Monday 3 January 2022

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোঃ ভাঃ): বুকের গুলি (ধীরেন্দ্র লাল ধর)

 

বুকের গুলি

ধীরেন্দ্র লাল ধর

রায়নগরের চৌধুরীদের বাড়ীতে ভূত দেখা দিল। যে ঘরে সদাশিববাবু থাকতেন সেই ঘরে মাঝরাতে প্রায়ই মানুষের চলাফেরার শব্দ পাওয়া যায়। বড় বৌ তো একদিন রাত্রে ঘরে ঢুকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন সদাশিববাবু চেয়ারের উপর বসে আছেন। এর আগে দু’একজন চাকরও নাকি দেখেছিল, সেই থেকে সন্ধ্যার পর বাড়ীর ওদিকের মহলে কেউ আর ঘেঁষে না।

বিধবা স্ত্রী স্বামীর শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করালেন, তান্ত্রিক লাগালেন কিন্তু সদাশিববাবুর আত্মার কোন সদ্গতি করতে পারলেন না।

জমিদার বাড়ীর ব্যাপার টাকা-পয়সার অভাব নেই, যখন কিছুতেই কিছু হলো না, তখন বড় বৌ বললেন—যিনি এই আত্মার সদ্গতি করতে পারবেন তাকে দু'শো টাকা প্রণামী দেওয়া হবে। কিন্তু তখন তান্ত্রিকেরা হাল ছেড়ে দিয়েছে।

এই ভূত দেখা দেবার আগের একটা ছোট ইতিহাস আছে। রায়নগরের জমিদারীর মালিক ছিলেন দু’ভাই, সদাশিব আর সত্যহরি। সদাশিব ছিলেন ভাল শিকারি। সুন্দরবন অঞ্চলে তিন বার তিনটে কেঁদো বাঘ তিনি মেরেছিলেন, চিতাবাঘ মেরেছিলেন অন্ততঃ দু’ডজন। গায়ে ছিল অসুরের মত শক্তি আর মনে ছিল দুর্ধর্ষ সাহস। দীর্ঘ দশাসই চেহারা, সহসা লোকে পাঞ্জাবী বলে ভুল করতো।

সত্যহরি কিন্তু দাদার মত ছিল না। অমন লম্বা চওড়া জোয়ান না হলেও খাটাখাটুনির ব্যাপারে সে পিছপা হতো না। জমিদারী দেখাশুনার ব্যাপারে জলা-জংগল ভেঙে ঘোরাফেরা করতে কোন সময়েই তার বাধতো না, বর্ষা কি রোদ সে গ্রাহ্য করতো না। জমিদারীটা দেখাশুনা করতেন সত্যহরি, আর সদাশিব থাকতো শিকার আর খেলাধুলা নিয়ে।

দুভাইয়ে মনের মিল ছিল খুব। সত্যহরি যা করতেন তাই, সদাশিব কখনো কোন ব্যাপারে কৈফিয়ত চায়নি। কিন্তু হঠাৎ একদিন কি হলো কে জানে, সন্ধ্যার পর দু'ভায়ে দোতলার নাচ-ঘরে কথা বলছিল, হঠাৎ একটা বন্দুকের শব্দ শোনা গেল, তারপরেই সত্যহরি হন্তদন্ত করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাড়ির লোকেরা ছুটে এলো, দেখলে গুলি খেয়ে সদাশিব মেঝের উপর পড়ে আছে। সেই থেকে সত্যহরির আর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। ব্যাপারটা পুলিশে গেলে অনেকদূর গড়াত, কিন্তু বড় বৌ চারদিক বিচার করে ব্যাপারটা সেইখানেই চাপা দিলেন। পুলিশের কানে যখন কথাটা পৌছুলো, তার তিনদিন আগে সদাশিববাবুর অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হয়ে গেছে।

আইন-আদালত হলো না বটে কিন্তু শ্রাদ্ধের পর থেকেই দেখা দিল এই প্রেতাত্মা। বাড়ীতে পুরুষ মানুষ কেউ ছিল না। সদাশিব ছিলেন নিঃসন্তান, আর সত্যহরির একটি মাত্র ছেলে, বয়স মাত্র দু'বছর। বড় বৌ নিজেই জমিদারী দেখাশুনা করতে লাগলেন। এই প্রেতাত্মার সদগতি করার জন্য তিনি অনেক কিছুই করলেন কিন্তু শেষ অবধি কিছুই হলো না। শেষে ওই দু’শো টাকা প্রণামীর কথাই রাষ্ট্র করতে হন্যে। কিন্তু তাতেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

