামুলি এক বাদুড় মাত্র। রাতভর খুঁজে বেড়ায় কাউন্ট রাডোভানকে।
তোমাদের মতো কয়েকজনের মিথ্যে রটনায় ভয় পায় সবাই।’
‘তাহলে কাউন্ট রাডোভানের কবর? সেটা
কোথায়?’ দ্রুত প্রশ্ন করল ড্রাগুটিন পালমেন।
‘কাউন্ট রাডোভানকে এখানে আদৌ কবর দেওয়া
হয়নি। হাজার হোক‚ কাউন্ট মানুষ তিনি। ভ্যাম্পায়ার দোষ কাটাবার জন্য একাধিক পাদ্রি
আর ওঝা আনিয়ে নানা ক্রিয়াকর্ম করা হয়েছিল পুরো সাত দিন ধরে। কাউন্টের হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ
না করে দূরে পাহাড়ের এক গোপন গুহায় রেখে দেওয়া হয়েছিল কফিন। নিশ্ছিদ্র করে বন্ধ করা
হয়েছিল গুহার মুখ। গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া অন্য কেউ জানতে পারেনি। মাত্র গতকালই গুহার
সেই বন্ধ মুখের পুরনো গাঁথুনি ফাটল ধরে ভেঙে পড়েছে…’
‘থামুন তো সার।’ আগন্তুকের কথার মাঝেই
প্রায় ফুঁসে উঠল ড্রাগুটিন পালমেন। ‘শুধু বাজে কথা! আমার পাওনাটা এবার দিন দেখি। চলে
যাই।’
বলতে বলতে ড্রাগুটিন পালমেন ফস করে
কোমর থেকে বড় একটা ছোরা বের করে লাফিয়ে পড়ল আগন্তুক লোকটার উপর। রাত হয়ে গেছে‚ অযথা সময় নষ্ট করা যায় না। এই নির্জন
প্রান্তরের মাঝে লোকটাকে একাকী দেখে এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে। নতুন কাউকে
পেলে গল্প শুনিয়ে অন্ধকার না নামা পর্যন্ত তাকে ধরে রাখাই তার আসল উদ্দেশ্য। গল্পটা
পুরনো অবশ্য। অনেকেই শুনতে চায় না। নতুন আগন্তুকেও তার ব্যতিক্রম মনে হচ্ছিল না। তাই
দেরি না করে এবার কোমর থেকে ছোরাটা বের করেছিল। টাকাপয়সা বের করে দিলে ভাল‚ নইলে খুনেও আপত্তি নেই।
কিন্তু ছোরা বের করেও হঠাৎ আগন্তুকের
মুখের দিকে চোখ পড়তে হাতের অস্ত্র স্থির হয়ে গেল তার। লোকটার চোখ দুটো হঠাৎ অমন জ্বলে
উঠেছে কেন। নরকের আগুন যেন। জিব দিয়ে ঠোঁট চাটছে। গালের দুই পাশ দিয়ে দুটো তীক্ষ্ণ
দাঁত বাইরে বের হয়ে আসছে।
ড্রাগুটিন পালমেনের হাতের অস্ত্র হাতেই
রয়ে গেল। ততক্ষণে আগন্তুকের গালের দুই পাশ দিয়ে বের হয়ে আসা দুটো তীক্ষ্ণ দাঁত তার
গলার উপর চেপে বসতে শুরু করেছে।
আ—হ্—হ্—হ্—হ্…
মৃত্যু আর্তনাদের সেই রেশ নির্জন উপত্যকায়
কিছুমাত্র সাড়া জাগাল না। বহুদিন পরে ভ্যাম্পায়ার আজ রক্তের স্বাদ পেয়েছে। শেষ বিন্দু
রক্তটুকুও তার চাই আজ। ওদিকে বাদুড়টাও ইতিমধ্যে নেমে এসেছে। আগন্তুকের মাথার উপর খুশিতে
ঘুরে ঘুরে উড়ছে।
আপলোড: ৪/৬/২০২১
আপনার লেখা ভৌতিক কাহিনী গুলি খুবই ভালো লাগে। শারদীয়া শুকতারায় প্রকাশিত রাসমণির গল্প গুলি অসাধারন। রাসমণি কে নিয়ে আরো গল্প লিখলে খুব আনন্দ পাবো। ধন্যবাদ।
ReplyDeleteখুব খুবই ভালো লাগলো। ভ্যাম্পায়ারের গল্প লেখার ইতিহাসটুকু খুবই চিত্তাকর্ষক। ভ্যাম্পায়ার আর ড্রাকুলার আবেদন কোনোদিন ফুরোবার নয়। ব্যক্তিগতভাবেও ড্রাকুলা আমার ভীষণই প্রিয় একটি চরিত্র। ওই ভালোবাসা থেকে আগের বছরেই লিখে ফেলি একটি ড্রাকুলা ফ্যান ফিকশনও। খুব আনন্দও হয় যখন সেটি ছাপার অক্ষরে দেখি। আপনার লেখা, রিসার্চ খিব খুব ভালো লাগলো। ঋত্বিক গ্রূপের আপনার অসুস্থতার কথা জানলাম। সাবধানে থাকুন, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠুন। আরো লেখা আসুক আপনার কলম থেকে। 🙏
ReplyDeleteশিহরণ জাগানো এই গল্পটি অসাধারণ কিন্তু আমি সবার আগে রাখবো ভ্যামপায়র নিয়ে অনেক অজানা কথা যা হয়ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিন্তু এইবার সেইগুলো এক জায়গায় পাওয়া গেল । মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীবেষ্টিত গভীর অরণ্যে হীরের অনুসন্ধানে গিয়ে আমি শুনেছিলাম যে মন্ত্র বেসুরো গাইলে মানুষ ধীরে ধীরে নিজের অজান্তে রক্তচোষা ঈগলে পরিণত হয় যে একটি মেয়ের বেশে আসে, কোনো যুবককে ভুলিয়ে তার রক্ত পান করে ঈগল হয়ে উড়ে যায় । এই ঈগলকে এরা রাজগদড় বলে ।
ReplyDeleteAsadhran
ReplyDeleteঅভূতপূর্ব
ReplyDeleteএক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম, খুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteএক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম, খুব ভালো লাগলো
ReplyDelete