ভ্যাবলাকে নিয়ে বড়
ভাবনায় ছিলেন ওর মা। ভ্যাবলার বয়সটাই বাড়ছে। এই আষাঢ়ে আঠারো পার হয়ে গেল, কিন্তু বুদ্ধিতে
একেবারেই গোবরগণেশ। বাবা নেই। বিধবা মা চৌধুরীবাড়িতে দু’বেলা।
হেঁশেল ঠেলে যা উপায় করেন তাতে মা-ছেলের দিন চলে। তবু ছেলের জন্য ডাক্তারবদ্যি,
তাবিজ-কবজ, এসব কম করেননি। কিন্তু উন্নতি
হয়নি। ছেলেটার আসল নাম তাই হারিয়ে গেছে অনেক দিন। টিকে রয়েছে পড়শিদের দেওয়া
ওই ভ্যাবলা নামটা। পাড়ার অনেকের কাছেই ভ্যাবলা তাই হাসি-তামাশার বস্তু।
এই তো মাত্র মাস কয়েক
আগের কথা। ভ্যাবলার মা তখনও বেঁচে। সেদিন রাত থেকে তাঁর ধুম জ্বর। সকালে খানিক
বেলাতেও যখন বুঝলেন,
আজ আর বেরোবার জো নেই, ছেলেকে ডেকে খবরটা
চৌধুরীবাড়িতে দিয়ে আসতে বলেছিলেন। এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। ভ্যাবলাও বের হয়ে
পড়েছিল। কিন্তু মোড়ের কাছে আসতেই পড়ে গেল বকেশের খপ্পরে। পাড়ার ফক্কড় ছেলেছোকরাদের
চাঁই বকেশ তখন সঙ্গীদের নিয়ে চায়ের ঠেকে আড্ডা জমিয়েছে। এই সকালে ভ্যাবলাকে
হনহন করে যেতে দেখে তার মাথায় পোকা নড়ে উঠল। কাছে আসতেই হাঁক দিয়ে বলল, ‘আরে ভ্যাবলা যে! তা এই সকালে যাচ্ছিস কোথায়?’
বকেশের বাজখাঁই হাঁক শুনে
থামতেই হল ভ্যাবলাকে। থতিয়ে গিয়ে বলল, ‘চ-চ-চৌধুরীজ্যাঠার বাড়ি।’
‘সে কী রে!’ বকেশ
প্রায় আকাশ থেকে পড়ল। ‘চৌধুরীজ্যাঠার বাড়ি যাবি, তা এই পথে কেন?’
বকেশের ওই কথায় আরও
ঘাবড়ে গিয়ে ভ্যাবলা বলল,
‘ক-ক-কেন! পথ ভুল হয়েছে নাকি?’
‘আলবত। চোখ নাচিয়ে
বকেশ বলল, ‘এদিকে তোর চৌধুরীজ্যাঠার বাড়ি কে বলেছে! কোনও
দিন গেছিস?’
ব্যাপার হল, চৌধুরীবাড়ি এই
পথেই। ভ্যাবলা আগেও গেছে। কিন্তু হঠাৎ বকেশের ওই কথায় সব গুলিয়ে গেল। খানিক চুপ
হয়ে থেকে শেষে মাথা চুলকে বলল, ‘যাইনি বোধ হয়। তা বাড়িটা
কোন পথে গো?’
‘কোন পথে?’ ভুরু কুঁচকে বকেশ বলল, ‘কী করে বোঝাই বল দেখি?