রায়নগর থেকে ইচ্ছামতী প্রায় ক্রোশখানেক পথ। নদীর কোণেই শ্মশান। শ্মশানের পাশেই ডোমপাড়া। কালু ডোম ছিল ডোমপাড়ার সর্দার। মদ আর মড়া ছিল তার সঙ্গী। হাঁড়িভরা তাড়ি আর মড়ার চুল্লী ছাড়া সে আর কিছু বুঝত না। দু’শো টাকা পুরস্কারের কথাটা তার কানে পৌছুলো, বললো—জীবনে তো ভূত দেখিনি, একবার দেখে আসি।

কালু রায় গিন্নীর সঙ্গে দেখা করলো, বললো—আজ রাতে আমি ওই ঘরে থাকবে।

বড় বৌ কালুকে চিনতেন, পূজা-পার্বণের দিন সে আসতো, পার্বণী নিয়ে যেতো। বললেন-তুই কী করবি ? তন্ত্রমন্ত্র কিছু জানিস?

কালু বললো-তন্ত্রমন্ত্র নয়, আমি বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলবো। বাবার মুখে শুনেছি, অপঘাতে যারা মারা যান তারা অনেক সময় দেখা দেন, কিছু বলতে আসেন, তাঁদের সেই কথাটা শুনতে হয়। আমার তাই মনে হয় বড়বাবুও কিছু বলতে আসেন, তার কথাটা বলা হয়ে গেলেই তিনি আর থাকবেন না। আমি তাই এক রাত্তির ওই ঘরে থেকে দেখতে চাই বড়বাবু কি বলতে চান।

তুই একা থাকবি?

একা নয় তো দোকা পাবো কোথায় মা, আমার অত ভয়ডর নেই, শ্মশানেই তো পড়ে থাকি, আর এ-তো জমিদার বাড়ী। এখানে একটা ডাক পাড়লেই তো দশজন ছুটে আসবে।

বড়বৌয়ের কাছ থেকে দুটো টাকা চেয়ে নিয়ে কালু বিদায় হলো। সন্ধ্যাবেলা দু’বোতল, ধেনো মদ গামছায় জড়িয়ে নিয়ে কালু এলো। দরোয়ান তাকে পৌঁছে দিল দোতলার নাচঘরে, বলল, রাতে যদি ভয়-ডর পাস তো সাড়া দিস। আমরা ক’জন ওদিকের বারান্দায় শুয়ে থাকবো, ডাকলেই সাড়া পাবি।

কালু বললো—তোরা নাক ডাকিয়ে ঘুমুগে যা, তোদের আমি ডাকবো না, তোরা কি আমাকে সেই মানুষ পেয়েছিস? কত অমাবস্যার রাত ইচ্ছামতীর শ্মশানে কাটিয়ে দিলুম। হুঃ ।

কালু দরজার পাশে মেঝের উপর বসে পড়লো।

দু’মহল বাড়ী। সদর মহলে মস্ত কাছারি বাড়ীর উপরের তলায় নাচঘর। সেখানে একদিন বড় বড় গাইয়ের আসর বসতো। কত নাচিয়ে নেচে গেছে। লম্বা টানা হলঘর, অন্ততঃ একশো লোক ফরাসের উপর বসে আসর জমাতে পারে। এখানে কতদিন কত জমিদারের দরবার হয়েছে। নিবারণ মুখুজ্যে যখন রেষারেষি করে ভাইয়ের ঘর জ্বালিয়ে দিলে তখন এই নাচঘরে কর্তাবাবুর দরবারে তার বিচার হয়েছিল। সে বিচার-সভায় কালুও এসেছিল তার বাবার হাত ধরে। কালুর বয়স তখন কতই বা, সাত-আট বছর হবে। সেই প্রথম সে এই নাচঘরে এসেছিল আর আজ এসেছে এই দ্বিতীয় বার। সেদিনকার নাচঘরে কত লোক, কত বরকন্দাজ, কত জৌলুষ, আজ সে একা। কালু ভাল করে নাচঘরটা একবার দেখে নেয়।

দরজার সামনে একটা টুলের উপর লণ্ঠনটা বসানো আছে। সেই লণ্ঠনের আলোয় লম্বা ঘরখানার শেষ অবধি ভাল দেখা যায় না। পর পর মাথার উপর তিনটে ঝাড়লণ্ঠন। দেয়ালের গায়ে বড় বড় আয়না। সারি সারি দরজার মাথায় একখানি অয়েল-পেন্টিং করা ছবি। ওদিকের দেয়ালে কয়েক জোড়া ঢাল আর বল্লম সাজানো। চার কোণে ব্রাকেটের উপর চারটে বাঘের মাথা। ঘরের মাঝে একখানি গোল টেবিল আর খান চারেক চেয়ার। কালু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো, নাঃ, এ ঘরে ভয় পাবার মত তো কোথাও কিছু নেই। তবে এত বড় ঘরে একলা থাকলে একটু ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়, কিন্তু কালু এর চেয়ে ঢের বেশি ফাঁকা শ্মশানে রাত কাটায়। তবে সারাদিন-রাত দরজা বন্ধ করে রাখায় ঘরটা ভ্যাঁপসা হয়ে উঠেছে। বাতাস না থাকার জন্য কেমন যেন মাথা ধরে যায়। নদীর ধারে কিন্তু এইটি হবার জো নেই, যদি কোথাও না হাওয়া থাকে তবু নদীর ধারে হাওয়া আছেই।

কালু গামছার ভিতর থেকে বোতল দুটি বের করলো। তারপর উঠে গিয়ে বসলো একখানি চেয়ারে। টেবিলের উপর বোতল দুটি রেখে সে ভালো করে জাঁকিয়ে বসলো। আজ সে একটু বড়মানুষি করে নি। মাটিতে বসে মেঝেতে বসে সে অনেক তাড়ি খেয়েছে, আজ চেয়ারে বসে টেবিলে বোতল রেখে খাবে। একটা গেলাস থাকলে ভাল হয় কিন্তু গেলাস আর এখন পায় কোথা। একটা ...বোতলের ছিপি খুলে কালু আধ বোতল গলায় ঢেলে দিলে। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে বসে বসে ভেবে নেবার চেষ্টা করলে নিজেকে ঠিক জমিদার বলে মনে হয় কি না। তারপর সহসা চেয়ার ছেড়ে সে উঠে পড়লো, বললো—দূর, এতে যে কেন বাবুরা বসেন কে জানে, এতে বসার কোন সুখ আছে, হাত পা ছড়ানোর উপায় নেই।

বোতল নিয়ে কালু নেমে এলো মেঝের উপর। ভাল করে পা ছড়িয়ে বসে বোতলের বাকিটুকু গলায় ঢেলে দিলে। তারপর গামছায় মুখটা মুছে নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বললো, এতক্ষণে বসে আয়েস হলো, মেজাজ ঠিক হলো।

একটা বড় শালপাতা জড়ানো চুরুট ধরিয়ে কালু টানতে সুরু করলো। নেশাটা বেশ জমে উঠতে চুরুটটা শেষ করে কালু ঝিমুতে সুরু করলো। ভুতের ভয়ে সারারাত তো জেগে বসে থাকা যায় না, ভূত যখন আসবে তখন জাগলেই চলবে।

দেউড়িতে দারোয়ানের আর সাড়া নেই, সারা বাড়ী নিঝুম হয়ে গেল। কালুরও দিব্যি নাক ডাকতে শুরু করলো।