যা ভ্যাবলা ছেলে, ফের না গুলিয়ে ফেলিস।’
আসলে ফিল্ড তৈরি হবার পর
জুতসই একটা জবাব চট করে মাথায় আসছিল না তার। বকেশের পাশে ছিল গুগলে। বলল ‘ভেবো না ওস্তাদ।
বলো তো আমি বুঝিয়ে দিতে পারি।’
ছোটখাট গুগলের মাথা এসব ব্যাপারে
বেশ পরিষ্কার। বকেশ তাই ঘাড় নাড়ল। গুরুর অনুমতি পেয়ে গুগলে চোখ নাচিয়ে মোড়ের
বাঁ দিকে চাঁদমারি যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাবিসনি ভ্যাবলা, এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যা। খানিক এগোলেই চাঁদমারির মাঠ। গেলেই দেখতে পাবি
এক পাল মোষ চরে বেড়াচ্ছে। তার কোনোটার শিংয়ের উপর যদি একটা দাঁড়কাক বসে আছে
দেখিস, তবে আর চিন্তা নেই।’
‘কেন গো?’ আগ্রহে জানতে চাইল ভ্যাবলা।
‘কেন কী রে!’ চোখ
মটকে উত্তর দিল গুগলে, এবার শুধু একটা ঢিল ছুঁড়ে উড়িয়ে
দিবি। কাকটা উড়ে যে বাড়িতে গিয়ে বসবে সেটাই তোর চৌধুরীজ্যাঠার বাড়ি।
‘সত্যি!’ মাথা
চুলকে ভ্যাবলা বলল।
‘শুধু সত্যি নয় রে,
একেবারে তিন সত্যি।’ গুগলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বকেশ বলল, ‘তা মনে থাকবে তো রে? নাকি ফের ভুলে যাবি?’
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ‚ মনে থাকবে।’ উৎসাহে চাঙ্গা হয়ে
ভ্যাবলা বলল।
‘তাহলে দেরি না করে
দৌড়ো।’
বেশি আর বলতে হল না।
ভ্যাবলা ছুটল চাঁদমারির দিকে।
এহেন ছেলেকে নিয়ে কোন
মায়ের না চিন্তা হয়?
তায় বাবা নেই। বলা যায়, যতদিন বেঁচে ছিলেন
ভ্যাবলার মা আগলে রেখেছিলেন ছেলেকে। চৌধুরীবাড়িতে রাঁধুনির কাজ করলেও বাজারের
কাছে বেশ ভাল জায়গায় শ্বশুরের রেখে যাওয়া ছোট বসতবাড়িটা ছিল। তাই সেদিক দিয়ে
ভাবনা ছিল না। তবে ভ্যাবলার কথা ভেবে মা অবশ্য অনেকবার ভেবেছিলেন জমি-বাড়ি বিক্রি
করে সেই টাকায় ছেলের একটা নিশ্চিত ব্যবস্থা করে যাবেন। ভাল খদ্দেরও মিলেছিল।
কিন্তু চৌধুরীবাড়ির বড়কর্তা গজেন চৌধুরীর ভরসা পেয়ে আর সেই পথে যাননি। খবরটা
কানে আসতে তিনি বলেছিলেন, ‘অমন ভাল জমিটা এখনই বেচার কী
দরকার বামুনদিদি! জায়গাটা দিন-দিন যেমন জমজমাট হয়ে উঠছে, বছর
কয়েক সবুর করলে দুনো দাম মিলবে। আর হাজার হোক আমরা তো আছি। এটুকু বলতে পারি,
তোমার আবর্তমানে ভ্যাবলা বানের জলে ভেসে যাবে না।'
গজেন চৌধুরী শুধু
চৌধুরীবাড়ির বড়কর্তাই নয়, সদর আদালতের ডাকসাইটে উকিল। মানী মানুষ। সেই মানুষের
ওই কথায় ভ্যাবলার মা খানিক ভরসা পেলেও যদি জানতেন যে, বছর ঘোরার
আগেই তাঁকে ইহলোকের মায়া কাটাতে হবে তাহলে অন্য রমক ভাবতেন। শরীরটা অনেক দিন ধরেই
গোলমাল করছিল। তাই নিয়েই দু’বেলা চৌধুরীবাড়ির হেঁশেল ঠেলে
যাচ্ছিলেন। ভ্যাবলাকেও জানতে দেননি।
হঠাৎ সব শেষ হয়ে গেল।
মাত্র তিন দিনের জ্বরে চিরতরে চোখ বোঁজার পর। তা চৌধুরীবাড়ির বড়কর্তা গজেন
চৌধুরী তার কথা ভোলেননি। শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাবার পর একদিন নিজেই এসে হাজির হলেন
ভ্যাবলার কাছে। শৌখিন মানুষ। পকেট থেকে সুগন্ধি রুমাল বের করে চোখ মুছে বললেন, ‘ভ্যাবলারে বড়
ভাল মানুষ ছিলেন বামুনদিদি। এভাবে চলে যাবেন, ভাবতেও পারিনি।
কী বলব, সেই থেকে বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি রে। বেজায় কষ্ট।’
মা নেই। ঘরে সেই থেকে
হাঁড়ি ভ্যাবলারও চড়েনি। চাট্টি চিড়ে-মুড়ি চিবিয়ে দিন চলছে। তাই বা ক’দিন মিলবে জানা
নেই। উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না। আসলে একেই তো গুছিয়ে কথা বলতে শেখেনি। তায়
আবার বড়কর্তা গজেন চৌধুরীর সামনে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শুধু। দেখে ফের
রুমালে চোখ মুছলেন গজেন চৌধুরী। ফোৎ করে নাক টেনে গলা নামিয়ে বললেন, ‘ভ্যাবলারে বামুনদিদিকে কথা দিয়েছিলাম, তাই সব কাজ
ফেলে ছুটে এলুম।’
‘ক-কী?’ ঢোঁক গিলে ভ্যাবলা বলল।
‘কী আর! এই
অবস্থায় তোর একটা হিল্লে না করে কি আর বসে থাকতে পারি রে!’