ঠিক কতক্ষণ বাদে কালুর ঘুম ভাঙলো আর কেন যে ঘুম ভাঙলো তা বলা শক্ত। চোখ মেলেই সবার আগে তার চোখে পড়লো নেশার বোতল দুটো। ভর্তি বোতলটার ছিপি খুলে আগে সে খানিকটা গলায় ঢাললো তারপর সোজা হয়ে বসলো। আর ঠিক তখনই কয়েকবার দপ দপ করে উঠে লণ্ঠনটা নিভে গেল। চাকর তেল চুরি করেছে, নাহলে এখন তো লণ্ঠনটা নিভে যাবার কথা নয়। অন্ততঃ সারা রাত আলোটা জ্বলা উচিত। যাক গে, একফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে দরজা দিয়ে। তাতে ঘরের অন্ধকারটুকু কেমন যেন আবছায়া এলোমেলো হয়ে উঠেছে। সেই আবছায়া ঘরের মধ্যে কি যেন একটা নড়ছে। কালু ভাল করে দেখলো, কে একজন ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। কালু বলে উঠলো—কে?

লোকটি এবার সামনে এসে দাঁড়ালো। কালু তো অবাক, এ যে চৌধুরীদের বড়বাবু, সেই হাতকাটা শার্ট আর ধুতি। সহসা কালুর মুখে কোন কথা জাগলো না।

-কি রে কালু, তুই এখানে কি করছিস?

কালু সত্যি থতিয়ে গিয়েছিল, এবার যেন সে কথা খুঁজে পেল। ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বললো—পেন্নাম হই বড়বাবু।

—থাক থাক, তা তুই এখানে কি করছিস?

—আজ্ঞে, আপনার প্রেতিক্ষে করছি। বড় মা বললেন, তুই এখানে থাক, বড়বাবু যদি আসেন তো তাকে জিজ্ঞেস করে নিস, তিনি কি চান।

বড় বৌ তোকে পাঠিয়েছে! কেন, নিজে থাকতে পারেনি।

আজ্ঞে, সে তো সত্যি কথাই, আপনার সামনে কি সবাই থাকতে পারে হুজুর, ভয় করে তো।

ভয় করে, আমি তাকে খেয়ে ফেলব! তোদের মাথাগুলো সব একসঙ্গে গুড়িয়ে ফেললে তবে আমার রাগ যায়, তোরা সব সমান পাজী।

—সে তো ঠিক কথা হুজুর, সব মানুষই পাজী, সেইজন্যই তো আমি লোকালয় ছেড়ে শ্মশানে গিয়ে থাকি।

—ঠিক করেছি, তুই ঠিক বুঝেছিস, নাহলে যে ভাইকে আমি মানুষ করলুম সেই ভাই আমাকে গুলি করে মারলে! এখন আবার এই নায়েব ব্যাটা মতলব করেছে সমস্ত জমিদারীটা হাতিয়ে নেবে। বড় বৌ মেয়েছেলে। কিছু বোঝে না, বলবি নায়েব-গোমস্তা সব যেন বিদায় করে দেয়, আমার হুকুম।

—ঠিক বলবো হুজুর।

এবার ছায়ামূর্তি যেন কিছুটা খুশি হলো। সামনে থেকে সরে গেল, ওদিককার একখানি চেয়ারে গিয়ে বসলো। কালু চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। শ্মশানে এতদিন তার কেটেছে কিন্তু প্রেতাত্মাকে এমনভাবে মুখোমুখি সে কখনও দেখেনি। ঘরের মধ্যে আর বসে থাকবে না এক দৌড়ে পালিয়ে যাবে, তাই সে ভাবতে লাগলো, কিন্তু উঠে পালানোর মত শক্তি সে পেল না। হঠাৎ একটা কথা তার মনে হলো, বললো, হুজুর, আর একটি কথা। নায়েব গোমস্তাকে ছাড়িয়ে দিলে জমি-জায়গা দেখাশুনা করবে কে?

—সব বেচে দেবে। শুধু এই রায়নগরটা রাখবে।

—অত টাকা পয়সা নিয়ে রাখবে কোথায় হুজুর, মেয়েছেলে, চোর ডাকাতের ভয় আছে।

—রাখবার জন্যে ব্যাংক আছে। আর রাখবার কোন দরকারও নেই। একটা বড় হাইস্কুল করে দেবে এখানে। কাছারি বাড়ীতে ইস্কুল বসবে, আর ওই টাকার সুদে চলবে। বুঝলি?

—বুঝেছি হুজুর।

—না কিচ্ছু বুঝিসনি, শোন্, ইস্কুল হবে আমার নামে—সদাশিব হাইস্কুল। আর নায়েবকে যেন কাল সকালেই বিদায় দেয়, কলিকাতা থেকে আমার বন্ধু হরেন মল্লিককে আসতে বলবে, সেই সব ব্যবস্থা করবে, বুঝলি?

—বুঝেছি হুজুর, বড় মা’কে সব বলব।

—কি নাম বললুম?

—আজ্ঞে হরেন মল্লিক।

—হ্যাঁ, সব ঠিক ঠিক বলবি। বলবি বড়বাবুর হুকুম, অন্যথা না হয়।

—বলবো হুজুর।

ছায়া এবার চেয়ার থেকে উঠে পড়লো। আবার শুরু হলো ঘরের মধ্যে পায়চারি করা। . চাঁদের আলোর আবছায়াতে সাদা কাপড়ের ছায়াটি নড়ে, কালু যত দেখে ততই তার মনে হয় যে যেন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু চোখ 'চেয়ে তো কেউ স্বপ্ন দেখে না। কালুর যেন এবার অল্প অল্প ভয় করতে থাকে। । হঠাৎ ছায়া আবার কালুর সামনে এসে দাঁড়ালো, বললো, আমাকে তোর ভয় করছে না?

—আজ্ঞে, হাঁ, তা একটু একটু করছে বৈ কি।

—করতেই হবে, আমাকে বড় বড় কেঁদো বাথ ভয় করত, আর তুই তো সেদিনকার ছেলে। কতগুলো বাঘ আমি মেরেছি তুই জানিস?

—আজ্ঞে, শুনেছি বিশ-পঁচিশটা।

—ঠিক। অনেক বাঘকে আমি গুলি করে মেরেছি, শেষে এই বন্দুকের গুলিতে আমি নিজেও মরেছি। কি বলিস?

—আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর।

—আচ্ছা, তুই কিছু শুনতে পাচ্ছিস?

—কি হুজুর?

—এই যে আমি কথা বলছি, আর খন–খন করে একটা শব্দ হচ্ছে।

—আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।

—ওটা কিসের শব্দ বল দিকি ?

—তা তো জানি না, হুজুর।

—সেই বন্দুকের গুলিটা বুকের মধ্যে বিধে আছে।

—তাই হবে, হুজুর।

—হবে নয়, তাই আছে।

—তাই আছে, হুজুর।

—ওই গুলিটা তোকে বের করে দিতে হবে।

—আমি কি করে বের করে দেব হুজুর, আমি তো ডাক্তার নয়।

—ডাক্তার লাগবে না, আমি যা বলছি শোন, এই দ্যাখ গুলিটা ডানদিকের পাঁজরের নিচে আটকে আছে, দ্যাখ—চকিতে সাদা জামার ছায়াটা সরে গেল, দেখা গেল মাথা থেকে কোমর অবধি একখানা কংকাল।

এবার কালুর নেশার ঝোঁক কেটে গেল, তার মনে হলো সে যেন কাঁপছে।

কংকাল বললো, দেখছিস। গুলিটা সামনের দিক দিয়ে বুকের মধ্যে ঢুকেছে। পিঠের দিক থেকে ঘা দিলে ওটা আবার সামনে দিকে বেরিয়ে যাবে। আমি উপুড় হয়ে শুচ্ছি, তুই একটা হাতুড়ি দিয়ে পিঠে ঘা মার।

কালু এবার যেন পালাবার একটা ফিকির পেল। বললে, তাহলে একটা হাতুড়ি নিয়ে আসি।

—ওই তো হাতুড়ি। ওই কোণে রয়েছে।

কংকাল নিজেই হাতুড়িটা নিয়ে এলো, বললো, এই যে হাতুড়ি, আমি শুচ্ছি, ভাল করে পেটা এবার।

কংকাল সেইখানেই শুয়ে পড়লো। শুয়ে পড়লো একেবারে দরজার সামনে। কালুর পালানোর পথটুকু বন্ধ করে দিল যেন।

কালু আর কি করে, উঠে দাঁড়ালো, হাতুড়ি দিয়ে কংকালের পিঠে মারলো এক ঘা। ভয়ে ভয়েই মারলো, কিসে কি হয় বলা তো যায় না।

কংকাল তর্জন করে উঠলো, তোর গায়ে কি এতটুকু জোর নেই, হতভাগা! ভাত খাস না? দুম দাম পেটা। নাহলে আমি ওই হাতুড়ি তোর মাথায় মেরে শিখিয়ে দেব কি করে হাতুড়ি পেটাতে হয়। পেটা হতভাগা।

কালু দুম করে এক ঘা মারলো, তারপর বললো, আরো জোরে মারবো?