এ কথার কী আর জবাব দেবে
ভ্যাবলা। গজেন চৌধুরী বললেন, ‘শোন ভ্যাবলা, মা নেই। এখানে এই
পুরান ভাঙা বাড়িতে পড়ে থেকে আর কী করবি? তাই অনেক ভেবে ভাল
এক ব্যবস্থা করেছি। নতুন এক বাড়ি ঠিক করেছি তোর জন্য। বলি কী, সেখানে গিয়ে থাক। রান্নাবান্না, ফাইফরমাশ খাটার
সর্বক্ষণের মানুষও রয়েছে একজন। এবার রাজি থাকিস তো বল।’
এসব ব্যাপার ভ্যাবলাকে কখনো
ভাবতে হয়নি। সে ক্ষমতাও নেই। তাই নীরবে মাথা নাড়ল একটু। দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস
ছাড়লেন গজেন চৌধুরী। ’যাক,
তবে মতি হয়েছে দেখছি! কদিন বড় ভাবনায় ছিলাম রে। তা শোন ভ্যাবলা,
খালি হয়ে গেলে এ বাড়ির ব্যবস্থাও তো একটা করতে হবে। কাগজপত্তর
পাঠিয়ে দেব, গোটা কয়েক টিপছাপ দিয়ে দিস। খরচপত্তরের জন্য
কিছু নগদও পাঠিয়ে দেব। ভাবিসনি।’
ফের রুমালে আর এক দফা চোখ
মুছে বিদায় নিলেন গজেন চৌধুরী। পরের দিনই জনাকয়েক লোক নিয়ে বাড়িতে বড় এক
ভ্যানগাড়ি এসে হাজির। ঘরে সামান্য যা মালপত্র ছিল তারা হইহই করে তুলে ফেলল
গাড়িতে। তুলে নিল ভ্যাবলাকেও। তারপর দরজায় মস্ত এক তালা ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেল। খানিক
বাদে সেই গাড়ি যখন শহরের প্রান্তে বাগান ঘেরা মস্ত এক বাড়ির সামনে এসে হাজির হল, দেখে তাক লাগার
জোগাড় ভ্যাবলার। এমন বাড়ি শুধু চোখেই দেখেছে, ভিতরে ঢোকার
সুযোগ হয়নি। ঝাঁ চকচকে নতুন দু’তলা বাড়ি। লাগোয়া মস্ত
বাগান, পুকুর। এমন বাড়িতে থাকতে পাবে জেনে ভ্যাবলা তো
আহ্লাদে আটখানা।
এদিকে ব্যাপার যে অন্য
রকম তা আর সে জানবে কেমন করে? আসলে বাড়িটা গজেন চৌধুরীর শাঁসালো এক মক্কেল শশী
হাওলাদারের। পুরোনো বাগান কিনে তিনিই তৈরি করিয়েছিলেন বাড়িটা। শখের জিনিস, তাই খরচের দিকে
দৃষ্টিপাত করেননি। কিন্তু বাড়ি করার পর দু’রাত্তিরও থাকতে
পারেননি। বলা যায় পালিয়ে বেঁচেছেন। তারপর নানাভাবে চেষ্টা হয়েছে আরও বার কয়েক।
কিন্তু সুবিধা হয়নি। শেষে ভাড়া দিয়ে যাতে কিছু খরচ অন্তত উশুল করা যায়,
সেই চেষ্টাও করেছিলেন। ভাল ভাড়াটেও মিলেছিল। কিন্তু তারাও এক
রাত্তিরের বেশি টিঁকতে পারেনি। সাধের বাড়িটা তাই এখন শশী হাওলাদারের গলার কাটা।
শহরতলির একটেরে অত বড় বাড়ি। অন্তত দেখাশোনার জন্যও একটা লোক দরকার। কিন্তু
ইদানীং ডবল মাইনে কবুল করেও লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় তিনি ধরেছিলেন গজেন
চৌধুরীকে। হাতের কাছে ভ্যাবলাকে পেয়ে করিতকর্মা গজেন চৌধুরী সুযোগটা আর নষ্ট
করেননি।
তা এতসব ভ্যাবলার জানার
কথা নয়। বেজায় খুশিতে দু’তলার দক্ষিণ খোলা মস্ত ঘরে তক্তপোশ এনে বিছানা পেতে নিয়েছে। লোকগুলো
অবশ্য দেরি করেনি। মালপত্র নামিয়ে দিয়ে সেই দণ্ডেই সরে পড়েছে। এদিকে গজেন
চৌধুরী যে কাজের মানুষের কথা বলেছিলেন, তারও দেখা নেই।
দুপুরে তাই চাট্টি চিঁড়ে-মুড়ি চিবিয়ে এক ঘটি জল খেয়ে ভ্যাবলা বিছানায় আধশোয়া
হয়ে খোলা জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। দিব্যি ফুরফুরে হাওয়া। পুরোনো বাড়ির
চাইতে ঢের ভাল। ভাবতে-ভাবতে একটু তন্দ্রামতো এসেছে, হঠাৎ মনে
হল কে যেন জানলার ওধারে একটু উঁকি দিয়েই সরে গেল। প্রায় ধড়মড়িয়ে উঠে বসল
ভ্যাবলা। ‘ক-কে কাজের দাদা নাকি?’
চৌধুরীজ্যাঠার সেই কাজের
মানুষ এসে গিয়েছে, ভ্যাবলা এমনটাই ভেবেছিল। কিন্তু মিনিট খানেক ওদিকে কোনও সাড়াশব্দ নেই।
চোখের ভুল ভেবে ফের শুতে যাবে, জানলার ওধারে ফের সেই মাথাটার
দেখা মিলল। একমাথা উসকোখুসকো চুল। কিম্ভুত আকারের চ্যাপটা বেঢপ দুই কানের ডগায় একগোছা
করে চুল। কশের লম্বা দাত দুটোর অনেকটাই বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। কুতকুতে চোখে লোকটা তাকিয়েছিল
ওর দিকে। ভ্যাবলা বলল, ‘জ-জানলার ওখানে কেন গো দাদা। ও-ওধারে
দরজা রয়েছে, ভ-ভিতরে এসো।’
সে কথায় কেমন থতমত খেয়ে
গেল লোকটা। তবে সামলে নিতে সময় লাগল না। খনখনে গলায় বলল, ‘কেঁ? আঁমি!’
‘ত-তবে আর কে?’
ভ্যাবলা বলল, ‘ব-বাড়িতে আর দুটি মানুষ নেই গো।
ভ-ভেব না, কাজও কম।’
‘অঁ!’ আগন্তুক একবার কটমট করে তাকাল ভ্যাবলার দিকে। কশের দাঁত দুটো আর একটু
বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর প্রায় বাতাসে ভর করে লিকলিকে সিড়িঙ্গে চেহারার লোকটা
গরাদের ফাঁক গলে সাঁ করে ঢুকে পড়ল ভিতরে। দু’পাটি দাঁত
কড়মড় করে বলল, ‘বঁলি হাঁ কঁরে তাঁকিয়ে আঁছ যেঁ বঁড়ো! ভঁয়
হঁচ্ছে নাঁ?’
‘ভ-ভয় পাব কেন!’
অবাক হয়ে ভ্যাবলা বলল, ‘ব-বলে সেই থেকে তোমার জন্য
হাপিত্যেশ করে রয়েছি। দ-দু’বেলা চিড়ে চিবিয়ে বড় কষ্টে
রয়েছি গো।’
লোকটা সেই কথায় প্রায়
খিচিয়ে উঠল এবার। ভয়ানক খোঁনা গলায় বলল, ভঁয়ঁ হঁচ্ছে নাঁ মাঁনে! দুঁ’তলার জাঁনলা
গঁলে চঁলে এঁলুম, তাঁ দেঁখেও ভঁয় হঁয়নি!’
‘ভ-ভয় হবে কেন! স-সেবার
চৌধুরীজ্যাঠার বাড়িতে ওইভাবে দু’তলার ঘরে পাইপ বেয়ে উঠেই তো এক চোর বেবাক সাফ করে
নিয়ে গিয়েছিল। এ-এ আর এমন কী কায়দা!’
‘আঁ, তাঁই বুঁঝি! তাঁ এঁই যেঁ চঁন্দ্রবিন্দু কঁতা, এঁতেও
কিঁচু পেঁত্তয় হঁলনি!’
‘ক-কী পেত্তয়?'
গোড়ায় ভ্যাবলা সামান্য থতমত খেলেও একটু থেমে বলল‚ ‘ব-বুঝেছি।’
‘অ্যাঁ, বোঁঝা গেঁছে তাঁহলে!’ বেজায় খুশি হয়ে বলল লোকটা,
তাঁ ভঁয় হঁচ্ছে নাঁ?
‘ভয় লাগবে কেন!’ প্রায় আকাশ থেকে পড়ল ভ্যাবলা, ‘আ-আমাদের পাড়ার
নাকাষষ্টিরও ওই রোগ আছে গো দাদা। একটু ঠান্ডা লাগলেই কথা অমন নাকিসুরো হয়ে যায়।
স-সবাই তাই নাকাষষ্টি বলে ডাকে। তা ঘরে যা বাতাস, ঠান্ডা
একটু লাগতেই পারে। তবে ভেবো না। দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।’
আর সহ্য হল না লোকটার।
কটমট করে দু’চোখে এক ঝলক আগুন ঝরিয়ে ধাঁ করে নিজের মাথাটা উপড়ে নিল ঘাড় থেকে। তারপর
শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে কন্ধকাটা অবস্থায় দু’পায়ে দুমদাম ভলি
প্র্যাকটিস করল খানিক। শেষে ফের ধড়ের উপর যথাস্থানে বসিয়ে দিয়ে দু’পাটি দাঁত বের করে তাকাল।।
অবাক হয়ে লোকটার সেই
কাণ্ড হাঁ করে দেখছিল ভ্যাবলা। লোকটা ধড়ের উপর মুণ্ডুটা ফের বসিয়ে দিতেই খুশিতে
হাততালি দিয়ে বলল,
‘বাহ, দারুণ ম্যাজিক দেখাও তো দাদা!’
লোকটা তখন মুণ্ডুটা ফের
যথাস্থানে বসিয়ে সবে ভ্যাবলার দিকে তাকিয়েছে। মুহূর্তে তার দাঁতগুলো ফের ভিতরে ঢুকে
গেল। শুকিয়ে আমশি। থতমত খেয়ে বলল, ‘অ্যাঁ, ম্যাঁজিক!
কোঁতায়?’
‘কেন, এই যে দেখালে এখুনি। সেবার মেলায় সন্তোষকুমারের ম্যাজিক হয়েছিল গো। ঠিক
এইভাবে নিজের ধড় থেকে মুণ্ডু কেটে ফের জুড়ে দিয়েছিল! তুমি ওই সন্তোষকুমারের
কাছে শিখেছ বুঝি?
ভ্যাবলা আজ পর্যন্ত দুটো
কথাও কারও সঙ্গে গুছিয়ে বলতে পারেনি। কেউ সেভাবে কথাও বলেনি ওর সঙ্গে। নতুন সঙ্গী
পেয়ে সেই ভ্যাবলার মুখে আজ যেন খই ফুটতে শুরু করেছে। কথায় সেই জড়তাও নেই।
কিন্তু ওপক্ষও ছাড়বার পাত্র নয়। খানিক গুম হয়ে থেকে ফস করে একটা হাত বাড়িয়ে
দিল জানলার বাইরে। দেখতে দেখতে হাতটা বিশাল লম্বা হয়ে পৌঁছে গেল দূরে এক নারকেল
গাছের ডগায়। নিমেষে একটা নেয়াপাতি ডাব ছিড়ে ভ্যাবলার সামনে ফেলে দিয়ে বলল, ‘কীঁ বুঁঝলে এঁবার?’
‘বুঝলুম গো দাদা।
তুমি সন্তোষকুমারের থেকেও ঢের ভাল। তা কাজের ফাঁকে এমন ম্যাজিক আবার দু'একটা দেখিও। বেশ মজা।’
‘নাহ!’ দারুণ
হতাশায় লোকটা এবার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। অদূরে ভ্যাবলার দিকে করুণ চোখে
তাকিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে বকতে লাগল, ‘এ যে গেরো হয়ে
গেল দেখছি! বাগানে পাঁচ পুরুষের বাস আমাদের। মানুষ তো ছার, ভুল
করে একটা কাকপক্ষী ঢুকে পড়লে পালাতে পথ পায়নি। আর এতক্ষণেও ছোঁড়ার মগজে ঢুকল
না কিছু!’
‘বিড়বিড় করে কী
বকছ গো দাদা?’ আগ্রহে জানতে চাইল ভ্যাবলা।
‘বলছি, তোমার মতো এমন গোবর ভরা মগজ আর দুটি দেখিনি বাপু!’
‘বিলকুল ঠিক কথা গো
দাদা। একগাল হেসে ভ্যাবলা বলল, ‘সেই জন্যই তো সবাই নাম
দিয়েছে ভ্যাবলা। মাথায় সহজে ঢুকতে চায় না কিছু। দ্যাখো না, সেদিন বকেশদার কথায় কী হেনস্তাই না হতে হল।’
‘অ!’ এই এতক্ষণে লোকটার
চোখদুটো সামান্য চকচক করে উঠল। ‘তাও ভাল বাপু। নইলে যা খেল
দেখাচ্ছিলে, সমাজে আর মুখ দেখাবার জো ছিল না।’
‘কী‚ কী বললে গো দাদা? কিছু বুঝতে
পারলুম না।’
‘এখন বুঝে আর কাজ
নেই। দিন কয়েক সবুর করো। শিখিয়ে পড়িয়ে মাথার গোবরটা একটু সাফ করে দিই। নিজেই
বুঝতে পারবে তখন। এখন বরং ডাবটা কেটে নিয়ে আসি।
‘ভাল বলেছ গো দাদা।
সত্যি কথা বলি, তোমায় সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলে ভিতরে যেন বলও
পাচ্ছি একটু। তা দাদা ডাবটা কেটে দিয়ে চট করে একটু বাজারের দিকে যাও দেখি। কদিন
চিঁড়ে চিবিয়ে মুখে চড়া পড়ে গেছে। আজ রাতে বেশ করে একটু কচি পাঁঠার মাংস রাঁধো।’
দিন কয়েক কেটে গেছে এরপর।
নতুন বাড়িতে বেশ ভালই আছে ভ্যাবলা। দিনভর সঙ্গী বলতে সর্বক্ষণের সেই কাজের মানুষ।
আগে সারাদিন ঘরে গুম হয়ে কাটত। এখন নানা কথায় দিব্যি সময় চলে যায়। লোকটার
হাতের রান্নারও জবাব নেই। সেই প্রথম দিন শুধু পাঁঠার মাংসই নয়, সঙ্গে চিতল মাছের
পেটির ব্যবস্থাও করে ফেলেছিল। খেয়ে মন মজে গেছে ভ্যাবলার। চলছে নিত্য নতুন ফরমাশ।
দুপুরে কী রান্না হবে তাই নিয়ে সেদিন কথা হচ্ছিল দু’জনে।
হঠাৎ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন বড়কর্তা গজেন চৌধুরী। দু’বেলা
ভালমন্দ খেয়ে ভ্যাবলার চেহারায় ইতিমধ্যে জেল্লা ফিরে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে ঢোঁক
গিলে বললেন, ‘এই যে বাবাজীবন, বেঁচে…, থুড়ি কেমন আছ তাই দেখতে এলুম।’
ভ্যাবলা ততক্ষণে আড় চোখে
দেখে নিয়েছে ঘরের অন্য ব্যক্তিটি ইতিমধ্যে হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গেছে বাতাসে। হেসে
বলল, থুড়ি
বলার দরকার নেই জ্যাঠা। শুধু বেঁচে নয়, দিব্যি ভালই আছি।
জয়জয়কার হোক আপনার।’
‘ভ্যাবলার মুখে এমন
চটজলদি উত্তর মিলবে ভাবতেই পারেননি গজেন চৌধুরী। হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন শুধু। তাই
দেখে ভ্যাবলা বলল, ‘ভাল কথা জ্যাঠা, ওবাড়ির
দলিলপত্তরে টিপছাপ তো সেদিনই সেরে নিয়েছেন। তা এবাড়ির দলিলটা কিন্তু পাইনি এখনও।
সঙ্গে কথামতো নগদ টাকাটাও পাঠিয়ে দেবেন। মনে থাকে যেন।’
বলা বাহুল্য, গজেন চৌধুরী এরপর
আর কথা বাড়ায়নি। কোনওমতে ঘাড় নেড়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। গজেন চৌধুরী বিদায় নিতেই
ভ্যাবলা দেখল ঘরের অন্য ব্যক্তিটি যথাস্থানে হাজির হয়ে গেছে। আবার। বলল, ‘হঠাৎ যে ভ্যানিশ হয়ে গেলে দাদা!’
‘না হয়ে উপায় আছে?’
প্রায় খ্যাঁক করে উঠল
ওপক্ষ। গজেন উকিলের মাথায় তো আর গোবর ভরা নেই। ভ্যানিশ না হলে এত কথা বলার সুযোগ
পেতে? তা তোমারও তো দেখছি মাথার গোবর অনেকটাই সাফ হয়ে গেছে গো! বেশ তো কথা
কইলে! কিন্তু দলিলটলিলের কথা কী বলছিলে?’ সন্দেহে দুলে উঠল লোকটার
চোখ দুটো।
‘হেঁ-হেঁ।’ ধরা
পড়ে কাষ্ঠ হাসল ভ্যাবলা। সেজন্য ভেব না। বাগানেই বাস যখন, ওদিকটা
ছেড়েই দেব তোমাদের। যা খুশি করো, দেখতেও যাব না। বদলে আমার
এদিকটা কিন্তু তোমাকেই সামলাতে হবে ভূত, থুড়ি ভুতোদা। হাজার
হোক এমন একটা কাজের মানুষ কোথায় আর পাই বলো?
ছবি (হেডপিস):
নির্মলেন্দু মণ্ডল (সৌজন্য: আনন্দমেলা)
অন্য ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
আপলোড: ৪/৮/২০১৬
ইশ্! আমিও যদি এমন একজন "কাজের মানুষ" পেতাম !
ReplyDeleteWonderful!!
ReplyDeleteDarun darun! Eirakom ekjon upokari bhut pele ar dekhte hoto na!
ReplyDeleteEta ageo ekbar porechhi anandamelate, abaro pore valo laglo. Anabil anander golpo. Khub valo lekha.
ReplyDeleteKHUB VALO LAHGLO
ReplyDeleteValo laglo sir
ReplyDeleteHahaha ... ���� Bhablar aakkelodyoy
ReplyDeleteDarun moja pelam :)
ReplyDeleteতাহলে সঙ্গ দোষে ভুত হয়ে গেল ভ্যাবলার মতো আরো একটা ভ্যাবলা । তবে আর একটা বলি কি করে ভ্যাবলা নিজেই এখন আর ভ্যাবলা নেই । এর পড়ে ভ্যাবলা ওই উকিল কে ভুতো দাদা কে দিয়ে যা নাচ দেখাবে সেটা আপনি না লিখলেও আমি ধরেই নিচ্ছি ।
ReplyDeletekhub bhalo laglo.
ReplyDeleteDarun
ReplyDeleteখুব সুন্দর লেখা, খুব ভালো লাগলো পড়ে
ReplyDeleteখুব ভালো
ReplyDeleteAwesome
ReplyDeleteএ যে তেনাদের কমেডি-মার্কা গপ্পো! এর একটা sequel হলে মন্দ হয়না।
ReplyDeleteDarun
ReplyDeleteদারুন !!!
ReplyDeleteভারী মজার গল্প
ReplyDelete