—হাঁ হাঁ, যত জোর তোর গায় আছে। ভাল করে পেটা।

—আপনার লাগবে না তো?

—নিজের কাছের মানুষদের কাছ থেকে যে পেটানি খেয়েছি, রপর তুই আর কত পেটাবি। আমার কথা তোকে ভাবতে হবে না, পেটা, ভাল করে পেটা।

কালু দুমদাম করে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করে দিল। হাতুড়ির ঘা সত্যি কারও গায়ে পড়ছে কিনা কালু তা বুঝতে পারে না। তবে এক এক বা মারে, শব্দটা কানে এসে বাজে, আর তারই সঙ্গে শুনতে পায় ফোঁস করে এক একটা নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। শুধু নিঃশ্বাস ফেলার শব্দই নয়, এক এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা যেন এসে লাগে কালুর গায়। কালুর মনে হয় ঠাণ্ডা যেন চারিপাশ থেকে চেপে ধরছে। হাতুড়ি পেটানোর শ্রমে দেহটা যদি বা একটু চনচনে হয়ে ওঠে কিন্তু যত পেটায় ততই যেন শীতের কাঁপুনি জাগে হাড়ের ভিতরে। কালুর এক সময় মনে হয় এবার বুঝি সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

হঠাৎ কোন এক সময় ঠন করে একটা শব্দ হলো। একটা কি ছিটকে এসে লাগলে কালুর কপালে। এবার সত্যি কালু চোখে অন্ধকার দেখলো, মাথা ঘুরে পড়ে গেল সেইখানেই।

—কালু। কালু সর্দার।

একসঙ্গে ক’জন চাকর দরোয়ান এসে ঘরে ঢুকলো। কালুর কপাল কেটে রক্ত ঝরছে, মেঝের উপর হাতুড়িটা পড়ে আছে। দেখা গেল একখানি চেয়ারের খানিকটা কালু হাতুড়ি পিটিয়ে ভেঙেছে আর চেয়ারের পাশেই পড়ে আছে একটা শিসের গুলি। বন্দুকের গুলি।

সবাই বললো, কালুটা মাতাল, নেশা করে রাতভর মাতলামি করেছে।

কেউ অবশ্য বললো, মাতলামি নয় রে, মাতলামি করে কেউ কখনো কপালে হাতুড়ি মারে? এ ভূতের সঙ্গে মারামারি হয়েছে। অতো সাহস কি ভাল।

তা সে ভালো মন্দ যাই হোক, চোখেমুখে জল দিয়ে কালুর জ্ঞান যখন হলো, রাত তখন প্রায় তিনটে। কালু কিন্তু কাউকে কোন কথাই বললো না। বোতলের বাকিটা গলায় ঢেলে দিয়ে বোতল দুটি গামছায় জড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো, তারপর শুয়ে পড়লো সদর দরজার সামনেই।

কে একজন বললো, কি হয়েছিল রে ? কালু বললো কিছু না, যা, আমাকে এখন ঘুমুতে দে।

ঘুম থেকে উঠে কালু বড় বৌয়ের সঙ্গে দেখা করলো। বড় বৌ মন দিয়ে সব কিছু শুনলেন। তারপর সেই দিনই বিদায় করে দিলে নায়েক–গোমস্তাদের। কলকাতা থেকে ডাকিয়ে আনা হল হরেন মল্লিককে। অল্প দিনের মধ্যে জমিদারীর নতুন বিলি ব্যবস্থা করা হল। ছ'মাসের মধ্যে সদর কাছারিতে পত্তন হল সদাশিব হাইস্কুলের। নাচঘর থেকে প্রেতাত্মাও অন্তর্হিত। ভূতের সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি আর।

আপলোড: ২৬/৮/২০২২

1 comment: